মোল্লা নাসিরুদ্দিন হোজ্জার ৫০ টি মজার গল্প
নাসিরুদ্দিন হোজ্জা তথা মোল্লা নাসিরুদ্দিনের নাম শোনেননি এমন মানুষ বিরল। তাকে কিংবদন্তি বললেও কম বলা হবে। বিশ্বের এমন কোনো প্রান্ত নেই যেখানে নাসিরুদ্দিন হোজ্জার গল্প প্রচলিত নয়। তার জীবন সম্বন্ধে খুব বেশি জানা না গেলেও সাধারণভাবে ধারণা করা হয়, ত্রয়োদশ শতকে বর্তমান তুরস্কের এসকিসেহির প্রদেশের সিভ্রিহিসার নামের শহরে তার জন্ম। অবশ্য কেউ কেউ বলেন, তার জন্ম আধুনিক ইরানের পশ্চিম আজারবাইজান প্রদেশের ‘খোয়’ শহরে। এই মতবাদ অনুসারে, পেশায় তিনি ছিলেন বিচারক বা কাজি, এবং ইসলামের নানা নিগুঢ় তত্ত্বে তিনি ছিলেন বিরাট পণ্ডিত।
নাসিরুদ্দিনের উপস্থিত বুদ্ধি ও বিজ্ঞতার খ্যাতি দেশ ও কালের সীমানা ছাড়িয়েছে- যদিও কোনো কোনো গল্পে তাকে পাওয়া যায় বোকা ও নেহাতই সাদাসিধে মানুষ হিসেবে। ফলে নাসিরুদ্দিন মহাবুদ্ধিমান নাকি মহাবোকা ছিলেন তা নিয়ে জল্পনাকল্পনার শেষ নেই। তবে আসল ঘটনা যাই হোক, নাসিরুদ্দিনের গল্পগুলো শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মানুষকে নির্মল আনন্দ জুগিয়ে আসছে। মোল্লা নাসিরুদ্দিনের বিশাল গল্পসম্ভার থেকে মজার কয়েকটি এখানে গ্রন্থিত করা হল।
১.
একদিন এক জ্ঞাতি এসে নাসিরুদ্দিনকে একটা হাঁস উপহার দিলে। নাসিরুদ্দিন ভারী খুশি হয়ে সেটার মাংস রান্না করে জ্ঞাতিকে খাওয়ালে।
কয়েকদিন পরে মোল্লাসাহেবের কাছে একজন লোক এসে বললে, আপনাকে যিনি হাঁস দিয়েছিলেন, আমি তাঁর বন্ধু।
নাসিরুদ্দিন তাকেও মাংস খাওয়ালে।
এর পর আরেকদিন আরেকজন এসে বলে, আপনাকে যিনি হাঁস দিয়েছিলেন, আমি তার বন্ধুর বন্ধু। নাসিরুদ্দিন তাকেও খাওয়ালে।
তারপর এল বন্ধুর বন্ধুর বন্ধু। মোল্লাসাহেব তাকেও খাওয়ালে।
এর কিছুদিন পরে আবার দরজায় টোকা পড়ল। আপনি কে?দরজা খুলে জিজ্ঞেস করলে নাসিরুদ্দিন।
আজ্ঞে মোল্লাসাহেব, যিনি আপনাকে হাঁস দিয়েছিলেন, আমি তার বন্ধুর বন্ধুর বন্ধুর বন্ধু।
ভেতরে আসুন, বললে নাসিরুদ্দিন, খাবার তৈরিই আছে।
অতিথি মাংসের ঝোল দিয়ে পোলাও মেখে একগ্লাস খেয়ে ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন, এটা কীসের মাংস মোল্লাসাহেব?
হাঁসের বন্ধুর বন্ধুর বন্ধুর বন্ধুর, বললে নাসিরুদ্দিন।
.
২.
নাসিরুদ্দিন বাজারে গিয়ে দেখে সারি সারি খাঁচায় ময়না বিক্রি হচ্ছে, সেগুলির দাম একেকটা পঞ্চাশ টাকা।
পরদিন সে তার ধাড়ি মুরগিটাকে নিয়ে বাজারে হাজির, ভাবছে সেটাকে বিক্রি করে মোটা টাকা পাবে।
যখন দেখল যে পাঁচ টাকার বেশি দাম দিতে চায় না কেউ, তখন সে তম্বি শুরু করলে। তাই দেখে একজন লোক এসে তাকে বললে, মোল্লাসাহেব, কালকের পাখিগুলো যে কথা বলতে পারে, তাই এত দাম। তোমার মুরগি কথা বলে কি?
নাসিরুদ্দিন চোখ রাঙিয়ে বললে, পুঁচকে পাখি বকবক করে কানের পোকা নড়িয়ে দিলে তার হয়ে গেল পঞ্চাশ টাকা দাম, আর আমার এতবড় মুরগি নিজের ভাবনা নিয়ে চুপচাপ থাকে বলে তার কদর নেই? যতসব ইয়ে।
.
৩.
নাসিরুদ্দিন বাজার থেকে খাবার আনে, আর তার গিন্নি সেগুলো লুকিয়ে এক বন্ধুকে দিয়ে দেয়।
ব্যাপার কী বলো তো? একদিন মোল্লা বললে–খাবারগুলো যায় কোথায়?
বেড়ালে চুরি করে, বললেন গিন্নি।
কথাটা শুনেই নাসিরুদ্দিন তার সাধের কুড়ুলটা এনে আলমারির ভিতর লুকিয়ে ফেললে।
ওটা কী হল? জিজ্ঞেস করলেন গিন্নি।
বেড়াল যদি দশ পয়সার খাবার চুরি করতে পারে বললে নাসিরুদ্দিন, তা হলে দশ টাকার কুড়ুলটা বাইরে ফেলে রাখি কোন ভরসায়?
.
৪.
এক সন্ধ্যায় নির্জন রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে নাসিরুদ্দিন কয়েকজন ঘোড়সওয়ারকে এগিয়ে আসতে দেখে প্রমাদ গুনলে। নির্ঘাত এরা তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে শাহেন শা-র ফৌজে ভর্তি করে দেবে।
রাস্তার পাশেই গোরস্থান; নাসিরুদ্দিন এক দৌড়ে তাতে ঢুকে ঘাপটি মেরে রইল।
ঘোড়সওয়াররা কৌতূহলী হয়ে গোরস্থানে ঢুকে দেখে নাসিরুদ্দিন একটা কবরের ধারে কাঠ হয়ে পড়ে আছে। এখানে কী হচ্ছে মোল্লাসাহেব? তারা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলে।
নাসিরুদ্দিন বুঝলে তার আঁচে গলতি হয়েছে। সে বললে, সব প্রশ্নের তো আর সহজ উত্তর হয় না। যদি বলি যে তোমাদের জন্যই আমার এখানে আসা, আর আমার জন্যই তোমাদের এখানে আসা, তা হলে কিছু বুঝবে?
.
৫.
নাসিরুদ্দিন তার পুরনো বন্ধু জামাল সাহেবের দেখা পেয়ে ভারী খুশি। বললে, বন্ধু, চলো পাড়া বেড়িয়ে আসি।
লোকজনের সঙ্গে দেখা করতে গেলে আমার এই মামুলি পোশাক চলবে না, বললে জামাল সাহেব। নাসিরুদ্দিন তাকে একটি বাহারের পোশাক ধার দিলে।
প্রথম বাড়িতে গিয়ে নাসিরুদ্দিন গৃহকর্তাকে বললে, ইনি হলেন আমার বিশিষ্ট বন্ধু জামাল সাহেব। এঁর পোশাটা আসলে আমার।
দেখা সেরে বাইরে বেরিয়ে এসে জামাল সাহেব বিরক্ত হয়ে বললেন, তোমার কেমনতরো আক্কেল হে! পোশাকটা যে তোমার সেটা কি না বললেই চলত না?
পরের বাড়িতে গিয়ে নাসিরুদ্দিন বললে, জামাল সাহেব আমার পুরনো বন্ধু। ইনি যে পোশাকটা পরেছেন সেটা কিন্তু ওঁর নিজেরই।
জামাল সাহেব আবার খাপ্পা। বাইরে বেরিয়ে এসে বললেন, মিথ্যে কথাটা কে বলতে বলেছিল তোমায়?
কেন? বললে নাসিরুদ্দিন, তুমি যেমন চাইলে তেমনই তো বললাম।
না, বললেন জামালসাহেব, পোশাকের কথাটা না বললেই ভাল।
তিন নম্বর বাড়িতে গিয়ে নাসিরুদ্দিন বললে, আমার পুরনো বন্ধু জামাল সাহেবের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই। ইনি যে পোশাটা পরেছেন সেটার কথা অবিশ্যি না বলাই ভাল।
.
৬.
নাসিরুদ্দিন নাকি বলে বেড়াচ্ছে যারা নিজেদের বিজ্ঞ বলে তারা আসলে কিচ্ছু জানে না। এই খবর শুনে সাতজন সেরা বিজ্ঞ নাসিরুদ্দিনকে রাজার কাছে ধরে এনে বললে, শাহেন শা, এই ব্যক্তি অতি দুর্জন। ইনি আমাদের বদনাম করে বেড়াচ্ছেন। এর শাস্তির ব্যবস্থা হোক।
রাজা নাসিরুদ্দিনকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার কিছু বলার আছে?
আগে কাগজ কলম আনা হোক, জাঁহাপনা, বললে নাসিরুদ্দিন।
কাগজ কলম এল।
এদের সাতজনকে একটি করে দেওয়া হোক।
তাও হল।
এবার সাতজনে আলাদা করে আমার প্রশ্নের জবাব লিখুন। প্রশ্ন হল-রুটির অর্থ কী?
সাত পণ্ডিত উত্তর লিখে রাজার হাতে কাগজ দিয়ে দিলেন, রাজা পর পর উত্তরগুলো পড়ে গেলেন।
পয়লা নম্বর লিখেছেন রুটি একপ্রকার খাদ্য।
দুই নম্বর–ময়দা ও জলের সংমিশ্রণে তৈয়ারি পদার্থকে বলে রুটি।
তিন নম্বর–রুটি ঈশ্বরের দান।
চার নম্বর–একপ্রকার পুষ্টিকর আহার্যকে বলে রুটি।
পাঁচ নম্বর–রুটির অর্থ করতে গেলে আগে জানা দরকার, কোনপ্রকার রুটির কথা বলা হচ্ছে।
ছয় নম্বর–রুটির অর্থ এক মূর্খ ব্যক্তি ছাড়া সকলেই জানে।
সাত নম্বর–রুটির প্রকৃত অর্থ নির্ণয় করা দুরূহ ব্যাপার।
উত্তর শুনে নাসিরুদ্দিন বললে, জাঁহাপনা, যে জিনিস এঁরা প্রতিদিন খাচ্ছেন, তার মানে এঁরা সাতজন সাতরকম করলেন, অথচ যে লোককে এঁরা কখনও চোখেই দেখেননি তাকে সকলে একবাক্যে নিন্দে করছেন। এক্ষেত্রে কে বিজ্ঞ কে মূর্খ সেটা আপনিই বিচার করুন।
রাজা নাসিরুদ্দিনকে বেকসুর খালাস দিলেন।
.
৭.
নাসিরুদ্দিনের দজ্জাল গিন্নি ফুটন্ত সুরুয়া এনে কর্তার সামনে রাখল তার জিভ পুড়িয়ে তাকে জব্দ করবে বলে, কিন্তু ভুলে সে নিজেই দিয়ে ফেলেছে তাতে চুমুক। ফলে তার চোখে জল এসে গেছে।
নাসিরুদ্দিন তাই দেখে বলে, হল কী? কাঁদছ নাকি?
গিন্নি বললেন, মা মারা যাবার ঠিক আগে সুরুয়া খেয়েছিলেন, আহা! সেই কথাটা মনে পড়ে গেল।
এবার নাসিরুদ্দিনও সুরুয়ায় চুমুক দিয়েছে, আর তার ফলে তারও চোখ ফেটে জল।
সে কী, তুমিও কাঁদছ নাকি? শুধোলেন গিন্নি।
নাসিরুদ্দিন বললে, তোমায় জ্যান্ত রেখে তোমার মা মারা গেলেন, এটা কি খুব সুখের কথা?
.
৮.
রাজদরবারে নাসিরুদ্দিনের খুব খাতির।
একদিন খুব খিদের মুখে বেগুন ভাজা খেয়ে ভারী খুশি হয়ে রাজা নাসিরুদ্দিনকে বললেন, বেগুনের মতো এমন সুস্বাদু খাদ্য আর আছে কি?
বেগুনের জবাব নেই, বললে নাসিরুদ্দিন।
রাজা হুকুম দিলেন, এবার থেকে রোজ বেগুন খাব।
তারপর পাঁচদিন দুবেলা বেগুন খেয়ে ছদিনের দিন রাজা হঠাৎ বেঁকে বসলেন। খানসামাকে ডেকে বললেন, দূর করে দে আমার সামনে থেকে এই বেগুন ভাজা।
বেগুন অখাদ্য, সায় দিয়ে বললে নাসিরুদ্দিন।
রাজা একথা শুনে ভারী অবাক হয়ে বললেন, সে কী মোল্লাসাহেব, তুমি যে এই সেদিনই বললে বেগুনের জবাব নেই!
আমি তো আপনার মোসাহেব, জাঁহাপনা, বললে নাসিরুদ্দিন, বেগুনের তো নই।
.
৯.
নাসিরুদ্দিন সরাইখানায় ঢুকে গম্ভীরভাবে মন্তব্য করলে, সুর্যের চেয়ে চাঁদের উপকারিতা অনেক বেশি।
কেন মোল্লাসাহেব? অবাক হয়ে প্রশ্ন করলে সবাই।
চাঁদ আলো দেয় রাত্তিরে, বললে নাসিরুদ্দিন, দিনে আলোর দরকারটা কী শুনি?
.
১০.
নাসিরুদ্দিন তার এক বন্ধুকে নিয়ে সরাইখানায় ঢুকেছে দুধ খাবে বলে। পয়সার অভাব, তাই এক গেলাস দুধ দুজন আধাআধি করে খাবে।
বন্ধু বললে, তুমি আগে খেয়ে নাও তোমার অর্ধেক। বাকিটা আমি পরে চিনি দিয়ে খাব।
চিনিটা আগেই দাও না ভাই, বললে নাসিরুদ্দিন, তা হলে দুজনেরই দুধ মিষ্টি হবে।
বন্ধু মাথা নাড়লে। আধ গেলাসের মতো চিনি আছে আমার সঙ্গে, আর নেই।
নাসিরুদ্দিন সরাইখানার মালিকের সঙ্গে দেখা করে খানিকটা নুন নিয়ে এল। ঠিক আছে, সে বললে বন্ধুকে, এই নুন ঢাললাম দুধে। আমি অর্ধেক নোনতা খাব, বাকি অর্ধেক মিষ্টি খেও তুমি।
.
১১.
মোল্লা এক ছোঁকরাকে মাটির কলসি দিয়ে পাঠালে কুয়ো থেকে জল তুলে আনতে। দেখিস, কলসিটা ভাঙিসনি যেন, বলে একটা থাপ্পড় মারলে ছোঁকরার গালে।
এক পথচারী ব্যাপারটা দেখে বললে, কলসি না ভাঙতেই চড়টা মারলেন কেন মোল্লাসাহেব?
তোমার যা বুদ্ধি,বললে নাসিরুদ্দিন, ভাঙার পরে চড় মারলে কি আর কলসি জোড়া লেগে যাবে?
.
১২.
নাসিরুদ্দিন একটা মনিহারী দোকানে গিয়ে জিজ্ঞেস করলে, এখানে পেরেক পাওয়া যায়?
আজ্ঞে হ্যাঁ, বললে দোকানদার।
আর চামড়া?
আজ্ঞে হ্যাঁ, যায়।
আর সুতো?
যায়, আজ্ঞে।
আর রঙ?
তাও যায়।
তা হলে তুমি বসে না থেকে একটা জুতো তৈরি করে ফেলো না বাপু!
.
১৩.
নাসিরুদ্দিন এক পড়শির কাছে গিয়ে হাত পাতলে। এক গরিব তার দেনা শোধ করতে পারছে না। তার সাহায্যে যদি কিছু দেন।
পড়শির মনটা দরাজ, সে খুশি হয়ে তার হাতে কিছু টাকা দিয়ে বললে, আহা বেচারি! এই ঋণগ্রস্ত অভাগাটি কে, মোল্লাসাহেব?
আমি, বলে নাসিরুদ্দিন হাওয়া।
কিছুদিন পরে নাসিরুদ্দিন আবার সেই পড়শির কাছে এসে হাত পেতেছে। পড়শি একবার ঠকে সেয়ানা হয়ে গেছে। বললে, বুঝেছি। দেনাদারটি এবারও তুমিই তো?
আজ্ঞে না। বিশ্বাস করুন। এবার সত্যিই আমি না।
পড়শির আবার মন ভিজল। নাসিরুদ্দিনের হাতে টাকা দিয়ে বললে, এবার কার দুঃখ দূর করতে যাচ্ছ মোল্লাসাহেব?
আজ্ঞে, আমার।
কীরকম?
আজ্ঞে এই অধম এবার পাওনাদার।
.
১৪.
সুসংবাদ দিলে বকশিশ পায় জেনে একজন লোক নাসিরুদ্দিনকে গিয়ে বললে, তোমার জন্য খুব ভাল খবর আছে, মোল্লাসাহেব।
কী খবর?
তোমার পাশের বাড়িতে পোলাও রান্না হচ্ছে।
তাতে আমার কী?
তোমাকে সে পোলাওয়ের ভাগ দেবে বলছে।
তাতে তোমার কী?
.
১৫.
নাসিরুদ্দিন নদীর ধারে বসে আছে, এমন সময় দেখে নজন অন্ধ নদী পেরোবার তোড়জোড় করছে।
নাসিরুদ্দিন তাদের কাছে প্রস্তাব করলে যে, জনপিছু এক পয়সা করে নিয়ে সে নজনকে পর পর কাঁধে করে পার করে দেবে। অন্ধরা রাজি হয়ে গেল।
নাসিরুদ্দিন আটজনকে পার করে ননম্বরের বেলায় মাঝনদীতে হোঁচট খেতে পিঠের অন্ধ জলে। তলিয়ে গেল।
বাকি আটজন দেরি দেখে ওপার থেকে চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলে, কী হল মোল্লাসাহেব?
এক পয়সা বাঁচল তোমাদের, বললে নাসিরুদ্দিন।
.
১৬.
নাসিরুদ্দিন আর তার গিন্নি একদিন বাড়ি ফিরে এসে দেখে চোর এসে বাড়ি তছনছ করে দিয়ে গেছে। গিন্নি তো রেগে আগুন। বললে, এ তোমার দোষ। সদর দরজায় তালা দাওনি, তাই এই দশা।
পড়শিরাও সেই একই সুর ধরলে। একজন বললে, জানলাগুলোও তো ভাল করে বন্ধ করোনি দেখছি।
আরেকজন বললে, চোর আসতে পারে সেটা আগেই বোঝা উচিত ছিল।
আরেকজন বললে, দরজার তালাগুলোও পরীক্ষা করে দেখা উচিত।
কী আপদ! বললে নাসিরুদ্দিন, তোমরা দেখছি শুধু আমার পিছনেই লাগতে শুরু করলে!
দোষ তো তোমারই মোল্লাসাহেব, পড়শিরা বললে।
বটে? বললে নাসিরুদ্দিন, আর চোরের বুঝি দোষ নেই?
.
১৭.
নাসিরুদ্দিনের ভারী শখ একটা নতুন জোব্বা বানাবে, তাই পয়সা জমিয়ে দরজির দোকানে গেল ফরমাশ দিতে। দরজি মাপ নিয়ে বললে, আল্লা করেন তো এক সপ্তাহ পরে আপনি জোব্বা পেয়ে যাবেন।
নাসিরুদ্দিন এক সপ্তাহ কোনওরকমে ধৈর্য ধরে তারপর আবার গেল দরজির দোকানে।
একটু অসুবিধা ছিল মোল্লাসাহেব, বললে দরজি, আল্লা করেন তো কাল আপনি অবশ্যই জোব্বা পেয়ে যাবেন।
পরদিন গিয়েও হতাশ। মাফ করবেন মোল্লাসাহেব, বললে দরজি, আর একটি দিন আমাকে সময় দিন। আল্লা করেন তো কাল সকালে নিশ্চয় রেডি পাবেন আপনার জোব্বা।
নাসিরুদ্দিন এবার বললে, আল্লা না করে তুমি করলে জোব্বাটা কবে পাব সেটা জানতে পারি কি?
.
১৮.
এক প্রবীণ দার্শনিক সরাইখানায় বসে বিলাপ করছেন, বিচিত্র জীব এই মানুষ। কোনও কিছুতেই তৃপ্তি নেই। শীতকালে বলে ঠাণ্ডায় মলাম, গ্রীষ্মে বলে গরমে প্রাণ আইঢাই।
সবাই তার কথায় সায় দিয়ে গম্ভীরভাবে মাথা নাড়ল।
বসন্তের বিরুদ্ধে যার নালিশ আছে সে হাত তোলো, বললে নাসিরুদ্দিন।
.
১৯.
নাসিরুদ্দিনের গানবাজনা শেখার শখ হয়েছে। এক জবরদস্ত ওস্তাদের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলে, আপনি বাদ্যযন্ত্র শেখাতে কত নেন?
প্রথম মাসে তিন রৌপ্যমুদ্রা, তারপর থেকে প্রতি মাসে এক রৌপ্যমুদ্রা।
বেশ, তা হলে দ্বিতীয় মাস থেকেই শুরু করব আমি, বললে নাসিরুদ্দিন।
.
২০.
এক চোর নাসিরুদ্দিনের বাড়িতে ঢুকে তার প্রায় সর্বস্ব চুরি করে রওনা দিল নিজের বাড়ির দিকে।
নাসিরুদ্দিন রাস্তা থেকে সব দেখে একটি কম্বল কাঁধে নিয়ে চোরের পিছু ধাওয়া করে তার বাড়িতে ঢুকে কম্বল গায়ে দিয়ে শুয়ে পড়ল মেঝেতে।
কে হে তুমি? চোর জিজ্ঞেস করলে, আমার বাড়িতে কেন?
আমার জিনিস যখন সবই এখানে, বললে নাসিরুদ্দিন, এখন থেকে এটাই আমার বাড়ি নয় কি?
.
২১.
সরাইখানায় কজন সৈনিকের আগমন হয়েছে। তারা যুদ্ধক্ষেত্রে তাদের বীরত্বের বড়াই করছে। একজন বললে, খোলা তলোয়ার হাতে এমন তেজের সঙ্গে ছুটলাম আমি দুশমনের দিকে যে-তারা একেবারে ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। আমায় রেখে কার সাধ্য!
সবাই একথা শুনে সমস্বরে বাহবা দিলে। নাসিরুদ্দিনও এককালে যুদ্ধ করেছে। সে বললে, তোমার কথা শুনে আমার নিজের একটা যুদ্ধের ঘটনা মনে পড়ছে। এক শত্রুর পা কেটে ফেলেছিলাম তলোয়ারের এক কোপে।
তাই শুনে এক প্রবীণ যোদ্ধা বললে, ওইখানেই তো ভুল। কাটা উচিত ছিল মুণ্ডুটা।
মুণ্ডুটা না থাকলে আর মুণ্ডু কাটব কোত্থেকে? বললে নাসিরুদ্দিন।
.
২২.
এক পড়শি মোল্লাসাহেবের কাছে একগাছ দড়ি ধার চাইতে এসেছে।
পাবে না বলে নাসিরুদ্দিন।
কেন মোল্লাসাহেব?
দড়ি কাজে লাগছে।
ওটা তো মাটিতে পড়ে আছে আজ কদিন থেকে মোল্লাসাহেব।
ওটাই কাজ।
পড়শি তবু আশা ছাড়ে না। বললে, কদিন চলবে কাজ মোল্লাসাহেব?
যদ্দিন না ওটা ধার দেওয়া দরকার বলে মনে করি বললে নাসিরুদ্দিন।
.
২৩.
নাসিরুদ্দিন হামামে গেছে গোসল করতে। পরিচারক তার ছেঁড়া পোশাক দেখে আধখানা সাবান আর একটা ময়লা তোয়ালে ছুঁড়ে দিলে তার দিকে।
নাসিরুদ্দিন কিন্তু যাবার সময় তাকে ভালরকম বকশিশ দিয়ে গেল। পরিচারক ভাবলে, এ কেমন হল? খাতির না করেই যদি এত পাওয়া যায় তা হলে খাতির করলে না জানি কত মিলবে!
পরের সপ্তাহে নাসিরুদ্দিন আবার গেছে হামামে। এবার তাকে দেখেই পরিচারক একেবারে বাদশার হালে তার তোষামোদ করেছে। আচ্ছা রকম দলাই-মালাই করে, গায়ে আতর ছিটিয়ে দিয়ে, কাজের শেষে হাত পাততেই নাসিরুদ্দিন তাকে একটি তামার পয়সা দিয়ে বললে, গতবারের জন্য এই বকশিশ। এবারেরটা তো আগেই দেওয়া আছে।
২৪.
নাসিরুদ্দিন এক আমীরের বাড়ি গেছে দুর্ভিক্ষের চাঁদা তুলতে। দরোয়ানকে বললে, তোমার মনিবকে গিয়ে বলল মোল্লাসাহেব চাঁদা নিতে এসেছেন।
দরোয়ান ভিতরে গিয়ে মিনিটখানেক পরে ফিরে এসে বললে, আজ্ঞে, মনিব একটু বাইরে গেছেন।
তা হলে তোমায় একটা কথা বলে যাই,বললে নাসিরুদ্দিন, তোমার মনিব এলে তাঁকে বোলো যে, বেরোবার সময় তাঁর মুণ্ডুটা যেন জানলার ধারে রেখে না যান। কখন চোর আসে বলা কি যায়!
২৫
নাসিরুদ্দিনের বন্ধুরা একদিন তাকে বললে, চলো, আজ রাত্রে আমরা তোমার বাড়িতে খাব।
বেশ, এসো আমার সঙ্গে, বললে নাসিরুদ্দিন।
বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে সে বললে, তোমরা একটু সবুর করো, আমি আগে গিন্নিকে বলে আসি ব্যবস্থা করতে।
গিন্নি তো ব্যাপার শুনে এই মারে তো সেই মারে। বললেন, চালাকি পেয়েছ? এত লোকের রান্না কি চাট্টিখানি কথা? যাও, বলে এসো ওসব হবে-টবে না।
নাসিরুদ্দিন মাথায় হাত দিয়ে বললে, দোহাই গিন্নি, ও আমি বলতে পারব না। এতে আমার ইজ্জত থাকবে না।
তবে তুমি ওপরে গিয়ে ঘরে বসে থাকো। ওরা এলে যা বলার আমি বলব।
এদিকে নাসিরুদ্দিনের বন্ধুরা প্রায় এক ঘণ্টা অপেক্ষা করে শেষটায় তার বাড়ির সামনে এসে হাঁক দিল, ওহে নাসিরুদ্দিন, আমরা এসেছি, দরজা খোলো৷
দরজা ফাঁক হল, আর ভিতর থেকে শোনা গেল গিন্নির গলা।
ও বেরিয়ে গেছে।
বন্ধুরা অবাক! কিন্তু আমরা তো ওকে ভিতরে ঢুকতে দেখলাম। আর সেই থেকে তো আমরা দরজার দিকেই চেয়ে আছি। ওকে তো বেরোতে দেখিনি।
গিন্নি চুপ। বন্ধুরা উত্তরের অপেক্ষা করছে। নাসিরুদ্দিন দোতলার ঘর থেকে সব শুনে আর থাকতে না পেরে বললে, তোমরা তো সদর দরজায় চোখ রেখেছ; সে বুঝি খিড়কি দিয়ে বেরোতে পারে না?
.
২৬.
নাসিরুদ্দিন তার বাড়ির বাইরে বাগানে কী যেন খুঁজছে। তাই দেখে এক পড়শি জিজ্ঞেস করলে, ও মোল্লাসাহেব, কী হারালে গো?
আমার চাবিটা, বললে নাসিরুদ্দিন।
তাই শুনে লোকটিও বাগানে এসে চাবি খুঁজতে লাগল। কিছুক্ষণ খোঁজার পর সে জিজ্ঞেস করলে, ঠিক কোনখানটায় ফেলেছিলে চাবিটা, মনে পড়ছে?
আমার ঘরে।
সে কী! তা হলে এখানে খুঁজছ কেন?
ঘরটা অন্ধকার, বললে নাসিরুদ্দিন। যেখানে খোঁজার সুবিধে সেইখানেই তো খুঁজব?
.
২৭.
নাসিরুদ্দিনের পোষ পাঁঠাটার উপর পড়শিদের ভারী লোভ, কিন্তু নানান ফিকির করেও তারা সেটাকে হাত করতে পারে না। শেষটায় একদিন তারা নাসিরুদ্দিনকে বললে, ও মোল্লাসাহেব, বড় দুঃসংবাদ। কাল নাকি প্রলয় হবে। এই দুনিয়ার সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাবে।
তা হলে পাঁঠাটাকেও ধ্বংস করা হোক, বললে নাসিরুদ্দিন।
সন্ধেবেলা পড়শিরা দলেবলে এসে দিব্যি ফুর্তিতে পাঁঠার ঝোল খেয়ে গায়ের জামা খুলে নাসিরুদ্দিনের বৈঠকখানায় নাক ডাকিয়ে ঘুমোতে লাগল।
সকালে ঘুম থেকে উঠে তারা দেখে তাদের জামা উধাও।
প্রলয়ই যদি হবে, বললে নাসিরুদ্দিন, তা হলে জামাগুলো আর কোন কাজে লাগবে ভাই? তাই আমি সেগুলোকে আগুনে ধ্বংস করে ফেলেছি।
.
২৮.
নাসিরুদ্দিন বাজার থেকে মাংস কিনে এনে তার গিন্নিকে দিয়ে বললে, আজ কাবাব খাব; বেশ ভাল করে রাঁধো দিকি।
গিন্নি রান্নাটান্না করে লোভে পড়ে নিজেই সব মাংস খেয়ে ফেললে। কর্তাকে তত আর সে কথা বলা যায় না, বললে, বেড়াল খেয়ে ফেলেছে।
এক সের মাংস সবটা খেয়ে ফেলল?
সবটা।
বেড়ালটা কাছেই ছিল, নাসিরুদ্দিন সেটাকে দাঁড়িপাল্লায় চড়িয়ে দেখলে ওজন ঠিক এক সের।
এটাই যদি সেই বেড়াল হয়, বললে নাসিরুদ্দিন, তা হলে মাংস কোথায়? আর এটাই যদি সেই মাংস হয়, তা হলে বেড়াল কোথায়?
.
২৯.
নাসিরুদ্দিনের যখন বয়স খুব কম তখন একদিন তার বাপ তাকে বললেন, ওরে নসু, এবার থেকে খুব ভোরে উঠিস।
কেন বাবা? অভ্যেসটা ভাল, বললেন নসুর বাপ। আমি সেদিন ভোরে উঠে বেড়াতে গিয়ে রাস্তার মধ্যিখানে পড়ে থাকা এক থলে মোহর পেয়েছি।
সে থলে তো আগের দিন রাত্রেও পড়ে থাকতে পারে, বাবা। সেটা কথা নয়। আর তা ছাড়া আগের দিন রাত্রেও ওই পথ দিয়ে হাঁটছিলুম আমি; তখন কোনও মোহরের থলে ছিল না।
তা হলে ভোরে উঠে লাভ কী বাবা? বললে নাসিরুদ্দিন। যে লোক মোহরের থলি হারিয়েছিল সে নিশ্চয় তোমার চেয়েও বেশি ভোরে উঠেছিল।
.
৩০.
শিকারে বেরিয়ে পথে প্রথমেই নাসিরুদ্দিনের সামনে পড়ে রাজামশাই খেপে উঠলেন। লোকটা অপয়া। আজ আমার শিকার পণ্ড। ওকে চাবকে হটিয়ে দাও।
রাজার হুকুম তামিল হল।
কিন্তু শিকার হল জবরদস্ত।
রাজা নাসিরুদ্দিনকে ডেকে পাঠালেন।
কসুর হয়ে গেছে নাসিরুদ্দিন। আমি ভেবেছিলাম তুমি অপয়া। এখন দেখছি তা নয়।
নাসিরুদ্দিন তিন হাত লাফিয়ে উঠল।
আপনি ভেবেছিলেন আমি অপয়া? আমায় দেখে আপনি ছাব্বিশটা হরিণ মারলেন, আর আপনাকে দেখে আমি বিশ ঘা চাবুক খেলাম। অপয়া যে কে, সেটা বুঝতে পারলেন না?
.
৩১.
নাসিরুদ্দিন একজন লোককে মুখ ব্যাজার করে রাস্তার ধারে বসে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করলে, তার কী হয়েছে। লোকটা বললে, আমার জীবন বিষময় হয়ে গেছে মোল্লাসাহেব। হাতে কিছু পয়সা ছিল, তাই নিয়ে দেশ ঘুরতে বেরিয়েছি, যদি কোনও সুখের সন্ধান পাই।
লোকটির পাশে তার বোঁচকায় কতগুলো জিনিসপত্র রাখা ছিল। তার কথা শেষ হওয়ামাত্র নাসিরুদ্দিন সেই বোঁচকাটা নিয়ে বেদম বেগে দিলে চম্পট। লোকটাও হাঁ হাঁ করে তার পিছু নিয়েছে, কিন্তু নাসিরুদ্দিনকে ধরে কার সাধ্য! দেখতে দেখতে সে রাস্তা ছেড়ে জঙ্গলে ঢুকে হাওয়া। এইভাবে লোকটিকে মিনিটখানেক ধোঁকা দিয়ে সে আবার সদর রাস্তায় ফিরে বোঁচকাটাকে রাস্তার মাঝখানে রেখে একটা গাছের আড়ালে লুকিয়ে রইল। এদিকে সেই লোকটিও কিছুক্ষণ পরে এসে হাজির। তাকে এখন আগের চেয়েও দশগুণ বেশি বেজার দেখাচ্ছে। কিন্তু রাস্তায় তার বোঁচকাটা পড়ে আছে দেখেই সে মহাফুর্তিতে একটা চিৎকার দিয়ে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।
গাছের আড়াল থেকে নাসিরুদ্দিন বললে, দুঃখীকে সুখের সন্ধান দেবার এও একটা উপায়।
.
৩২.
তর্কবাগীশ মশাই নাসিরুদ্দিনের সঙ্গে তর্ক করবেন বলে দিনক্ষণ ঠিক করে তার বাড়িতে এসে দেখেন মোল্লাসাহেব বেরিয়ে গেছেন। মহা বিরক্ত হয়ে তিনি মোল্লার সদর দরজায় খড়ি দিয়ে লিখে গেলেন মূর্খ।
নাসিরুদ্দিন বাড়ি ফিরে এসে কাণ্ড দেখে এক হাত জিভ কেটে এক দৌড়ে তর্কবাগীশ মশাইয়ের বাড়ি গিয়ে তাঁকে বললে, ঘাট হয়েছে পণ্ডিতমশাই, আমি বেমালুম ভুলে গেসলুম আপনি আসবেন। শেষটায় বাড়ি ফিরে দরজায় আপনার নামটা লিখে গেছেন দেখে মনে পড়ল।
.
৩৩.
গাঁয়ের লোকে একদিন ঠিক করল নাসিরুদ্দিনকে নিয়ে একটু মশকরা করবে। তারা তার কাছে গিয়ে সেলাম ঠুকে বললে, মোল্লাসাহেব, আপনার এত জ্ঞান, একদিন মসজিদে এসে আমাদের তত্ত্বকথা শোনান না! নাসিরুদ্দিন এককথায় রাজি।
দিন ঠিক করে ঘড়ি ধরে মসজিদে হাজির হয়ে নাসিরুদ্দিন উপস্থিত সবাইকে সেলাম জানিয়ে বললে, ভাই সকল, বলো তো দেখি আমি এখন তোমাদের কী বিষয় বলতে যাচ্ছি?
সবাই বলে উঠল, আজ্ঞে সে তো আমরা জানি না।
মোল্লা বলল, এটাও যদি না জানো তা হলে আর আমি কী বলব! যাদের বলব তারা এত অজ্ঞ হলে চলে কী করে?
এই বলে নাসিরুদ্দিন রাগে গজগজ করতে করতে মসজিদ ছেড়ে সোজা বাড়ি চলে এল।
গাঁয়ের লোক নাছোড়বান্দা। তারা আবার তার বাড়িতে গিয়ে হাজির।
আজ্ঞে, আসছে শুক্রবার আপনাকে আর একটিবার আসতেই হবে মসজিদে।
নাসিরুদ্দিন গেল, আর আবার সেই প্রথম দিনের প্রশ্ন দিয়েই শুরু করল। এবার সব লোকে একসঙ্গে বলে উঠল, আজ্ঞে হ্যাঁ, জানি।
সবাই জেনে ফেলেছ? তা হলে তো আর আমার কিছু বলার নেই,এই বলে নাসিরুদ্দিন আবার বাড়ি ফিরে গেল। গাঁয়ের লোক তবুও ছাড়ে না। পরের শুক্রবার নাসিরুদ্দিন আবার মসজিদে হাজির হয়ে তার সেই বাঁধা প্রশ্ন করল। এবার আর মোল্লাকে রেহাই দেবে না গাঁয়ের লোক, তাই অর্ধেক বলল জানি, অর্ধেক বলল জানি না।
বেশ, তা হলে যারা জানো তারা বলল, আর যারা জানো না তারা শোনো–এই বলে নাসিরুদ্দিন আবার ঘরমুখো হল।
.
৩৪.
নাসিরুদ্দিন বাড়ির ছাতে কাজ করছে, এমন সময় এক ভিখিরি রাস্তা থেকে হাঁক দিল, মোল্লাসাহেব, একবারটি নীচে আসবেন?
নাসিরুদ্দিন ছাত থেকে রাস্তায় নেমে এল। ভিখিরি বলল, দুটি ভিক্ষে দেবেন মোল্লাসাহেব?
তুমি এই কথাটা বলার জন্য আমায় ছাত থেকে নামালে?
ভিখিরি কাঁচুমাচু হয়ে বললে, মাফ করবেন মোল্লাসাহেব,–গলা ছেড়ে ভিক্ষে চাইতে শরম লাগে।
হুঁ…তা তুমি ছাতে এসো আমার সঙ্গে।
ভিখিরি তিনতলার সিঁড়ি ভেঙে ছাতে ওঠার পর নাসিরুদ্দিন বললে, তুমি এসো হে; ভিক্ষেটিক্ষে হবে না।
.
৩৫.
নাসিরুদ্দিন লেখাপড়া বেশি জানে না ঠিকই, কিন্তু তার গাঁয়ে এমন লোক আছে যাদের বিদ্যে তার চেয়েও অনেক কম। তাদেরই একজন নাসিরদ্দিনকে দিয়ে নিজের ভাইকে একটা চিঠি লেখালে। লেখা শেষ হলে পর সে বললে, মোল্লাসাহেব কী লিখলেন একবারটি পড়ে দেন, যদি কিছু বাদটাদ গিয়ে থাকে।
নাসিরুদ্দিন প্রিয় ভাই আমার পর্যন্ত পড়ে ঠেকে গিয়ে বললে, পরের কথাটা বাক্স না গরম না ছাগল সেটা বোঝা যাচ্ছে না।
সে কী মোল্লাসাহেব, আপনার লেখা চিঠি আপনিই পড়তে পারেন না তো অপরে পড়বে কী করে?
সেটা আমি কী জানি? বললে নাসিরুদ্দিন। আমায় লিখতে বললে আমি লিখলাম। পড়াটাও কি আমার কাজ নাকি?
লোকটা কিছুক্ষণ ভেবে মাথা নেড়ে বললে, তা ঠিকই বললেন বটে! আর এ চিঠি তো আপনাকে। লেখা নয়, কাজেই আপনি পড়তে না পারলে আর ক্ষতি কী?
হক কথা, বললে নাসিরুদ্দিন।
.
৩৬.
নাসিরুদ্দিন একবার ভারতবর্ষে এসে এক সাধুর দেখা পেয়ে ভাবলে, আমার মতো জ্ঞানপিপাসু ব্যক্তির পক্ষে সাধুর সাক্ষাৎ পাওয়া পরম সৌভাগ্য। এর সঙ্গে আলাপ না করলেই নয়!
তাঁকে জিজ্ঞেস করতে সাধু বললেন তিনি একজন যোগী; ঈশ্বরের সৃষ্ট যত প্রাণী আছে সকলের। সেবাই তাঁর ধর্ম।
নাসিরুদ্দিন বললে, ঈশ্বরের সৃষ্টি একটি মৎস্য একবার আমাকে মৃত্যুর কবল থেকে রক্ষা করেছিল।
এ-কথা শুনে যোগী আহ্লাদে আটখানা হয়ে বললেন, আমি এত দীর্ঘকাল প্রাণীর সেবা করেও তাদের এত অন্তরঙ্গ হতে পারিনি। একটি মৎস্য আপনার প্রাণরক্ষা করেছে শুনে এই দেখুন আমার রোমাঞ্চ হচ্ছে। আপনি আমার সঙ্গে থাকবেন না তো কে থাকবে?
নাসিরুদ্দিন যোগীর সঙ্গে থেকে তার কাছ থেকে যোগের নানা কসরত শিক্ষা করলে। শেষে একদিন যোগী বললেন, আর ধৈর্য রাখা সম্ভব নয়। অনুগ্রহ করে যদি সেই মৎস্যের উপাখ্যানটি শোনান।
একান্তই শুনবেন?
হে গুরু! বললেন যোগী, শোনার জন্য আমি উদগ্রীব হয়ে আছি।
তবে শুনুন, বললে নাসিরুদ্দিন, একবার খাদ্যাভাবে প্রাণ যায় যায় অবস্থায় আমার বঁড়শিতে একটি মাছ ওঠে। আমি সেটা ভেজে খাই।
.
৩৭.
এক ধনীর বাড়িতে ভোজ হবে খবর পেয়ে নাসিরুদ্দিন সেখানে গিয়ে হাজির।
ঘরের মাঝখানে বিশাল টেবিলের উপর লোভনীয় সব খাবার সাজানো রয়েছে রুপোর পাত্রে। টেবিল ঘিরে কুরসি পাতা, তাতে বসেছে হোমরা-চোমরা সব ভাইয়েরা। নাসিরুদ্দিন সেদিকে এগোতেই কর্মকর্তা তার মামুলি পোশাক দেখে তাকে ঘরের এক কোনায় ঠেলে দিলেন। নাসিরুদ্দিন বুঝলে সেখানে খাবার পৌঁছতে হয়ে যাবে রাত কাবার। সে আর সময় নষ্ট না করে সোজা বাড়ি ফিরে গিয়ে তোরঙ্গ থেকে তার ঠাকুরদাদার আমলের একটা ঝলমলে আলখাল্লা আর একটা মণিমুক্তো বসানো আলিশান পাগড়ি বার করে পরে আবার নেমন্তন্ন বাড়িতে ফিরে গেল।
এবার কর্মকর্তা তাকে একেবারে খাস টেবিলে বসিয়ে দিলেন, আর বসামাত্র নাসিরুদ্দিনের সামনে এসে হাজির হল ভুরভুরে খুশবুওয়ালা পোলাওয়ের পাত্র। নাসিরুদ্দিন প্রথমেই পাত্র থেকে খানিকটা পোলাও তুলে নিয়ে তার আলখাল্লায় আর পাগড়িতে মাখিয়ে দিলে। পাশে বসেছিলেন এক আমীর। তিনি ভারী অবাক হয়ে বললেন, জনাব, আপনি খাদ্যদ্রব্য যেভাবে ব্যবহার করছেন তা দেখে আমার কৌতূহল জাগ্রত হয়েছে। এই প্রক্রিয়ার অর্থ জানতে পারলে আমি বিশেষ বাধিত হব।
অর্থ, খুবই সোজা, বললে নাসিরুদ্দিন। এই আলখাল্লা আর এই পাগড়ির দৌলতেই আমার সামনে এই ভোজের পাত্র। এদের ভাগ না দিয়ে আমি একা খাব সে কি হয়?
.
৩৮.
একদিন রাত্রে দুজনের পায়ের শব্দ পেয়ে নাসিরুদ্দিন ভয়ে একটা আলমারিতে ঢুকে লুকিয়ে রইল।
লোক দুটো ছিল চোর। তারা বাক্সপ্যাঁটরা সবই খুলছে, সেইসঙ্গে আলমারিটাও খুলে দেখে তাতে মোল্লাসাহেব ঘাপটি মেরে আছেন।
কী হল মোল্লাসাহেব, লুকিয়ে কেন?
লজ্জায়, বললে নাসিরুদ্দিন। আমার বাড়িতে তোমাদের নেবার মতো কিছুই নেই তাই লজ্জায় মুখ দেখাতে পারছি না ভাই।
.
৩৯.
এক চাষা নাসিরুদ্দিনের কাছে এসে বললে, বাড়িতে চিঠি দিতে হবে মোল্লাসাহেব। মেহেরবানি করে আপনি যদি লিখে দেন।
নাসিরুদ্দিন মাথা নাড়লে। সে হবে না।
কেন মোল্লাসাহেব?
আমার পায়ে জখম।
তাতে কী হল মোল্লাসাহেব? চাষা অবাক হয়ে বললে, পায়ের সঙ্গে চিঠির কী?
নাসিরুদ্দিন বললে, আমার হাতের লেখা কেউ পড়তে পারে না। তাই চিঠির সঙ্গে আমাকেও যেতে হবে সে চিঠি পড়ে দিতে। জখম পায়ে সেটা হবে কী করে শুনি?
.
৪০.
নাসিরুদ্দিন এক বাড়িতে চাকরের কাজ করছে। মনিব তাকে একদিন ডেকে বললেন, তুমি অযথা সময় নষ্ট করো কেন হে বাপু? তিনটে ডিম আনতে কেউ তিনবার বাজার যায়? এবার থেকে একবারে সব কাজ সেরে আসবে।
একদিন মনিবের অসুখ করেছে, তিনি নাসিরুদ্দিনকে ডেকে বললেন, হাকিম ডাকো।
নাসিরুদ্দিন গেল, কিন্তু ফিরল অনেক দেরিতে, আর সঙ্গে একগুষ্টি লোক নিয়ে।
মনিব বললেন, হাকিম কই?
তিনি আছেন, আর সঙ্গে আরও আছেন, বললে নাসিরুদ্দিন।
আরও কেন?
আজ্ঞে হাকিম যদি বলেন পুলটিশ দিতে, তার জন্য লোক চাই। জল গরম করতে কয়লা লাগবে, কয়লাওয়ালা চাই। আপনার শ্বাস উঠলে পর কোরান পড়ার লোক চাই, আর আপনি মরলে পরে লাশ বইবার লোক চাই।
৪১.
রাজামশাই একদিন নাসিরুদ্দিনকে ডেকে বললেন, বনে গিয়ে ভাল্লুক মেরে আনো।
নাসিরুদ্দিন রাজার আদেশ অমান্য করে কী করে? অগত্যা তাকে যেতেই হল।
বন থেকে ফেরার পর একজন তাকে জিজ্ঞেস করলে, কেমন হল শিকার, মোল্লাসাহেব?
চমৎকার, বললে নাসিরুদ্দিন।
কটা ভাল্লুক মারলেন?
একটিও না।
বটে? কটাকে ধাওয়া করলেন?
একটিও না।
সে কী। কটা দেখলেন?
একটিও না।
তা হলে চমৎকারটা হল কী করে?
ভাল্লুক শিকার করতে গিয়ে সে জানোয়ারের দেখা না পাওয়ার চেয়ে চমৎকার আর কী হতে পারে?
.
৪২.
এক পড়শি এসেছে নাসিরুদ্দিনের কাছে এক আর্জি নিয়ে।
মোল্লাসাহেব, আপনার গাধাটা যদি কিছুদিনের জন্য ধার দেন তো বড় উপকার হয়।
মাফ করবেন, বললে নাসিরুদ্দিন, ওটা আরেকজনকে ধার দিয়েছি।
কথাটা বলামাত্র বাড়ির পিছন থেকে গাধা ডেকে উঠে তার অস্তিত্ব জানান দিয়ে দিল।
সে কী মোল্লাসাহেব, ওটা আপনারই গাধার ডাক শুনলাম না?
নাসিরুদ্দিন মহারাগে লোকটার মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দেওয়ার সময় বললে, আমার কথার চেয়ে আমার গাধার ডাককে যে বেশি বিশ্বাস করে, তাকে কোনওমতেই গাধা ধার দেওয়া চলে না।
.
৪৩.
এক বেকুবের শখ হয়েছে সে পণ্ডিত হবে। সে মনে মনে ভাবলে মোল্লার তো নামডাক আছে পণ্ডিত হিসেবে, তার কাছেই যাওয়া যাক, যদি কিছু শেখা যায়।
অনেকখানি পথ পাহাড় ভেঙে উঠে সে খুঁজে পেলে নাসিরুদ্দিনের বাসস্থান। ঢোকবার আগে জানলা দিয়ে দেখলে মোল্লাসাহেব ঘরের এককোণে ধুনুচির সামনে বসে নিজের দু হাতের তেলো মুখের সামনে ধরে তাতে ফুঁ দিচ্ছে।
ঘরে ঢুকে বেকুব প্রথমেই হাতে ফুঁ দেওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করলে। ফুঁ দিয়ে হাত গরম করছিলাম, বলে নাসিরুদ্দিন চুপ করলে। বেকুব ভাবলে, একটা জিনিস তো জানা গেল। আর কিছু জানা যাবে কি?
কিছুক্ষণ পরে নাসিরুদ্দিনের গিন্নি দুবাটি গরম দুধ এনে কর্তা আর অতিথির সামনে রাখলেন। নাসিরুদ্দিন তক্ষুনি দুধে ফুঁ দিতে শুরু করলে।
এবার বেকুব সম্ভ্রমের সঙ্গে শুধোলে, হে গুরু, এবারে ফুঁ দেবার কারণটা কী?
দুধ ঠাণ্ডা করা, বললে নাসিরুদ্দিন।
বেকুব বিদায় নিলেন। যে লোক বলে ফুঁ দিয়ে জিনিস গরম হয়, আবার ঠাণ্ডাও হয়, তার কাছ থেকে জ্ঞানলাভের কোনও আশা আছে কি?
.
৪৪.
মোল্লা এখন কাজি, সে আদালতে বসে। একদিন এক বুড়ি তার কাছে এসে বললে, আমি বড়ই গরিব। আমার ছেলেকে নিয়ে বড় ফ্যাসাদে পড়েছি কাজিসাহেব। সে মুঠো মুঠো চিনি খায়, তাকে আর চিনি জুগিয়ে কুল পাচ্ছি না। আপনি হুকুম দিয়ে তার চিনি খাওয়া বন্ধ করুন। সে আমার কথা শোনে না।
মোল্লা একটু ভেবে বললে, ব্যাপারটা অত সহজ নয়। এক হপ্তা পরে এসো, আমি একটু বিবেচনা করে তারপর এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেব।
বুড়ি হুকুমমতো এক হপ্তা পরে আবার এসে হাজির! মোল্লা তাকে দেখে মাথা নাড়লে।–এ বড় জটিল মামলা। আরও এক হপ্তা সময় দিতে হবে আমাকে।
আরও সাতদিন পরেও সেই একই কথা। অবশেষে ঠিক এক মাস পরে মোল্লা বুড়িকে বললে, কই, ডাকো তোমার ছেলেকে।
ছেলেটি আসতেই মোল্লা তাকে হুঙ্কার দিয়ে বললে, দিনে আধ ছটাকের বেশি চিনি খাওয়া চলবে। যাও।
বুড়ি মোল্লাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বললে, একটা কথা জিজ্ঞেস করার ছিল, কাজিসাহেব।
বলো।
এই নিয়ে চারবার ডাকলেন কেন আমাকে? এর অনেক আগেই তো আপনি এ হুকুম দিতে পারতেন।
তোমার ছেলেকে হুকুম দেবার আগে আমার নিজের চিনি খাওয়ার অভ্যেস কমাতে হবে তো! বললে নাসিরুদ্দিন।
.
৪৫.
রাস্তার কয়েকটি ছোঁকরা ফন্দি করেছে তারা মোল্লাসাহেবের জুতোজোড়া হাত করবে। একটা লম্বা গাছের দিকে দেখিয়ে তারা মোল্লাসাহেবকে বললে, ওই যে গাছ দেখছেন, ওটায় চড়ার সাধ্যি কারুর নেই।
আমার আছে, বলে মোল্লাসাহেব জুতোজাড়া পা থেকে না খুলেই গাছটায় চড়তে শুরু করলেন। বেগতিক দেখে ছেলেরা চেঁচিয়ে বলল, ও মোল্লাসাহেব, ওই গাছে আপনার জুতো কোনও কাজে লাগবে কি?
মোল্লাসাহেব গাছের উপর থেকে জবাব দিলেন, গাছের মাথায় যে রাস্তা নেই তা কে বলতে পারে?
.
৪৬.
নাসিরুদ্দিন বাজারে গিয়ে এক নিলামদারের হাতে তার গাধাটিকে তুলে দিলে। সেটাকে দিয়ে আর কাজ চলে না, তাই একটা নতুন গাধা কেনা দরকার।
আর পাঁচরকম জিনিস পাচার হয়ে যাবার পর গাধা যখন নিলামে উঠল, নাসিরুদ্দিন তখন কাছাকাছির মধ্যেই রয়েছে। নিলামদার হাঁক দিলে, এবার দেখুন এই অসামান্য, অতুলনীয় গাধা। পাঁচ স্বর্ণমুদ্রা কে দেবেন এর জন্য? মাত্র পাঁচ স্বর্ণমুদ্রা!
এক চাষা হাত তুললে। দর এত কম দেখে মোল্লাসাহেব নিজেই হেঁকে বসলেন, ছয় স্বর্ণমুদ্রা।
ওদিকে অন্য লোকেও ডাকতে শুরু করেছে, আর নিলামদারও গাধার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। দর যত বাড়ে ততই বাড়ে গুণের ফিরিস্তি।
চাষা ও মোল্লাসাহেবের মধ্যে ডাকাডাকিতে গাধার দাম চড়ে চল্লিশ স্বর্ণমুদ্রায় পৌঁছে শেষটায় মোল্লাসাহেবেরই জিত হল। গাধার আসল দাম ছিল বিশ স্বর্ণমুদ্রা, অর্থাৎ লোকসান হল দ্বিগুণ।
কিন্তু তাতে কী এসে গেল? যে গাধার এত গুণ, বললে মোল্লাসাহেব, তার জন্য চল্লিশ স্বর্ণমুদ্রা তো জলের দর।
.
৪৭.
নাসিরুদ্দিন মওকা বুঝে একজনের সবজির বাগানে গিয়ে হাতের সামনে যা পায় থলেতে ভরতে শুরু করেছে।
এদিকে মালিক এসে পড়েছেন। কাণ্ড দেখে তিনি হন্তদন্ত নাসিরুদ্দিনের দিকে ছুটে এসে বললেন, ব্যাপারটা কী?
নাসিরুদ্দিন বললে, ঝড়ে উড়িয়ে এনে ফেলেছে আমায় এখানে।
আর খেতের সবজিগুলোকে উপড়ে ফেলল কে?
ওড়ার পথে ওগুলিকে খামচে ধরে তবে তো রক্ষা পেলাম।
আর সবজিগুলো থলের মধ্যে গেল কী করে?
সেই প্রশ্নই তো আমাকেও চিন্তায় ফেলেছিল, এমন সময় আপনি এসে পড়লেন।
.
৪৮.
মোল্লাগিন্নি মাঝরাত্তিরে নাসিরুদ্দিনের ঘুম ভাঙিয়ে বললেন, ব্যাপার কী? চশমা পরে ঘুমোচ্ছ কেন?
মোল্লা নতুন চশমা নিয়েছে। খাপ্পা হয়ে বললে, চোখে চালশে পড়েছে, চশমা ছাড়া স্বপ্ন দেখব কী করে?
.
৪৯.
থলেতে একঝুড়ি ডিম লুকিয়ে নিয়ে নাসিরুদ্দিন চলেছে ভিনদেশে। সীমানায় পৌঁছতে শুল্ক বিভাগের লোক তাকে ধরলে। নাসিরুদ্দিন জানে ডিম চালান নিষিদ্ধ।
মিথ্যে বললে মৃত্যুদণ্ড বললে শুল্ক বিভাগের লোক। তোমার থলেতে কী আছে বলো।
প্রথম অবস্থার কিছু মুরগি, বললে মোল্লাসাহেব।
হুম–সমস্যার কথা। মুরগি চালান নিষিদ্ধ কিনা খোঁজ নিতে হবে, তারপর ব্যাপারটার মীমাংসা হবে। ততদিন এ থলি রইল আমাদের জিম্মায়। ভয় নেই, তোমার মুরগিকে উপোস রাখব না আমরা।
কিন্তু আমার মুরগির জাত যে একটু আলাদা, বললে নাসিরুদ্দিন।
কীরকম।
আপনারা তো শুনেছেন অবহেলার দরুন মুরগির অকাল বার্ধক্য আসে।
তা শুনেছি বটে!
আমার মুরগিকে ফেলে রাখলে সেগুলো অকালে শিশু হয়ে যায়!
শিশু মানে?
একেবারে শিশু, বললে নাসিরুদ্দিন, যাকে বলে ডিম।
.
৫০.
মোল্লা মসজিদে গিয়ে বসেছে, তার জোব্বাটা কিঞ্চিৎ খাটো দেখে তার পিছনের লোক সেটাকে টেনে খানিকটা নামিয়ে দিলে। মোল্লা তৎক্ষণাৎ তার সামনের লোকের জোব্বাটা ধরে নীচের দিকে দিলে এক টান। তাতে লোকটি পিছন ফিরে চোখ রাঙিয়ে বললে, এটা কী হচ্ছে?
মোল্লা বললে, এ প্রশ্নের জবাব দিতে পারে আমার পিছনের লোক।
Post a Comment