হিরের নেকলেস – আহসান হাবীব
‘মামা-ভাগনে যেখানে, বিপদ নাই সেখানে’—এই বাক্যটা অন্তুর ক্ষেত্রে একবারেই যেন উল্টো। তার একটাই মামা—‘ছোট মামা’। একটাই মামা আবার ছোট মামা হয় কীভাবে? একজন ছোট মামা থাকলে নিশ্চয়ই বড় মামা, মেজ, সেজ মামাও থাকা উচিত। কিন্তু অন্তুর একটাই মামা, সেটা আবার ছোট মামা। তার কারণ হচ্ছে ছোট মামা সবার ছোট, তার রয়েছে চারজন বড় বোন, তাই সে সবার ছোট, সেই থেকে ছোট মামা। সে যাই হোক, এই মামার সঙ্গে যতবার অন্তু কোথাও গেছে, ততবারই তার বিপদে পড়তে হয়েছে। যেমন-তেমন বিপদ না, বেশ ভালো রকম বিপদই…যেমন দু-একটা ঘটনার উদাহরণ দিলেই বিষয়টা পরিষ্কার হবে।
এক নম্বর ঘটনা—
একবার মামা অন্তুদের বাসায় এসে বলল, ‘চল অন্তু’।
—কোথায়?
—মাছ ধরতে। দারুণ এক পুকুরের সন্ধান পেয়েছি। ফরমালিন দেওয়া মাছ তো অনেক খেলি, চল আজ তোকে নিয়ে পুকুরের তাজা মাছ ধরব, তারপর নিজে রান্না করে খাওয়াব।
—তুমি আবার রাঁধতে পারো নাকি?
—আপা, তোমার ছেলে কী বলে?
বলে ছোট মামা অন্তুর মায়ের দিকে তাকায়। অন্তুর মা অবশ্য কোনো মন্তব্য করেন না। মাথা ঝাঁকিয়ে হ্যাঁ-না টাইপ একটা ভঙ্গি করে চলে গেলেন রান্নাঘরের দিকে। যাহোক, শেষ পর্যন্ত অন্তুকে যেতে হলো মামার সঙ্গে মৎস্য শিকারে। মামা অবশ্য মৎস্য শিকারে যাওয়ার আগে তাকে মোগলাই খাওয়ালেন। এটাই বাড়তি পাওনা। মামার পরিচিত এক সিএনজিওয়ালা আছে। তাকে নিয়ে চললেন শাহজাহানপুরের কাছাকাছি কোনো একটা অজানা পুকুরের সন্ধানে।
পুকুর একটা পাওয়া গেল বটে, বেশ সুন্দর পরিবেশ, দেয়াল দিয়ে ঘেরা। মামা গম্ভীর হয়ে বড়শি ফেলল। অন্তু একটা কমিকস নিয়ে বসল। মামা মাছ ধরতে থাকুক, এই ফাঁকে ঢাকা কমিকসের নতুন কমিকসটা শেষ করা যাক—ভাবল অন্তু। মিনিট দশেক পর হঠাৎ একটা বাজখাঁই গলা শোনা গেল। দুজনেই চমকে পেছন ফিরে দেখে একটা লম্বা শুঁটকা টাইপ লোক দাঁড়িয়ে। তার হাতে চেইন দিয়ে বাঁধা একটা ভয়ংকরদর্শন এলসিশিয়ান কুকুর। লোকটি নাকে ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে কেমন একটা অদ্ভুত ভঙ্গিতে চেঁচিয়ে উঠল, ‘ওই, তোগো এইখানে মাছ ধরতে পারমিশন দিছে কেঠা, সাইনবোর্ড দেখস না?’ ঠিক তখনই দুজনে অবাক হয়ে দেখে, তাদের পাশের আমগাছটার নিচেই একটা সাইনবোর্ড, তাতে স্পষ্ট করে লেখা—
ব্যক্তিগত পুকুর। এখানে মাছ ধরা, গোসল করা সম্পূর্ণ নিষেধ।
আশ্চর্য, এত বড় সাইনবোর্ড তাদের কারও নজরে পড়ল না ক্যান? মামা তখন আমতা আমতা করে বলল—
—না না, আমরা তো মাছ ধরতে আসিনি।
—তাইলে?
—এ্যাঁ ইয়ে এই যে কেঁচোকে গোসল দিচ্ছি! হে হে তাই না অন্তু…? মামা বড়শি উঁচিয়ে টোপে গাঁথা কেঁচোটা দেখায়।
লোকটা মনে হলো দাঁতে দাঁতে একটা ঘর্ষণ দিল। তারপর ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে একটা হুংকার দিয়ে বলল, ‘তবে রে…কেঁচোকে গোসল দাও?’ বলেই হাতের শিকলটা ছেড়ে দিল আর অন্তু দেখল ভয়ংকরদর্শন অ্যালসেশিয়ান কুকুরটা যেন সিনেমার মতো স্লো মোশনে ছুটে আসছে…‘বাপ রে, অন্তু পুকুরে লাফ দে…’ বলে মামা বড়শি-টড়শি ছুড়ে ফেলে ঝাঁপ দিল পুকুরে। অন্তু অবশ্য লাফ দিল না, সে চট করে তিন মাস পিছিয়ে গেল! তাদের পাড়ায় এক ইরানি তায়কোয়ান্দো এক্সপার্টের কথা মনে পড়ল। যে তাদের পাড়ার বড় ভাইদের ‘সূর্য তরুণ ক্লাবে’ এসে তায়কোয়ান্দোর কিছু টেকনিক শিখিয়েছিল ওদের, মানে যারা আগ্রহী তাদের। কীভাবে এ ধরনের হঠাৎ বিপদগুলোকে মোকাবিলা করতে হবে। অন্তু লম্বা করে শ্বাস নিল। প্রতিপক্ষের শক্তিকেই কাজে লাগিয়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে হবে। অ্যালসেশিয়ান কুকুরটা লাফ দিয়েছে…পেছনে ছুটে আসছে লম্বা শুঁটকা লোকটাও। লোকটার ওজন কত হবে? লোকটার ভারকেন্দ্র নাভিতে লোকটা একটু ঝুঁকে ছুটে আসছে…তার মানে ভারকেন্দ্র সরে গেছে…দ্রুত চিন্তা চলছে অন্তুর মাথায়, যা করার এখনই করতে হবে। হাঁটু ভাঁজ করে নিচু হলো অন্তু… তারপর হঠাৎ উঠে দাঁড়াল দুই হাত উঁচু করে…অসম্ভব ঝুঁকিপূর্ণ একটা কৌশল, অনেক প্র্যাকটিস করেছিল একসময়। কিন্তু অন্তু এখন পারবে তো?
খুব শিগগির অন্তু আবিষ্কার করল, কুকুরটা আর লোকটা পুকুরে হাবুডুবু খাচ্ছে, লোকটা অদ্ভুত দৃষ্টিতে অন্তুকে মাপছে। আর ছোট মামাও তখন মাঝ পুকুরে হাবুডুবু খাচ্ছে। ওখান থেকে চেঁচিয়ে কী বলছে বোঝা যাচ্ছে না।
দ্বিতীয় ঘটনাটা আরও মারাত্মক।
আবার যথারীতি এক শুক্রবারে মামা এসে হাজির।
—অন্তু চল।
—কোথায়?
—ক্রো নেস্ট হান্টিং প্রজেক্টে।
—মামা দেখো, পরশু আমার পরীক্ষা।
—আহা চল না বাবা, বেশিক্ষণ লাগবে না। দুই ঘণ্টার মামলা। তোকে ডাবল ডিমের মোগলাই খাওয়াব। পাশের ঘর থেকে অন্তুর মা এসে ধমক দিলেন, ‘কিরে ছোটন, আবার ওর পিছে লেগেছিস কেন? জানিস না ওর হাফ ইয়ার্লি পরীক্ষা?’ (ছোট মামার ডাক নাম ছোটন)।
—আহা আপা, ঘণ্টাখানেকের জন্য যাবে আমার সঙ্গে, যাব আর আসব। আমি আবার ওকে দিয়ে যাব। পরীক্ষার সময় শুধু পড়লে হয় নাকি? হালকা রিফ্রেশমেন্টের দরকার আছে।
তবে শেষ পর্যন্ত যেতেই হলো অন্তুকে। পথে মামা বিষয়টা ব্রিফ করল। সে নতুন একটা প্রজেক্ট নিয়েছে, সেটা হচ্ছে ‘ক্রো নেস্ট হান্টিং প্রজেক্ট’, বাংলায় বলা যেতে পারে ‘কাকের বাসা পর্যবেক্ষণ প্রকল্প’। মানে একসময় নাকি কাকের বাসায় তল্লাশি করা একটা পেশা ছিল। মানুষ গাছে উঠে কাকের বাসা তল্লাশি করত। কাকের বাসায় দিব্যি ছোটখাটো দামি জিনিসপত্র, কখনো নাকি সোনাদানা পাওয়া যেত।
—তার মানে, তুমি সেই পুরোনো পেশা ফিরিয়ে আনতে চাচ্ছ? ডাবল ডিমের মোগলাই চিবাতে চিবাতে বলে অন্তু।
—ঠিক তা নয়, কিছুটা আবার তা-ও…হ্যাঁ, আমি কাকের বাসা সার্চ করে যদি দামি কিছু পাই, সেটা আমি তার প্রকৃত মালিককে ফিরিয়ে দেব।
—তাতে তোমার লাভ কী?
—এই যে তাকে একটা সার্ভিস দিলাম, তার জন্য একটা সার্ভিস চার্জ নেব। আইডিয়াটা কেমন?
—দারুণ। যদিও ভেতরে ভেতরে প্রচণ্ড হতাশা বোধ করল অন্তু। উফ্…এই ছোট মামাটার যে কবে বাস্তব বুদ্ধি হবে। ‘এই জন্য তোমার এই প্রজেক্টের নাম হচ্ছে ক্রো নেস্ট হান্টিং প্রজেক্ট?’
—ঠিক তাই। আজ এর শুভ উদ্বোধন।
—তা আমাকে ঠিক কী করতে হবে?
—কিছু না। আমি যখন গাছে উঠে ক্রো নেস্ট হান্টিং শুরু করব, তখন তুই নিচে দাঁড়িয়ে ভালো করে দু-একটা ছবি তুলবি। ফেসবুকে ছবি দিয়ে একটা ইভেন্ট খুলতে হবে না!
—বুঝতে পেরেছি। টিস্যু পেপারে হাত মুছতে মুছতে বলে অন্তু।
অবশেষে অনেক খুঁজেপেতে তারা একটা ঝাঁকড়া রেন্ট্রি গাছের নিচে দাঁড়াল। এপাশটায় লোকজন বেশি নেই। মামা তার পরিচিত সিএনজিওয়ালাকে বলল মই, গ্লাভস, হেলমেট এসব নামাতে।
—এসব কেন? অন্তু অবাক হয়ে জানতে চায় হেলমেট আর গ্লাভস দেখে।
—আরে গাধা, কাকের বাসায় অনেক সময় ছোটখাটো সাপ-গুইসাপও থাকে। তাই এই সাবধানতা। আর যদি কাকের দল ঠোকর মারে, তাই হেলমেট।
অবশেষে মই লাগিয়ে গ্লাভস আর হেলমেট পরে মামা তরতর করে গাছে উঠে গেল। নিচ থেকে অন্তু টপাটপ ছবি তুলতে লাগল মামার স্মার্ট ফোনে। সিএনজিওয়ালা মালেক জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা অন্তু মিয়া, তোমার মামায় কী করে?’
—ক্রো নেস্ট হান্টিং প্রজেক্ট। অন্তু গম্ভীর হয়ে বলার চেষ্টা করে।
—হেইডা কী?
—কাকের বাসায় সোনাদানা খোঁজে ছোট মামা। মালেক মিয়া হতভম্ব্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে অন্তুর দিকে। তারপর একটু পরে ফিসফিস করে বলে, ‘তোমার ছোট মামারে জলদি বিয়া দেও, দেখবা পাগলামি ছুইটা যাবে।’ বলে আর দেরি করে না। সিএনজিতে উঠে স্টার্ট দিয়ে সরে পড়ে।
কাকের প্রথম বাসায় দুই টাকা দামের একটি প্লাস্টিকের চিরুনি পাওয়া গেল। এতেই ছোট মামা ভয়ানক উত্তেজিত হয়ে গেল।
—দেখেছিস, তোকে বলেছিলাম না? কিছু না-কিছু পাওয়া যাবেই যাবে।
—এখন কি তুমি এই চিরুনির মালিককে এটা ফিরিয়ে দেবে? তাকে পাবে কোথায়? অন্তুর কথার উত্তর না দিয়ে মামা দ্বিতীয় একটা গাছে তরতর করে উঠে গেল মই বেয়ে। এই গাছে কিছু পাওয়া গেল না। হেলমেটের ওপর দিয়ে কাককুলের দু-চারটা ঠোকর খেল। সেই ছবিও তুলতে হলো অন্তুকে।
তৃতীয় গাছে উঠতে গিয়ে বিপদ হলো। কোত্থেকে এক মুশকো দারোয়ান এসে ক্যাক করে মামার ঘাড় চেপে ধরল। এই গাছটা ছিল একটা বাড়ির কম্পাউন্ডের ভেতরে। অন্তু অবশ্য মামাকে নিষেধ করেছিল এখানে ঢুকতে। মামা তখন বলেছিল, ‘আরে, এটা তো একটা রিসার্চ ওয়ার্ক। বুঝিয়ে বললে সবাই বুঝবে। আমাকে বাধা দেবে কে?’
এই পর্যায়ে অন্তু কোনো রিস্ক নিল না। এক লাফে বাউন্ডারির বাইরে চলে এল। কারণ দারোয়ানের যে দশাসই দুই টনি সাইজ, তাতে করে একে তায়কোয়ান্দো দিয়ে চিতপটাং করা এককথায় অসম্ভব। তা ছাড়া সেই ইরানি তায়কোয়ান্দো এক্সপার্ট তাদের যা বুঝিয়েছিল, সেটা হচ্ছে যেখানে গতির ব্যাপারটা আছে, সেখানে প্রতিপক্ষের শক্তিকে বুমেরাং করে ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব, অন্য ক্ষেত্রে অন্য কৌশল। অবশ্য অন্য কৌশল আর অন্তুদের শেখা হয়নি সেবার।
কিছুক্ষণ বাদে ঘাড় ডলতে ডলতে মামা বেরিয়ে এল। মই, হেলমেট আর গ্লাভস ছাড়াই।
—কী হলো মামা, মই-হেলমেট আনলে না?
—ওই হারামজাদা রেখে দিয়েছে। বলেছে…
—কী বলেছে?
—থাক, তোর শুনে কাজ নেই। শুনলে তোর মন খারাপ হবে। তবে দাঁড়া না, ওই বাছাধনকে আমি এমন শিক্ষা দেব। ওর বাপের নাম মফিজ করে দেব!
এ ঘটনার পর থেকে অন্তু সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, আর নয়, অনেক হয়েছে। ‘মামা-ভাগনে যেখানে, বিপদ নাই সেখানে’—এই বাক্য অন্তু আর ছোট মামার ক্ষেত্রে অচল।
তবে না, খুব শিগগির, মানে ফাইনাল পরীক্ষার পরপরই একদিন ছোট মামার ফোন এল। কারণ ছোট মামার এ বাসায় আসা নিষিদ্ধ। অন্তুর মা ছোট ভাই ছোটনের জন্য এ বাড়িতে মার্শাল ল জারি করেছেন। এর পেছনেও একটা গল্প আছে। সেটা এ রকম। সেবার অন্তুর চিকুনগুনিয়া হলো। মরো মরো অবস্থা অন্তুর। তারপর অন্তু সুস্থ হলে অন্তুর মা ছোট ভাই ছোটনকে ডেকে একটা মুরগি সদগা দিতে বললেন। তার জন্য টাকাও দিলেন। সেবারও ছোট মামা অন্তুকে নিয়ে বের হয়ে সোজা ঢুকে গেল একটা রেস্টুরেন্টে; ঢুকে আস্ত গ্রিল মুরগির সঙ্গে নানরুটি বেশ আয়েশ করে খেল দুজনে। খাওয়া শেষে ফেরার সময় অন্তু বলল—
—ছোট মামা, মুরগি সদগা দেবে না?
—দিলাম তো
—মানে?
—মানে এই যে তুই-আমি মিলে মুরগির গ্রিল খেলাম। তোর মা মুরগি কিনে কোনো এতিমকে দিতে বলেছিল। এতিম মুরগি নিয়ে কী করত? তারাও তো খেত মুরগিটা নাকি? সেটা আমিই খেলাম। আমিও তো এতিম, তোর নানা মারা গেছে দশ বছর আগে… তো আমি এতিম না? এ ঘটনা জানার পর অন্তুর মা ছোট মামার বিরুদ্ধে অন্তুদের বাসায় মার্শাল ল জারি করেছেন। সে কারণে বাসায় না এসে মামার ফোন—
—হ্যালো, অন্তু?
—বলো।
—তোদের পাড়ার তাজমহল রেস্টুরেন্টে চলে আয় জলদি।
—কেন?
—আহ্, যা বলছি শোন। জলদি চলে আয়, আগে মোগলাই খাই তারপর কাজের কথা।
মোগলাই খেতে খেতে ফের সেই আগের আলাপ, ‘ক্রো নেস্ট হান্টিং প্রজেক্ট…।’
—উফ্ মামা, আবার?
—তো, তুই কি ভেবেছিস আমি রণে ভঙ্গ দিয়েছি? নেভার। এখন আরও নতুনভাবে নেমেছি।
—কিন্তু, সেই মই আর হেলমেট?
—ওই সব পুরোনো জিনিসপত্র বাদ, এখন আধুনিক অ্যালুমিনিয়ামের ফোল্ডিং মই, টর্চ লাগানো হেলমেট আর পলিমার গ্লাভস জোগাড় করেছি। নাচতে নেমে খেমটা দিলে চলে?
—খেমটা না মামা, ঘোমটা।
—ওই হলো…অলরেডি দশটা গাছ টার্গেট করেছি। শোন, তুই আমার সঙ্গে আছিস তো? তোর তো পরীক্ষা শেষ, এখন ফ্রি। ভাবিস না, তোকেও আমি একটা সার্ভিস চার্জ দেব। নে, আপাতত দুই শ টাকা রাখ, ইন অ্যাডভান্স। না করতে যাচ্ছিল অন্তু, কিন্তু হাতে নগদ দুই শ টাকা পড়ায় না’টা ডাবল ডিমের মোগলাইয়ের সঙ্গে গিলে ফেলল অন্তু।
খুব শিগগির ছোট মামা লেকের পাশে একটা গাছে উঠে পড়ল। নিচে সেই সিএনজিওয়ালা দাঁত খোঁচাতে খোঁচাতে আগের মতোই ফিসফিস করে বলল, ‘তোমার মামার পাগলামি তো আরও বাড়ছে মনে হয়, কী কও তুমি?’
অন্তু কিছু বলে না।
—তোমারে না কইছিলাম তোমার মামার একটা বিয়ার ব্যবস্থা করো। তোমার মা-খালাদের কও। সেই রকম বউয়ের হাতে পড়লে একদম পিভিসি পাইপের মতো সিদা হয়া যাইব। কী কও তুমি? এই পর্যায়ে ড্রাইভার মালেকের গলা আরও নেমে যায়। বলে, ‘আমার কাছে কইলাম ভালো পাত্রী আছে…বাড়ি বরিশাল…।’
অন্তু এবারও কিছু বলে না। হাসে। ‘শোনো অন্তু মিয়া, আমি বরং ফুটি। এই পাগলের লগে লগে ঘুরলে আমার প্যাডের ভাত চাইল হয়া যাইব…কী কও তুমি?’
—হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন। এবার সায় দেয় অন্তু। তবে অন্তু বুঝল, ‘কী কও তুমি’ হচ্ছে সিএনজিওয়ালার মুদ্রাদোষ। তবে খুব শিগগির মি. কী কও তুমি চলে গেল তার সিএনজি নিয়ে। এদিকে ছোট মামা একটা বাসার দেয়াল টপকে ঢুকেছে আবার অন্তুর নিষেধ সত্ত্বেও। অন্তু বাইরে অপেক্ষা করছে অনেকক্ষণ হয়ে গেল, অথচ মামার কোনো খবর নেই। ঘণ্টা দুয়েক পর দেয়ালের এপাশ থেকে উঁকি দিল অন্তু। দেখে, মইটা গাছের নিচেই আছে। হেলমেটটা পড়ে আছে মাটিতে, কিন্তু মামা নেই। একটু দূরে মামার এক পাটি জুতা পড়ে আছে। ধক করে উঠল অন্তুর বুকটা! মামার কি কোনো বিপদ হলো? আশপাশে কেউ নেই, চারদিকে সন্ধ্যা নেমে আসছে। অন্তুর ভয় ভয় করছে। সে আরেকটু অপেক্ষা করল। অন্ধকার যখন আরেকটু গাঢ় হলো, তখন সে দেয়াল টপকে ভেতরে ঢুকল। চারদিকে গাঢ় অন্ধকার, শুধু একটা ঘরে আলো জ্বলছে। সেদিকে অন্তু এগিয়ে গেল পা টিপে টিপে। জানালার কাছে গিয়ে বুকটা হিম হয়ে গেল ওর। ঘরের ভেতরে একটা চেয়ারে ছোট মামাকে বেঁধে রাখা হয়েছে। তাদের কথাবার্তা দিব্যি শোনা যাচ্ছে বাইরে থেকে। কারণ, পর্দা দেওয়া জানালাটার একটা পার্ট খোলা।
—তোর লগে আর কে কে আছিল?
—কেউ না, আমি একাই।
—ঠিক কইরা ক?
—ঠিক করেই বলছি। ছোট মামা ফোঁপাতে ফোঁপাতে কোনো রকমে বলে। মনে হয় ছোট মামাকে ভালো মারধর করা হয়েছে।
—তর লগে একটা পিচ্চি ত্যাঁদড় আছে। ওইডা কই ক?
এবার অন্তুর মনে পড়ে এই লোকটাকে। এই লোকটাই অ্যালসেশিয়ান কুকুর নিয়ে ওদের ধরতে এসেছিল। তার মানে, এই বাড়িটার সামনেই ওই পুকুরটা? ওরা পেছন দিক দিয়ে ঢুকেছে বলে বুঝতে পারেনি। না, সেটা তো ছিল শাহজাহানপুরের দিকে। তবে কি এটা অন্য একটা বাড়ি? ওই ভয়ংকর কুকুরটা এখানে আছে? একটা ঠান্ডা স্রোত অন্তুর মেরুদণ্ড দিয়ে বয়ে যায় যেন।
ঠিক তখনই তার ঘাড়ের কাছে একটা বিটকেলে গন্ধের গরম শ্বাস অনুভব করে অন্তু। পেছন ফিরে তাকাতেই হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যায়…তার পেছনেই দাঁড়িয়ে আছে সেই ভয়ালদর্শন অ্যালসেশিয়ান কুকুরটা। কুকুরটা কি মনে রেখেছে অন্তুকে? সে যে তায়কোয়ান্দোর কৌশল প্রয়োগ করে কুকুরটাকে ছুড়ে ফেলেছিল পুকুরে। কুকুরেরা নাকি ১০ হাজার রকম গন্ধ মনে রাখতে পারে, ছোট মামাই একদিন বলেছিল। সে কি অন্তুর গন্ধও মনে রেখেছে? এসব ভাবছিল অন্তু সেকেন্ডের ফ্র্যাকশন সময়ে। তখন আবার ঘরের ভেতরের কথাগুলোও দিব্যি কানে আসছিল অন্তুর!
—তুই কী দেখছস, ঠিক করে বল।
—আমি কিছু দেখি নাই, সত্যি বলছি।
—গাছে উঠতেছিলি কেন?
—ওই যে বললাম ক্রো নেস্ট হান্টিং প্রজেক্ট… কাকের বাসা…কথা শেষ করতে পারে না, ছোট মামাকে ঠাস করে একটা চড় বসায় ওই লোকটা। ‘ও মাগো’ বলে কঁকিয়ে ওঠে ছোট মামা। তার পাশে আরও দুজন দাঁড়িয়ে। অন্তুর ভুলও হতে পারে, তিনজনের একজনের হাতে একটা পিস্তল ধরা। ঠিক তখনই ওর ঘাড়ের কাছে প্রচণ্ড যন্ত্রণার সঙ্গে সঙ্গে ধপ করে কিছু হলো বলে মনে হলো অন্তুর। নিশ্চয়ই কুকুরটা ঘাড়ের কাছে কামড়ে ধরেছে! অজ্ঞান হওয়ার আগে অন্তু আবছাভাবে দেখল, কুকুরটার পেছনে আরেকটা লোক দাঁড়ানো। তার হাতে ধরা একটা লাঠির মতো কিছু। লোকটা কি ওই লাঠি দিয়ে ওর ঘাড়ের কাছে বাড়ি দিয়েছে? নাকি অ্যালসেশিয়ান কুকুরটা কামড়ে দিয়েছে? ভাবতে ভাবতে ধুপ করে মাটিতে পড়ে গেল অন্তু। সে জ্ঞান হারাল।
জ্ঞান ফিরল একটা প্রায় অন্ধকার ঘরে। অন্তু দেখে, তার মুখের কাছে আরেকটা মুখ ঝুঁকে আছে। মুখটা চেনা চেনা। লোকটা কিছু একটা বলছে, কিন্তু কোনো শব্দ কানে আসছে না। তখনই লোকটাকে চিনতে পারল অন্তু। আরে, এ তো তার ছোট মামা ছোটন। ছোট মামা তখন দুই হাতে অন্তুকে ধরে ব্যাকুল হয়ে ঝাঁকাচ্ছে। তখনই কান দুটি হঠাৎ অন হয়ে গেল।
—এই অন্তু! অন্তু!!
—উ!
—ঠিক আছিস তো? আমাদের ওরা একটা ঘরে বন্দী করে রেখেছে।
—ওরা কারা?
—জানি না কারা, তবে ভালো লোক না নিশ্চয়ই।
—আমাদের কেন আটকাল?
—সেটাই তো বুঝতে পারছি না।
মোটামুটি সুস্থ হয়ে বসতে অন্তুর ঘণ্টাখানেক লাগল। দুজনেই একটু সুস্থির হয়ে ভাবতে বসল কী করা যায়। স্যাঁতসেঁতে ঘরটার এক কোনায় পনেরো ওয়াটের একটা বাতি জ্বলছে মিটমিট করে।
—আমাদের খুব সম্ভব মাটির নিচে একটা ঘরে আটকে রেখেছে।
—কী করে বুঝলে?
—দেখছিস না, এদিক দিয়ে ওপরে সিঁড়ি উঠে গেছে। অন্তু তাকিয়ে দেখে ঠিক তাই। তখনই তার কানে এল পানির শব্দ, পাশেই ঝিরঝির করে কোথাও পানি পড়ছে বা ওই রকম কিছু। অন্তু হামাগুড়ি দিয়ে ওই ঝিরঝির শব্দের দিকে এগোল; অন্ধকারে পরিষ্কার বোঝা গেল না, তবে একটা টিন দিয়ে কিছু ঢেকে রাখা হয়েছে ওপাশটায়।
—অন্তু, সকালের আগেই যে করেই হোক আমাদের পালাতে হবে এখান থেকে।
—কেন?
—কারণ, ওরা আলোচনা করছিল, সকালে আমাদের ধরে কোথায় যেন পাঠাবে।
—এই দেখো টিনের দরজা, ওপাশে পানির শব্দ পাচ্ছি। এটা মনে হচ্ছে একটা দরজাই হবে। অন্তু উত্তেজিত হয়ে বলে। এগিয়ে আসে ছোট মামা, ‘আরে, তাই তো রে!’ নিশ্চয়ই ওপাশে পানির ড্রেনটেন কিছু আছে। তুই সর, আমি দরজাটা ভেঙে ফেলি।
—পারবে?
—পারতেই হবে—বলে ছোট মামা ছুটে এসে কাঁধ দিয়ে ধাক্কা দিল টিনের দরজাটায়। একবার, দুবার, তিনবার। চতুর্থবারে হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল দরজাটা। ভয় হলো পাছে শব্দ শুনে লোকজন যদি আবার ওপর থেকে ছুটে আসে! তবে সেটা ঘটল না। দরজাটা ভেঙে পড়তেই দেখা গেল একটা ড্রেনের মতো প্যাসেজ, ঝিরঝির করে নোংরা পানি বয়ে চলেছে। একটা বোটকা বিচ্ছিরি গন্ধ নাকে এসে লাগল।
হিরের নেকলেস
অলংকরণ: রাজীব
—অন্তু, মনে হয় এ যাত্রা বেঁচেই গেলাম আমরা। বলে ছোট মামা টিনের ভাঙা দরজাটা টপকে ঝুপ করে ড্রেনে নেমে পড়ল। পা ডুবে গেল হাঁটু পর্যন্ত। ‘নেমে আয় অন্তু।’ চেঁচাল ছোট মামা। তার গলায় বেশ উৎফুল্ল সুর। কিন্তু অন্তুর মনে হলো, এই নোংরা ড্রেন দিয়ে হেঁটে তারা কি সত্যিই মুক্তি পেতে যাচ্ছে? এখন রাত কত? এই নোংরা ড্রেনের পানিতে যদি সাপখোপ থাকে? এই সব ভাবতে ভাবতে কখন যে ঝুপ করে ছোট মামার পেছনে পেছনে নেমে পড়ল অন্তু, নিজেও জানে না।
কতক্ষণ ওই নোংরা পুঁতিগন্ধময় ড্রেন দিয়ে তারা দুজন হেঁটেছে, তার হিসাব নেই। একটা লম্বা টানেল ধরে হাঁটছে তো হাঁটছেই, একসময় অন্য প্রান্তে সূক্ষ্ম আলোর রেখা মিলল বলে মনে হলো। তবে কি মুক্তি এসে গেল ওদের? ভেতরে কেমন দমবন্ধ লাগছে দুজনের। বোটকা বিচ্ছিরি গন্ধটা অবশ্য নাকে সয়ে এসেছে। আর ঠিক তখনই হঠাৎ আলোর ঝলকানি। টানেলের মুখটা একটা জায়গায় এসে যেন হঠাৎ ওপরের দিকে খুলে গেল। টানেলটা এখানে ওপরের দিকে খোলা। আচমকা আলোর ঝলকানিতে তারা দুজন টের পেল, টানেলের বাইরে ভোর হচ্ছে। এত সুন্দর সকাল অন্তু আর তার ছোট মামার জীবনে যেন একটাও আসেনি আগে।
টানেলের খোলা জায়গাটা দিয়ে দুজনের বের হতে অবশ্য বেশ কসরত করতে হলো। বের হয়ে এসে দেখে একটু দূরেই একটা পাবলিক টয়লেট, এত ভোরে কিছু লোক এসে অজু করছে। হয়তো ফজরের নামাজে যাবে। ওরা আর দেরি করল না। ঝট করে দুজনে দুটি খালি রুমে ঢুকে সাওয়ার ছেড়ে কঠিন একটা গোসল দিল। কতক্ষণ ধরে শরীরে পানি ঢেলেছে দুজনের কারোরই কোনো হুঁশ নেই। বাইরে দরজার ধাক্কায় শেষ পর্যন্ত বের হয়ে আসতে হলো। তখনো খুব একটা ভিড় হয়ে ওঠেনি। যে কজন আছে, তারা সন্দেহজনক দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিল ওদের দিকে। সাতসকালে জুতা-মোজা-কাপড় পরে কেউ গোসল করে? বের হয়ে এসে গোসল বাবদ দুজনকে দশ টাকা করে দিতে হলো। তা-ও ভালো, ছোট মামার পকেটে কিছু টাকাপয়সা হয়তো ছিল। টাকা যে নিল, সে ছোটখাটো একটা ইন্টারভিউ নেওয়ার চেষ্টা করল ওদের।
—আপনাগো বাড়ি?
—এখানেই।
—জামাকাপড়ে এত কালিঝুলি লাগল ক্যামনে?
—ওই যে সার্ফ এক্সেল আছে না? বলে মামা লোকটার দিকে একটা হাসি দিল। লোকটা ফানটা বুঝল না; আরও গোটা কয়েক প্রশ্ন করল, ওরা তার উত্তর না দিয়ে হাঁটা দিল। জলদি এই এলাকা থেকে সরে পড়া দরকার।
জায়গাটা কোথায় ঠিক বোঝা যাচ্ছিল না। তারা দুজন হাঁটা শুরু করল ভেজা কাপড়ে। কতক্ষণ হেঁটেছে দুজনের কারও খেয়াল নেই। একসময় মনে হলো শরীরের ভেজা কাপড়গুলো শুকিয়ে উঠছে। শুধু অন্তুর পায়ের কেডস তখনো ভেজা জব জব করছে। তখনই দুজনের নজরে পড়ল একটা রেস্টুরেন্ট। আর সঙ্গে সঙ্গে ক্ষিধায় নাড়ি-ভুঁড়ি ছিঁড়ে আসতে চাইল যেন। তাই তো, গত রাতে তো তাদের কিছুই খাওয়া হয়নি! দুজনেই ঢুকে পরোটা আর ডিম-ভাজির অর্ডার দিল।
সত্যি এত মজার নাশতা যেন জীবনেও খায়নি অন্তু। মামা তো পরোটাই নিল ছয়টা আর ডাবল ডিমের মামলেট তিনটা। খাওয়া শেষে ঢেকুর তুলে মামা অন্তুর কানে কানে ফিসফিস করল—
—অন্তু, তুই দৌড় দিবি ডানে আর আমি বাঁয়ে।
—মানে?
—মানে বুঝলি না? আমার কাছে টাকা নেই, খাওয়ার বিল দিব কোত্থেকে? বিশ টাকা ছিল, ওটা তো গোসলখানায় দিয়ে দিলাম। অন্য পকেটে ১০০০ টাকার একটা নোট ছিল, ওটা ওই বিটলেটা আমাকে চেয়ারে বাঁধার সময় হাতিয়ে নিয়েছে।
শুনে অন্তুর পেটের পরোটা-ডিমভাজি যেন সঙ্গে সঙ্গে হজম হয়ে গেল। মামা আবার ফিসফিস করে বলল, ‘আমি ওয়ান টু থ্রি বললেই দুজনে দৌড় শুরু করব, ঠিক আছে?’ অন্তু দুর্বলভাবে মাথা নাড়ে।
মাইলখানেক দৌড়ে একটা বাজারের মোড়ে ছোট মামাকে পাওয়া গেল। মামা সিগারেট ফুঁকছে।
—সিগারেটের টাকা কোথায় পেলে?
—একটা সিগারেটের টাকা ছিল। বুঝলি অন্তু, বাসায় গিয়ে বলবি রাতে আমার সঙ্গে মেসে ছিলি।
—তুমি মেসে থাকো?
—তো আমাকে বাসা থেকে বের করে দিয়েছে না, তুই জানিস না? তোর মা আর ছোট আপারা মিলে ষড়যন্ত্র করে বের করে দিয়েছে। নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারলে নাকি ঢুকতে দেবে।
—বলো কী!
—কেন, তোর মা তোকে কিছু বলেনি?
—না তো!
দীর্ঘশ্বাস ফেলল ছোট মামা, ‘আমাকে আজকাল কেউ দেখতে পারে না রে!’
—কী করে দেখবে? তুমি যেসব কাণ্ডকারখানা করছ আজকাল!
—সেটাও ঠিক। নাহ্, সব ছেড়েছুড়ে ভাবছি সন্ন্যাসী হয়ে যাব। হিমালয়ের কোনো গুহায় গিয়ে ধ্যান করব। আনলুম বিলুম প্রাণায়াম ধ্যান। প্রথমে বাঁ নাক বন্ধ করে ডান নাকে শ্বাস ছাড়তে হবে, তারপর ডান নাক বন্ধ করে বাঁ নাকে শ্বাস নিতে হবে…
—ওটাই করো। ওটাই মনে হয় তোমার করা বাকি আছে।
—তুই যাবি আমার সঙ্গে?
—না, আর কখনোই তোমার সঙ্গে যাব না। প্রমিজ। শক্ত মুখে বলল অন্তু। মামা কথা বলল না। ফোঁস করে আবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল, ‘নাহ্, সত্যিই তোর আজ অনেক কষ্ট হলো। এমনটা হবে ভাবিনি। তবে দেখিস, ওই বাড়ির লোকগুলোকে আমি জেলের ভাত যদি না খাওয়াই, আমার নাম ছোটন না। ওরা আসলে ঠিক কী করে, সেটাও বের করতে হবে। নির্ঘাত বড় কোনো ক্রাইম হচ্ছে ওখানটায়। আচ্ছা অন্তু, গোয়েন্দা হলে কেমন হয় বল তো? প্রাইভেট গোয়েন্দা। এ লাইনে মানুষজন কম আছে, তুই কী বলিস?
অন্তু কড়া চোখে তাকায় ছোট মামার দিকে।
বাড়ি ফিরতে ফিরতে সকাল দশটা। মা দরজার কাছেই ছিলেন, খপ করে কানে ধরলেন, ‘রাতে কোথায় ছিলি?’
ছোট মামার মেসে। চি-চি করে বলে অন্তু।
আমিও তাই ভেবেছি। দাঁড়াও, ওই ছোটনা ফাজিলটার ব্যবস্থা এবার আমিই করব। এ কী! কাপড়চোপড়ের এই অবস্থা কেন? কালিঝুুলি মাখা! মনে হচ্ছে ড্রেন থেকে উঠে এসেছিস? যা জলদি গোসলে যা বলছি। অন্তু দেরি করে না, একছুটে বাথরুমে ঢুকে পড়ে। এত সহজে ছাড়া পাবে ভাবতেই পারেনি সে।
এর দুই দিন পরই মামার ফোন।
—হ্যালো, অন্তু?
অন্তু সতর্ক হয়ে বলে, ‘বলো’। আবার না মামা কোনো প্রজেক্টে ফাঁসিয়ে দেয়।
—শোন, আমি পুলিশ নিয়ে ওই বাড়িটায় গিয়েছিলাম।
—তারপর?
—গিয়ে দেখি বাড়িতে টু-লেট ঝুলছে। এক দিনের নোটিশে ওরা বাড়ি পাল্টে ফেলেছে। বড় ধরনের কোনো ক্রাইম করত ওরা। পুলিশ কিছু না পেয়ে আমার ওপর হম্বিতম্বি করল। ওরা ভেবেছে আমি মিথ্যা বলেছি। পরে মাটির নিচের ওই ঘরটা খুঁজে পেয়ে ওদের বিশ্বাস হলো। আমি অবশ্য তোর কথা বলিনি। বলেছি, আমি একাই গিয়েছিলাম। সবই খুলে বললাম পুলিশকে।
—তোমার ক্রো নেস্ট হান্টিংয়ের কথাও বলেছ?
—হ্যাঁ, তা-ও বলেছি।
—শুনে পুলিশ কী বলল?
—বলল, আমার নাকি মাথায় গোলমাল আছে। একজন ভালো সাইকিয়াট্রিস্টের ঠিকানা দিল। তবে পুলিশ অফিসারটা ভালো ছিল। বলেছে, তারা ওই বাসায় নাকি ক্রিমিনালদের ধরার একটা ভালো কু্ল পেয়েছে। ওদের নাকি ধরে ফেলবে শিগগির।
—ক্লুটা কী?
—সেটা আমায় বলেনি। ঠিক আছে রাখলাম, ভালো থাকিস।
—তোমার ক্রো নেস্ট হান্টিংয়ের কী হবে?
—ওটা চলবে। ওই যে বিদ্রোহী কবি নজরুলের গান আছে না…যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে…
—ওটা রবিঠাকুরের গান মামা।
—ওই হলো…আচ্ছা রাখি রে। খোদা হাফেজ।
তবে মামা সত্যি সত্যিই এর পরে আর অন্তুকে কখনো ডাকেনি। একা একাই তার ‘ক্রো নেস্ট হান্টিং প্রজেক্ট’ চালিয়ে গেছে। একদিন সত্যি সত্যি কাকের বাসায় একটা অনেক দামি হিরের নেকলেস পায় মামা। সেটার ছবি তুলে ফেসবুকে দেয় তার প্রকৃত মালিকের সন্ধানে। একদিন এক সুন্দরী তরুণী হিরের নেকলেসটা যে তাঁর, সেই প্রমাণ নিয়ে মামার মেসে গিয়ে হাজির হয়। মামা প্রমাণ যাচাই-বাছাই করে তাঁকে তাঁর নেকলেস ফিরিয়ে দেয়। এবং মামা কোনো সার্ভিস চার্জ নেয় না। প্রথম সাকসেসফুল কেস বলে ফ্রি সার্ভিস! পরে মামার কাছে সেই তরুণী নেকলেস উদ্ধারের কাহিনি শুনে পুরোই ‘হতস্তম্ভিতমূঢ়’ (হতভম্ব+স্তম্ভিত+বিমূঢ়)!
তবে আরও মজার ব্যাপার হচ্ছে, সেই কাকের বাসায় পাওয়া মহামূল্যবান হিরের নেকলেসটা কিন্তু মাসখানেক পর ফের মামার কাছেই ফিরে এসেছে! কীভাবে? আর কীভাবে! সেই তরুণী এখন অন্তুর ছোট মামি। মামা তার নিজের বাসাতেই এখন থাকে, বড় বোনরাই ফিরিয়ে এনেছে বিয়ের আগে আগেই। ক্রো নেস্ট প্রজেক্ট না, মামা এখন ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের এক প্রজেক্টে ভালো চাকরি করছে। মামা মামিকে নিয়ে নিজেদের বাড়িতে এখন দিব্যি সুখেই আছে।
সত্যি, পৃথিবীতে কত আশ্চর্যজনক ঘটনাই না ঘটে! মামার হিরের নেকলেস পাওয়ার ঘটনাটাই তার অন্যতম উদাহরণ। মামার বিয়ের দুই সপ্তাহ পরে আরও আশ্চর্যজনক একটা ঘটনা ঘটে। এক শুক্রবার বন্ধের দিনে অন্তু ঘুম থেকে উঠে তাদের বাসার পাশের ছোট্ট বাগানটায় গিয়ে দাঁড়াতেই প্রচণ্ড ভয় পেয়ে যায়। সেই অ্যালসেশিয়ান কুকুরটা! হিজ মাস্টার্স ভয়েজের কুকুরটার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। কুকুরটা অন্তুকে দেখে লেজ নাড়তে নাড়তে উঠে আসে অন্তুর কাছে। যেন অন্তুই তার প্রভু। আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি, সেই থেকে ওই ভয়ংকরদর্শন কুকুরটা অন্তুর সঙ্গেই থাকে। অন্তু তার একটা নামও দিয়েছে—‘বাঘা’। বাঘা বললেই ছুটে আসে অন্তুর কাছে। কে জানে, অন্তুকে কেন এত পছন্দ করল কুকুরটা! এটাও বিরাট রহস্য।
কুকুরের কাহিনি শুনে একদিন অবশ্য অন্তুর মামা হন্তদন্ত হয়ে এসে উত্তেজিতভাবে বলল, ‘বুঝলি অন্তু, তোর বাঘাকে একদিন আমার সঙ্গে দে তো। ওকে নিয়েই আমি ওই ক্রিমিনালদের ধরতে যাব। জানিস তো কুকুরেরা ১০ হাজার রকমের গন্ধ আলাদা করতে পারে।’
—কোথায় পেয়েছ এই তথ্য?
—জানি জানি, আমি জানি। তুই বাঘাকে আমার সঙ্গে দিবি কি না বল?
—প্লিজ মামা, বাঘাকে আর জ্বালিয়ো না। ওকে তুমি কন্ট্রোল করতে পারবে না। তুমি না হানিমুনে যাচ্ছ মামিকে নিয়ে, তাই যাও।
মামা নাকি মামিকে নিয়ে হানিমুনে যাচ্ছে অ্যাথেন্সে। কিন্তু টাকাপয়সা সে রকম জোগাড় না হওয়ায় হানিমুনের সময় শুধু পেছাচ্ছে। মামা অবশ্য হুঁশিয়ারি দিয়েছে, সে একা হলেও হানিমুনে যাবে! কে জানে, এই মামার পক্ষে সবই সম্ভব।
Post a Comment