বিশ্বাসের প্রতি অবিশ্বাস – মুহাম্মদ বরকত আলী
দু’হাতে হাত কড়া। এই প্রথম আমার হাতে হাত কড়া পড়ল। ইতো পূর্বে কখনো-ই চুড়ির মত এই অদ্ভুত জিনিসটা আমার হাতের ধারে কাছেও আসেনি।
বাংলাদেশ পুলিশবাহিনি খুব চৌকস। এত দ্রুত হাত কড়া পরাতে পারে তা আমার অজানা ছিলো। সত্যিই অবাক করার মত। কথা বলার সময় দেবে না। দু একটা কথা শেষ হতে না হতেই হাত কড়া লাগানো কাজ সম্পূর্ণ। তবে আর যাই হোক অদ্ভুত এই বস্তুটা হাতে পরে মন্দ লাগছে না। মনে হচ্ছে হাতে চুড়ি পরেছি। এটা অপরাধীর দৌঁড়িয়ে পালিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা হারায়। দুই হাত প্রায় কাছাকাছি থাকায় দ্রুত দৌঁড়ানো একদম সম্ভব নয়। তবে চাইলে ম্যারাথন দৌঁড় হতে পারে।
আমার সাথে আরও তিনজনকে আটক করেছে পুলিশ। আমাদের পাহারা দেওয়া জন্য একজন কনস্টেল আছেন। সে আমার সমবয়সী হবে। বাকি সদস্যরা পালিয়ে যাওয়া আসামীর পিছনে ছুটেছে। যদিও জানি না তারা প্রকৃত অপরাধী কিনা। তাদের কথা জানা দূরের কথা, আমি নিজেও জানি না আমাকে কেন আটক করেছে।
‘জনাব, জানতে পারি কি, আমাকে কেন আটক করা হয়েছে?’
কনেস্টেবল আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বলল, ‘থানায় গিয়ে জানানো হবে। এখন বলার সময় নাই। মন মেজাজ বেজায় খারাপ।’
বুঝতে পারছি খুব চাপের মধ্যে আছেন তিনি। উপর থেকে চাপ আছে নিশ্চয়। আর সেই চাপ কমাতে নিচের দিকে চাপ দিয়েছে। যাকে বলে নিম্ন চাপ।
পার্কে অবসর যাপন করতে আসা উপস্থিত যত নারী পুরুষের আগমন হয়েছে তাদের কাজ এখন আমাদের ঘিরে দাঁড়িয়ে থেকে কানাঘুষা করা। প্রকৃিতর নিয়মে নাকি নিজেদের নিয়মে জানি না। তবে এখন তারা সেই মহান কাজটাই যথাযথ ভাবে পালন করছেন। কেউ কেউ পালিয়েছে। কথায় বলে, ‘‘ঘোড়ার পিছনে যেও না, আর পুলিশের সামনে যেও না।’’ পুলিশ নাকি ছায়ে দঁড়ি পাকায়। অতি পুরনো কথা। যাকে বলি কথার কথা। যতই কথার কথা হোক না কেন, তবুও পূর্বপুরুষের এই অমূল্যবাণি অক্ষরে অক্ষরে পালন করে থাকেন অনেকেই।
বিকেলে পার্কে আসা বিনোদন নিতে। এর মধ্যে হুট করে পুলিশের হানা। পড়ে রইল তোর বিনোদন। ছেড়ে দে মা কেঁদে বাচি অবস্থা। পড়িমড়ি করে যে যেমন পেরেছে বাড়ির পথ ধরেছে। আর কিছু মানুষ আছে যাদেরকে বলা হয় উচ্ছুক জনতা অথ্যাৎ পাবলিক। এই উচ্ছুক জনতার দল আমাদের ঘিরে রেখেছে। নিজেদের মধ্যে কানা ঘুষা করছে আর আমাদের দেখছে। মনে হচ্ছে চিড়িয়াখানার নতুন কিছু জীব যন্তু নিয়ে আসা হয়েছে পার্কে। পাবলিকের বিনোদনের নতুন এক আবিষ্কার। পার্কে নানা জাতের ফুল গাছ, গাছের পাশে বেঞ্চ। বেঞ্চে বসে গল্প করবে, বাদাম খাবে, ঝালমুড়ি খাবে। সেই সাথে যুক্ত হয়েছে অভিনব এই আয়োজন। আমরা যেন এখন মানুষের আনন্দ দেওয়ার মাধ্যম।
কিছুক্ষণপর ফিরে এলেন তাড়া করা পুলিশের সদস্যরা। বুঝতে পারছি পালিয়ে যাওয়া বাকি কজনের একজনেরও নাগাল পায়নি। আমাদের ঘিরে থাকা উচ্ছুক জনতাদের পার্ক থেকে রেব বললেন। কয়েক মুহূর্তেই সব ফাঁকা হয়ে গেল।
আমার সাথে আটক থাকা তিন জনের সাথে বাড়ির মোবাইল নম্বর নিয়ে কথা বললেন একজন পুলিশ সদস্য। ওদেরকে আমার থেকে কিছুটা দূরে সরিয়ে নিয়ে গেছে। তবে কিছুটা শুনতে পেলাম। ওদের বাড়ির লোকদের ফোনকল দিয়ে বললেন, ‘আমি রতনপুর থানার এস আই জায়েদ বলছি। আপনার ছেলেকে আমরা পার্ক থেকে আটক করেছি। থানায় দেখা করেন। তিন জনের বাড়িতেই একই কথা বলে এবার আমার কাছে এলেন।
‘নাম কি?’
‘তপু।’
‘বাড়ির যোগাযোগের মোবাইল নম্বর দে।’
‘বাড়ির মোবাইল নম্বর মুখস্ত নেই জনাব।’
এস আই জায়েদ আমার কথা শুনে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলেন কয়েক মুহুর্ত। কিছুক্ষণপর বললেন, ‘ও আচ্ছা, তা বেশ ভালো কথা। তো, লেখাপড়া?’
‘জি¦ জনাব।’
‘কতটুকু? মানে স্কুল কলেজ, নাকি বিশ্ববিদ্যালয়?’
জানি না এদেশে কতটুকু লেখাপড়া জানলে শিক্ষিত বলা হয়। তবে এতটুকু জানি যে মাধ্যমিক পাশ দিয়ে সদ্য পুলিশে চাকুরি পাওয়া কনস্টেবলকেও স্যার বা জনাব বলে সম্বোধন করতে হয়। তা নাহলে জনাবেরা গোস্সা করে। এটাও জানি যে, এই সদ্য চাকুরি পাওয়া মানুষটার মুখ থেকে তুই তোকারি আর গালাগালিও শুনতে পাওয়া যায় খুব সহজে। আর তাই বোঝা কঠিন হয় কে শিক্ষিত আর কে অশিক্ষিত। আমি শিক্ষিত হয়ে উঠেছি কিনা তা জানার আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম,
‘তা কতটুকু লেখাপড়া জানা মানুষকে আপনি শিক্ষিত বলবেন, জনাব?’
‘বেশি প্যাঁচাপ্যাঁচি করিস না। সরাসরি বল।’
‘মাস্টার্স শেষ করেছি সবে মাত্র। এখন বসে আছি। টিউশনি করি। একটা কাজের খোঁজে আছি। মনের মত কাজ পেলেই লেগে পড়ব। জানেনতো মনের মত কাজ না পেলে সেই কাজে মন বসানো কঠিন হয়ে যায়। এই ধরুন আপনি সারাদিন আসামির পিছনে দৌঁড়ান দেন। এতে কি আপনি নিজে থেকে সন্তুষ্ট? জানি জনাব, আপনি সন্তুষ্ট না। কখনোই ভাবেননি এত এত দৌঁড়ানি দিতে হবে। কিন্তু এখন আপনি দৌঁড়ানি দিতে বাধ্য। অসন্তুষ্ট মন নিয়ে কাজ করা যায় না। আর তাই আসামিগুলো ধরতে পারলেন না।’
এস আই জায়েদ হাসলেন। বললেন, ‘আমাকে কি তোর বোকা মনে হয়? একজন মাস্টার্স পাশ ছেলের বাড়ির মোবাইল নম্বর মুখস্ত নেই। অবাক করা কথা না?’
এস আই সাহেব তার এন্ড্রয়েড মোবাইল ফোনটা এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘কথা বেশি না বলে তাড়াতাড়ি মোবাইল নম্বর দে।’
বাড়ির নম্বর মুখস্ত নেই এটা তিনি কিছুতেই মানতে রাজি না। তাই এক প্রকার বাধ্য হয়ে একটা নম্বর দিলাম। উনি ফোন কল দিলেন। কেউ একজন হ্যালো বলতেই এস আই সাহেব বললেন, ‘আমি রতনপুর থানার এস আই জায়েদ বলছি। তপু আপনার কে হয়?’
মোবাইলে লাউড স্পীকার দেওয়া। ফোনটা মনে হচ্ছে একজন মধ্য বয়স্ক পুরুষমানুষ ধরেছেন। ওপাশ থেকে ভেসে এলো, ‘কে তপু? আপনি ভুল করছেন। তপু নামের কেউ আমার আত্মীয় কিংবা বন্ধু নেই।’ এতটুকু বলেই ফোন কেটে দিলো। এস আই স্যার আরও একবার ফোন দিলো। এবার কাস্টমার অফিসের রেকর্ড করা গান বেজে উঠল। ‘‘আপনার ডায়েলকৃত নম্বরটি এই মূহুর্তে বন্ধ আছে। কিছুক্ষণপর আবার চেষ্ট করুন, ধন্যবাদ।’’ এস আই সাহেব রেগে গিয়ে বললেন, ‘কি নম্বর দিলি? এটা তো ভুল নম্বর মনে হচ্ছে। সেতো তোকে চেনেই না। এখন আবার মোবাইল বন্ধ রেখেছে।’
‘ভুল নম্বর দিইনি জনাব। সঠিক নম্বর দিয়েছি। ভুল নম্বর হলে ফোন কল ঢুকতো না।’
‘তাহলে এটা কার নম্বর?’
‘যে ভদ্র লোকটি ফোন রিসিভ করেছেন এটা উনারই নম্বর।’
‘তুই কিন্তু আমাকে সব গোলমাল পাকিয়ে দিচ্ছিস।’
‘জনাব, আপনাকে প্রথমেই বলেছি আমি নিজেই মোবাইল ফোন ব্যবহার করি না। আমার বাড়ির কারো নম্বর আমার মুখস্ত নেই। অথচ আপনি জোরাজোরি করছেন। আমার কথা বিশ^াস করছেন না। তাই এগার অঙকের একটা সংখ্যা বলেদিলাম।’
উনি মনে হয় এবার আমার কথা বিশ^াস করেছেন। মোবাইল নম্বরের কথা আর বললেন না। একজন কনস্টেবলকে বললেন, ‘সবাইকে গাড়িতে উঠাও।’
বাড়ি থেকে বের হয়েছি আজ আট বছর চার/পাঁচ মাস হবে। বাড়ির সাথে মানুষের সাথে তেমন কোনো যোগাযোগ নেই। আমার নিজস্ব কোনো মোবাইল ফোন নেই। মোবাইল ফোন মানুষের জীবনকে খুব সংক্ষিপ্ত করে দিয়েছে। কারণে অকাণে যেকোনো সময় ফোন কল আসে। ফোন রিসিভ করে খুব সহজেই নানান মিথ্যে কথা বলে। আমি স্বধীনচেতা মানুষ। নিজে স্বধীন থাকতে পছন্দ করি। অন্যের অধিনে থাকাটা আমার পক্ষে অসম্ভব। কাছে মোবাইল ফোন থাকলে দেখা গেল কেউ ফোন করে বিরক্ত করছে স্রেফ অকারণে। বাড়ির মোবাইল নম্বর আছে। তবে সত্যি সত্যিই মুখস্ত নেই। যে নম্বরটা আছে সেটা আমার মেসের রুমমেটের মোবাইলে সেভ করে রেখেছি। ইচ্ছে হলে আমি নিজে থেকেই বাড়িতে ফোন করি। যখন বাড়ির নম্বর মুখস্ত করার কথা মনে ধরে তখন ঐ অংক গুলোর সাথে আরও কিছু আবোল তাবোল অংক যোগ করে মাথা থেকে বের করে দিই। ইচ্ছে করেই মুখস্ত করিনি। দরকার নেই।
হাতকড়াতে হাতের চামড়া আটকা পড়েছে। চামড়ায় বেজায় চিমটি লাগছে।
এস আই সাহেবকে বললাম, ‘জনাব, আমি কোনো অপরাধ করিনি। আমাকে ছেড়েদিন।’
এস আই সাহেব একজন কনস্টেবলকে বললেন, ‘এই মালটা বড় শেয়ানা মাল। ওর কাছ থেকেই বের করতে হবে আসল গ্যাং এর খবর। ওর হাত কড়া সামনে থেকে খুলে পিছলে দাও।’
আমি বিনয়ের স্বরে বললাম, ‘জনাব, আমিতো কোনো অপরাধ করিনি। ওদেরকে আমি চিনি না। অনুগ্রহ করে আমার হাতকড়া খুলে দিন।’
কনস্টেবল আমার হাত কড়া খুলে দিয়ে হাত দুটো পিছ মোড়া দিয়ে পিছনে হাত কাড়া লাগাল। একি আজব রে বাবা।
আমাদেরকে গাড়িতে উঠানো হল। গাড়ি চলল থানার দিকে।
কখনো ভাবতেই পারিনি এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হবে। যাক এটাও একপ্রকার নতুন অভিজ্ঞতা হল। বেঁচে থাকতে হলে অভিজ্ঞতার দরকার আছে। তবে অভিজ্ঞতা দুই ধরনের। ভালো আর মন্দ। ভালো অভিজ্ঞতা নিজের প্রয়োজনের তাগিদে অর্জন করা উচিৎ। মন্দ অভিজ্ঞতা নিজে এসেই হাঁজির হয়। নিতে না চাইলেও বাধ্য করে।
এমন জঘন্য অভিজ্ঞতা এর পূর্বে আমার ছিলো না। আমার জীবনে এটা একটা বিরাট অর্জন। এমন জঘন্য অভিজ্ঞতা অর্জন কজনের ভাগ্যে জোটে?
গাড়ি এসে সোজা থামল রতনপুর থানায়। একে একে সবাইকে নামিয়ে থানার অফিস কক্ষে ঢুকানো হলো। এস আই জায়েদ নিজের চেয়ারে বসলেন। ভাবখানা দেখে মনে হচ্ছে আজ একটা বিরাট মহান কাজ করেছেন। উনি মনে হয় ভাবছেন এবার তার প্রমোশন ঠেকায়কে। বড় একটা গ্যাং ধরেছে। এই গ্যাংয়ের প্রধান আমি। এশহরের বড় বড় সন্ত্রাসীরা আমার কথায় চলে। আমিই তদের বস। ইস, ব্যাপারটা ভাবতে মন্দ লাগছে না।
বেলা গড়েছে। এখন দুপুর। খিদেয় পেটটা চু চা করছে। জানি না দুপুরে খাবারের ব্যবস্থা আছে কিনা। জেলখানায় হলে ঠিক ব্যবস্থা হত। এখানে মনে হয় কিছুই দেওয়া হবে না। আমরা তিনজন অফিস কক্ষে পাশাপাশি দাড়ানো। কারো মুখে কথা নেই। এখন পর্যন্ত কারো নাম জানি না। অন্যদের হাতে দঁড়ি পরানো। আমার হাতে হাতকড়া। এটা একপ্রকার অসমতা। এস আই সাহেব কি যেন কাজপত্র ঘাটছিলেন। এস আই সাহেবকে বললাম, ‘জনাব, ওদের হাতে দঁড়ি আর আমার হাতে হাতকড়া। এটা এক প্রকার অন্যায়। আমার হাতকড়াটা খুলে দিন। কথা দিচ্ছি পালাবো না। আপনারা না জানলেও আমিতো জানি, আপনারা আমাকে ভুলক্রমে আটক করেছেন। আমি অপরাধি নই। তাই নিশ্চিত থাকতে পারেন আমি পালাবো না। পালিয়ে যায় অপরধিরা।’
এস আই বললেন, ‘সত্যি করে বলতো তুই কি মনে করছিস আমি বোকা?’
‘কি যে বলেন। আপনি শিক্ষিত মার্জিত মানুষ। পড়াশোনা করে এখানে চাকুরি পেয়েছেন। আপনি বোকা হতে যাবেন কেন? আপনি খুব ধুরন্ধরবাজ এবং খুব দক্ষ পুলিশ অফিসার।’
এস আই জায়েদ চেয়ার ছেড়ে উঠে এলেন।
‘তুই সত্যিই বুদ্ধিমান। তোর বুদ্ধির তারিফ করতে হয়।’
আদিল বলে ডাক দিলেন কাউকে। অফিস কক্ষে এসে বললেন ইয়েস স্যার। পার্কে যে আমার হাত কড়াটা সামনে থেকে পিছনে পরিয়ে ছিল সেই কনস্টেবল।
এস আই সাহেব বললেন, ‘বেড়ি গুলো কোথায়?’
‘আছে স্যার। নিয়ে আসবো?’
এরা আমাকে বিশ্বাস করবে না। পুলিশের দয়া মায়া নেই। আজ প্রমান পেলাম।
‘জনাব, বেড়ি লাগবে না। হাতকড়া থাক। হাতকড়াতেই বেশ আছি।’
দুপুরের পর নতুন একজন সিপাহি আসলেন। মধ্য বয়স্ক। দাঁড়ি আধাপাকা-কাচা। মেহেদি লাগানো। কাঁধে ঝোলানো রাইফেল। বুকের উপর ব্যাজে লেখা আছে মো. রতন আলি। এস আই সাহেব, বললেন, ‘রতন সাহেব, এদের বাড়িতে ফোন করে জানানো হয়েছে। কারো বাড়ি থেকে কোনো লোক এলে গোল ঘরে বসতে বলবেন। দুপুরের পর বড় বাবু আসবেন। তারপর তাদের নিয়ে বসা যাবে।’ আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এটা বড় শেয়ানা। চোখে চোখে রাখবেন। খুব সাবধান। আপনিতো আবার….।’ এতটুকু বলে থেমে গেলেন।
চলে গেলেন এস আই সাহেব। কথা শুনে মনে হলো এই রতন সাহেবটা একটু বোকা গোছের মানুষ। বোকা বললে ভুল হবে। এরা সহজ সরল মানুষ। পৃথিবীতে যারা সহজ সরল তাদেরকে বোকা বলা হয়। আসলে তারা বোকা না। তারা ভালো মানুষ। মন্দ মানুষগুলো এই সব সহজ সরল মানুষগুলোর কাঁধে ভর করে উঁচু স্থানে ওঠে। নিজেদের সুবিধার জন্যই এদেরকে বোকা তকমা দিয়েছে।
রতন সাহেব বললেন, ‘সবাই হাটুগেড়ে বসে পড়েন।’
ভালো মানুষের এই হল নমুনা। যেখানে উচ্চ শিক্ষিতরা খুব সহজে ‘তুই’ শব্দ ব্যবহার করছে, সেখানে এই মধ্য বয়স্ক মানুষটা তার ছেলের বয়সের মানুষকে বলছে ‘আপনি’। শিক্ষিত গায়ে লেখা থাকে না। ভালো মানুষ শব্দটা নামের পাশে লেখা থাকে না। ব্যবহারেই তার পরিচয়।
সবার সাথে আমিও বসে পড়লাম। আমার হাত পিছনে থাকায় একটু বেশি অসুবিধা হচ্ছে। কিন্তু উপায় নেই। পড়েছি মঙ্গলের হাতে খানা খেতে হবে এক সাথে। একথার অর্থ জানি না। সবাই বলে তাই বললাম। তবে ভাব অর্থ জানি। আমরা অনেক শব্দের অর্থই জানি না। অথচ সেই শব্দগুলো এমন ভাবে বাংলা শব্দ ভান্ডারে স্থান দখল করে নিয়েছে যে, সেই শব্দগুলোকে এমন ভাবে ব্যবহার করা হয় যেনো মনে হয় এই শব্দগুলো বাংলা শব্দ। যেমন, কেউ কাউকে বলল, তুই যে এত বক বক করছিস এর ‘ল’ বুঝিস? ‘ল’ বুঝিস না আর কথা বলতে এসেছিস। যদি বলা হয় বলেন তো এই ‘ল’ মানে কী? বলতে পারবে না। কিন্তু শব্দটা ঠিক জায়গায় ব্যবহার করেছে। সে যা বোঝানোর জন্য বলেছে দুজনেই বুঝতে পেরেছে। কিন্তু বাংলা অর্থ জানে না। অথচ তার বলা উচিৎ ছিল, তুই কি আইন জানিস? আইন না জেনে কথা বলতে এসেছে। এরকম অনেক শব্দই আজ বাংলা ভাষায় স্থান দখল করে নিচ্ছে স্থায়ি ভাবে। বিশেষ করে তরুণেরা অনেক বাংলা শব্দ ইচ্ছে করে বাদ দিয়ে ফ্যাশন করে ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করছে।
রতন সাহেব দরজার বাইরে একটা চেয়ার নিয়ে বসলেন। তিনি এখন আমাদের পাহারাদার।
আমার সাথে থাকা দু’জনের একজন বলল, ‘শালা তোর জন্যই ধরা খেলাম।’ অন্যজন চুপ। আমি বললাম, ‘কি জন্য ধরা খেলাম ভাই? অন্তত আপনিই বলুন কাহিনি কি?’
লিডার টাইপের লোকটা বলল, ‘মানুষ খুন। আমরা মানুষ খুন করেছি। আপনি, আপনি আমাদের বুদ্ধিদাতা। মানে হুকুমদাতা। আপনি হুকুমের আসামি। বুঝেছেন কাহিনি কি?’
বুঝলাম না, এরা আবার আমার উপর খেপলো কেন?
‘আপনারা মজা করছেন? ঠিক করে বলুন। তা না হলে আমাকে ছেড়ে দিতে বলুন।’
অন্য একজন বললেন, ‘এখন আপনাকে ছেড়ে দিতে বললেই ছেড়ে দিবে? একদম না। দেখছেন না, আপনার হাতে হ্যান্ডকাপ আর আমাদের হাতে দঁড়ি?’
অন্যজন বলল, ‘আপনিই আমাদের লিডার। কি লিডার সাহেব খুন করার টাকাটা কবে দেবেন?’
‘মজা বাদ দেন। আপনাদের কাছে দু’বোতল ফেনসিলিড ফেলে যাওয়া লোকটা কে? তাকে নিশ্চয় আপনারা চেনেন। আপনারা দু’জন বন্ধু তা বুঝতে পারছি। আমি আপনাদের কেউ না। দয়া করে এই কথাটা শিকার করবেন।’
দরজায় পাহারা দেওয়া রতন আলি হালকা মেজাজে বললেন, ‘এই একদম যুক্তি পরামর্শ চলবে না। চুপচাপ থাকেন।’
আমার খুব খিদে পেয়েছে। খাবার না পেলেও সমস্যা নেই। না খেয়ে থাকাটা আমার অভ্যাস আছে। তবে, অন্তত একটা পাউরুটি কিনবা দুটাকা দামের বিস্কুট খেয়ে পানি খেতে হবে। অলিম্পিক বিস্কুট। দুই টাকা প্যাকেট। এলাচের গন্ধটা দারুন। এটাও যাদি না হয়, তাহলে আল্লাহ তায়ালার অশেষ নেয়ামত হল পানি , আপাতত এক গøাস পানি হলেই চালিয়ে নেওয়া যাবে।
একজন কনস্টেবলকে কীভাবে সম্বধোন করে ডাকতে হবে তা জানা নেই। ছোট বেলায় দেখেছি গ্রামে পুলিশ ঢুকলে সাধারন পাবলিক থেকে শুরু করে মেম্বার চেয়ালম্যান সবাই স্যার স্যার ডেকে মুখে ফেনা তুলে ফেলে। তাহলে আমি স্যার বললে সমস্যা কি। স্যার শব্দদের অর্থ হল, জনাব। ইংরেজীতের স্যার, বাংলায় জনাব। কোনটাতে তিনি সন্তুষ্ট হবেন কে জানে।
‘জনাব, রতন আলি সাহেব একটু এদিকে আসবেন।’
কথার কোনো জবাব দিলেন না। একবার উঁকি মারলেন।
আর একটা বার চেষ্টা করে দেখি। একবার না পারিলে দেখো শত বার। কেবল একবার চেষ্টা করেছি। আরও নিরানব্বই বার বাকি আছে।
‘জনাব, রতন আলি সাহেব, একটু শুনবেন।’
উনি বিরক্ত হয়ে অফিস কক্ষে আসলেন।
‘কি হয়েছে ? এত হাক ডাক কেনো?’
‘এখানে কি দুপুরের খাবার দেওয়া হয় না?’
উনি হাসলেন। এই হাসি মাখামুখটা মেহেদি মাখা দাঁড়িতে তখন অসাধারন করে তুলেছে।
হাসি মাখা মুখ নিয়ে বললেন, ‘না।’
আমার পকেটে আপাতত কোনো টাকা নেই। হয়ত এটাও অনেকে বিশ^াস করতে চাইবে না। একজন মাস্টার্স পাশ ছেলের পকেটে টাকা নেই। বিশ্বাস না করলেও কিছু করার নেই। এটাই সত্যি। সব সময় পকেটে টাকা থাকে না। টাকা না থাকলেও কোনো সমস্যা মনে করি না। মেসে গিয়ে তিন বেলা সময় মত খাবার পেলেই হল। অতিরিক্ত টাকার কি দরকার?
‘আপনি মুরুব্বি মানুষ, তাই আগেই মাফ চেয়ে নিচ্ছি। মাফ করবেন জনাব, আমাকে এক গ্লাস পানি খাওয়াতে পারবেন?’
অফিস কক্ষের এক কোনায় একটা ছোট টি টেবিলে একটা জগ আর একটা গ্লাস রাখা আছে। উনি আঙ্গুল দেখিয়ে দিয়ে বললেন, ‘ঐ যে ওখানে আছে। ওখান থেকে নিয়ে খেতে হবে।’
‘জনাব, আমার হাত বাঁধা। তাও আবার পিছনে। সামনের দিকে থাকলে কোনো সমস্যা হত না। হাত দুটো খুলে দিন। আমি কথা দিচ্ছি পালাব না। পানি খেয়েই আবার না হয় হাতকড়া পরালেন।’
‘একদম না।’
রতন আলী একপ্রকার চেচিয়ে উঠলেন। মনে হয় এ কথায় তিনি ভয় পেয়েছেন।
এবার উনি কিছুটা মেজাজ দেখিয়ে বললেন, ‘তাহলে পানি খেতে হবে না।’
বুঝলাম না। হাত কড়া খুলে দিতে বলাতে এমন রেগে গেলেন কেন?
‘আচ্ছা জনাব, পানি খাওয়া বন্ধ। একটা কথা মনে করে আমার খুব ভালো লাগছে। আপনার নামের সাথে থানার নাম। বেশ ভালো। নামের সাথে মিল হলে তারা একে অপরকে মিতা বা মিতি বলে। কিন্তু মানুষের নাম আর থানার নাম এক হলে কি বলে?’
‘এই থানাও আমার মিতা। আপনার কোনো সমস্যা আছে?’
‘কোনো সমস্যা নেই। নামের সাথে মিল থাকায় এই থানার বড় বাবু হওয়া উচিৎ ছিল আপনার। কিন্তু আপনি কিনা একজন কনস্টেবল।’
রতন সাহেবের মনে হয় দয়া হল। উনি নিজে এক গ্লাস পানি নিয়ে হাজির হলেন। বললেন, ‘হা করেন, আমি খাইয়ে দিচ্ছি।’
আমাকে নিজের হাতে পানি খাইয়ে দিলেন।
বাইরে থেকে চেয়ারটা নিয়ে আমার সামনে বসলেন। বললেন, ‘আমি তখন প্রথম চাকুরিতে যোগ দিয়েছি। দু’তিন বছর হবে। একদিন একটা আসামিকে নিয়ে কোর্টে হাজিরা দিতে যাচ্ছিলাম। আমার সাথে আরও দু’জন সিপাহি ছিল। আসামি ছিল আমার হাতে। যেতে যেতে পথের মধ্যে বলল প্রস্রাব করবে। আমি বললাম দঁড়ি ধরে উল্টো দিকে তাকাচ্ছি। আপনি প্রস্রাব করেন। সে বলল, হ্যান্ডকাপ থাকলে কি করে করবো। আপনি আপাততো আমার হ্যান্ডকাপটা আর কোমরের দঁড়িটা খুলে দিন, প্রস্রাব হয়ে গেলে আবার নাহয় দিলেন।
আমি তাকে বিশ্বাস করে সরল মনে সেটাই করলাম, ও যেটা চায়। খুলে দিতেই দে দৌঁড়। তখন আমার চাকুরি নিয়ে টানাটানি। আমি নাকি ইচ্ছে করে তাকে পালাতে সাহায্য করেছি। থানার বড় বাবুকে সাথে নিয়ে দশদিনপর সেই আসামিকে আবার গ্রেফতার করেছিলাম। এরপর থেকে আর কাউকেই বিশ্বাস করতে পারি না। আরে বাপু, আমি তাকে ছেড়ে দিবো কোন দুঃখে? সে হলো আসামি। আমি সরকারের হুকুমের চাকর। তুই অপরাধ করলে শাস্তি পাবি আর নিরপরাধী হলে হাকিম তোকে ছেড়ে দেবে। আমার সাথে তোরতো কোনো শত্রুতা নেই। তুই আামকে এত বড় বিপদে ফেলবি কেন?’
উনার কথা শুনে আমার সাথে থাকা দুজন হাসছে মুখ টিপে টিপে।
‘জনাব, এজন্যইতো আজ কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না। এই দেখুন আপনি আমাকে মুক্ত করে দিলে সত্যি সত্যিই আমি পালাতাম না। কিন্তু আপনার বিশ্বাস নিয়ে আগেই কেউ খেলেছে তাই আমাকে আর বিশ্বাস করতে পারছেন না। এভাবেই সত্যটা আজ মিথ্যায় ঢেকে যাচ্ছে। কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যা, কে সত্য আর কে মিথ্যা সেটা বলা আজ দুরূহ ব্যাপার হয়ে গেছে। এখন দিন বদলেছে। আজ সত্যবাদি শাস্তি পায় আর মিথ্যাবাদি মুক্তি পায়।’
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চলল। বড় বাবু এখনো এলেন না। আমাদের খাবার দেওয়া হয়নি। খিদেয় পেট চু চু করছে। আমার সাথে থাকা দুজনের অভিভাবক এসেছেন। ওনাদের সাথে এসেছেন আরও কয়েক জন। হয়তো গ্রামের মেম্বার আর নেতাটাইপের কিছু লোক। তরুণদের পোষ মানিয়ে নিজের কাজ হাসিল করে এসব নেতারা। আর এসব নেতাদের পোষ মানায় বড় বড় রাঘব বোয়ালেরা।
অপেক্ষার পালা শেষ হলো। থানার বড় বাবু আসলেন। এস আই জায়েদ আসলেন। থানার বারান্দায় দাঁড় করানো হল আমাদের।
বড় বাবু সামনে এলেন। প্রথমজনকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কিরে, ব্যবসা করিস? কত দিন ধরে চলছে?’
প্রথম জন উত্তর দিলো, ‘স্যার, ব্যবসা করবো কেনো? আমরা ওসব খায় না। ঐ লোকটাকেও আমরা চিনি না। হঠাৎ আমাদের সামনে বোতল ফেলে দিয়ে পালাল।’
বড় বাবু কষে দিলেন একটা চড় বসিয়ে। চড় খেয়ে বেচারার কথা বন্ধ। ভয়ে আছি। কি জানি আমার গালেও পড়ে কিনা।
দ্বিতীয় জনকে বলল, ‘তুই বল, কে বোতল চালাচালি করে?’
আগের জনের চড় খাওয়া দেখে এ বেচারার মুখ বন্ধ। কোনো কথা বলছে না। বড় বাবু এস আই জায়েদকে বললেন, ‘ওরা নিজের ইচ্ছেতে কিছু বলবে না। সাইজ করা লাগবে। সবার পকেট দেখো।’
এস আই সাহেব সবার পকেট চেক করতে লাগলেন। প্রথম জনের কাছে কিছুই পেল না। দ্বিতীয় জনের কাছেও কিছু পেল না। তৃতীয় জনের কাছেই বিপদ লুকিয়ে ছিল। পেল একটা গাজার গুটি। বড় বাবুর হাতে ছিল রুল। সটা সট দিল কয়েক বাড়ি। বিরক্ত হয়ে বার কয়েক চেঁচিয়ে উঠলেন। বললেন, ‘সব কটাকে চালন দিয়ে দাও।’
বড় বাবু অফিস কক্ষে ঢুকলেন। রতন আলী আমাদের পাহারা দিতে লাগলেন। এস আই জায়েদ গোল ঘরের দিকে গেলেন গ্রাম থেকে যারা এসেছেন তাদের সাথে কথা বলতে। দুর থেকে দেখা যাচ্ছে সব। কিন্তু কোনো কথা শোনা যাচ্ছে না। এস আই গ্রাম থেকে আসা লোকগুলোর সাথে কিছুক্ষণ আলাপ করে ফিরে এলেন অফিস কক্ষে। বড় বাবুর সাথে কি যেনো আলাপ করে আবার চলে গেলেন ওদের কাছে।
আমরা যে যার মত বাঁধা অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকলাম। যার পকেটে গাজা পাওয়া গেছে তাকে অন্যজন গালাগালি করতে লাগলÑ‘শালা তোর কাছে মাল ছিল সেটা আগেই ফেলে দিতি। পকেটে রাখলি কেন?’
‘আমি জানিই না আমার কাছে মাল আছে। কিভাবে পকেটে যে এল সেটা সত্যিই জানি না।’
ওদেরকে বললাম, ভাইজানেরা, আপনাদের লোকজন এসেছ। আমার কেউ আসেনি, আসবেও না। অনুগ্রহ করে আমাকে জড়াবেন না।’
আমার কথা শুনে ওরা দুজনেই মৃদু হাসল। এই বিপদের সময় হাসির কি হল? আজব তো! আমি মরি জালার জালায় শেয়াল এসে দাঁত ক্যালায়।
এস আই জায়েদ দুজন লোক সাথে নিয়ে অফিস কক্ষে ঢুকলেন। মনে হয় গ্রামের মেম্বার হবে। কিছুক্ষণ হ্যাঁ-না, শব্দের আওয়াজ ভেসে এল। এভাবে চলল বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা। কোনো সমাধান এল না। রতন আলি বিদেয় হয়েছে। অন্য একজন কনস্টেবল এলেন আমাদের পাহারা দিতে। অনেক প্যাঁচালের পর আমাদের রেজাল্ট এল। রাত আনুমানিক দশ এগারোটা হবে। তাও ভালো যে একটা দফারফা হয়েছে।
আমার সাথে দুজনকে ছেড়ে দিলেন। আমার কপালে শনি। বড় বাবু বললেন, ‘তোর বাসার কেউ আসেনি। তাই তোকে ছাড়তে পারছি না। কাল সকালে চালান দেব।’
‘জনাব, সত্যি বলছি, ওদের কাউকেউ আমি চিনি না। না ঐ বোতল দেওয়া লোকটাকে, না চিনি ওদের তিনজনকে।’
বড় বাবু বললেন, তাহলে ওদের সাথে কেন?
‘আমি আগেই বলেছি, পার্কে ঘুরতে এসেছিলাম। আমি কখনোই ওসব খাই না। এই প্রথম এমন বোতল দেখলাম। আগে কখনো দেখিনি।’
বড় বাবু বললেন, ওদের তিনজনের সাথে যদি তোর পরিচয়-ই না থাকে, তাহলেতো তুই ঐবোতল দেওয়া লোকটার সাথে ব্যবসা করিস।’
‘না। একদম না। তাকে আমি চিনিই না।’
‘প্রথম প্রথম সবাই এভাবেই বলে। পরে থ্যারাপি দিলে গটগট করে সব বলে দিবে।’
রাত বার’টা বাজতে চলল। বড় বাবু বললেন, ‘হাজতে ঢুকাও। ওর ব্যবস্থা কাল হবে।’
আমাকে হাজত খানায় ঢুকানো হল। ভেবে ছিলাম এবার একটু হাত পা টান করা যাবে। কিন্তু সে আশায় বালি। ইতিপূর্বে আমার জন্য অপেক্ষা করছিল আরেক জন হাজতবাসি। লোকটা এক কোনায় বসে কোকাচ্ছে। হাত পা চোখ মুখ সবইত ঠিক আছে। তবে লোকটা কোকাচ্ছে কেন? ভালো করে খেয়াল করে দেখলাম। মুখ থেকে লালা পড়ছে না। সাধারনত মানুষ অসুস্থ হলে মুখে লালা পড়ে। দুঃখ পেলে যেমন চোখে জল আসতে দেরি হয় না, ঠিক তেমনি মানুষ অসুস্থ হলে মুখে লালা চলে আসে। কলসা বেয়ে বের হয়। যদিও বিচ্ছি, তবুও এটাই নিয়ম। মানুষটার কাছে গিয়ে বসলাম। না, কোনো কথা এল না তার কাছ থেকে। পাশে বসে পড়লাম।
‘কোন অপধারে?’
লোকটার ঐ কোকানো ছাড়া অন্য কোনো সাড়া শব্দ পেলাম না। আরও নিকটে গিয়ে বললাম, ‘আরে আমাকে বলতে লজ্জা কিসের? এখন আমি আর আপনি দুজনেই সমান। এটা হাজতখানা। দুজনেই এখন আসামি। আচ্ছা, আমরা দুজনেই যখন আসামি তখন তুমি বা তুই বলা যেতে পারে, তাই না?’
লোকটা এবার আমার দিকে তাকালো। কোনো কথা বলল না। চোখে কেমন জানি একটা আক্রশ।
‘আচ্ছা মামলার কথা যাক। এখন বলেন ডিম কয়টা দিয়েছিল? আহা, সমস্যা নেই। আমরা আমরাতো। কয়টা ডিম?’
লোকটা মনেহয় হাঁপের রুগি। মানে এজমা আছে। বুকের ভিতর থেকে ঘড়ঘড় আওয়াজ বের হয়ে আসছে।
আমার দিকে ঘাড় ঘুুরিয়ে বলল, ‘খুন করেছি। আমি খুলের আসামি। পলাতক ছিলাম। রিমান্ডে নিয়েছিল। ডিম? এক হালি দিয়েছে। গরম গরম।’
লোকটা আমার দিকে এগিয়ে এসে বলল, ‘বেশি কথা বললে তোকেও খুন করব।’ কথা শেষ করে সামনে দুই হাতে ভর দিয়ে মাথা নিচু করে হাঁপাতে লাগল।
শুনেছি যাদের বেশি সাজা হয়ে যায় তারা জেলখানার ম্যাড নামে পরিচিতি লাভ করে। এই ম্যাড মানে পাগল না। এই ম্যাড মানে জেলখানার বড় ভাই, মাস্তান। অন্যান্য আসামিদের যখন যা হুকুম করবে তা শুনতে বাধ্য হবে। তানাহলে খাবার কম পাবে, শোবার জায়গা পাবে না, আত্মীয় স্বজন দেখতে এলে টাকা চাইবে। এরকম অনেক সমস্যা হবে। এটাতো হাজতখানা। ভয়ের কোনো কারণ নেই।
লোকটা কিছুক্ষণ দম নিয়ে মাথা তুলল। বিচ্ছিরী একটা হাসি দিয়ে বলল, ‘কি, বেলুন ফুস? কথা বন্ধ? তোর জন্য ডিম অপেক্ষা করছে। তৈরি থাক।’
লোকটা মনে করছে তাকে আমি ভয় পেয়েছি। ভয় পেলে আরও পেয়ে বসবে। বিশ্বাস নেই। হাজতেও হাত পা টিপে নিতে হয় কিনা কে জানে।
সকাল হতে না হতেই এস আই জায়েদ নিজে এসে হাজতের তালা খুলে আমাকে বেরিয়ে আসতে বললেন। বললেন, ‘তপু সাহেব বেরিয়ে আসেন।’
বুঝলাম না কি এমন হলো যে এক রাতের ব্যবধানে তুই থেকে আপনি, আসেন, সাহেব। তাও আবার এস আই নিজে এসেছেন। যাই হোক, ছেড়ে যখন দিচ্ছে তখন প্রশ্ন করে লাভ কী। চলে যখন যাচ্ছি লোকটার সাথে বিদায় নেওয়া উচিৎ। লোকটা সারা রাত মোষের মত পড়ে পড়ে ঘুমিয়েছে। মার খাওয়া শরীর। শরীরের ব্যাথায় মাঝে মধ্যে এপাশ ওপাশ করতে গিয়ে উঁ আঁ শব্দ করেছে। আমার সারাতার ঘুম হয়নি। এমন নির্ঘুম রাত অনেক কাটিয়েছি। কিন্তু এটা ছিল নতুন অভিজ্ঞা।
লোকটাকে ঘুম থেকে জাগাতেই বলল, ‘বিরক্ত করছি কেনে?’
‘চলে যাচ্ছি, বিদায় জানাতে হবে না? আচ্ছা এবার ঘুমান। আমি চলে যাচ্ছি ভালো থাকবেন।’
লোকটা চোখ কটমট করে তাকিয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ার ভান করল। হয়তো সে মনে করতে পারে একদিনে সাক্ষাতের আবার আলাপ কিসের। তার সাথে আমার বন্ধুত্ব হয়েছে নাকি।
এস আই জায়েদ হাত বাড়িয়ে দিলেন। মৃদু হেসে বললেন, ‘আপনিতো ভাই জব্বর এখখান লোক। বলবেন না আপনি মেয়র সাহেবের লোক। ছি ছি আপনার সাথে খারাপ ব্যবহার করে ফেলেছি মাফ চাই।’
থানার বাইরে বের হতেই দেখি নীলা দাড়িয়ে। এবার বুঝতে পারলাম বিষয়টা কি। নীলার চাচাত ভাই বাবু, মানে হাত কাটা বাবু। শহরের মাস্তান। রাজনীতির মানুষ। কলেজে পড়ার সময় বিরধী দলের এক নেতার হাত কব্জি থেকে কেটে নিয়ে ছিল। সেই হাত নিয়ে সারা শহর ঘুরে ছিল। এ নিয়ে ছ’মাস জেল খেটেছে। সেই থেকে নামের সাথে যুক্ত হয়েছে হাত কাটা বাবু মাস্তান। বাবু ভাই তাহলে মেয়রকে দিয়ে ফোন করেছে। আর বাবু ভাইকে বলেছে নীলা।
নীলা রেগে আছে। এই রাগকে আমি বেশ প্রধান্য দিই। প্রত্যেকটা মানুষের এমন প্রকৃতিগত রাগ থাকা ভালো। এটাকে বলে ভালোবাসার প্রকাশ। আমার অবশ্য এই রাগ নেই। রাগ করতে পানি না।
‘কেমন আছো নীলা?’
আমার কথার কোনো জবাব দিলো না। একটা অটো রিক্সা ডেকে শুধু এতটুকু বলল, ‘ওঠো।’
(সমাপ্ত)
Post a Comment