বাঘ-বকরি – সাফিয়া মুস্তারি
বাজারের এক পাশে বিরাট খেলার মাঠ। মাঠটার এক প্রান্তে হাইস্কুল। হাইস্কুলের পূর্ব দিকে আমাদের প্রাইমারি স্কুল। আমি, ইকরি, টুনু ক্লাস টুতে পড়ি। বিনু পড়ে থ্রিতে। হাইস্কুলের গেটের একপাশে বুড়ো একটা বটগাছ, যার ডাল থেকে মোটা মোটা শিকড় নেমে এসেছে। বটগাছ দেখলেই কেমন ভয় ভয় লাগে। কিন্তু এই গাছটার ব্যাপারই আলাদা। স্কুলের টিফিন আর ছুটির সময় এখানে ভ্যান নিয়ে মুড়ি মাখাওয়ালা আসে। ঝুড়িতে বাদাম নিয়ে আসে বাদামওয়ালা।
হাইস্কুলের ছাত্রছাত্রীরা টিফিন করে বটগাছের নিচে। স্কুলের মাঠে যখন ফুটবল খেলা হয়, তখন আমরা এই গাছের নিচে বসেই খেলা দেখি। আমাদের দুই ঘণ্টা ক্লাস, কোনো টিফিন নেই। ছুটির সময় দুই টাকার মুড়িমাখা কিনে খেতে খেতে বাড়ি যাই। আমাদের চারজনেরই স্বপ্ন হাইস্কুলে ওঠা। কারণ হাইস্কুলের ছাত্ররা স্কুলড্রেস পরে, টিফিন পিরিয়ড পায়, মাঠে ফুটবল খেলতে পারে। এই ব্যাপারটাতে বিনু আমাদের সঙ্গে খুব গর্ব করে বেড়ায়। কারণ, ও আমাদের আগে হাইস্কুলে উঠবে। আমাদের চারজনের বাড়ি এক পাড়ায়। স্কুল ছুটির পর একসঙ্গে বাড়ি ফিরি। বিনু হাইস্কুলে উঠে গেলে ওর সঙ্গে আর বাড়ি যাওয়া হবে না।
আজ স্কুল থেকে ফিরেই সবাই পাড়ার পেছনের ভিটেয় চলে গেলাম। একটা কাঁঠালগাছের নিচে বসে আছে ভুট্টু—আমাদের বাড়ির ছাগল। ভুট্টুর দুটো ছানা—লালু আর কালু। কালুর রংটা কালো। পায়ের কাছে খানিকটা সাদা। আর লালু বাদামি। লালু-কালু একটু দূরে লাফালাফি করছে। আজ বাঘ-বকরি খেলা হবে। বই-খাতা কাঁঠালগাছটার নিচে রেখে আমরা হাত বাটলাম, বিনু বাঘ হলো আর আমি হলাম বকরি। বিনু বাঘ হলে খেলা ভয়ানক হয়ে ওঠে। আসলেই বাঘের মতো দৌড়ায় বিনু।
যতক্ষণ ঘরে আছি সমস্যা নেই। কিন্তু ঘর থেকে বের হওয়ার পর বিনুর সঙ্গে পারা কঠিন। খেলা শুরু হলো। সবাই মিলে হাত ধরাধরি করে গোল হয়ে বেড়া বানিয়েছে। গোলের ভেতর বকরি—অর্থাৎ আমি দাঁড়িয়ে আছি। বিনু বেড়ার ফাঁকফোকর দিয়ে বেড়া ভেঙে ঘরে ঢোকার চেষ্টা করছে। ও বেড়া ভেঙে ঘরে ঢুকতেই বেড়া গলে বেরিয়ে ঝেড়ে দৌড় দিলাম আমি। পেছনে তাকিয়ে দেখি বেড়া ভেঙে আবার বেরিয়ে এসেছে বিনু। একটু পরেই পেছনে বিনুর হালুম হালুম করে ছুটে আসার আওয়াজ পেলাম। অন্যরা আবার বেড়ার ভেতর ঢোকার জন্য আমাকে ডাকছে। কিন্তু বিনু পথ আগলে রেখেছে। আমি তালপুকুরের পেছন দিকটায় দৌড়ে গেলাম, ঘুরে আবার বেড়ায় ঢোকার জন্য। বিনু কিছুক্ষণ আমার পেছনে ছুটে আবার পথ আগলে দাঁড়িয়ে গেল। পুকুরের পেছন দিকটায় বেশ জঙ্গল। আমি জঙ্গলের একটু ভেতরে ঢুকে গেলাম। জঙ্গলের ভেতর একটা ভাঙা মাটির ঘর আছে। সবাই বলে ওই ঘরে নাকি এক ডাইনি বুড়ি থাকত। আমরা দল বেঁধে মাঝেমধ্যেই ওখানে যাই। কিন্তু আজ একা এদিকে আসায় ভয় লাগছে। জঙ্গল থেকে বেরোনোর জন্য পা বাড়াতেই পেছন থেকে একটা ডাক শুনলাম। ‘পিনু…পিনুউউ…!’ আমার নাম ধরে ডাকছে কে যেন। পেছনে তাকিয়ে দেখি হাসিখুশি এক বুড়ি দাঁড়িয়ে আছে। আগে কখনো গ্রামে দেখিনি তাকে। ওনার সঙ্গে কথা বললাম,
‘তুমি কে গো?’
‘কেন? আমায় চিনতে পারোনি? আমি ওই ভাঙা বাড়িতে থাকি। লোকে ডাইনি বুড়ির কথা বলে কখনো শোনোনি গো?’
আমি ভয়ে দৌড় দেওয়ার জন্য ঘুরতেই বুড়ি আবার কথা শুরু করল।
‘আরে, ভয় নেই বাছা। আমি ভূত তো না। এত ভয় কিসের…দু-একটা জাদুমন্তর শিখেছি বলে লোকে ডাইনি বলে।’
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলাম। ডাইনি ভাবতেই মনে হতো কালো ঢিলা জামা পরা কুঁজো বুড়ি, তার বাঁকানো নখ থাকবে…আর হাতে ঝাড়ু তো চাই-ই চাই, ঝাড়ুতে ভর দিয়ে হাঁটবে আর উড়ে বেড়াবে। এই শাড়ি পরা সাদাসিধে বুড়িকে ডাইনি মনেই হচ্ছে না। বুড়ি আমার সঙ্গে খুব আদর করে কথা বলছে—
‘বাঘ-বকরি খেলো নাকি গো? তুমি বুঝি বকরি হয়েছ? হে হে হে…আমার বাড়ি যাবে? তাহলে বাঘে আর খেতে আসবে নাহ হাহ হাহ হা। ঘরে মোয়া বানিয়ে রেখেছি, খাবে?’
বুড়ি খুব আগ্রহ করে আমাকে তার বাড়ি নিয়ে গেল। বুড়ির হাতের মোয়ার স্বাদ তো ভোলার মতো নয়।
‘তুমি জাদু দিয়ে মোয়া বানিয়েছ?’ বললাম আমি। ডাইনি বুড়িকে কী বলে ডাকব বুঝতে পারছিলাম না; সমাধানটা উনিই দিয়ে দিলেন।
‘আমাকে ডাইনি বুড়িই ডেকো গো। সবাই তাই-ই ডাকে। হেহ হে হে। এ যে জাদুর মোয়া, এমন স্বাদ কোথাও নেই।’ হেসে বললেন বুড়ি। মোয়া খাওয়া শেষ হওয়ার আগেই শুনি বিনু ইকরিরা আমাকে ডাকছে। আমি বুড়ির কাছে আর কয়টা মোয়া চাইলাম বন্ধুদের জন্য। কিন্তু দিলেন না তিনি। বুড়ি আমাকে মোয়া দেবে না—ভাবতেও পারিনি। একটু রাগ হলো। মুখ ভার করে চলে এলাম। বিনু-ইকরিরা সব অন্য দিকে চলে গেছে। আমি ওদের দিকে এগোলাম। পায়ের নিচে বেশ কচি দূর্বাঘাস, দেখে খুব লোভ হলো। নরম ঘাসের স্বাদ না জানি কেমন হবে। আগে কখনো ঘাস খেতে ইচ্ছে হয়নি। মনের সাধ নাকি ফেলে রাখতে নেই। এমন ইচ্ছে হয়তো আর কখনো হবে না। ঘাস খেতে শুরু করলাম আমি। বাহ, বেশ মজা…খুব রস। প্রথমে ভয় হচ্ছিল, বন্ধুরা যদি দেখে আমি ঘাস খাচ্ছি, ভীষণ লজ্জায় পড়ে যাব। কিন্তু একটু পর এত ভালো লাগল যে ঠিক করলাম, বন্ধুদেরও খাওয়াব। স্কুলে স্যার একা একা ক্লাসের বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আর কিছু করার থাকে না।
আমি ঠিক করে ফেললাম, এরপর এমন হলে ঘাস খাব। আমাদের স্কুলের বারান্দার সামনে বেশ কচি ঘাস আছে। আমি খেলার জায়গায় চলে গেলাম। ইকরি-বিনু-টুনু আমাকে রেখেই আবার খেলা শুরু করেছে। আমি ওদের মাঝখানে গিয়েই বুড়ির কাহিনি শুরু করলাম। কিন্তু ওরা বিরক্ত হয়ে আমার দিকে তাকাল। ইকরি-বিনু-টুনু সবাইকে খুব বড় লাগছে। আমি এমনিতেই একটু খাটো, কিন্তু ওদের তো এত লম্বা দেখানোর কথা না। ওদের বিরক্ত মুখ দেখে বোঝাই যাচ্ছে আমি খেলার মাঝখানে চলে যাওয়ায় রেগে গেছে ওরা। আমার কথায় কান না দিয়ে ওরা হুরর-হুরর করে তাড়িয়ে দিল আমাকে। আমি মন খারাপ করে কাঁঠালগাছটার নিচে গিয়ে দাঁড়ালাম। আমি খেলার মাঝে চলে গেলাম বলে আমাকে খেলায় নিল না। কাছেই আমাদের ছাগল ভুট্টু বসে আছে। ভুট্টুটাকে কি বিশাল মনে হচ্ছে! কাছে যেতে সাহস হচ্ছে না। এবার লালু আর কালুর দিকে চোখ পড়তেই চমকে উঠলাম। ওরা আমার সমান হয়ে গেছে। না, সবাই হয়তো ঠিকই আছে, আমিই লালু–কালুর সমান হয়ে গেছি। কাছ থেকে একটা ঘ্যাড়ঘেড়ে কণ্ঠ কথা বলে উঠল, ‘পিনু না?’
আমি তাকিয়ে দেখি ভুট্টু ছাড়া কেউ নেই। আবার সেই কণ্ঠ কথা বলে উঠল। আমি অবাক হয়ে দেখলাম ভুট্টু ঘাস-পাতা চিবোতে চিবোতে বেশ নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলে উঠল, ‘বলি, তুমি আমাদের বাড়ির পিনু না?’ এবার আমি ভীষণ ভয় পেলাম, ছাগলটা কীভাবে কথা বলছে! ভয়ে ভয়ে মাথা নাড়িয়ে জানালাম আমিই ‘আমাদের বাড়ির’ পিনু। ভুট্টু আবার চুপচাপ পাতা চিবোতে লাগল, যেন দুনিয়ায় কোনো কিছুতেই তার কোনো আগ্রহ নেই। ভুট্টুর সঙ্গে আরও কথা বলতে ইচ্ছে হলো কিন্তু ওকে দেখে গুরুজন টাইপের কেউ মনে হচ্ছে, কথা বলার সাহস হয় না। একটু পর লালু আর কালু এসে আমাকে দেখে খুব মজা পেল।
আমারও খুব ভালো লাগল ওদের সঙ্গে খেলতে। কিন্তু একটু পর খেয়াল হলো, বিনু-টুনুরা সব চলে গেছে। আমাকেও যেতে হবে। একে তো স্কুল থেকে সোজা খেলতে এসেছি, তারপর আবার সময়মতো খেতে না গেলে মা খুব বকবে। বিনুদের পুকুরে দুটো ডুব মেরে বাড়ি যাব। বিনুদেরও ওখানেই থাকার কথা। কিন্তু আমি বিনুদের পুকুরে যাব শুনে লালু-কালু খুব হেসে ভুট্টুকে বলল, ‘মা, শোনো পিনু ভাই কী বলে, ও নাকি বিনুদের পুকুরে যাবে।’ শুনে নির্লিপ্ত ভুট্টুও বিশ্রী শব্দে হেসে উঠল। আমাকে বোকার মতো তাকিয়ে থাকতে দেখে ভুট্টু বলল, ‘ছাগলে সাঁতার জানে না। পুকুরে নামলে ডুবে মরবে। আর বিনুদের পুকুরের তো তল পাওয়াই শক্ত।’ এবার আমি খুব রেগে গেলাম, ‘আমি কি ছাগল নাকি? ঠাট্টা হচ্ছে?’ কিন্তু আমার রাগকে ওরা কেউ পাত্তাই দিল না। আমিই ওদের সব সময় শাসন করি। নিজের বাড়ি পোষা ছাগলের কাছে পাত্তা না পেয়ে আমি আরও তর্জন-গর্জন শুরু করলাম। ভুট্টু তার সেই নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলল, ‘তুমি ছাগল নও তো কী? আমার লালু-কালু যা তুমিও তা-ই।’ এবার একেবারে স্পষ্ট করে বলে দিল আমি ছাগল!
ওদের কথা আমার কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না। তবু আমি বাড়ি না গিয়ে ওদের সঙ্গেই থেকে গেলাম। কাঁঠালগাছটার নিচে আমার বই–খাতাগুলো ছিল, এখন সেগুলোও দেখছি না। ইকরি হয়তো যাওয়ার সময় নিয়ে গেছে। লালু–কালুর সঙ্গে ঘাস খেতে খেতে আমি বিশ্বাস করতে শুরু করলাম যে আমি সত্যিই ছাগল হয়ে গেছি। সব নিশ্চয় ওই ডাইনি বুড়ির কাজ। ওই বুড়িই আবার সব ঠিক করে দিতে পারবে, লালু-কালুও আমার সঙ্গে একমত হলো। কিন্তু ভুট্টু তেমন আগ্রহ দেখাল না, ঘাস চিবোতে চিবোতে ঘ্যাড়ঘেড়ে গলায় বলে উঠল, ‘ডাইনি বুড়ি কি তোমার হাতে মোয়া নাকি? তাকে পাওয়া অত সোজা না।’ মোয়ার কথা শুনেই বুড়ির ওই জাদুর মোয়ার কথা মনে পড়ল। ব্যাটা ডাইনি বুড়ি ওই মোয়া খাইয়েই আমাকে ছাগলে বানিয়েছে। লালু-কালু আর আমার ঠেলাঠেলিতেই ভুট্টু আমাদের সঙ্গে তালপুকুরের পেছনে গেল। কিন্তু চারজনে অনেক খুঁজেও ডাইনি বুড়িকে পেলাম না। খালি বুড়ির কুঁড়েঘরে একটা বাটি পেলাম, যেটাতে বুড়ি আমাকে মোয়া দিয়েছিল। ভুট্টুর গম্ভীর আদেশে আমি সেটা বেশ করে চেটেপুটে খেলাম। এদিকে ডাইনি বুড়িকে খুঁজতে খুঁজতে বিকেল পেরিয়ে গেল। গাছের ফাঁক দিয়ে হলদে আলো আসছে, পাখিরা ডাক ছেড়ে উড়ে যাচ্ছে, গাছে গাছে ঝিঁঝি পোকারা পাগলের মতো ডেকে যাচ্ছে আর মা রাগে গজগজ করতে করতে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। এই সবকিছু যেন একটা কথাই বলছে, ‘দিন শেষ, ঘরে ফিরতে হবে।’ মায়ের ভাবসাবে মনে হচ্ছে এক্ষুনি এসে আমার পিঠে দু-চার ঘা বসিয়ে দেবে। কিন্তু সে রকম কিছুই হলো না।
মা এসে ভুট্টুকে টেনে নিয়ে গেল, পেছন পেছন লালু-কালুও যেতে শুরু করল। একটু ভেবে আমিও তাদের পেছন পেছন রওনা দিলাম। আজ আমি সারা দিন বাড়ি যাইনি, তারপর উটকো ঝামেলা হিসেবে বাড়ির ছাগল তিনটির সঙ্গে কাদের একটা ছাগলছানা এসে জুটেছে।
মা আজ মহা খ্যাপা। ভুট্টুদের সঙ্গে মা আমাকেও ছাগলের ঘরে ঢুকিয়ে দিল। আমি ঘরের এক কোণে খড়ের মধ্যে গা ডুবিয়ে শুয়ে পড়লাম। অবাক হয়ে দেখলাম ভুট্টু ঘ্যাড়ঘেড়ে গলায় লালু-কালুকে গল্প শোনাচ্ছে, ‘এক দেশে ছিল এক…’। আমার চোখ বুজে আসছে। বোধ হয় ঘুমে। কানে আসছে ভুট্টুর একঘেয়ে ঘ্যাড়ঘেড়ে কণ্ঠ।
Post a Comment