গোয়েন্দা চৌকস ও পাখি রহস্য
দুর্ধর্ষ ছড়াকার ও নামজাদা গোয়েন্দা চৌকসকে তার শান্তিনগরের বাসায় খুঁজে পেতে খুব তকলিফ হলো। গলি, তস্যগলি ও এক ডজন কানাগলির ভিড়ে এমন একটা বিদঘুটে বাড়িতে আস্তানা গেড়েছে যে সম্ভবত মক্কেলরা ওর বাসা পেতে পেতেই দিন পার করে ফেলে।
দুই ঘণ্টা ঘোরাঘুরি করে শেষমেশ যখন চৌকসের সদরে দাঁড়িয়েছি, তখন দেখি একদল হন্তদন্ত হয়ে ওপর থেকে নামছে। আরও এক পার্টি দরজার বাইরে অপেক্ষা করছে। চৌকসের পসার ভালো জানা ছিল, তবে এতটা যে সেটা আন্দাজ করতে পারিনি।
কাঠের সদর দরজায় বড় বড় করে দুই লাইন ছড়া লেখা:
যদি পড়ো বিপাকে আর ভজকটে সব রহস্যে
ঘাবড়িয়ো না, ভড়কিয়ো না, চলে আসো সহাস্যে!
এ তো দেখি রীতিমতো বিজ্ঞাপন! লোকটার মাথায় কিঞ্চিৎ ব্যারাম আছে বোঝাই যাচ্ছে।
দরজার সামনে একটা কাঠের বেঞ্চি পাতা। সেখানে বসে অপেক্ষা করা শুরু করলাম। দ্বিতীয় পক্ষ মক্কেল বেরোতেই দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলাম আমি। দেখি লম্বা নাকের এক অ্যাসিস্ট্যান্ট একটা ঘোরানো সিঁড়ির নিচে টেবিল পেতে বসে নাম এন্ট্রি করছে। আমাকে দেখে বললেন, ‘রহস্য না বিপাক?’
আমি থতমত খেয়ে বললাম, ‘দুটোই। কোন রহস্যই বা বিপাক নয়?’
তিনি ভ্রু কুঁচকে বললেন, ‘আছে তো! একটু আগে যিনি এসেছিলেন, তাঁর তো ছড়ায় ছন্দ মিলছিল না বলে এসেছিলেন। ওটা আসলে রহস্য না, তবে বিপাক তো বটেই।’
‘বলেন কী! এমন ধারা সমস্যা নিয়েও লোক আসে নাকি?’
‘আলবৎ আসে! সেসব কথা থাক। এখন আপনার সমস্যা বলুন।’
‘আপনাকেই বলতে হবে? গোয়েন্দা চৌকসকে একবারে বললে হয় না? ব্যাপারটা গোপনীয় কি না।’
লম্বা-নাক নাক সিটকাল।
‘এসব গোপনীয়তা কোটা এখন আর নেই। এমন কোটায় অনেক কবি ঢুকে ঠিকই স্যারকে কবিতা শোনানোর চেষ্টা করত—এটাও স্যারের শত্রুদের কাজ। একবার কবিতা শুনলে স্যারের মাথায় যে জট লাগে, তা খুলতে আড়াই দিন লাগে। গেলবার যখন তুর্কমিনিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম বকসের কেসটা স্যার প্রায় গুটিয়ে এনেছেন, তখনই প্রেসিডেন্টের শত্রুপক্ষ এক আততায়ী কবিকে ভাড়া করে। কবি গোপনীয়তার দোহাই দিয়ে স্যারের রুমে ঢুকে যখন তার এক জঘন্য কবিতা পড়ে শোনাল, সাথে সাথে প্রায় সমাধান করা কেসটা গুবলেট পাকিয়ে ফেললেন স্যার।’
আমি বললাম, ‘তাহলে তো মুশকিলের কথাই। আমি আসলে এসেছি আমার এক পোষা টিয়া পাখি চুরি হয়েছে, সে জন্য। খুব করে খুঁজেও পেলাম না। শেষমেশ পাড়ার বেলায়েত সাহেব চৌকস সাহেবের ঠিকানা দিলেন।’
‘পুলিশে গিয়েছিলেন?’
‘হ্যাঁ, গেছি। কিন্তু পুলিশ অফিসার খুব রেগে গেলেন। আমাকে বললেন, আপনি জানেন, আমার হাতে কয়জন মিসিং মানুষের লিস্ট আছে? তাদেরই কোনো গতি করতে পারলাম না, আর আপনি আসছেন পাখি নিয়ে!’
‘অদ্ভুত তো!’ নাক-লম্বা বিস্ময় প্রকাশ করল, ‘এ দেশের পুলিশও না! কী যে!’
আমি বললাম, ‘তা যা বলেছেন! এ জন্যই তো প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটরই ভরসা।’
নাক-লম্বা বলল, ‘ঠিক আছে। তবে আসুন। আপনার কেসটা সিরিয়াস। মিসিং কেসের ব্যাপারে দেরি করা যায় না।’
আমি তার বদান্যতায় খুশি হলাম। কারণ আমার খানিকটা সন্দেহ ছিল লোকটা হয়তো পুলিশের মতোই আমার পাখি হারানোকে পাত্তা দেবে না।
তার পিছু পিছু গোয়েন্দা চৌকসের চেম্বারে ঢুকলাম। চৌকস চেয়ারে বসে পত্রিকা পড়ছিলেন। আমরা ঢুকতেই কাগজের ফাঁক দিয়ে তাকালেন। ভদ্রলোকের দৃষ্টি খুব প্রখর, তাকাতেই অন্তরে গিয়ে লাগল। বয়স আনুমানিক চল্লিশ, চুলে আর দাড়িতে একাকার মুখ। পরনে একটা ফতুয়া আর ঢোলা প্যান্ট।
আমার সমস্যাটা মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। শুনেটুনে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি আবার কবিতাটবিতা লেখেন না তো?’
আমি তড়িঘড়ি করে বললাম, ‘আরে না। কী যে বলেন!’
‘আর ছড়া?’ তিনি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে আবার প্রশ্ন করলেন।
আমি বললাম, ‘ছড়া লিখি না, কিন্তু পড়ি এবং শুনি। ভালোই লাগে। আমার পাখিটাও ছড়া জানত।’
তিনি এবার আগ্রহী হলেন, ‘কোন ছড়া?’
‘আমি হব সকাল বেলার পাখি,
সবার আগে কুসুম বাগে উঠব আমি ডাকি!’
‘হুম, ভালো ছড়া। তো পাখিটা পালাল কখন?’
‘পালিয়েছে বলি নাই। আমার ধারণা চুরি হয়েছে।’
‘পাখি কে চুরি করবে? আশ্চর্য!’ চৌকস বিরক্ত হলেন, ‘পাখিরা পালায়। পাখা থাকলে আপনিও পালাতেন সুযোগ পেলে।’
আমি জবাবে কিছু বললাম না। তবে মনে মনে দমে গেলাম। এই গোয়েন্দাকে দিয়েও কাজ হবে না মনে হচ্ছে।
চৌকস চেয়ার ছেড়ে উঠে বললেন, ‘তবে কেউ একজন পাখির খাঁচা খুলে দিয়েছে। খাঁচাটা কে খুলেছে সেটা বরং একটা রহস্য হতে পারে।’
আমি বললাম, ‘আমার বাসায় আমি ছাড়া অন্য কেউ থাকে না। সকালে তালা মেরে অফিসে যাই। গ্রিল দেওয়া বারান্দায় পাখির খাঁচা।’
‘এর মাঝে পাখিকে খাবার দেয় কে?’
‘কেউ না, আমি অফিস থেকে এসেই দিই।’
‘হুম, বুঝেছি। তার মানে নিশ্চিত হওয়া গেল, ওটা পালিয়েছেই।’
‘না না, যা ভাবছেন তা নয়। খাবারের সংকট ওর হয় না। ওর বাটিতে অফিসে যাওয়ার আগেই কাঁচা বুট দিয়ে যাই যথেষ্ট পরিমাণে।’
‘হুম!’ চৌকস ভ্রু কুঁচকালেন। তারপর আনমনে বললেন—
‘যদি দাও নাশতা না, বুট
করবে তোমায় নাস্তানাবুদ!’
আমি বললাম, ‘তার মানে বলছেন, অন্য নাশতা দেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু রোজ তো ঠিকই খাচ্ছে।’
‘না না, সেটা না। আমি ভাবছি শব্দটা বুট না হয়ে বুদ হলে আরও ভালো মিলত। অবশ্য পুরোপুরি মিলে গেলেও সমস্যা। ছড়ার সৌন্দর্য নষ্ট। যাই হোক, চলেন তো গিয়ে দেখি আপনার বাসায়।’
বলে তিনি একটা ওভারকোট পরে নিলেন। এই গরমে ওভারকোট পরলেন কেন, সেই প্রশ্ন করতে সাহস পেলাম না। গোয়েন্দাদের ওটাই হয়তো দস্তুর। তবে তিনি যে রহস্য সমাধানে নেমে গেছেন বোঝা গেল!
২.
পাখির নাম রুস্তম আলী। ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকালেন চৌকস। ‘আর নাম পেলেন না? টিয়া পাখির নাম রুস্তম আলী। আপনার দেখছি এসথেটিক সেন্সের খুব বাজে অবস্থা!’
আমি বললাম, ‘নামটা আগের মালিকের দেওয়া। আমি আর পাল্টাতে পারিনি। নাম কি পাল্টানো যায় বলুন?’
চৌকস সাহেব বিরক্ত গলায় খালি খাঁচার দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বললেন—
‘রুস্তম আলী নাম পাখিটার
খাঁচায় কিছু নেই দেখি তার!’
তারপর খাঁচার দরজা পরখ করে বললেন—
‘একি! এটা তো লক করা না, তালা কই?’
আমি বললাম, ‘সিটকিনি লাগানো তো!’
তিনি অবিশ্বাসের ভঙ্গি করে বললেন, ‘আপনি তো আচ্ছা দেখছি! ছিটকিনি খোলা কোনো ব্যাপার? চাইলেই তো পা দিয়ে ছিটকিনি খোলা যায়!’
আমি বললাম, ‘তা হয়তো যায়, কিন্তু পাখির কি অত বুদ্ধি আছে?’
তিনি এমন ভঙ্গি করলেন, যেন আমি এমন একটা কথা বলেছি, সেটা তাঁর বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে।
‘আপনি জানেন, আমি আমার ডিটেকটিভ জীবনে ১০৫তম যে মার্ডার কেসটা পেয়েছিলাম, সেখানে হত্যাকারী কে ছিল?’
‘কোন পাখি?’ আমি সবিস্ময়ে তাঁকে জিজ্ঞেস করি।
‘না, পাখি কেন হবে! কিন্তু এক পাখিপালক। এবং সেই হত্যাকাণ্ডে তাকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছে তার পোষা কাক পাখি।’
‘কাক পাখি?’
হ্যাঁ, খুবই পাজি পাখি। এই কাক পাখি আর কবি এ দুই প্রজাতিকে আমি বিশ্বাস করি না! আর পুলিশের কাণ্ড দেখেন, তারা হত্যাকারীকে শুধু গ্রেপ্তার করেছে, সেই পাখিটা ছেড়ে দিয়েছে। না জানি সেটা আর কী অঘটন ঘটিয়েছে পরে।’
তিনি তারপর কিছুক্ষণ এপাশ-ওপাশ পরীক্ষা করে বললেন, ‘বারান্দার দেয়ালে দেখা যাচ্ছে ম্যাপ লাগিয়েছেন? কারণ কী?’
‘ম্যাপটা লাগানোর জায়গা পাচ্ছিলাম না।’
‘হুম, শহরের ম্যাপ। খুব সন্দেহজনক!’
তারপর তিনি বেশ কিছুক্ষণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ম্যাপটা দেখলেন।
‘আপনার পাখিটা নজরুলের ওই ছড়াটা ছাড়া আর কোনো ছড়া পারত?’
‘পারত অনেক ছড়াই, তবে “সকাল বেলার পাখি”টা ওর প্রিয় ছড়া। প্রতি সকালেই আবৃত্তি করত।’
‘হুম! ঠিক আছে। বুঝেছি আপনার পাখি কই। চলেন।’
‘বুঝেছেন? বলেন কী!’ আমি নিজ কানকে বিশ্বাস করতে পারলাম না।
‘হ্যাঁ, আপনি খাঁচাটা নিয়ে চলুন। বদমাশটা কই আছে ঠিক জানি!’
৩.
তারপর গোয়েন্দা চৌকসের কথামতো আমরা খাঁচাসহ একটা সিএনজি অটোরিকশা নিয়ে রওনা হলাম। প্রথমে গেলাম পুরান ঢাকায়, সেখান থেকে নদীর পাড়ে গিয়ে একটা নৌকাযোগে বুড়িগঙ্গা পার হয়ে একটা বালুর মাঠে হাজির হলাম। বালুর মাঠের এক পাশে সারি সারি নৌকা, সবজিবোঝাই। এরা এপার থেকে ওপারে সবজি ফেরি করে।
বালুর মাঠের মাঝখানে একটা ঝাঁকড়া গাছ। কী গাছ কে জানে!
নৌকা থেকে নেমে সেই গাছের দিকে রওনা হলেন চৌকস। পিছু পিছু গেলাম আমিও। গাছটার কাছাকাছি পৌঁছানোর পর বলেন, ‘এবার যান, গাছের নিচে গিয়ে পাখির নাম ধরে ডাকুন।’
পুরো ব্যাপারটা আমার কাছে ছেলেমানুষি লাগছিল। কিন্তু ওই নির্জন জায়গায় চৌকসের অবাধ্য হবার সাহস পেলাম না।
গাছের নিচে গিয়ে ‘রুস্তম আলী’ বলে জোরে দুবার ডাক দিলাম।
কোনো সাড়া পেলাম না। ওপরে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম গাছটাতে কিছু আছে কি না। ঘন ঝোপের কারণে কিছু বোঝার উপায় নেই।
আমি চৌকসকে বললাম, ‘আপনি নিশ্চিত ও এখানেই…’
তিনি বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘আবার ডাক দিন। কনফিউশনে আছে। এত সুন্দর ব্যবস্থা, উন্মুক্ত পরিবেশ, খাবারের চিন্তা নাই। সেটা ছেড়ে আবার খাঁচার জীবনে কে ফিরতে চায়? তবে খাঁচার পাখির খাঁচার প্রতিও মায়া থাকে। দরদ দিয়ে ডাকুন।’
ডাকতে যদিও আমার অস্বস্তি লাগছিল, তবু আবার গলা ছেড়ে ডাকলাম, বেশ দরদ দিয়ে।
‘রুস্তম রে! আয় বাপ আমার!’
বলতে না বলতেই দেখি আমার রুস্তম ডানা ঝাপটে নিচে নেমে আসছে গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে। আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে ওর গায়ে হাত বুলিয়ে দিলাম। মনে হলো আমাকে দেখে খুশিই হয়েছে, আমার হাতে মুখ ঘষে নিজে থেকেই খাঁচায় ঢুকে গেল!
একটু দূরে দাঁড়িয়ে চৌকস দেখছিলেন, তাঁর মুখে অবশ্য কোনো ভাবান্তর হলো না। যেন দৃশ্যটা খুব স্বাভাবিক।
আবার ফিরতি পথ ধরলাম আমরা।
ফিরতে ফিরতে চৌকসকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কীভাবে বুঝলেন রুস্তম ওখানেই গেছে?’
তিনি বিরক্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আপনারা কি না! এতটুকুও বোঝেন না। জায়গাটার নাম কি বলেন তো? আমরা যেখানে গেছি?’
‘কী?’
‘কুসুমবাগ!’
‘কুসুমবাগ?’
‘হ্যাঁ, বারান্দার দেয়ালে টানানো ম্যাপটা দেখলেই তো বুঝতেন!’
‘তো কী হয়েছে?’ আমি যেন তা-ও থই পাই না।
তিনি এবার প্রায় রেগে হড়বড় করে বললেন, ‘তো মানে? পাখিকে শখ করে ছড়া শিখাবেন, আর তার দণ্ড দেবেন না! সবার আগে কুসুমবাগে উঠব আমি ডাকি—এটা রোজ রোজ আবৃত্তি করলে কোন পাখির শখ না হয় কুসুমবাগে গিয়ে পালাতে!’
তারপর বিড়বিড় করে আপন মনে বললেন—
পাখিকে শেখাও ছড়া
আবার মাশুল দেবে না কড়া!
লেখা: মাশুদুল হক
Post a Comment