ভূত-রাজার বুদ্ধি – খায়রুল বাবুই

ভূত-রাজার বুদ্ধি – খায়রুল বাবুই

তিতি আর তুতু। ভাইবোন।

‘ত’ বংশের সর্বশেষ প্রজন্ম ওরা দুজন।

তিতি বড়, তুতু ছোট।

বয়সে বড় হলেও তিতি নিজেও এখনো খুব ছোট। তিতির বয়স একশ চুরাশি আর তুতু এ বছরই মাত্র আটানব্বইয়ে পড়ল!

এখন সময়টা ঝড়-তুফানের। তিতি-তুতুকে নিয়ে তাই সব সময় টেনশনে থাকে তাদের মা তেতে। বাবা ভূত-রাজ তাতা, তিনি অবশ্য নির্ভার, নিশ্চিন্ত।

ভূতদের মধ্যে বংশগরিমা আছে। তাতার সঙ্গে তেতের বিয়ে নিয়ে অনেক হাঙ্গামা হয়েছিল। তেতে ছিল ‘ঝ’ বংশের মেয়ে। নাম ছিল ঝেঝে।

একদিন…না…একরাতে তাতার সঙ্গে তার দুর্ঘটনাক্রমে দেখা। প্রচণ্ড ঝড়-তুফান হচ্ছিল। ঝেঝেরা যে তেঁতুলগাছটায় বসবাস করত, ঝড়ে শিকড়সুদ্ধ উড়ে গিয়ে সেটি পড়ে ছিয়াশি হাজার দুই শ মাইল দক্ষিণের এক গ্রামে। সেই গ্রাম ছিল ‘ত’ বংশের ভূতদের রাজ্য। নাম—তত্তাপাড়া।

ভূত-সমাজে একটি নিয়ম বেশ কড়াকড়িভাবে পালিত হয়। সেটি হলো, অনুমতি ছাড়া এক রাজ্যের ভূত অন্য রাজ্যে প্রবেশ করতে পারবে না। নিয়ম লঙ্ঘন করলে কঠিন শাস্তি। পরপর ছয় দিন দুপুর ঠিক বারোটা থেকে দুইটা পর্যন্ত সূর্যের দিকে হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে।

অন্ধকারের বাসিন্দা ভূতদের কাছে আলো হচ্ছে ইঁদুর মারা বিষের মতো। তাই একনাগাড়ে ছয় দিন বিষ খাওয়ার মতো শাস্তির ভয়ে সবাই নিয়ম মেনে চলে। কারণ, ভূতদের পক্ষে ছয় দিন দূরে থাক, মাত্র ছয় মিনিটও সূর্যের আলো সহ্য করা কঠিন।

আর ওই রকম শাস্তির ফলাফল একটাই—তেঁতুল তোলা! (মনুষ্য সমাজের বাগ্ধারা ‘পটল তোলা’কে ভূত-সমাজে বলে ‘তেঁতুল তোলা’।)

তো, নিয়ম লঙ্ঘন করায় ঝেঝেরা পুরো পরিবার অর্থাৎ সে ও তার মা-বাবা ভীষণ বিপদে পড়ে যায়। শাস্তি অর্থাৎ মৃত্যু অনিবার্য।

‘ত’ বংশের রাজা তোতো তত্তাপাড়ার সবাইকে নিয়ে সালিসে বসে। সঙ্গে ছিল একমাত্র ভূত রাজপুত্র তাতাও।

‘…সালিস বৈঠকের কিছু নাই। হাজার হাজার বছর ধরে প্রচলিত নিয়ম লঙ্ঘনের জন্য অন্যেরা যে শাস্তি পেয়ে আসছে, এদের জন্যও একই শাস্তি ঘোষণা করলাম আমি।’ ঝেঝে পরিবারের তিন সদস্যের দিকে তাকিয়ে বলল তোতো।

ঘোষণা শুনে ভঁরভঁর করে কেঁদে ফেলে ঝেঝে। অল্প বয়স, সবে দুই শ এগারো। হাজার বয়স পেরোনো ঝেঝের মা-বাবা অবশ্য শাস্তির জন্য প্রস্তুত। তারা জানে, এ অপরাধের শাস্তি পেতেই হবে। তাই নিয়তি মেনে নিয়ে চুপ থাকে তারা।

‘কিন্তু বাবা,’ ঝেঝের মুখের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে বলে ওঠে ভূত রাজপুত্র তাতা, ‘ওরা তো ইচ্ছে করে বিনা অনুমতিতে আমাদের রাজ্যে আসেনি। তুফানই ওদের বাড়িসুদ্ধ উড়িয়ে এখানে এনে ফেলেছে। ওদের দোষ কী?’

‘ঝ’ বংশের ছোকরা ভূতদের দিনের ঘুম হারাম করা সুন্দরী ঝেঝে। ঝেঝের রূপে মুগ্ধ হয়ে গেছে তাতাও। বুঝতে পারল, ভালোবেসে ফেলেছে ঝেঝেকে। তাই জীবনে প্রথমবারের মতো কোনো সালিস বৈঠকে বাবার রায় ঘোষণার পরও অপরাধীদের পক্ষ নিয়ে কিছু বলার দুঃসাহস দেখাল তাতা।

তাতার কথা শুনে উপস্থিত সব ভূত একসঙ্গে চমকে উঠল। কারণ সবাই জানে, সালিস বৈঠকে রাজার ঘোষণাই চূড়ান্ত। এরপর অপরাধীর পক্ষে কেউ কিছু বললে তাকেও সমান শাস্তি পেতে হবে।

তোতো অবাক হয়ে একটানা সাড়ে উনিশ ঘণ্টা পুত্রের মুখের দিকে চেয়ে রইল। তারপর কী যেন চিন্তা করে সবার উদ্দেশে বলল, ‘সম্মানিত ভূতোদয়, আপনারা আজকের সালিস বৈঠকের বিস্তারিত নিজ চোখে দেখলেন এবং কানে শুনলেন। আপনারা জানেন, অপরাধী যে-ই হোক, শাস্তি তাকে পেতেই হবে। প্রয়োজনে আমরা মাটি খুঁড়ে হলেও প্রকৃত অপরাধীদের খুঁজে বের করে শাস্তি দিতে বদ্ধপরিকর। এটা শুধু আমার মুখের কথা না, ভূত-রাজ্যের হাজার বছরের নিয়ম। তাই আমার সন্তান হওয়া সত্ত্বেও ঝেঝে বংশের পক্ষে সুপারিশ করায় তাতার জন্যও আমি একই শাস্তি বরাদ্দ করলাম।’

ভূত-রাজার কথা শুনে উপস্থিত অধিকাংশ ভূতই ভঁরভঁর করে, বাকিরা হোঁইঁ-হোঁইঁ করে কেঁদে উঠল। একমাত্র পুত্রের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করতে পারল রাজা? কী করে পারল? তাহলে এরপর কে নেবে রাজ্যভার? রাজবংশে অন্ধকার গাঢ় করার জন্য তো কেউ থাকবে না!

‘মহামান্য রাজা, আমার একটা কথা ছিল,’ বসা থেকে উঠে শূন্যে ভাসতে ভাসতে বলল রাজ্যের পণ্ডিত-ভূত তুংতেং, ‘তাতার কথায় যুক্তি আছে। ওই ঝে পরিবার ইচ্ছে করে আমাদের রাজ্যে অনুপ্রবেশ করেনি। এর জন্য তুফানই দায়ী। তাই আমিও তাদের সূর্যালো শাস্তির (সূর্যের আলো খাওয়া) বদলে অন্য কোনো শাস্তি প্রদানের অনুরোধ করছি।’

ভূত-রাজা গভীর ভাবনায় পড়ে গেল। তুংতেং হচ্ছে রাজ্যের সবচেয়ে বয়স্ক ও জ্ঞানী ভূত। তার কথার দাম আছে। ওদিকে তুংতেংয়ের কথা শুনে তাতা ও ঝেঝের মুখ আশায় অন্ধকার হয়ে গেল। এ যাত্রায় প্রাণ রক্ষা পেতে যাচ্ছে বুঝতে পেরে ঝেঝে সঙ্গে সঙ্গে তাতার প্রেমে পড়ে গেল।

‘ঠিক আছে, আপনি যখন বলছেন, তখন আমি ওদের সূর্যালো শাস্তি মাফ করলাম।’ তুংতেংয়ের দিকে তাকিয়ে বলল ভূত-রাজা তোতো, ‘কিন্তু তাতা আমার মুখের ওপর কথা বলে যে অপরাধ করেছে, সে জন্য শাস্তি হিসেবে ওকে তিন শ বছরের নির্বাসন দিলাম। তিন শ বছর পর তাতা এই রাজ্যে প্রবেশ করতে পারবে। তার আগে নয়।’

এর পরের কাহিনি খুবই সংক্ষিপ্ত। ঝেঝে পরিবারের সঙ্গে নির্বাসনে যায় তাতা। ঝেঝের বাবার মুখে ঘটনা শুনে ‘ঝ’ বংশের সবাই তাতাকে সম্মানের সঙ্গে তাদের রাজ্যে থাকতে দিল। এর এক শ চৌদ্দ বছর পর ঝেঝের সঙ্গে ধুমধাড়াক্কা করে বিয়ে হয় তাতার।

তারপর থেকে ‘ত’ বংশের বউ হয়ে গেল ঝেঝে। নাম পাল্টে হলো তেতে।

তিন শ বছর পর নির্বাসন-শাস্তি শেষে নিজ রাজ্যে ফেরত আসে তাতা। তাতার সঙ্গে তেতে ওরফে ঝেঝেকে দেখে সঙ্গে সঙ্গে মূর্ছা যায় ভূত-রাজ তোতো। একান্ন দিন পর জ্ঞান ফিরে যখন জানতে পারে ঝেঝেকে বিয়ে করেছে তাতা এবং তাদের ঘরে দুটি সন্তানও আছে, তখন আবার মূর্ছা যায় তোতো। তারপর আর জ্ঞান ফেরেনি ভূত-রাজার।

তাতা এখন ত বংশের প্রধান, তত্তাপাড়া রাজ্যের রাজা। আর তেতে রানি।

রাজকন্যা তিতি আর রাজপুত্র তুতুকে নিয়ে তাদের সুখের সংসার। রাজ্যের সবচেয়ে বড় তেঁতুলগাছটায় থাকে তারা।

একদুপুরে রাজপরিবারের সবাই গভীর ঘুমে। হঠাৎ শুরু হলো প্রচণ্ড ঝড়। শোঁ শোঁ শব্দ আর ঝুমবৃষ্টিতে তেতের ঘুম ভেঙে গেল। ভরদুপুরেও চারদিক প্রায় অন্ধকার। ভূত-রাজা তাতা এবং তিতি-তুতু তখনো নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। গুড়গুড়ুম শব্দে বজ্রপাতের আলোয় তেতের চোখ ঝলসে যাওয়ার অবস্থা।

একটা লম্বা লাঠি নিয়ে তাতার নাকে সুড়সুড়ি দিল তেতে। এ ছাড়া তাতার ঘুম ভাঙানোর কোনো উপায় নেই।

‘ভূউউউউউচ্চো…’ শব্দে বিকট হাঁচি দিয়ে ধড়মড় করে জেগে ওঠে ভূত-রাজা।

‘কী হলো তেতে, অবেলায় ঘুম ভাঙালে কেন?’

‘দেখছেন না বজ্রসহ প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছে।’

‘তাতে কী? সারারাত রাজকার্য করে মাঝদুপুরে ঘুমটা মাত্র গাঢ় হয়েছে, আর তুমি…,’ তাতা কিছুটা বিরক্ত, ‘ঝড়-বৃষ্টিকে ভয় পাওয়ার মতো তো কোনো কারণ নেই।’

‘তা নেই, কিন্তু আমি ভয় পাচ্ছি অন্য একটা বিষয় ভেবে।’ তেতে কিছুটা চিন্তিত।

‘কী বিষয়?’

‘মনে আছে আপনার, এ রকমই এক ঝড়-বৃষ্টির সময় পুরো পরিবারসহ আমি এই রাজ্যে উড়ে এসে পড়েছিলাম।’

‘হ্যাঁ,’ বলে তেতের গালটা টেনে দেয় ভূত-রাজা, ‘সে-ই জন্যই তো তোমার-আমার দেখা হলো। প্রেম হলো। তুমি হলে তত্তাপাড়া রাজ্যের রানি।’

তিতি ও তুতুর দিকে তাকিয়ে তেতে বলল, ‘আমি আসলে ওদের নিয়ে ভয় পাচ্ছি।’

‘দূর। আমাদের এই ভূতস্থল মানে তেঁতুলগাছটা প্রায় একুশ হাজার বছর পুরোনো। এটা ওপড়ানোর সাধ্য ঝড়ের নেই।’

‘যদি অন্য কোনো রাজ্য থেকে কোনো পরিবার ঝড়ে উড়ে এসে জুড়ে বসে এখানে, তখন কী হবে?’

মুচকি হাসে ভূত-রাজা, ‘তুমি দেখছি আমার বুদ্ধি-সুদ্ধির ওপর ভরসা করতে পারছ না রানি।’

তেতে লজ্জিত হয়, ‘এ কথা বলছেন কেন ভূত-রাজ?’

‘শোনো, যে রাতে আমি এ তত্তাপাড়া রাজ্যের রাজা হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছি, তার পরদিন থেকে টানা ছেষট্টি বছর তোমার কাছ থেকে দূরে ছিলাম। মনে আছে?’

‘সে কথা আমি কী করে ভুলতে পারি বলুন!’

‘আজকের এই ঝড়-তুফানের কথা মাথায় রেখেই আমি সেই ছেষট্টিটি বছর ব্যয় করেছি এ রাজ্যের পুরো সীমানায়।’

‘বলেন কী? আপনি না শিকারে বেরিয়েছিলেন?’ তেতে কিছুটা বিস্মিত।

‘হাঁ হাঁ হাঁ…’ ভূত-রাজার বিকট হাসির শব্দে ঘুম ভেঙে যায় তিতি আর তুতুর। তাদের দিকে তাকিয়ে তাতা বলে, ‘হু রানি, শিকারই আমার উদ্দেশ্য ছিল। তবে সেটি ছিল শিকারির হাত থেকে তিতি-তুতুকে রক্ষা করা।’

‘মানে?’ তেতে কিছুই বুঝতে পারে না।

‘মানে হলো, আমি তত্তাপাড়া রাজ্যের পুরো সীমানাজুড়ে লক্ষ ফুট উঁচু প্রাচীর তুলে দিয়েছি। যেন অন্য রাজ্য থেকে এ রাজ্যে কখনো ঝড়ে কেউ উড়ে না আসে। আর তিতি বা তুতু কখনো যেন আমার মতো ভুল করার সুযোগ না পায়!’

ভূত-রাজার কথা শুনে বিস্ময়ে বাক্রুদ্ধ হয়ে যায় তেতে। মনে মনে বুদ্ধির তারিফ করে। তাকায় সন্তানদের দিকে। ইতিমধ্যে ঝড় থেমে গেছে। তেঁতুলগাছটার দুই ডালে আবার ঘুমিয়ে পড়েছে ভূত-রাজপুত্র তিতি আর ভূত-রাজকন্যা তুতু।

No comments