চিলেকোঠায় কেউ যেয়ো না – অনীশ দাস অপু
বিন্তির চোখের রং ওর গায়ের মতোই—হলুদ। জান্নাতুল ফেরদৌসকে কঠোরভাবে বলা আছে বিন্তি কিংবা সে যেন কখনোই চিলেকোঠার ঘরে না যায়।
জান্নাতুল ফেরদৌস মা–বাবার সঙ্গে এই প্রথম ওদের গ্রামের বাড়িতে এসেছে। ওরা থাকে আমেরিকায়। বোস্টনে জন্ম জান্নাতুল ফেরদৌস ওরফে জিনুর। তবে মা–বাবা ওকে একদম বাঙালি কায়দায় বড় করেছেন। তাই জিনু খুব ভালো বাংলা বলতে পারে এবং মাছ-ভাত তার খুব প্রিয়। বিশেষ করে ইলিশ মাছ। সে খুব সুন্দর করে কাঁটা বেছে ইলিশ মাছ খেতে পারে, যা অনেক বাংলাদেশি ছেলেমেয়েও পারে না!
গ্রামের বিশাল বাড়িটি দেখাশোনা করে ওদের কেয়ারটেকার। সে-ই আসলে বলেছে চিলেকোঠার ঘরে যেন জিনু জীবনেও না যায়।
কেন, প্রশ্ন করেছিল জিনু। জবাবে রহস্যময় ভঙ্গিতে হেসে চুপ করে থেকেছে রহমত উল্লাহ।
জান্নাতুল ফেরদৌসের মা মিসেস আমেনা মোহসিন মেয়েকে বারণ করে দিয়েছেন চিলেকোঠার ঘরে না ঢুকতে। ব্যাখ্যা দিয়েছেন—শতাব্দীপ্রাচীন অন্ধকার ও ঘর চামচিকা আর ধুলো–ময়লায় বোঝাই। ভয় পেতে পারে জিনু। অসুখ বাঁধিয়ে বসাও বিচিত্র নয়।
চিলেকোঠার ঘর দেখার প্রচুর আগ্রহ জান্নাতুল ফেরদৌসের। তবে মা–বাবার খুবই বাধ্য মেয়ে সে। ওরা কিছু নিষেধ করলে সে কাজ জীবনেও করবে না জিনু।
কিন্তু আজ নেহাত ঠেকায় পড়ে চিলেকোঠার ঘরে আসতে হয়েছে জিনুকে। বিন্তির কারণে।
বিন্তি ভীষণ ছটফটে, দুষ্টু। কোথাও একদণ্ড স্থির থাকতে জানে না। ফুড়ুত করে জিনুর কোল থেকে নেমে ছুটেছে চিলেকোঠার ঘরের দিকে। জিনুকেও বাধ্য হয়ে আসতে হয়েছে পেছন পেছন। চিলেকোঠার ঘরের সিড়িতে দাঁড়াল জিনু। ব্যস্ত চোখ খুঁজছে বিন্তিকে। সিঁড়ির মাথায় কতগুলো বাক্সের মধ্যে হলদে লেজটাকে দেখতে পেল সে। ‘বিন্তি, এদিকে আসো।’ নরম গলায় ডাকল জিনু।
চিলেকোঠার ঘরের দরজায় তালা নেই। সামান্য ফাঁক হয়ে আছে কপাট। একটা হলুদ ঝিলিক দেখল জিনু ফাঁকটার আড়ালে, অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল বিন্তি।
‘বিন্তি, চলে আয় বলছি, ’ এবার গলা চড়ল জিনুর। ‘তোর ও ঘরে যাওয়া নিষেধ, জানিস না?’
কোনো সাড়া নেই বিন্তির।
‘এদিকে এসো, রেহনুমা। বিন্তি আমার কাছে।’ মিষ্টি, নরম একটা কণ্ঠ ভেসে এল চিলেকোঠার ঘর থেকে। জমে গেল জিনু। বড় বড় হয়ে গেল চোখ, ঘুরে তাকাল কণ্ঠের উৎসের দিকে।
একটা আরামকেদারা। দেখলেই বোঝা যায় বহু পুরোনো। ওতে বসে মৃদু দুলছেন সাদা শাড়ি পরা এক বৃদ্ধা। তাঁর মাথার চুল ধবধবে সাদা, চেহারা ভারি বিষণ্ন। তার কোলে বিন্তি, লেজ গুটিয়ে বসে আছে। দুজনেই তাকিয়ে আছে জিনুর দিকে।
‘এদিকে এসো, ’ বৃদ্ধা আস্তে আস্তে হাত বোলাচ্ছেন বিন্তির মাথায়। ‘তোমার বিড়াল আমার কাছে। ও আমার বন্ধু হয়ে গেছে, রেহনুমা।’ হাসলেন তিনি। তবে তার চোখ হাসছে না। আধো অন্ধকারে মনে হলো জ্বলছে চোখ জোড়া, চাহনিটাও কেমন কঠিন।
‘আমার নাম রেহনুমা নয়, ’ ঢোঁক গিলল জিনু।
‘জানি, জানি সে কথা, সোনা, ’ দ্রুত বলে উঠলেন তিনি। ‘তবে তোমার চেহারা অবিকল রেহনুমার মতো। তোমার সঙ্গে তার এত মিল যে তোমাকে রেহনুমাই মনে হচ্ছে। তোমাকে রেহনুমা ডাকলে তুমি কি খুব রাগ করবে? তোমাকে তো আমি রেহনুমাই ভাবছি। তোমরা এ বাড়িতে আসার পর থেকে তোমাকে আমি দেখছি। তুমি যখন বাগানে খেলা করো, তখন তোমাকে আমি দেখি। এ জানালা দিয়ে।’ ছোট একটা জানালার দিকে হাত তুলে দেখালেন বৃদ্ধা। এত স্বচ্ছ চামড়া, জিনুর মনে হলো চামড়া ভেদ করে জানালার গরাদগুলোও দেখতে পাচ্ছে সে। ‘আমি কত দিন ধরে অপেক্ষা করে আছি তুমি আসবে। বিশেষ করে আজকের দিনটার জন্য। আজ যে তুমি এগারোতে পা দিয়েছ, সোনা।’ আবার হাসলেন তিনি মিষ্টি করে।
বৃদ্ধা ঠিকই বলেছেন, আজ জান্নাতুল ফেরদৌসের এগারোতম জন্মদিন।
‘কিন্তু ওখানে দাঁড়িয়ে কেন, রেহনুমা, সোনা?’ বললেন তিনি। ‘উঠে এসো। ঘরে এসো। তোমার সঙ্গে কথা বলার জন্য মুখিয়ে আছি আমি।’
চিলেকোঠার ঘরে ঢুকতে ইচ্ছা করছে না জিনুর, ভয় লাগছে। মহিলার আচরণে কেমন অস্বাভাবিক একটা ব্যাপার আছে। জিনু ভাবল, মাকে এ মহিলার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করবে।
‘এসো!’ গোঁ ধরে রইলেন বৃদ্ধা। ‘তোমাকে আমার রেহনুমার ছবি দেখাব। দেখবে রেহনুমার সঙ্গে তোমার কত মিল।’
‘ধন্যবাদ। কিন্তু ছবি দেখতে ইচ্ছা করছে না।’ বলল জিনু।
‘আমি যাই।’ হঠাৎ মনে পড়ল কেন এখানে এসেছে সে। ‘বিন্তি এসো।’ ডাকল বটে, কিন্তু একটুও নড়ল না বিড়ালটা। আগের মতো বৃদ্ধার কোলে মুখ গুঁজে বসে রইল। মহিলা তার পরনের শাড়িতে গুঁজে রাখা ছোট একটা ছবি বের করে হাতছানি দিয়ে ডাকলেন জিনুকে।
‘এসো, রেহনুমা। ছবি দেখো। তারপর বিন্তিকে যেতে দেব।’ এমনভাবে কথাটা বললেন যেন বিন্তির যাওয়া না যাওয়া তার ওপর নির্ভর করছে। বিন্তিকে ধরে রাখার তার কী অধিকার আছে?
না, জান্নাতুল ফেরদৌস ওপরে যাবে না। সে সিঁড়ির চার নম্বর ধাপে উঠল। এখান থেকে গলা বাড়িয়ে ছবিটা দেখা যাবে, তারপর বিন্তিকে নিয়ে নেমে যাবে নিচে। সে আরেক ধাপ সিঁড়ি উঠল।
‘হ্যাঁ, এসো সোনা। এসো।’
ছবি না দেখলে অদ্ভুত মহিলা বিন্তিকে ছাড়বেন না বুঝতে পারল জিনু। সর্বশেষ ধাপে উঠে এল ও। মহিলার দিকে পা বাড়িয়েছে, এমন সময় বয়ে গেল একঝলক ঠান্ডা হাওয়া। ছবিটি মহিলার হাত থেকে যেন পিছলে গেল, পাখা মেলল শূন্যে। তারপর ল্যান্ড করল ধুলোভরা মেঝেতে।
জিনু ঝুঁকল মেঝের ওপর থেকে ছবিটি কুড়িয়ে নিতে, ঠিক তখন চেয়ার থেকে লাফিয়ে নামল বিন্তি, ছুটল সিঁড়ির দিকে।
ছবিটি হাতে নিয়ে সিধে হলো জিনু। তাকাল শতাব্দীপ্রাচীন রকিং চেয়ারটার দিকে। চেয়ার খালি। হঠাৎ করেই যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছেন বৃদ্ধা।
খোলা দরজাটা বন্ধ করে দিল জিনু। অদ্ভুত, ভাবল ও, গোটা ব্যাপারটা আসলে অদ্ভুত একটা কল্পনা ছাড়া কিছু নয়। নিজেকে প্রবোধ দিল ও। চিলেকোঠার ঘর নিয়ে নানা কথা ভেবেছি আমি, তাই কল্পনায় ওই বুড়ি মহিলাকে দেখেছি।
কিন্তু পুরোটাই যদি কল্পনা হয়ে থাকে, তাহলে এ ছবি এল কোত্থেকে!
ছবিটি সাদা–কালো, হলদেটে রং ধরেছে। ছোট একটি মেয়ের ফটোগ্রাফ। অবিকল জান্নাতুল ফেরদৌস ওরফে জিনুর মতো দেখতে।
ছবিটা উল্টে দেখল জিনু, পেছনে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা—রেহনুমা ফেরদৌস, বয়স এগারো।
ছবি নিয়ে নিজের ঘরে ঢুকল জিনু, ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারের ওপর রেখে দিল।
আজ জিনুর জন্মদিন। বাবা অবশ্য কাউকে দাওয়াত দেননি। শুধু বিশাল একটি কেক এনেছেন আর মা তার মেয়ের পছন্দের ইলিশ পোলাও এবং খাসির রেজালা রান্না করেছেন।
খাওয়াদাওয়া শেষে বাবা ড্রয়িংরুমে বসে সিগারেট ফুঁকছেন, রান্নাঘরে মাকে বাসন ধুতে সাহায্য করছে জিনু।
ন্যাকড়া দিয়ে একটা প্লেট মুছতে মুছতে জিজ্ঞেস করল জিনু, ‘রেহনুমা কে, মা?’
মিসেস আমেনা মোহসিন মাংসের বাটি ধুতে ব্যস্ত, মেয়ের প্রশ্ন তেমন খেয়াল করলেন না, হালকা গলায় বললেন, ‘জানি না, মা। কে সে?’
‘আমিও জানি না,’ জবাব দিল জিনু। ‘তবে এ নামে কেউ বোধ হয় ছিল। ওই মেয়েটার একটা ছবি পেয়েছি আমি চিলেকোঠার ঘরে…’
ঝট করে ঘুরলেন মেয়ের দিকে মা। ‘তোমাকে না ওখানে যেতে মানা করেছি?’
‘যেতে চাইনি তো,’ মিনমিন করে বলল জিনু। ‘বিন্তিটা দৌড়ে গেল। আমাকেও তাই…’
‘ঠিক আছে। আর যাবে না। হ্যাঁ, কী বলছিলে যেন?’
‘বলছিলাম রেহনুমা ফেরদৌস, বয়স এগারো। মেয়েটার চেহারা অবিকল আমার মতো। বয়সও মিলে যায়।’
‘রেহনুমা ফেরদৌস?’ মা এক মিনিট কী যেন ভাবলেন, ‘চিলেকোঠার ঘরে? হুম…ওখানে অবশ্য অনেক পুরোনো জিনিসপত্র আছে। তবে কোনো ছবি দেখেছি বলে মনে পড়ছে না।…ফেরদৌস…দাঁড়াও! দাঁড়াও! মনে পড়েছে…ওটা তোমার দাদির দাদির মেয়ের নাম। রেহনুমা ফেরদৌস ছিলেন তোমার প্রপিতামহী, মানে গ্রেট গ্র্যান্ডমাদারের মেয়ে। ছোটবেলায় মারা গেছেন তিনি।’
জিনু আরেকটা প্লেট মুছতে লাগল।
‘কিন্তু…’ বলে চললেন মা, ‘ওনার কোনো ছবি দেখেছি বলে তো মনে পড়ে না। কোথায় পেলে, ট্রাংকে?’
‘মেঝেতে কুড়িয়ে পেয়েছি।’ বলল জিনু।
‘কোথায় ছবিটা?’
‘আমার ঘরে।’
প্লেট মোছা হলে জিনু ছবিটা দেখাল মাকে। মনে মনে আফসোস হচ্ছে, এখন ওই বৃদ্ধার কথাও বলতে হবে। যদিও জিনু মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে স্রেফ কল্পনায় সে বুড়িকে দেখেছে।
‘হ্যাঁ,’ বললেন মা। ‘তোমার দাদির দাদির মেয়েই বটে। ওই সময়ে তোলা ছবি। মেয়েটির মৃত্যুর পর তোমার প্রপিতামহী পাগল হয়ে যান। বছরের পর বছর এ বাড়ির আনাচে–কানাচে ঘুরে বেড়িয়েছেন তিনি আর শুধু রেহনুমা নাম ধরে ডেকেছেন। ’
‘চিলেকোঠায় একটা রকিং চেয়ার দেখলাম, ওটা বোধ হয় গ্রেট গ্র্যান্ডমাদারের, তাই না?’ জিজ্ঞেস করে জিনু।
‘হ্যাঁ। ওটা আমি বিয়ের পর থেকে ওখানে দেখে আসছি।’
‘আমার চেহারা কি রেহনুমার মতো?’
‘অনেকটা তো বটেই।’ জবাব দিলেন মা। চোখে চশমা পরে খুঁটিয়ে দেখলেন ছবিটি। তারপর মেয়েকে ওটা ফেরত দিয়ে বললেন, ‘ভুল বললাম। অনেকটা নয়, পুরোটাই।’ আদর করে মেয়ের রেশম কালো চুল নেড়ে দিলেন। ‘তোমরা দুজনেই খুব সুন্দরী।’
ব্যাপারটির পরিসমাপ্তি ঘটল ওখানেই। ছবির কথা জিনু ভুলে গেল বেমালুম। তবে পরদিন বিকেলে সে নিজের ঘরে ঢুকছে, কে যেন দূর থেকে ডাক দিল। ‘রেহনুমা-আ!’ ঘুরল জিনু, ওর ঘর থেকে চিলেকোঠার ঘরটা পরিষ্কার দেখা যায়। দরজা বন্ধ করে এসেছিল জিনু। কিন্তু এখন ওটা হাট করে খোলা।
বুকের ভেতর যেন হাতুড়ির বাড়ি পড়ল জিনুর। আমি কিছু শুনিনি, নিজেকে প্রবোধ দিল ও। সব আমার কল্পনা। আমি যাব না। আমি আর চিলেকোঠার ঘরে যাব না।
‘রেহনুমা-আ-আ!’ দূরাগত ডাকটি মৃদু, তবে নরম এবং পরিষ্কার।
যাব না আমি, নিজেকে বোঝাল জিনু, ও ঘরে কেউ নেই। কারও অস্তিত্ব নেই। আমি স্রেফ কল্পনায় বুড়িকে দেখেছি। জিনু চলে এল নিজের ঘরে। জানত না এ জন্য ওকে কী দুর্ভোগ পোহাতে হবে।
গভীর ঘুমের স্তর থেকে অস্বস্তি নিয়ে জেগে গেল জান্নাতুল ফেরদৌস, দেখল তার পায়ের কাছে বসা বিন্তি, আঁধারে চোখ জ্বলছে। আর তার পেছনে সাদা শাড়ি পরা চিলেকোঠার সেই বুড়ি। তবে হাসছেন না তিনি, শ্বাপদের মতো জ্বলছে চোখ।
‘তোমাকে আমি ডেকেছিলাম,’ বললেন তিনি কঠিন গলায়। ‘তুমি আসোনি। তুমি ভীষণ বেয়াদব। আমরা সারাটা বিকেল তোমার জন্য অপেক্ষা করেছি। আসোনি কেন?’
মহিলার গলার স্বর ভয় পাইয়ে দিল জিনুকে। গায়ের কাঁথাটা চিবুক পর্যন্ত টেনে নিল। আমতা–আমতা করে বলল, ‘আপনি মানে…’
‘মানে মানে করতে হবে না।’ হিসিয়ে উঠলেন বৃদ্ধা। ‘যখনই ডাকব, চলে আসবে তুমি…’
ভয়ে চোখে জল এসে গেল জিনুর। মাকে ডাকার জন্য হাঁ করল, কিন্তু গলা থেকে আওয়াজই বেরোল না।
হঠাৎ মহিলার চেহারা বদলে গেল, মিষ্টি এবং বিমর্ষ লাগল তাকে। ‘রেহনুমা, আমার সোনা…আমি তোকে ভয় দেখাতে চাইনি রে। তোর অভাব খুব অনুভব করছি আমি। অবশেষে তোর দেখা পেয়েছি। কথা দে, প্রতিদিন তুই আমার কাছে আসবি।’
‘নিজের জায়গায় ফিরে যান।’ ফুঁপিয়ে উঠল জিনু, ‘আপনার ঘরে যান, প্লিজ…’
‘যাব রে, মা। যাচ্ছি তো।’ শিরা ওঠা হাত বাড়িয়ে জিনুর গাল ছুঁলেন তিনি আদর করে। ‘শুধু আমাকে কথা দে, কাল আমার ওখানে আসবি। কথা বলবি এই নিঃসঙ্গ, অসহায় বুড়ির সঙ্গে।’
‘আচ্ছা।’ ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল জিনু।
সঙ্গে সঙ্গে অদৃশ্য হয়ে গেল মহিলা, আর বিন্তি চোখ বুজে পায়ের কাছে ঘুমিয়ে পড়ল।
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে গত রাতের কথা কিছুই মনে থাকল না জিনুর। বাথরুমে ঢুকল মুখ–হাত ধুতে। আয়নায় তাকাল এবং চমকে উঠল।
ডান গালে লালচে তিলের মতো একটা দাগ। আঙুল দিয়ে ওখানে ঘষল জিনু। উঠল না দাগটা। হঠাৎ গত রাতের কথা মনে পড়ে গেল। মহিলা ডান গালে হাত ছুঁইয়েছিল। কিন্তু…কিন্তু ওটা তো স্বপ্ন ছিল, তাই না? আসলে মশা কামড় দিয়েছে, তাই ফরসা গালে লালচে দাগ ফুটে আছে। নিজের ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট হয়ে নাশতার টেবিলে গেল জিনু।
মিসেস আমেনা মোহসিন মেয়ের গাল পরীক্ষা করে বললেন, ‘মশা কামড়েছে। তোমার ঘরে অ্যারোসল স্প্রে করে দিচ্ছি। আর মশা ঢুকতে পারবে না।’
তবে কাল রাতের স্বপ্নটা নিয়ে সারাটা দিন বিব্রত থাকল জিনু। ঘুমাবার সময় যত এগিয়ে এল, অস্বস্তিটা বেড়ে চলল। একবার ভাবল মাকে বলবে ঘটনাটা। উঁহু, মা শুনলে এমন ঠাট্টা শুরু করে দেবেন, রীতিমতো লজ্জায় পড়ে যাবে জিনু। বলবেন হরর গল্প পড়ে হরর স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে সে। থাক, মাকে বলতে হবে না।
ঘুমাবার সময় জীবনে এই প্রথম খাটের তলা, আলমারি ইত্যাদি দেখে নিল জান্নাতুল ফেরদৌস। তারপর দরজায় খিল দিল। টেনেটুনে দেখল ঠিকঠাক বন্ধ হয়েছে কি না।
বিছানায় উঠে পড়ল জিনু, হাত বাড়িয়ে বাতির সুইচ অফ করল। গ্রাম হলেও এদিকে যে কটি বাড়ি পল্লী বিদ্যুতের সুবিধে ভোগ করছে, জিনুদের বাড়ি তাদের একটি।
আজ রাতে আমি ঘুমাব না, মনে মনে বলল জিনু। তাই করল সে। এক ঘণ্টা আঁধারে চোখ মেলে তাকিয়ে রইল।
তারপর ঘুমে চোখ বুজে আসছে, ঠিক তখন ঘটনাটা ঘটল। বাঁ পায়ে কিসের শক্ত গুঁতো খেয়ে লাফিয়ে উঠল জিনু। ধড়মড় করে উঠে বসল।
বিছানার কিনারায় বসে আছেন সেই বৃদ্ধা। হাসছেন। চাঁদের আলোয় ঘরের ভেতরটা বেশ পরিষ্কার। মহিলার চোখ জ্বলছে বিন্তির মতো, শক্ত করে ধরে আছেন জিনুর পায়ের গোড়ালি।
বিন্তি তার পাশেই, ভয়ানক লাগছে ওকে। শরীরটা ফুলে যেন দ্বিগুণ হয়েছে। হাঁ করা মুখ, ধবধবে সাদা দাঁত বের হয়ে আছে।
জিনু শুনল, মহিলা বলছেন ফিসফিস করে…এবার আমার সময়…রেহনুমা…তুমি তোমার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছ…বলেছিলে আসবে…আসোনি…আমাকে তাই আসতে হয়েছে…আমি তোমাকে আজ নিয়ে যাব আমার সঙ্গে…
ধস্তাধস্তি করল জিনু, কিন্তু বুড়ির গায়ে কী শক্তি, অবলীলায় ওকে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন বিছানার প্রান্তে। ‘আমি তোমাকে শিক্ষা দেব…তোমার কত বড় সাহস…কথা দিয়ে কথা রাখো না…’
জিনু গলা ফাটিয়ে চিৎকার দিতে চাইল, কিন্তু গলা দিয়ে গোঙানি ছাড়া কিছুই বেরোল না। প্রাণপণ চেষ্টা করছে বুড়ির বজ্রমুষ্টি থেকে পা ছুটিয়ে নেওয়ার।
‘আমরা এবার চলে যাব…আমরা তিনজন….সারা জীবনের জন্য…আমার রেহনুমা…’
হাত বাড়াল জিনু কিছু একটা আঁকড়ে ধরার জন্য। কিন্তু হাতে কিছুই বাঁধল না, ওকে বুড়ি ধীরে ধীরে টেনে নিয়ে চলেছেন…
এবার তিনি জিনুর চুল ধরলেন মুঠো করে। ব্যথায় গায়ে আগুন ধরে গেল ওর। প্রাণপণ শক্তিতে বুড়ির বুকে দুহাত দিয়ে রাম ধাক্কা মারল জিনু। ফুসফুস থেকে সমস্ত দম বেরিয়ে যাওয়ার মতো হিসহিস শব্দ শুনল ও। বন্ধন মুক্ত হয়ে গেল জিনু।
দ্রুত গড়ান দিয়ে মেঝেতে নামল জিনু, আর তখন বিন্তি ঝাঁপিয়ে পড়ল ওর ওপর, নখ বসে গেল কাঁধে। তীব্র ব্যথাটা যেন ফুসফুসে শক্তি জোগাল জিনুর, মুখ হাঁ করল ও, গলার গভীর থেকে বেরিয়ে এল চিৎকার। বিন্তিকে দুহাতে ধরল ও, ছুড়ে ফেলে দিল মেঝেতে। ওর কবজি চেপে ধরল শুকনা, খটখটে একটা হাত। পাঁই করে ঘুরল জিনু। ভৌতিক বুড়ি, দাঁতহীন মাড়ি বেরিয়ে পড়েছে, ভয়ানক লাগছে দেখতে। ঠিক যেন একটা ডাইনি।
ওদিকে বন্ধ দরজায় ক্রমাগত দমাদম করাঘাত পড়ছে। জিনুর মায়ের উদ্বিগ্ন কণ্ঠ ভেসে এল, ‘কী হয়েছে, জিনু? দরজা বন্ধ করে রেখেছ কেন…জিনু?’
ডাইনি বুড়ির কী শক্তি! জিনুকে হাত মুচড়ে জানালার দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। জিনু আবার চিৎকার দিল। বুড়ির গলা সাপের মতো হিসহিস করে উঠল কানের পাশে, ‘তোকে আসতেই হবে…আজ থেকে তুই আমার রেহনুমা…’
হ্যাঁচকা টানে জিনু ছিটকে পড়ল জানালার ওপর, খট করে খুলে গেল জানালা। টের পেল ওকে জানালা দিয়ে টেনে বের করার চেষ্টা করছে বুড়ি। জানালার ফ্রেম ধরে ফেলল জিনু, প্রাণপণে ঝুলে রইল…
এমন সময় ভেঙে পড়ল বেডরুমের দরজা, জ্বলে উঠল আলো। জানালার ফ্রেম ছেড়ে দিল জিনু, পড়ে গেল মেঝেতে। ওর মা–বাবা ছুটে গেলেন ওর দিকে।
এরপরের ঘটনাগুলো যেন ঘোরের মধ্যে ঘটতে লাগল। কাঁদছে জিনু, ওর মা কাঁধে বিন্তির নখের আঁচড় পরিষ্কার করে দিচ্ছেন, ব্যান্ডেজ করছেন, ফোঁপাতে ফোঁপাতে জিনু বলছে, ‘না, বিন্তিকে মেরো না। ওর কোনো দোষ নেই।’ বিন্তি ভয়ের চোটে আলমারির আড়ালে পালিয়েছে।
অনেক সময় লাগল জিনুর ধাতস্থ হতে। তারপর বলল, ‘সবকিছুর নষ্টের গোড়া চিলেকোঠার রকিং চেয়ারটা…ওটা পুড়িয়ে ফেলো…’ তারপর সে মা–বাবাকে পুরো ঘটনা বলল।
বাবা চিলেকোঠা থেকে আরামকেদারাটা নিয়ে এলেন। কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিলেন। দাউ দাউ জ্বলে উঠল আগুন। সে দৃশ্য জিনু দেখল স্থির চোখে, তার পায়ের নিচে বসে থাকল বিন্তি।
সে-ও দেখল শতাব্দীপ্রাচীন আরামকেদারাটাকে গ্রাস করছে আগুনের লেলিহান শিখা, পুড়ে যাচ্ছে ওটা।
Post a Comment