কাননে কুসুম কলি – স্বপ্নময় চক্রবর্তী
জ্যামে যখন মিনিবাসটা আটকে পড়েছে, জানালা দিয়ে দেবাশিস দেখল ফুটপাতে অনেকগুলো কাচ্চাবাচ্চা জাঁতি দিয়ে সুপুরি কুচোচ্ছে। খুশি হল।
দেবাশিস টেলিভিশনে চাকরি করে। শিশু শ্রমিকদের উপর একটা ডকুমেন্টারি করার কথা ভাবছিল বেশ কিছুদিন। এ ব্যাপারটাও লাগানো যেতে পারে।‘এর চেয়ে হাঁটলে আগে পৌছব’ কণ্ডাকটারকে এই কথা দিয়ে নেমে গেল দেবাশিস।
ডানহাতে জাঁতি বাম হাতে সুপুরি, কী দ্রুত চলছে দু’হাত। কালো বুটিজামার মেয়েটা বলল আজ আমি আইস্কিরিম, তুই? হলদেটে হওয়া, আসলে সাদা টেপ জামার আরো ছোটো মেয়েটা বলল মাংস, বলেই ও ফুটপাতে বসা রোগা লোকটার পেল্লায় অ্যালুমিনিয়ামের ডেক্চির দিকে তাকায়। সিগারেট কিনতে ও ফুটপাতে গেলে একটুর জন্য মরা কৃমি ও মাছিসমেত গু মাড়িয়ে ফেলত। কাছেই ঐ মাংসওলা। উবু হয়ে বসা দুটো লুঙ্গি পরা লোক যা খাচ্ছে, তা হল ছোটো করে কাটা নাড়িভুঁড়ি। গন্ধে বুঝল পাশেই কোথাও চুল্লু বিক্রি হয়।
কুঁচো সুপুরির স্তূপের সামনে বাচ্চারা কথা বলছে:
–তোর ক’কেজিরে চিনু?
–এই ধামা হলে পাঁচ হবে।
–ইস্রে, আমার তিন চলছে। মাথাটায় উকুন খাজলাচ্ছে, চুলকোতে গেলে হাত বন্ধ। তোর উকুন না বেছে দিইচি সেদিন, চারটে চুলকানি পাওনা আছে, ওটা দিবি এখন?
–কাজের পরে সন্ধ্যাবেলায় দেব।তুই এখন ডিস্কো কাটনা, তাড়াতাড়ি
হবে।
মেয়েটা বাম হাতের তালুতে দুটো করে সুপুরি এক সঙ্গে রাখে এবং জাতি দিয়ে এক সঙ্গে কাটতে কাটতে বলে ডিস্-কো-ডিস-কো।
দেবাশিস মেয়েটাকে নাম জিজ্ঞাসা করে।
–হাসি।
–না-না, হেলেন। অন্য একটা ছেলে বলে। কথা বলার সময় নাচে, মালিক তাই হেলেন নাম দিয়েছে। দাঁত ফোকলা ছেলেটা হাসে।
–সারাদিনে কতটা কাটতে পারো?
–আমি চার কিলো।
–আমি পাঁচ কিলো।
–আমি একদিন ছ’কিলো করেছি।
–কিলোতে কত করে মজুরি?
–আধা ফালা চার আনা, চৌকো আট আনা, ছক্কা একটাকা, ঝিরি ঝিরি দুটাকা।
–সারা দিনে কত রোজগার করো?–
–তিন টাকা–
–সাড়ে তিন।
–পয়া দিনে চারটাকার উপর। দেবাশিস পয়া দিন ব্যাপারটা অনুমানে অনুধাবন করে। যেদিন মাথায় উকুন কম থাকবে, কিংবা যেদিন ঘন ঘন ঘাম মুছতে হবে না, কিংবা যে দিন পায়ে ঝিম ধরবে না। পয়া দিন।
–কখন এসেছ আজ?
–আমি সাইরেনের আগে।
–আমি বাবুদের রেশন তুলি।যখন এলাম তখন কলের জল চলে গেছে। –তোমাদের মা-বাবা কী করেন?
–আমার বাবা মরে গেছে।মা…
–ওর মা ভিকিরি। দাঁত ফোকলা বললে।
–তোমার মা-বাবা?
–আমার আসল মা চলে গেছে। বাবার নতুন বৌ আমায় প্যাদায়। আমি যা কামাই, খেয়েলি। রাস্তায় শুই।
দেবাশিসের তেমন কোনো প্রেমিকা নেই। সন্ধায় বন্ধুদের সঙ্গে একটা চায়ের দোকানে আড্ডা মারে।সেদিন ওখানে না গিয়ে মামাবাড়ি গেল। দুটো মামাতো বোন আছে। একজন বি.এ. বিটি করে বিয়ের জন্য বসে আছে, ছোটোটা এম.এ. পড়ছে রবীন্দ্রভারতীতে। টিভিতে চাকরি পাবার পর মামার বাড়িতে ওর গ্ল্যামার হয়েছে। এখন মামারবাড়ির সবাই ওকে ঘিরে বসে। দেবাশিস সংবাদ পাঠক অমুকের চরিত্রদোষ, বিখ্যাত প্রযোজক অমুকের পদোন্নতির গোপন রহস্য বা অমুকের সঙ্গে তাঁর স্ত্রীর মনোমালিন্যের কারণ ইত্যাদি রকম টিভি স্টারদের গোপন কথার গল্প বলে।
আজ মামাবাড়ি যেতেই–আরে এসো এসো দেবাশিসদা,বলেই উচ্ছসিত ছোটোবোন হাত ধরে ভিতরে নিয়ে তার দুই বান্ধবীর কাছে গিয়ে বলল–এই যে দেবাশিসদা, যার কথা বলি।
–টিভি তে?
মেয়ে দুটোর চোখে টুনি বাল্বের অস্তিত্ব টের পায় দেবাশিস।এই মওকায় বলে ফেলে–মামাতো বোনের দিকে চেয়ে–একটা যা প্রোগ্রাম প্ল্যান নিয়েছি না সুজাতা–টেরিফিক্। ঠোঁটে সিগারেট গুঁজে লাইটার হাতে নিল।
চাইণ্ড লেবারদের নিয়ে।–সিগারেট ঠোঁটে নাচল।
দেবাশিস অফিসে এই প্রোগ্রামটার ব্যাপারে প্রোপোসাল পাঠাল। প্ল্যানিংটা এইরকম।
চায়ের দোকানের বয়।
ট্রেনের শিশু হকার।
ট্রেনের মোটবওয়া কিশোর।
সুপুরিকাটা বাচ্চাগুলো।
হাওড়ার লেদকারখানাগুলোর শিশুশ্রমিক।
শিশুশ্রম সম্পর্কে আইনের ব্যাখ্যা এবং ল-ইয়ারের সঙ্গে ইন্টারভিউ।
শিশুশ্রম সম্পর্কে একজন সমাজতাত্ত্বিকের সঙ্গে ইন্টারভিউ।
স্টেশন ডিরেকটার ডেকে পাঠালেন।
–কোন্ ল-ইয়ারকে ইন্টারভিউ করতে চাও?
–ঠিক করিনি, স্যার।
–ঠিকাছে।আমি একজনকে ফোন করে দিচ্ছি।
–সোসিওলজিস্ট?
–ডাঃ বিনয় বসু।
–ওতো লেবেলড্ লোক। পাল্টাও।
–কাকে নেব স্যার?
সেটা তুমি দেখ। এমন কাউকে নিও না যে রুট টুট্ খুঁজবে। তাহলে টেলিকাস্ট করা যাবে না। আর একটা কথা, প্রোগ্রামে ওটা রাখোনি? হাউ গভ্মেন্ট ট্রাইস টু প্রিভেন্ট দিস্ প্রাক্টিস্ অফ্ ইউজিং চাইল্ড লেবারস্? লেবার কমিশনারের সঙ্গে একটা ইন্টারভিউ রাখো। রিভাইস্ ইওর প্ল্যান।ওকে?
গাড়িতে বসেই ক্যামেরা প্যান করানো হ’ল।
রাস্তা, লোকজন, যানবাহন, দোকানের সারি। মিড্শট।
একটা দোকান।
ক্লোজ মিড্শট। দোকান মালিকের বাস্ট। সামনে সুপুরির স্তূপ।
জুম ইন্। সুপুরির স্তূপ।
(একজন মালিক বলল–ক্যা হোতা হায় সার?–
সুটিং হোতা হায়, সুটিং, সিনেমাকা।
কেয়া নাম সার সিনেমাকা?
–নসীব কলকাত্তা কি)
ক্লোজ্শট। সুপুরির স্তূপ।
ক্যামেরা আস্তে আসে বিভিন্ন সাইজের সুপুরি কুঁচির স্যাম্পল রাখা মাটির সরাগুলির উপর দিয়ে প্যান করে।
পরের শট-এ রাস্তায় বসা বাচ্চাগুলো সুপুরি কুচোচ্ছে। প্রত্যেকের আলাদা আলাদা ক্লোজশট্ নিল দেবাশিস। দেবাশিস পকেট থেকে একমুঠো টফি বের করে দেখাল, বলল, ছবি তোলা হয়ে গেলে সব্বাইকে দেবে। তারপর বলল যে যে পারো, ডিস্কো সুপুরি কাটো। সিনেমার ছবি উঠবে।
একটা ১৪/১৫ বছরের ছেলে বলল বুঝেছি, কাটিং সিনেমা উঠবে, আসল সিনেমার আগে হয়। দেবাশিস হাতের উপর এম্ফাসিস্ দেবার জন্য ক্যামেরা তাক করে।
ক্লোজশট্। বাচ্চাদের হাত, হাতের খেলা, সুপুরি ঝরে পড়ছে।
একসঙ্গে দুটো করে সুপুরি, জাঁতিতে চাপ, শিরা ফুলে যাচ্ছে, হাতের শিরাগুলো টানটান, সুপুরি খসে খসে পড়ছে।
আবার দুটো সুপুরি জাতিতে, আড়ালে। অন্য হাত কাঁপছে, চাপ, ছিটকে গেল জাতি, ছড়িয়ে গেল সুপুরি, নখসমেত একটু অংশ কুচোনো সুপুরির পাশে পড়ে আছে। সুপুরির কুচি শুষে নিচ্ছে রক্ত। ক্যামেরা টালমাটাল।
মেয়েটার জামা রক্তময় হয়ে উঠেছে, কী ঘটনা বুঝতে মেয়েটার কয়েক সেকেণ্ড সময় লেগেছিল।এবার মেয়েটা তুমুল আর্তনাদ করে ওঠে। ছিন্ন ডানার মতো ঝাপট মারে হাত, আর রক্ত ছিটোয়। কী সর্বনাশ হল সমবেত স্বরে এই আর্তনাদ, দেবাশিস পেছতে থাকে।ক্যায়া হো গিয়া রে?–মালিকরা নেমে আসে।
দেবাশিস ছুটে গিয়ে গাড়িতে স্টার্ট, এখুনি। ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দেয়, তীব্র বাজে ইলেকট্রিক হর্ন।
প্ল্যানিংটা একটু চেঞ্জ করল দেবাশিস। সুপুরির ব্যাপারটা রাখল শেষের দিকে। জাঁতিতে আঙুল কেটে টুকরো হয়ে পড়ে যাওয়াটা অদ্ভুত এসেছে। নাম রাখল ‘এইসব শিশুগুলি’। টেলিকাস্ট হল। পরদিন অফিসে ঢুকতেই একজন সহকর্মী হাত বাড়িয়ে দিল।
–এ রিয়াল ডকুমেন্ট, মাইরি, এক্সিলেন্ট। দেবাশিস তার সবগুলি আঙুল সমেত হাত করমর্দনের ঝাঁকুনি পেল, তখন থ্যাংকিউ উচ্চারণ বড়ো দুর্বল ও কাঁপা শোনাল।
সমাজসেবিকা গায়ত্রী দেবী শিশুমেলার তরফ থেকে স্টেশন ডিরেক্টারকে ফোন করলেন দুঃসাহসিক প্রোডাকশনের জন্য। ওয়ার্ল্ড লুথেরান ফোন করল।
দেবাশিসের কলিগ্রা অনেকেই বলল, রিলটা একবার দেবেনতো, পরে দেখে নেব। স্টেশন ডিরেক্টার ডেকে নিয়ে বললেন–এ গুড প্রডাকশন! আই উইল সেন্ড ইঁট ফর ন্যাশানাল অ্যাওয়ার্ড।
চায়ের দোকানে বন্ধুদের আড্ডায় যেতেই ওরা ‘এইযে এসেছে শালা, মার’, বলে হাসল। শালা গোবিন্দ নিহাল্নি। কেমিস্ট কিন্তু ফিল্ম পত্রিকার সম্পাদক বন্ধু বলল–মেয়েটার আঙুলখানা নিয়ে নিলি?
দেবাশিস বলল–না মাইরি, ওটা একটা অ্যাক্সিডেন্ট। হয়ে গেল। বড্ড গিল্টি লাগে নিজেকে।
–ক্যামেরাই কি মেয়েটার অ্যাটেনশন ডাইভার্ট করেছিল?
দেবাশিস বাসের টিকিট পাকাচ্ছিল।
একজন লেকচারার বন্ধু বলল, বাচ্চাগুলোর কাজটার মধ্যে তো রিস্ক ইন্ভল্ভড রয়েছে। হয়তো এমনিতেই হতে পারত, অ্যাকসিডেন্টালি ক্যামেরাটা সেখানে গিয়ে পড়েছিল। এর আগেও হয়তো এরকম ঘটে গেছে, তখন তো ক্যামেরা যায়নি।
এই ব্যাখ্যাটা দেবাশিসের সবচেয়ে ভালো লাগল। সিগারেট ধরাল।
ইঞ্জিনিয়ার অথচ ছোটো গল্পকার বন্ধু বলল, আই এগ্রি সেদিন না হলেও অন্যদিন হতে পারত। আসলে রেক্লেস প্রফিট ওরিয়েন্টেশনের আউটকাম এসব। একজন অ্যাডাল্টের ওয়ান ফোর্থ পেমেন্ট দিয়ে হাফ কাজ পাওয়া যাচ্ছে মানে হানড্রেড পার্শেন্ট মোর প্রফিট ইন রেসপেক্ট অফ লেবার পেমেন্ট।
বয় চা নিয়ে এল। গল্পকার ওকে দুটো টাকা দিয়ে এক প্যাকেট সিগারেট আনতে পাঠাল। কুইক।
ফিল্ম পত্রিকার সম্পাদক বলল–এ-ও কিন্তু শিশুশ্রমিক দাদা। বয় সিগারেট এনে টেবিলে রাখল। ওর হাতের চামড়া কিছুটা কুঁচকে আছে।
–কী হয়েছে রে এখানে?
–চায়ের জলে।
–কবে?
–পুজোর সময়ে।
–পুজোর সময়?–অথচ…
ওরা এ-ওর চোখের দিকে তাকাল এবং আলোচনার মোড় ঘোরাল। বল দেবাশিস, তোর বোনের বান্ধবীর খবর কী?
দেবাশিস আজকাল বাসে উঠবার আগে জিজ্ঞেস করে নেয়–ভায়া এস.এন. ব্যানাজী?–কন্ডাকটার যাবে না বললেই ও নিশ্চিন্তে ওঠে। সুপুরির দোকানগুলোর সামনে দিয়ে বাসে যেতেও ভয় পায় ও।
খবরের কাগজে টিভির ঐ ‘এইসব শিশুগুলি’র রেফারেন্স দিয়ে শিশু শ্রমিক আইনের প্রয়োগ সম্পর্কে কয়েকটা চিঠি বেরিয়েছে। ফিচারও বের হল। এইভাবে শুরু:
কলকাতা কর্পোরেশন-দেয় ট্রেড লাইসেন্স কি ট্রেড সিক্রেট আছে যাতে কর্পোরেশন ভবনের নাকের ডগায় সারবন্দি শিশুরা বিপজ্জনকভাবে সুপুরি কুঁচোচ্ছে?
কিছুদিন পর দিল্লি থেকে খবর এল জাজেরা বলেছেন দেবাশিসের ‘এইসব শিশুরা’ বেস্ট ডকুমেন্টারি যার নগদ টাকা অ্যাওয়ার্ড। যে প্রডিউসারটি সর্বদা দেবাশিসের নিন্দা করে সে ডান কাঁধে মৃদু থাপ্পড় দিল। এ এস ডি, গতবার যিনি খুব খারাপ সি আর দিয়েছিলেন, বাম কাধে মৃদু থাপ্পড় দিল।
যে সুন্দরী মহিলা লাইব্রেরিয়ানটির সাথে বই ফেরত দেয়া নিয়ে বিশ্রী ঝগড়ার পর তিক্ত সম্পর্ক বহু চেষ্টাতেও দেবাশিস ভালো করতে পারেনি, সেই মহিলা সিঁড়িতে লাল আঁচলের বাতাস দিয়ে পারফিউম গন্ধের সাথে জানাল দারুণ খবর। এমনকি দেবাশিসের মোটা বেল্টের স্টিলের বগলসে একবার টোকা মারল।বলল লাইব্রেরিতে আসবেন, কফি খাওয়াব।
দেবাশিস হাফ্ সি.এল. নিয়ে বাড়ি ফিরে এল। ফ্যান ছেড়ে ঘুমল। মা, বোন, কাউকে জানাল না অ্যাওয়ার্ডের কথাটা। সন্ধায় ছাতে উঠল, যখন বাতাস মাথার চুল ফালি ফালি করে ওড়াচ্ছিল, তখন দুহাতে মাথার চুল চেপে ধরল, ঝাঁকাতে লাগল। সূর্য ডোবার পর আকাশের শেষ লাল রং ঐ মেয়েটার আঙুলের চোঁয়ানো রক্তের মতো। ছাতের রেলিং-এর ধারে চলে আসে। গা গোলাচ্ছে। অফিসে গেলেও যেন খাটালের পাশের পাঁচিল। সবাই ঘুঁটে মারছে–কনগ্র্যাচুলেশন, অ্যাওয়ার্ড, পুরস্কার। পরের দিন টেলিফোনে অসুস্থতার কথা জানাল অফিসে। সহকর্মীটি জিজ্ঞাসা করল–কী অসুখ–অ্যাওয়ার্ডের গ্যাস?
চায়ের দোকানের আড্ডায় বন্ধুদের সাথে আলোচনা করে ঠিক করল অ্যাওয়ার্ডের পুরো টাকাটাই যার আঙুল কাটা গেছে, সেই মেয়েটাকে দিয়ে দেবে।
তিনমাস পরে অ্যাওয়ার্ডের টাকাটা এলে দেবাশিস ওর চার বন্ধুর দল নিয়ে এস.এন. ব্যানাজী রোডে এল। ফিল্ম পত্রিকার সম্পাদক বলল– ক্রিমিনোলজির সেই ট্রাডিশন–দ্যাখ–অপরাধী যাচ্ছে অকুস্থলে। –যাবেই। দেবাশিস বলল–ও দূর থেকে চিনিয়ে দেবে মেয়েটাকে, তারপর বাকি বন্ধুরা যা হয় করবে। মেয়েটার বাড়ি গিয়ে ওর অভিভাবকের হাতে তুলে দেবে টাকাটা। দেবাশিস পিক্চারে থাকবে না।
এই যে সুপুরির দোকানগুলো। কিন্তু কই? ফুটপাথের ধারের সারবন্দি বাচ্চারাতো নেই। কী ব্যাপার? আজ তাহলে ওরা আসেনি?
দেবাশিস পিক্চারে নেই তাই ওর এক বন্ধু এক দোকান মালিককে জিজ্ঞাসা করল–যেসব বাচ্চালোগ সুপারি চিপ্স্ করতা থা, কাহা গিয়া?
–কৈ নেহি হ্যায় সার। আপনা মর্জিসে সব বিলকুল মিশিন বৈঠা দিয়া সার।
আস্তে আস্তে ব্যাপারটা বুঝল ওরা। গভর্নমেন্ট থেকে চাপ দিয়ে ওদের সুপুরি কুঁচো করার মেশিন কিনিয়েছে সম্প্রতি। ওদের সরকারি অফিসার ভেবেছে। তাই লস্যি মাঙিয়েছে। বাচ্চাকাচ্চাগুলোর খবর ওরা জানে না। যার কেটে গিয়েছিল সেই মেয়েটার খবরও ওরা রাখে না।
ইঞ্জিনিয়ার অথচ ছোটো গল্পকার বন্ধুটির প্রশ্নের উত্তর মালিকরা জানাল বাচ্চা-কাচ্চাগুলোকে হাটিয়ে এখন অনেক ঝামেলা কমে গেছে।সবচেয়ে বড়ো কথা, মেশিনে লেবার খরচ কম। ‘যো হুয়া সার আচ্ছাই হুয়া, সার আচ্ছাই হুয়া।’
ব্যাপারটা এখানেই শেষ।কিন্তু দেবাশিস কাউকে পুরো ব্যাপারটা বলতে
গেলে আর একটু না বলে পারবে না।
কিছুদিন পরে ‘শিল্পগঠনে ব্যাংক’ এই নামে একটা ডকুমেন্টারি করতে গিয়ে ব্যাংকের সাহায্যে গড়ে ওঠা বেলেঘাটা অঞ্চলে একটা গ্রাইণ্ডিং মেশিনের কারখানা প্রি-কভারেজে গিয়ে দ্যাখে কারখানার মালিক ওর সহপাঠী ঘোতন। পরীক্ষায় ভালো টুকতে পারত আর গুলির টিপ্ ছিল খুব। যাক ঘোতন ‘এইসব শিশুগুলি’-র ব্যাপারে কিছু বলল না, বাঁচা গেল।
ঘোতন খুব খুশি হল, মনের কথা বলল দেবাশিসকে।বলল, তুই আছিস ভালো মাইরি, টিভিতে কত মেয়ে-ফেয়ে…।
ঘোতন কারখানার কথা বলল মন্ত্রীর চামচে থেকে ব্যাংক অফিসার পর্যন্ত কাকে কী ধান্ধা করতে হয়েছে, কাকে কত দিতে হয়েছে। এসব কাহিনিতো আর টিভিতে বল যাবে না।
ঘোতন একদিন বিয়ার খাওয়াতে চাইল।
কতজনকেই তো খাওয়াতে হয়। ..বিয়ে করিসনি! বাঃ। চাস্তো নিয়ে যেতে পারি। বাঁধা আছে।…
ঘোতনের খুশি মুখ থেকে সুঘ্রাণ সিগারেট ঘুরে ঘুরে ওড়ে।ভালো প্রফিট থাকছে।ডোমেস্টিক্ গ্রাইণ্ডারের সাথে আর একটু ভারী ধরনের বিট্লনাট চিপিং মেশিন তৈরি করছি। একটা মেশিনেই বিভিন্ন সাইজের সুপুরি কাটা যায়।গভর্নমেন্টের লেবার ওয়েলফেয়ার ডিপার্টমেন্টের থুরুতে সুপুরি মার্চেন্টরা কিনছে। কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল ফাইভ্ পার্সেন্ট দি। সাউথ ইন্ডিয়া থেকেও দুচরটে অর্ডার পেয়েছি। চ’না, কারখানা দেখবি ষোলোজন কাজ করে।
দেবাশিস কারখানায় গিয়ে দেখল পাঁচ-ছজন বাচ্চা ছেলে, কেউ ঘষছে লোহার পাত, কেউ দুহাতে চক্চকে ইস্পাতের ফলা টানটান করে ধরে রেখেছে ঘুরন্ত লোহার চাক্তির উপর। শান দিচ্ছে। তারাবাজির মতো ঠিক্রোচ্ছে আগুন।
আমি আজ আইস্কিরিম্।
তুই–
আমি ঘুগনি।
লোহার শব্দে, মেশিনের শব্দে ঐ বাচ্চাগুলোর কথাবার্তা শোনা যায় না।
দুটো বাচ্চা মেয়ে সরু তামার তার জড়াচ্ছে আরমেচারে তাঁদের সরু-সরু আঙুলে। আঙুলগুলো ঠিকই তো আছে আপাতত।
Post a Comment