অনুবাদ গল্প: বোতল-ভূত
হাওয়াই দ্বীপে কিউ নামে একজন লোক ছিল। কিউ একদিন ভাবল, সারা পৃথিবী সে ঘুরে বেড়াবে। অজানা দেশগুলো ঘুরে দেখার খুব শখ তার। একটা জাহাজে করে আমেরিকার পশ্চিম উপকূলে সানফ্রান্সিসকোতে সে চলে এল। সানফ্রান্সিসকো চমত্কার শহর। ঝা-চকচকে রাস্তাঘাট। ধনী লোকদের বসবাস সেখানে। কিউ মুগ্ধ হয়ে শহরটা ঘুরে ঘুরে দেখল। যা দেখে তা-ই ভালো লাগে। এত সুন্দর সুন্দর রাজপ্রাসাদের মতো বাড়িঘর চারদিকে। এমন একটা বাড়ি হলে তার খুব ভালো হতো।
শহর দেখতে দেখতে হঠাত্ করে একটা বাড়ির ওপর তার চোখ আটকে গেল। বিশাল বাড়ি। জানালা দিয়ে বাড়ির ভেতরটা দেখা যাচ্ছে। বাড়ির ভেতর একজন লোক অস্থিরভাবে পায়চারি করছে। চেহারাটা বিমর্ষ। মনে হচ্ছে সে কোনো বিপদে পড়েছে। বাড়ির লোক কিউকে দেখে বাড়ির ভেতর আসতে বলল। ভয়ে ভয়ে বাড়ির ভেতর গেল কিউ।
লোকটা তাকে দেখে হাসিমুখে বলল, ‘এটা আমার বাড়ি। খুব সুন্দর, ঠিক না?’
কিউ বলল, ‘এত সুন্দর বাড়ি আমি আগে কখনো দেখিনি। এমন একটা বাড়ি থাকলে আমি সারা দিন খুশিতে ধেই ধেই করে নাচতাম আর হাসতাম। কিন্তু আপনাকে এত বিমর্ষ লাগছে কেন?’
লোকটা বলল, ‘তুমি যদি চাও তাহলে তুমি নিজেও এমন একটা বাড়ির মালিক হতে পারো। তোমার কাছে যদি ৫০ ডলার থাকে, তাহলেই হলো।’
‘এই রকম একটা বাড়ি?’
‘শুধু এই বাড়ি না। আরও অনেক কিছুই তোমার হতে পারে।’ কথা শেষ করে লোকটা ঘরের ভেতর গেল। তারপর একটা কাচের বোতল নিয়ে এল। বোতলটার ভেতর রংধনুর মতো সাত রঙের ধোঁয়া খেলা করছে। দেখে মনে হয় বোতলের ভেতর কিছু একটা নড়ছে।
‘এই বোতলটা দিয়ে তুমি যা ইচ্ছে তা-ই করতে পারবে। শুধু একটা শর্ত। বোতলটা তোমাকে ৫০ ডলারে কিনতে হবে। এটা কোনো সাধারণ বোতল না। এটার ভেতর নরকের অভিশপ্ত শয়তান আছে। তার অনেক ক্ষমতা। বোতলটা কিনে তুমি একে যা বলবে, সে তোমার জন্য তা-ই করে দেবে।’
‘তাহলে আপনি কেন এটা বিক্রি করতে চাচ্ছেন?’ কিউ বলল।
লোকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘এই বোতলের অসুবিধা হলো তোমার মৃত্যুর আগে তোমাকে বোতলটা বিক্রি করে তারপর মরতে হবে। নয়তো সারা জীবন দোজখের আগুনে জ্বলতে হবে। বোতলটা যখন নরক থেকে প্রথম পৃথিবীতে আসে, তখন এর অনেক দাম ছিল। আরেকটা শর্ত হলো, তুমি যেই দামে বোতলটা কিনবে তার চেয়ে কম দামে বিক্রি করতে হবে। বেশি দামে বিক্রি করতে পারবে না।’
কিউ বলল, ‘আপনার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না।’
‘তুমি বোতলটা ৫০ ডলার দিয়ে কিনে নাও। তারপর বোতলটাকে বলো তোমার ৫০ ডলার ফেরত দিতে। যদি ফেরত না আসে তাহলে তোমার ৫০ ডলার আমি ফেরত দিয়ে দেব।’
কিউ মনে মনে ভাবল, দেখা যাক কী হয়। সে ৫০ ডলার দিয়ে বোতলটা কিনল। তারপর বলল, ‘বোতলের ভূত, আমার ৫০ ডলার আমাকে ফেরত দাও।’
বলার সঙ্গে সঙ্গেই সে লক্ষ করল তার প্যান্টের পকেট কেমন ভারী লাগছে। হাত দিয়ে কিউ দেখল সেখানে ৫০ ডলার। সে বেশ অবাক হলো। আবার ভয়ও পেল। তাড়াতাড়ি বোতলটা ফেরত দিয়ে সে বলল, ‘আপনার বোতল আপনি নিয়ে যান। আমার এটার দরকার নেই।’
লোকটা বলল, ‘এখন আমার আর করার কিছু নেই। তুমি এটা কিনেছ এখন এটা তোমার। আর তুমি এই মুহূর্তে আমার বাড়ি থেকে বের হয়ে যাও।’
কিউ বাড়ি থেকে বের হয়ে এল। বোতলটাকে পাশের এক পুকুরে ছুড়ে নিজের জাহাজে ফিরে এল সে। কিন্তু কেবিনে ঢুকে নিজের কাপড়ের বাক্স খুলতেই সেই বোতলটাকে দেখতে পেল। ছিটকে ঘর থেকে বের হয়ে এল কিউ। তার বন্ধু লোপকা দেখে কিউকে জিজ্ঞেস করল, ‘কী হয়েছে কিউ?’
কিউ পুরো ঘটনা খুলে বলল।
লোপকা বলল, ‘ভয়ের কী আছে! তুমি বোতলের ভূতের কাছে তোমার যা ইচ্ছে চাও। যদি সেটা সত্যি হয় তাহলে এরপর এটা আমি তোমার কাছ থেকে কিনে নেব।’
কিউয়ের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন হনুলুলু দ্বীপে সমুদ্রের কাছে তার অনেক বড় একটা বাড়ি হবে। প্রচুর টাকাপয়সা হবে। সারা দিন সে সমুদ্রের পারে শুয়ে থাকবে। সে বোতল-ভূতের কাছে তার মনের ইচ্ছের কথা বলল।
একদিন কিউ আর তার বন্ধু লোপকা হাওয়াই দ্বীপে ফিরে এল। ঠিক তখনই এক লোক এসে কিউকে বলল, ‘তার একমাত্র চাচা মারা গেছে। চাচার সব সম্পত্তি কিউকে দিয়ে গেছে। হনুলুলু দ্বীপে চাচার যে বিশাল রাজপ্রাসাদ ছিল, সেটাও তাকে দিয়ে গেছে।’
ঘটনা শুনে কিউ আর লোপকা দুজনেই খুব অবাক।
লোপকা বলল, ‘এটা কাকতালীয় হতে পারে। তুমি বোতল-ভূতের কাছে আরও কিছু চাও।’
কিউ যা চাইল সবই পেল। লোপকা খুশি হয়ে বলল, ‘এবার তুমি ইচ্ছে করলে ৪৯ ডলারে এটা আমার কাছে বিক্রি করে দিতে পারো। একটা বিশাল জাহাজে করে সিন্দবাদের মতো অভিযানে বেরিয়ে পড়া আমার অনেক দিনের স্বপ্ন।’
কিউ বোতলটা তার বন্ধু কাছে বিক্রি করে দিয়ে বেশ সুখেই হনুলুলু দ্বীপে দিন কাটাতে লাগল। এক বিকেলে সমুদ্রের তীরে একটা মেয়েকে দেখতে পেল সে। মেয়েটিকে সে আগে কখনো দেখেনি। এত সুন্দর মেয়ে। কিউ মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি কি এই শহরে নতুন এসেছেন?’
মেয়েটা বলল, ‘আমার নাম কুকুয়া। কিয়ানু আমার বাবা। এত দিন ওয়াহু শহরে ছিলাম। আজই এখানে এসেছি।’
‘তার আগে বলুন আপনি কি বিবাহিত?’
কুকুয়া হেসে বলল, ‘প্রথমে আপনি বলেন যে আপনি বিয়ে করেছেন কি না?’
‘অবশ্যই না। বিয়ের কথা জীবনেও চিন্তা করিনি। কিন্তু এখন থেকে করছি। আমার মনে হচ্ছে, আপনার মতো একটা মেয়েকে বিয়ে করতে না পারলে আমার সারা জীবন বৃথা যাবে।’
শুনে কুকুয়া আবারও হাসতে থাকল।
কিউ বলল, ‘আপনি রাজি হলে আপনার বাবার কাছে আজ যেতে পারি। আমি কি যাব?’
কুকুয়া মাথা নেড়ে বলল, ‘ঠিক আছে, আসেন।’
কিউ খুশিতে নাচতে নাচতে বাড়ি গেল। বাড়ির চাকরেরা শুনতে পেল, কিউ চিত্কার করে গান গাইছে আর গোসল করছে। এ সময় হঠাত্ লক্ষ করল তার পায়ে কিসের যেন একটা দাগ। ভালোভাবে দেখে ভয়ে তার চোখ-মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। এটা কুষ্ঠ নাকি! তার কুষ্ঠ হয়েছে। এই মরণ রোগ নিয়ে সে কীভাবে কিউকে বিয়ে করবে। ভাগ্যের এই পরিহাসে আহত হয়ে সারা রাত সে ঘুমাতে পারল না। সকালে ঘুম থেকে উঠেই তার মনে হলো বোতল-ভূতই পারে তাকে এই বিপদ থেকে রক্ষা করতে। কিন্তু কোথায় পাবে সে বোতল-ভূত।
কিউ বাড়ি থেকে বেরিয়ে শহরের পর শহরে বোতলটির সন্ধানে ঘুরতে লাগল। হঠাত্ একদিন নতুন ধনী হওয়া এক লোকের কাছে বোতলের সন্ধান পেল সে। কিন্তু বোতলের দাম তখন এক ডলারে নেমে এসেছে। এক ডলারে এই বোতল কেনার পর সে আর বিক্রি করতে পারবে না। মৃত্যুর পর সারা জীবন তাকে নরকে জ্বলতে হবে। কিউ ভাবল কুকুয়াকে বিয়ে করার জন্য সে তাতেও রাজি।
তাই আবারও বোতল কিনল কিউ। এরপর সুস্থ শরীরে সে কুকুয়াকে বিয়ে করল। খুব আনন্দে দিন কাটাতে থাকল তারা। কিন্তু বোতলের কথা মনে হলেই কিউয়ের মন খারাপ হয়ে যেত। একদিন কুকুয়া তাকে বিষয়টা জিজ্ঞেস করল। কিউ সব খুলে বলল।
কুকুয়া বলল, ‘চিন্তার কিছু নেই। আমেরিকাতে যেটা এক ডলার, ফ্রান্সে সেটা পাঁচ সেন্টাইম। আমরা ফ্রান্সে গিয়ে বোতলটা বিক্রি করব।’
ফ্রান্সে তারা বোতলটার বিষয়ে বলে সেটা বিক্রির চেষ্টা করল। কিন্তু কেউই ঝুঁকি নিয়ে বোতল-ভূতকে কিনতে রাজি হলো না। দুশ্চিন্তায় কিউয়ের শরীর আরও খারাপ হতে লাগল। শেষ পর্যন্ত কুকুয়া একটা ফন্দি আঁটল। এক রাতে সে রাস্তার এক বৃদ্ধকে সব ঘটনা খুলে বলল। তারপর তাকে চার সেন্টাইম দিয়ে অনুরোধ করল তার স্বামীর কাছ থেকে বোতলটা কিনতে। এরপর বৃদ্ধের কাছ থেকে আবারও তিন সেন্টাইম দিয়ে বোতলটা কেনার প্রতিশ্রুতি দিল কুকুয়া।
বৃদ্ধ রাজি হলো। বোতল নিয়ে বৃদ্ধ ফিরে আসতেই কুকুয়া বৃদ্ধের কাছ থেকে তিন সেন্টাইম দিয়ে বোতলটা কিনে নিল। লুকিয়ে বোতলটা বাড়িতে নিয়ে গেল সে। বাড়িতে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই তার স্বামী আনন্দে ছুটে এসে তাকে সব খুলে বলল। কিউ আগের মতো হাসিখুশি হয়ে চলতে লাগল। কিন্তু দিনকে দিন কুকুয়ার মন খারাপ হতে লাগল।
বিষয়টা কিউয়ের নজর এড়াল না। একদিন সে ঘরের জিনিসপত্র ঘাঁটতে গিয়ে সেই বোতলের দেখা পেল। সে বুঝতে পারল, তাকে বাঁচানোর জন্য তার স্ত্রী বোতলটা আরেকজনের মাধ্যমে নিজেই কিনেছে। তাই সেও স্ত্রীর মতো একটা ফন্দি আটল। এক রাতে রাস্তায় এক মাতালকে পেয়ে তাকে পুরো ঘটনা খুলে বলল। বোতলটা দুই সেন্টাইমে তার স্ত্রীর কাছ থেকে কিনে নিয়ে আসতে বলল।
কিউ বেশ কিছুক্ষণ রাস্তায় অপেক্ষা করছিল। একটু পর দেখল মাতালটা হেলেদুলে বোতল-ভূতটাকে হাতে করে নিয়ে আসছে। কাছে আসার পর কিউ বলল, এবার তুমি এক সেন্টাইমে বোতলটা আমার কাছে বিক্রি করতে পারো।
মাতাল সঙ্গে সঙ্গে চিত্কার করে বলল, ‘আমি তো এমনিতেই নরকে যাব। এই বোতলটা আমার সঙ্গে গেলে আরও ভালো হয়। এত সুন্দর একটা বোতল আমি কিছুতেই কারও কাছে বিক্রি করব না। তুমি যদি আর এক পা আমার সামনে আসো, আমি ঘুষি দিয়ে তোমার নাক ভেঙে দেব।’
কিউ বলল, ‘এই বোতলটা তুমি বিক্রি না করলে সারা জীবন তোমাকে দোজখে জ্বলতে হবে।’
আমি এত কিছু বুঝি না। এত সুন্দর একটা বোতল আমি কিছুতেই বিক্রি করব না।’ মাতাল বলল। তারপর বোতলটি হাতে নিয়ে হেলতে-দুলতে চলে গেল মাতাল লোকটি।
মনের আনন্দে বাড়ি ফিরল কিউ। তারপর হনুলুলু দ্বীপে ফিরে সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে লাগল কিউ আর কুকুয়া।
মূল গল্প: দ্য বোটল ইম্প
লেখা: রবার্ট লুই স্টিভেনসন
রূপান্তর: রাফিক হারিরি
Post a Comment