সত্যি ভূত মিথ্যে ভূত – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

সত্যি ভূত মিথ্যে ভূত – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

সেদিন সন্ধ্যায় ঝিরঝিরিয়ে বৃষ্টি ঝরছে! টেবিলবাতির আলোয় জম্পেশ করে একখানা গল্প লেখার জন্য কলম বাগিয়ে ধরেছি, এমনসময় কলিংবেল বাজল। বাজল বলা ভুল, বাজতে লাগল।

লেখার মুড নষ্ট হলে সব লিখিয়েই খাপ্পা হন। খাপ্পা হয়ে উঠে গেলুম। কলিংবেল একবার বাজানোই যথেষ্ট। অন্তত এই কথাটা বলেও মনের ঝাল ঝাড়ব, আগন্তুক যেই হোক না কেন।

দরজা খুলে দেখি, ঢ্যাঙা কেঠো চেহারার প্রৌঢ় এক ভদ্রলোক। পরনে সাদাসিধে ধুতি-পাঞ্জাবি! মুখে খোঁচাখোঁচা দাড়ি-গোঁফ এবং মিটিমিটি হাসি। কিছু বলার আগেই করজোড়ে নমস্কার করলেন। আপনি কি বিখ্যাত লেখক নকুড়চন্দ্র গুই? আপনার সঙ্গে কিছু জরুরি কথাবার্তা আছে।

বিখ্যাত কথাটায় প্রশংসা ছিল। আর প্রশংসা শুনলে কোন লেখক না খুশি হন! আমিও খুশি হলুম বইকী। অমন করে বেল বাজানোর কৈফিয়ত চাইতেও ভুলে গেলুম। তাছাড়া জরুরি কথাবার্তা ব্যাপারটাও আশাব্যঞ্জক। ভদ্রলোক নিশ্চয় কোনও প্রকাশক। তাই খাতির করে বললুম,–আসুন, আসুন। ভেতরে এসে বসুন। তারপর কথাবার্তা হবে।

ভদ্রলোক ঘরে ঢুকে সোফায় বসলেন। তারপর হাই তুলে বললেন,–আপনি তো ভূতের গল্প লেখেন?

একটু হেসে বললুম,–মাঝে-মাঝে দু-চারটে লিখি। তা আপনি কি–

ভদ্রলোক আমার কথায় বাধা দিয়ে বললেন, আমার কথা পরে হচ্ছে। আগে আমার প্রশ্নের জবাব দিন।

এবার একটু অবাক হয়ে বললুম, কী আপনার প্রশ্ন?

–ওই যে বললুম, আপনি ভূতের গল্প লেখেন! কিন্তু কথাটা হল, আপনি যে ভূতের গল্প লেখেন, আপনি কি কখনও ভূত দেখেছেন?

বিরক্তি চেপে বললুম,–লেখকরা যা লেখেন, কল্পনা করেই লেখেন। ভূতের গল্প লিখতে হলে স্বচক্ষে ভূত দেখতেই হবে, এটা কোনও যুক্তি নয়।

–তার মানে আপনি বানিয়ে লেখেন! সুতরাং আপনি মিথ্যা কথা লেখেন। আপনি একজন মিথ্যুক।

খাপ্পা হয়ে বললুম, কী যা-তা বলছেন আপনি?

ভদ্রলোক বাঁকা হেসে বললেন,–ঠিকই বলছি। আপনি জানেন চীনে-ভূতের গল্প লেখা মানা? লিখলেই জেলে ঢুকিয়ে দেয়। শুধু তাই নয় জেলে ঢুকিয়ে মেথরের কাজ করিয়ে ছাড়ে।

–চীনে কী হয়, তা নিয়ে আমার মাথাব্যাথা নেই, আর দেখুন, আমার সময়ের দাম আছে। আপনি আসুন।

ভদ্রলোক আমাকে গ্রাহ্য করলেন না। বললেন,–ডুকে যখন পড়েছি, তখন সহজে বেরুচ্ছিনে–অন্তত একটা চূড়ান্ত বোঝাঁপড়া যতক্ষণ না হচ্ছে!

গলার স্বর আর কথার ভঙ্গিতে একটু দমে গিয়ে বললুম, কী মুশকিল। বোঝাঁপড়াটা কীসের?

–ভূতের ব্যাপারে।

–বুঝলাম না।

–আপনি–মানে আপনার মতো যারা ভূত নিয়ে গল্প লেখেন তাঁরা কেউই ভূত দেখেননি। অথচ ভূত নিয়ে গল্প লেখেন। আপনারা মিথ্যুক। আপনাদের চীনা শাস্তির ব্যবস্থা করা উচিত।

–বেশ। গভর্নমেন্টকে বলুন ব্যবস্থা করতে।

গভর্নমেন্টকে বলে কি হবে না। ভদ্রলোক পকেট থেকে নস্যির কৌটো বের করে নাকে এক টিপ নস্যি গুজলেন। তারপর বিকট একখানা হাঁচি হেচে বললেন, ভূতেদের না দেখে ভূতের গল্প লেখা অন্যায়। কারণ এতে খামোকা ভূতেদের ডিসটার্ব করা হয়। চীনারা এটা বুঝেছে বলেই শাস্তির ব্যবস্থা করেছে।

–ভূত না দেখে ভূতের গল্প লিখলে ভূতেদের ডিসটার্ব করা হয় বলছেন। কথাটা বুঝলুম না।

–খুব সহজ কথা। যাদের স্বচক্ষে দেখেননি, তাদের কথা লিখছেন, তার মানে আপনি তাদের সম্পর্কে ভুলভাল ইনফরমেশন দিচ্ছেন। তারা যা নয়, তাই লিখছেন। তার মানেটা দাঁড়াচ্ছে, আপনি সত্যের অপলাপ করছেন।

–তাহলে আপনি বলছেন সত্যি সত্যি ভূত আছে?

–আলবত আছে। আপনারা তাদের সম্পর্কে যা লিখছেন, তা কখনও সত্যিকার ভূতের কথা নয়। স্রেফ নকল ভূতের কথা। আপনারা পাঠকদের ঠকিয়ে পয়সা কামাচ্ছেন।

একটু হেসে বললুম,–দেখুন, গল্প মানেই তো তাই। বাস্তবের সঙ্গে কল্পনার

ভদ্রলোক রেগে গিয়ে বললেন, কোথায় বাস্তব? বাস্তবরে ব-টুকুও তো দেখেননি!

–আহা, দেখিনি। কিন্তু শুনেছি। সবই যে স্বচক্ষে দেখে লিখতে হবে তার মানে নেই। ধরুন, সম্রাট অশোককে আমি স্বচক্ষে দেখিনি। কিন্তু তাকে নিয়ে গল্প লেখা যাবে না?

–সম্রাট অশোক আর ভূত এক জিনিস নয়।

–দেখুন, এ নিয়ে আপনার সঙ্গে তর্ক করার ইচ্ছা আমার নেই। আপনি দয়া করে আসুন।

ভদ্রলোক আগের মতো বাঁকা হেসে বললেন, একবার ঢুকে যখন পড়েছি, হেস্তনেস্ত না করে সহজে বেরুচ্ছিনে।

খাপ্পা হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললুম, পুলিশকে ফোন করব বলে দিচ্ছি।

করুন।–ভদ্রলোক ফের হাই তুলে বললেন, তবে আপনাকে একটা সুপরামর্শ দিতেই এসেছি। ভূতের গল্প লিখতে হলে সত্যিকার ভূত আগে দেখা দরকার। তাদের সম্পর্কে রং ইনফরমেশন দিয়ে গুলতানি ঝাড়া অত্যন্ত অন্যায়। এতে ভূতেদের অপমান করা হয়।

চার্জ করার ভঙ্গিতে বললুম, সত্যিকার ভূত বলে কিছু নেই। ভূতপ্রেত মানুষের সেন্টপার্সেন্ট কল্পনা।

–কল্পনা–সেন্টপার্সেন্ট?

–আলবাত সেন্টপার্সেন্ট।

–সত্যিকার ভূত নেই?

–না। নেই?

–দেখতে চান?

–চাই। দেখান।

–দেখতেই তো পাচ্ছেন।

–তার মানে? কোথায় দেখতে পাচ্ছি?

–আপনার চোখের সামনে।

না হেসে পারা গেল না। বললুম, তার মানে, আপনি বলতে চাইছেন যে আপনিই ভূত?

–ঠিক ধরেছেন।

–কিন্তু আপনি যে ভূত, তার প্রমাণ?

–প্রমাণ আছে বইকী। তবে এত সহজে প্রমাণ দিলে কি চলে? আপনাকে যদি কেউ চার্জ করে বসে যে, আপনিই নকুড়চন্দ্র গুই, তার প্রমাণ দিন, আপনার আঁতে ঘা লাগবে। প্রেস্টিজ বলে একটা কথা আছে না? যখন-তখন যে কেউ প্রমাণ চাইলেই তো দেওয়া যায় না। ভূতেরও প্রেস্টিজ আছে।

–বোঝা যাচ্ছে, আপনি একজন বদ্ধপাগল। পুলিশকে খবর না দিয়ে উপায় নেই দেখছি।

রেগেমেগে পাশের ঘরে গিয়ে থানায় রিং করলুম। কিছুক্ষণ রিং হওয়ার পর ঘ্যানঘেনে গলায় সাড়া এল। তখন নিজের পরিচয় দিয়ে বললুম, আমার ঘরে জোর করে একটা লোক ঢুকে পড়েছে। কাইন্ডলি কেউ এসে একটা ব্যবস্থা করুন।

–হাতে অস্ত্রস্ত্র আছে নাকি?

–না।

–টাকাপয়সা দাবি করছে কি?

–না-না! ব্যাপারটা হল, লোকটা বদ্ধ পাগল।

–তাই বুঝি? তাহলে কোনও মেন্টাল হসপিটালে খবর দিন।

–কী আশ্চর্য!

–আশ্চর্য কীসের? পাগলটাগলের হ্যাঁপা সামলানো পুলিশের ডিউটির মধ্যে পড়ে না।

–কাইন্ডলি কথাটা শুনুন আগে।

–বলুন।

–লোকটা বলছে সে একজন ভূত।

–তাহলে ভূতের রোজা ডাকুন?

–আপনারা কেউ আসবেন না তাহলে?

–সরি। এটা পুলিশের ডিউটির মধ্যে পড়ে না।

ফোন রাখার শব্দ হল। কী করব ভাবছি, এমন সময় হঠাৎ মনে পড়ে গেল লালবাজার পুলিশ হেড কোয়ার্টারে আমার পরিচিত এক অফিসার আছেন। বরাতজোরে তাকে পাওয়া গেল। ব্যাপারটা শুনে প্রথমে একচোট হাসলেন। তারপর বললেন,–এখনই যাচ্ছি, ভাববেন না। ওকে কথাবার্তা বলে-টলে জাস্ট মিনিট পাঁচেক আটকে রাখুন।

বসার ঘরে ফিরে দেখি, ভদ্রলোক চোখ বুজে যেন ঘুমোচ্ছেন। পুলিশ আসছে, অতএব আমি এবার বেপরোয়া। বললুম,–ও মশাই! শুনছেন?

চোখ বুজে যেন ঘুমের মধ্যে বললেন,–শুনেছি।

–লালবাজার থেকে পুলিশ আসছেন। এখনও বলছি, আপনাকে বিপদে ফেলতে চাই নেই। আপনি কেটে পড়ুন।

একই অবস্থায় থেকে বললেন, কে আসছে বললেন?

–লালবাজারের ক্রাইমব্রাঞ্চের ইন্সপেক্টার বন্ধুবিহারী ধাড়া।

ভদ্রলোক চোখ খুলে সোজা হয়ে বসলেন। মুখে হাসি। বন্ধু আসছে বুঝি? বাঃ। খুব ভালো, খুব ভালো।

অবাক হয়ে বললুম, ভালো মানে? ওঁকে চেনেন আপনি?

–খুব চিনি। বন্ধু আর আমি ছেলেবেলার বন্ধু।

–চালাকি করবেন না!

চালাকি কী সত্যি, বলে ভদ্রলোক আবার চোখ বুজলেন এবং আগের মতো সোফায় হেলান দিলেন। ঘুমজড়ানো গলায় স্বগতোক্তি করলেন, সারারাত সারাদিন মাইকের চোটে ঘুমোতে পারিনি। বড্ড ঘুম আসছে।

মিনিট দুই পরে কলিংবেল বাজল। এত শিগগির এসে পড়লেন মিঃ ধাড়া। খুব খুশি হয়ে দরজা খুললুম। মিঃ ধাড়া সহাস্যে বললেন,–আছে, না পালিয়েছে?

–আছে। ঘুমোচ্ছ।

বন্ধুবিহারী ধাড়া ঘরে ঢুকেই থমকে দাঁড়ালেন। তারপর প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন, মুরারি না? কী কাণ্ড।

ভদ্রলোক চোখ খুলে হাই তুলে বললেন,–আয়, কতদিন পরে তোর সঙ্গে দেখা!

মি. ধাড়া তার পাশে বসে কাঁধে হাত রেখে বললেন, তুই আছিস কোথায় এখন?

–মধ্যমগ্রামের ওদিকে। আজকাল যা অবস্থা, ডেরা খুঁজে পাওয়াই প্রবলেম।

আমার ডেরায় চলে আয় না। খুব নিরিবিলি জায়গায়। তবে মাঝে-মাঝে মাইকের বড্ড উপদ্রব। পুলিশের চাকরি করে ওটা কানসওয়া হয়ে গেছে। অসুবিধে হবে না।–বলে মিঃ ধাড়া সহাস্যে আমার দিকে ঘুরে ফের বললেন, মুরারি আমার ছেলেবেলার বন্ধু, বুঝলেন?

বললুম,–তা না হয় বুঝলুম। কিন্তু উনি নিজেকে ভূত বলছিলেন কেন?

মিঃ ধাড়া আরও হেসে বললেন, কী কাণ্ড! ভূত নিজেকে ভূত বলবে না তো কি মানুষ বলবে? বলে মুরারীবাবুর দিকে ঘুরলেন।

–তবে মুরারি, কাজটা কিন্তু ঠিক করোনি। খামোকা এই নিরীহ লেখক ভদ্রলোককে জালাতে না এলেই পারতে।

মুরারিবাবু চোখ কটমট করে বললেন,–এসেছি কি সাধে? উনি ভূতেদের ব্যাপারে রং ইনফরমেশন দিয়েছেন। স্বচক্ষে ভূত না দেখে ভূতেদের ব্যাপার-স্যাপার না জেনে একরাশ মিথ্যা কথা। অসহ্য। বন্ধু, তোমারও উচিত এর একটা বিহিত করা।

বন্ধুবিহারী ধাড়া উঠে দাঁড়ালেন। যাকগে মরুকগে! বিহিত করে হবেটা কী? এতদিন স্বচক্ষে ভূত দেখেননি। এবার দেখলেন। ব্যস, এবার থেকে আর বানিয়ে লিখবেন না। নাও, চলো–তোমার ডেরায় যাওয়া যাক। বাপস ডেরা খুঁজে পাওয়া কী যে প্রবলেম হয়েছে আজকাল। কো-অপরেটিভ হাউসিং করলে মন্দ হয় না বরং।

কথা বলতে-বলতে দুজনে বেরিয়ে গেলেন। আমি হতভম্ব হয়ে বসে রইলুম মিনিট দুই। তারপর টনক নড়ল। ঝটপট দরজা বন্ধ করে হন্তদন্ত হয়ে পাশের ঘরে গেলুম। ফের থানায় রিং করলুম। তেমনি দেরি করে সাড়া এল। বললুম,–আমি লেখক নকুড়চন্দ্র গুই বলছি। একটু আগে একটা লোকের কথা বলছিলুম

–লোকটা চলে গেছে তো?

–হ্যাঁ। কিন্তু একটা খবর জানতে চাইছি। লালবাজারে ক্রাইম ব্রাঞ্চের ইন্সপেক্টর বন্ধুবিহারী–

–কাগজে খবর পড়েননি? ডাকাতাদের সঙ্গে সংঘর্ষে গতরাত্রে উনি মারা গেছেন।

এ পর্যন্ত শুনেই ফোন নামিয়ে রাখলুম। তারপর নাক এবং কান দুটো মলে প্রতিজ্ঞা করলুম, আর কখনও ভূতের গল্প লিখব না লিখব না–লিখব না…

No comments