বত্রিশ পাটি দাঁত – সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
চোদ্দো বছরের পুরোনো দম্পতি শুয়ে আছে চোদ্দো বছরের পুরোনো খাটে, চোদ্দো বছরের পুরোনো বিছানায়, ঢাউস একটা লেপ গায়ে দিয়ে। লেপের অন্তঃকরণটি প্রাচীন, বাইরের খোলাটি নবীন, মার্কিন। খুব কম পাওয়ারের নীল একটা আলো পায়ের দিকে দেয়ালের গায়ে জ্বলছে। ক্রিম রঙের দেয়ালের গা বেয়ে সবুজ ধারায় গড়িয়ে এসে একটা ফোটোর কিনারায় আটকে গেছে। তলার দিকে গভীর একটা ছায়া! ছায়া ফেলেছে ওই নিদ্রিত দম্পতি। রাগ রাগ মুখ করে ডান পাশে বিকাশ, বাঁ-পাশে অল্প একটু ঘোমটা টেনে আরতি। আরতির মুখে ঠিক হাসি নয়, হাসির ওয়ারে চাপা বিজয়িনীর মুখ। ফোটোগ্রাফার, বিকাশের বুকের একপাশে আরতির কাঁধটা লেপটে দিয়ে অন্তত ওই ছবিটা যতদিন না ধূসর হয় ততদিন এই প্রমাণ রেখে গেছেন—তোমরা দুজনে দুজনের কাছের মানুষ।
কাছাকাছি, পাশাপাশি থেকে লেপটা-লেপটি করে সংসার করো। কমলি যখন পাকড়েছে মিঞা, সহজে নেহি ছাড়েগা। দরকোচা মারা, ফোড়ার গায়ে তোকমারির পুলটিনের মতো আটকে থাকবে। সম্পর্ক যত শুকোচ্ছে তত আঁটোসাটো হবে। ছবিটা বছর সাতেক আগের যে রাতে, যে মেজাজে তোলা তাতে ছবির ফ্রেমে একজন থাকলে আর একজনের থাকা উচিত ছিল না। থাকলেও দুজনে দু-পিঠে থাকলে উচিত বিচার হত। ছবি তোলা নিয়েই সন্ধের ঝগড়া রাত আটটা নাগাদ কাপডিশ ছোড়াছুড়ির পর্যায়ে এসে যখন আরও বড় কিছুর দিকে ঝুঁকছিল, ঠিক তখনই ফ্যামিলি ফ্রেন্ড সমরেশের আগমন। সমরেশ দু-পক্ষকে সংযত করে বিকাশকে ফ্রয়েড শেখাল।
ফ্রয়েড সাহেবের কায়দা। দীর্ঘ দাম্পত্যজীবনে স্ত্রীর সঙ্গে তাঁর একদিনই একটু খিটিমিটি হয়েছিল অতি সামান্য একটা ব্যাপার নিয়ে মুরগির মাংস। তারপর সেই রণক্ষেত্রে সমরেশ নিজের উদাহরণ হাজির করেছিল। সে নাকি প্রতি সপ্তাহের গোটা রবিবারটাই বউয়ের পায়ে জবাফুলের মতো উৎসর্গ করে দিয়েছে। ছোট এক-কামরার ফ্ল্যাটে দুজনে মুখোমুখি বসে থাকে। আদর-টাদর করে। পাকা চুল তুলে দিয়ে সাহায্য করে। উকো দিয়ে গোড়ালি মেজে দেয়। পেটিকোটের দড়ি পরিয়ে দেয়। কখনও গড়ের মাঠে হাওয়া খাওয়াতে নিয়ে যায়। টানা ট্যাক্সিতে লেকে নিয়ে গিয়ে ঝালমুড়ি খাওয়ায়। পিঠের মাশরুম স্পঞ্জ দিয়ে সাফ করে দেয়। সামান্য একটি ছবি নিয়ে দক্ষযজ্ঞ! মিটসেফ থেকে নতুন কাপডিশ বের করে তিনজনে চা-চানাচুর খেয়ে রাত ন’টা নাগাদ আই ভি স্টুডিয়োতে গিয়ে বিকাশ বউ নিয়ে ফ্লাশলাইটের সামনে বসেছিল। ফোটোগ্রাফার কানু পকেট থেকে চিরুনি বের করে দিয়েছিল। দুজনের সেই মুহূর্তে সাগর প্রমাণ মানসিক ব্যবধান থাকলেও দৈহিক ব্যবধান কমতে কমতে রুটির বুকে কৃপণের মাখন করে দিয়েছিল। একটুও হাসি হাসি মুখ হয়নি। দেরিতে আসা কেরানির দিকে অফিসের বড়বাবুর তাকানো মুখের মতো হয়ে গিয়েছিল।
সেই মাল দুটি এখন লেপের তলায়। মশারির বাইরে মেঝের ওপর পৌষের শীত হামা দিচ্ছে। বন্ধ জানলার বাইরে শীত হি-হি শব্দ করছে। বিকাশ এমনিই একটু ঘুমকাতুরে, তার ওপর শীত। তার ওপর লেপটা সারাদিন ছাদে রোদ খেয়ে আরতির প্রথম যৌবনের মতো মোলায়েম গরম হয়েছে, তার ওপর নতুন ওয়াড় পড়েছে। আগের রাত পর্যন্ত যে ওয়াড় ছিল তাতে সারারাতে। পালা করে হয় স্বামী না হয় স্ত্রী হারিয়ে যেত! দরকারের সময় গলা শুনতে পেলেও কেউ কাউকে খুঁজে পেত না। বেশ ঘুলঘুলি সাইজের গোটা কতক ফর্দাফাঁই ছেঁড়া। সেই গবাক্ষ দিয়ে ঘুমের ঘোরে হয় বিকাশ না হয় বউ লেপের খোলের গভীর জগতে সেঁদিয়ে বসে থাকত। কখনও সখনও খোলের মধ্যে দুজনের দেখা হয়ে যেত। সেটা অবশ্য বাই চান্স। বেশির ভাগ একপক্ষ। বাইরে, একপক্ষ ভেতরে। কয়েক রাত আগে আরতি গিয়েছিল লেপের উদাম লাল টকটকে বুকে উষ্ণতা খুঁজতে। তারপরে দুঃস্বপ্ন দেখেই হোক কি লেপ আর ওয়াড়ের যৌথ আদরে দম আটকে গিয়ে হোক, গোঁ গোঁ শব্দ করে বিকাশের ঘুম চটকে দিয়েছিল। বিকাশ ফায়ার ব্রিগেডের কায়দায় একটানে ঘুলঘুলি-মুলঘুলি ফর্দাফাঁই করে গোঁ গোঁ—আরতিকে লেপের গভীরের জগৎ থেকে। উদ্ধার করে এনে ভেবেছিল—খোলের মধ্যে মানুষের ঢোকার মতো লেপ ঢোকানোটা যদি সহজ হত। মুক্ত আরতির ব্যাপারটা ছিল অন্য। আলো দেখতে না পেলে তার দম আটকে যোবা লেগে। যায়। হঠাৎ চোখ খুলে দেখি নীল আলো নেই, কেউ নেই, কেউ নেই, গোঁ গোঁ। কালই তুমি ওয়াড়ের কাপড় কিনে আনবে। কী রাক্ষুসে ওয়াড় রে বাবা, কোনদিন দেখব দুজনেই ওর মধ্যে মরে কাঠ হয়ে আছি। ভাগ্যিস তুমি বাইরে ছিলে, লর্ডল্যানসেলেট। তোমাকে উদ্ধার করার জন্য লেডি অফ দি শ্যালট। সদ্য উদ্ধারপ্রাপ্ত রাজকন্যা আরতি এরপর যা করেছিল আরও সুন্দর। ওয়াড়ের একটা ঘুলঘুলির মধ্যে দুটো পা ঢুকিয়ে দোলায় শুয়ে সেয়ানা শিশু যেভাবে খলখল করে পা ছোঁড়ে, বিছানায় আধ শোয়া হয়ে সেইভাবে পা ছুড়ে ছুড়ে লেপের খোলটাকে ছিঁড়ে কুটিকুটি করে একটা তৃপ্তির হাসি হেসে বলেছিল, শত্রুর শেষ রাখতে নেই, দাও এক গেলাস জল গড়িয়ে দাও। এতবড় একটা কাজের পর যে-কোনও স্বামীরই উচিত স্ত্রীকে এক গেলাস জল কেন, এই শীতের রাতে লেমনেড মিশিয়ে কি লাইম জুস দিয়ে জিন কলনিস ঠোঁটের ডগায় তুলে ধরা। জলের গেলাসটা ঠক করে কোণের টেবিলে রেখে আরতি আদেশের সুরে বলেছিল, কালই ছ’মিটার পুরু লংক্লথ কিনে আনবে। স্ত্রীর এঁটো গেলাস কে আর এই শীতে ধুতে যায়! সেই গেলাসেই জল ঢেলে স্ত্রীর না চুমুক দেওয়া অংশটা আন্দাজ করে জল খেতে খেতে বিকাশ বলেছিল—মাসের শেষ, তলানি গোটা দশেক টাকা পড়ে আছে, মাসটা কাবার করে ওয়াড়ের কাপড় আনা যাবে।
আহা শুধু লেপ গায়ে দেওয়া যায় নাকি, খারাপ হয়ে যাবে না!
দিনচারেকে কী আর উনিশ-বিশ হবে। খালে ঢোকালেই কি যৌবন ফিরে আসবে!
এমন লেপ পাচ্ছ কোথা, বাবা একটা সেরা জিনিস দিয়ে গেছেন। যেমন গরম, তেমনই নরম, তেমনি বিশাল। ছেলে, মেয়ে, স্বামী প্লাস একটা পাশবালিশ তোফা তলিয়ে যাবে।
আলো নিভিয়ে সে-রাতের মতো সেরা লেপের ধূসর লাল জগতে তলিয়ে যেতে যেতে বিকাশ যে কথাটা ভেবেই ছিল, সোচ্চারে বলতে পারেনি, তা হল, শ্বশুরমশাই সেরা দুটি বাঁশ তাঁর ঝাড় থেকে নামিয়ে দিয়েছিলেন, একটি লেপ আর সেই লেপের তলায় ঢোকার সঙ্গী লেপাক্ষি আরতি। লেপটা অবশ্যই বড়, আশাতীত বড়, লেপ যিনি দিয়েছিলেন তাঁর হৃদয় তাঁরই মেয়ের হৃদয়ের চেয়ে বড়। প্রথম বিয়ের হুটোপাটির তিন মাসে বিকাশ মনে মনে লেপটার প্রশংসা না করে। পারেনি। বেড়ে ফ্যামিলি সাইজ। নতুন বিছানায় ঔরাঙ্গবাদের রেশমি চাদরে দুটো পিচ্ছিল প্রাণী যখন মাছের মতো কিলবিল করত, গড়ের মাঠের মতো বিশাল লেপ তখন বিশ্বাসঘাতকতা করে বাইরের শীতলতায় কোনওদিন তাদের ফাঁস করে দেয়নি। একটি সন্তানের আগমন এবং তার বোধবুদ্ধি হবার পরও লেপ তার অন্তরালে মাঝে মাঝে একটু বেশি কাছাকাছি, একটু বেশি সাহসী হবার সুযোগ করে দিয়েছে। এখন এই মধ্যবয়েসে সংসার যখন সব নির্য্যাস নিংড়ে নিয়েছে, শরীর যখন সব বাষ্প মোচন করে বাতিল বয়লার হয়ে গেছে, তখন এ লেপ বাঁশ ছাড়া আর কী! মনে তো এখন গুনগুন গান, কম্বলবন্ত, কৌপিনমন্ত; খলু ভাগ্যবন্ত। এই লেপ রোজ সকালে তাকেই তো পাট করে ভাঁজ করে গুছিয়ে রাখতে হয়। সেই সময় নড়া ছিঁড়ে যাবার উপক্রম। ঘাড়ে করে ছাদে রোদ খাওয়াতে তোলার সময় মালুম হয় সংসারের ভার, একটি স্ত্রীলোককে বহনের ভার। গ্রীষ্মে সিলিং থেকে দোলানো জাফরি কাঠের পাটাতনে ঝোলাতে গিয়ে টাল খেতে হয়। তারপর বৎসরান্তে শীত যখন জানলার কাচে নাক রেখে ধোঁয়াটে নিঃশ্বাস ছাড়ে তখন আবার চেয়ারের ওপর টুল রেখে শরীরের ভারসাম্য বজায় রেখে সেই লেপ নামাতে হয়। প্রথমে নামে লেপ, সঙ্গে সঙ্গে নামে ধুলো, মানে বড় মাকড়সা, নেংটি ইঁদুর, তেলাপোকা।
নতুন ওয়াড়ের গন্ধ শুঁকতে সেই লেপের তলায় প্রথমে ঢুকছে বিকাশ। পাশে এসে কুকুরকুণ্ডলী হয়ে শুয়েছে আরতি। সারা বছর একটাই তার শোওয়ার ধরন। বিকাশ চিরকালই বুকে হাত দুটো ভাঁজ করে রেখে চিত হয়ে শোয়। জাগ্রত অবস্থায় ঠোঁট দুটো বোজানো থাকে। ঘুমোলে শরীর যেই আলগা হয়, নীচের ঠোঁটটা বাজে কাঠের জানলার মতো অল্প একটু বেকে ফাঁক-দাঁত হয়ে যায়। তারপর যতই সে ঘুমের ঘোরে পায়ে পায়ে এগিয়ে যেতে থাকে ততই সেই ছুঁচো ফাঁক মুখ দিয়ে শিসের মতো এক ধরনের হিস-হিস শব্দ বেরোতে থাকে। দুজনের এই দু-ধরনের শোয়া নিয়ে মাঝে দিনকতক দুজনের মধ্যে দক্ষযজ্ঞ হয়েছে। আরতির ঘুম পাতলা। ভাঙা বাটির ফাটলে হাওয়ার শব্দের মতো বিকাশের ঘুমন্ত সাইরেনে ঘুমোতে না পেরে আরতি বিকাশকে ঠ্যালা মেরে জাগিয়ে দিয়ে প্রথম প্রথম অনুরোধ করেছে—পাশ ফিরে শোও। অনুরোধ যখন বিফল হয়েছে তখন বালিশ নিয়ে মেঝেতে নেমে শোবার ভয় দেখিয়েছে। অবশ্য নেমে শোয়নি কখনও। মেঝেতে বড় রিপু ভয়—ইঁদুর, আরশোলা, বিছে। বিকাশ আবার ‘দ’ হয়ে শোয়া পছন্দ করে না। এইভাবে যারা শোয় তাদের চরিত্র ভয়প্রবণ। মনে মনে তারা অসহায়, অবলম্বন খুঁজছে। অবলম্বন হিসেবে বিকাশ তো পাশেই রয়েছে, তবে কেন ‘দ’ হয়ে শোয়া? তার মানে বিকাশের। ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল নয় সে। তা ছাড়া শরীরের পক্ষে ক্ষতিকর। সোজা হয়ে শোও। আরতি আদেশ মান্য করার চেষ্টা করেছে। চিত হয়ে শুয়েছে। তারপর ঘুমের ঘোরে পাশ ফিরে শুয়ে আবার যে কে সেই। ঘুমন্ত আরতির দুটো পা টেনে সোজা করতে গিয়ে বিকাশ অবাক হয়ে গেছে —দারা সিং-এর কাঁকড়া প্যাঁচ। টেনে খোলা যায় না। হিস্টিরিয়া রোগীও দাঁতি লাগা চোয়ালে। অবশেষে দুজনেই দুজনকে মেনে নিয়েছে। জাগরণের ইস্টিশান না পৌঁছোনো পর্যন্ত বিকাশের ইঞ্জিন স্টিম ছাড়বে। কটাস করে আরতির পায়ের খিল খুলবে না।
দূরে রাস্তার বাঁকে শীতের রাতের কুকুর ঝাপসা কুয়াশার ভূত দেখে কাঁদছে। দেয়াল ঘড়ির পেন্ডুলাম ঘরের বাইরের প্যাসেজে হাইহিল জুতো পরে পায়চারি করছে। বিকাশের মুখ দিয়ে হাওয়া শিসের শব্দে অক্সিজেন কার্বন ডাই অক্সাইড আদান-প্রদান করছে। আরতি হাঁটু দিয়ে। নিজের হজম যন্ত্র চেপে বদহজমের সাধনা করছে। কোথাও কোনও গোলমাল নেই। ছেলে আর মেয়ে আলাদা ঘরে বেহুশ। খাবার ঘরের মিটসেফে ইঁদুর পাঁপড় চিবোচ্ছে। বাথরুমের কলে। টিনের বালতিতে ফোঁটা ফোঁটা জল পড়ছে। একতলা থেকে দোতলায় ওঠার সিঁড়ির উত্তরের জানলার ভাঙা কাচ দিয়ে অন্ধকারের সঙ্গে আলো আর সাদা কুয়াশার মিশেল তৈরি হচ্ছে।
বিকাশের ঘুমটা হঠাৎ ভেঙে গেল। এক ঘুমে রাত কাবার করার মতো পরিশ্রম সে এখনও করে। কোথায় যেন একটা বেড়াল ডাকছে ম্যাও, ম্যাও করে। না, পাশাপাশি কোনও বাড়িতে নবজাতক শীতে ওঁয়া ওঁয়া করছে। না, দূরে নয়তো! ঘরে ঘরে বেড়াল! ঢুকল কী করে? জানলা-দরজা সবই তো বন্ধ! মনে হচ্ছে বিছানায়! লেপের তলায়! কে রে! বিকাশ কান খাড়া করে শুনল। তার ডান পাশে লেপের মাথাটা জড়িয়ে গোল আর সেই গোল বস্তুটির তলা থেকে শব্দটা আসছে—ঊরে বাবারে! ঊরে ঊরে ঊ উ। বিকাশ গোটানো লেপটাকে আরতির মাথার তলা থেকে টেনে সোজা করল। লেপের সঙ্গে কিছু উসকো চুল লেপের বাইরে বেরিয়ে এল।
বিকাশ এইবার লেপটা উলটে আরতির মুখটা বের করল। শব্দটা বেশস্পষ্ট আর সুরেলা হল— ঊরে, ঊরে। দু-হাত দিয়ে গাল চেপে ধরে ‘দ’-আরতি আর্তনাদ করছে। বিকাশ হাত দিয়ে বস্তুটিকে সোজা করল। নীল আলোয় মুখের যন্ত্রণা স্পষ্ট, চোখে জল। কী হল কী? অ্যাাঁ, কী হল? বলবে তো কী হল?
দাঁত, উরে বাবারে দাঁত।
দাঁত আবার কী হল?
ভীষণ যন্ত্রণা।
পাশ ফিরে শোও। কিছুক্ষণ দমবন্ধ করে রাখো, কমে যাবে। মাঝরাতে দাঁতের যন্ত্রণায় এর চেয়ে ভালো দাওয়াই বিকাশের জানা ছিল না।
পাশ ফিরে শুলে কী হবে গোঁ! কী গোঁ গোঁ করছ তখন থেকে। ভূতে ধরল নাকি! বিকাশ বিরক্তিটা ঠিক চেপে রাখতে পারল না। বেশ নরম গরম বিছানায় দিব্যি ঘুম দিচ্ছিল, কোনও ভালো স্বপ্নও হয়তো দেখছিল। আরতির আবার রাগ আর অভিমান দুটোই বেশি, প্রকাশ চোখের জলে। অস্বাভাবিক মুখের ধরনে। বেশ তোলো হাঁড়ির মতো মুখ হলেই বুঝতে পারে বিকাশ খেপী খেপেছে। ছেলেবেলায় আরতির আদুরে ডাকনাম ছিল খেপী। বিয়ের পর বিকাশ অন্যান্য লুক্কায়িত তথ্যের সঙ্গে এটা জেনেছে। বিকাশের খোঁচা খেয়ে, আরতি ঘুরে বিকাশের দিকে পিছন ফিরে শুলো। চোখে দাঁতের যন্ত্রণায় জলের সঙ্গে অভিমানের ডোজ যুক্ত হল। বিকাশ বুঝতে পারে না বিপদে পড়েও মানুষ কী করে রাগতে পারে! বিপদের প্ল্যাটফর্ম হল বন্ধুত্বের, সমর্পণের, হাত মেলাবার। বিকাশ বালিশে আধশোয়া হয়ে বললে, একেই তুমি রাগপ্রধান, এখন দাঁতের ব্যথায় একেবারে কালোয়াতি। যখন সাবধান করেছিলুম তখন শোনোনি কেন? এখন মরো। লেপের ভিতর থেকে উত্তর এল, কী সাবধান করেছিলে? উঁহুহু। সরি।
প্রথম হল চিনি চায়ে সাধারণ মানুষ ক’চামচ চিনি খায়? ম্যাক্সিমাম দু-চামচ। তুমি! তিনে গিয়েও তোমার থামতে আপত্তি, চার হলেই ভালো হয়। ভাবছ আমাকে বাঁশ দিচ্ছ, আজ্ঞে না, নিজেকেই নিজে দিচ্ছ বাঁশ। আমার কী হবে? কাঁচকলা! খাও না মাসে বিশ কিলো চিনি খাও। যতদিন। চাকরি আছে দিয়ে যাব, সেভিংস নিল! চোখ বুজলেই হাতে হ্যারিকেন! চিনি, চকোলেট, রসগোল্লা, সন্দেশদাঁতের যম। এখন সামলাও ঠ্যালা।।
বিকাশদম নেবার জন্যে থামল। যদিও ভীষণ যন্ত্রণা তবু আরতি চিনির খোঁটার উত্তর না দিয়ে পারল না।
—বিশ কিলো করছ। গতমাসে ওঁরে বাবারে, রেশন ছাড়া দশ কিলো বাড়তি এসেছে, তা-ও এক কিলোমনুর মার কার্ড থেকে ম্যানেজ করেছি। উঁহুহু।
–দশ কিলো চিনির দাম জানো? দু-কিলো চায়ের দাম জানো? একটা বড় কফির দাম জানো? শালা গৌরী সেন রে? ভেবে ভেবে চুল পেকে গেল। জানার মধ্যে জানো, ড্রেস সার্কেল, ব্যালকনি, স্টল।
—ঠিক আছে, দিনে দুবার চা খেতুম, কাল থেকে তাও খাব না। পারি নিজে রোজগার করে খাব।
—মাসে পকেট মেরে রোজগার তো কম হয় না!
—শেষে মাসে তো সবই হাতিয়ে নাও। চিনি, চিনি, চিনি, নিজে তো দিনে বারদশেক চায়েতে কফিতে খাও। তাও একে রামে রক্ষে নেই দোসর লক্ষ্মণ। বন্ধুবান্ধবের তো অভাব নেই। তারপর রোজ চাটনি।
—চাটনির জন্যে বড়বাজার থেকে ভেলি এনে দিই পাঁচ কিলো, চাটনিতে চিনি ঢোকাচ্ছ কি? আর নিজের বন্ধুদের কথা ভুলছ কী করে? রামের মা, রমাদি, ভুলো, কল্যাণী, বাপের বাড়ি। তারা ন’মাসে-ছ’মাসে আসে, এর উপর চুরি আছে।
—চুরি! বিকাশ শুয়ে পড়েছিল, আবার আধশোয়া হল। চুরি-টুরি, মিথ্যে কথা, ধাপ্পাবাজি এসব সহ্য করতে পারে না। পৈতৃক গুণ। বিকাশ বললে, মনুর মা’র কাল সকালেই ডিসচার্জ। শেষ মাস। হাতে টাকা নেই। যেখানে থেকে পারি ধারধোর করে এক মাসের মাইনে নাকের ডগায় ছুড়ে দিয়ে গেট আউট, তোমার অসুবিধে হয় যতদিন না লোক পাচ্ছি নিজে বাসন মাজব।
—ঊঁরে বাবারে? পুরোটা না শুনেই উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে। মনুর মা তোমার মার আমলের লোক, সে সব থাকতে চিনি চুরি করতে যাবে কোন আককেলে? চোর তোমার ছেলে আর মেয়ে। সারাদিন মুঠো মুঠো চিনি ধ্বংস করে।
বিকাশ সোজা উঠে বসল গ্যাঁট হয়ে। বড় বড় মাথার চুল খামচে ধরে কিছুক্ষণ এমনভাবে বসে রইল যেন বজ্রাঘাত হয়েছে। মুখে ছি-ছি শব্দ। ছি-ছি ছি, ছি, তুমি তো আগে কখনো বলোনি। চোর, চুরি! এত খাচ্ছে, তবু চুরি, ইস ইস! এই নীচতার তো একটা ব্যবস্থা করতে হয়। ইমিডিয়েটলি একটা ব্যবস্থা করতে হয়। বিকাশ কোল থেকে লেপটা ফেলে দিল।
কী ব্যবস্থা তুমি করবে! এই রাত আড়াইটের সময়? ধরে ঠ্যাঙাবে?
ঠ্যাঙাঠেঙি আমার কোষ্ঠীতে নেই, বুঝলে। ওসব মধ্যযুগের জিনিস, আধুনিক কালে অচল, আমার হল অন্য টেকনিক। সাইকোলজিক্যাল ট্রিটমেন্ট। একমাস আর কিছুনা, স্রেফ চিনি খাইয়ে যাব মুঠো মুঠো কিলো কিলো।
আরতি যন্ত্রণায় আর একবার কুঁই কুঁই করে উঠে বলল—দাও না। যদি তোমার কাছে কোনও বড়ি-মড়ি থাকে।
—থাকলেও দেব না। কথায় কথায় তোমার বাড়। আট প্রহর হরিনাম সংকীর্তনের মতো, তোমার মাথা ধরা, না হয় বুক ধড়পড়, না হয় পেটে ব্যথা, এখন গোদের ওপর বিষফোঁড়া দাঁতের যন্ত্রণা! শরীর নিয়ে ইয়ারকি! গোটা গোটা সুপুরি খাবার সময়ে মনে ছিল না, কাঠ খেলেই আঙরা দাস্ত হয়।
—বাগানে এতগুলো সুপুরি গাছ, আমি না খেলে খাবেটা কে?
—গাছগুলো বেড়া দেবার পারপাসে পূর্বপুরুষেরা করেছিলেন। তোমার সুপুরি বিলাসের জন্য করা হয়নি। বেশি সুপুরি খেলে কী হয় জানা আছে? দাঁত যায়, কিডনিতে স্টোন হয়, ক্যানসার হয়। ইমপোটেন্ট হয়ে যায়।
—সে আবার কী?
—সে বোঝার ক্ষমতা থাকলে রোজ রাত্তিরে পাশে শুয়ে শুয়ে ঘণ্টাখানেক ধরে বাঘিনীর হাড় চিবোবার মতো কটাস কটাস করে আস্ত আস্ত সুপুরি চিবিয়ে নিজের বারোটা বাজাতে না। স্লেভ অব হ্যাবিটস। তোমার জন্য আমার এতটুকু করুণা নেই। তোমার বারো মাসে তেরো পার্বণ। আইবুড়ো বেলায় দাঁত মাজতে? আরতি কোনও উত্তর দিল না। দাঁত চেপে পড়ে রইল। বিকাশ মশারির একটা পাশ তুলে তেড়ে কুঁড়ে নেমে পড়ল। ভেবেছিল মেঝেতে পা দিয়েই অভ্যস্ত জায়গায় চটিজোড়া পেয়ে যাবে। পায়ের পাতা ঠান্ডা মেঝেতে ছ্যাঁক করে উঠল। কী হল? মাথা নীচু করে দেখল একপাটি জুতো উলটে আছে আর একপাটি চলে গেছে খাটের তলায়। বাঃবাঃ! লাথি মেরে জুতোটাকে খাটের তলায় পাঠিয়ে দিয়েছ? কোনও একটা সেনস অফ ডিসেনসি নেই? মরো শালা এখন হামাগুড়ি দিয়ে। দাঁতের যন্ত্রণা? বিকাশবিকৃত গলা করল, দাঁতের যন্ত্রণা তো সাত খুন মাপ।
খাটের তলাটা যেন আরও ঠান্ডা। পাশ থেকে আলো গড়িয়ে এসে যেটুকু দেখা যায়। এটা আবার কী? ও উলের গোলা? সোয়েটার হচ্ছে, না গুষ্টির পিণ্ডি হচ্ছে? জুতো উদ্ধার করে বিকাশ ফিরে এল। চটি পায়ে দিয়ে ফটাস ফটাস করে খানিক ঘরময় ঘুরল। তোমার আর কী? কাল সকালে ছ’টার মধ্যে বেরোতে হবে, কে এক শালা আসছে এয়ারপোর্টে। এদিকে সারারাত ঘুম নেই।
—তুমি ঘুমোও না! আমার জন্যে তোমায় জাগতে হবে না। আমার জন্যে যম জাগবে।
—তুমি যমের অরুচি। চোদ্দো বছর দেখছি তো? এইটুকুতেই কাতর। মনে আছে সেবার? ভীষণ ব্যাপার, ভীষণ ব্যাপার, চালাও স্পেশালিস্ট। বত্রিশ টাকা চোট? কী ব্যাপার! না একটু কোলাইটিস মতো হয়েছে। দাও জোলাপ, অল ক্লিয়ার। তোমাকে জানি না, আদরের ননী!
—তুমি শুয়ে পড়োনা, আমি মরছি মরতে দাও।
–দাঁতের ব্যথায় কেউ মরে না। অন্যকে মারে। অত চিৎকার করার কী আছে! মনে আছে আমার। একবার কার্বাঙ্কাল হয়েছিল?
আরতি চুপ করে রইল।
—তার মধ্যেই তোমার সিনেমা চলছে, যাত্রা চলছে, বোনের বাড়ি চলছে। ছ-ছটা মুখ! যন্ত্রণায় মরে যাচ্ছি। মুখে টুঁ টু শব্দটি নেই। মনে মনে বলছি, কা তব কান্তা! পিসিমা এসে ড্রেস করে দিয়ে যাচ্ছেন। বিবেকানন্দ টেকনিক চালাচ্ছি। ব্যথার জায়গা থেকে মনটা উইথড্র করার চেষ্টা করছি।
আরতি চুপ করে থাকতে পারল না।না, তোমার জন্যে তো আমি কিছুই করি না, সব করেন তোমার পিসিমা।
—যাক, তোমার সঙ্গে আমি মাঝরাতে তর্ক করতে চাই না। তুমি করেছ, কি করোনি সে বিচার ওপরে গিয়ে হবে। এখন তোমার জন্যে আমাকে কিছু করতেই হয়। বিয়ে যখন করেছি।
বিকাশ দরজা খুলে বাইরে বেরুল। দরজার ডান পাশে সুইচ বোর্ড। আগের মতো চোখ চলে না। ঠান্ডা, থইথই অন্ধকারে কোমর ভাঙা জলে যেভাবে হাঁটে সেইভাবে বিকাশ এগিয়ে আলোর। সুইচ টিপল। খিরকি খিড়িংশব্দ করে বসার জায়গায় মাথার ওপর ফ্লুরোসেন্ট বাতি জ্বলে উঠল। মাঝরাতে আলোর যেন চোখ ফোটে। চারিদিক ঝলসে গেল। এখন! এখন আমাকে কী করতে হবে? দাঁত দিয়ে নীচের ঠোঁটটা চেপে ধরে বসার জায়গায় সোফাটোফার দিকে বিকাশ এমনভাবে তাকিয়ে রইল যেন অশরীরী কোনও ডেন্টিস্ট সেখানে বসে আছে। বিকাশের গায়ে শ্যান্ডো গেঞ্জি। গরম বিছানা লেপের তলা থেকে হঠাৎ বেরিয়ে বেশশীত করছে। এই গরম ঠান্ডায় হঠাৎ জ্বর হয়ে গেলে বেশ কিছু টাকার ধাক্কা। সোফার ওপর দলা পাকানো আরতির চাদর। শোবার আগে গা থেকে খুলে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে। চাদরটা তুলে বার দুয়েক ঝেড়ে বিকাশ চাদরটা গায়ে ছড়াল। উ, হিঙের গন্ধ বেরোচ্ছে। ভদ্রমহিলার কী যে অভ্যেস! পরদা, চাদর, বিছানার উদবৃত্ত বেড কভারের অংশ, বালিশের ঝালর, শাড়ির পশ্চাদ্দেশে সুযোগ পেলেই খুচুং করে হাত মুছে দেবে। কড়াইশুটি হিং দিয়ে আলুর দম খাওয়া হয়েছে রাতে। হাত ধোবার পর স্মৃতিটুকু রেখে গেছে চাদরে।
না, একটু ভাবা দরকার। বারণ করা সত্বেও চামচে চামচে চিনি আর কটমটর সুপুরি খাওয়া! ঠিক সাজাই হয়েছে! মরুক যন্ত্রণায়! কিন্তু সারারাত ঘুমোতে দেবে না যে? অনবরত উঁ আঁ করবে। যখন হাঁচি হয় তখন ননস্টপ পঞ্চাশটার কমে থামে না। ডেঙ্গুজ্বর হলে চিৎকারে লোক জড়ো করে ফেলে। এর উপর একাদশী অমাবস্যায় পায়ের গোছে বাতে-কামড় আছে। তুমি আর কী বুঝবে বলো। গদামগুম থেকে থেকে খাটে পা ছুড়বে—ওপর একটু দাঁড়াবে গো? দাঁড়ালে পায়ের কিছু থাকবে? পাঁকাটির মতো ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। গদামগুম কী হচ্ছে কী? ওঃ চিবোচ্ছে। অগত্যা। দাও একটু হাত দিয়ে টিপে দাও! চোদ্দো বছরের পুরোনো বউ মাতৃসমা? ভুজঙ্গ ডাক্তারের কম্পাউন্ডারকে ধরে ইনঞ্জাকশান দেওয়াটা শিখতেই হবে দেখছি। তারপর। গোটকতক মরফিয়ার অ্যাম্পুল জোগাড় করে রাখতে হবে। বিয়ের ছ’মাস বড়জোড় এক বছর পর্যন্ত বউয়ের ভিরকুটি সহ্য করা যয়, মন্দ লাগে না। তারপর যতক্ষণ ঘুমোয় ততক্ষণই শান্তি। দাঁতের এখন কী করা যায়? মারো এক ঘুষি। ঝরঝর করে যে-ক’টা ঝরে যায়! চুল ঝরে টাক হয়ে গেছিল, পাতা ঝরে গাছ কঙ্কাল হয়ে গেল, বয়েস ঝরে বুড়ো মেরে গেল, মেদ ঝরে মেরুদাঁড়া। বেরিয়ে গেল, গোটা কতক দাঁত ঝরে গেলে কী হয়? ঝরলে যে গেরস্তর কল্যাণ হয়। দাঁড়াও। দিচ্ছি তোমার দাওয়াই। জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সব কিছু না জানলে সংসার করা উচিত নয়। শুধু ডাক্তারে রক্ষে নেই, থেরাপি, সার্জারি, গাইনি, ই এন টি, দারা সিং ক্যাসিয়াস ক্লে, পি সি সরকার, রকফেলার সব গলিয়ে অ্যালয় করে স্বামী ঢালাই করলে তবে যদি এ যুগে বাঁচা। যায়।
দোতলায় বিকাশের বাবা থাকেন। বিকাশের ছেলে আর মেয়ে তাঁর কাছেই শোয়। মৃতদার বৃদ্ধ একটু সঙ্গ পান। সারারাত ঘুমোতে পারেন না। যতক্ষণ নাতি, নাতনি জেগে থাকে সমানে বকর বকর করেন। যেন সমবয়সি তিন বন্ধু। বিকাশ জানে বৃদ্ধ জেগেই আছেন। মৃদু আলো দরজার তলা দিয়ে একটু আভার মতো লাল মেঝের ওপর ঠিকরে এসেছে। দরজা ভেজানেনা। ভেতর। থেকে ছিটিকানি টানা নেই। বারে বারে বাথরুমে যেতে হয়! শীতকালে একটু বেশিই। বিকাশ দরজা খুলতেই মশারির ভেতর থেকে আপাদমস্তক লেপ মুড়ি একটি বসা মূর্তি প্রশ্ন করলেন, কী চাই? সঙ্গে সঙ্গে বললেন, সব ঠিক আছে। ভেবেছেন ছেলে-মেয়ের খবর নিতে এসেছে। বিকাশ মশারির কাছাকাছি আসতেই লেপের ওপর দিকে একটি দাঁড়ি-গোঁফওয়ালা মুখ বেরোল। সুদূর অতীত থেকে বৃদ্ধ নিজেকে বর্তমানে ফিরিয়ে আনন্দে মাথার ওপর লেপ টেনে চারিদিকে বেশ একটা গরম অন্ধকার তৈরি করে অনিদ্রার রুগি সারারাত অতীতের মানুষদের কাছে টেনে আনেন। সেই কলেজের দিন। কেমিস্ট্রির প্রফেসার। ফিজিক্সের প্রফেসার দে। হাওড়ার ভাসমান সেতু। ইডেন গার্ডেনের গোরা ব্যান্ড। শিবদাস ভাদুড়ির ফুটবল। আমার দিন তো চলে যায় মা, চলে যায় মা।
কথা না বাড়িয়ে বিকাশ কাজের কথাটা পেড়ে ফেলল—আপনার কার্বোলিক অ্যাসিডের শিশিটা একবার দেবেন?
দাঁত কনকন করে? তোমার?
আজ্ঞে না, আপনার বউমার।
আরতির হাঁটুর ওপর আয়না, পাশে একটা বড় দইয়ের ভাঁড়। অ্যাসিডে তুলো ভিজিয়ে তুলো জড়ানো কাঠিটা বিকাশ সাবধানে আরতির হাতে দিয়ে বলল, কুমিরের মতো একখানি হাঁ করে যে দাঁতের গোড়ায় যন্ত্রণা হচ্ছে, সেই গোড়ায় টুকটুক করে দুবার ঠেকিয়ে দাও। সাবধান, জিভে বা অন্য কোথাও যেন না লাগে, পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। তারপর ওই ভাঁড়ে বারে বারে থুতু ফেলো।
প্রথমে আরতি বেশ বড় করে হাঁ করল। দেখার মতো হাঁ, অনেকটা তাড়কা রাক্ষসীর মতো। হাতে ধরা তুলো জড়ানো কাঠিটা মুখের সামনে নিয়েও এল। বিকাশ ফিলম ডিরেক্টারের মতো নির্দেশ দিল, ঠিক হ্যায় ঠিক হ্যায়, লাগাও লাগাও। হাঁ বন্ধ হয়ে গেল। আমার ভয় করছে।
—ভয়ের কী আছে? বাবা দিনে বার সাতেক করে দেন! যে রোগের যে দাওয়াই। পুড়িয়ে না দিলে কমবে না।
—না বাবা দরকার নেই, তুমি অন্য কিছু দাও। —অন্য কিছু দাও! বিকাশ ভেংচি কাটল। অন্য কিছু কী দেব! যেমন কুকুর তেমন মুগুর! তুমি হাঁ করো আমি বরং একদা এক বাঘের গলায় হাড় ফুটিয়াছিল কায়দায় লাগিয়ে দি।
—তা কখনও হয় নাকি। বত্রিশটা দাঁতের কোন দাঁতটায় হচ্ছে তুমি বুঝবে কী করে? নিজের চুলকানি অপরকে দিয়ে চুলকানো। ঠিক হয়? হচ্ছে ওপর পাটির কশের দাঁতে।
—তাহলে এক কাজ করি, ডিশে খানিকটা গ্লিসারিন ঢেলে আনি। মধুর মতো আগে খানিকটা চেটে নাও। জিভে একটা কোটিং পড়ে যাবে। অ্যাসিড লাগলেও পুড়বে না।
—কী যে তোমার অদ্ভুত পরামর্শ! মরছি আমি দাঁতের জ্বালায়, তার ওপর গ্লিসারিন চেটে পেট খারাপ হয়ে মরি আর কী!
—তোমার মতো ভীতু মেয়েমানুষের সংসার করা উচিত হয়নি বুঝলে। ভালো ভালো পুষ্টিকর ওষুধে গ্লিসারিন থাকে জানো। বিয়ারে এই গ্লিসারিন থাকে। বোতল খেয়ে সব ইয়া হুঁড়ি। বাগাচ্ছে।
—কী দরকার বাবা অত অশান্তিতে। তোমার একটা বড়ি দাও না। কোনওরকমে রাতটা কাটাই। তারপর দেখা যাবে কাল সকালে।
বড়ি থাকলে তো দেব। সবসময় কি স্টকে থাকে নাকি? এ কি আলু-পেঁয়াজ চাল-ডাল! অ্যাসিডই এ রোগের একমাত্র দাওয়াই। না পোড়ালে তোমার ঘুমের বারোটা আমারও ঘুমের বারোটা। আরতি আবার হাঁ করে লেপটা মাথা থেকে ঘাড়ের ওপর নেমে এল। একটা হাতও বেরোল। হাতটা তুলে দক্ষিণ-পশ্চিম কোণের টেবিলের দিকে প্রসারিত করে বলল, সোজা চলে যাও, ড্রয়ারটা খোলো, একটা সাদা চাবি পাবে। বিকাশ নির্দেশ পালনের জন্যে এগিয়ে গেল। প্রথমে বাঁ দিকের ড্রয়ারটা খুলল। খুলতেই একগাদা গোল করা ফুলো শিরিষ কাগজ মেঝেতে পড়ে গেল।
উঁহু, উঁহু, ওটা নয়, ও ড্রয়ারটা নয়, ডান দিকেরটা খোলো।
বিকাশ নীচু হয়ে শিরিষ কাগজগুলো আবার গোল করে যথাস্থানে ঢোকাল। মাঝে মাঝে সারারাত বৃদ্ধ শিরিষ কাগজ দিয়ে দরজা ঘষেন। চার বছর ধরে চলেছে। ঘুমোতে যখন পারি না তখন ব্যর্থ চেষ্টা নিয়ে বিছানায় না পড়ে থেকে সংসারের খরচ বাঁচাই। চার বছরেও কাঠের গ্রেন তেমন মসৃণ হয়নি। রং লাগবে কি? লাগালেই হল? রং তো এক সেকেন্ডের ব্যাপার। ঘষাটাই আসল। আজ্ঞে কয়েক টিন রং সব শুকিয়ে যাবে কোথায়? সল্টভেন্ট দিলেই ঠিক হয়ে যাবে।
ডান দিনের ড্রয়ারে ছুরি, কাঁচি, গজাল, পেরেক, বাটালি, প্লায়ার।
—পেয়েছিস না যাব? আরে সামনেই তো আছে, একেবারে ওপরে, না পেলে বল।
এই ড্রয়ারেই আছে যখন পাব নিশ্চয়ই। আশাবাদী বিকাশ হতাশ না হয়ে হাতের আঙুল বাঁচিয়ে চাবি খুঁজতে লাগল। বাবার রাখা তো, সহজে কি পাব?
—পেলি না? কী আশ্চর্য! যে জায়গায় আছে অন্ধও খুঁজে পাবে। চোখ বুজিয়ে হাত দে তো। বিকাশ গুনগুন করে গান গাওয়ার সুরে বললে, পাচ্ছি না তো, পাচ্ছি না, গেল কোথায়, কোথায় গেল?
বিকাশের বাবা নেমে এলেন, সর দেখি। হাতড়ালেন কিছুক্ষণ। আশ্চর্য! গেল কোথায়? এদের জন্যে আর কিছু রাখা যায় না, গেছে। দূর করে কোথায় ফেলে দিয়েছে। এই গুচোচ্ছি, এই সব লন্ডভন্ড করে দিচ্ছে। বিকাশের ছেলে আর মেয়ের উদ্দেশ্যে চোখা, চোখা কিছু বিশেষণ প্রয়োগ করতে করতে বৃদ্ধের হঠাৎ কী খেয়াল হল, দাঁড়া দেখি। বিছানায় চলে গেলেন। মাথার বালিশ উলটে বললেন, হিয়ার ইউ আর, আই অ্যাম সরি। মশারির ভেতর থেকে চাবিটা বের করতে করতে নাতিকে আদর হল—হুনোটা। একটু আগের গালাগালিটা আদর দিয়ে পাল্লা সমান করলেন।
বিকাশকে চাবিটা দিলেন। বাক্সটা খোলা, উত্তরের দেয়ালে টুলের উপর রংচটা লোহার ক্যাশ বাক্স। খুলেছিস? —আজ্ঞে হ্যাঁ। ডানদিকের খোপের খামটা তোল। নীল ফিতে বাঁধা আর একটা চাবি পাবি। পেয়েছিস! আজ্ঞে হ্যাঁ,–নিয়ে আয়।
বিকাশ চাবি হাতে পরবর্তী নির্দেশের অপেক্ষায় রইল। উত্তরের ঘরের তালা খুলে আলমারির মাথায় আর একটা সাদা চাবি পাবে। আলমারিটা খুললেই একেবারে নীচের তাকের বাঁ-দিকে কাচের স্টপার লাগানো একটি শিশি পাবে।
আলমারির মাথায় একসার বই দাঁড় করানো। একটা দাড়ি কামাবার টাকপড়া বুরুশ, গোটাকতক ওষুধ আর সাবানের বাক্স, হরলিকসের শিশিতে চিনি, একটা দূরবিন। যাক চাবিটা পেয়েছে। শিশিটাও সহজে পেল। শোনো, জাস্ট একটু টাচ করে দেবে। জিভে যেন না লাগে, সঙ্গে সঙ্গে ফোসকা হয়ে যাবে। থুতু ফেলে দিতে বলবে। ওঃ। দাঁতের ব্যথা সাংঘাতিক ব্যথা…দন্তশূল পিত্তশূল। সব শূলের ক্যাটিগরি।
বিকাশ শিশি হাতে নেমে এল। বেশ সুন্দর শিশিটা। মেট্রো প্যাটার্নের ছিপি। প্রায় আধশিশির মতো অ্যাসিড। আরতি লেপমুড়ি দিয়ে ডানপাশে কাত হয়ে বাবা রে মা রে করছে।
—ওঠো। দাঁতের যন্ত্রণার যম এনেছি। ওঠো লাগিয়ে দি।
—কী জিনিস?
—ওঠোই না। সরু কাঠিতে একটু তুলো জড়াও।
—তুলো এনেছ?
—নীচে নেই?
—নীচে তুলো কোথায়? তুলো তো ওনার কাছে।।
—আবার যেতে হবে? বেশ মানুষকে বারে বারে বিরক্ত করা।
আরতি উঠে বসেছে। বিকাশ জোর আলোটা জ্বালা। দাঁড়াও তুলো নীচেই আছে। আমার মাথার বালিশে একটা ফুটো আছে। আঙুল ঢোকালেই তুলো আসবে।
—কী যে বলো। শিমুল তুলোয় হয় নাকি? আর ফুটো তোমাকে বড় করতে দিচ্ছে কে?
বিকাশ আবার ওপরে উঠল, একটু তুলো।
আবার সেই এক প্রক্রিয়া। ডানের ড্রয়ারে চাবি। সেই চাবি দিয়ে, উত্তরের ঘরের চাবি, আলমারির মাথা। সব্বার ওপরের তাকে একসার বইয়ের পেছনে একটা ছোট বাক্স। সেই বাক্সে তুলো।
হাতটা জিভের কাছাকাছি নিয়ে গেল। রেডি ওয়ান টুঁ থ্রি লাগাও।
—ভয় করছে। আরতি প্রায় জলভরা চোখে বিকাশের দিকে অসহায়ের মতো তাকাল।
দাঁড়াও। তবে একটা বুদ্ধি এসেছে। আমার কাছে লম্বা একটা খাম আছে প্রায় তোমার জিভের মাপে। মা কালীর মতো জিভটা বার করো, পরিয়ে দি, খানিকটা প্রোটেকশান হবে।
বিকাশ সত্যি একটা সরু লম্বা খাম নিয়ে এল। ছেলের জন্যে ছবি আঁকার তুলি কিনেছে; সেই সময় খামটা এসেছিল। ডগার দিকটা সহজে ঢুকল। আগে গেল জিহ্বামূলে। তা যাক গে।। মানুষের অবাধ্য অবোধ জিভ সাধারণত ডগা খেলিয়েই সব কিছুর স্বাদ-বিস্বাদ পেতে চায়। ডগা দিয়েই ছোবল মারতে চায়। সেইটাকেই যখন খাপে পোরা গেছে, আর ভাবনা কী! নাও লাগাও। টুকটুক করে বারকতক ঠেকিয়ে দাও। ওঁ শান্তি।
আরতি যতটা ভীষণ কাণ্ড ভেবেছিল, ততটা হল না। খুব খানিকটা লালা বেরোল। সারা মুখে অদ্ভুত একটা লাইফবয় লাইফবয় গন্ধ। সেই চিড়িক ধরানো মাথা ঝনঝন করা অদ্ভুত মিনমিনে ব্যথাটা সত্যিই যেন একটু কমে গেল।
ঘরে আবার নীল আলো জ্বলে উঠল।
পুবের জানলায় কাচের মাথায় শুকতারা দেখা দিয়েছে। ঘূর্ণায়মান মঞ্চের মতো রাত একটু করে দিনের দিকে ঘুরে চলেছে। একটু পরেই আলমবাজারের চটকলের গম্ভীর ভোঁ বেজে উঠবে। পাশের চায়ের দোকানে কেটলি, চামচে নাড়ার শব্দ উঠবে। সামনের রাস্তায় মানসবাবুর ব্রংকাইটিসের ভীষণ কাশি শোনা যাবে। লেপের তলায় বিকাশের পায়ে নিজের পা কাঁচি করে আরতি বললে, ভোরে আর আমায় ডেকো না, চা-টা তুমিই করে খেয়ে ফেল।
বিকাশ কোনও উত্তর দিল না, সে তখন অন্য জগতে। ফডুত ফডুত করে তার নাক ডাকছে।
অ্যালার্মের শব্দে বিকাশ ধড়মড় করে উঠে বসল। সেকেন্ড খানেকের মধ্যেই ঘুমের ঘোর কেটে গিয়ে মনে পড়ল গতরাতের ঘটনা। ভাগ্যিস অ্যালার্মটা দিয়ে রেখেছিলাম! তাই তো ঘুম ভাঙল। উনি তো পড়ে পড়ে আটটা অব্দি ঘুমোবেন। রাতে ভালো ঘুম হয়নি, দাঁতের যন্ত্রণায়। চায়ের। জলটা তুমি চাপাও প্লিজ। তিনশো পঁয়ষট্টি দিনের মধ্যে তিনশো দিনই যদি চা করে খেতে হয় তাহলে বিয়ে করেছিলাম কী কারণে! এই তো আমি বিকাশ চন্দ্র–ঝড় হোক, জল হোক, অসুখ হোক, যাই হোক অফিস তো বাবা যেতেই হয়। ফোর্টিন ডেজ ক্যাজুয়াল লিভ, চোদ্দো দিনে একদিন আর্ড লিভ। আর বাজার! শীতে একদিন অন্তর। গ্রীষ্ম-বর্ষা রোজ। আর রোজ মাছ খেতে চাইলে এভরি-ডে। তখন তো নাকি সুরে বলা যাবে না, আমি আঁজ বাঁজার যেতে পারছি না। অ্যাই ওঠো, ওঠো। সরে শুচ্ছ কী! ছটার মধ্যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়তে হবে। অফিসের। গাড়ি আসবে। আরতির সাড়াশব্দ না পেয়ে লেপের একটা কোণ ধরে জলছবির মতো ওঠাল। যাঃ তেরিকা। এটা তো সেই ম্যাগনাম বালিশটা। বাঃ, বেড়ে কায়দা! ছেলে ঠকানো কারবারে। শিশুকে স্তন্যপান করাতে করাতে একটু ঘুম এলেই মায়েরা এই ভাবে পাশে, পাশবালিশ শুইয়ে কেটে পড়ে। গেল কোথায় সাতসকালে? দাঁতের যন্ত্রণায় সুইসাইড করেনি তো! চটি গলিয়ে। লটরফট করতে করতে বিকাশ ঘরের বাইরে গেল।
দেখেছ এই শীতে শুধু একটা চাদর জড়িয়ে বাইরের সোফায় জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। সামনে খালি কাপ। চা করে একলা একলা খাওয়া হয়েছে। হায় প্রেম! এইভাবে ড্রাই হয়ে গেলে! বিকাশ সামনে গিয়ে দাঁড়াল। হাঁটুর মধ্যে মুখ গুঁজে পা দুটো গাড় করে আরতি বদনার মতো। বসে আছে! ঘাড়ের কাছে গোল খোঁপা স্লো-বল চন্দ্রমল্লিকার মতো ভাঙচুর হয়ে আছে। কী গো! এখানে এইভাবে বসে! অ্যাই! চিৎকার করেই বিকাশের মনে হল সকালেই দু-ছেলেমেয়ের মার সঙ্গে এতটা জোর গলায় সোহাগ করা চলে না। কানের কাছে মুখ এনে ফিশফিশ করে বলল, অ্যাই।
দুটো হাঁটুর মাঝখান থেকে আরতির মুখটা উঠে এল। ওরে বাবারে! এর কার মুখ! বিকাশের স্ত্রীর! না রাবণের! তেবাঁকা শাঁকালু। ডানপাশটা ফুলে ডিমের মতো মুরগি বা হাঁস নয়, একেবারে রাজহাঁসের ডিম যে গো! কী করে করলে? একরাতেই এতটা বড়! যথেষ্ট শ্রীবৃদ্ধি হয়েছে।
আরতির চোখের কোল বেয়ে বেশ বড় সাইজের মুক্তোর দানার মতো এক ফোঁটা জল গড়িয়ে এল! এখন কী হবে? উত্তরে আরতি একটা হাত ওপরে তুলল। ঈশ্বর জানেন কী হবে! মুখ দিয়ে শব্দ বেরোচ্ছে না। সমগ্র মুখগহ্বরে বিশাল একটি আন্ডা।
এ বস্তুকে সামলানো বিকাশের জ্ঞানবুদ্ধির বাইরে। সেলফ মেডিকেশান আর চলবে না। চা করতে করতে বিকাশের মনে পড়ল, কোথায় যেন পড়েছিল, জামগাছের ছাল পুড়িয়ে দাঁতের গোড়ায় লাগালে উপকার হয়। এ-ও পড়েছিল, একবার ঠান্ডা জল একবার গরম জল পালা করে কুলি। করলে কিছু একটা হয়। কিন্তু যেরকম ফুলেছে তাতে তো কোনও টোটকাই চলবে না! সারাদিন বেচারা খাবেই বা কী! মহা মুশকিল। ওই শরীর নিয়ে রাঁধবেই বা কী করে! অদ্য হরিবাসর। আমাকে তো এখুনি বেরোতে হবে।
আরতির সামনে চায়ের কাপ নামিয়ে বিকাশ জিগ্যেস করল, রান্নাবান্নার কী হবে? আড়চোখে চায়ের কাপটার দিকে তাকিয়ে আরতি ঠোঁট ফাঁক না করে যা বলল তা অনেকটা এইরকম শোনাল, ‘উমা ববে। বো বকমে। বো বকমে।’
বাবা! এ আবার কী ভাষা! বিকাশ তাড়াতাড়ি একটা স্লিপল্যাড আর পেনসিল এগিয়ে দিল। প্লিজ বাংলা অথবা ইংরেজিতে লিখে দাও।
আরতি খুব বিরক্ত মুখে লিখল, কোনওরকমে হবে।
তুমি কী খাবে?
আরতি লিখল, জল পর্যন্ত সহ্য হচ্ছেনা, গরমও নয় ঠান্ডাও নয়। অতএব উপোস।
যাঃ, তা কখনও হয়! কিছু একটা খেতেই হবে। সারাদিন উপবাস করে থাকবে কি?
আরতি একটু হাসল। বিকাশ অবাক হয়ে দেখল, মুখটা ঠিক যেন ন্যাকড়ায় জড়ানো একতাল ডালভাতে।
আচ্ছা! বেশ পাতলা করে খিচুড়ি খেলে কেমন হয়?
উত্তরে আরতি এমনভাবে মাথা নাড়ল বিকাশ যেন বিষ খেতে বলছে!
তাহলে দুধ দিয়ে সুজি ফুটিয়ে খেলে কেমন হয়?
বিকাশ বেশ বুঝল আরতি মুখ বাঁকাল! তবে মুখটা এমনিই তেড়াবেঁকা হয়ে আছে বলে বোঝা গেল না। না, বিকাশের আর কথা বলার সময় নেই। অন্যদিনের চেয়ে অন্তত দু-ঘণ্টা আগে বেরোতে হবে। আজ আবার লোডশেডিং-এর নির্ঘণ্ট। অমনি ফচাত করে পাওয়ার চলে যাবে, সঙ্গে সঙ্গে কলের মোটা জলের ধারা মূত্রধারা থেকে অশ্রুধারা হয়ে যাবে। দৌড়ে একবার। দোকানে যেতে হবে সুজি, রতনের দুধ, দুটো বড় নরমপাক ব্যবস্থা করে দিয়ে না গেলে, পরে ঝগড়াঝাঁটির সময় খোঁটা খেতে হবে। বউদের ওপর তো বিশ্বাস কি নির্ভরতা কোনওটাই রাখা চলে না। কুকুরের বদমেজাজের মতো। মাথায় হাত বুলোচ্ছে, পটাপট লেজ নাড়ছে। পরক্ষণেই কী হল খ্যাঁক করে কামড়ে দিল। এই গলায় গলায় এই আদায়-কাঁচকলায়।।
রতনের দোকানে দুধের লাইনে দাঁড়িয়ে বিকাশের হঠাৎ মনে পড়ল, আরে রতনের মার কাছে অব্যর্থ দাঁতের মাদুলি আছে বলে শুনেছি। একবার চেষ্টা করে দেখলে হয় না? মোষের মতো মুসঘুসে রতন বড় হাতা উঁচু গলা উলিকট গেঞ্জি পরে বিশাল একটা ব্যারেল থেকে অ্যালুমিনিয়ামের মগ ডুবিয়ে ডুবিয়ে ক্রেতাদের ঘটিতে-বাটিতে-গেলাসে-ক্যানে ছিড়িক ছিড়িক করে দুধ ঢালায় ভীষণ ব্যস্ত। দুধ আবার দুরকমের—গরু, মোষ; এখন কি আর মাদুলির কথা জিগ্যেস করা যাবে? বিকেল! বিকেলেও দুধ। গভীর রাতে; তখন আবার ছানায় জাঁক। দুপুরে! দুপুরে নাক ডাকিয়ে মোষের মতো ঘুম। রতনের গায়ে-গতরে সোনা মোড়া আহুদি বউয়ের। নিশ্চয়ই দাঁতের যন্ত্রণা হয় না। কী করে হবে! দেবতা হাতের মুঠোয়। কী সুখের জীবন! লেখাপড়া শিখলেই মানুষের মনে অশান্তি, যত দুঃখ। লেখাপড়া করিবে মরিবে দুঃখে।
বিকাশের পাত্রে দুধ ঢালছে রতন। রতনের মুখে বিকাশ কখনও হাসি দেখেনি। ডিসট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের মুখের মতো। বিকাশ একগাল হাসল। যদি রতন হাসে, তাহলে মাদুলির কথাটা। পাড়বে। সেই মুখই নয়! সবসময় একটা তুচ্ছতাচ্ছিল্য ভাব। পয়সা হলে যা হয়। জল বেচে। পাঁচতলা বাড়ি-গাড়ি। দোকানে ফোন, টিভি! ফ্রিজ। তবু বিকাশ তাক করে কথাটা ছুড়ল—শুনেছি। আপনার মার কাছে দাঁতের মাদুলি পাওয়া যায়?
হ্যাঁ যায়! বিকাশকে হাতের ঝটকায় লাইনচ্যুত করে, পরবর্তী খদ্দেরকে পোজিশনে এনে রতন বলল, এখন পাওয়া যাবে না।
কেন স্যার! বিকাশ স্যার বলে সম্বোধন করে ফেলে নিজেকেই নিজে গালাগাল দিল। ব্যক্তিত্বর অভাব। তেমন ব্যক্তিত্ব থাকলে এক ধমকে বউয়ের দাঁত ব্যথা ভালো করে দেওয়া যায়। আগের যুগের মেয়েদের অসুখ করলে টুঁ শব্দটি করার উপায় ছিল কি? রতন দুধ দিতে দিতেই বললে, মা তীর্থ করতে গেছেন। একমাস পরে ফিরবেন।
হয়ে গেল! এক মাস তো ওই ফোলামুখ ঝুলিয়ে রাখা যায় না। নিজের দাঁত হলে কথা ছিল না। এ বাবা বউয়ের মুখ! ফোলা মুখ যেই চুপসে যাবে অমনি ছুটবে বাক্যবাণ। কোরামিনের বাবা। মরা মানুষ জ্যান্ত হয়ে এক বস্ত্রে গৃহত্যাগ করে হরিমুদির লাটে ওঠা দোকানের রকে গিয়ে বসবে, ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকবে বিচিত্র জগৎ-সংসারের দিকে। কী হয়েছে দাদা! দাদা বোবা! গৃহিণী ঝেটিয়ে শুধু কর্তাকেই বের করেননি, মগজটিকেও ধোলাই করে দিয়েছেন। একেবারে ভ্যাকুয়াম।
এক হাতে সুজি অন্য হাতে দুধ নিয়ে বিকাশ ঊর্ধ্বশ্বাসে বাড়ি ঢুকল। এখুনি দৌড়োতে হবে এয়ারপোর্টে। তাহলে তুমি একটু সুজির পায়েস করে ঠোঁট দুটোকে তর্কচঞ্চর মতো করে স্টেনলেস স্টিলের চামচে দিয়ে আস্তে আস্তে টাগরায় ফেলে স্টমাকের দিকে ম্যানেজ করে নিয়ো। মুখ বাঁকালে কেন? তোমার মুখের ওই ছিরি দেখলে গা হিম হয়ে যায়। কী করবে বলো। ক’টাদিন একটু কষ্ট করো। তারপর আবার গরগরে মাছের ঝাল, ঝরঝরে ভাত, ডাঁটাকটাস কটাস সুপুরি। আপাতত দাঁতের হলিডে।
বিকাশ বেরোতে গিয়ে ফিরে এল। সুজির পায়েস করতে জানো তো! তুমি তো এই চোদ্দো বছরে
তিনটে জিনিসই বারে বারে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে করে গেলে, ভাত, চেয়ে থাকা ডাল আর মাছের তেল গড়ানো সরষে ঝাল; সেই এক কনসার্ট। শুকনো কড়ায় সুজিটাকে একটু নেড়ে লাল লাল করে। দুধে ঢেলে ফোঁটাবে, পাতলা থাকতেই নামাবে, ঈষদুষ্ণ পেটে চালান করবে। ফিরে আসি তারপর যা হয় ব্যবস্থা করব।
একটু সেঁক দিয়ে দেখতে পারো। মুখে মাফলার জড়াও। ও হ্যাঁ। বিকাশ আবার ফিরে এল। একটা ছোট এলাচ, গোটা দুই তেজপাতা দিয়ে।
বিকাশ একটু বেলাবেলি ফিরে এল। হাতে কাগজে মোড়া ছোট একটা কৌটো। দরজার সামনে এটা আবার কার চটি! গোড়ালিটা খয়ে খয়ে গেছে। স্ট্র্যাপে সোনালি রং লাগানো ছিল যৌবন বয়সে। প্রৌঢ়ত্বে দাঁত বেরিয়ে গেছে। কোন মাল আবার এলেন? বিকাশ ভাবতে ভাবতে দরজা ঠেলল। ঠেলতেই খুলে গেল। ওরে বাবা! শোবার ঘরে খাটে পা ঝুলিয়ে বসে আছেন সেই জাঁদরেল মহিলা। ঘটিহাতা উলিকট ব্লাউজ। ধবধবে সাদা ফিতে পাড় শাড়ি। ঘিয়ে রঙের শালে সুঁচের কাজ করা। শাশুড়ি খুব একটা দূরে থাকেন না। মাঝে মাঝেই মেয়ের খবরদারি করতে। আসেন। জামাই কেমন রেখেছে মেয়েকে দেখতে হবে না! প্রায়ই ভদ্রমহিলা বলেন, তুই যদি না পারিস বল, আমি বলছি জামাইকে। বিকাশের কেল্লা একা কুম্ভ নয়, কুম্ভ আর কুম্ভি দুজনে রক্ষা করছেন।
বিকাশকে দেখে মহিলা মাথায় একটু ঘোমটা টেনে দিলেন। ঘাড়ের কাছে গোল খোঁপায় কাপড়টা আটকে রইল। একটু আগেই বোধহয় মুখে জর্দা পান ঠুসেছিলেন। রোমন্থন চলেছে। ইদানীং একটু মোটা হয়েছেন। বিকাশ লক্ষ করেছে, বিধবারা যেন একটু মোটাই হন। স্বামীদের খপ্পর থেকে বেরোতে পারলেই মুক্তির আনন্দে স্বাস্থ্য ফিরে যায়।
কেমন আছেন? বিকাশ ভয়ে ভয়ে জিগ্যেস করল।
ওই এক রকম আছি, কে আর আমার খবর রাখছে বলো! উত্তরে বিকাশ হে হে করে একটু হাসল। সব অভিযোগের উত্তর বিকাশ এইভাবেই সহজ সরল করে নিয়েছে। খাটের বাহুতে পিঠ রেখে আরতি বসে আছে। নীল গরম চাদরের ঘোমটা। মুখটা রূপকথার ডাইনির মতো। ঘটের। ওপর ওলটানো ডাব। তলার দিকটা ফুলো। মাথার দিকটা সরু। কেমন আছে? আছ না বলে। বিকাশ আছে বলল। স্বাভাবিক আরতির হাজার ল্যাঠা। এখন একমাত্র খবর দাঁত। দাঁত কেমন আছেন?
মা যখন রয়েছেন, গর্ভধারিণী, তখন মেয়ে কেন জবাব দেবে! আরতির মা বললেন, তোমার বাবা দোষ আছে। সংসারে কোনও ব্যাপারে তোমার তেমন গা নেই। এসব কি ফেলে রাখার জিনিস?
সেপটিক হয়ে গেছে! গত বছর নন্দা এইভাবেই গেছে। ডাক্তার-বদ্যি কেউ কিছু করতে পারল। মুখ ফুলছে, ক্রমশ ফুলছে, এই এতখানি, বাতাবি লেবু। ব্যস, সেই ফোলাই কাল-ফোলা।
কে নন্দা, কোথাকার নন্দা, গড নোজ! ওনার স্টকে এইরকম বহু মাল আছে। এ বলে আমায় দ্যাখ ও বলে আমায় দ্যাখ। বিকাশ কেবল অনুমান করার চেষ্টা করল নন্দার মুখটা ফুলে তার স্ত্রীর মার মতো হয়ে উঠেছিল, না আরও বেশি। বিকাশ বলল, চলো তাহলে, ডাক্তার মিত্রের কাছে। নাও, রেডি হয়ে নাও। আমি রেডি, জামা-কাপড় আর ছাড়ব না।
বিকাশ হাতের মোড়কটা আয়নার তলায় ছোট ব্র্যাকেটে রাখতে রাখতে বললে, এনেছি মোক্ষম জিনিস। দাঁতের যম। দেহ যাবে তবু দাঁত যাবে না। শিকড় পর্যন্ত শক্ত বটের ঝুড়ি নামিয়ে দেবে।
কী জিনিস! আরতির মার কৌতূহল।
গুড়াখু। অভ্যেস করতে পারলে এর চেয়ে ভালো মাজন আর কিছু নেই। আমাদের পঞ্চার প্রেসক্রিপশান। আরতির মানন্দাকে ছেড়েছিলেন, বিকাশ পঞ্চকে ঝেড়ে কিস্তি মাত করে দিলে।
ওঃ বাবা সাংঘাতিক জিনিস! খবরদার তুই যেন ভুলেও ব্যবহার করিসনি! মাথা ঘুরে বাথরুমে পড়বি আর মরবি; তোর আবার লো-প্রেসার। মা মেয়েকে এমনভাবে শাসন করলেন, জামাই যেন মারবার প্ল্যান করছে।
নিত্য বিষ খেয়ে লোকে বেঁচে আছে, বংশবৃদ্ধি করছে। কৌটো কৌটো জর্দা ফাঁক করে নিজে। তোফা আছেন। সামান্য দোক্তার মাজনে ওনার মেয়ে উলটে পড়বেন! নিজের গর্ভ সম্পর্কে কী ধারণা! কথা না বাড়িয়ে আরতিকে তাড়া লাগাল।
খানকতক গাওয়া ঘিয়ে লুচি ভেজে দি, সুজির পায়েস দিয়ে খাও। এতটা রাস্তা যাবে। আরতি মার তোয়াজের জন্য খাট থেকে নেমে এল। তুমি বরং একটু ময়দা ঠেসে দাও। আমি ঠাসতে গেলে শিরে চাপ পড়ে দাঁতটা হু-হু করে উঠবে।
ওসব করতে গেলে ডাক্তারকে আর ধরতে পারব না। বিকাশ লুচির হাত থেকে বাঁচতে চাইল। না না, আগে ডাক্তার। আরতির মা খুঁতখুঁত করে বললেন, তাহলে একটু সুজি আর চা খাও না।
তাই দে! কিছুনা খেলেও চলে। বেলায় খেয়েচি। শরীরটা ঢিস ঢিস করছে। মহিলা বিশাল একটা হাই তুললেন। বিকাশের বিশ্বরূপ দর্শন হল! গজালের মতো সারি সারি দাঁত। পান-দোক্তার রসে পাকা বাঁশের মতো চেহারা।
আমি চা করি তুমি বরং মাকে সুজিটা দাও। তুমিও একটু নাও! আজ রাতে অন্য কিছু নেই। সব সুজি। হোল ফ্যামিলি সুজি।
ভালোই হয়েছে—সুজি নাইট। সকলেরই দাঁতের গোঁড়া ফুলেছে বলে ধরে নেওয়া যাক।
বিশাল ডেকচিতে সুজির পায়েস। রতনের খাঁটি দুধ ওপরে লোভনীয় সরের আঁচল বিছিয়ে রেখেছে। একটি তেজপাতা মুখ থুবড়ে পেছন উলটে পড়ে আছে। ‘আরকটিক’ সাগরে পেঙ্গুইন যেন মাছ খুঁজতে গিয়ে যেই ডুব মারতে গেছে, সঙ্গে সঙ্গে জল জমে বরফ! পাশ থেকে এক চামচ কেটে তুলে নিয়ে বিকাশ আলগোছে মুখে ফেলল। বাপস কী মিষ্টি! মহিলা গত জন্মে বোধহয় ডেয়ো পিঁপড়ে ছিলেন, এ জন্মে কাঠপিঁপড়ে? আরতির মা চা খেতে খেতে মেয়েকে বললেন, আমিও যাব নাকি তোর সঙ্গে?
জামাইকে যেন বিশ্বাস নেই। কোথায় কোন হাতুড়ে-টাতুড়ের কাছে নিয়ে যাবে। নিজের চোখে। চেম্বার আর ‘ফি’-র অঙ্কটা দেখতে পেলে তবু একটু স্বস্তি। না, জামাইয়ের বেশ কিছু খসল। মেয়ে তাড়াতাড়ি বললে, না তার আর দরকার নেই! এতটা রাস্তা তোমাকে আবার যেতে হবে।
সাধে তোমাকে বলি বিকাশ, চায়ে চুমুক দিয়ে ভদ্রমহিলা বিকাশকে বললেন, সাধে তোমাকে বলি, মেয়ের আমার অনেক ফাঁড়া। সেই ছেলেবেলায় কী করেছিল জানো? লুকোচুরি খেলছে। মেয়ে। ভীষণ আদুরে ছিল তো! ওই মেয়ে আসতেই তো কত্তার বরাত ফিরল। বাড়িতেই খেলছে। অত বড় বাড়ি! কে আর খেয়ালে রেখেছে। রাতে খেতে বসে কত্তার খেয়াল হয়েছে। মেয়ে কোথায়? মাছের ডিম খাবে। পার্শে মাছের এক জোড়া ডিম পাতের পাশে আলাদা করা আছে। খোঁজ খোঁজ। কোথায় মেয়ে, কোথায় মেয়ে? কোথাও নেই। ওমা সে কী রে! কী সব্বনেশে ব্যাপার! দ্যাখ কোথা গেল। কত্তার খাওয়া মাথায় উঠল। তুমি থামো তো বাপু। আরতি বোধ হয়। মার দিকে বড় বড় চোখ করে তাকাল। মেয়েকে ধমক দিয়ে ভদ্রমহিলা আবার শুরু করলেন।
বাড়ি তোলপাড়। কত্তা বললেন, পুলিশ ডাক। জেলে এনে সবকটা পুকুরে জাল ফেল। এদিকে ন গিন্নির প্যানপ্যান মেয়েটা সন্ধে থেকে কচ্ছে কী, দেখে যাও মা এই সিন্দুকে কী আছে। তুই থাম
তো বাপু, খালি একটা কতকালের সিন্দুক তার মধ্যে আবার কী থাকবে? গুচ্ছের আরশোলা। কেবলই বলে, দ্যাখো না খুলে, দিদি আছে। শেষে কত্তা বিরক্ত হয়ে বললেন, খুলে একবার দেখিয়ে দে তো মেয়েটাকে। অন্তত একটা শান্তি হোক। ঠাকুরপো সিন্দুকটা খুলতে খুলতে বললে, দ্যাখো। দেখে যাও কী আছে। ডালাটা খুলেই চিঙ্কার। ওমা! এই তো মেয়ে। কত্তা সাবধান করছেন, হাত দিয়ো না, আর এগিয়ো না। এ মার্ডার কেস। আঙুলের ছাপ পড়বে। জ্ঞাত শত্রুর কাজ। আগে পুলিশ আসুক। রাখো তোমার পুলিশ। আমার কম সাহস! সোজা গিয়ে মেয়ের নাকের কাছে হাত। দিব্যি নিঃশ্বাস পড়ছে। আরতি, এই আরতি। মেয়ে ঘুমোচ্ছে। ভোঁস ভোঁস
করে ঘুমোচ্ছে। শেষে কী ব্যাপার! না মেয়ে লুকিয়েছে, আমাদের পিলে চমকে যায়। কত্তা বললেন, এ মুদিনীর ওপর যায়।
—মুদিনীটা কে? বিকাশ প্রশ্ন না করে পারল না।
—ওই যে, সেই সময় এক যাদুকর বেরিয়েছিল। সিন্দুকের খেলা দেখাত।
—ও হুর্ডুনী।
—ওই হল, হুডিনী না মুদিনী।
বিকাশ আড়চোখে বউকে একবার দেখে নিল। এমন মূল্যবান বস্তু চিরকাল সিন্দুকে থাকলেই তো ভালো হত। কী দরকার ছিল, ধূলার এ ধরণীতে সংসারের পাদানিতে।
ডেন্টিস্ট বললেন, সাংঘাতিক করে এনেছেন। এ তো শুধু দাঁত নয়, সেপটিক হয়ে গেছে। কী করেছিলেন? পিন, সেফটিপিন দিয়ে খোঁচাখুঁচি? আরতি একটু ভেবে বললে, সেফটিপিন।
সর্বনাশ! সবার আগে টিটেনাস টকসয়েড তারপর চড়া ডোজে অ্যান্টিবায়োটিকস। ফুলো সাবসাইড করুক, তারপর একসট্রাকশনের কথা ভাবা যাবে।
আপনি মশাই বাড়ি থেকে আলপিন, সেফটিপিন, মাথার কাঁটা সব বিদেয় করুন। মেয়েদের খোঁচা মারা রোগ জীবনে যাবে না।
যোলো টাকা ডাক্তারের হাতে ঝেড়ে দিয়ে আরও গোটা ষোলো টাকা ওষুধে গচ্চা দিয়ে, খোঁচামারা বউ নিয়ে বিকাশ বাড়ি ফিরে এল। রাতে দুশ্চিন্তায় ভালো ঘুম হল না, এই বয়েসে স্ত্রীবিয়োগ হলে, দ্বিতীয়বার তো আর পিঁড়িতে বসতে পারবে না। তখন একটা ছেলে, একটা মেয়ে নিয়ে করবে কী! মাঝরাতে লেপটা সরিয়ে আরতির মুখটা আবছা আলোয় একবার দেখল। ঘুমন্ত ভিসুভিয়াস। ফুলোটা একটু কমছে কি? দুটো ট্যাবলেট তো পড়েছে। বিকাশ আবার শুয়ে পড়ল। যেমন করেই হোক টাকার জোগাড় করে দাঁতগুলো ঠিক করে দিতে হবে। বাবা তবু সকাল-সন্ধে ব্রাশ করে, কার্বলিক দিয়ে, ছিয়াত্তর বছর পর্যন্ত চালিয়ে গেলেন। রক্ত হাই সুগার। সহজে ছানি। সারানো কি দাঁত নড়ানো চলবে না। বউয়েরটাই প্রায়োরিটি। দাঁত তোলার আগে ব্লাড, ইউরিন, দাঁতের এক্স রে সবকিছু করাতে হবে। একগাদা খরচ, তা হোক, তারপর তোলালেই তো হবে না। ফোকলা করে ফেলে রাখা যায় না। বাঁধাতে হবে। সেও এক ঝামেলা।
সকালে মনে হল, ফোলাটা একটু কমেছে। যাক বাবা। এ যাত্রা রক্ষে পেল।
বিকাশ মনে মনে হিসেবটা ঝালিয়ে নিল—এক-একটা দাঁতের পেছনে বত্রিশটাকা করে, বত্রিশ ইনটু বত্রিশ। তারপর বাঁধানো, আরও হাজার। দু-হাজার টাকার ধাক্কা! কে জানত বউয়ের দাঁত এত মূল্যবান? সামনের বার বিয়ে করতে হলে টুথলেস মহিলা বিয়ে করবে। কাবুলের সিডলেস খেজুর কি দক্ষিণের স্টেনলস আঙুরের মতো দন্তহীন স্ত্রী। একমাত্র সেঁতো হাতির কথা চিন্তা করা যায়। শ্বশুর মহাশয়ের সেঁতো মেয়ে মহা জ্বালা। প্রথম জীবনে দাঁত খিচিয়ে। শেষ জীবনে প্রভিডেন্ট ফান্ড ধরে টানাটানি করে।
তিন মাসের মধ্যেই আরতির সব দাঁত একটা-দুটো করে উৎপাটিত হয়ে গেল। ভাটপাড়ায় ভাস্বতী বলেছিল, থার্টি টুঁ অল আউট। দাঁত বের করে আর হাসতে হচ্ছে না! সব গেটআউট। মুখটা তেবড়ে গেল। বয়েস এক লাফে বেড়ে গেল কুড়ি। মাড়ির ওপর পরম যত্নে ডেন্টিস্ট সাজিয়ে দিলেন নকল দাঁত, সবচেয়ে দামি দাঁত। আরতির মা আগেই সাবধান করে দিয়েছিলেন, দাঁত হল মুখের শোভা। কৃপণতা কোরো না বাবা! ঘুরবে ফিরবে ফিক করে হাসবে।
বিকাশ বলল, দেখি মুখটা একবার তোলো। ঘরে আর কেউ নেই তাই সাহস করে বলতে পারল।
বহু সাধ্যসাধনায় আরতি লাজুক মুখে এমন চোখে তাকাল, বিকাশের মনে হল নতুন করে শুভদৃষ্টি হচ্ছে। চোখে সেই রাতের ধারালো দৃষ্টি না থাকলেও একটা স্বচ্ছ গভীরতা আছে। দু সন্তানের জননীর চোখে সেই দুষ্টুমি নেই, বউয়ের চোখে মার চোখ। শোবার আগে আরতি দাঁত দু-পাটি খুলে জলের বাটিতে ডোবাতে যাচ্ছিল। বিকাশ বললে, রাতের এই তো সবে ভরা যৌবন, এর মধ্যে ফোকলা হবে! তোমার মুখটা মাইরি এরকম পালটে গেছে! আগের চেয়ে ভালো হয়ে। গেছে। চলো কাল একটা ছবি তুলে আসি। আবার ছবি। আরতি হাসতে গিয়ে সামলে নিল। নতুন দাঁত। এখনও অভ্যাস হয়নি। কেবলই মনে হচ্ছে খুলে পড়ে যাবে। মনে নেই ওই ছবিটা তোলার সময় কী কাণ্ড হয়েছিল?
তা হয়েছিল। তখন প্রেমের ভাঁটা চলছিল। এখন দাঁতের ঝিলিকে আবার জোয়ার এসেছে। তোমাকে ভালোবাসতে ভীষণ ইচ্ছে করছে। মাইরি। তোমার হাসিতে আমার টাকার চেকনাই লেগেছে।
বিকাশ আরতির কোমরটা ধরে কাছে টেনে নিল। একমুঠো কোমর আর নেই, একটু চর্বি জমেছে। তাহলেও চোদ্দো বছর পেছিয়ে যেতে খারাপ লাগল না। কানের কাছটা তোমার হাজার টাকার দাঁত দিয়ে সেই, সেই প্রথম রাতের মতো একটু কুটকুট ইঁদুর-কামড় দাও না।
আহা কী আব্দার! তারপর যাক আর কি ভেঙে। মনে নেই ডাক্তারবাবু কী বলেছেন? ডেলা ভেলিগুড়, আমের আঁটি, ছোলা ভাজা, চকোলেট বার, শাঁক আলু এসব নকল দাঁতে চলবে না। আমার কানটা তোমার লিস্টে নেই। একটা রিকোয়েস্ট রাখো না গো। তোমার জন্যে এত করলুম। দংশনে বিকাশ সে আনন্দ পেল না। তেমন ধার নেই। ভসকা পেঁপের মতো স্বাদ। নকল। দাঁতে আর যেই হোক, লাভবাইট তেমন জমে না। দাঁত ওষুধ মেশানো জলে গা ধুতে গেল। দাঁতহীন আরতি বিকাশের পাশে লেপের তলায় এসে ঢুকল। বিকাশ হু করে একটা শব্দ করল। হাই তুলে বলল, ঘুমিয়ে আছে এক দিদিমা সব যুবতীর যৌবনে। তাই না!
Post a Comment