বিপদ (মিসির আলি) – হুমায়ূন আহমেদ
আফসারউদ্দিন জাহাজ কোম্পানির বড় অফিসার
আফসারউদ্দিন খুব গম্ভীর ধরনের একটা দেশি জাহাজ কোম্পানির বড় অফিসার। বড় অফিসাররা এমনিতেই গম্ভীর হয়ে থাকেন। ইচ্ছে না-করলেও তাঁদের গম্ভীর থাকতে হয়। আফসার সাহেবের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা সে-রকম নয়। তিনি এই গান্তীর্য নিয়েই জন্মগ্রহণ করেছেন। কঠিন হয়ে থাকতেই তাঁর ভালো লাগে। হাসি-তামাশা, ঠাট্টা-ফাজলামি তাঁর একেবারে সহ্য হয় না। তাঁর কথা হল-হাসিতামাশাই যদি লোকজন করবে। তাহলে কাজ করবে। কখন? পৃথিবীটা কোনো নাট্যশালা না যে হাসি-তামাশা করে লোক-হাসাতে হবে।
আফসার সাহেবের দুর্ভাগ্য, তাঁর আশেপাশের মানুষজনের স্বভাব তাঁর স্বভাবের একেবারে উল্টো। তাঁর স্ত্রী মীরা সৰ্ব্বক্ষণই হাসছেন। কারনে-অকারনে হাসছেন। এই তো সেদিন তাঁদের কাজের ছেলে কুদ্দুস হাত থেকে ফেলে টী-পট ভেঙে ফেলল। এই দেখে মীরা ফিক করে হেসে ফেললেনঃ আফসার সাহেব বললেন, একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে। হাত থেকে ফেলে একটা দামি জিনিস ভেঙেছে। এতে হাসির কী হল?
মীরা বললেন, টী-পট ভেঙেছে দেখে হাসি নি। টী-পট ভাঙার পর কুদ্দুস কেমন হতভম্ব হয়ে ভাঙা পটটার দিকে তাকিয়ে ছিল তাই দেখে হেসে ফেললাম।
তার মুখের ভঙ্গি দেখে তুমি হেসে ফেললে?
হ্যাঁ।
দয়া করে আমার সামনে এই কাজটা করবে না। হাসতে ইচ্ছা করলে বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে হাসবে।
মীরা আবার হেসে ফেললেন। আফসার সাহেব বললেন, হাসলে যে?
তুমি কেমন গম্ভীর মুখে কথা বলছো তাই দেখে—
দয়া করে আমার সামনে থেকে যাও।
মীরা উঠে চলে যান, তবে হাসতে-হাসতে যান। তা দেখেও আফসার সাহেবের গা জ্বালা করে।
তাঁর দুই মেয়ে সুমী আর রুমীও অবিকল মার মতো। দিন-রাত হাসছে। তারা মাঝেমাঝে স্কুলের মজার-মজার সব ঘটনা বাবাকে বলতে আসে। ঘটনা বলবে কি, বলার আগেই হাসি।
আফসার সাহেব শীতল গলায় বলেন, কী বলতে চোচ্ছ ঠিকমতো বল। এত হাসলে বলবে কী করে?
না-হাসলে এই ঘটনা বলা যাবে না। বাবা! হি-হি-হি-হয়েছে কি, আমাদের ক্লাসের একটা মেয়ে অরুণা-হি-হি-হি-সে করল কি, হি-হি-হি—
চুপ কর।
ঘটনাটা শোন বাবা। ভারি মজার— তারপর অরুণা-হি-হি-হি।
স্টপ। স্টপ।
অরুণার গল্প বলা হয় না। মেয়ে দুটি দুঃখিত হয়। তবে সেই দুঃখও খুব সাময়িক। আবার কোনো- একটা মজার ঘটনা ঘটে। এক বোন অন্য বোনের গায়ে হাসতে-হাসতে গড়িয়ে পড়ে।
আজ সোমবার।
আফসার সাহেব নাশতা খেতে বসেছেন। তাঁর দুই মেয়ে সুমী রুমী বসেছে দু পাশে। রুমী কী একটা হাসির কথা বলতে যাচ্ছিল। বাবা কড়া করে তার দিকে তোকানোর কারণে সে চুপ করে গেল। সুমী তখন কী একটা বলতে গেল! মীরা চোখের ইশারায় তাকে থামিয়ে দিলেন। নাশতার টেবিলে হাসাহসি না-হওয়াই ভালো। মীরা টী-পট থেকে কাপে চা ঢালছেন। হঠাৎ একটা দুর্ঘটনা ঘটল। মেঝে থেকে লাফ দিয়ে একটা বিড়াল আফসার সাহেবের কোলে এসে বসল। আফসার সাহেব লাফ দিয়ে তিন হাত ওপরে উঠে গেলেন। যে-পিরচে ডিম, রুটি, মাখন এবং পনিরের টুকরো সাজানো ছিল তা ছিটকে পড়ল মেঝেতে। পুরো ঘটনোটা ঘটল দু সেকেণ্ডের ভেতর।
সুমী রুমী খিলখিল করে হেসে ফেলল। তারা জানে এখন হাসা মানেই বিপদ।। ভয়ংকর বিপদ। বাবা প্রচণ্ড রাগ করবেন! কিন্তু কিছুতেই তারা হাসি থামাতে পারল না। মীরা খুব চেষ্টা করছেন না-হাসতে। দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরেছেন। লাভ হচ্ছে না। হাসি এসে যাচ্ছে। আর বুঝি আটকানো গেল না।
আফসার সাহেব মেঘগর্জন করলেন, রুমী সুমী, তোমরা আমার সামনে থেকে উঠে গেলে আমি খুশি হব।
মেয়ে দু জন তৎক্ষণাৎ ছুটে ঘরে চলে গেল। ঘরের ভেতর থেকে তাদের হাসি শোনা যাচ্ছে—হা-হা-হা– হি-হি-হি।ভ
এবার মীরাও হেসে ফেললেন। তবে শব্দ করে নয়, নিঃশব্দে। হাসির কারণে তাঁর হাত কাঁপছে। চায়ের কাপে ঠিকমতো চা চালতে পারছেন না।
মীরা।
কি?
হাসছ কেন জানতে পারি?
হাসি এসে গেল। তাই হাসছি। বিশেষ কোনো কারণে নয়।
কেন হাসি এসে গেল তা জানতে পারি?
সরি।
সরির কোনো ব্যাপার না। তুমি বল কেন হাসলে?
মীরা গম্ভীর গলায় বললেন, তুমি কেমন চমৎকার শূন্যে উঠে গেলো! হঠাৎ মনে হল, পৃথিবীতে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি বলে কিছু নেই। দৃশ্যটা দেখতে ভালো লাগল। তাই হাসলাম।
তুমি যদি আমার সামনে থেকে চলে যাও আমি খুশি হব।
সত্যি চলে যেতে বলছ?
যদি হাসি বন্ধ করতে না পার তাহলে অবশ্যই চলে যাবে।
তোমার নাশতা তো বিড়াল ফেলে দিয়েছে। নাশতা নিয়ে আসি?
না।
চা দিই, নাকি চা-ও খাবে না? ভালো করে তাকিয়ে দেখ, আমি কিন্তু হাসছি না। গম্ভীর হয়ে আছি।…
বলতে-বলতে মীরা ফিক করে হেসে ফেললেন। খানিকট চা ছিলকে টেবিলে পড়ে গেল। তিনি টী-পট নামিয়ে রেখে প্রায় ছুটে শোবার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন। দুই মেয়ের হাসির সঙ্গে যুক্ত হল তাঁর হাসি।
চায়ের কোপ হাতে আফসার সাহেব এক-একা বসে আছেন। তাঁর মন বিষগ্ন। শোবার ঘর থেকে মা এবং দুই মেয়ের হাসির শব্দ ভেসে আসছে। হাসির জোয়ার নেমেছে। রাগে আফসার সাহেবের গা জ্বলে গেল। যে-বিড়ালের জন্যে এত কাণ্ড, সে নিশ্চিন্ত এবং আনন্দিত ভঙ্গিতে মেঝেতে পড়ে থাকা ডিম, পনির এবং মাখন-রুটি খাচ্ছে। সে একা খাচ্ছে না, তার সঙ্গে দুটো বাচ্চাও আছে। তারাও খাচ্ছে এবং মাঝেমাঝে চোখ তুলে আফসার সাহেবকে দেখছে। আফসার সাহেবের ইচ্ছে করছে প্রচণ্ড লাথি দিয়ে বিড়ালটাকে ফুটবলের মতো দূরে ছুঁড়ে দেন।
মেঝে পরিষ্কার করার জন্যে কাজের ছেলে কুদ্দুস এসেছিল। আফসার সাহেব তার দিকে রাগী চোখে তাকাতেই সে ভয় পেয়ে রান্নাঘরে ঢুকে গেল। তারও কি হাসির রোগ আছে? রান্নাঘর থেকে হাসির মতো আওয়াজ আসছে। হ্যাঁ, কুদ্দুস ব্যাটাও হাসছে।
বিড়াল পরিবার মহানন্দে খেয়ে যাচ্ছে। আফসার সাহেবের রাগ ক্রমেই বাড়ছে। তিনি ঠিক করে ফেললেন-ডান পায়ে বিড়ালটার গায়ে একটা দুৰ্দান্ত কিক বসাকেন, যাতে সে ভবিষ্যতে কখনো এইভাবে তাঁকে অপদস্থ না-করে। বসাতে যাবেন, তখন একটা ব্যাপার ঘটল। তিনি পরিষ্কার শুনলেন-মা-বিড়ালটা যে-সব কথা বলছে তা তিনি বুঝতে পারছেন। ম্যাও ম্যাও করেই নিচু গলায় কথা বলছে, কিন্তু তিনি প্রতিটি শব্দ বুঝতে পারছেন। এ কী অদ্ভুত কাণ্ড!
মা-বিড়ালটা বলছে, খোকাথুকু সাবধান! লোকটা আমাদের দিকে তাকাচ্ছে, মতলব ভালো না। মনে হচ্ছে উঠে দাঁড়াবে।
একটা বাচ্চা বিড়াল বলল, উঠে দাঁড়ালে কী হয় মা?
লাথি মারতে পারে। তোমরা একটু দূরে সরে যাও।
কতটা দূরে যাব?
খুব বেশি দূর যেতে হবে না। লাথি মারলেও সে তোমাদের মারবে না। আমাকে মারবে। মানুষ কখনো বিড়ালের বাচ্চার গায়ে হাত তোলে না।
কেন মা?
মানুষের মনে মায়া বেশি, এই জন্যে। তবু সাবধানের মার নেই। এই লোক খুব রেগে আছে। রেগে গেলে মানুষের মাথার ঠিক থাকে না। কি করতে কি করে বসবে। কী দরকার রিস্ক নিয়ে?
রিস্ক কী মা?
রিস্ক হচ্ছে একটা ইংরেজি শব্দ। এর বাংলাটা ঠিক জানি না।
বিড়ালের বাচ্চা দুটি অনেকটা দূরে চলে গেল। সেখান থেকে তাকিয়ে রইল আফসার সাহেবের দিকে। আফসার সাহেব পাথরের মূর্তির মতো বসে রইলেন। ব্যাপারটা কী? বিড়ালের মানুষের মতো কথা বলার কোনোই কারণ নেই। শুধুমাত্র রূপকথার বইতে পশু-পাখি মানুষের মতো কথা বলে। এটা কোনো রূপকথা নয়। তিনি বিংশ শতাব্দীতে বাস করছেন। বাবর রোডের দোতলা বাসার ডাইনিং রুমে বসে আছেন। অফিসের গাড়ি চলে এসেছে, এখন অফিসে যাবেন। এই সময় বিড়ালের ভাষা তিনি বুঝতে পারছেন, তা হতেই পারে না। বিড়াল একটিমাত্র শব্দ জানে-মিয়াঁও। এই শব্দের কোনো মানে নেই। আর থাকলেও মানুষের তা বোঝার কথা না।
আফসার সাহেব সিগারেট ধরালেন।
একটা বিড়ালের বাচ্চা তখন কথা বলে উঠল, মা, লোকটা সিগারেট ধরিয়েছে। এখন বোধহয় আর আমাদের মারবে না।
বিড়ালের মা বলল, আমারও তাই ধারণা। তবে খোকাখুকু, এখন একটু সাবধানে থাক। কারণ লোকটা জ্বলন্ত সিগারেটের টুকরা ছুঁড়ে ফেলবে। গায়ে লাগলে তোমাদের পশমে আগুন ধরে যাবে। মনে নেই একবার জ্বলন্ত সিগারেটের টুকরায় পা দিয়ে পা পুড়িয়ে ফেললে, মনে আছে?
আছে। আচ্ছা মা, তোমার এত বুদ্ধি কেন?
দূর বেটিা আমার বুদ্ধি নেই।
তোমার অনেক বুদ্ধি। তুমি লাফ দিয়ে ওই লোকটার কোলে বসলে-এই জন্যেই তো সে নাশতার প্লেট মেঝেতে ফেলে দিলা তার নাশতা এখন আমরা খাচ্ছি। আচ্ছা! মা, তুমি রোজ এই রকম কর না কেন?
এ-রকম রোজ করা যায় না। পরপর দুদিন করলেই এরা রাগ করবে। আমাদের বাড়ি থেকে বের করে দেবে। একদিন করেছি। তো, সবাই ভাবছে অ্যাকসিডেন্ট।
অ্যাকসিডেন্ট কী মা?
অ্যাকসিডেন্ট হচ্ছে একটা ইংরেজি শব্দ। এর মানে দুর্ঘটনা।
তুমি ইংরেজিও জান?
অল্প-অল্প জানি, শুনে-শুনে শিখেছি। বাটার মানে মাখন, চীজ হল পনির, নরমাল ওয়াটার মানে পানি, তবে ফ্রীজের পানি না।…
ইস্ মা, তোমার যে কী বুদ্ধি!
আফসার সাহেবের মাথা ঘুরছে। গা-হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। এ-সব কী? তাঁর কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? এ-সব তো মাথা-খারাপের লক্ষণ। তিনি দ্রুত ভাবতে চেষ্টা করলেন তাঁর বংশে কোনো পাগল আছে কি না। মনে পড়ল না। তিনি তাকালেন। বিড়ালগুলির দিকে।
ছোট বিড়ালটা বলল, মা-দেখ, লোকটা আমার দিকে তাকাচ্ছে।
বিড়ালের মা বলল, লোকটা-লোকটা বলছি কেন? এইসব অসভ্যতা। আমরা উনার বাড়িতে থাকি। সম্মান করে কথা বলা উচিত।
কী বলব মা?
স্যার বল। স্যার বলাই ভালো। কিংবা ভদ্রলোক বলতে পার।
ভদ্রলোক বলা কি ঠিক মা? উনি একবার আমাদের বস্তায় ভরে ফেলে দিতে চেয়েছিলেন।
ফেলে তো দেয় নি।
উনার মেয়েগুলির জন্যে ফেলেননি। মেয়েগুলি কাঁদতে লাগল। লোকটা ভালো না মা। খারাপ লোক। সবসময় বকাঝকা করে।
সারাদিন অফিস করে ক্লান্ত হয়ে আসে। বকাঝকা করবে না তো কি! এই সব ছোটখাটো দোষ ধরতে হয় না।
একবার তোমার গায়ে লাথি দিয়েছিল মা!
মনের ভুলে দিয়েছে। রোজ তো আর দেয় না।
আফসার সাহেব আর সহ্য করতে পারলেন না। কী সর্বনাশ, এ-সব কী হচ্ছে! ক্লান্ত গলায় ডাকলেন, মীরা-মীরা। প্লীজ, তাড়াতাড়ি আস!
মীরা ছুটে বের হয়ে এলেন। রুমী সুমীও এল। তারা অবাক হয়ে তাকাচ্ছে। কুদ্দুসও রান্নাঘর থেকে মাথা বের করেছে। মীরা বললেন, কী ব্যাপার?
আফসার সাহেব কিছু বলতে পারলেন না। তিনি বিড়ালের কথা বুঝতে পারছেন, এই হাস্যকর কথা তাঁর পক্ষে বলা সম্ভব না। নিশ্চয়ই তাঁর শরীর খারাপ করেছে। মাথায় রক্ত উঠে গেছে কিংবা এই জাতীয় কিছু।
মীরা বললেন, তোমার মুখ এমন ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে কেন? শরীর খারাপ করেছে?
হুঁ। হঠাৎ মাথাটা ঘুরে উঠল।
নিশ্চয়ই প্ৰেশার। মহসিনকে খবর দেব? ও এসে তোমার প্ৰেশার মেপে দেবে।
কাউকে খবর দেবার দরকার নেই।
প্ৰেশার মাপলে ক্ষতি তো কিছু নেই। আর শোন, আজ অফিসে যাবারও দরকার নেই। প্রচুর ছুটি তোমার পাঞ্ছনা। অতিরিক্ত কাজের চাপে তোমার এই অবস্থা হয়েছে। সুমী, যা তো, নিচে গিয়ে ড্রাইভারকে বলে আয় আজ তোর বাবা অফিসে যাবে না।
মীরা তাঁকে বিছানায় গুইয়ে দিলেন। জানালার পর্দা টেনে ঘর খানিকটা অন্ধকার করে দিলেন।
তুমি চুপচাপ শুয়ে বিশ্রাম নাও। আমি মহসিনকে খবর দিচ্ছি। ও বিকেলে এসে তোমার প্ৰেশার মাপবে।
আফসার সাহেব কিছু বললেন না। মহসিন এসে তাঁর প্ৰেশার মাপবে এই খবরও তাঁর ভালো লাগল না। মহসিন মীরার সবচেয়ে ছোট ভাই। কিছুদিন হল ডাক্তারি পাস করে বের হয়েছে। এমনিতে ছেলে খুব ভালো, তবে ঠাট্টা-তামাশা বড় বেশি করে। সহ্য করা যায় না।
মীরা।
কি?
মহসিনকে খবর দেবার দরকার নেই।
আচ্ছা যাও, খবর দেব না।
তুমি একটু বস তো আমার পাশে।
মীরা বসলেন। কপালে হাত দিয়ে স্বামীর গায়ের উত্তাপ দেখলেন। গা ঠাণ্ডা, জ্বর নেই। কিন্তু চোখ-মুখ যেন কেমন দেখাচ্ছে। যে-কোনো কারণেই হোক মানুষটা খুব ভয় পেয়েছে। গলার স্বরও জড়ানো।
মীরা।
কী?
আফসার সাহেব ইতস্তত করে বললেন, তুমি কি বিড়ালের কথা বুঝতে পার?
মীরা হতভম্ব হয়ে বললেন, বিড়ালের কথা বুঝতে পারি মানে! এ-সব কী বলছ?
আফসার সাহেব অত্যন্ত বিব্রত ভঙ্গিতে বললেন, আমার ধারণা বিড়াল মাঝেমাঝে মানুষের মতো কথা বলে। মন দিয়ে শুনলে ওদের সব কথা বোঝা যায়।
মীরা বিস্মিত হয়ে বললেন, তুমি ওদের কথা বুঝতে পারছ?
হ্যাঁ।
বুঝতে পারলে ভালো। এখন ঘুমুতে চেষ্টা কর।
আফসার সাহেব চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলেন। রুমী সুমী স্কুলে গেল না। মাঝেমাঝে পা টিপে-টিপে এসে বাবাকে দেখে গেল। সুমী বাবার কানে-কানে বলল, তোমার কী হয়েছে বাবা? তিনি জবাব দিলেন না। তাঁর কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না।
মা-বিড়ালটা একবার এসে ঘুরে গেল। সে দুঃখিত গলায় তার বাচ্চাদের বলল, বেচারা আজ অফিসে গেল না কেন বুঝতে পারছি না। অসুখবিসুখ করল কি না কে জানে? চারদিকে ইনফ্লুয়েঞ্জা হচ্ছে।
একটা বাচ্চা বলল, ইনফ্লুয়েঞ্জা কী মা?
একটা রোগের নাম। এইসব তুমি বুঝবে না। সবসময় প্রশ্ন করে বিরক্ত করবে না।
প্রশ্ন না করলে জানব কী করে?
মা-বিড়াল বলল, এখন এ-ঘর থেকে চলে যাও। বেচারা ঘুমানর চেষ্টা করছে। তাকে ঘুমুতে দাও।
ইনফ্লুয়েঞ্জা কী, তা তো তুমি বললে না!
বললাম তো ইনফ্লুয়েঞ্জা একটা অসুখের নাম। তখন জ্বর হয়, মাথায় পানি ঢালতে হয়।
আমাদের কি ইনফুয়েঞ্জা হয়?
না, আমাদের হয় না।
আমাদের কী কী অসুখ হয় মা?
আহ্, চুপ কর তো! বেচারাকে কি তোমরা ঘুমুতে দেবে না?
আমাদের কী কী অসুখ হয় সেটা যদি তুমি আমাদের না-বল তাহলে আমরা শিখব কী করে?
বারান্দায় চল। কারান্দায় বলব।
বিড়াল তার দু বাচ্চাকে নিয়ে বের হয়ে গেল। বাচ্চা দুটির যাবার তেমন আগ্ৰহ নেই। বারবার ফিরে তাকাচ্ছে।
আফসার সাহেব সারা দিন বিছানায় শুয়ে রইলেন। তাঁর বুক ধকধক করছে, মাথা ঘুরছে। এ কী সমস্যা! এ কী সমস্যা!
সন্ধ্যাবেলা তাঁর ছোট শ্যালক মহসিন এসে উপস্থিত। সঙ্গে প্ৰেশার মাপার যন্ত্র। মীরা বলেছিল তাকে খবর দেবে না। কিন্তু খবর দিয়েছে। মীরা কথা রাখেনি। আফসার সাহেব মহসিনকে সহ্যই করতে পারেন না, দেখামাত্র তাঁর মাথায় রক্ত উঠে যায়। আজও উঠে গেল। মহসিন দাঁত বের করে বলল, কেমন আছেন দুলাভাই?
তিনি শুকনো গলায় বললেন, ভালো।
শুনলাম আজ অফিসে যান নি।
শরীরটা ভালো লাগছে না।
শুয়ে-শুয়ে কী করছেন?
কিছু করছি না।
বুবু বলছিলেন–আপনি নাকি এখন অ্যানিম্যাল ল্যাংগোয়েজে এক্সপার্ট হয়ে গেছেন—হা-হা-হা।
আফসার সাহেবের ইচ্ছে করল। ফাজিলটার গালে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিতে। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলালেন।
বিড়ালের সব কথা নাকি বুঝে ফেলছেন?
আফসার সাহেব চুপ করে রইলেন। মহসিন বলল, বিড়াল কোন ভাষায় কথা বলে দুলাভাই? সাধুনা চলিত?
আমার শরীরটা ভুলো লাগছে না।–তুমি অন্য ঘরে যাও।
রাগ করছেন নাকি?
না, রাগ করছি না। তুমি আমাকে একটু একা থাকতে দাও!
আগে প্ৰেশারটা মাপি, তারপর যত ইচ্ছা একা থাকবেন।
প্ৰেশার মাপা হল। দেখা গেল প্ৰেশার স্বাভাবিক। মহসিন বলল, আপনার সমস্যা কি জানেন দুলড়াই? আপনার সমস্যা হচ্ছে-গাষ্ঠীর্য একটু সহজ হোন। স্বাভাবিকভাবে হাসি-তামাশায় জীবন পার করার চেষ্টা করুন। দেখবেন, বিড়ালের কথা আর শুনতে পাচ্ছেন না।
তুমি যাও তো এ-ঘর থেকে।
যাচ্ছি। কয়েকটা ঘুমেরট্যাবলেট দিয়ে যাচ্ছি। রাতে দুটা খেয়ে ঘুমুবেন। আপনার ঘুম দরকার।
আফসার সাহেব মীরার ওপর খুবই রাগ করলেন। মীরা কাজটি ঠিক করে নি। কেন সে এই ব্যাপারটা জানাচ্ছে? বিড়ালের কথা বুঝতে পারার পুরো ব্যাপারটা যে হাস্যকর তা কি তিনি বোঝেন না? খুব ভালো বোঝেন। তিনি জানেন, তাঁর কোনো সমস্যা হয়েছে… হয়তো মাথা গরম হয়ে আছে কিংবা কানো কোনো সমস্যা হয়েছে। এটা কি লোকজনকে বলে বেড়ানোর মতো ঘটনা? সবকিছু সবাইকে বলতে নেই, এই সাধারণ বুদ্ধি কি মীরার নেই?
দেখা গেল, সন্ধ্যা নাগাদ লোকজনে বাড়ি ভরে গেল। ঢাকার আত্মীয়স্বজনরা অনেকেই এসে গেছেন। সবার মুখে রহস্যময় হাসি। রাগে-দুঃখে আফসার সাহেবের চোখে পানি এসে গেল।
এমন অবস্থা হবে জানলে তিনি কিছুতেই মীরাকে ব্যাপারটা বলতেন না।
আফসার সাহেব সারারাত জেগে কাটালেন। এক ফোঁটা ঘুম হল না। তন্দ্ৰামতো আসে আর মনে হয় কী ভয়ংকর কাও ঘটে গেছে—, তিনি বিড়ালের কথা বুঝতে পারছেন! তখনি ঘুম ভেঙে যায়। তিনি ধড়মড় করে উঠে বসেন। তাঁর সঙ্গে-সঙ্গে মীরাও রাত জেগেই কটালেন। মীরা একসময় বললেন, এত অস্থির হচ্ছ কেন? যদি বিড়ালের কথা বুঝতে পার-পারলে। এতে অসুবিধা তো কিছু হচ্ছে না।
আফসার সাহেব বললেন, আমি যে বিড়ালের কথা বুঝতে পারি তা কি তুমি বিশ্বাস কর?
মীরা বললেন, হ্যাঁ, করি।
না। তুমি বিশ্বাস কর না। আমাকে সত্ত্বনা দেবার জন্য বলছি।
তুমি ঘুমুবার চেষ্টা কর।
চেষ্টা করছি।–লাভ হচ্ছে না। আমার এ কী সর্বনাশ হল বল তো?
কোনো সর্বনাশ হয় নি। দেখবে কাল ভোরেই সব ঠিক হয়ে গেছে।
কীভাবে ঠিক হবে?
আমি ব্যবস্থা করব।
কী ব্যবস্থা করবো?
ভোর হোক, তখন দেখবে।
শেষবরাতের ঠাণ্ডায়—ঠাণ্ডায় আফসার সাহেব ঘুমিয়ে পড়লেন। ঘুম ভাঙল সকাল দশটায়। বাসা খালি। বাচ্চারা স্কুলে চলে গেছে। মীরা নাশতা বানিয়ে অপেক্ষা করছেন। আফসার সাহেব হাত-মুখ ধুয়ে নাশতার টেবিলে বসলেন। আশেপাশে বিড়ালগুলিকে দেখতে পেলেন না। খানিকটা নিশ্চিন্ত বোধ করলেন। মীরা বললেন, আজ অফিসে গিয়ে লাভ নেই। রাতে ভালো ঘুম হয় নি। বাসায় থাক, রেষ্ট নাও!
আরে না। পরপর দু দিন কামাই দেওয়ার কোনো মানে হয় না। ভালো কথা—বিড়ালটা কোথায়?
জানি না। আছে নিশ্চয়ই কোথাও। বাদ দাও তো।
আফসার সাহেব অফিসে চলে গেলেন। অফিসে নানান কাজে সময় কেটে গেল।
একটা মীটিং ছিল, মীটিং শেষ করে বাসায় ফিরতে-ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেল।
বাসায় ফিরে স্বস্তি বোধ করলেন। বিড়াল নেই। তিনি কিছু জিজ্ঞেস করলেন না, তবে বুঝলেন—কুদ্দুস এদের বাসা থেকে তাড়িয়েছে। ভালোই করেছে। অনেকদিন পর আফসার সাহেব সুমী রুমীকে সঙ্গে নিয়ে টিভি দেখলেন। কি একটা ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান হচ্ছে। ভয়ংকর রোগা একটা লোক নানা ধরনের আবোল-তাবোল কথা বলে হাসাবার চেষ্টা করছে। আফসার সাহেবের ক্ষমতা থাকলে চড় দিয়ে বদমাশটার সব কটা দাঁত ফেলে দিতেন। ক্ষমতা নেই বলে কিছু করতে পারলেন না। রুমী বলল, লোকটা কি রকম মজা করতে পারে দেখলে বাবা? এমন হাসাতে পারে!
তিনি হু-জাতীয় শব্দ করলেন এবং ভাব করলেন যেন মজা পাচ্ছেন। রাতে দুই মেয়ে যখন স্কুলে কি-সব ঘটনা ঘটেছে বলতে শুরু করল, সে-সবও তিনি মন দিয়ে শোনার চেষ্টা করলেন। স্নাত দশটায় মহসিন টেলিফোন করল :
দুলাভাই, ভালো?
হ্যাঁ, ভালো।
বিড়ালের কথা নিশ্চয়ই আর শোনেন নি?
না।
ভেরি গুড। রাতে ঘুমুতে যাবার আগে ঘুমের ট্যাবলেট দুটা মনে করে খাবেন।
আচ্ছা।
এই সঙ্গে আপনাকে একটা ছোট্ট অ্যাডভাইস দিচ্ছি। সবসময় এমন কঠিন ভাব করে থাকবেন না। রিল্যাক্স করুন। হাসুন, গল্প করুন। সবাইকে নিয়ে কোথাও বেড়াতে যান।
কোথায় যাব?
কক্সবাজার চলে যান। আসলে আপনার যা হয়েছে তা হল-নাৰ্ভ উত্তেজিত হয়েছে। নাৰ্ভ একসাইটেড হলে এ-সব হতে পারে। রাখি দুলাভাই?
আচ্ছা।
রাত এগারটার দিকে হাত-মুখ ধুয়ে এক গ্লাস গরম দুধ খেয়ে আফসার সাহেব ঘুমুতে গেলেন। ঘুমের ট্যাবলেট খাবার ইচ্ছে ছিল না—এমনিতেই ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে, তবু দুটা ট্যাবলেট খেলেন! ভালো ঘুম হল। একটানা ঘুম ঘুম ভাঙল খুব ভোরে। তিনি শোবার ঘর থেকে বের হয়ে বারান্দায় এসে বেতের চেয়ারে বসলেন। রাতে ভালো ঘুম হওয়ায় শরীরটা ঝরঝরে লাগছে। বারান্দায় বসে সকাল হওয়া দেখতে তাঁর সবসময়ই ভালো লাগে। এক কাপচা পেলে হত। চা বানানোর কেউ নেই। সবাই ঘুমুচ্ছে। তিনি নিজেই রান্নাঘরে ঢুকে গেলেন। চা বানানো এমন কোনো কঠিন কর্ম না। পানি গরম করতে পারলেই হল।
চায়ের কাপ হাতে আফসার সাহেব চেয়ারে এসে বসলেন। তখনই মা– বিড়ালটাকে দেখতে পেলেন। পিলারের আড়ালে চুপচাপ বসে আছে। বাচ্চা দুটিও আছে। হাঁটা, তারা কথা বলছে। আফসার সাহেব তাদের প্রতিটি কথা বুঝতে পারছেন।
ছোট বিড়াল : মা দেখ, ভদ্রলোক চা খাচ্ছেন।
মা : বললাম না চুপ থাকতে, কথা বলছিস কেন?
ছোট বিড়াল : মা, উনাকে জিজ্ঞেস কর তো-কেন আমাদের বস্তায় ভরে ফেলে দিয়ে এল?
মা : আহ্! কী যে বোকার মতো কথা বলিসা মানুষ কি আমাদের কথা বোঝে? বুঝলে তো সব সমস্যার সমাধানই হত। মানুষ যদি একবার পশুদের কথা বুঝত তাহলে পশুদের আর কোনো দুঃখ থাকত না।
ছোট বিড়াল : যদি আমাদের কথা বুঝতে পারত। তাহলে আমি উনাকে কী বলতাম, জান?
মা :কী বলতে?
ছোট বিড়াল : বলতাম–কেন আপনারা আমাদের এমন কষ্ট দিলেন? সারা রাত হোটে-হেঁটে এসেছি। আমরা তো ছোট, আমাদের বুঝি কষ্ট হয় না?
ছোট বিড়াল দুটির একটি শুধু কথা বলছে। অন্যটি শুয়ে আছে। মা-বিড়ালটি একটু পরপর জিভ দিয়ে শুয়ে থাকা বাচ্চাটাকে চেটে দিচ্ছে। এই বিড়ালটা খুবই অসুস্থ। দীর্ঘ পথ হেঁটে এসে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। মা-বিড়াল তার কানে—কানে বলল–
মা বিড়াল : খুব খারাপ লাগছে মা?
অসুস্থ বিড়াল হ্যাঁ।
মা : খিদে লেগেছে?
অসুস্থ বিড়াল : হ্যাঁ।
মা : আমার লক্ষ্মী সোনা। চুপ করে শুয়ে থাক। দেখি কিছু পাওয়া যায় কি না।
অসুস্থ বিড়াল : মা, আমরা কি লুকিয়ে থাকব?
মা : লুকিয়ে থাকাই ভালো। দেখতে পেলে ওরা হয়তো আবার আমাদের বস্তায় ভরে দূরে কোথাও ফেলে দিয়ে আসবে।
অসুস্থ বিড়াল : মানুষরা এমন কেন?
মা : পৃথিবীটা তো মা মানুষরাই দখল করে নিয়েছে। পৃথিবী এখন চলছে। ওদের ইচ্ছামতো।
অসুস্থ বিড়াল : পৃথিবী ওরা দখল করে নিয়েছে কেন মা?
মা : ওদের বুদ্ধি বেশি।
অসুস্থ বিড়াল : আমাদেরও তো মা বৃদ্ধি বেশি। তোমার মতো বৃদ্ধিতো কারোরই নেই।
মা : আমাদের বুদ্ধি কোনো কাজে লাগে না রে মা। আর কথা বলিস না। তোর শরীর দুর্বল।
অসুস্থ বিড়াল :মা, ঐ ভদ্রলোক কী খাচ্ছেন?
মা : চা খাচ্ছেন।
অসুস্থ বিড়াল : আমার একটু চা খেতে ইচ্ছা করছে মা।
মা : ইচ্ছা করলেই তো খাওয়া যায় না সোনা।
আফসার সাহেব উঠে পড়লেন। ফ্ৰীজ খুলে দুধ বের করলেন। বাটিতে দুধ ঢাললেন। কয়েক টুকরা পাউরুটি নিলেন। খানিকটা জেলিও পিরচের এক কোণায় দিলেন। খাবারগুলি পিলারের কাছে রাখলেন। চায়ের কাপে সামান্য চা ছিল। একটা পিরিচে তা-ও ঢেলে এগিয়ে দিলেন।
ছোট বিড়াল; মা, উনি এ-সব করছেন কেন?
মা : বুঝতে পারছি না।
ছোট বিড়াল : উনি কি আমাদের খেতে দিচ্ছেন?
মা : তা-ই তো মনে হচ্ছে!
ছোট বিড়াল : আমরা কি খাব?
মা : একটু অপেক্ষা করে দেখি।
ছোট বিড়াল : আমার ভয়ভয় লাগছে মা। আমার মনে হচ্ছে খেতে যাব, আর ওমনি উনি আমাদের ধরে বস্তায় ভরবেন।
মা : অন্যের সম্পর্কে এত ছোট ধারণা করতে নেই মা! এতে মন ছোট হয়। উনি ভালবেসে খেতে দিয়েছেন। এস, আমরা খাই।
তারা তিন জনই এগিয়ে গেল। ছোট বিড়াল দুটি একসঙ্গে দুধের বাটিতে জিত ভেজাতে লাগল। মা-বিড়াল বিরক্ত হয়ে বলল, তোমরা দেখি ভদ্রতা কিছুই শিখলে না! উনাকে ধন্যবাদ দেবে না? ধন্যবাদ দাও! ছোট বিড়াল দুটি একসঙ্গে বলল, ধন্যবাদ।
খাওয়া শেষ করে আর একবার ধন্যবাদ দেবে।
আচ্ছা।
ছোটো বিড়ালটা বলল, পিরচের গায়ে লাল রঙের এই জিনিসটা কী মা?
এর নাম জেলি, রুটি দিয়ে খায়। তোমাদের জেলি খাওয়া ঠিক হবে না।
কেন মা?
এতে দাঁত খারাপ হয়।
এই পর্যায়ে মীরা শোবার ঘর থেকে বের হলেন। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। আফসার সাহেব থমথমে গলায় বললেন, তুমি কি বিড়ালগুলিকে বস্তায় ভরে ফেলে দিতে বলেছিলে?
মীরা বললেন, তোমাকে কে বলল?
ফেলে দিতে বলেছিলে কি বল নি?
হ্যাঁ, বলেছিলাম।
খুব অন্যায় করেছ।
অন্যায় করব কেন? এর আগেও তো একবার বস্তায় ভরে বিড়াল ফেলা হয়েছে। সেবার তো তুমিই ফেলতে বলেছিলে। বল নি?
আর ফেলবে না।
এদেরকে কি তুমিই খাবার দিয়েছ?
হ্যাঁ।
এখনো কি তুমি এদের কথা বুঝতে পারছ?
পারছি।
মীরা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন। তাঁর মনে হল ব্যাপারটাকে আর অবহেলা করা ঠিক হবে না। কোনো- একজন ডাক্তারের কাছে তাঁকে নিতে হবে। কোনো বড় মনোবিজ্ঞানী, যিনি ব্যাপারটা বুঝবেন।
নাশতার টেবিলে মীরা বললেন, আজ সন্ধ্যায় তোমাকে যদি কোনো ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে চাই, তুমি যাবে?
সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে?
হ্যাঁ।
সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে কোন যাব? তোমার কি ধারণা, আমি পাগল?
না, তুমি পাগল না। আবার ঠিক সুস্থও না। কোনো সুস্থ মানুষ কখনো বলবে না, সে বিড়ালের কথা বুঝতে পারছে।
আফসার সাহেব কোনো উত্তর দিলেন না।
মীরা বললেন, তুমি অফিসে চলে যাও। ঘরে বসে-বসে বিড়ালের কথা শুনলে হবে না। এইসব নিয়ে একেবারেই চিন্তা করবে না। সন্ধ্যাবেলা আমরা একজন বড় ডাক্তারের কাছে যাব।
ঠিক আছে, যাব। কিন্তু বিড়ালগুলিকে তুমি তাড়াবে না। দুপুরে আলাদা করে খেতে দেবে। রাতেও খেতে দেবে। মনে থাকে যেন।
তোমার কি মনে হয় না, তুমি বাড়াবাড়ি করছ?
আফসার সাহেব শীতল গলায় বললেন, না, আমি বাড়াবাড়ি করছি না। বলেই মনে হল হয়তো তিনি ঠিক বলছেন না। কিছুটা বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। এখন তাঁর আচরণ নিশ্চয়ই সহজ-স্বাভাবিক মানুষের আচরণ নয়। অস্বাভাবিক একজন মানুষের আচরণ। তাঁকে যদি কেউ সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে যেতে চায়, তাহলে তাকে দোষ দেওয়া যাবে না। তিনি ক্লান্ত গলায় বললেন, মীরা, এ কী সমস্যায় পড়া গেল বল তো!
মীরা বললেন, সব ঠিক হয়ে যাবে।
আফসার সাহেব ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেললেন। তাঁর কেন জানি মনে হচ্ছে, কিছুই ঠিক হবে না। যতই দিন যাবে ততই সব এলোমেলো হয়ে যাবে।
পাগলের ডাক্তারদের চেহারা
পাগলের ডাক্তারদের চেহারায় না-হোক, চোখে খানিকটা পাগল-পাগল ভাব থাকে। তারা সহজভাবে আলাপ-আলোচনা করতে-করতে দুম করে কঠিন কোনো কথা বলে সরু চোখে রুগীর দিকে তাকিয়ে থাকে। কথাবার্তা বলতে হয় বিছানায় শুয়ে। একটা ছবি চোখের সামনে ধরেজিজ্ঞেস করে, ছবি দেখে আপনার মনে যা আসছে বলুন তো! কী দেখছেন ছবিতো? পাগলের ডাক্তার বা সাইকিয়াটিস্ট সম্পর্কে আফসার সাহেবের এই ছিল ধারণা। তিনি এমন একজন লোকের সঙ্গে দেখা করবেন, এ-জাতীয় মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে ঘর থেকে বেরুলেন। যাঁর সঙ্গে দেখা হল তাকে দেখে মোটামুটি হতাশই হলেন। লুঙ্গি-পরা আধাবুড়ো একজন লোক, যে দরজা খুলেছে খালি গায়ে এবং তাঁদের দেখেই ব্যতিব্যস্ত হয়ে শার্ট খুঁজতে শুরু করেছে। আলনায় বেশ কয়েকটা শার্ট এক জায়গায় রাখা। একটা নিতে গিয়ে ভদ্ৰলোক সব কটা ফেলে দিলেন। যে—শার্ট গায়ে দিলেন তার সবগুলি বোতাম সাদা রঙের, কিন্তু মাঝখানের একটা বোতাম কালো।
ভদ্রলোক বিব্রত গলায় বললেন, আসুন, আসুন। আপনাদের সাতটার সময় আসার কথা ছিল না?
মীরা বললেন, একটু আগে এসে পড়েছি। বাসা খুঁজে পাব কি না বুঝতে পারছিলাম না, এই জন্যে সকল—সকাল রওনা হয়েছিলাম। আগে এসে আপনাকে অসুবিধায় ফেলি নি তো?
জ্বি-না, কোনো অসুবিধা নেই। বসুন, আমি চায়ের ব্যবস্থা করি।
ভদ্রলোক তাঁদের কিছু বলার সুযোগ না-দিয়ে ছোটো একটা কেতলি হাতে বের হয়ে গেলেন। পায়ে স্পঞ্জের স্যাণ্ডেল, পরনে লুঙ্গি। সেই লুঙ্গিও যে খুব ভদ্রভাবে পরা, তা নয়। মনে হচ্ছে যে-কোনো সময় কোমর থেকে খুলে আসবে।
আফসার সাহেব বললেন, এই তোমার সাইকিয়াটিস্ট?
মীরা বললেন, হ্যাঁ। তাঁর পোশাক-আশাক দেখে বিভ্রান্ত হয়ে না। উনি বিখ্যাত ব্যক্তি। নাম বললেই চিনবে–উনি মিসির আলি।
মিসির আলি আবার কে?
মানসিক সমস্যার বিশ্লেষণের ব্যাপারে তাঁর মতো মানুষ এখনো জন্মায় নি। অতি বিখ্যাত ব্যক্তি।
অতি বিখ্যাত ব্যক্তির হল তো দেখছি ফকিরের মতো! ঘরের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে—খেতে পান না।
উনি কখনো কারও কাছ থেকে কোনো টাকা পয়সা নেন না।
চলে কী করে? আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্যারাসাইকোলজি পড়াতেন। এখন চাকরি চলে গেছে। শুনেছি টিউশনি করেন।
আফসার সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, তুমি কিছু মনে করো না। যত বিখ্যাত ব্যক্তিই হোন, আমার কিন্তু তাঁর উপর বিন্দুমাত্র ভক্তি-শ্রদ্ধা হচ্ছে না।
ভক্তি-শ্রদ্ধার তো কোনো ব্যাপার নেই। তুমি তোমার সমস্যার কথা বলবে– ফুরিয়ে গেল।
আমি এই ভদ্রলোকের সঙ্গে কোনো কথাই বলব না। উনি চা আনতে গেছেন। চা এলে চা খাব। চলে যাব।
আচ্ছা, এখন বস।
কোথায় বসব? বসার জায়গা কোথায়?
ঘরে বসার জায়গা আসলেই নেই। দুটি চেয়ারের একটার ওপর কেরোসিন কুকার। অন্যটির ওপর গাদাখানিক বই। বিছানায় বসা যায়। তবে সেই বিছানায় চাদরের ওপর কি কারণে জানি খবরের কাগজ বিছানো। বসতে হলে খবরের কাগজের ওপর বসতে হয়।
আফসার সাহেব বিরক্ত মুখে খবরের কাগজের ওপর বসলেন। মীরা বসলেন স্বামীর পাশে। মিসির আলির নামের সঙ্গে মীরার পরিচয় আছে। মুখোমুখি এই প্রথম দেখলেন। মীরার ভাই মহসিন ঠিকানা দিয়েছে। এবং বলেছে-এই লোকের চেহারায় বিভ্ৰান্ত না-হতে। মীরা নিজেও এখন খানিকটা বিভ্ৰান্ত বোধ করছেন। প্রফেশনাল কোনো সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যাওয়াই ভালো ছিল। অ্যামেচারীদের ওপর খুব ভরসা। করা যায় না।
মিসির আলি চায়ের কেতলি এবং তিনটা কাপ হাতে ঢুকলেন। কাপে চা ঢালতেঢালতে বললেন, আফসার সাহেব, আপনি কেমন আছেন?
ভালো। আমার নাম জানলেন। কী করে?
আপনার শ্যালক মহসিন সাহেব, উনিই আপনার নাম বলেছেন। আপনার সমস্যা কি, তার আভাসও দিয়েছেন। এখন আপনি বলুন, সমস্যাটা আপনার মুখ থেকে শুনি।
ও যা বলেছে তাই। নতুন করে আমার কিছু বলার নেই।
আপনি কি কিছু বলতে চাচ্ছেন না?
জ্বি-না।
কেন বলুন তো?
আফসার সাহেব উত্তর না।
মিসির আলি হাসিমুখে বললেন, যে-কোনো কারণেই হোক, আপনি আমাকে পছন্দ করছেন না। সাইকিয়াটিস্ট হিসেবে আমি সম্ভবত আপনাকে ইমপ্রেস করতে পারি নি! এটা নতুন কিছু না। সবার ক্ষেত্রে ঘটে। তখন আমি কী করি জানেন? এমন কিছু করি, যাতে আমার ওপর বিশ্বাস ফিরে আসে। কারণ পুরোপুরি বিশ্বাস না-আসা পর্যন্ত আমি কোনো সাহায্য করতে পারি না। যেই মুহূর্তে আমার ওপর আপনার পরিপূর্ণ আস্থা আসবে, সেই মুহূর্ত থেকে আপনি আমার কথা মন দিয়ে শুনবেন। আমার যুক্তি গ্রহণ করবেন।
আফসার সাহেব বললেন, তাহলে বিশ্বাস অর্জনের জন্য কিছু করুন।
পারছি না। সবসময় পারি না।
আফসার সাহেব চায়ের কাপ নামিয়ে রাখতে—রাখতে বললেন, মীরা, চল যাই।
মীরা দুঃখিত গলায় বললেন, তুমি ওঁকে কিছুই বলবে না?
না।
সমস্যাটা নিজের মুখে বলতে অসুবিধা কী?
আফসার সাহেব কঠিন দৃষ্টিতে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, চল যাই। আমার শরীর ভালো লাগছে না। বাসায় গিয়ে শুয়ে থাকব। তা ছাড়া আমার কোনো সমস্যাও নেই।
মিসির আলি উঠে দাঁড়ালেন। সহজ গলায় বললেন, চলুন, আপনাদের রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসি।
তার প্রয়োজন হবে না।
অনেক অপ্রয়োজনীয় কাজ আমি করি আপনাদের জন্যে চা আনার কোনো প্রয়োজন ছিল না, তবু এনেছি। চা অনেক দূর থেকে আনতে হয়েছে। চা-টা যেন গরম থাকে এ—জন্যে ছুটতে-ছুটিতে এসেছি। চা গরম ছিল না?
আফসার সাহেব একটু বিব্রত বোধ করলেন। মীরা আবার বললেন, বস না। কিছু বলতে না-চাইলে বলবে না। দু মিনিটের জন্যে বস।
আফসার সাহেব বসলেন।
মিসির আলি বললেন, আমার ধারণা, অফিসে চাকরি সম্পর্কিত বড় রকমের সমস্যায় আপনি আছেন। সম্ভবত আপনার চাকরি চলে গেছে। এটা কি ঠিক?
মীরা ভয়ংকরীভাবে চমকে উঠলেন।
আফসার সাহেব চমকালেন না। স্থির দৃষ্টিতে অনেকক্ষণ মিসির আলির দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, আপনি ঠিকই ধরেছেন। তবে চাকরি এখনো যায় নি। হয়তো শিগগিরই চলে যাবে। অফিসের মালিকপক্ষের সঙ্গে অনেক দিন থেকেই বনিবন্যা হচ্ছিল না। গত দু মাসে তা চরম আকার নিয়েছে। এখন অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, হয় ওরা আমাকে ছাড়িয়ে দেবে, নয়তো আমিই রিজাইন করব।
মীরা ক্ষীণ গলায় বললেন, এইসব কিছুই তো তুমি আমাকে বল নি।
আফসার সাহেব বললেন, তোমাকে বলার সময় হয় নি বলেই বলি নি। সময় হলে নিশ্চয়ই বলতাম।
এত বড় একটা ব্যাপার তুমি গোপন করে রাখবে?
হ্যাঁ, রাখব।
আফসার সাহেব পকেট থেকে সিগারেট বের করতে—করতে মিসির আলির দিকে তাকিয়ে বললেন, আমার এই ব্যাপার আপনি কী করে অনুমান করলেন?
খুব সহজেই অনুমান করেছি। কোনো মানসিক সমস্যা যখন হয় তখন তার পিছনে কিছু-না-কিছু কারণ থাকে। পারিবারিক অশান্তি, চাকরির ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা ইত্যাদি। একটা ছোটো বাচ্চা যখন পরিবারের কারো সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পায় না, যখন সে দেখে বাবা-মা সারাক্ষণ ঝগড়া করছেন-তখন সে কথা বলা শুরু করে টবের ফুলগাছের সঙ্গে। এমনভাবে কথা বলে, যেন ফুলগাছটা তার কথা শুনছে, কথার জবাব দিচ্ছে। আসলে এ-রকম কিছু ঘটছে না।
আপনার ধারণা আমি বিড়ালের কথা বুঝতে পারি না? আমি যা বলছি বানিয়ে— বানিয়ে বলছি?
না, আমি তেমন কিছু ধারণা করছি না। আপনি যা বলছেন তা-ই বিশ্বাস করছি। সেই বিশ্বাস থেকেই আমি এগোব।
এবং একসময় আপনি প্রমাণ করতে চেষ্টা করবেন যে আমি যা বলছি তা ভুল।
তা-ও না। আমি সত্য যা তা-ই প্রমাণ করতে চেষ্টা করব। আপনি সহজ হয়ে। সহজভাবে আমার কথার জবাব দিন। সত্য প্রতিষ্ঠায় আমাকে সাহায্য করুন। আপনার ব্যাপারে খুবই আগ্ৰহ বোধ করছি।
কেন?
কারণ আপনি যা বলছেন, তা আগে কেউ বলে নি। কিছু-কিছু পীর-দরবেশের কথা আমরা বইপত্রে পাই, যাঁরা দাবি করতেন পশু-পাখির কথা বুঝতে পারেন, কিন্তু সেই দাবির পক্ষে তেমন কোনো প্ৰমাণ পাই না। একজন অতি বিখ্যাত ভারতীয় চিকিৎসকের কাহিনী আছে, যিনি গাছপালা থেকে অষুধ তৈরি করতেন। তাঁর সম্পর্কে প্রচলিত গল্প হচ্ছে-তিনি গাছের কথা বুঝতে পারতেন। তিনি পথ দিয়ে যখন হেঁটে যেতেন, গাছ তাঁকে ডেকে বলত।–তুমি আমার পাতা ছিঁড়ে নিয়ে যাও। পাতার ব্লস বের করে শ্বাসকষ্টের রুগীকে মধু মাখিয়ে খেতে দাও। রোগ আরোগ্য হবে। প্রাচীন ভারতের ঐ চিকিৎসকের নাম গল্পে আছে–মহাদেব একবার রাগে অন্ধ হয়ে ব্ৰহ্মার মাথা কেটে ফেলেছিলেন। কোনো উপায় না দেখে পৃথিবী থেকে অশ্বিনীকুমারকে দেবলোকে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি সেই ছিন্ন মস্তক জোড়া লাগান।
আফসার সাহেব বললেন, আমি কি একটা সিগারেট খেতে পারি?
অবশ্যই পারেন। ইচ্ছা করলে আমাকে একটা দিতেও পারেন।
আফসার সাহেব সিগারেট ধরিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে লাগলেন। তবে মিসির আলিকে সিগারেট দিলেন না। একজন সিগারেট চেয়েছে, তার পরেও তাকে দেওয়া হচ্ছে না। ব্যাপারটা দৃষ্টিকটু।
মিসির আলি বললেন, কী ব্যাপার, সিগারেট দেবেন না? কেড়ে নিতে হবে?
আফসার সাহেব বললেন, সরি। এই নিন। বলেই হেসে ফেললেন।
মীরা লক্ষ করলেন, আফসার সাহেব অনেকটা সহজ হয়ে এসেছেন। মুখের কাঠিন্য কমে গেছে। মীরা মিসির আলি নামের লোকটির প্রতি কৃতজ্ঞতা বোধ করলেন। এই লোক আর কিছু পারুন না-পরুিন, তাঁর স্বামীর প্রাথমিক কাঠিন্য ভেঙে দিয়েছেন। এটি কম কথা নয়। তা ছাড়া লোকটির কথা বলার ভঙ্গিও তাঁর ভালো লাগল। কথাবার্তায় কোনো সবজান্তা ভঙ্গি নেই। পা উঠিয়ে ছেলেমানুষের মতো বসে আছেন। কথা বলার সময় হাত নাড়ছেন। তাঁর সামনে রাখা চায়ের কাপে এক ফোঁট চাও নেই। অনেক আগেই চায়ের শেষ বিন্দুটিও তিনি শেষ করেছেন। অথচ বেচারার সেটা খেয়াল নেই। খালি চায়ের কাপেই ক্রমাগত চুমুক দিচ্ছেন। মাঝে-মাঝে চুমুক দেবার আগে চায়ের কাপে ফুঁ দিচ্ছেন। ভাবটা এমন যে, গরম চা ফুঁ দিয়ে ঠাণ্ডা করে খেতে হচ্ছে।
মিসির আলি খাট থেকে নামতে-নামতে বললেন, আফসার সাহেব, আমি ছোট একটা ক্যাসেট প্লেয়ার জোগাড় করেছি। সেখানে বিড়ালের কথা টেপ করা আছে। আপনাকে তা শোনাব এবং আপনি বলবেন-বিড়াল কী বলছে। পারবেন না?
অবশ্যই পারব।
আজ শুধু এই পরীক্ষাটাই করব, তারপর অন্য পরীক্ষা অন্য সময়ে করা হবে। আফসার সাহেব বললেন, আমি টেপ শুনে যদি বলি বিড়াল এই কথা বলছে তাহলে তা আপনার বোঝার উপায় নেই। আমি ভুল বলছি না। সত্যি বলছি।
বোঝার উপায় আছে।
কী উপায়? আপনি নিশ্চয়ই বিড়ালের কথা বোঝেন না!
তা বুঝি না। তার পরেও উপায় আছে- আচ্ছা এখন মন দিয়ে শুনুন—
টেপ খানিকক্ষণ বাজানো হল। একটা বিড়ালের ম্যায়াও মর্য্যায়াও শোনা যাচ্ছে। আফসার সাহেব তাঁর সমস্ত ইন্দ্ৰিয় তীক্ষ্ণ করে শুনলেন। টেপ বাজান শেষ হল। মিসির আলি বললেন, বলুন, বিড়ালটা কী বলল।
বুঝতে পারিনি।
কিছুই বুঝতে পারেন নি?
জ্বি-না।
ভালো কথা।—এখন অন্য একটা শুনুন। খুব মন দিয়ে শুনুন। একই বিড়ালের কথা।–ভিন্ন সময়ে ভিন্ন পরিস্থিতিতে।
আফসার সাহেব শুনলেন। তাঁর মুখে হতাশার ভাব স্পষ্ট হয়ে উঠছে। কারণ এবারও তিনি কিছু বুঝতে পারছেন না। কিছুই না। বিড়ালের সাধারণ ম্যাঁয়াও।
কিছু বুঝলেন?
জ্বি-না।
কিছুই না?
না।
আরো একটি অংশ শোনাচ্ছি। দেখুন, এটা বুঝতে পারেন কি না। এবার অন্য বিড়াল, আগেরটা না।
আফসার সাহেব হতাশ গলায় বললেন, আমার মনে হয়না কিছু বুঝতে পারব। এ— রকম হচ্ছে কোন কে জানে!
খুব মন দিয়ে শুনুন।
মন দিয়েই শুনছি।
আরো মন দিন। চোখ বন্ধ করে শুনুন।
তিনি শুনলেন। কিছুই বুঝলেন না। মিসির আলি বললেন, তিনটি ভিন্ন পরিস্থিতিতে বিড়ালের কথা টেপ করা হয়েছে। প্রথম বার বিড়ালকে দুধ খেতে দিয়ে গায়ে-মাথায় হাত বোলান হয়েছে। সে যখন শব্দ করেছে তখন তা টেপ করা হল। দ্বিতীয় বার তাকে একটা সূচালো কাঠি দিয়ে খোঁচা দেওয়া হচ্ছিল। তৃতীয় বারে অন্য একটা বিড়ালকে ভয় দেখানো হচ্ছিল।
আফসার সাহেব বিষণ্ণ গলায় বললেন, আপনি নিশ্চয়ই আমার কথা পুরোপুরি অবিশ্বাস করছেন। ধরেই নিয়েছেন আমি মিথ্যা করে বলেছি-বিড়ালের কথা বুঝতে পারি।
আমি এত দ্রুত এবং এত সহজে কোনো সিদ্ধান্তে আসি না। আমি এখনো ধরে নিচ্ছি। আপনি বিড়ালের সব কথা বুঝতে পারেন। এই হয়তো পারছেন না। আপনাকে আমি যা করতে বলব তা হচ্ছে, সহজ- জীবন-যাপনের চেষ্টা করবেন! বিড়াল নিয়ে খুব বেশি ভাববেন না, আবার খুব কমও ভাববেন না। খাওয়াদাওয়া করবেন! নিয়মিত অফিসে যাবেন। অফিসের সমস্যা মেটাতে চেষ্টা করবেন। যদি না-মেটে তাতেও ক্ষতি নেই। সব পরিস্থিতিতে খাপ খাইয়ে চলার চেষ্টা আপনাকে করতে হবে।
মীরা বললেন, ওকে নিয়ে বাইরে কোথাও বেড়াতে গেলে কেমন হয়? যেমন ধরুন, কক্সবাজারে কিছুদিন কাটিয়ে এলাম।
মিসির আলি বললেন, আমি তার প্রয়োজন দেখছি না। সমস্যা থেকে দূরে সরে যাওয়া সমস্যা সমাধানের কোনো পথ নয়। সমস্যাকে মোকাবেলা করতে হয়। সমস্যার ভেতরে থেকে।
আফসার সাহেব বললেন, আমরা কি এখন উঠব?
জ্বি, নিশ্চয়ই উঠবেন। আর শুনুন আফসার সাহেব, আপনি এখন এক ধরনের ঘোরের মধ্যে আছেন। এই ঘোর-ঘোর ব্যাপারটা আমার ভালো লাগছে না।
আমি ঘোরের মধ্যে আছি, এটা কেন বলছেন?
এটা বলছি, কারণ আপনার চারপাশে কী ঘটছে তা আপনি দেখছেন না। তাকিয়ে আছেন, কিন্তু কিছুই আপনার চোখে পড়ছে না। আমি দীর্ঘ সময় ধরে একটা খালি কাপে চুমুক দিচ্ছি। মাঝে-মাঝে এমন ভাব করছি যে গরম চা ফুঁ দিয়ে ঠাণ্ডা করে নিচ্ছি। ব্যাপারটা আপনার চোখেও পড়ে নি। অথচ আপনার স্ত্রী ঠিকই ধরেছেন। খালি কাপে চুমুক দেওয়ার ব্যাপারটা ছিল ইচ্ছাকৃত। আপনার বর্তমান মানসিক অবস্থা বোঝার জন্যে এটা করতে হয়েছে।
এই প্রথম বারের মতো অফিসার সাহেবের মনে হল- তাঁর সামনে বসে থাকা রোগা এবং মোটামুটি কুদর্শন মানুষটি অসম্ভব বুদ্ধিমান। এই মানুষটা খুব ঠাণ্ডা মাথায় পুরো পরিস্থিতি হাতের মুঠোয় নিয়ে নিতে পারে। এ-জাতীয় মানুষের সঙ্গে এর আগে তাঁর পরিচয় হয় নি। তিনি বললেন, উঠি মিসির আলি সাহেব?
মিসির আলি বললেন, চলুন, আমিও আপনাদের সঙ্গে যাই-এগিয়ে দিয়ে আসি।
এগিয়ে দিতে হবে না।
আমি এমনিতেও বেরুব। বিসমিল্লাহ্ হোটেল বলে একটা রেস্টুরেন্ট আছে–আমি রাত নটায় সেখানে ভাত খেতে যাই।
মীরা বললেন, আপনি কি একা থাকেন?
হ্যাঁ।
আপনাকে কি কিছু ব্যক্তিগত প্রশ্ন করতে পারি?
মিসির আলি সহজ গলায় বললেন, না। বিখ্যাত মানুষদের লোকজন ব্যক্তিগত প্রশ্ন করে বিরক্ত করে। আমি বিখ্যাত কেউ নই। আমার ব্যক্তিগত জীবন এতই সাধারণ যে প্রশ্ন করার কিছুই নেই।
আফসার সাহেব হঠাৎ করে প্রায় সবাইকে চমকে দিয়ে বললেন,–আমাকে একটু সাহায্য করুন। প্লীজ। আমি জানি আপনি পারবেন।
আফসার সাহেব
আফসার সাহেব তিনি দিন পর অফিসে এসেছেন। এই তিন দিনে অনেক কাগজপত্র তাঁর টেবিলে জমা থাকার কথা। তিনি টেবিলে কোনো কাগজপত্র দেখলেন না। এটাকে মোটামুটি অস্বাভাবিক ব্যাপার বলা যেতে পারে। তাঁর মনে একটা ক্ষীণ সন্দেহ হল! সেই সন্দেহ নিজের মনেই চেপে রাখলেন।
অফিসে তাঁর চেয়ারে বসার পরপর তিনি দুধ ছাড়া এককাপ চা খান। এই চা তাঁর বেয়ারা নাজিম বানিয়ে দেয়। পানি গরম কান্নাই থাকে। তিনি অফিসে ঢোকামাত্র কাপে টী-ব্যাগ দিয়ে তাঁর কাছে নিয়ে আসা হয়।
অপ্রয়োজনীয় কোনো কথা তিনি নাজিমের সঙ্গে বলেন না। শুধু নাজিম কেন, কারো সঙ্গেই বলেন না। তাঁর মতে অফিস হচ্ছে কাজকর্মের জায়গা, গল্পগুজবের আখড়া না। আজ আফসার সাহেব নিয়মের ব্যতিক্রম করলেন। নাজিম চায়ের কাপ নামিয়ে রাখামাত্ৰ হাসিমুখে বললেন, কেমন আছ নাজিম?
নাজিম বিস্মিত হয়ে বলল, ভালো আছি, স্যার।
ভালো থাকলেই ভালো। তুমি থাক কোথায়?
পুরানা পল্টন!
বাসায় কে কে আছে?
স্ত্রী, দুই ছেলে, এক মেয়ে আর আমার মা।
তোমাদের বাসায় কোনো বিড়াল আছে নাকি?
নাজিম এই প্রশ্নের কোনো মানে বুঝতে পারল না। তাঁর বাসায় বিড়াল আছে কি না এটা স্যার কেন জিজ্ঞেস করলেন? আফসার সাহেব দ্বিতীয় বার প্রশ্নটি করলেন, কী, আছে বিড়াল?
জ্বি স্যার, একটা আছে।
কত বড়?
নাজিম এই প্রশ্নেরও কোনো মানে বুঝল না। বিড়াল কত বড়-তার মানে আবার কী? বিড়াল তো বিড়ালের মতো বড়ই হবে। একটা বিড়াল তো আর বাঘের মতো বড় হবে না, কিংবা ইঁদুরের মতো ছোটও হবে না। নাজিম ক্ষীণ স্বরে বলল, বিড়ালের কথা জিজ্ঞাস করতেছেন কেন স্যার?
আফসার সাহেব অপ্ৰস্তুত হয়ে বললেন, এমনি জিজ্ঞেস করছি-বিড়াল সম্পর্কে একটা বই পড়ছিলাম তো! পড়তে-পড়তে হঠাৎ,… আচ্ছা এখন যাও।
বিড়াল সম্পর্কে তিনি যে বই পড়ছেন, এই ঘটনা সত্যি। তিনি ভেবে রেখেছিলেন। বিড়াল বিষয়ে যেখানে যত বই পাবেন, পড়বেন। সমস্ত নিউ মার্কেট ঘেটে একটামাত্র বই পেয়েছেন। উইলিয়াম বেলফোর্ডের ক্যাট ফ্যামিলি? বিহেভিয়ারেলস্টাডিজ। সেবইয়ে বিড়াল সম্পর্কে বলতে গেলে কিছুই নেই। বাঘ, চিতাবাঘের কথায় পাতা ভর্তি। সুন্দর-সুন্দর রঙিন ছবি-আসল ব্যাপার কিছু নেই।
এসে ঢুকল। ক্ষীণ গলায় বলল, স্যার।
বই থেকে মুখ তুলে আফসার সাহেব বললেন, কি ব্যাপার?
বড় সাহেব আপনেরে সালাম দিছেন।
বই বন্ধ করে আফসার সাহেব উঠে দাঁড়ালেন।
ডেল্টা শিপিং করপোরেশনের বড়সাহেবের নাম ইসহাক জোয়ারদার। ছোটখাটো মানুষ। মেজাজ অত্যন্ত খারাপ। আফসার সাহেবকে তিনি দু চোখে দেখতে পারেন না। অবশ্যি কথায়-বার্তায় তা কখনো বুঝতে দেন না।
স্যার, ডেকেছেন?
ইসহাক সাহেব হাসিমুখে বললেন, গল্পগুজব করার জন্যে ডেকেছি। কেমন আছেন বলুন। শরীর ঠিক আছে?
জ্বি।
তিন দিন অফিসে আসেন নি, তাই ভাবলাম কোনো সমস্যা কি-না।
জ্বি-না স্যার, কোনো সমস্যা নেই।
আপনার এক আত্মীয়ের সঙ্গে পার্টিতে দেখা। তাঁকে আপনার ব্যাপারে খুব উদ্বিগ্ন মনে হল।
কেন?
বলছিল–আপনার মাথায় কোনো সমস্যা হয়েছে। আপনি নাকি বলে বেড়াচ্ছেন বিড়ালের কথা বুঝতে পারেন?
আফসার সাহেব চুপ করে রইলেন। ভেবে পেলেন না ঘটনা এত দ্রুত ছড়াচ্ছে কীভাবে? মনে হচ্ছে সপ্তাহখানেকের ভেতর ঢাকা শহরের সব লোক জেনে যাবে। পত্রিকার লোক আসবে ইন্টারড়ু নেওয়ার জন্যে। বলা যায় না, টিভির কোনো ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানেও তাঁর ডাক পড়তে পারে। টিভি উপস্থাপক একটা বিড়াল নিয়ে স্টুডিওতে উপস্থিত হবেন। চিকুন গলায় বলবেন–সুপ্রিয় দর্শকমণ্ডলী, এবার আপনাদের জন্যে রয়েছে এক বিশেষ ধরনের বিনোদনের ব্যবস্থা। আজ আমরা স্টুডিওতে এমন এক ব্যক্তিত্বকে এনেছি যিনি বিড়ালের কথা বুঝতে পারেন বলে দাবি করেন। সেই বিশেষ ব্যক্তিত্বকে হাততালি দিয়ে অভ্যর্থনা করবার জন্যে আপনাদের অনুরোধ করছি। তালি পড়ছে। হাসির শব্দ শোনা যাচ্ছে….
আফসার সাহেবের চিন্তার সুতো ছিঁড়ে গেল। ইসহাক সাহেব বললেনবিড়ালের কথা বুঝতে পারেন বলে যা শুনছি তা কি সত্যি?
জ্বি স্যার, সত্যি!
আই সি, ভেরি ইন্টারেষ্টিং। শুধু কি বিড়ালের কথাই বুঝতে পারেন, না কুকুর, গরু, গাধা, ভেড়া, ছাগল-সবার কথাই বুঝতে পারেন?
বিড়ালের ব্যাপারটা জানি। অন্যগুলি পরীক্ষা করে দেখি নি।
আপনি একটা কাজ করুন না কেন? খাতা এবং পেনসিল নিয়ে চিড়িয়াখানায় চলে যান। যে-সব প্রাণীর কথা। আপনি বুঝতে পারেন তাদের নামের বিপরীতে একটা করে টিক চিহ্ন দিন। আমার ধারণা, বিড়ালের কথা যখন বুঝতে পারছেন অন্যদেরটাও ইনশাআল্লাহ্ পারবেন।
আফসার সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, স্যার, আপনি কি আমার সঙ্গে ঠাট্টা করছেন?
সরি-তা একটু ঠাট্টা অবশ্যি করেছি। ক্ষমা করবেন। আমি যদি বলতাম বিড়ালের কথা বুঝতে পারছি, তাহলে আপনিও আমাকে নিয়ে ঠাট্টা করতেন।
না, আমি করতাম না।
হয়তো-বা করতেন না। যাই হোক, আমি করে ফেলেছি। তার জন্যে ক্ষমা চাচ্ছি। আপনি এক কাজ করুন-অফিস থেকে দিন দশেকের ছুটি নিন।
আমার ছুটির প্রয়োজন নেই।
আমার মনে হয় প্রয়োজন আছে। আপনি ছুটি নিন। সাইকিয়াটিস্টকে দিয়ে ভালোমতো চিকিৎসা করান, নয়তো কিছুদিন পর বলা শুরু করবেন-আপনি পিঁপড়ার কথাও বুঝতে পারছেন। আমি ছুটির ব্যবস্থা করে রেখেছি। যদি চান আমি কয়েক জন সাইকিয়াটিক্টের ঠিকানাও আপনাকে দিতে পারি।
আমি স্যার তার কোনো প্রয়োজন বোধ করছি না।
আপনি হয়তো করছেন না, আমি করছি! আমি এমন কাউকে অফিসের গুরুত্বপূর্ণ কাজ দিতে পারি না, যে পশুদের কথা বুঝতে পারে। আমার এমন অফিসার দরকার, যে মানুষের কথা বুঝতে পারবে। আমি লক্ষ করেছি, আমাদের মধ্যে বেশির ভাগই মানুষের কথা বুঝতে পারি না।
আফসার সাহেব উঠে দাঁড়ালেন।
ইসহাক সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, চলে যাচ্ছেন নাকি?
জ্বি, চলে যাচ্ছি। আপনার অত্যন্ত অপমানসূচক কথা শুনতে ইচ্ছা করছে না।
কি করবেন বলুন, আমি তো আর বিড়াল না। বিড়াল হলে হয়তো আমার কথাগুলি খুব অপমানসূচক মনে হত না।
আফসার সাহেব নিজের ঘরে ঢুকলেন। অসহ্য রাগে শরীর কাঁপছে। রাগ সামলাতে কষ্ট হচ্ছে। রীতিমতো বমি এসে যাচ্ছে। এই মানুষটি তাঁকে এ-জাতীয় অপমান আগেও করেছে, ভবিষ্যতেও করবে। এত অপমানের ভেতর চাকরি করার কোনো মানে হয় না। কোনো মানে হয় না। তাঁর কিছু সঞ্চয় আছে। মিরপুরে জায়গা কিনে রেখেছেন। প্রভিডেন্ট ফাণ্ড থেকে লাখ তিনেক টাকা পাওয়ার কথা। বয়স এমন কিছু হয় নি। চেষ্টাচরিত্র করলে আরেকটা চাকরি কি জোগাড় করতে পারবেন না? তিনি কাজ জানেন জাহাজ চলাচল জাতীয় যে-কোনো প্রতিষ্ঠানে ভালো চাকরি পাওয়ার কথা।
তিনি পি. এ.-কে ডেকে রেজিগনেশন লেটার ডিকটেট করলেন। ড্রাফট দেখে দুটা বানান ঠিক করলেন। চিঠি টাইপ করে আনতে পাঠালেন। পি. এ.ব সাধারণত কোনো কাজই দ্রুত করে না। এই কাজটা সে অত্যন্ত দ্রুত করল। তিনি চিঠিতে সই করলেন। সই করার পর তাঁর গায়ের জ্বালা খানিকটা কমল। মন শান্ত হল। নাজিমকে চা বানাতে বললেন। নাজিম চা বানিয়ে আনল।
জ্বি স্যার।
চাকরি ছেড়ে দিয়েছি নাজিম।
স্যার, শুনেছি।
কার কাছে শুনলে?
পি. এ. স্যার চিঠি টাইপ করছিলেন। সবাইকে বলেছেন।
ও, সবাই তাহলে জানে। ভালো, জানলেই ভালো।
আফসার সাহেব বিস্মিত হলেন। সবাই জানে, অথচ কেউ এসে তাঁকে বলল না। রেজিগলেশ্বন লেটার না-দেবার জন্যে। এরা কেউ কি তাঁকে পছন্দ করে না? মানুষ হিসেবে তিনি কি এই সামান্য সহানুভূতিটুকুও পেতে পারেন না? দীর্ঘ পনের বছর তিনি নিষ্ঠার সঙ্গে এই প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেছেন। কাজে ফাঁকি দেন নি। দশটায় অফিসে আসার কথা, দশটায় এসেছেন। পাঁচটা পর্যন্ত অফিস। কোনো দিন পাঁচটা বাজার দশ মিনিট আগে অফিস ছেড়ে যান নি।
নাজিম।
জ্বি স্যার।
চা ভালো হয়েছে, তুমি এখন যাও।
আফসার সাহেব রেজিগনেশন লেটার পি. এ.-র হাতে জমা দিয়ে অফিস ছেড়ে বের হলেন। তখনো দুপুরে-ল্যাঞ্চের সময় হয় নি। তাঁর মনে ক্ষীণ আশা ছিল শেষ মুহূর্তে হয়তো সবাই এসে ভিড় করবে। তা-ও কেউ করল না।
তিনি দুপুরে কিছু খেলেন না। বাসায়ও ফিরে গেলেন না। দীর্ঘ সময় রাস্তায়রাস্তায় হাঁটলেন। একসময় ক্লান্ত হয়ে পার্কে ঢুকলেন বিশ্রামের জন্যে। দীর্ঘ আট বছর পর পার্কে এলেন। ঢাকা শহরের পার্কগুলি যে এখনো এত সুন্দর আছে তা তিনি ভাবেন নি। পর্কে বসে থাকতে তাঁর ভালোই লাগল। কিছুক্ষণ আগে ভালো একটা চাকরি ছেড়ে এসেছেন-এই নিয়ে তাঁর মনে কোনো অনুশোচনা বোধ হল না। বরং একধরনের শান্তি অনুভব করলেন। পার্কে বসেই ঠিক করলেন, আজ অন্য দিনের মতো সাড়ে পাঁচটায় বাসায় উপস্থিত হবেন না। নিয়মের ব্যতিক্রম করবেন। একটা ছবি দেখলে কেমন হয়? ছাত্রজীবনে প্রচুর সিনেমা দেখতেন। গত দশ বছরে একটাও দেখেন নি। সিনেমা হলে ঢুকে ছবি দেখতে কেমন লাগে কে জানে!
তিনি বাড়ি ফিরলেন রাত এগারটায়। শীতের দিনে রাত এগারটা মানে অনেক রাত। মীরা উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তায় এতটুকু হয়ে গেছেন। চারদিকে খোঁজখবর করছেন। কেউ কিছু বলতে পারছে না। মীরা ভেবে রেখেছেন, সাড়ে এগারটা পর্যন্ত দেখবেন। তারপর হাসপাতালে-হাসপাতালে খোঁজ নেয়া শুরু করবেন।
আফসার সাহেবকে দেখে আনন্দে তাঁর চোখে প্রায় পানি এসে গেল। সুমী রুমী ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল বাবাকে! সুমী কাঁদো-কাদো গলায় বলল, কোথায় ছিলে বাবা?
আফসার সাহেব হাসিমুখে বললেন, একটা ছবি দেখলাম।
কী দেখলে?
কুকসিনেমা হলে একটা সিনেমা দেখলাম।
হ্যাঁ, সত্যি।
কী নাম ছবির?
ড়াবির সংসার
কী আছে। ছবিতো?
মারামুরি-কাটাকাটি, গান-বাজনা, নাচ-সবই আছে। কিছুই বাদ নেই।
মীরা দীর্ঘ সময় স্বামীর দিকে তাকিয়ে থেকে নরম গলায় বললেন, হাত-মুখ ধুয়ে খেতে এস। তোমার জন্যে আমরা সবাই না-খেয়ে বসে আছি।
খাবার টেবিলে বসেই আফসার সাহেব বললেন, বিড়ালকে খেতে দিয়েছ?
মীরা শীতল গলায় বললেন, ঐ-সব নিয়ে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না।
বিড়ালকে কি খাবার দিয়েছ?
হ্যাঁ।
ভালোমতো দিয়েছ?
হ্যাঁ, ভালোমতোই দেওয়া হয়েছে। তুমি ভাত খাও তো!
কেন জানি খেতে ইচ্ছা করছে না। এক গ্লাস দুধ দাও। দুধ খেয়ে শুয়ে পড়ি।
ভাত সত্যি খাবে না?
না।
মীরা গ্লাসে করে দুধ নিয়ে এলেন। দুধের গ্লাস রাখতে।-রাখতে ইংরেজিতে বললেন, শুনলাম তুমি নাকি চাকরি ছেড়ে দিয়েছ?
হ্যাঁ। কার কাছে শুনলে?
অফিস থেকে টেলিফোন করে জানিয়েছে।
এত বড় একটা সিদ্ধান্ত নেবার আগে আমাকে জিজ্ঞেস করারও প্রয়োজন মনে করলে না?
জিজ্ঞেস করা তো অর্থহীন। সিদ্ধান্ত নেব আমি। এই সিদ্ধান্ত তুমি তো নিতে পারবে না।
সংসার চলবে কীভাবে?
অসুবিধা হবে না, চলবে।
এই বাড়ি ছেড়ে দিতে হবে! এখন তো আর আট হাজার টাকা বাড়ি ভাড়া পাবে না-দু-কামরার একটা ঘূপটি ঘর নিতে হবে।
নেবা মানুষের দিন তো সব সময় সমান যায় না। এখন আমার দিন খারাপ যাচ্ছে।
আফসার সাহেব দুধের গ্লাস হাতে উঠে দাঁড়ালেন। মীরা বললেন, কোথায় যাচ্ছ?
তোমরা খাওয়া শেষ করে। আমি বারান্দায় বসি।
আমাদের সঙ্গে বাস না।
এখন বসতে ইচ্ছা করছে না। একটু এক-একা থাকি।
বারান্দায় বসার কিছুক্ষণের মধ্যেই বিড়ালটাকে তার বাচ্চা দুটি নিয়ে এগিয়ে আসতে দেখা গেলঃ আফসার সাহেব কান পেতে রইলেন। হ্যাঁ, বুঝতে পারছেন। কথা বুঝতে তাঁর কোনোই অসুবিধা হচ্ছে না।
বাচ্চা বিড়াল : মা, স্যার আজ এত দেরি করে বাসায় এসেছেন কেন?
মা :বুঝতে পারছি না। ভদ্রলোকের কোনো- একটা সমস্যা হয়েছে।
বাচ্চা : কী সমস্যা?
মা : তাঁর স্ত্রী টেলিফোনে কথাবার্তা যা বলছিলেন তাতে মনে হচ্ছে চাকরি নিয়ে সমস্যা। উনি বোধহয় চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। আমাদের সামনে ভয়াবহ বিপদ।
বাচ্চা: বিপদ কেন?
মা : চাকরি ছেড়ে দিলে তাঁদের টাকা পয়সার সমস্যা হবে। রাতদিন ঝগড়াঝাঁটি হবে! এখন তা-ও মাঝে-মাঝে খাবারটাবার দেয়-তখন তা-ও দেবে না।
বাচ্চা : মা, আজ তো এখন পর্যন্ত আমাদের কোনো খাবার দিল না।
মা : রাতের খাবার শেষ হোক, তখন দিলে দিতেও পারে।
বাচ্চা : মা, তোমার কি মনে হয় দেবো?
মা : বুঝতে পারছি না-দিতেও পারে। বাচ্চা। খুব খিদে লেগেছে মা।
মা : একটা ইঁদুর মেরে খাওয়াতে পারি-খাবি?
বাচ্চা : না, রান্না-করা খাবার খাব। মা, ওরা আজ কী রান্না করেছে?
মা :সিম দিয়ে কৈ মাছ। মাছের সঙ্গে একটু সিম দিলে ভালো হয়-ভেজিটেবল একেবারেই খাওয়া হচ্ছে না।
বাচ্চা : সিম দিলেও কিন্তু আমি খাব না মা।
মা : এমনিতেই খাওয়া পাওয়া যাচ্ছে না। তার ওপর যদি এই যন্ত্রণা তোমরা কর, তাহলে তো মুশকিল! সিম যদি দেয় তাহলে খেতে হবে। সিমে অনেক ভিটামিন।
বাচ্চা : ভিটামিন কী মা?
মা : এইসব তোমরা বুঝবে না। ভিটামিন খুব প্রয়োজনীয় একটা জিনিস।
আফসার সাহেব উঠে পড়লেন। খাবার ঘরে উঁকি দিলেন। বাচ্চাদের খাওয়া হয়ে গেছে। তারা হাত ধুচ্ছে। মীরার খাওয়া এখনো শেষ হয় নি। আফসার সাহেব বললেন, মীরা, তুমি তো আমাকে মিথ্যা কথা বলেছ।
মীরা বললেন, কী, মিথ্যা বললাম?
তুমি বলেছ–বিড়ালদের খাবার দিয়েছ। আসলে দাও নি।
এটা এমন কোনো মিথ্যা না, যার জন্যে তুমি এমন কঠিনভাবে বাচ্চাদের সামনে আমার কাছে কৈফিয়ত তলব করবে।
আমাকে মিথ্যা কথা কেন বললে? কেন বললে, বিড়ালদের খাবার দেওয়া হয়েছে?
তুমি হঠাৎ করে যাতে আপসেট না-হও সে-জন্যেই সামান্য মিথ্যাটা বললাম। তোমার দুশ্চিন্তার কারণ নেই-এক্ষুণি খাবার দিচ্ছি। যদি চাও চেয়ার- টেবিলে দেব। কাঁটা চামচ দেব। সালাদও দেব।
আফসার সাহেব কঠিন কিছু বলতে গিয়েও বললেন না। মীরা বললেন, তুমি যে অসুস্থ হয়ে পড়ছি, তা কি তুমি বুঝতে পারছি? জীবনে কোনোদিন তুমি নিজের মেয়েদের খাবারের ব্যাপারে কোনো খোঁজ নাও নি-আজ ব্যস্ত হয়ে পড়েছ বিড়াল নিয়ে অকারণে হৈচৈ করছি। তোমার স্বভাব্যচরিত্র বদলে যাচ্ছে। এক-একা সিনেমা দেখে ফুলে। আমরা দুশ্চিন্তা করতে পারি—এটা একবারও তোমার মনে এল না।
সরি।
থাক, সরি বলতে হবে না।
মীরার রাগ বেশিক্ষণ থাকল না। কিছুক্ষণ পরই নরম গলায় বললেন, কিছু মনে করো না। অনেক কড়া কথা বলে ফেলেছি। আমি দেখতে পাচ্ছি। তুমি একধরনের সমস্যার ভেতর দিয়ে যােচ্ছ। তোমার সঙ্গে আরো শান্ত ব্যবহার করা উচিত ছিল, তা করিনি। আমি লজ্জিত। এস, ঘুমুতে এস। ভয় নেই, তোমার বিড়ালকে খেতে দিয়েছি। দুটো আস্ত কৈ মাছ দিয়েছি।
আফসার সাহেব বললেন, সঙ্গে সিম দিয়েছ তো?
সিম?
হ্যাঁ, সিম। বিড়ালের বাচ্চা দুটো গ্ৰীন ভেজিটেবল একেবারেই খেতে চায় না। অথচ ওদের দরকার।
মীরা অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে রইলেন। খানিকক্ষণ পর স্বামীর হাত ধরে বললেন, এস, ঘুমুতে এস।
সেই রাতে আফসার সাহেব ভয়ংকর একটা দুঃস্বপ্ন দেখলেন। ঘুমের মধ্যেই বিকট চিৎকার করতে লাগলেন। মীরা তাঁর গা ঝাঁকাতে-কাকাতে ব্যাকুল হয়ে ডাকতে লাগলেন, কী হয়েছে? এ্যাই, এ্যাই, কী হয়েছে? রুমী সুমীও ঘুম ভেঙে বাবার ঘরে ছুটে এল।
আফসার সাহেব চোখ মেলতেই মীরা কীদো-কাদো গলায় বললেন, কী স্বপ্ন দেখেছ? কী স্বপ্ন?
আফসার সাহেব হতচকিত চোখে তাকাচ্ছেন। কিছু বলতে পারছেন না। তাঁর সারা গা ঘামে ভিজে গেছে। তৃষ্ণায় বুক ফেটে যাচ্ছে।
মীরা বললেন, কী স্বপ্ন দেখলে?
আফসার সাহেব বসে ক্ষীণ গলায় বললেন, পানি খাব। এক গ্লাস খুব ঠাণ্ডা পানি দিতে বল।
সুমী পানি আনতে ছুটে গেল।
আফসার সাহেব তৃষ্ণার্তের মতো পানি পান করলেন। পানির গ্লাস এত উঁচু করে ধরলেন যে কিছু পানি গলা বেয়ে নেমে শার্ট ভিজে গেল। কুদ্দুস, যে থাকে ঘরের অন্য প্রান্তে, সেও উঠে এসেছে। ঘুমের মধ্যে আফসার সাহেব যে ভয়ংকর চিৎকার দিয়েছেন তা ঘরের শেষ পর্যন্ত গিয়েছে।
মীরা স্বামীর গায়ে হাত রেখে কোমল গলায় বললেন, কী স্বপ্ন দেখেছ?
আফসার সাহেব ক্লান্ত গলায় বললেন, স্বপ্নে দেখেছি, আমি একটা বিড়াল হয়ে গেছি। বিড়াল হয়ে মাঠে ছোটাছুটি করছি। জ্যোৎস্না রাত-আবছাভাবে সবকিছু দেখা যাচ্ছে। আমি অসম্ভব ক্ষুধার্তা আমি বসে আছি ইঁদুরের গর্তের কাছে। একসময় একটা ইঁদুর বের হল-আমি লাফ দিয়ে ইঁদুরের ওপর পড়লাম। ইঁদুরটাকে ছিঁড়ে টুকরাটুকরা করলাম। আমার সমস্ত মুখে ইঁদুরের রক্ত লেগে গেল।
মীরা নরম গলায় বললেন, স্বপ্ন হচ্ছে স্বপ্নল স্বপ্ন নিয়ে মাথা ঘামোনর কোনোই কারণ নেই। ভোর হোক, আমরা মিসির আলি সাহেবের কাছে যাব! ওঁকে সব বলব!
আমি কোথাও যাব না।
আচ্ছা বেশ, যেতে না-চাইলে যাবে না।
আমাকে আর এক গ্লাস পানি দাও।
মীরা পানি নিয়ে এলেন। আফসার সাহেব ক্লান্ত গলায় বললেন, মীরা, দেখ আমার হাত দুটায় ইঁদুরের গন্ধ। বিশ্ৰী পচা গন্ধ।
কী বলছি তুমি।
হ্যাঁ, সত্যি তাই। এই হাতে আমি ইঁদুর ধরেছি। গন্ধ তো হবেই-তুমি শুঁকে দেখ।
পাগলামি করো না তো। ঘুমুতে যাও। ভূমি বলছি মনগড়া কথা। তুমি কি ইঁদুর কখনো শুঁকে দেখেছ যে, ইঁদুরের গন্ধ কেমন তা জোন? আরাম করে ঘুমাও তো।
আফসার সাহেব ঘুমুতে গেলেন না। বাথরুমে ঢুকে অনেকক্ষণ সাবান দিয়ে হাত ধুলেন। তাতেও তাঁর মন শান্ত হল না। শাওয়ার ছেড়ে দিয়ে দীর্ঘ সময় গোসল করলেন। যখন বেরিয়ে এলেন, তখন তাঁর চোখ লাল হয়ে আছে। গা ঈষৎ গরম সম্ভবত জ্বর আসছে। তোয়ালে হাতে মীরা দাঁড়িয়ে আছেন। রুমী সুমীও আছে। তারা যথেষ্ট পরিমাণে ভয় পেয়েছে। তবে চুপ হয়ে আছে, কিছু বলছে না। আফসার সাহেব লক্ষ করলেন-খাবার টেবিলের নিচে দুটো বাচ্চানিয়ে মা-বিড়ালটা বসে আছে। তারা কথা বলছে ফিসফিস করে। তবে তাদের ফিসফিসানি বুঝতে আফসার সাহেবের কোনো অসুবিধা হচ্ছে না।
বাচ্চা বিড়াল : মা, উনার কী হয়েছে?
মা-বিড়াল : বুঝতে পারছি না।
বাচ্চা : শীতের সময়, এত ভোরে কেউ গোসল করলে ঠাণ্ডা লাগবে না?
মা-বিড়াল : তা তো লাগবেই। দেখছিস না, শীতে কেমন কাপছেন! ভদ্রলোকের কিছু-একটা সমস্যা হয়েছে। সমস্যাটা আমি বুঝতে পারছি না।
বাচ্চা : বোঝার চেষ্টা কর না কেন মা? তোমার তো কত বুদ্ধি!
মা-বিড়াল : বুঝে লাভ কিছু নেই। উনাকে সাহায্য করতে পারব না। আমরা হচ্ছি। পশু। পশু কখনও মানুষকে সাহায্য করতে পারে না।
বাচ্চা : ভদ্রলোক এত কষ্ট পাচ্ছেন, আমরা কিছুই করব না?
মা-বিড়াল : প্রার্থনা করতে পারি।
বাচ্চা : প্রার্থনা কী?
মা-বিড়াল : প্রার্থনা হচ্ছে সৃস্টিকর্তার কাছে কিছু চাওয়া!
বাচ্চা : সৃষ্টি কর্তা কে মা?
মা : যিনি আমাদের সবাইকে সৃষ্টি করেছেন।
বাচ্চা : আমাদের সবাইকে কে সৃষ্টি করেছেন?
মা :আহ্, চুপ কর তো! দিন-রাত এত প্রশ্নের জবাব দিতে ভালো লাগে না।
আফসার সাহেব তোয়ালে দিয়ে গা জড়িয়ে শোবার ঘরে ঢুকলেন। মীরা বললেন, গরম এককাপ চা এনে দি?
দাও।
মীরা চা বানিয়ে এনে দেখলেন, আফসার সাহেব। আবার সাবান দিয়ে হাত ধুচ্ছেন। মীরাকে দেখে ফ্যাকসেভাবে তাকালেন। ক্লান্ত গলায় বললেন, মীরা, আমি মনে হয় পাগল হয়ে যাচ্ছি।
মিসির আলিকে আজ অনেক ভদ্র দেখাচ্ছে। আগের দিন খোঁচা-খোঁচা দাড়ি ছিল, আজ ক্লিন শেভূড়। ঘরও বেশ গোছানো। বিছানায় খবরের কাগজ ছড়ানো নেই। চেয়ারে বই গাদা করে রাখা হয় নি। কেরোসিন কুকারটিও অদৃশ্য। টেবিলে সুন্দর টেবিল-ল্যাম্প জ্বলছে। মিসির আলি চেয়ারে বসে টেবিল-ল্যাম্পের আলোয় গভীর মনযোগে পড়ছেন সরীসৃপ-বিষয়ক একটি বই। গত কিছুদিন ধরেই তিনি ক্রমাগত জীবজন্তু সম্পর্কিত বই পড়ে যাচ্ছেন। শুরু করেছিলেন বিড়াল দিয়ে, এখন চলে এসেছেন সরীসৃপে। পড়তে অদ্ভুত লাগছে। আগে তাঁর ধারণা ছিল সাপ ডিম দেয়। সেই ডিম থেকে বাচ্চা ফুটে বের হয়। এখন দেখা যাচ্ছে কিছু-কিছু সাপডিম দেয় না, সরাসরি বাচ্চা দেয়। চন্দ্রবোড়া এ— রকম একটা সাপ।
দরজায় শব্দ হচ্ছে। ভিক্ষার জন্যে ভিখিরি এসেছে। মিসির আলিকে দরজা খুলতে হল না। ষোল-সতের বছরের এক ছেলে ভেতর থেকে বের হয়ে দরজা খুলে দিল এবং কাট-কটা গলায় বলল-কাম কইরা ভাত খান। বিনা কমে ভাত নাই! এই ছেলেটির নাম মজনু। তাকে ঘরের কাজকর্মের জন্যে মাসে দেড় শ টাকা বেতনে রাখা হয়েছে। এই বাড়িতে মজনুর আজ সপ্তম দিন। সপ্তম দিনে সে দেখিয়ে দিয়েছে যে সে কোজ জানে। শুধু যে জানে তা নয়-খুব ভালো জানে। মিসির আলিকে এখন আর বিসমিল্লাহ্ হোটেলে ভাত খেতে যেতে হয় না। ঘরেই রান্না হয়। সেই রান্নাও অসাধারণ। খাওয়ার ব্যাপারটায় যে আনন্দ আছে তা তিনি ভুলে গিয়েছিলেন। আজ দুপুরে মজনু পাবদা মাছের ঝোল রান্না করেছে। টমেটো এবং মটরশুটি দিয়ে। সেই রান্না খেয়ে মিসির আলি মজনুর বেতন দেড় শ টাকা থেকে বাড়িয়ে এক শ পঁচাত্তর করে দিয়েছেন!
মজনু।
জ্বি স্যার!
চা বানাও তো দেখি–
মজনু গম্ভীর গলায় বলল, দুধ, লেবু, না আদা?
যা ইচ্ছা বানাও।
আপনার ঠাণ্ডা-ঠাণ্ডা লাগছে। আদা চা খান, শরীরের জন্যে ভালো।
দাও, আদা-চা দাও
মজনুর আদা-চা খেয়ে মিসির আলির মন ভালো হয়ে গেল। অসাধারণ ব্যাপার! চা যতটুকু গরম হওয়া দরকার ততটুকুই গরম। ঠাণ্ডাও না, বেশি গরমও না। আদার পরিমাণও যেন মাপা! বীজ আছে, আবার চায়ের স্বাদও নষ্ট হয় নি।
মজনু।
জ্বি স্যার।
আগে কি কোনো হোটেলে কাজটাজ করতে?
জ্বে-না–
এত চমৎকার রান্নাবানা শিখলে কীভাবে?
মজনু জবাব না-দিয়ে ভেতরে চলে গেল। সে রাতের রান্না বসিয়েছে। দুপুরের খাবার সে রাতে দেয় না। রাতে আলাদা রান্না হয়। চায়ে চুমুক দিতে-দিতে মিসির আলি ভাবতে লাগলেন—মজনুর বেতন এক শ পঁচাত্তর না করে পুরোপুরি দু, শ করে দেওয়াই ভালো। যে-কোনোভাবেই হোক, এই ছেলেকে আটকে রাখতে হবে। তাঁর নিজের অর্থনৈতিক সমস্যার কিছুটা সমাধান হয়েছে। বিলেতে থাকাকালীন তিনি প্রফেসর রেইজেনবার্গের সঙ্গে যুগ্ম-সম্পাদনায় অ্যাবনর্ম্যাল বিহেভিয়ের ইন ফেজ ট্রানজিশন বইটি লিখেছিলেন। সেই বই। এ-বৎসর কয়েকটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্যতালিকাভূক্ত হয়েছে। প্রকাশক ভালো টাকা দিচ্ছে। প্রথম দফায় তিনি পাঁচ হাজার ডলারের একটি চেক পেয়েছেন। সেই চেক ভাঙানো হয়েছে। মার্কেল ষ্টোনের অসম্ভব। সুন্দর টেবিল-ল্যাম্প এবং একটি ড়েকসেট ঐ টাকায় কেনা। মিসির আলি এখন রোজই কিছু-না-কিছু কিনছেন। জিনিসপত্র কেনার ভেতরে যে আনন্দ আছে, তাও তিনি জানতেন না।
আবার দরজার কড়া নড়ছে।
মিসির আলির মনে পড়ল সাড়ে চার শ টাকায় তিনি একটা কলিং বেল কিনেছেন। বেলটা এখনো লাগানো হয় নি। মজনুকে পাঠিয়ে একজন ইলেকটিক মিস্ত্রি নিয়ে আসতে হবে। রান্না শেষ হলে ওকে পাঠাবেন।
মিসির আলি নিজেই দরজা খুললেন। মীরা এবং আফসার সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন! আফসার সাহেবের দৃষ্টি উদভ্ৰান্ত। মনে হয়। গত তিন-চার দিন দাড়ি কাটেন নি।
মুখভর্তি খোঁচা-খোচা দাড়ি। শরীরও মনে হয় ভেঙে পড়েছে।
আসুন, ভেতরে আসুন!
দুজন ঘরে ঢুকলেন। মীরা ক্ষীণ স্বরে বললেন, আপনাকে আবার বিরক্ত করতে এলাম।
মিসির আলি বললেন, আপনাদের আরো আগেই আসা উচিত ছিল—আপনারা দেরি করে ফেলেছেন বলে মনে হচ্ছে। আফসার সাহেব, বসুন।
আফসার সাহেব বসলেন! মিসির আলি বললেন, আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে-আপনার সমস্যা মোটেই কমেনি-বরং বেড়েছে। আমি কি ঠিক বলছি?
আফসার সাহেব কিছু বললেন না। মীরা বললেন, জ্বি, ঠিক বলছেন।
প্রাথমিকভাবে আপনার যা বলার আছে বলুন। তারপর আমি কিছু প্রশ্ন করব।
আফসার সাহেব কিছুই বললেন না। পাথরের মতো মুখ করে বসে রইলেন। মীরা বললেন, গত দু রাত ধরে সে ভয়ংকর স্বপ্ন দেখছে। ভয়াবহ স্বপ্ন।
কী রকম স্বপ্ন?
সে বিড়াল হয়ে গেছে। ধরে- ধরে ইঁদুর খাচ্ছে–এইসব স্বপ্ন। মিসির আলি হাসতে-হাসতে বললেন, আমার কাছে স্বপ্নটা খুব ভয়াবহ মনে হচ্ছে না। যদি উল্টোটা স্বপ্নে দেখতেন। অর্থাৎ আপনি ইঁদুর এবং বিড়াল আপনাকে ছিঁড়ে-ছিঁড়ে খাচ্ছে-তাহলে ত ভয়াবহ হত।
আফসার সাহেব কঠিন গলায় বললেন, আমি যা দেখছি তা যথেষ্টই ভয়াবহ। আমার পরিস্থিতিতে আপনি নন বলেই বুঝতে পারছেন না।
আমি খুব ভালো বুঝতে পারছি। পরিবেশ হালকা করার জন্যেই হাসতে-হাসতে কথাগুলি বলেছি। সমস্যা যত বড় হবে, তাকে তাত সহজভাবে গ্রহণ করা উচিত।
আপনি কি তা করেন?
হ্যাঁ, করি। একবার ভয়ংকর জটিল একটা সমস্যাকে হাসিমুখে গ্ৰহণ করেছিলাম—সেই গল্প অন্য এক সময় বলব।-আজ। আপনার সঙ্গে কথা বলি। আমি প্রশ্ন করছি, প্রশ্নগুলির জবাব দিন।
তারাও আগে আমি আপনার কাছে জানতে চাচ্ছি কেন আমি এ-রকম ভয়ংকর স্বপ্ন দেখছি?
মস্তিষ্ক নানান কারণে উত্তেজিত হয়ে আছে। একটা বিষয় নিয়ে ক্রমাগত ভাবছেন।–তাই স্বপ্নে দেখছেন। জেলেদের স্ত্রীরা সব সময় স্বপ্নে দেখে তাদের স্বামীরা নৌকাড়ুবিতে মারা গেছে, কখনো স্বপ্নে দেখে না তারা মারা গেছে রোড অ্যাক্সিডেন্টে। আপনার ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার ঘটছে। ভালো কথা-ফ্রানৎস কাফকার মেটামরফোসিস গল্প কি আপনি পড়েছেন? গল্পে একটা মানুষ আস্তে—আস্তে কুৎসিত একটি পোকা হয়ে যায়।
না, আমি পড়ি নি। গল্প-উপন্যাস আমি খুব কম পড়ি।
আচ্ছা, এখন প্রশ্ন-উত্তর পর্বে চলে আসছি। আমি প্রশ্ন করার সঙ্গে-সঙ্গে উত্তর দেবেন। ভাবার জন্যে সময় নেবেন না। তেবে উত্তর দেবেন। এমন প্রশ্নও আমি করব না। বিড়ালের কথা এখনো বুঝতে পারছেন?
পারছি।
আপনি কি এদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন?
না।
যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছেন?
হ্যাঁ। আমি একবার কথা বলার চেষ্টা করেছি।
বিড়াল বুঝতে পারে নি?
না।
কিন্তু বিড়াল তো আপনাদের কথা বুঝতে পারে। অন্তত তাদের কথাবার্তা থেকে নিশ্চয়ই তা বোঝা যায়।
হ্যাঁ, বোঝা যায়।
তাহলে আপনার কথা সে বুঝল না কেন?
জানি না।
আপনি নিজে কি বিশ্বাস করেন যে আপনি বিড়ালের কথা বুঝতে পারেন?
হ্যাঁ, বিশ্বাস করি।
মিসির আলি সিগারেট ধরাতে-ধরাতে বললেন, না, আপনি বিশ্বাস করেন না। অন্য প্রশ্নগুলির জবাব আপনি সঙ্গে-সঙ্গে দিয়েছেন। এই প্রশ্নটির জবাব দিতে বেশ দেরি করেছেন। আপনি যদি পুরোপুরি বিশ্বাস করতেন যে বিড়ালের কথা। আপনি বুঝতে পারেন, তাহলে আজ যে- সমস্যা আপনার হচ্ছে সেই সমস্য হত না। আপনি একই সঙ্গে ব্যাপারটা বিশ্বাস করছেন এবং করছেন না। আমি কি ঠিক বলছি?
হ্যাঁ, ঠিক বলছেন। আমি বিড়ালের কথা বুঝি। তার পরেও আমার মনে সন্দেহ আছে।
কেন আছে?
বিড়াল এমন সব কথা বলে যা একটি বিড়াল বলবে বলে মনে হয় না।
উদাহরণ দিন।
যেমন ধরুন।–মা-বিড়াল তার বাচ্চাদের জেলি খেতে নিষেধ করছে, কারণ জেলি খেলে দাঁত নষ্ট হবে। কিংবা সে বাচ্চাদের শ্ৰীন ভেজিটেবল খাওয়াতে চাচ্ছে-কারণ তাতে ভিটামিন আছে–
এ ছাড়াও অন্য কোনো কারণ কি ঘটেছে, যার জন্যে আপনার মনে সন্দেহ হচ্ছে-বিড়ালের কথা আসলে বোঝা যায় না?
হ্যাঁ, এ-রকম ব্যাপারও ঘটেছে। আমি ইদানীং রাস্তায় প্রচুর হাঁটাহাঁটি করি। বেশ কয়েক বার বিড়ালের সঙ্গে দেখা হয়েছে। ওরা ম্যাও ম্যাও করেছে, কিন্তু ওদের কোনো কথা আমি বুঝতে পারিনি।
মিসির আলি বললেন, আপনাদের যদি সময় থাকে আমার সঙ্গে একটা বাড়িতে চলুন। ওদের গোটা তিনেক বিড়াল আছে। আমি দেখতে চাই ওদের কথা। আপনি বুঝতে পারেন। কি না।
মীরা বললেন, সেটা কি ঠিক হবে? তাঁরা কী না কী মনে করবেন—
তাঁরা কিছুই মনে করবেন না। আমরা কী জন্যে যাচ্ছি তাও তাঁদের বলা হবে না।
আফসার সাহেব বললেন, আমার বাসায় চলুন। সেখানে তো বিড়াল আছে।
সেই বিড়ালের কথা যে আপনি বুঝতে পারেন তা তো বলেছেন, আমি নতুন বিড়াল নিয়ে পরীক্ষা করতে চাই। অবশ্যি অস্বস্তি বোধ করলে থাক।
না, অস্বস্তি বোধ করছি না। চলুন।
মিসির আলি মজনুর কাছে বাড়ি বুঝিয়ে দিয়ে রওনা হলেন। মজনু ব্যাপারটা ঠিক পছন্দ করল না। বিরক্ত মুখে বলল, ফিরতে কি দেরি হইব?
হাঁটা, একটু দেরি হবে।
রান্না হইছে। ভাত খাইয়া যান।
না-ভাত এখন খাব না। তুমি একটা ইলেকট্ৰিক মিস্ত্রি ডেকে কলিং বেল লাগিয়ে নিও।
মিসির আলি তাঁর পরিচিত ঐ ভদ্রলোকের বাসায় এক ঘন্টা কাটালেন। তাঁদের বিড়াল তিনটা না, দুটা। একটি অতি বৃদ্ধ। নড়াচড়ার শক্তি নেই। অন্যটি টম ক্যাট। বেশ উগ্র স্বতাবের। এরা অনেক বারই হ্যাঁয়াও হ্যাঁয়াও করল। আফসার সাহেব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বিড়াল দুটিকে দেখলেন। ওদের কথা শুনলেন, কিন্তু ওরা কি বলছে কিছুই বুঝলেন না।
বাড়ি থেকে বের হয়ে মিসির আলি বললেন, আপনার মুখ দেখে মনে হচ্ছে বিড়ালগুলির কথা কিছুই বুঝতে পারেন নি। তাই না?
হ্যাঁ। আমি কিছুই বুঝি নি। কিন্তু আপনি বিশ্বাস করুন-আমি আমাদের বাসার বিড়ালটার কথা বুঝি খুব ভালো বুঝি।
মিসির আলি বুললেন, আপনি নিজে কি ধরতে পারছেন—আপনার কথায় যুক্তি নেই? আপনি একটিমাত্র বিড়ালের কথা বুঝতে পারছেন, অন্য কোনো বিড়ালের কথা বুঝতে পারছেন না। তা কী করে হয়?
জানি না। কী করে হয়। মিসির আলি সাহেব, আমি খুব কষ্ট আছি। আপনি আমার কষ্ট দূর করুন। এইভাবে কিছুদিন গেলে আমি পাগল হয়ে যাব। আমার ধারণা, ইতোমধ্যে খানিকটা পাগল হয়েছি।
মিসির আলি বললেন, আমি আপনার ব্যাপারটা নিয়ে ক্রমাগত ভাবছি। আমি এখনো তেমন কিছু বুঝতে পারছি না। তবে মনে হচ্ছে বুঝতে পারব। রহস্য উদ্ধার হবে।
কি জন্যে মনে হচ্ছে রহস্য উদ্ধার হবে? তেমন কোনো কারণ কি ঘটেছে?
না, তেমন কোনো কারণ ঘটে নি। তার পরেও মনে হচ্ছে। আমার প্রায়ই এরকম হয়। একধরনের ইনট্যুশন কাজ করে।
মিসির আলি হেঁটে-হেঁটে বাসায় ফিরলেন। বাসার সদর দরজা খোলা। মজনু কলিং বেলও লাগায় নি। মিসির আলি ঘরে ঢুকে বড় ধরনের চমক খেলেন-তাঁর ঘর খালি। মজনু সবকিছু নিয়ে ভোগে গেছে ডলার ভাঙিয়ে সাত হাজার টাকা রেখেছিলেন ফটো অ্যালবামের ভেতর–সেই অ্যালবামও নেই। এত ভারি যে মিউজিক সেন্টার—তা-ও নেই। টেবিল-ল্যাম্প, কলিং বোল-তা-ও নেই। শীতবস্ত্রের মধ্যে তাঁর একটা ভালো শাল ছিল-সেটিও নিয়ে গিয়েছে।
তবে রান্না করে গেছে। টেবিলে সুন্দর করে খাবারুদাবার সাজিয়ে রাখা। পানির গ্লাস, একটা পিরিচে। লবণ, কাঁচামরিচ এবং কাটা শসা রান্না হয়েছে কৈ মাছের দোপিয়াজী, একটা ভাজা এবং ডাল।
মিসির আলি হাত ধুয়ে খেতে বসে গেলেন। প্রতিটি আইটেম অসাধারণ হয়েছে। খেতে-খেতেই মনে হল অতি ভদ্র, নিপুণ রাঁধুনি এই ছেলেটির সন্ধান বের করা খুব কঠিন না। এই ছেলে কোনো বিদেশির বাড়িতে আগে কাজ করত। কথাবার্তায় প্রচুর ইংরেজি শব্দ-তা-ই বলে দেয়। ইংরেজি শব্দগুলি খাবারদাবার-সংক্রান্ত। কাজেই ধরে নেয়া যায়। সে বাবুর্চি ছিল। চুরির দায়ে তার চাকরি চলে যায়—কিংবা পুলিশ হয়তো তাকে খুঁজছে। সে সাময়িক আশ্রয় নিতে এসেছিল তাঁর কাছে। ছেলেটি যেবাড়িতে কাজ করত, সেই বাড়ি গুলশান এলাকায়। কারণ কথাবার্তায় সে গুলশান মার্কেটের কথা প্রায়ই বলত। সে বলছিল একটা প্ৰেশার কুকার হলে অনেক রকম রান্না সে রাঁধতে পারবে। গুলশান মার্কেটে প্ৰেশার কুকার পাওয়া যায়।
মজনু এত সব তারি জিনিস নিজের কাছে রাখবে না। যেহেতু বুদ্ধিমান সে, চেষ্টা করবে অতি দ্রুত জিনিসগুলি বিক্রি করে দিতে।
কোথায় বিক্রি করবে? তার পরিচিত জায়গায়। অবশ্যই গুলশান মার্কেটে। কাজেই এখন একটা বেবিট্যাক্সি নিয়ে তিনি যদি গুলশান মার্কেটে চলে যান তাহলে মজনুকে পাওয়া যাবে!
মিসির আলি খাওয়া শেষ করে হাত ধুয়ে বিছানায় এসে বসলেন। বিস্মিত হয়ে দেখলেন তাঁর বালিশের কাছে একটা পিরচে দু খিলি পান, একটা সিগারেট এবং ম্যাচ রাখা। তিনি পান মুখে দিয়ে সিগারেট ধরালেন এবং মজনুকে ক্ষমা করে দিলেন। এবং তার প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই তাঁর কাছে মনে হল তিনি আফসার সাহেবের রহস্যভেদের কাছাকাছি চলে গেছেন। কিছু জিনিস এখনো জট পাকানো আছে। তবে তা হয়তো-বা খুলে ফেলা যাবে। কয়েকটা ছোটখাটো ব্যাপার পরীক্ষা করে দেখতে হবে। আরো কয়েকটা দিন লাগবে।
বিছানায় শুয়ে-শুয়ে গান শুনতে ইচ্ছা করছে। মিউজিক সেন্টারটা খুব শখ করে কিনেছিলেন। একটা গানও শোনা হল না। মন-খারাপ লাগছে। মন-খারাপ ভাব কাটানোর জন্যেই আবার র বইটা হাতে নিলেন।
ভয়ংকর বিষধর এবং একই সঙ্গে অপরূপ সুন্দর সাপের নাম ল্যাকেসিস মিউটা। এই ল্যাটিন নামের বঙ্গানুবাদ হল-নিঃশব্দুনিয়তি। বাৰু, কী সুন্দর নাম! মানুষ যেমন এসেছে বাঁদর থেকে, পাখিরা এসেছে সরীসৃপ থেকে। পাখিদের আদি পিতা-মাতা হচ্ছে সরীসৃপ–ভাবতেও যেন কেমন লাগে।
মিসির আলি বইয়ের পাতা উন্টে যাচ্ছেন। তাঁর মন-খারাপ ভাব কেটে যাচ্ছে। গান শুনতে ইচ্ছা করছে। গানের কথা মনে পড়তেই আবার খানিকটা মন-খারাপ হল। পূর্ব দামের একটা লং প্লেয়িং রেকর্ড কিনে এনেছিলেন। রেকর্ডটা পড়ে আছে। শোনা হয়নি। এই মুহূর্তে তাঁর শুনতে ইচ্ছা করছে-আজ শ্রাবণের পূর্ণিমাতে। পূর্ব দাম এই গানটি কেমন গেয়েছেন কে জানে!
ঘরের সব কটা জানালা বন্ধ
আফসার সাহেব গত দু দিন ধরে নিজের ঘর থেকে বের হচ্ছেন না! ঘরের সব কটা জানালা বন্ধ, পর্দা ফেলা দিনের বেলাতেও ঘর অন্ধকার হয়ে আছে। তিনি খাবার খেতে খাবার টেবিলেও যাচ্ছেন না। খাবার নিয়ে মীরা তাঁর ঘরে যাচ্ছেন। আফসার সাহেব ঠিকমতো খাচ্ছেনও না। অল্প কিছু মুখে দিয়েই বলছেন, খিদে নেই। মীরা বিরাট বিপদে পড়েছেন। কি করবেন বুঝতে পারছেন না বাচ্চাসহ বিড়ালটাকে কস্তায় ভরে আবার ফেলে দিয়ে আসা হয়েছে। এবার কাছে কোথাও নয়, গাড়ি করে একেবারে জয়দেবপুরে।
মীরা অবশ্যি আফসার সাহেবকে বলেছেন-বিড়ালগুলিকে বাসার বাইরে রাখা হয়েছে। মীরা ভেবেছিলেন এটা শুনে আফসার সাহেব রেগে যেতে পারেন। খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার-রাগেন নি। বরং এই প্রসঙ্গে কোনো কথাও বলেন নি। মনে হচ্ছে বস্তায় ভরে ফেলে দিয়ে আসার ব্যাপারটা তিনিও আন্দাজ করছেন।
আত্মীয়স্বজনরা ক্রমাগত আসছে। কেউ-কেউ দিনের মধ্যে দু বার তিন বার আসছে। মীরার বেশির ভাগ সময় এবং শক্তি ব্যয় হচ্ছে যেন তারা আফসার সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে না-পারেন। আত্মীয়স্বজনরা খুব বিরক্ত হচ্ছেন। কেউ-কেউ রােগও করছেন। আফসার সাহেবের এক মামা কঠিন গলায় মীরাকে বললেন, তুমি ওকে লুকিয়ে রাখলে তো লাভ হবে না। ওর চিকিৎসা হওয়া প্রয়োজন।
মীরা বললেন, চিকিৎসা হচ্ছে। আপনি তো চিকিৎসক না। আপনি যাবেন—ঐ সব কথা মনে করিয়ে দেবেন। আমি চাই না সে বিড়াল নিয়ে ভাবুক।
আমি বিড়াল নিয়েই যে কথা বলব, তা তোমাকে কে বলল?
আপনি কী নিয়ে কথা বলবেন?
কথা বলার বিষয়ের কি অভাব আছে? আমি পলিটিক্স নিয়ে কথা বলব। বিশ্ববিদ্যালয়ের সন্ত্রাস নিয়ে কথা বলব। এতে ওর উপকার হবে। পুরো ব্যাপারটা ভুলে থাকতে পারবে। ঘরে তালাবন্ধ করে রাখা তো কোনো সমাধান না।
মীরা তাঁকে ঘরে ঢুকতে দিয়েছেন। তিনি চেয়ারে বসতে-বসতে প্ৰথম যে কথাটা বললেন তা হচ্ছে-আচ্ছা বাবা, বিড়ালের সঙ্গে কী কী কথা তোমার হয়েছে গুছিয়ে বল। কোনো কিছু বাদ দেবে না। দরকার আছে।
শুধু যে আত্মীয়রা আসছে তা নয়-আত্মীয়দের আত্মীয়, তাদের আত্মীয়া মুখচেনা মানুষ,পড়ার মানুষ! পড়ার মানুষদের পরিচিত মানুষ। টেলিফোন সারাক্ষণইবাজছে। মীরা টেলিফোন ধরেন—এমন সব কথাবার্তা তিনি শোনেন যে তাঁর চোখে সত্যি পানি এসে যায়।
পত্রিকার অফিস থেকেও টেলিফোন এল সাপ্তাহিক চক্রবাকের প্রতিবেদক টেলিফোন করেছেন। মীরা টেলিফোন ধরলেন।
আপনি কি আফসার সাহেবের কী?
জ্বি।
আমি সাপ্তাহিক চক্ৰবাক থেকে বলছি।
কি ব্যাপার, বলুন।
আমরা খবর পেয়েছি আপনাদের বাড়িতে একজন বিড়ালে রূপান্তরিত হয়েছেন। তাঁর সারাগায়ে সাদা-সাদা লোম বেরিয়েছে লেজ গজিয়ে গেছে। কথাটা কি সত্যি।
আপনার কি ধারণা। এ-রকম খবর সত্যি হতে পারে?
জগতে অনেক অদ্ভুত-অদ্ভুত ঘটনা তো ঘটে।
ঘটলেও আমাদের এখানে ঘটে নি।
যদি না-ঘটে তাহলে এ-রকম একটা গুজব কী করে রটল?
আমি জানি ৎ কী করে রটল।
আচ্ছা ঠিক আছে -আমি ক্যামেরাম্যান নিয়ে আসছি।–আপনার এবং যার সম্পর্কে এই গুজব রটেছে তার একটা ইন্টারতভ্যু নিতে চাই।
কেন?
গুজবের উপর একটা নিউজ করব।
মীরা টেলিফোন নামিয়ে রেখে খানিকক্ষণ কাঁদলেন। সবচেয়ে ভালো হত এই বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও আশ্ৰয় নেওয়া—তা সম্ভব হচ্ছে না! আফসার সাহেব বাড়ি ছেড়ে কোথাও যেতে রাজি নন। তাঁকে এখান থেকে সরাতে হলে জোর করে সরাতে হবে।
মীরার ডাক্তার ভাই সাৰ্ব্বক্ষণিকভাবেই এ-বাড়িতে আছে। সে আফসার সাহেবের সঙ্গে বেশ ক বার কথা বলার চেষ্টা করেছে। কোনো লাভ হয় নি।
আফসার সাহেব কড়া চোখে তাকিয়েছেন-কোনো জবাব দেন নি। মীরার কথাবাতাঁর জবাব দেওয়াও তিনি ইদানীং বন্ধ করে দিয়েছেন। শুধু রুমী সুমী কিছু জিজ্ঞেস করলে জবাব দেন।
রুমী বাবার ঘরের দরজায় টোকা দিয়ে বলল, বাবা, আসব?
আফসার সাহেব বললেন, আয়।
রুমী ভয়ে-ভয়ে ভেতরে ঢুকল।
কেমন আছ বাবা?
ভালো আছি।
তোমাকে এমন বিশ্ৰী দেখাচ্ছে কেন?
দাড়ি-গোঁফ কামাচ্ছি না, কাজেই বিশ্ৰী দেখাচ্ছে।
কামাচ্ছ না কেন বাবা?
ইচ্ছা করছে না।
কোন ইচ্ছা করছে না?
জানি না। সব কেমন এলোমেলো হয়ে গেছে!
বাবা, আমি কি তোমার পাশে বসব?
বস।
রুমী ভয়ে-ভয়ে বসল। বাবার হাতের ওপর হাত রাখল।
বাবা।
কী মা?
সবাই বলছে তুমি নাকি বিড়াল হয়ে গেছ। তুমি কি বিড়াল হয়েছ?
না মা।
তাহলে সবাই এ-রকম মিথ্যা কথা বলছে কেন?
তা তো জানি না।
তোমার চোখ লাল কোন?
ঘুম হচ্ছে না। এর জন্যে চোখ লাল।
ঘুম হচ্ছে না কেন বাবা?
ঘুমুলেই দুঃস্বপ্ন দেখি–এই জন্যে ঘুমুতে ইচ্ছা করে না। ঘুম আসেও না।
তুমি কি পাগল হয়ে গেছ?
এখনো হই নি, তবে খুব শিগুগিরই হয়ে যাব বলে মনে হচ্ছে।
না, হবে না। মামা তোমার জন্যে খুব বড়-বড় ডাক্তার এনেছেন। তাঁরা তোমার চিকিৎসা করবেন।
চিকিৎসা করে আমার কিছুই করতে পারবে না। কারণ আমার কোনো অসুখ হয় নি।
তুমি কি আপনা-আপনি সেরে উঠবে?
তা-ও তো মা জানি না।
মহসিন বেশ ক জন ডাক্তার এনেছে। ডাক্তারা নানানভাবে আফসার সাহেবকে পরীক্ষা করেছেন। তেমন কিছুই পাননি। প্ৰেশার স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশি। সেটা তেমন কিছু না। আচার-আচরণেও তেমন কোনো অস্বাভাবিকতা নেই। ঘুম খুব কম হলে রিফ্লেক্স অ্যাকশান শ্লথ হয়ে যায়-তা হয়েছে। এর বেশি কিছু না। ডাক্তারদের সবারই ধারণা, ভালোমতো রেষ্ট হলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।
মহসিন মীরাকে বলল, যে করে হোক এই বাড়ি থেকে দুলাভাইকে বের করতে হবে। এখানে থাকলে তীর রেষ্ট হবে না। মাছির মতো লোকজন তন- ভিন্ন করছে!
মীরা বললেন, আমি বললে কিছু হবে না। আমি অনেক বলেছি।
মুখে বললে যদি না-হয়, তাঁকে জোর করে উঠিয়ে নিয়ে যেতে হবে। বাড়ির আবহাওয়া যা, তাতে যে-কোনো সুস্থ লোকও পাগল হয়ে যাবে।
মহসিন খুব ভুল বলে নি। বাড়ির সামনে একদল দুষ্ট ছেলে জটলা পাকাচ্ছে। তারা মাঝে-মাঝে বিড়ালের মতো ম্যাঁয়াও- ম্যাঁয়াও করে চিৎকার করছে। মানুষ মাঝেমাঝে খুব হৃদয়হীনের মতো আচরণ করে।
মহসিন বলল, আপা, তুমি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সব গুছিয়ে রােখ। আমি রাত দশটার পর মাইক্রোবাস নিয়ে আসব। এর মধ্যে একটা ফ্ল্যাট-বাড়ি ঠিক করে রাখব। তোমাদের সেখানে নিয়ে তুলব। আমি ছাড়া দ্বিতীয় কেউ জানবে না তোমরা কোথায় আছ। আমি আমার স্ত্রীকে পর্যন্ত বলব না।
কিন্তু তোর দুলাভাই? সে তো যেতে রাজি হবে না।
আমি রাজি করাচ্ছি।
মহসিন শোবারের ঘরের দরজায় টোকা দিয়ে বলল, আসব দুলাভাই?
আফসার সাহেব বললেন, না।
মহসিন দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকাল। আফসার সাহেব বললেন, আমি তো নিষেধ করেছিলাম ভেতরে আসতে।
ইমার্জেন্সির সময় বাধা-নিষেধ কাজে লাগে না। এখন হচ্ছে সুপার ইমার্জেন্সি। দুলাভাই, আমি জানি, আপনি আমাকে পছন্দ করেন না। কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য যে, আমি আপনাকে পছন্দ করি আপনি অতি সৎ, শাস্ত্ৰনীতি অক্ষরে-অক্ষরে মেনে-চলা একজন মানুষ। আপনি হয়তো বুঝতে পারছেন না যে এখন আপনার চরম দুঃসময় যাচ্ছে। এ-রকম কিছুদিন চললে আপনি পাগল হয়ে যাবেন। আপনাকে বাসা ছেড়ে গোপন কোনো জায়গায় যেতে হবে।
আমি তো কোনো অপরাধ করি নি যে পালিয়ে থাকব।
আপনার যুক্তি এক শ ভাগ সত্যি—আপনি কোনো অপরাধ করেননি। আমাদের এই সমাজটা এমন যে বেশির ভাগ শাস্তিই আমাদের বিনা অপরাধে পেতে হয়। এখানে শুধু যে আপনি একা শাস্তি পাচ্ছেন তাই না-আপনার মেয়ে দুটাও শাস্তি পাচ্ছে ওরা স্কুলে যেতে পারছে না। বাইরে গিয়ে খেলতে পারছে না। মুখ কালো করে ঘুরছে এবং কাঁদছে। ওদেরকে এই ঝামেলা থেকে মুক্ত করার জন্যে হলেও বাড়ি ছাড়তে আপনার রাজি হওয়া উচিত।
ভেবে দেখি।
হ্যাঁ, ভেবে দেখুন। খুব ভালো করে ভাবুন। বাড়ি ছাড়ার পক্ষে আরেকটি বড় যুক্তি আপনাকে দিচ্ছি। আপনার চাকরি নেই। এত বড় বাড়িতে আপনি এখন আর থাকতে পারেন না। ছোট বাড়ি নিতে হবে। আমি তেমনি ছোটখাটো একটা বাড়ি আপনার জন্যে দেখব।
আফসার সাহেব চুপ করে রইলেন।
মহসিন বলল, আমি এখন চলে যাচ্ছি। রাত দশটায় এসে সবাইকে নিয়ে যাব। দ্বিতীয় কোনো কথা শুনব না। যদি আপত্তি করেন জোর করে নিয়ে যাব।
রাত দশটায় মহসিন মাইক্রোবাস নিয়ে এল। আফসার সাহেব নিঃশব্দে গাড়িতে গিয়েবসলেন। কোনো আপত্তি করলেন না। তাঁরা গিয়ে উঠলেন গেণ্ডারিয়ার এক ফ্ল্যাটবাড়িতে। মহসিন করিৎকর্মী লোক। কিছু আসবাবপত্র এনে বাড়ি আগেই সাজিয়ে রেখেছে। এগার-বার বছরের একটা কাজের মেয়ে ঘর ঝাঁট দিচ্ছে।
নতুন বাসা খুব ছোট না-তিনটা রুম। বারান্দাটা ছোট হলেও শোবার ঘরটা বেশ বড়। অনেক উঁচু ছাদ। খোলামেলা ভাব আছে।
মহসিন বলল, দুলাভাই, আপনার বাসা পছন্দ হয়েছে?
আফসার সাহেব বললেন, হ্যাঁ, হয়েছে।
এই বাড়ির সবচেয়ে বড় সুবিধা কী, জানেন?
না।
এই বাড়ির সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে বাতাস। দখিন-দুয়ারি বাড়ি। শীত-কাল বলে টের পাচ্ছেন না। গরমকাল আসুক, দেখবেন ফু-ফু করে বাড়িতে হাওয়া খেলবে। আমার এক বন্ধু আগে এই বাড়িতে থাকত, তার কাছে শুনেছি।
আফসার সাহেব তেমন কোনো উৎসাহ দেখালেন না। আবার অনুৎসাহও দেখালেন না। মহসিন টিফিন ক্যারিয়ারে করে খাবার নিয়ে এসেছিল। রাতে তাই খাওয়া হল। আফসার সাহেব অনেক দিন পর ভালোমতো খাওয়াদাওয়া করলেন।
মহসিন মীরাকে আড়ালে নিয়ে গিয়ে বলল, আপা, এই বাড়ির আসল সুবিধার কথা এখন তোমাকে গোপনে বলে যাচ্ছি। এই বাড়ির আসল এবং একমাত্র সুবিধা হচ্ছে—তিনতলা ফ্ল্যাটের কোনো ফ্ল্যাটে বিড়াল নেই। তোমার ঐ বিড়ালও পথ খুঁজে খুঁজে এ-বাড়িতে আসবে না। বুঝতে পারছ?
পারছি।
এখন তোমাকে যা করতে হবে তা হচ্ছে, দুলাভাইকে ভালোমতো ঘুমানোর সুযোগ করে দেওয়া। ঠিকমতো ঘুমূলেই নাৰ্ভ শান্ত হয়ে যাবে। নাৰ্ভ শান্ত হলেই সব সমস্যার সমাধান হবে।
মীরা বললেন, আজ রাতটা তুই থেকে যা মহসিন, নতুন জায়গা, ভয়ভয় লাগছে।
আমি থাকব। দুলাভাইকে ঘুম পাড়ানোর দায়িত্বও আমার। আজ রাত নিয়ে তুমি চিন্তা করবে না।
মহসিন শোবার ঘরে গিয়ে বসল। আফসার সাহেব চুপচাপ সিগারেট টানছেন। তাঁকে আজ তেমন অস্থির বোধ হচ্ছে না। রুমী সুমী তাঁর পাশেই কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমুচ্ছে।
মহসিন বলল, দুটা ফ্রিজিয়াম খেয়ে আজ সারা রােত আপনি মড়ার মতো ঘুমুবেন, বুঝতে পারছেন?
আফসার সাহেব বললেন, অষুধ খেয়ে কোনো লাভ নেই, ঘুম আসবে না। ঘুমুলেই দুঃস্বপ্ন দেখব-এই টেনশানে আমার ঘুম আসে না।
আজ টেনশন করতে হবে না। আমি সারা রাত আপনার বিছানার পাশে জেগে। বসে থাকব। যখনই আপনি স্বপ্ন দেখতে শুরু করবেন, আমি আপনাকে ডেকে তুলব।
বুঝবে কী করে আমি স্বপ্ন দেখছি কি না?
স্বপ্ন দেখার সময় মানুষের চোখের পাতা কাঁপতে থাকে। একে বলে rapidleye movement, সংক্ষেপে REM। যখনই দেখব আপনার চোখের পাতা কাঁপছে, আমি আপনাকে ডেকে তুলব। আমার ওপর আপনি বিশ্বাস রাখুন, আমি আপনার খাটের পাশে একটা চেয়ার টেনে বসব।
মহসিন আসলেই তাই করল।
আফসার সাহেব ঘুমের অষুধ খেয়ে ঘুমুতে গেলেন। আশ্চর্যের ব্যাপার, মাথা বুলিশে ছোঁয়ানোমাত্র ঘুমিয়ে পড়লেন, এবং চমৎকার একটা স্বপ্ন দেখলেন।–স্বপ্নেও তিনি ঘুমুচ্ছিলেন। ঘুম ভাঙলে তিনি চোখ মেললেন। লক্ষ করলেন, তিনি একটা বেতের ভাঙা সুটকেসের ভেতর শুয়ে আছেন। তাঁর শীত লাগছে। বেশ শীত লাগছে। তিনি মানুষ নন-বিড়াল। সূৰ্যটকেসের ভেতর থেকে উঠে এলেন। খিদে পেয়েছে। খাবারের সন্ধানে যাওয়া উচিত। নানান রকম খাবারের স্ত্ৰাণ পাচ্ছেন। একটা পাউরুটির টুকরার ঘ্রাণ আসছে। পাউরুটিতে মাখন লাগানো মাখনের ঘ্রাণও পাওয়া যাচ্ছে। বেশ কিছু পিঁপড়া পাউরুটিতে আছে। তিনি পিঁপড়ার ঘ্রাণও পাচ্ছেন। কোথায় যেন চা ফেলে দিয়েছে। সেই চা শুকিয়ে মেঝেতে সরের মতো পড়েছে। তার গন্ধও নাকে আসছেঃ মেঝের ঐ অংশ চেটে দেখা যেতে পারে। রান্নাঘরের ডাষ্টবিনে কিছু ভাত আছে। তবে ভাত নষ্ট হয়ে গেছে। টক গন্ধ আসছে। আশ্চর্যের ব্যাপার, এক জায়গায় বসে তিনি সারা বাড়িতে কোথায় কি খাবার আছে তার গন্ধ পাচ্ছেন। তিনি হাই তুললেন। কোন কোন খাবার খাবেন তা মনে-মনে গুছিয়ে নিলেন। এইবার ইঁদুরের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। একটা মা-ইন্দুর বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে বের হয়েছে। শুধু গন্ধ দিয়ে তিনি প্রতিটি ইঁদুরকে আলাদা-আলাদা করে চিনতে পারছেন। মাটা ভয়ংকর বদ। একে মারার চেষ্টা করবেন। না, থাক। ছোট-ছোট বাচ্চা আছে। কী দরকার? খিদেও চলে গেছে। ঘুম পাচ্ছে। তিনি আবার বেতের সুটকেসে ঢুকে পড়লেন। স্বপ্নের মধ্যেই আবার ঘুম এসে গেল। ঘুম ভাঙািল রাত তিনটায়। আফসার সাহেব বিছানায় উঠে বসলেন। বিস্মিত হয়ে দেখলেন, মহসিন চেয়ারের হাতলে মাথা রেখে অকাতরে ঘুমুচ্ছে। তার নাকও ডাকছে।
আফসার সাহেব সাবধানে বিছানা থেকে নামলেন। বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। অবাক হয়ে লক্ষ করলেন, বারান্দার শেষ প্রান্তে বিড়াল একটা মাত্র বাচ্চা নিয়ে চুপচাপ বসে আছে। আফসার সাহেব ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেললেন। আর ঠিক তখন বিড়ালের কথা শুনতে পেলেন।
বাচ্চা : মা, দেখ-দেখ, উনি বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছেন।
মা : দেখছি।
বাচ্চা : আমরা যে বাসা খুঁজে-খুঁজে এখানে চলে এসেছি তা দেখে উনি কি খুশি হয়েছেন?
মা : না।
বাচ্চা : আমার ভাইটা যে মারা গেছে তা কি উনি বুঝতে পারছেন মা?
মা : মানুষ অসম্ভব বুদ্ধিমান, আমরা দু জন মাত্র এসেছি। তাই দেখে তো বোঝা উচিত।
বাচ্চা : আমাদের মনে যে খুব কষ্ট তা কি উনি বুঝবেন মা?
মা :না। পশুদের কষ্ট মানুষ কখনো বোঝে না।
বাচ্চা : এখন তাঁরা কি আমাদের আবার কস্তায় ভরে ফেলে দেবেন?
মা : দিতে পারে। আবার না-ও দিতে পারে। যখন দেখবে আমরা এত কষ্ট করে। পুরনো বাসায় গিয়েছি, সেখানে তাঁদের না-পেয়ে গন্ধ শুঁকে-শুঁকে এই জায়গায় এসেছি।–তখন অবাক হয়ে আমাদের রাখতেও পারে।
বাচ্চা : খিদে পেয়েছে মা।
মা : ঘুমিয়ে পড়া ঘুমিয়ে পড়লে খিদে লাগবে না।
বাচ্চা : মা।
মা : কি?
বাচ্চা : ভাইটির জন্য খুব কষ্ট হচ্ছে মা। কাঁদতে ইচ্ছা করছে।
মা : কাঁদতে ইচ্ছা করলে কাঁদ।
আফসার সাহেব শুনলেন বিড়ালের বাচ্চাটা কাঁদছে। এই কান্না অবিকল মানবশিশুর কান্নার মতো। অফিসার সাহেবের চোখে পানি এসে গেল।
খাতায় বিড়ালের ব্যাপারটা লিখেছেন
মিসির আলি বড় একটা খাতায় বিড়ালের ব্যাপারটা লিখেছেন। খাতাটা নিয়ে আফসার সাহেবের বাসায় যাবেন। যাবার আগে লেখাটা আরেক বার দেখে নিচ্ছেন। মিসির আলি লিখছেন :
১. আফসার সাহেব একজন বুদ্ধিমান মানুষ, তবে গম্ভীর প্রকৃতির। ঠাট্টা-তামাশা পছন্দ করেন না। সবকিছু খুব সিরিয়াসভাবে নেন। কাজেই তিনি যখন বলেন বিড়ালের কথা বুঝতে পারছেন, তখন ধরে নেওয়া স্বাভাবিক যে, তিনি ঠাট্টা-তামাশা করছেন না। একজন বুদ্ধিমান মানুষ কোনো কারণ ছাড়া হঠাৎ বলা শুরু করবেন না যে, তিনি বিড়ালের কথা বুঝতে পারছেন। এটা বলায় তাঁর কোনো লাভ হচ্ছে না।– বরং সামাজিকভাবে তিনি হাসির পাত্রে পরিণত হচ্ছেন। আমিও ধরেই নিচ্ছি। তিনি বিড়ালের কথা বুঝতে পারছেন। এটা ধরে নিয়ে অন্য যুক্তিগুলি পরীক্ষা করছি।
২ ক্যাসেট প্লেয়ারে বিড়ালের কথা টেপ করা ছিল। তাঁকে শোনানো হল। তিনি কিছু বুঝতে পারলেন না। এতে দুটি জিনিস প্রমাণিত হচ্ছে—ক তিনি সত্যি কথা বলছেন। মিথ্যা করে বলতে পারতেন যে, কথা বুঝতে পারছেন। মিথ্যা বললেও আমাদের তা ধরার ক্ষমতা ছিল না। খ বিড়াল হয়তো টেলিপ্যাথিক নিয়মে কথা বলে! যদি তার কথা হয় টেলিপ্যাথিক, তবে ক্যাসেট প্লেয়ারে ধরে রাখা বিড়ালের কথা হবে। অর্থহীন। টেলিপ্যাথিক কথা বলার সম্ভাবনাই বেশি। কারণ বিড়ালের ভোকাল কর্ড মিয়াও ছাড়া অন্য কোনো শব্দ করতে পারে না। একটিমাত্র শব্দে দীর্ঘ বাক্য তৈরি করা বা কথোপকথন চালানো অসম্ভব।
৩. আফসার সাহেব রাস্তায় হাঁটার সময় কিছু বিড়ালের দেখা পেতেন। তিনি তাদের কোনো কথা বুঝতে পারেন নি। বিড়ালের কথা যদি টেলিপ্যাথিক হয়, তাহলে তাদের কথাও বোঝা উচিত ছিল। আফসার সাহেবকে আমি একটি বাসায় নিয়ে গিয়েছিলাম। তাদেরও দুটি বিড়াল ছিল। আফসার সাহেব সেই দুটি বিড়ালের কথাও বুঝতে পারেন নি।
তাহলে ব্যাপার এই দাঁড়াচ্ছে—আমরা যেখান থেকে শুরু করেছিলাম আবার সেখানেই ফিরে গিয়েছি। এককথায়, আমরা এখন সহজ সিদ্ধান্তে চলে আসছে পারি ৪ আফসার সাহেব বিড়ালের কথা বুঝতে পারেন না। তিনি মনগড়া কথা বলছেন।
কিন্তু ইচ্ছা করলে এই সহজ সিদ্ধান্তে আমরা না-ও যেতে পারি। আমার সিদ্ধান্ত এ-রকম–আফসার সাহেব বিড়ালের কথা বুঝতে পারেন তবে সেই বিড়ালকে হতে হবে মা-বিড়াল এবং তার কিছু বাচ্চা থাকতে হবে। মা- বিড়াল বাচ্চাদের ট্রেনিং দেবার জন্যে ক্রমাগত তাদের নানান জিনিস শেখাবে। এই শেখানোর ব্যাপারটা সে করবে-টেলিপ্যাথিকেলি। বাচ্চারাও একইভাবে মার সঙ্গে যোগাযোগ করবে। শিক্ষার প্রাথমিক অংশ শেষ হবার পরপর বিড়ালদের এই ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যাবে। আফসার সাহেবের মস্তিষ্কের একটি অংশ কোনো এক বিচিত্র কারণে বিড়ালের টেলিপ্যাথিক কথোপকথন ধরতে পারছে। আমার ধারণা, ছোট-ছোট শিশু আছে এমন যে-কোনো বিড়ালের কথাই তিনি বুঝতে পারবেন।
এই অস্বাভাবিক ক্ষমতার সঙ্গে মানুষের পরিচয় নেই বলেই মানুষ এই ক্ষমতা দেখবে ভয়ে এবং বিস্ময়ে। মানুষ এটা সহজে গ্রহণ করতে পারবে না। শেষটায় এই ক্ষমতা আফসার সাহেবকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। মানুষ কখনোই অস্বাভাবিক কিছু সহজভাবে গ্রহণ করতে পারে না। কোনো মানুষ যদি কপালে তৃতীয় একটি চোখ নিয়ে জন্মায়, তাহলে আমাদের সমাজ তাকে ডাস্ট্রবিনে ছুঁড়ে দেবে। তৃতীয় চোখের জন্যে সেই মানুষটিকে কঠিন মূল্য দিতে হবে, যদিও সেই তৃতীয় চোখের কারণে মানুষটির পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা বেড়েছে। তার লাভই হয়েছে। কিন্তু আমাদের সমাজ ব্যাপারটা সেভাবে দেখবে না। মানুষকে উদার ভাবা হলেও মানুষ মোটেই উদার নয়। সে সব সময় দেখে তার গোষ্ঠীস্বর্থ। কাজেই আফসার সাহেবের সামনে খুব খারাপ দিন।
কী সুন্দর কী সুন্দর
মিসির আলি অনেক খুঁজে-খুঁজে আফসার সাহেবের বাসায় এসেছেন। বাসা থমথম করছে। কোনো সাড়াশব্দ নেই। বাড়িতে পা দিয়েই তাঁর মনে হল অশুভ কিছু যেন এই বাড়িতে ছায়া ফেলে আছে। ভয়াবহ কিছু ঘটে গেছে। কলিং বেল টিপতেই মীরা এসে দরজা খুললেন। তিনি এমনভাবে তাকালেন যেন মিসির আলিকে চিনতে পারছেন না। মীরার চোখ লাল, হয়তো কাঁদছিলেন।
মিসির আলি বললেন, কেমন আছেন?
মীরা কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললেন, ভালো নেই।
ভেতরে আসব?
আসুন।
আফসার সাহেব কোথায়?
মীরা চুপ করে রইলেন। মিসির আলি বললেন, আমি বুঝতে পারছি বড় রকমের কোনো ঘটনা ঘটেছে। আপনি কি আমাকে দয়া করে বলবেন, কী ব্যাপার?
মীরা চাপা গলায় বললেন, আমাদের ঐ বিড়ালটা একটা বাচ্চা নিয়ে খুঁজে-খুঁজে এই বাড়িতে চলে এসেছিল। কী করে গেণ্ডারিয়ার এই বাড়ি খুঁজে পেল আমি জানি না। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে দেখি বিড়ালটা তার বাচ্চা নিয়ে চুপচাপ বসে আছে। সুমীর আব্বা একগাদা খাবার খেতে দিয়েছে। আমার প্রচণ্ড রাগ হল। রাগে প্রায় অন্ধ হয়ে গেলাম-আমাদের সমস্ত যন্ত্রণার মূলে এই বিড়াল। আমার মনে হল এদের শেষ না করতে পারলে আমাদের মুক্তি নেই। তখন আমি খুব একটা খারাপ কাজ করলাম।
কি করলেন?
খুব নোংরা, খুব কুৎসিত একটা কাজ–বলতে গিয়েও আমি লজ্জায় মরে যাচ্ছি। আমি রান্নাঘরে ঢুকলাম। রান্নাঘরের চুলায় চায়ের পানি ফুটছিল। আমি সেই ফুটন্ত পানি এনে এদের গায়ে ঢেলে দিলাম। এত বড় অন্যায় যে আমি করতে পারি, তা কখনো কল্পনা করি নি। কিন্তু করেছি, নিজের হাতে ফুটন্ত পানি ঢেলে দিয়েছি।
তারপর?
পানি ঢালার পরই মনে হল আমি এ কী করলাম, আমি এ কী করলাম! তখন আমি নিজেই এদের নিয়ে হাসপাতালে ছুটে গেছি। হাসপাতালে নিয়ে যাবার পরপরই দুটা বিড়ালই মারা যায়।
আফসার সাহেব কোথায়? উনি ঘটনাটা কীভাবে নিয়েছেন?
আমার মনে হয় সহজভাবেই নিয়েছেন। বাসায় ফিরে আমি খুব কান্নাকাটি করছিলাম। উনি আমাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন। আমার মাথায় হাত বোলাতে-বোলাতে বলছিলেন-মানুষমোত্রই ভুল করে। তুমিও করেছ।
ঘটনাটা কবে ঘটেছে?
গতকাল।
মীরার চোখ দিয়ে ক্রমাগত পানি পড়ছে। তিনি নিজেকে সামলাতে পারছেন না। রুমী সুমী দরজার পর্দা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের মুখ শুকিয়ে এতটুকু হয়ে আছে।
মিসির আলি বললেন, আফসার সাহেব কোথায়?
মীরা বললেন, ও গিয়েছে টেনের টিকিট কাটতে। সবাইকে নিয়ে সে ঢাকার বাইরে কোথাও বেড়াতে যেতে চায়।
সেটা ভালো হবে। যান, ঘুরে আসুন।
মিসির আলি উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর কাছে মনে হচ্ছে এই পরিবারটি এখন সামলে উঠতে পারবে। বড় ধরনের দুর্ঘটনা এখন এদের কাছাকাছি নিয়ে আসবে। তা ছাড়া যেহেতু বিড়াল দুটিও এখন নেই। এটাও একধরনের মুক্তি।
মিসির আলি বললেন, আমি আজ যাই। আপনারা বাইরে থেকে ঘুরে আসুন। তারপর একদিন এসে চা খেয়ে যাব।
মীরা চোখ মুছতে-মুছতে নিচু গলায় বললেন, আপনাকে একটা ব্যাপার বলতে চাচ্ছি-আমি যখন বিড়াল দুটাকে নিয়ে রিকশা করে হাসপাতালে যাচ্ছি, তখন হঠাৎ স্পষ্ট শুনলাম, মা-বিড়ালটা বলছে— আমি আপনার পায়ে পড়ছি, আপনি আমার বাচ্চাটাকে বাঁচান। এই বেচারা সুন্দর পৃথিবীর কিছুই দেখল না। আমি কথাগুলি স্পষ্ট শুনলাম-যেন বিড়ালটা আমার মাথার ভেতর ঢুকে আমাকে কথাগুলি বলল। এই রকম কেন শুনলাম বলুন তো?
মিসির আলি কখনো মিথ্যা বলেন না-আজ বললেন। কোমল গলায় বললেন- এটা আপনার কল্পনা। অপরাধবোধে কাতর হয়ে ছিলেন বলেই কল্পনায় শুনেছেন। বিড়াল কি আর কথা বলতে পারে?
মীরা বললেন, আমারও তাই ধারণা।
বলতে-বলতে মীরা আবার চোখ মুছলেন।
মিসির আলি বাসার দিকে ফিরে চলছেন। শীতের সন্ধ্যা। আকাশ লাল হয়ে আছে। আকাশের লাল আলোয় কী অপূর্বই না দেখাচ্ছে শহরটাকে! হাঁটতে— হাঁটতে তাঁর মনে ফুল—প্রকৃতি এত সুন্দর করে নিজেকে শুধু মানুষের জন্যেই সাজায় না, তার সমস্ত জীব-জগতের জন্যেই সাজায়। মানুষ মনে করে শুধু তার জন্যেই বুঝি সাজিয়েছে, পাখি মনে করে তার জন্যে। বারান্দায় বসে-থাকা মা- বিড়াল মনে করে তাদের জন্যে। সে হয়তো তার শিশুটিকে ডেকে বলে—মা, দেখ-দেখ কী সুন্দর! কী সুন্দর!
Post a Comment