ছোটন কাকুর প্রজেক্ট – সৈয়দ খালেদ সাইফুল্লাহ
অঙ্ক স্যারের মুখ–চোখ থমথমে। তোতন টের পাচ্ছে, সামনে মহাবিপদ।
হুংকার দিয়ে স্যার জিজ্ঞেস করলেন, অন্তুর টিফিন বক্সে তুই গুবরে পোকা ছেড়ে দিয়েছিস?
এ তো ভালো ঝামেলা হলো! ছোটন কাকুর পোকাটা শখ করে স্কুলে নিয়ে এসেছিল। মজা করার জন্য টিফিনের সময় অন্তুর টিফিন বক্সে রেখেছিল একটু। দেখার সঙ্গে সঙ্গেই আঁ আঁ করে ফিট! তোতন পোকাটা সামলানোরও সময় পেল না। ডাক্তার-টাক্তার ডেকে হুলুস্থুল অবস্থা। আরে গাধা, ক্লাস টেনে পড়িস এখন! সাপ-বিছা দেখতে পেলে একটা কথা, গুবরে পোকা দেখলে কেউ ফিট খায়?
আর কপালটাও খারাপ। টিফিনের পরে ধর্ম ক্লাস হওয়ার কথা। ধর্ম স্যার অ্যাবসেন্ট দেখে আজ এসেছেন অঙ্ক স্যার। এমনিতেই ফিট-টিট হয়ে এক কেলেঙ্কারি অবস্থা, তার ওপর অঙ্ক স্যার এক মহাত্রাসের নাম। স্কুল থেকে বেত উঠে গেছে, কিন্তু অঙ্ক স্যার বিচিত্র সব শাস্তি প্রয়োগ করেন। তাঁর সবচেয়ে প্রিয় শাস্তি হলো জ্যামিতির এক্সট্রার সমাধান করতে দেওয়া। এক-দুই ঘণ্টা সময় লাগলেও ছুটির পর সমাধান করে তারপর বাড়ি যেতে হয়।
কী রে, কথা বলছিস না কেন? স্যারের হুংকারে তোতনের সংবিৎ ফিরল। আড়চোখে অন্তুর দিকে তাকাল। ওর হুঁশ ফিরেছে ফিট হওয়ার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই। বন্ধুদের মধ্যে এক-আধটু দুষ্টুমি হতেই পারে, সেটা ব্যাপার না। কিন্তু স্কুলের ডাক্তার আসার কারণে ব্যাপারটা সিরিয়াস হয়ে গেছে। অন্তুর চোখে একটু দুঃখ দুঃখ ভাব। থাকাটাই স্বাভাবিক। গুবরে পোকা দেখে তার ফিট হয়ে যাওয়ার কারণেই এখন তোতনের এই দুর্দশা।
তোতন আস্তে আস্তে বলল, জি স্যার। তবে ওটা গুবরে পোকা না। ইলেকট্রনিক বাগ।
কী এটা?
ইলেকট্রনিক বাগ।
ইলেকট্রনিক বাগ মানে? সবাইকে ভয় দেখানোর জন্য এই জিনিস পকেটে নিয়ে ঘুরিস?
ভয় দেখানোর জন্য না, স্যার। মাছের কাঁটা বাছার জন্য সঙ্গে রাখি।
অঙ্ক স্যার চোখে–মুখে অবিশ্বাস নিয়ে তোতনের দিকে তাকিয়ে আছেন। ছাত্ররা তাঁকে জমের মতো ভয় পায়—এটাই এত দিন জানতেন। এখন তাহলে ঠাট্টা করাও শুরু করেছে!
ঠান্ডা গলায় তিনি বললেন, গুবরে পোকা তোর মাছ বেছে দেয়?
জি স্যার। গুবরে পোকা না স্যার। এটা একটা ইলেকট্রনিক বাগ।
অঙ্কের শিক্ষক ইদ্রিস সাহেব আরেকটা রাম ধমক দিতে গিয়ে নিজেকে সামলালেন। বয়স বাড়ছে। বেশি উত্তেজিত হয়ে গেলে স্ট্রোক-ফোক হতে পারে। শুধু জিজ্ঞেস করলেন, কীভাবে কাঁটা বাছে দেখা তো?
তোতন শুকনা মুখে বলল, কীভাবে দেখাব, স্যার? ক্লাসের মধ্যে মাছ এনেছিলাম খালি আমি আর অন্তু। আমি তো মাছ খেয়েই ফেলেছি, আর অন্তুর টিফিন বক্সে দিয়েছিলাম যেন ইলিশ মাছের কাঁটা বেছে দেয়। পোকা দেখেই অন্তু টিফিন বক্স উল্টে ফেলে ফিট হয়ে গেল। পরে নাকি হরিপদ দপ্তরির বেড়ালটা এসে মাছটা খেয়ে গেছে।
অঙ্ক স্যার থমথমে মুখে বললেন, তোতন, তোর এই চোখে–মুখে মিথ্যা বলার লক্ষণটা খুব খারাপ। বড় হলে টাউট–বাটপাড় হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। খুব খারাপ লক্ষণ। যা–ই হোক, পোকাটা আমি জব্দ করছি। কালকে তোর গার্জিয়ানকে আসতে বলবি।
তোতন আর্তনাদ করে উঠল, স্যার, এটা সত্যিই মাছ বেছে দেয়। এই বাগ না নিয়ে গেলে ছোটন কাকু আমাকে খুব গালমন্দ করবে! স্যার, প্লিজ, এটা দিয়ে দেন।
খুব দেখি গালমন্দের ভয়। আচ্ছা, আমি নিজে এটা পরীক্ষা করব। সত্যি সত্যিই মাছ বেছে দিলে কালকে তুই এই পোকা ফেরত পাবি। এ বিষয়ে কথা শেষ। সিটে গিয়ে বোস। সবাই জ্যামিতি বই খোল। তিন নম্বর অনুশীলনের পাঁচ নম্বর সমস্যার সমাধান করে দেখা।
তোতন একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে সিটে গিয়ে বসল। আজ ছোটন কাকুকে কী বলে ম্যানেজ করা যাবে, সেটাই হলো চিন্তা।
দুই.
পরের দিন টিফিন টাইমে তোতন দুরুদুরু বুকে কমনরুমে ঢুকল। অঙ্ক স্যার দেখা করতে বলেছেন। পোকাটা পাওয়া যাবে তো? ওই তো লম্বা টেবিলের একেবারে কোনার চেয়ারে স্যার বসে রয়েছেন।
স্যার!
ওহ তোতন? বস। এই ধর তোর পোকা।
স্যার পোকাটা সামনে রাখলেন। খুশি হয়ে উঠল তোতন। যাক, বাঁচোয়া এখন। গতকাল ছোটন কাকু কী নিয়ে যেন খুব ব্যস্ত ছিল, ঘর থেকেই বেরোয়নি। পোকাটার কথা জিজ্ঞেস করলেই বিপদ হয়ে যেত। আজ আর ভয় নেই।
তোতন?
জি স্যার?
তোর এই পোকা দেখি সত্যি সত্যিই কাজ করে! রাতে বাসায় পুঁটি মাছের টক রান্না হয়েছিল। পোকাটার পেটে সুইচ চেপে ছেড়ে দিতেই কুটকুট করে পাতের সব মাছ বেছে ফেলল!
জি স্যার। আমিও বাসায় আগে এভাবেই খেতাম। মানে যখন ছোটবেলায় মাছ বেছে খেতে পারতাম না।
সকালে আমি পরীক্ষা করার জন্যই বাজার থেকে কাচকি মাছ কিনলাম। ভাতের সঙ্গে একটু কাচকি মাছের চচ্চড়ি খেলাম। তুই কি জানিস তোর এই পোকা কাচকি মাছও বাছতে পারে?
তোতন চুপ করে রইল। কাচকি মাছ তো কাচকি মাছ, স্যার তো জানেন না ছোটন কাকুর আরেকটা ইলেকট্রিক বাগ আছে, যেটা মাথার উকুনও বেছে দেয়!
এই জিনিস তুই কোত্থেকে পেয়েছিস? বাজারে কিনতে পাওয়া যায়?
জানি না, স্যার। মনে হয় পাওয়া যায় না। এগুলো আসলে স্যার আমার জিনিসও না। আমার ছোটন কাকু বানিয়েছে। ছোটন কাকু সায়েন্টিস্ট। ছোটবেলায় মাছ বেছে খেতে পারতাম না দেখে এটা বানিয়ে দিয়েছিল। এখন অবশ্য আর ব্যবহার করতে দেয় না। তাহলে নাকি পরে মাছ বাছতেই ভুলে যাব।
আচ্ছা? তোর ছোটন কাকু সায়েন্টিস্ট? কোথায় থাকেন উনি? বাইরের কোন দেশে?
না না, স্যার, আমাদের বাসাতেই থাকে। ওনার রুমেই ওনার ল্যাব। কাউকে ঢুকতে দেয় না।
আর কিছু বানিয়েছেন উনি? ইলেকট্রিক বাগ ছাড়া?
কত কিছুই তো বানিয়েছে, স্যার। একটা মাইক্রো চিপ আছে কাকুর। ওটা গরুর মাংসের তরকারিতে ছেড়ে দিলে কালাভুনা হয়ে যায়!
গরুর মাংসের তরকারি কালাভুনা হয়ে যায়? সঙ্গে সঙ্গেই?
না, স্যার, পাঁচ মিনিটের মতো সময় লাগে। গরুর মাংসে একটা বারবিকিউ বারবিকিউ সুগন্ধ চলে আসে। ছোটন কাকু আবার বারবিকিউর ফ্লেভার ছাড়া মাংস খেতে পারে না।
উম, খাবার জিনিস বাদ দিয়ে অন্য কিছু উনি করেননি?
কেন করবে না, স্যার? ছোটন কাকুর একটা ব্যাগ আছে। ওটার সুইচ চাপ দিলে আশপাশের ১০ ফিট জায়গায় ঝিরঝিরে বৃষ্টি পড়ে। মাথা বেশি গরম হয়ে গেলে বাসার ছাদে ছোটন কাকু এভাবে বৃষ্টিতে ভেজে।
বলিস কী? কীভাবে কাজ করে এই জিনিস?
বাবা জিজ্ঞেস করেছিল একদিন। কীভাবে যেন বায়ুচাপ কমিয়ে ফেলে ওই জায়গার। আমি ভালো করে বলতে পারব না, স্যার।
উমম।
আরেকটা জিনিস আছে, স্যার। কিন্তু আমাদের কখনো ধরতে দেয় না ওটা। কী একটা জুতার বাক্সের মতন।
জুতার বাক্স?
ওটার ভেতর থেকে কথা ভেসে আসে। ছোটন কাকু সারা দিন দেখি এর সঙ্গেই ফিসফিস করে কথা বলে। আমার আম্মার ধারণা, ছোটন কাকুর প্রেম হয়েছে কারও সঙ্গে। সায়েন্টিস্ট মানুষ তো, তাই মোবাইলে প্রেম না করে জুতার বাক্সে প্রেম করে।
আসলে ওটা কী?
জানি না, স্যার। ছোটন কাকুকে জিজ্ঞেস করলে বলে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স।
আই সি! তোর ছোটন কাকু তো জিনিয়াস মানুষ! আমাকে একদিন নিয়ে যাবি ওনার কাছে? দেখা করতাম।
সত্যি যাবেন, স্যার? অবশ্যই নিয়ে যাব।
একটা সমস্যা নিয়ে ইদানীং খুবই চিন্তা হচ্ছে। আমার ধারণা, তোর ছোটন কাকুই এর সমাধান করার উপযুক্ত লোক!
তিন.
বাসায় ঢুকেই তোতন বুঝল আজ একটা উত্সব উত্সব ভাব। এই সবের একটা গন্ধ পাওয়া যায় এমনিতেই। ঢুকতেই ড্রয়িং রুমে পড়ে গেল বড় চাচার সামনে। বড় চাচা পত্রিকা পড়ছিলেন। সব সময়ই পড়েন। একটা পত্রিকায় সারা দিন পড়ার মতো কী থাকে, তোতন জানে না।
এই যে তোতন সোনা, স্কুল কেমন হলো?
ভালো।
তোর টেস্ট পরীক্ষা যেন কবে?
খুব বেশি দিন আর নেই, বড় চাচা।
প্রিপারেশন কেমন?
এই রে! প্রিপারেশনের কথা আসা মানেই বড় চাচা এখন বাংলা ব্যাকরণের ঝাঁপি খুলে বসবেন। ওনার ব্যাকরণের প্রশ্ন ধরার একটা বাতিক আছে।
চুপ করে আছিস কেন? দেখি ষষ্ঠী তত্পুরুষ সমাসের একটা উদাহরণ বল তো?
ষষ্ঠী তত্পুরুষ সমাসের উদাহরণ তোতন জানে। রাজার পুত্র না হয়ে রাজপুত্র কিংবা খেয়ার ঘাট না হয়ে খেয়াঘাট। কিন্তু বলে লাভ নেই। এরপর বড় চাচা হয়তো দ্বিগু সমাসে চলে যাবেন। না হলে কারকে। না পারা পর্যন্ত নিস্তার নেই।
তোতন মাথা চুলকে বলল, মনে পড়ছে না তো, বড় চাচা!
তা মনে পড়বে কীভাবে? সারা দিন তো আছ ওই ছোটন কাকুর পিছিপিছি। ওর মতো হয়ে কোনো লাভ নেই। চান্স পেল অ্যাপ্লাইড ফিজিকসে, আর ভর্তি হলো কিনা পিওর ফিজিকসে। আরে, অ্যাপ্লাইড ফিজিকসের কত্ত প্রসপেক্ট, কত্ত সুযোগ! তা এখন পাস করে ঘরে বসে উনি সায়েন্টিস্ট হয়েছেন! বললাম কত করে বিসিএসটা দে, তা–ও দেবেন না উনি!
অ্যাপ্লাইড ফিজিকস আর পিওর ফিজিকসের পার্থক্য এখনো ভালো করে জানে না তোতন। বড় চাচার কথায় কী উত্তর দেবে, ভেবে পাচ্ছিল না। মা এসে বাঁচিয়ে দিল—এই যে তোতন, জানিস আজ কী হয়েছে? তোর অর্পা আপু সরকারি একটা নাচের প্রোগ্রামে ডাক পেয়েছে। কোরিয়া যাবে ওরা। যা, আগে অর্পাকে কংগ্র্যাচুলেট করে আয়।
আরে বাহ্! অর্পা আপুটা দেখিয়ে দিল তাহলে! বড় চাচা কিছুতেই মেয়েকে নাচ শিখতে দেবেন না। তাতে নাকি সময় নষ্ট! পড়ালেখা নষ্ট! তাহলে এ জন্যই আজ ঘরে উত্সব উত্সব ভাব। অর্পা আপুর ঘরে ঢোকার আগে রান্নাঘরে একটা ঢুঁ দিল। বড় চাচি মাত্র মনে হয় সরষে ইলিশটা চুলো থেকে নামিয়েছেন, ইলিশের ঘ্রাণে পুরো রান্নাঘর ম-ম করছে। দেখামাত্রই বড় চাচি বললেন, এই যে তোতন সোনা, তোর জন্য ইলিশের ডিমভাজা আলাদা করে রাখা আছে। গরম–গরম খেয়ে নে।
ডিম হাতে নিয়েই অর্পা আপুর ঘরে গেল। অর্পা খুব আগ্রহ নিয়ে তেঁতুল খাচ্ছিল। তোতনের হাতে ইলিশের ডিম দেখে তাচ্ছিল্যের সুরে বলল, মাছের ডিম? ছি! এটা একটা খাবার হলো?
তোতন পাল্টা জবাব দিল, নাহ্, পৃথিবীর সবচেয়ে মজার খাবার হলো লবণ দেওয়া পাকা তেঁতুল, বলেই হেসে ফেলল। অর্পাও পাল্টা হাসল।
আপু, কবে যাচ্ছিস রে?
এই তো সামনের মাসে। পনেরো দিনের ট্যুর। ভালো কথা, তার পরের মাসেই তোদের টেস্ট পরীক্ষা না?
হ্যাঁ।
ভালোই হলো। তোর পড়াশোনায় কোনো ডিস্টার্ব হবে না, আমি না থাকলে।
ধ্যাৎ, তুই কি বাচ্চা নাকি যে ডিস্টার্ব করবি?
আচ্ছা, তোদের এই সময়ে তো খুব মজা! পরীক্ষার আগেই প্রশ্ন পেয়ে যাবি না সব? এত কষ্ট করে তাহলে পড়ার দরকারটা কী?
এই চিন্তা আসলে তোতনের মাথায়ও এসেছে। প্রস্তুতি এখন পর্যন্ত একেবারে খারাপ না। তারপরও প্রশ্ন-টশ্ন হাতে পেয়ে গেলে খামোখা গাধার খাটনি খেটে কী লাভ? মুখে অবশ্য অর্পাকে বলল এসব প্রশ্ন-টশ্নের কথা তোতন মাথাতেও আনতে চায় না।
সন্ধ্যাবেলায় অঙ্ক স্যারের দেওয়া জ্যামিতির দুটো এক্সট্রার সমাধান করতে গিয়ে তোতনের আবার মনে পড়ল অর্পা আপুর সঙ্গে বলা কথাগুলো। অঙ্ক স্যার যে জটিল প্যাঁচের এক্সট্রা দিয়েছেন, প্রশ্ন পেয়ে গেলে খামোখা এই সমস্যা নিয়ে চিন্তা করে লাভ কী?
ভাবনাগুলো আপাতত মাথা থেকে সরিয়ে তোতন জ্যামিতিতে মন দিল। ইশ্, এসব বিপ্রতীপ কোণ, একান্তর কোণ কে আবিষ্কার করেছে? কী সব বিচ্ছিরি জিনিস!
কিছুক্ষণ চেষ্টার পরই তোতন হাল ছেড়ে দিল। এই জিনিসের সমাধান তার দ্বারা সম্ভব নয়। এর সমাধান অঙ্ক স্যারের পক্ষেই সম্ভব। আরেকজনের পক্ষেও সম্ভব, তার রুমে ঢোকা আপাতত নিষিদ্ধ। কী একটা জরুরি এক্সপেরিমেন্ট চালাচ্ছে ছোটন কাকু, ডিস্টার্ব করা একদম মানা।
দুরুদুরু বুকে ছোটন কাকুর দরজায় টোকা দিল তোতন। কিছু করার নেই, সমাধান করে না নিয়ে গেলে দেখা যাবে অঙ্ক স্যার আরও দুটো সমাধান করতে দিয়ে বসেছেন। তখন ছুটির পরে দুই ঘণ্টা বসে বসে সমাধান খোঁজো। এর চেয়ে ছোটন কাকুর বকুনি শোনা ভালো।
অল্প একটু ফাঁক হলো দরজাটা। ছোটন কাকুর রাগ রাগ মুখ দেখা গেল। টেবিলের ওপর একটা বিকারে সবুজ রঙের একটা তরল হিসহিস শব্দ করে ফুটছে। জুতার বাক্স থেকে মেয়েলি গলা ভেসে এল—ছোটন, বিকারে একটু পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট ঢালো।
তোতন ফিসফিস করে বলল, ছোটন কাকু, কে কথা বলে?
ছোটন কাকু বিরক্ত মুখে বলল, ওটা ট্যারান্টুনা।
ট্যারান্টুনা?
হ্যাঁ, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স আরকি।
আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স কী জিনিস, ছোটন কাকু?
ছোটন কাকু মহা বিরক্ত হয়ে বলল, কাজের সময় এত প্রশ্ন করিস কেন? কী জন্য এসেছিস বল।
আমার জ্যামিতির কিছু এক্সট্রার সমাধান করে দাও না? কালকে অঙ্ক স্যারকে করে দেখাতে হবে।
এক্সট্রার সমাধান করার সময় আমার নেই—বলেই দড়াম করে বন্ধ হয়ে গেল দরজা। তোতন হতাশ হয়ে হাঁটা ধরল। বড় চাচা যে ছোটন কাকুকে পাগল-টাগল ডাকেন, এই প্রথম মনে হচ্ছে বড় চাচা ভুল না–ও হতে পারেন।
চার.
অঙ্ক স্যার খুব আগ্রহ নিয়ে তোতনের দিকে তাকিয়ে আছেন। তোতনই বরং উত্তর দিতে গিয়ে অস্বস্তিতে পড়ে গেছে। এসব প্রশ্নের উত্তর সবাই জানে। কিন্তু সবাই এমন একটা ভাব নিয়ে থাকে, যেন এসব বিষয়ে তার কোনো ধারণাই নেই! গলা খাকারি দিয়ে তোতন বলল, ইয়ে স্যার, আমি প্রশ্ন-টশ্ন খুঁজি না, কিন্তু পরীক্ষার আগে প্রশ্ন কোথায় পাওয়া যায়, সেটা আমাকে অনেকে বলেছে।
সেটাই জিজ্ঞেস করছি। পরীক্ষার আগে যে প্রশ্ন পাওয়া যায় বলে শুনেছি, সেটা কোথায় পাওয়া যায়?
এগুলো স্যার ফেসবুকে পাওয়া যায়, ভাইবার গ্রুপে পাওয়া যায়, ইনস্টাগ্রামে প্রশ্নের ছবি পাওয়া যায়। সোশ্যাল মিডিয়াতেই বেশি, স্যার।
অন্য কীভাবে পাওয়া যায়?
অনেকে প্রশ্নের ফটোকপি জোগাড় করে। আরেকটা পদ্ধতিও আছে, স্যার। তবে এটা আগে হতো। পরীক্ষার আগের রাতে একটা রুমে ডেকে নিয়ে সবাইকে প্রশ্ন দেওয়া হয়। প্রশ্ন পাওয়ার পর কেউ আর বের হতে পারবে না। সারা রাত সেই প্রশ্নের সমাধান করে সকালে পরীক্ষা। এখন তো স্যার সবাই ঘরে বসেই প্রশ্ন হাতে পেয়ে যাচ্ছে, এই কষ্ট আর কেউ করে না।
উমম।
স্যার একটা কথা বলি?
কী কথা?
খুক খুক করে কেশে শুরু করল তোতন, আমি বুঝতে পেরেছি স্যার, আপনার প্রশ্ন লাগবে। কাউকে দেবেন মনে হয়। অসুবিধা নেই স্যার, আমি আছি না? কী কী বিষয়ের প্রশ্ন লাগবে, খালি আমাকে বলবেন। পরীক্ষার আগের রাতে পেয়ে যাবেন। কিন্তু আপনাকে পাঠাব কিসে? স্যারের কি ফেসবুক আছে?
বলেই তোতনের মনে হলো, ভুল হয়ে গেছে। শীতের গীত গরমে গাওয়া হয়ে গেছে। স্যারের চাহনি মোটেই সুবিধার লাগছে না।
তোতন?
জি স্যার?
তোদের প্রতি আমরা খুব একটা অবিচার করে ফেলেছি রে। তোদের পড়ালেখাই করিয়েছি শুধু। মোরাল স্ট্যান্ডটা দিতে পারিনি। এই দায়টা আমাদেরই।
তোতন চুপ করে রইল। স্যারের এভাবে মন খারাপ করা দেখে তার নিজেরও খারাপ লাগছে।
যে কাজে তোকে টিফিন টাইমে ডেকেছি, সেটা বলি। তোর ছোটন কাকুর সঙ্গে আজ সন্ধ্যায় আমার দেখা করিয়ে দিতে পারবি?
ছোটন কাকুর সঙ্গে? কাকু নিজের ঘরের দরজা খুললে হয়। তবে খুলবে বলে মনে হয় স্যার, আপনার কথা শুনলে খুলবে।
গুড। তাহলে সন্ধ্যাবেলা আমাকে নিয়ে যাস।
জি স্যার।
আর ইয়ে, ফেসবুকে কীভাবে প্রশ্ন বের করতে হয়, কম্পিউটার ল্যাবে গিয়ে আমাকে একটু দেখাতে পারবি এখন?
পরীক্ষার তো স্যার দেরি আছে। এসব জিনিস ঠিক আগের রাতে ফাঁস হয়। যে বিষয়ের পরীক্ষা থাকবে, সে পরীক্ষার আগের রাতে প্রশ্ন পাওয়া যাবে।
তা হোক, তুই গত বছরের ফাঁস হওয়া প্রশ্নটা দেখা।
তোতনের মেজাজটা খিঁচড়ে গেল। এমনিতেই স্যারের সঙ্গে ১০ মিনিট শেষ হয়ে গেছে, টিফিনের বাকি আছে আর ২০ মিনিট। ইদানীং মাঠের খেলার চেয়ে টিফিন টাইমে ক্লাসের আড্ডাতেই মন টানে বেশি। গেল আজকের আড্ডাটা। কিন্তু স্যারের হলোটা কী? গত বছরের ফাঁস হওয়া প্রশ্ন দিয়ে স্যার করবেনটা কী? টেস্ট পেপার ঘাঁটলেই তো হয়। স্যারের এই গোয়েন্দাগিরির রহস্য কী? তোতন চিন্তিত মুখে কম্পিউটার ল্যাবের দিকে এগোল।
পাঁচ.
এসএসসি পরীক্ষার সময়সূচিতে এবার একটু রদবদল হয়েছে। বাংলা–ইংরেজি দিয়ে পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা, এবার শুরু হচ্ছে গণিত দিয়ে। তোতনদের টেস্ট পরীক্ষার পরপরই অঙ্ক স্যার আর ছোটন কাকু কী যেন নিয়ে খুব মেতেছেন। বড় চাচাও একদিন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কি রে, তোর অঙ্ক স্যার ছোটনের সঙ্গে সারা দিন কী করেন?
তোতন মাথা চুলকে বলল, জানি না তো, বড় চাচা।
মাস দুয়েক আগে আমার কাছে বোর্ড অফিসের কেউ চেনাজানা আছে কি না জিজ্ঞেস করলেন। আমার বন্ধু রহমত তো বোর্ড অফিসেই আছে অনেক দিন। ফোন নম্বর দিলাম। ওরা ফোন করে দেখা করতে গেল। কী করছে জানিস কিছু?
আমাকে তো ছোটন কাকু ঘরেই ঢুকতে দেয় না। কী করছে কীভাবে বলব, বড় চাচা?
পাগলের কারবার। বেশি ঘাঁটানোর দরকার নেই ওদের। তোর পরীক্ষা কালকে থেকে না? প্রিপারেশন কেমন?
মোটামুটি।
দেখি অব্যয়ীভাব সমাস কয় প্রকার বল তো?
বড় চাচা! কালকে আমার অঙ্ক পরীক্ষা।
তাতে কী? অঙ্ক পরীক্ষার আগে অব্যয়ীভাব সমাস কয় প্রকার বলা যায় না? যা আমার চোখের সামনে থেকে! এদের দিয়ে কোনো আশা নেই।
বড় চাচার সামনে থেকে সরে তোতন গিয়ে বসল পড়ার টেবিলে। প্রস্তুতি মোটামুটি খারাপ হয়নি একেবারে। মাসখানেক আগে স্কুলে হেড স্যার একটা নাটুকে কাজ করিয়েছেন। সবাইকে ডেকে নিয়ে শপথ করিয়েছেন পরীক্ষার আগে কেউ প্রশ্ন জোগাড় করবে না। স্কুলের রেজাল্ট তাতে যা হয় হোক। তোতনের মনটাই খারাপ হয়ে গিয়েছিল। প্রশ্ন-টশ্ন একটু-আধটু দেখে প্রিপারেশন নেওয়া যেত, শপথটা নিয়ে নেওয়ায় এখন আর কীভাবে কী!
রাতের বেলা ফোন দিল অন্তু। কী রে, প্রশ্ন পেয়েছিস?
প্রশ্ন? হেড স্যার না ওই দিন ওয়াদা করালেন প্রশ্ন না নিতে?
ওহ, তোতন! তুই না একেবারেই ছেলেমানুষ! যা–ই হোক, প্রশ্ন এবার খুবই কঠিন হয়েছে। প্রিপারেশন নিতে সারা রাত লাগবে। উপপাদ্য আর সম্পাদ্যের এক্সট্রা তোকে মেসেঞ্জারে পাঠিয়েছি। দেখ তো সমাধান করতে পারিস কি না?
মেসেঞ্জার খুলে এক্সট্রাগুলো দেখে তোতনের একটু খটকা লাগল। এই দুটা এক্সট্রা তো অঙ্ক স্যারের প্রিয় সমস্যাগুলোর দুটা! কী হচ্ছে আসলে? এমনি এমনিই কমন পড়ে যাচ্ছে? নাকি স্যারও এই প্রশ্নফাঁসের ব্যবসায় নেমেছেন? সঙ্গে কি ছোটন কাকুকেও জুটিয়ে নিয়েছেন? নাহ্, আর চিন্তা করতে ভালো লাগছে না। পরীক্ষাটা আগে শেষ হোক, তারপর দেখা যাবে।
ছয়.
প্রশ্ন হাতে পাওয়ার পর পরীক্ষার হলে মোটামুটি একটা টর্নেডো বয়ে গেল ছাত্র মহলে। ফাঁস হওয়া প্রশ্ন নাকি কমন পড়ে নাই! অন্তু তো একেবারে খাতার ওপর মাথা দিয়ে হেড ডাউন করে আছে। তোতন ফিসফিস করে ডাকল, এই অন্তু, মাথা তোল। কী হয়েছে? শরীর খারাপ?
অন্তু বলল, কী হলো এইটা? সবগুলা পেইজ, গ্রুপ, ইমো ভাইবার গ্রুপ থেকে একই প্রশ্ন দেওয়া হয়েছে। সারা রাত ভাজা–ভাজা করে ফেলেছি। এখন এগুলো কী দেখি?
পরিদর্শকের দায়িত্বে থাকা শিক্ষক কাছাকাছি আসায় ওরা চুপ করে গেল। স্যার একটু ওদিকে গেলে তোতন আবার ফিসফিস করল, ভালো করে প্রশ্নটা পড়ে দেখ গাধা। খুবই সোজা প্রশ্ন। তুই এমনিতেই সব পারবি। শুরু কর।
পরীক্ষাটা শেষ করার পর খুবই ফুরফুরে লাগল তোতনের। প্রথম পরীক্ষা, তা–ও গণিতের মতো বিষয়। প্রথমটাতেই ভালো করা গেছে মানে বাকিগুলোও ভালো হওয়ার কথা।
সন্ধ্যাবেলায় স্কুলের মাঠে দেখা হয়ে গেল অঙ্ক স্যারের সঙ্গে। দুই দিন পর ইংরেজি পরীক্ষা। কম্প্রিহেনসিভ পার্টের একটা সলিউশন দেওয়ার জন্য ইংরেজির স্যার ডেকেছিলেন। দেখা হওয়ামাত্রই অঙ্কের স্যার ডেকে নিলেন মাঠের কোনায়।
কী রে, প্রশ্ন পেয়েছিলি পরীক্ষার আগে?
না স্যার, তবে টের পেয়েছি আপনার জ্যামিতির এক্সট্রা দুটা এসেছে।
স্যার হাসলেন। আসলে বুদ্ধিটা তোর ছোটন কাকুর, বুঝলি?
ছোটন কাকুর?
উনিই বললেন একটা ডামি প্রশ্ন বানাতে। তোর ছোটন কাকুর একটা বান্ধবী আছে না? আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স?
ট্যারান্টুনা?
হ্যাঁ। খেলটা ওই ট্যারান্টুনা দেখিয়েছে।
তোতন অবাক চোখে তাকিয়ে আছে দেখে স্যার আবার মুখ খুললেন, উনি ট্যারান্টুনাকে কাজে লাগালেন কোন কোন সোশ্যাল সাইট থেকে প্রশ্ন আউট হয়, সেটা বের করতে। মাসখানেক সময় লাগিয়ে ওটাই করা হলো। এর মধ্যে আরেকটা কাজ করতে হলো। উপযুক্ত কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়ে অঙ্ক পরীক্ষাটা সবার আগে আনাতে হলো। বেশ কাঠখড় পোহাতে হয়েছে এটা করতে গিয়ে।
অঙ্ক পরীক্ষাটাই আগে আনতে হলো কেন, স্যার?
কারণ তোর ছোটন কাকুর ট্যারান্টুনা কেবল গণিতের প্রশ্নটাই ধরতে পারছিল। বাংলা সাহিত্য বা ইংরেজি কম্প্রিহেনসিভ বলে তার মাথায় ঢোকে না। আমরা চাইছিলাম যা করার তা প্রথম পরীক্ষাতেই করতে হবে।
যাতে অন্য পরীক্ষায় আর কেউ প্রশ্ন বের করার চিন্তাও না করে?
ঠিক ধরেছিস।
কিন্তু স্যার আপনারা করেছেন কী? সবাই শুধু আপনাদের প্রশ্নই পেল কী করে?
সেটাতেই তো ভেলকি দেখাল ট্যারান্টুনা। পরীক্ষার আগের দিন বিকেলে যে সাইটগুলো প্রশ্ন লিক করে, সবার অ্যাকাউন্ট একযোগে হ্যাক হলো। সবার কাছ থেকে একই সময়ে একই প্রশ্ন বের হলো। প্রশ্ন বের হওয়ার আশায় যারা বসে ছিল, সঙ্গে সঙ্গে সবার কাছে ছড়িয়ে গেল!
তোতনের একটু অভিমান হলো। এত কিছু হয়ে গেল স্যার, আমাকে কিছুই জানালেন না?
ঠান্ডা মাথায় পরীক্ষা দিলি, আর এখন জানলি—এটাই ভালো হলো না? আর খেলা এখনই শেষ না। অনেক বড় জালের সন্ধান পাওয়া গেছে এসব করতে গিয়ে। পুলিশকে খবর দেওয়া হয়েছে, তারাই সামলাবে। তবে ট্যারান্টুনার সাহায্য বলে তাদেরও দরকার।
বলেন কী, স্যার?
এখন যা, শ্যামল বাবু কিসের যেন সমাধান করাবেন। সামনে ইংরেজি পরীক্ষা না? বুঝে নে ভালো করে। আর খবরদার, যা বলেছি, সেটা আর কারও মুখে শুনতে পেলে পরীক্ষার পরেও কিন্তু তোকে এক্সট্রার সমাধান করতে হবে।
স্যার হনহনিয়ে চলে গেলেন। মুখে-চোখে একটা তৃপ্তির আভা।
রাতে ছোটন কাকুর দরজায় ঠকঠকাল তোতন। এত বড় ঘটনা ঘটিয়ে ফেলেছে, সবই তো তোতনের বদৌলতেই। স্যারও তোতনের, কাকুও তোতনেরই। ছোটন কাকুর মুখে আরও ভালো করে শুনতে চাইলে এবার আর কাকু বিরক্ত হতে পারবে না।
আস্তে করে দরজাটা খুলল। ঠান্ডা গলায় ছোটন কাকু জিজ্ঞেস করল, কী চাই?
তোতন আনন্দিত গলায় বলল, তোমরা তো একেবারে খেল দেখিয়ে দিলে, ছোটন কাকু!
ভেতর থেকে ট্যারান্টুনার গলা শোনা গেল, ছোটন, ভার্নিয়ার স্কেল দিয়ে স্ক্রুর রেডিয়াসটা মেপে ফেলো কুইক।
বিরক্ত গলায় ছোটন কাকু বলল, তোতন, আরেকবার যদি দেখি খামাখা আমাকে বিরক্ত করতে, মার খাবি একদম।
খটাশ করে দরজা বন্ধ হয়ে গেল। তোতনের আরেকবার চিন্তাটা মাথায় এল—বড় চাচা যে ছোটন কাকুকে পাগল-টাগল ডাকে, সেটা একেবারে ভুল না–ও হতে পারে।
Post a Comment