ব্যাড বয় – আহসান হাবীব

ব্যাড বয় – আহসান হাবীব

মাহি স্কুল থেকে বাসায় এসে দেখে, ড্রয়িংরুমে পায়ের ওপর পা তুলে বসে আছে মন্টু মামা। ওপরের পা–টা টিকটিকির খসে পড়া লেজের মতো তিরতির করে কাঁপছে। বাবাও বসে আছে, তবে পেপারে মুখ ঢাকা। মাহিকে দেখে পেপারটা নামাল। বাবার মুখ গম্ভীর। কারণ পরিষ্কার। মন্টু মামাকে বাবা দুচোখে দেখতে পারে না। মা–ও মন্টু মামাকে পছন্দ করে না। তারপরও হঠাৎ হঠাৎ মন্টু মামা এসে হাজির হয়। তখনই গম্ভীর হয়ে যায় মা–বাবা দুজনই।

‘কী রে মাহি, খবর কী?’ ভ্রু নাচাল মন্টু মামা।

‘ভালো। মামা আজ রেজাল্ট হয়েছে। আমি ফার্স্ট হয়েছি।’

‘ফার্স্ট হয়েছিস?’ মামা হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেল। যেন ফার্স্ট হওয়াটা খুব খারাপ কাজ। ‘তুই তো গত বছরও ফার্স্ট হয়েছিলি?’

‘হ্যাঁ।’

‘তার আগের বছর?’

‘হ্যাঁ।’

‘ও সব সময়ই ফার্স্ট হয়।’ এবার পেপারটা নামাল বাবা। তার মুখটা একটু হাসি হাসি। অনেকটা পুত্র–গর্বে বাবারা যেমনটা হাসে। কিন্তু মামা গম্ভীর।

‘কোনো মানে হয় না, বুঝলি। সব সময় তোর ফার্স্ট হতে হবে কেন? অন্যদের একটু সুযোগ দিবি না? একবার না হয় সেকেন্ড হ, কিংবা থার্ড, ফোর্থ হ…বা ফেলই কর একবার, কী যায়–আসে?’

‘এসব কী বলছিস মন্টু?’ চায়ের কাপ হাতে মা কখন এসে দরজায় দাঁড়িয়েছে, ওরা কেউ খেয়ালই করেনি।

‘খারাপ কী বললাম আপা? আমি সাতটা স্কুলে পড়েছি। সাতটা স্কুলে সাতটা ফার্স্ট বয়। একটাকেও কোথাও দেখি না। মানে, ভালো কিছু হতে পারেনি। বড়জোর ডাক্তার হয়েছে, নইলে ইঞ্জিনিয়ার, না হলে বিদেশে গিয়ে সেকেন্ড ক্লাস সিটিজেন হয়ে ওয়ালমার্টে বিদেশি বউয়ের সঙ্গে ট্রলি ঠেলে বাজার করছে। লাভ কী? বরং খারাপ ছাত্রগুলো কিংবা ব্যাকবেঞ্চার ছিল যারা, তারা দিব্যি আছে…’

‘মন্টু তুই থামবি?’ মাহির মা তীব্র কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠল।

‘আচ্ছা থামলাম। চা কি আমার জন্য এনেছ?’ মাহির মা থমথমে মুখে চা–টা মাহির বাবার হাতে দিয়ে চলে গেল। মাহির কিন্তু পাগলাটে মন্টু মামার কথাগুলো বেশ মজাই লাগছিল। সে মন্টু মামার পাশে বসল এবং সে–ও টিকটিকির খসে পড়া লেজের মতো করে পা কাঁপাতে শুরু করল। ঠিক মন্টু মামার মতো করে।

‘মামা?’

‘বল।’

‘তার মানে তুমি বলছ, সব সময় ফার্স্ট হওয়ার কোনো দরকার নেই?’

‘না, নেভার।’

‘তুই একবার ফেল করে দেখ, চারপাশের সিনারিটা কেমন বদলে যায়। আশপাশের মানুষ…’

‘মন্টু!’ হঠাৎ চড়া গলায় চেঁচিয়ে ওঠে বাবা।

‘বলুন।’ মন্টু মামার মুখে মৃদু হাসি।

‘মাহি, তুমি একটু ভেতরে যাও।’ অনিচ্ছা সত্ত্বেও উঠে চলে গেল মাহি।

‘মন্টু, তুমি নিজেকে কী ভাবো?’

‘এই মুহূর্তে আমি মাহির মামা। দ্য অনলি ম্যাটারনাল আঙ্কেল।’

‘তুমি রোকেয়ার দূরসম্পর্কের ভাই। মাহির আপন মামাও না।’

‘দুলাভাই, তাতে কিছু যায়–আসে না। মামা তো মামাই…’

‘শোনো, আমি তোমাকে পরিষ্কার করে একটা কথা বলতে চাই।’

‘বলুন।’

‘তুমি এ বাসায় আসো, এটা আমার পছন্দ না। আই থিঙ্ক, রোকেয়ারও…’

‘আচ্ছা, আর আসব না। কিন্তু এসে যখন পড়েছি, চা-টা খেয়েই যাই।’ ঠিক তখনই জরিনা খালা চা নিয়ে ঢুকল। মামা বলল,

‘একি জরিনা খালা, শুধু চা? আগে তো বিস্কুট–চানাচুর কিছু একটা থাকত…অ্যাঁ?’

মামার বলার ধরনে জরিনা খালা ফিক করে হেসে আঁচল দিয়ে মুখ ঢেকে চলে গেল।

তবে চা–টা আয়েশ করে খেল মন্টু, ওরফে সাইদুল আলম, মাহির দূরসম্পর্কের মামা। বুয়েট থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে এখন বেকার। স্বেচ্ছাবেকার বলা যেতে পারে। আরও কিছুক্ষণ বসল মন্টু। তারপর হঠাৎ ‘দুলাভাই, তাহলে চলি’ বলে হন্তদন্ত হয়ে উঠে চলে গেল, যেন তার হঠাৎ কোনো কাজের কথা মনে পড়ে গেছে। মাহির বাবা ফিসফিস করে বলল, ‘ইডিয়ট একটা!’

মন্টু মামা চলে গেছে শুনে একটু মন খারাপ করল মাহি। তাকে না বলে চলে গেল। অবশ্য বেচারারই–বা দোষ কী? মা–বাবা কেউ ভালো করে এই মামার সঙ্গে কথাই বলে না। তবে মামার কথাটা ভাবতে লাগল মাহি। তাই তো, সব সময় তার ফার্স্ট হতে হবে কেন? ফার্স্ট না হলেই–বা কী যায়–আসে? সে তখন ভাবতে বসল…ফার্স্ট হলে লাভ কী কী আর না হলে লাভ কী কী…মানে সে ভালো ছাত্র আর খারাপ ছাত্রের একটা বিশ্লেষণ করতে বসল মনে মনে…

১) ফার্স্ট হলে লাভ, স্যাররা সবাই পছন্দ করেন।

২) মা–বাবাও পছন্দ করে। সবাই প্রশংসা করে, পাড়ার লোকজনও প্রশংসার চোখে তাকায়।

৩) তবে ক্লাসের অর্ধেক ছেলে তাকে পছন্দ করে না।

৪) সব সময় গুড বয় হয়ে থাকতে হয়।

৫) দুষ্টুমি করতে ইচ্ছা করলেও করে না। কারণ, সে যে ফার্স্ট বয়।

৬) ফার্স্ট বয় দেখে কখনো স্কুল পালায়নি। জীবনে কোনো অ্যাডভেঞ্চার নেই।

৭) স্কুলের টিফিন চুরি করে খেয়ে দেখেনি কেমন লাগে!

৮) ঝড়–বৃষ্টি–বাদল কখনো স্কুল মিস দেয় না। ওদিকে খারাপ ছাত্ররা বৃষ্টির দিনে স্কুল ফাঁকি দিয়ে ড্রেনের মধ্যে কাগজের নৌকা ছেড়ে রেস লাগায়, ফুর্তি করে, বৃষ্টির মধ্যে জাম্বুরা দিয়ে ফুটবল খেলে কী মজাটাই না করে!

৯) …

মাহি হিসাব করে দেখল, ফার্স্ট হয়ে আসলে স্যারদের সুনজরে পড়া ছাড়া আর খুব বেশি লাভ নেই। বরং যারা ক্লাসে ফার্স্ট–সেকেন্ড হয় না, মানে পড়াশোনায় ফাঁকিবাজ ছাত্র, তারা কিন্তু দিব্যি আছে। দুষ্টুমি করছে, ক্লাসের সবাইকে জ্বালাচ্ছে, স্যারদের বকা খাচ্ছে…স্কুলের গাছ বা পাড়ার এর–ওর বাগান থেকে এটা–সেটা চুরি করে খাচ্ছে…ইত্যাদি ইত্যাদি। আচ্ছা, খারাপ ছাত্র হলে কেমন হয়? মামা বলছিল সিনারিও বদলে যায়, সেটা কী ব্যাপার? মাহি ভাবল, আচ্ছা, একবার খারাপ ছাত্র হয়ে দেখা যাক না কী হয়। গুড বয় থেকে ব্যাড বয়! মাত্র একবার…

আবদুল আজিজ স্যার মাহিদের মডেল স্কুলের ত্রাস। তার ক্লাসে হোমওয়ার্ক না করে এলে ভয়ংকর সব শাস্তি পেতে হয়। তার শাস্তির ধরনও ভয়ংকর। একবার এক অভিভাবক কমপ্লেন করেছিলেন আজিজ স্যারের বিরুদ্ধে। আর কী আশ্চর্য! সেই স্যারের কিছুই হলো না, উল্টো ওই ছেলেকে স্কুল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল, মানে টিসি দেওয়া হয়েছিল। আসলে আজিজ স্যারের খুঁটির জোর অনেক, সবাই তা–ই বলে। সেটা ঠিক কোথায়, সেটা অবশ্য কেউ জানে না। দেশে এখন আইন হয়েছে, কোনো স্কুলেই ছাত্রছাত্রীদের এগারো রকমভাবে মারা চলবে না। এই আইনও স্যারের ভালোই জানা আছে। তাতে কী, স্যার তার নিজস্ব আইন নিয়ে দিব্যি আছেন।

তবে মাহির এই স্যারকে নিয়ে টেনশন নেই, কারণ সে যে অলটাইম গুড বয়। কোনো দিন ক্লাস মিস দেয় না, হোমওয়ার্ক মিস দেয় না, তার ভয় কী। আজিজ স্যার বোধ হয় ওই একজন, মানে মাহিকে কখনো কিছু বলেন না। কিন্তু মাহি ঠিক করেছে, ওই আজিজ স্যারের ক্লাস দিয়েই শুরু হবে তার অ্যাডভেঞ্চার। আসলেই মামা ঠিক বলেছে, তার জীবনে কোনো অ্যাডভেঞ্চার নেই। ‘ব্যাড বয়’ হয়ে একটা অ্যাডভেঞ্চার করা যাক না। দেখি, সিনারিটা কী বদলায়। সিনারি ব্যাপারটাও বোঝার দরকার আছে।

কিন্তু আজিজ স্যারের বেতের বাড়ি মাহি হজম করতে পারবে কি? স্যার মাথার পেছনের চুল ধরে পিঠের ওপর সপাসপ বেত মারেন। গুনে গুনে পাঁচ-সাতটা বাড়ি, কখনো বেশিও হয়। খবর হয়ে যায় সবার। ঠিক তখনই মাথায় এল বুদ্ধিটা। গল্পটা শুনেছিল নানার কাছে। নানারা যখন ছোট ছিলেন, তখন তাদের গ্রামের পাঠশালার এক পণ্ডিত স্যার ছিলেন, অসম্ভব বদরাগী। ভয়ানক নাকি পেটাতেন। তখন নানা বুদ্ধি করে তার ফতুয়ার নিচে পিঠে কুলা বেঁধে গিয়েছিলেন একবার। ব্যাপারটা সত্যিই কাজ করে কি না, দেখা যাক না। মাহি রান্নাঘরে গেল।

‘মা কুলা আছে?’

‘কেন, কুলা দিয়ে কী হবে?’

‘একটু দরকার আছে।’

‘ওই যে। আবার দিয়ে যাস।’

‘আচ্ছা।’

নিজের ঘরে এসে কুলাটা পিঠের ওপর দিয়ে দেখল একবারে খাপে খাপ। কোমরের একটু ওপরে পেটের কাছে বেল্ট দিয়ে আচ্ছা করে বাঁধল। তার ওপর একটা টি–শার্ট পরল, এর ওপর স্কুলের শার্ট, তার ওপর জ্যাকেটটা। বোঝার কোনো উপায়ই নেই। ভাগ্যিস শীত চলে গেলেও এখনো কেউ কেউ শীতের কাপড় পরে স্কুলে আসে। তাই জ্যাকেটটা পরা গেছে। এই সময় বুয়া এল।

‘মাহি।’

‘কী?’

‘কুলা বুলে আনছ?’

‘কুলা? কখন?’ মাহি ভেতরে–ভেতরে খুশি, বুয়া তাকে দেখেও বুঝতে পারেনি যে তার পিঠে আস্ত একটা কুলা বাঁধা আছে।

‘খালায় তো কইল…।’ বলে বুয়া গজ গজ করতে করতে চলে গেল।

মাহি স্কুলের ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে স্কুলে রওনা হলো। মা চেঁচাল,

‘কী রে মাহি, কুলাটা কই?’

‘আমি তো জানি না।’

‘কেন, তুই না চাইলি?’

‘চেয়েছিলাম, নিইনি তো। এখন আর লাগবে না। খুঁজে দেখো রান্নাঘরেই আছে। যাই, আমার স্কুলের দেরি হয়ে যাচ্ছে।’ মা আর বুয়া হতভম্ব হয়ে কুলা খুঁজতে লাগল, এইখানেই কুলাটা ছিল, এখন উধাও! মানে কী? আর ওই ফাঁকে মাহি এক লাফে একদম বাসার বাইরে।

আজ সোমবার সেকেন্ড পিরিয়ডে আজিজ স্যারের সমাজবিজ্ঞানের ক্লাস। স্যার চলে এসেছেন। ক্লাসে পিনপতন নিস্তব্ধতা। স্যারের হাতে বেত, আজ ছয়জন হোমওয়ার্ক আনেনি। সপাসপ বেত চলছে। স্যারও যেন ক্লান্ত বেত মারতে মারতে। হঠাৎ মাহি হাত তুলল।

‘স্যার?’

‘কী হলো?’ স্যার তখন ছয়জনকে পিটিয়ে বেশ ক্লান্ত।

‘স্যার, আমিও হোমওয়ার্ক আনিনি।’

স্যার একটা হাসি দিলেন, যেন মাহি স্যারের সঙ্গে মজা করছে। এমন একটা তেলতেলে হাসি।

‘সত্যিই আনিনি স্যার। আমাকে মারবেন না? ওদের মারলেন।’ হঠাৎ স্যারের ভ্রু কুঁচকে গেল।

‘আনিসনি কেন?’

‘ইচ্ছা করল না স্যার। অন্য পড়া ফেলে প্রতিদিন সাত-আট পাতা হোমওয়ার্ক বিরক্তিকর।’ ক্লাসের সবাই হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে মাহির দিকে। যারা একটু আগে মার খেয়ে ব্যথায় অল্পবিস্তর কোঁকাচ্ছিল, তারা পর্যন্ত মারের ব্যথা ভুলে তাকিয়ে আছে মাহির দিকে, মাহি বলে কী! স্যার বসে পড়েছিলেন, উঠে দাঁড়ালেন আবার। তারপর মাহির সামনে এসে দাঁড়ালেন। হঠাৎ মাহির মাথার পেছনটা ধরে নিচু করে সপাসপ মারতে লাগলেন পিঠে। আর সঙ্গে সঙ্গে গর্জাতে লাগলেন,

‘অ্যাঁ, বিরক্তিকর? হোমওয়ার্ক বিরক্তিকর? আমার সঙ্গে ইয়ার্কি? ফার্স্ট বয় হয়ে তেল হয়েছে?’

একসময় স্যার থামলেন, তিনি তখন রীতিমতো হাঁপাচ্ছেন। কিন্তু মাহি কিছু টেরই পেল না। সব মার পিঠে বাঁধা কুলার ওপর দিয়ে গেছে। নানার বুদ্ধিটা তো সত্যিই দারুণ। সোজা হয়ে দাঁড়াল মাহি, যেন কিছুই হয়নি। তারপর খুব স্বাভাবিক গলায় বলল,

‘স্যার আরও মারবেন, নাকি বসব?’

মাহির কথায় হঠাৎ পুরো ক্লাস হো হো করে হেসে উঠল। শুধু হেসে উঠল বলা ঠিক হলো না। সবাই টেবিল চাপড়ে চিৎকার–চেঁচামেচি করে মুহূর্তের মধ্যে ক্লাসটাকে যেন নরক বানিয়ে ফেলল। আজিজ স্যার হতভম্ব হয়ে গেলেন। তার ফরসা মুখ টকটকে লাল হয়ে গেল। তিনি কী করবেন, ঠিক যেন বুঝতে পারছেন না। হঠাৎ তার বেতটা টেবিলের ওপর ফেলে হনহন করে ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেলেন। যেন তিনি পালিয়ে গেলেন। ক্লাসের সবাই ঘিরে ধরল মাহিকে। হইহুল্লোড়, চিৎকার–চেঁচামেচি চলতেই লাগল…এই সময় টিফিন নিয়ে এল টিফিন ক্যাপ্টেন আরজু। আজকের টিফিন লাড্ডু আর প্যাটিস। সবাই লাড্ডুটা মাহিকে সাধাসাধি করতে লাগল। মাহিও গোটা তিনেক খেয়েই ফেলল। মাহি টের পেল, সত্যি, ব্যাড বয় হওয়ার মজা তো কম না। এর মধ্যে ঢং ঢং করে ঘণ্টা বাজল।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, ওই ঘটনার পর আজিজ স্যার আর ওদের ক্লাস নেননি। অন্য ক্লাসেও বেত নিয়ে মারধর করেননি। তিনি যেন হঠাৎ কেমন চুপসে গেছেন। মুহিত অবশ্য গম্ভীর হয়ে বলে, ‘তোর ওই ট্রিটমেন্টের কারণে আজিজ স্যারের ট্রমা হয়েছে।’ মুহিতের বাবা একজন বিখ্যাত সাইকিয়াট্রিস্ট; সে মাঝেমধ্যেই কঠিন কঠিন সব শব্দ বলে ফেলে।

‘আচ্ছা, ওই দিন আজিজ স্যার তোকে এত মারল, তুই ব্যথা পাসনি?’

‘একটুও না।’

‘কীভাবে সম্ভব?’

‘মেডিটেশন।’ গম্ভীর হয়ে বলে মাহি। মাহি খেয়াল করল, ব্যাড বয় হওয়ার পর থেকেই বেশ মিথ্যা কথা বলতে শুরু করেছে সে। কুলা নিয়ে মায়ের সঙ্গে প্রথম মিথ্যা বলার শুরু। অবশ্য এক বিখ্যাত লেখক অন্য কথা বলেছেন তার একটা বইয়ে, মাহি পেয়েছে। প্রতিটি মিথ্যা কথাই নাকি একেকটা ক্রিয়েটিভ গল্প। একটা মিথ্যা কথা বললে ওটা ঢাকতে আরও দশটা মিথ্যা কথা বলতে হয়…তার মানে কী হলো? তার মানে এগারোটা মিথ্যা কথা বলতে হলো, অর্থাৎ এগারোটা গল্প তৈরি হলো!

খুব শিগগির মাহির মা–বাবাকে একদিন হেডস্যার ডেকে পাঠালেন। তারা দুজনেই আশ্চর্য হলো। আবার খুশিও হলো, মাহি নিশ্চয়ই আউটস্ট্যান্ডিং কিছু করেছে স্কুলে। তাই ডেকে পাঠিয়েছেন হেডস্যার। তারা খুশিমনেই একদিন গেল স্কুলে, মাহিকে পর্যন্ত বলল না। ওকে পরে সারপ্রাইজ দেওয়া যাবে।

‘আপনারাই তাহলে মাহি, মানে মাহিউল আলমের মা–বাবা?’

‘জি।’

‘আচ্ছা, ঠিক করে বলুন তো মাহির কী হয়েছে?’

‘মানে, কী হবে?’

‘আপনারা কিছুই জানেন না?’

‘কী জানব?’

‘ও যে ঠিকমতো ক্লাস করে না। হোমওয়ার্ক করে না, টিফিনের পর প্রায়ই পালিয়ে যায়। হাফইয়ার্লি পরীক্ষায় সব সাবজেক্টে টেনেটুনে ৩৩ পেয়েছে। এক সাবজেক্টে ফেল। নেহাত ফার্স্ট বয় ছিল বলে পাস করিয়ে দেওয়া হয়েছে। এসব আপনারা কিছুই জানেন না?’

‘এসব কী বলছেন আপনি?’ মা–বাবা দুজনেই হতভম্ব!

‘আপনারা কেমন গার্জিয়ান? ছেলের কোনো খোঁজখবরই রাখেন না। এই হোসেন! হোসেন!’ পিয়ন হোসেন এসে দাঁড়াল।

‘যাও তো, ক্লাস সেভেনের মাহিকে ডেকে নিয়ে আসো।’ ‘জি স্যার’ বলে ছুটল হোসেন। একটু পর এসে বলল, ‘স্যার, ও আজ স্কুলে আসেনি।’

‘ওই দেখুন।’ বললেন হেডস্যার। ‘কী ছেলে তৈরি করেছেন আপনারা? সে কী ছিল আর কী হয়েছে! এর মানে কী? এ রকম ছাত্র তো আমি স্কুলে রাখব না।’

মাহির বাবা আফজাল হোসেন আর মা রোকেয়া বেগম দুজনই কোনোরকমে টলতে টলতে বাসায় ফিরল। মা সঙ্গে সঙ্গে বিছানা নিল। আর বাবা চিৎকার করতে লাগল, ‘এসব হয়েছে তোমার ভাই ওই মন্টুর কারণে। ওই ফাজিলটা ওর মাথাটা নষ্ট করেছে। আমার সোনার টুকরা ছেলেটার মাথা বিগড়ে দিয়েছে। দাঁড়াও, ওকে আমি জেলের ভাত খাওয়াব। ও ভেবেছেটা কী…? আমি ওর বিরুদ্ধে মামলা যদি না করেছি, তো আমার নাম আফজাল হোসেন না…।’

কিন্তু আশ্চর্য হচ্ছে, সেদিন মাহি বাসায় ফিরল না। মাহি গেলটা কোথায়? সত্যিই মাহি কোথায়?

আজ স্কুলে যাওয়ার সময় বাবার কাছে ৫০ টাকা চেয়েছিল মাহি। বাবা তখন অফিসের উদ্দেশে বের হচ্ছিল। ‘৫০ টাকা দিয়ে কী হবে? আমার কাছে টাকা নেই।’ বলে গাড়িতে উঠে চলে গেল বাবা। মায়ের কাছে চাইল মাহি, আশ্চর্য, মা–ও ঠিক একই কথা বলল, ‘৫০ টাকা দিয়ে কী হবে? আমার কাছে এখন খুচরা টাকা নেই।’ আর কিছু বলল না মাহি। সে সোজা পাড়ার মোড়ের লাইব্রেরিতে গিয়ে তার বইগুলো সব বিক্রি করল। বোর্ডের পাঠ্যবই, ভালো দামই পেল। দোকানি একটু অবাক হলেও ১৯০ টাকা তুলে দিল মাহির হাতে। মাহি প্রথমে একটা আইসক্রিম কিনল। তারপর সেটা চাটতে চাটতে বেশ খানিকটা হেঁটে গিয়ে বাসস্ট্যান্ডটার বেঞ্চে বসল। বাসস্ট্যান্ডটা ফাঁকা। একটা বুড়ো লোক উবু হয়ে বসে আছে। হাতে একটা লাঠি। বুড়ো লোকটা তার দিকে তাকিয়ে একটু হাসল। তারপর ফিসফিস করে বলল, ‘আমাকে একটা খাতা আর কলম দিতে পারো?’

‘খাতা–কলম দিয়ে কী করবেন?’

‘কাজ আছে।’ তারপর যেটা বলল, সেটা শোনার জন্য মাহি প্রস্তুত ছিল না। বুড়োটা বলল,

‘আমাকে বাঁচাও!’ মাহির মনে হলো সে ভুল শুনেছে। কিন্তু বুড়ো লোকটা আবার বলল, ‘আমাকে বাঁচাও।’

‘আমাকে কিছু বলছেন?’

বুড়ো লোকটা মাথা নাড়ল, ফের বলল,

‘তুমি আমাকে বাঁচাও। আমার ছেলের হাত থেকে বাঁচাও।’

‘আপনার ছেলে কী করেছে?’

এই সময় একটা লোক এল। কড়া গলায় বলল, ‘বাবা চলো।’

বুড়ো লোকটা অসহায়ভাবে মাহির দিকে তাকাল, তারপর বাধ্য ছেলের মতো উঠে দাঁড়াল। লোকটা বেশ চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,

‘যা বলছি মন দিয়ে শোনো। তোমাকে ওল্ডহোমে ব্যবস্থা করে দিয়েছিলাম। সেখানে ওদের অফিসের খাতাপত্রে, দেয়ালে অঙ্ক করে বারোটা বাজিয়েছ ওদের প্রতিষ্ঠানের, ওরা বলেছে তোমাকে আর রাখবে না। তোমার মাথা খারাপ, তোমাকে মেন্টাল ক্লিনিকে নিয়ে যেতে। এখন আমি কী করব? মন দিয়ে শোনো…এখন আমি যা করতে যাচ্ছি, তোমার ভালোর জন্যই করছি। এখন যেখানে যাব, পথে কারও সঙ্গে কোনো কথা বলবে না। তোমাকে নতুন একটা জায়গায় নিয়ে যাচ্ছি। ওখানে তুমি ভালো থাকবে।’

বুড়ো লোকটা বিড়বিড় করে বলল, ‘রেনু…’

‘না, খবরদার ওই মেয়ের নাম উচ্চারণ করবে না। ও হচ্ছে বদের বদ একটা মেয়ে। ওখানে তোমার যাওয়া চলবে না। আমি যেখানে যাচ্ছি, ওখানেই চলো…’

লোকটা তখন একটা বাসে উঠে পড়ল। মাহির কী হলো কে জানে, সে-ও বাসটায় চড়ে বসল। বাসটা যাচ্ছে কোথায়, কে জানে। বাসের ভাড়া ফিক্সড, ৬০ টাকা। কন্ডাক্টরটা ভালো। ছাত্র বলে ওর কাছে হাফ ভাড়া নিল, ৩০ টাকা। বাসে বসে থাকতে থাকতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে মাহি, নিজেও জানে না। যখন ঘুম ভাঙল, দেখে বুড়ো আর ওই লোকটা নেই। মানে কী? সে লাফিয়ে উঠল। কন্ডাক্টরকে জিজ্ঞেস করল,

‘সামনের সিটের বুড়ো লোকটা কই?’

‘ওনারা তো আগের স্টপে নাইমা গেছেন।’

‘বলেন কী? আমাকে এখানে নামায়া দেন।’

‘হায় হায়, তুমি ওগোর সাথে? আগে বলবা না।’ বাস থামিয়ে ওকে নামিয়ে দেওয়া হলো।

উল্টো দিকের একটা বাস ধরে পেছনের বাসস্টপে ফিরে এল মাহি। কিন্তু আশ্চর্য, এখানে লোকজনই নেই। ফাঁকা বাসস্টপেজ। এটা যে একটা বাসস্টপেজ, কে বলবে? পেছনে জঙ্গলের মতো। হঠাৎ দেখে, দূরে একটা বেঞ্চে সেই বুড়ো লোকটা বসে আছে, হাতে সেই লাঠি, পায়ের কাছে একটা ছোট ক্যাম্বিসের ব্যাগ।

বুড়ো মাহিকে দেখে হাসল।

‘আপনার ছেলে কোথায়?’

‘আমাকে এখানে বসিয়ে রেখে বলছে, আমার ওষুধ আনতে যাচ্ছে, এখনই আসবে।’

‘কখন গেছে?’

‘অনেকক্ষণ, আসলে আমি জানি, সে আর আসবে না। আমাকে এখানে ফেলে গেছে।’ মাহি হতভম্ব হয়ে লোকটার পাশে বসল।

‘সত্যিই যদি না আসে, আপনি কী করবেন?’

‘জানি না, তুমি কে?’

‘আমাকে মনে নেই? আজ সকালেই তো দেখা হলো। আপনি একটা খাতা আর কলম চাইলেন।’

‘বলেছি নাকি? আমার মনে নেই। সব ভুলে যাই। খাতা এনেছ?’

‘জি না। আচ্ছা রেনু কে?’

বুড়ো লোকটা চমকে তাকাল মাহির দিকে। ফিসফিস করে বলল, ‘আমাকে রেনুর কাছে নিয়ে যেতে পারবে?’

‘কোথায় থাকেন উনি?’

‘তা তো জানি না।’

‘তাহলে কীভাবে যাব? রেনু কি আপনার মেয়ে?’

বুড়ো মাথা নাড়ে।

‘মনে করার চেষ্টা করে দেখুন না, উনি কোথায় থাকেন।’ মাহির কথার কোনো জবাব দিল না বুড়ো। মাথা গুঁজে বসে রইল লাঠি হাতে, হঠাৎ হালকা নাক ডাকার শব্দ পাওয়া গেল। দিব্যি ঘুমিয়ে পড়েছে লোকটা। আহা, বুড়োটার জন্য বড্ড মায়া হলো মাহির। এখন কী করবে মাহি? এ রকম বিপদে কী করা উচিত? তখনই বুদ্ধিটা এল। আচ্ছা, মন্টু মামাকে ফোন করলে কেমন হয়? মন্টু মামার ফোন নম্বরটা মনে করার চেষ্টা করল সে, হ্যাঁ আছে, মনে আছে। ০১৭৯…।

‘হ্যালো মন্টু?’

‘কে, আপা? কী খবর?’

‘কেন, তুই জানিস না খবর?’

‘মানে, কী খবর জানব?’

‘মাহি বাসা থেকে পালিয়েছে।’ ওপাশে মাহির মায়ের ফোঁপানোর শব্দ শোনা গেল।

‘কী বলছ? সত্যি? দ্যাটস গ্রেট!’

‘শাট আপ, বেয়াদব, শয়তান কোথাকার! তুই আমার সোনার টুকরা ছেলেটাকে নষ্ট করেছিস। আমি তোকে পুলিশে দেব। তুই ভেবেছিস কী? তুই এখন কোথায়?’

‘আচ্ছা আপা, ফোনে গালাগাল না শুনে তোমাদের বাসায় এসে সামনাসামনি গালাগাল শুনলে কেমন হয়? আমি আসছি…আপা আপা হ্যালো?’ ওপাশে ফোন রেখে দিয়েছে মাহির মা। ঠিক তখনই দ্বিতীয় ফোনটা এল।

‘হ্যালো!’

‘হ্যালো, মন্টু মামা?’

‘আরে মাহি! তুই নাকি বাসা থেকে পালিয়েছিস? দ্যাটস গ্রেট। পৃথিবীর অনেক বিখ্যাত মানুষই বাসা থেকে পালিয়েছিল। যেমন ধর, গোর্কি, হেমিংওয়ে, ইয়ান ফ্লেমিং, হেক্সার…। আচ্ছা, তুই ঠিক কোথায় আছিস বল তো?’

‘মামা, আগে আমার কথা মন দিয়ে শোনো। আমি একটা ফোনের দোকান থেকে ফোন করেছি।’

‘আচ্ছা বল।’

সব খুলে বলল মাহি। সেই ঢাকা থেকে বাসে করে বুড়োর পিছু নেওয়া, তারপর বুড়োকে হারিয়ে ফেলে আবার খুঁজে পাওয়া, এখন যে একটা বাসস্টপে বুড়োকে নিয়ে বসে আছে, বুড়োর ছেলে তাকে রেখে পালিয়েছে, বুড়ো যে মেয়ে রেনুর কথা বলছে…সব খুলে বলল। মন্টু মামা বলল,

‘ঠিক আছে, তুই যেখানে আছিস থাক। আমি আসছি।’

‘জায়গাটা চিনতে পেরেছ?’

‘তুই যতটুকু বললি আর বাকিটা গুগল ম্যাপের হেল্প নিয়ে আমি চলে আসতে পারব।’

‘কতক্ষণ লাগবে মন্টু মামা?’

‘আমি গাড়ি নিয়ে আসব। ছয় ঘণ্টার রাস্তা। পুলিশ যদি না ধরে, আমার আসতে লাগবে তিন ঘণ্টা।’

‘মানে, অর্ধেক সময়ে আসবে কীভাবে?’

‘সেটা আমি জানি আর আমার গাড়ি জানবে! বাই…আসছি।’

এবার অপেক্ষার পালা।

মাহি বুড়োকে ওই বেঞ্চে বসিয়ে রেখে বেশ অনেকটা হেঁটে একটা বাজারে এসেছে। ছোট্ট একটা বাজার। ভাগ্য ভালো, সেখানে ফোনের একটা দোকান পাওয়া গেছে। মোট ২২ টাকার কথা বলেছে মাহি। ফোনটা রেখে একটু শান্তি হলো। খিদে লেগেছে বেশ। একটা দোকানে ঢুকে শিঙাড়া খেল মাহি। বুড়োর জন্যও শিঙাড়া কিনল, সঙ্গে কলা আর পাউরুটি আর একটা পানির বোতল। এখানে কোনো ভাতের দোকান পাওয়া গেল না। এখন বুড়ো লোকটা কী খায় কে জানে। এতক্ষণে তারও নিশ্চয়ই খিদে লেগেছে।

ফিরে এসে দেখে, বেঞ্চটা খালি। বুড়ো লোকটা নেই। বেঞ্চের নিচে ক্যাম্বিসের ছোট্ট ব্যাগটা রয়েছে।

ওদিকে মাহির বাবা আফজাল সাহেব গেল থানায় ডায়েরি করাতে। তার ছেলে নিখোঁজ। থানা ইনচার্জ অফিসার জানালেন, ‘৪৮ ঘণ্টার আগে আমরা তাকে নিখোঁজ হিসেবে ধরব না। আগে ৪৮ ঘণ্টা যাক। দেখুন, রাগটাগ করে কোনো বন্ধুর বাসায় গিয়েছে কি না। বকাটকা দিয়েছিলেন নাকি?’

‘না, বকা দেব কেন?’

‘আরে আজকালকার ছেলেপেলে, খুবই সেনসেটিভ। আমার ছেলেটা একদিন একটা স্মার্টফোন চেয়ে বসল। আমি বললাম, নো। স্মার্টফোনের বয়স হয়নি তোমার। ব্যস, রাগ করে সোজা মাকে নিয়ে নানার বাড়ি গিয়ে বসে আছে। তবে আমার ধারণা, ওর মা তাকে তাল দেয়…’

‘তা হবে। তাহলে কি ৪৮ ঘণ্টা পরে আসব?’

‘হ্যাঁ, তা–ই করুন। তবে আত্মীয়স্বজনের বাসা, বন্ধুবান্ধবের বাসা, সব জায়গায় খোঁজ লাগান।’

একটা হ্যারিয়ার গাড়ি নিয়ে প্রায় উড়ে আসছে মন্টু মামা। নিজেই ড্রাইভ করছে। গাড়িটা অবশ্য তার না, তার এক বন্ধুর। ধানমন্ডিতে এই বন্ধুর একটা শোরুম প্লাস গ্যারেজ আছে। মন্টু মামা মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, সে কারণেই তার গাড়ি সম্পর্কে অগাধ জ্ঞান। প্রায়ই বন্ধুকে গাড়ির নানা বিষয়ে সাহায্য করে। আর তাই তার বন্ধু, মামা যখন যে গাড়ি চায় ধার দেয়।

পথে দুবার পুলিশ মামাকে ধরার চেষ্টা করেছে, কিন্তু মামার স্পিডের কাছে সুবিধা করতে পারেনি। আর পুলিশের একটা সাইকোলজি আছে। রাস্তায় খুব দামি গাড়ি তারা পারতপক্ষে ধরে না। কারণ দেখা যায়, ওই গাড়ি হয়তো কোনো মন্ত্রী বা এমপির অথবা তাদের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজনের! পরে উল্টো ঝামেলায় পড়তে হয় তাদের। দরকার কী!

ঠিক দুই ঘণ্টা আটান্ন মিনিটে চার হাজার সিসির হ্যারিয়ার গাড়িটা ধুলো উড়িয়ে এসে থামল ঠিক সেই বেঞ্চটার সামনে। বেঞ্চের ওপর তখন লম্বা হয়ে ঘুমাচ্ছিল মাহি। লাফিয়ে উঠে বসল।

‘ওহ্‌, মামা চলে এসেছ? থ্যাংকস থ্যাংকস… থ্যাংকস…!’

‘হ্যাঁ, তোর বুড়ো কই?’

সব খুলে বলল মাহি। ফোন করে খাবার কিনে এসে দেখে বুড়ো নেই।

‘বুড়োর জন্য কী খাবার আনতে গিয়েছিলি?’

‘পাউরুটি আর কলা।’

‘দে, আমি খাই। এত তাড়াহুড়ো করে এসেছি। খেতেই ভুলে গেছি, প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে।’

কলা আর পাউরুটি খেতে খেতে পুরো বিষয়টা নিয়ে ভাবতে লাগল মামা। পানির বোতলটা শেষ করে ক্যাম্বিসের ব্যাগটা খুলল; ভেতরে দুটো শার্ট, একটা লুঙ্গি আর কয়েকটা কাগজ। কাগজগুলো দেখে মামা উত্তেজিত হয়ে গেল।

‘সর্বনাশ!’

‘কী হলো মামা?’

‘দেখছিস না, কাগজগুলোতে ঠাসা সব অঙ্ক লেখা।’

‘তাতে কী?’

‘এ তো আমাদের ডক্টর আহমাদ কবীর স্যারের হাতের লেখা রে।’

‘উনি কে?’

‘উনি অঙ্কের জাহাজ। ভুল বললাম, অঙ্কের সাবমেরিন…স্যার নিজেকে সব সময় আড়াল করে রাখতে পছন্দ করতেন। একটা জটিল সূত্র নিয়ে কাজ করছিলেন। তারপর স্যারের মাথা খারাপের মতো হয়ে গেল। কলেজ থেকে চাকরি চলে গেল। তারপর হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেলেন। কলেজে আমি তার সরাসরি ছাত্র ছিলাম রে। হুম…এখন স্যারকে খুঁজে বের করতে হবে। আচ্ছা, এখানে একটা নদী আছে না?’

‘নদী?’

‘হ্যাঁ, আমার হিসাবে এ এলাকায় একটা নদী থাকার কথা। তুরাগ নদের সবচেয়ে বড় শাখাটা। একটা মানুষও তো নেই যে কাউকে জিজ্ঞেস করব।’ তখনই দেখা গেল মাথায় পানের বরজ নিয়ে এক চাচাকে। মামা জিজ্ঞেস করল,

‘চাচা এখানে নদীটা কোথায়?’

‘তুরাগ নদ?’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ।’

‘এই জঙ্গলের পিছেই।’

মামা ‘দ্য আইডিয়া!’ বলে চেঁচিয়ে উঠল। ‘দাঁড়া, আগে গাড়িটা সাইড করি।’ গাড়ি সাইড করে ওরা জঙ্গলের ভেতর ঢুকে গেল। এটাকে জঙ্গল বলা ঠিক হচ্ছে না। সারি সারি সেগুনগাছ। খুব সম্ভবত বন মন্ত্রণালয়ের কোনো প্রকল্প এটা। ফাঁকে–ফুঁকে অন্য সব নাম না জানা গাছ গজিয়ে উঠেছে; তবে পাঁচমিশালি গাছগাছালির আয়োজনটাকে অবশ্য জঙ্গলের মতোই দেখায়। জঙ্গলের ভেতর সরু কিছু রাস্তা পাওয়া গেল, তার মানে, মানুষ এই পথে চলাফেরা করে। অল্প হাঁটার পরই পাওয়া গেল নদীটা। নদী একসময় বড়ই ছিল। এখন শুকিয়ে খাল হয়ে গেছে। দুই পাশে বিস্তীর্ণ বালুচর।

‘ওই দেখ স্যার, যা ভেবেছিলাম…’

‘মানে? কই?’

‘ওই দেখ, মাটিতে উবু হয়ে বসে নির্ঘাত কাঠি দিয়ে বালুর ওপর কোনো অঙ্ক কষছেন।’

ওরা কাছে গিয়ে দেখে, সত্যি তা–ই। বুড়ো গভীর মনোযোগে একটা গাছের মরা ডাল দিয়ে কী সব সংখ্যা লিখে চলেছে একের পর এক। ওদের দেখে তাকাল। তারপর হাসিমুখে বলল, ‘আমি প্রায় শেষ করে এনেছি ইকুয়েশনটা।’

‘স্যার, আমাকে চিনতে পেরেছেন? আমি মন্টু।’

‘সাইদুল আলম মন্টু?’

‘আশ্চর্য স্যার, আপনি আমার পুরো নাম মনে রেখেছেন? আমার কী সৌভাগ্য, স্যার।’

‘তোমার নামে তিনটা শব্দ। ৩ হচ্ছে প্রাইম সংখ্যা। প্রাইম সংখ্যা আমি কখনো ভুলি না।’

‘স্যার, চলুন, বাকি কাজ আমার বাসায় কাগজে–কলমে করবেন।’

‘অনেক কাগজ লাগবে কিন্তু, এখনো একটা পুরো ফেজ বাকি, তবে সমাধানটা আমার মাথায় চলে এসেছে।’

‘জি স্যার, চলুন…’

হ্যারিয়ার গাড়িটা উল্কার বেগে ছুটছে ঢাকার দিকে। সামনে বসেছে মন্টু মামা আর মাহি। পেছনে স্যার চোখ বুজে বসে আছেন, মাঝেমধ্যে বিড়বিড় করে বলছেন, ‘রুট ওভার তিন তিন দশমিক আটত্রিশ…পাইয়ের মান এখানে ধ্রুবক…’

‘এটা কোন রাস্তায় যাচ্ছি আমরা?’ মাহি বলল।

‘এটা একটা বাইপাস রাস্তা। আপাতত এই রাস্তায় কিছুদূর এগিয়ে যাই, তারপর মূল রাস্তায় আবার উঠে যাব। এই রাস্তায় গাড়ি চলে না। বাজে রাস্তা। কিন্তু এই গাড়ি চলবে।’ ঠিক তখনই গাড়ি ব্রেক করে দাঁড়াল।

‘কী হলো?’

ওরা দেখল, সামনে একটা গাছ আড়াআড়িভাবে পড়ে আছে রাস্তার ওপর। মানে রাস্তা বন্ধ। আর কী আশ্চর্য, চারটা লোক ম্যাজিকের মতো উদয় হলো ওদের গাড়ির চারপাশে। চারজনের মধ্যে একজন বিদেশি। একজন এগিয়ে এসে মন্টু মামার জানালার কাছে হাসিমুখে দাঁড়াল।

‘কী ব্যাপার?’

‘ব্যাপার হচ্ছে, রাস্তা তো বন্ধ। গাড়ি আর যাবে না।’ লোকটা বলল। অন্য লোকগুলো গাড়ির পেছনে দেখার চেষ্টা করছে। ঠিক তখনই লোকটা মন্টু মামার মাথায় একটা পিস্তল চেপে ধরল। ঠান্ডা স্বরে বলল, ‘গাছটা আমরাই ফেলেছি, যাতে তুমি আর যেতে না পারো। এখন কোনো ঝামেলা না করে ওই বুড়োকে আমাদের হাতে তুলে দাও।’

‘কেন?’

‘প্রশ্ন করে সময় নষ্ট কোরো না। আমাদের হাতে সময় কম।’

‘ঠিক আছে, স্যারকে নিচ্ছ নাও, কিন্তু তোমাদের প্ল্যানটা কী?’

‘পুরো প্ল্যান তোমার না জানলেও চলবে। তবে এটুকু জানতে পারো। ডক্টর হাক্সলির প্রাইভেট প্লেন অপেক্ষা করছে এয়ারপোর্টে। উনি ওনাকে সোজা নিয়ে যাবেন তার দেশে।’

‘কেন? ওনার দেশে নিতে হবে কেন?’

‘সেটা সময়–সুযোগমতো ওনাকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিয়ো।’

‘আচ্ছা ঠিক আছে, স্যারকে নিচ্ছ…তবে স্যারকে কিছু খাওয়াও, সারা দিন কিন্তু স্যার না–খাওয়া।’

‘ঠিক আছে। এ ইনফরমেশনের জন্য ধন্যবাদ।’

পেছন থেকে আহমাদ কবীর বললেন, ‘সাইদুল আলম মন্টু, থামলে কেন, জলদি চলো!’

কিন্তু ওরা দরজা খুলে স্যারকে ততক্ষণে নামিয়ে নিয়েছে, স্যার ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না কী ঘটছে। এগিয়ে এল সেই বিদেশিটা, সে স্যারের কানে কানে হাসিমুখে কিছু বলল। স্যার অবাক হয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে আছেন। একবার ঘুরে তাকালেন মন্টু মামা আর মাহির দিকে, কিছু একটা বললেনও, কিন্তু কিছু বোঝা গেল না। স্যারকে একটা গাড়িতে তুলল ওরা। সাদা বেশ বড় একটা হাইয়েস মাইক্রোবাস দাঁড়িয়ে ছিল রাস্তার ওপর পড়ে থাকা গাছটার উল্টো দিকে। ওটা ওরা খেয়ালই করেনি। মুহূর্তে সাদা মাইক্রোটা উধাও হয়ে গেল।

‘স্যারের গুরুত্বটা বুঝলি? সাদা চামড়ার লোকজন চলে এসেছে স্যারকে হাইজ্যাক করতে।’

‘এখন কী হবে মন্টু মামা?’

‘ওরা স্যারের ইকুয়েশনটা হাইজ্যাক করার তালে আছে। কিন্তু মন্টু মিয়া বেঁচে থাকতে এটা হতে পারবে না। মাহি, তুই আছিস তো আমার সাথে?’

‘আছি, যাব কোথায়?’

‘তুই এক কাজ কর, এই ফোনটা দিয়ে তোর মাকে ফোন কর। “আপা” নামে তোর মায়ের নম্বর সেভ করা আছে। বল যে চিন্তা না করতে, তুই ভালো আছিস। আর আমি এই ফোনটা দিয়ে কয়েকটা জরুরি ফোন করি কয়েক জায়গায়।’

‘হ্যালো মা, আমি মাহি।’

‘মাহি! বাপ তুই কই?’ ওপাশে মাহির মা হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল।

‘চিন্তা কোরো না, আমি মন্টু মামার সাথে আছি।’

‘মন্টু ফাজিলটা তোর সঙ্গে আছে? কোথায় আছে বল? ওর নামে তোর বাবা থানায় মামলা দিয়েছে!’

‘উফ মা…পরে কথা হবে। রাখলাম। চিন্তা কোরো না, আমি চলে আসব শিগগির। রাখলাম।’ ফোন কেটে দিল মাহি।

‘তোর কথা শেষ হয়েছে?’ মন্টু মামা বলল।

‘হ্যাঁ, মা বলল বাবা তোমার নামে মামলা দিয়েছে থানায়।’

‘কী মামলা? কিডন্যাপের মামলা? মন্দ কী? কয়েক দিন না হয় ডক্টর হাক্সলির সাথে জেল খেটে আসি। ওটাই বাকি ছিল।’

‘ডক্টর হাক্সলিটা কে?’

‘যে স্যারকে আমাদের কাছ থেকে এইমাত্র হাইজ্যাক করল। মহা ধুরন্ধর। তুই কি মনে করিস, স্যারকে উদ্ধার করতে পারলে ওই ব্যাটাকে পুলিশ ধরবে না? আচ্ছা বাদ দে, সিটবেল্ট বেঁধে শক্ত হয়ে বস। আমি গাড়ি নিয়ে জাম্প করে ওই গাছটা পার হব। সামনের মাইক্রোবাসটা ধরতে হবে।’

মন্টু মামা গাড়িটা বেশ খানিকটা ব্যাক গিয়ার দিয়ে পিছিয়ে গেল। তারপর প্রচণ্ড স্পিডে ছুটে এসে হার্ডব্রেক করল। এই গাড়ির ব্রেক হাইড্রলিক, প্রচণ্ড গতিতে ফ্লুইড ছুটে যায় ব্রেক পাইপে…সঙ্গে সঙ্গে হার্ডব্রেক! মুহূর্তে রাস্তার ওপর পড়ে থাকা কাটা গাছটা টপকে উড়ে গিয়ে মাটিতে আছড়ে পড়ল গাড়িটা; চাকার শক্তিশালী শক অ্যাবজরভারের কারণে ওরা খুব একটা টের পেল না, তারপরই উল্কার বেগে ছুটল গাড়ি। মন্টু মামা যে এত সুন্দর গাড়ি চালায়, জানতই না মাহি।

ফাঁকা হাইওয়ের ওপর সাদা হাইয়েস মাইক্রোটা রাস্তার এক সাইডে একটা খাবার রেস্টুরেন্টের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সম্ভবত স্যারের জন্য কিছু খাবার কেনা হচ্ছে। কিংবা তারাও খাচ্ছে।

‘মাহি?’

‘বলো।’

‘সব ঠিক থাকলে আমাদের অপারেশন এখানেই হবে, একটু দূরেই দাঁড়াই আমরা। এখান থেকেই আমরা স্যারকে উদ্ধার করব। সেকেন্ড একটা দল চলে আসবে। ওই দেখ, ওপরে।’

‘একটা ড্রোন উড়ছে।’

‘হ্যাঁ, এতক্ষণ ওটা ছিল ওদের ড্রোন। এখন ওটা হয়ে গেছে আমাদের ড্রোন। হা হা হা, ওদের সফটওয়্যারটা আমরা সুইংবাই করেছি।’

‘মানে?’

‘মানে, মনে কর, ড্রোন হাইজ্যাক, ও এখন আমাদের তথ্য সরবরাহ করছে। হা হা।’ এই সময় গাড়ির পাশে একটা বাচ্চা মেয়ে গোলাপ ফুল নিয়ে এল।

‘স্যার, ফুল কিনবেন?’

‘হ্যাঁ কিনব, সব ফুল কিনব।’ মামা এক শ টাকা দিয়ে সব ফুল কিনে ফেলল। মেয়েটা মহাখুশি।

‘এত ফুল দিয়ে কী হবে মামা?’

‘তোকে একটা কাজ করতে হবে, তুই শার্টটা খুলে ফেল।’

‘কেন?’

‘যা বলছি জলদি কর।’

মাহি শার্ট খুলে ফেলল। মামা একটা বোতল বের করল। পোড়া মবিলের তেল ভরা একটা বোতল। ‘এই মবিল তোর মুখে–গায়ে, হাত–পায়ে ভালো করে মেখে ফেল একটু, তাহলে তোকে একটু অন্য রকম দেখাবে। অ্যাজ ইফ, তুই রাস্তায় ফুল বিক্রি করিস। তারপর ওই মাইক্রোটার কাছে যা। গিয়ে দেখে আয়, ঠিক কজন বসে আছে এবং ইম্পর্ট্যান্ট যেটা সেটা হচ্ছে, স্যার কোন পাশে বসেছেন, সেটা খেয়াল করবি।’

মাহি তখন বুঝে গেছে তাকে কী করতে হবে। পোড়া মবিল মুখে–গায়ে মাখার পর গাড়ির ভিউ মিররে নিজেকে দেখে হেসে ফেলে মাহি! তাকে সত্যি এখন দেখাচ্ছে ঠিক যেন আফ্রিকার কোনো গভীর অরণ্য থেকে উঠে আসা কোনো ট্রাইবাল গোষ্ঠীর ছেলে। মামা হো হো করে হেসে ফেললেন, ‘উফ…তোর মা যদি এখন দেখত তোকে!’

সাদা হাইয়েস মাইক্রোটার কাছে এগিয়ে গেল মাহি।

‘স্যার, ফুল নিবেন?’

‘নো নো।’ বিদেশিটা চেঁচিয়ে উঠল। তারপরও ঘ্যান ঘ্যান করতে লাগল মাহি। ‘নেন না স্যার, অনেক ভালো গোলাপ ফুল। মাত্র পাঁচ টাকা।’

‘ওই ছেমরা, ভাগ কইতাছি।’ সামনে বসা ড্রাইভারটা খেঁকিয়ে ওঠে। চট করে মাহি দেখে নেয় ভেতরে কয়জন আছে, কে কীভাবে বসেছে। স্যারের বাঁ পাশে বসেছে বিদেশিটা। পেছনের সিটে একজন, তার হাতে একটা পিস্তল, সে সেটা খুব আলগোছে ধরে রেখেছে। এই লোকটাই মামার মাথায় পিস্তল ধরেছিল। তার মানে, বাইরে আরও দুজন।

‘কী রে, ফুল বেচতে পারলি?’ মাহি ফিরে আসতেই জানতে চাইল মামা।

‘না, একটাও না।’

‘একটাও না? আচ্ছা, এখন বল গাড়ির ভেতরে কী অবস্থা?’ যা যা দেখে এসেছে, সব খুলে বলল মাহি। মামা মাথা নাড়ল। ‘গুড।’ তখনই একটা ফোন এল মামার কাছে।

‘হ্যালো জগলু, আমরা রেডি।’

‘মাহি, তুই গাড়িতে বসে থাক। বাকি কাজ আমরা করব। আমি হয়তো নামব।’

ঠিক তখনই অন্য একটা গাড়ি পাশ দিয়ে এগিয়ে গেল, আর কী আশ্চর্য, হঠাৎ ঠাস করে মাইক্রোটার গায়ে লাগিয়ে দিল। বেশ বাজেভাবেই লাগিয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে মাইক্রোর ড্রাইভার নেমে এল, পিস্তল হাতের লোকটাও নেমে এল। বেশ এটা হাউকাউ শুরু হয়ে গেল রাস্তার ওপর, বিদেশিটাও নেমে এসেছে। যে গাড়িটা লাগিয়ে দিয়েছে, সেটা একটা লার্নারের গাড়ি। পেছনে বড় করে ‘এল’ লেখা। তারা সরি বলছে। তাতে কাজ হচ্ছে না। সেখান থেকেও চারজন নেমে এসেছে। এ রকম হাউকাউ যখন চলছে, তখন হঠাৎ ঠাস করে একটা গুলির শব্দ হলো। ঝনঝন করে লার্নারের গাড়ির সামনের উইন্ডশিলটা গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গেল। হকচকিয়ে গেল সবাই। কে গুলি করল! বাইরে যারা এতক্ষণ হাউকাউ করছিল, তারা সবাই আড়ালে চলে গেল। কেউ গাড়ির আড়ালে, কেউ উঁচু কংক্রিটের ডিভাইডারটার আড়ালে। দ্বিতীয় একটা গুলি হলো…ঠাস!

‘বোল্ট অটোমেটিক রাইফেলের গুলি!’ মন্টু মামা ফিসফিস করল,

‘মানে?’

‘মানে, এই রাইফেল থেকে একটা গুলি বের হলে পরের গুলিটা লোড করতে ঠিক তিন সেকেন্ড সময় লাগে।’

‘তুমি কীভাবে জানো?’

‘আমি জানি। মনে হচ্ছে তৃতীয় কোনো পক্ষ এসে গেছে। তার মানে বুঝতে পারছিস, স্যারের গুরুত্বটা!’

‘বুঝতে পারছি।’ কিছু না বুঝেই বলে মাহি।

‘শোন, তিন সেকেন্ডের মধ্যে আমি যদি মাইক্রোবাসটার কাছে পৌঁছাতে পারি। তাহলে স্যারকে বাঁচাতে পারব বলে মনে হচ্ছে। রিস্কটা নিতেই হবে, আমাদের প্ল্যানে গোলমাল হয়ে গেছে। স্যার মাইক্রোতে এখন একা আছেন! এটাই চান্স…বিগ চান্স! তুই বসে থাক…’ বলেই আস্তে করে বের হয়ে গেল মন্টু মামা। আর তখনই চতুর্থ গুলিটা হলো। কী ঘটছে, কেউ এখনো বুঝতে পারছে না। দু–একজন পথচারী হঠাৎ গুলির শব্দ শুনে পালাচ্ছে। ঝাঁপ ফেলে দিয়েছে আশপাশের দোকানগুলো। মাহি তিন সেকেন্ডের হিসাব করতে শুরু করল মনে মনে…এক হাজার এক…এক হাজার দুই…এক হাজার তিন…সব ঠিকঠাক থাকলে মন্টু মামার সাদা মাইক্রোবাসটার কাছে পৌঁছে যাওয়ার কথা; ঠিক তখনই সাদা মাইক্রোটা স্টার্ট নিয়ে এগিয়ে যেতে শুরু করল। বিদেশিটা চিৎকার করতে করতে গাড়ির পেছনে ছুটছে, পিস্তল হাতের লোকটা পিস্তল বের করে দুই রাউন্ড গুলি করে বসল। ততক্ষণে মাইক্রোবাসের অন্য দুজন ছুটে এসেছে। তারা হতভম্ব, তাদের হাতে খাবারের প্যাকেট। মাইক্রোবাসটা তখন নাগালের বাইরে। বোল্ট অটোমেটিক রাইফেলে যে তিন সেকেন্ড পরপর গুলি হচ্ছিল, সেটাও কেন যেন বন্ধ হয়ে গেল, এরা ঠিক কোন পক্ষ নিয়ে গুলি ছুড়ল, বোঝা গেল না!

তারপর তো ইতিহাস। শেষ পর্যন্ত প্রফেসর আহমাদ কবীরকে উদ্ধার করা গেছে। পুলিশ, সাংবাদিক সব ছুটে এসেছে। প্রতিটা পত্রিকায় প্রথম পাতায় বক্স নিউজ চলে এসেছে। কয়েকটা নিউজ এ রকম, ‘স্কুলছাত্রের অসমসাহসিকতায় দেশের বিশিষ্ট গণিতবিদ আহমাদ কবীর উদ্ধার!’

‘অবশেষে স্কুলছাত্র মাহি এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করল।’

‘জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গণিতবিদ ডক্টর আহমাদ কবীরকে উদ্ধার করল ক্লাস সেভেনের মাহি।’

তবে স্যারকে আপাতত রাখা হয়েছে মন্টু মামার ঝিগাতলার বাসায়। তার মেয়ে রেনুকে ডিবি পুলিশ খুঁজে বের করেছে। এই পৃথিবীতে মানুষের মাত্র তিনটা লেয়ারে খোঁজ লাগিয়ে যে কারও কাছে নাকি পৌঁছানো যায় বা পৌঁছানো সম্ভব। পুলিশ এই সূত্র কাজে লাগিয়ে প্রফেসরের হারানো মেয়ে রেনুকে খুঁজে বের করেছে দিনাজপুর থেকে। মেয়ে নিজেও একটা কলেজের অধ্যাপক। সে ব্যস্ত হয়েছে বাবাকে তার দিনাজপুরের বাসায় নিয়ে যাওয়ার জন্য। তার সৎভাইকে অবশ্য আর খুঁজে পাওয়া যায়নি, মানে এখন পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায়নি। সে ভোজবাজির মতো উধাও হয়ে গেছে। সৎভাই বাবাকে নিয়ে কেন এই চোর–পুলিশ খেলল, কেনই–বা জঙ্গলে ফেলে আসতে গেল, এটা তার কাছে একটা রহস্য। পুলিশ অবশ্য পুরো ব্যাপারটা নিয়ে তদন্ত শুরু করেছে। তারা সেই বিদেশিকে গ্রেপ্তার করেছে, তার সাঙ্গপাঙ্গদেরও। বোল্ট অটোমেটিক রাইফেলের স্নাইপার শুটারকে অবশ্য পুলিশ এখনো ধরতে পারেনি। তবে তদন্ত চলছে।

বিশিষ্ট গণিতবিদ ডক্টর আহমাদ কবীর স্যার তার মেয়ে রেনুর কাছে যাওয়ার আগে আমরা বরং মাহির ঘরে ফেরাটা কেমন হলো, সেটা চট করে দেখে আসি।

বন্ধুর কাছ থেকে ধার করা হ্যারিয়ার গাড়িটা এসে হার্ডব্রেক করে দাঁড়াল মাহিদের বাসার সামনে। গাড়ি দেখে ছুটে এল মাহির মা–বাবা।

মাহির বাবা ছুটে এসে মন্টু মামার কলার চেপে ধরে হুংকার দিয়ে উঠল,

‘সব হয়েছে তোমার জন্য, তোমাকে আমি পুলিশে দেব।’

‘তা দেন, কলারটা ছাড়েন, দম আটকে মরব তো।’

‘তুমি মরো, সেটাই চাই। আমার মাহি কই?’

‘মাহি কই? মাহি কই?’ মাহির মা–ও চেঁচাচ্ছে। মাহি তখন মন্টু মামার পেছনে একটু আড়াল হয়ে আছে; এত কাহিনির পর তার একটু লজ্জাই লাগছে। তা ছাড়া তার সারা গায়ে কালো পোড়া মবিল শুকিয়ে চামড়ার সঙ্গে লেপ্টে গিয়ে এখন দেখাচ্ছে ঠিক যেন ধানখেতের কাকতাড়ুয়ার মতো। তার ওপর খালি গা। এই তেল–চটচটে গায়ে কি আর শার্ট পরা যায়!

‘কী আশ্চর্য! এই তো মাহি। নিজের ছেলেকেও চেনেন না?’ মন্টু মামা বলল। মা-বাবা দুজনেই হতভম্ব হয়ে তাকাল মাহির দিকে।

‘এটা মাহি? এ কী অবস্থা তোর?’

‘ফেয়ার অ্যান্ড লাভলী দিয়ে ওকে একটা গোসল দাও আপা!’ ততক্ষণে নিজের ছেলেকে চিনতে পেরে ঝাঁপিয়ে পড়ে জড়িয়ে ধরেছে। হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগল, ‘কোথায় ছিলি? কোথায় ছিলি?’ মায়ের শক্ত দুই হাতের ভেতর হাঁসফাঁস করতে করতে মাহি হাসিমুখে বলল, ‘মন্টু মামা, ফেয়ার অ্যান্ড লাভলী না গ্লো অ্যান্ড লাভলী…হি হি।’

‘আচ্ছা মামা, ওরা, মানে ওই বিদেশিরা তোমার স্যারকে ধরে নিতে চাচ্ছিল কেন?’ পরে সুযোগ বুঝে প্রশ্নটা করে মাহি মন্টু মামাকে।

‘তা–ও বুঝলি না? ওদের সম্ভবত স্যারের ওই ইকুয়েশনটা দরকার।’

‘ওরা জানল কীভাবে?’

‘ওরা সব জানে। তা ছাড়া স্যার একবার এক আন্তর্জাতিক বক্তৃতায় এটার বিষয়ে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, তখনই বোধ হয়…আচ্ছা বাদ দে, চল।’

‘কোথায়?’

‘কোথায় আবার? বাইরে, চারটা চ্যানেল থেকে সাংবাদিকেরা এসেছেন।’

‘কেন?’ মাহির মুখ হাঁ হয়ে যায়।

‘আপাতত মুখটা বন্ধ কর। মশা ঢুকবে। মাছিরা সব রিজাইন দিয়েছে, এখন মশাদের রাজত্ব…চল চল, তোকে বাইট দিতে হবে।’

‘মানে, আমি ওদের কামড়াব?’

‘না, ওরা তোকে কামড়াবে। হা হা হা…চল চল চল।’

অবশেষে ব্যাড বয় মাহি ওরফে মাহিউল আলম স্কুলে যেতে শুরু করেছে। তবে এখনো সে ব্যাড বয়ই আছে। ফের যে গুড বয় হয়ে উঠবে, সে সম্ভাবনা আপাতত খুব একটা নেই বলেই মনে হচ্ছে; ফাইনাল পরীক্ষা হলে বোঝা যাবে হয়তো, অবশ্য প্রথম হওয়াটাই যদি গুড বয় হওয়ার অন্যতম লক্ষণ হয়, তবে সে স্কুলে, পাড়ায় সব জায়গায় মোটামুটি বিখ্যাত। স্কুলের নিচু ক্লাসের মেয়েরা তার অটোগ্রাফ নিতে আসে। প্রথম প্রথম লজ্জা পেত, এখন গম্ভীর হয়ে অটোগ্রাফ দেয়। ওদের ভালোভাবে পড়াশোনা করার উপদেশও দেয়।

মাহির মা–বাবা অবশ্য এখন আর তাকে ফার্স্ট হতেই হবে, এসব বলে না। ঠিকই তো, সব সময় ফার্স্ট হতে হবে কেন? দুয়েকটা ভালো কাজ করে যদি মাহির মতো বিখ্যাত হওয়া যায়, তা–ইবা মন্দ কী?

মন্টু মামা এখন মাঝেমধ্যেই আসে। বাবার সঙ্গে খুব খাতির। সেদিন মাহি দেখে, বাবা বলছে, ‘বুঝলে মন্টু, আমরা কিন্তু ইনফরমেশনের যুগে বাস করছি। কিন্তু বুঝতে হবে, ইনফরমেশনটা কিন্তু নলেজ না। তবে ইনফরশেনটাকে যদি স্কিল হিসেবে আত্মস্থ করতে পারো, দ্যান সেটা হবে নলেজ। তবে নলেজ নিয়ে আমাদের বসে থাকলে চলবে না। তারপর সেটাকে তোমার উইজডম হিসেবে বুঝতে হবে। উইজডমই সোসাইটির কাজে লাগে, নলেজ নয়…কী, বুঝতে অসুবিধা হলো?’

No comments