গেস্টহাউসের রহস্য – আনিসুল হক
‘আপনি কি ভূতে বিশ্বাস করেন?’
‘না। একদম বিশ্বাস করি না।’
‘আমি মানুষকে বিশ্বাস করি না।’ তিনি বললেন।
লোকটা বোধ হয় হেঁয়ালি করছেন। পরনে ধবধবে সাদা লুঙ্গি। গায়ে একটা ধূসর রঙের চাদর। চোখে একটা গোল ফ্রেমের চশমা।
আমরা দুজন বসে আছি একটা পুকুরের ধারে, সিমেন্টের বেঞ্চিতে। একটা ধু ধু মাঠের প্রান্তে এই পুকুরটা। পুকুরে লাল রঙের শাপলা আছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের একটা নির্জন গেস্টহাউসে এসে উঠেছি। আগে এইখানে একটা নদী ছিল। সেটা মরে গেছে। গেস্টহাউসটা পরিত্যক্তপ্রায়। একজন মাত্র দারোয়ান থাকে।
আমার বন্ধু ইঞ্জিনিয়ার জয়নালকে ই–মেইল করেছিলাম। ‘দোস্ত, আমি যাচ্ছি ফাঁসিতলা। ওখানে একটা অ্যাসাইনমেন্ট আছে। একজন প্রবীণ ভদ্রলোক একটা পুরোনো পুঁথির সংগ্রহশালা করেছেন। সেটা দেখব। পারলে পুঁথিগুলো পড়ব। যদি কোনো উপন্যাসের সাবজেক্ট পেয়ে যাই, তাহলে দিন পনেরো ঢাকা থেকে নিজেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন করে রেখে একটা উপন্যাস দাঁড় করিয়ে তারপর ঢাকা আসব। ফাঁসিতলার আশপাশে কোনো নির্জন গেস্টহাউস কি আছে তোদের পানি উন্নয়ন বোর্ডের?’ ও লিখল, ‘দোস্ত, তোর জন্য পারফেক্ট একটা গেস্টহাউস আছে। ফাঁসিতলা থেকে নেমে তিন মাইল আসতে হবে রিকশাভ্যানে। জায়গাটার নাম কালীতলা। সেখানে একটা পুরোনো বটগাছ দেখবি। বটগাছের গায়ে দেখবি দুটো তালগাছ। বটগাছের গা থেকেই তালগাছ দুটো উঠে এসেছে। লোকে বলে, জোড়া বটতলা। সেখানে রিকশাভ্যান ছেড়ে দিবি। একটাই রাস্তা। খানিকটা এলেই দেখতে পাবি, আমাদের গেস্টহাউসটা। কবে যাবি বল, আমি বলে রাখব। ওখানে আমাদের কর্মচারী আছে, রতন। সে সব ব্যবস্থা করে রাখবে। কলতলা থেকে পানি তুলে রাখবে বাথরুমে। রান্নাবান্না করবে। তুই যত দিন ইচ্ছা থাকিস। কেউ ডিস্টার্ব করবে না। যত্ন করে উপন্যাস লিখিস। তবে একটা শর্ত আছে। উপন্যাসটা তুই আমাকে উৎসর্গ করবি।’
আমি লিখলাম, ‘অফ কোর্স। উপন্যাসটা তোকেই আমি উৎসর্গ করব!’
এইভাবেই এখানে আসা।
আজ সকাল নয়টার দিকে এসে পৌঁছেছি এই গেস্টহাউসে। তখন হেমন্তের আকাশ ছিল ঝকঝকে পরিষ্কার, নীল আকাশে কে যেন ভাসিয়ে দিয়েছিল সাদা মেঘের ভেলা, লতাগুল্মে ঢাকা মাঠটায় ছিল রৌদ্রছায়ার খেলা, কাঁটাগাছে হলুদ ফুলে প্রজাপতি ওড়াউড়ি করছিল।
রতন দৌড়ে এসেছিল।
‘স্যার, আপনে আসছেন, আপনার কথা আমারে বড় স্যারে কইয়া রাখছে। আমি দোতলার ঘরটা আপনার লাইগা রেডি কইরা রাখছি।’
দোতলায় উঠলাম। ঘরটা বড়ই। বিছানাও পরিষ্কার। তবে গেস্টহাউসটা আসলেই পুরোনো। এদিকটায় কেউ আসে না মনে হয়। দেয়ালে শেওলা। চাদর-কম্বলেও বাক্সের গন্ধ। এসি নেই। একটা ফ্যান আছে। বড় শব্দ করে।
দুপুরে খাওয়া ভালোই হলো। পেঁপেভাজি, ছোট মাছ, রুই মাছ, আলুভর্তা আর ডাল।
রতন বলল, ‘স্যার, আপনার রাইতের খাবার আমি চারটার মধ্যে পাক কইরা টেবিলে দিয়া রাখব। সন্ধ্যার সময় আমারে একটু পাশের গঞ্জে যাইতে হইব। আপনে খায়াদায়া বাসনকোসন ফেলায়া রাইখেন। আমি সকাল সকাল আইসা ধুইয়া দিব। সকালে নাশতা কী খাইবেন? হাতে বেলা পরাটা আইনা দিই? ডিম আর বুটের ডাল! হইব?’
‘হ্যাঁ। হবে।’
‘চা খাইবেন?’
‘কফি পেলে ভালো হতো। আচ্ছা, তুমি ফ্লাস্কে গরম পানি দিয়ে যেয়ো। আর টি–ব্যাগ। আমি দুধ-চিনি ছাড়া চা খাই। কাপে গরম পানি ঢেলে নিলেই হয়ে যাবে।’
বিকেলবেলা ডাইনিং টেবিলে খাবার ঢেকে রেখে রতন বিদায় নিল।
বিশাল এই গেস্টহাউস। পেছনে ঘন গজারি বন। চারদিকে গাছপালা। সূর্য ডোবার আগেই অন্ধকার নেমে আসছে। আমি ঘর থেকে বের হলাম। মাঠটা ধরে হাঁটতে হাঁটতে এসে পৌঁছালাম একটা পুকুরের পাড়ে। সেখানে দেখি একজন চাদর-গা মানুষ বসে আছে! ভয় যে পাইনি, তা বলব না। ভূতের ভয় নয়। মানুষের ভয়। এই নির্জন গেস্টহাউসে রতন ছাড়া আর কোনো মানুষ থাকার কথা নয়!
তবে পৃথিবীটা মানুষের। আর মানুষ যায় না, এমন কোনো জায়গা তো পৃথিবীতে নেই। দূরে হলেও মানুষের বসতি নিশ্চয়ই আছে। সেখানকার কেউ তো আসতেই পারে।
আমি পেছন থেকে গলা খাঁকারি দিলাম। তিনি একবার ঘুরে তাকালেন। তারপর বললেন, ‘আপনি কি এই গেস্টহাউসের নতুন গেস্ট?’
আমি বললাম, ‘জি। আজ সকালেই এসেছি।’
তিনি বললেন, ‘ভালোই হলো। একা একা থাকতে থাকতে বড় বোর ফিল করছি। আপনি এসেছেন। কদিন থাকবেন তো?’
‘হ্যাঁ। সে রকমই তো ইচ্ছা।’
‘বেশ হলো। আপনার সঙ্গে গল্প করা যাবে। একা একা এই বিশাল বাড়িতে থাকতে থাকতে আমার বুঝলেন না যাকে বলে মনে আর কানে শেওলা পড়ে গেছে। কথা না বলতে পারলে কেমন লাগে বলুন।’
‘আপনাকে পেয়ে আমারও ভালোই লাগল। একা একা থাকতে হবে, জায়গাটা বেশ গা ছমছমে। একটু কিন্তু ভয় ভয়ই লাগছিল।’
‘ভয়! ভয় কাকে?’
‘না, অন্য কিছু না। এই মানুষকেই। কত রকমের মানুষ থাকে। চোর-ডাকাত। সাধু-সন্ন্যাসী। সাইকোপ্যাথ। থাকে না?’
‘তা থাকে। মানুষের মধ্যে অনেক কিছু থাকে। মানুষ বড় ক্ষতিকর প্রাণী।’ এরপর খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে সেই প্রশ্নটা করলেন তিনি, ‘আপনি কি ভূতে বিশ্বাস করেন?’
আমি বললাম, ‘না। একদম বিশ্বাস করি না।’
তিনি বললেন, ‘আমি মানুষকে বিশ্বাস করি না।’
আমি বললাম, ‘আমি মানুষকে বিশ্বাস করি। মানুষে বিশ্বাস করি। আমি একজন লেখক। আমাকে লিখতে হয়। আমার লেখার বিষয় হলো মানুষ। কাজেই মানুষে বিশ্বাস না করে আমি পারি না।’
তিনি বললেন, ‘তাহলে আপনি লেখকই নন। আপনি ঠিক করে নিয়েছেন আপনি লেখক, তাই আপনাকে মানুষে বিশ্বাস করতে হবে। তা কেন? আপনার মন থাকবে সংস্কারমুক্ত। একেবারে সাদা কাগজের মতো। আপনি যদি দেখেন কোনো একজন ভালো, আপনি ভালো লিখবেন। যদি দেখেন কোনো একজন খারাপ, খারাপ লিখবেন।’
‘ভেরি ইন্টারেস্টিং। আপনার কথা আমার খুব ভালো লাগছে। আপনি নিজে কী করেন?’
তিনি হেসে ফেললেন। বললেন, ‘আমিও লেখক। আমিও লিখি। আমার ৩০টা উপন্যাস বেরিয়ে গেছে।’
‘তাই নাকি? ৩০টা। আপনার নামটা তো ঠিক…মানে আমি তো বাংলাদেশের সব লেখককেই মোটামুটি চিনি।’
‘না মানে আপনাদের ঢাকার লেখক তো আমি নই। আমার লেখা এই বনবাদাড়ে চলে আরকি। ঢাকা শহরে চলে না।’
‘তবুও যদি নামটা বলতেন!’
‘নাম আমি বলব। আপনি লেখক। আমি লেখক। আমাদের অবশ্যই অনেক জানাশোনা হওয়া দরকার। বলব।’
‘আপনার উপন্যাসের সাবজেক্ট কী? কী ধরনের উপন্যাস আপনি লেখেন।’
‘এই তো সামাজিক উপন্যাস। আমাদের সমাজের সমস্যা, ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির সম্পর্ক। এই সব নিয়ে!’
‘আসলে উপন্যাস তো তা-ই। আমিও এই সব নিয়েই লিখি।’
‘ঔপন্যাসিক হিসেবে আপনাদের সাহেব অনেক সুবিধা। নানা ঘটনা ঘটে। আপনারা লেখেন। আমাদের সমাজে তো তেমন কিছু ঘটেই না।’
‘আপনাদের এই এলাকাটা নির্জন। এখানে জীবন বুঝি নিস্তরঙ্গ।’
‘এলাকার কথা হচ্ছে না। আপনি যতটা নির্জন ভাবছেন, ততটা নির্জনও না। রাতের বেলা এই জঙ্গলের মধ্যে আমাদের সমাজের সবাই আসে। হাটবাজার বসে। গান–বাজনা হয়! আপনি চাইলে আপনাকে আজ রাতেই নিয়ে যেতে পারি। তবে আসল কথা হলো, আমাদের সমাজে হিংসা-বিদ্বেষ নাই। এর কারণ, কারও কোনো অভাব নাই। আবার কারও কোনো নিজস্ব সম্পত্তি নাই।’
‘আপনাদের সমাজটা কি আদিম সাম্যবাদী সমাজ?’
‘আপনারা মানুষেরা নানা ব্যাখ্যা দিতে পছন্দ করেন। আমাদের নিয়ম হলো, ধরুন কারও খিদে পেয়েছে, সে হাত বাড়িয়ে জ্যোৎস্না খেয়ে নিল। কোনো অসুবিধা নাই। আকাশে জ্যোৎস্নার তো অভাব নাই। যে যতটা পারে খাচ্ছে। ফলে এই নিয়ে কোনো মারামারি নাই।’
এবার আমার মনের মধ্যে কু ডাক দিতে লাগল। সূর্য ডুবে যাচ্ছে। আকাশে অস্তরাগ। বাদুড় উড়ছে। গাছে গাছে ঝুলতে শুরু করে দিয়েছে বাদুড়। দূরে শিয়াল ডাকতে শুরু করল।
তিনি বলতে লাগলেন, ‘আপনাদের সমাজ আমার পছন্দ না সাহেব। এই যে এই গেস্টহাউসের ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন জয়নাল। আপনি চেনেন তো?’
‘হ্যাঁ। আমার বন্ধু। ওকেই তো মেইল করলাম। সেই তো ব্যবস্থা করে দিল।’
‘হ্যাঁ। জয়নাল সাহেব। বড় ভালো লোক ছিলেন। দুই ছেলে। ক্লাস নাইনে আর সেভেনে পড়ে। এই এখানে কাটাখালী নদীটা পুনঃখনন করতে হবে। ৪৫ কোটি টাকার প্রজেক্ট। এলাকার চেয়ারম্যান টাকার ভাগ চায়। এলাকার লিডার টাকার ভাগ চায়। কন্ট্রাক্টর কাজ না করে বিল করল। উনি বললেন, আমি সাইন করব না। ব্যস। সকালবেলা লোকটা অফিসে যাবে বলে বের হলো। ড্রাইভার তাকে নিয়ে এল এই গেস্টহাউসে। দোতলার পুব দিকের রুমটা। সেখানে এনে বন্দী করে রাখল তাকে। এই জায়গাটা তো নির্জন। কেউ আসে না। ওখানেই লোকটা মরে পড়ে রইল।’
‘জয়নাল মারা গেছে?’
‘আপনি জানেন না? আপনার সঙ্গে না ই–মেইলে কথা হয়েছে। সে বলে নাই যে সে মারা গেছে?’
‘কী বলছেন আপনি?’
‘হ্যাঁ। জয়নাল সাহেবের সঙ্গে আমার কালকে কথা হয়েছে। উনি বলেছেন, আমার বন্ধুটা বুয়েটে পড়ত। তবে ইঞ্জিনিয়ারিং করে না। সাংবাদিকতা করে। আর লেখালেখি করে। আমি যেন আপনাকে সব বলি। গিয়ে আপনি জয়নালের কথা লিখবেন। জয়নাল গুম হয়নি। খুন হয়েছে। এলাকার লিডার, চেয়ারম্যান, কন্ট্রাক্টর মিলে খুনটা করেছে। তার বডি এই পুকুরে তিনটা পাথরের বস্তার সঙ্গে বেঁধে ডুবিয়ে রাখা হয়েছে।’
ঘন অন্ধকার চারদিকে। পাশের লোকের মুখও দেখা যাচ্ছে না। শুধু সাদা চাদর নড়ছে।
তিনি বলে চলেছেন, ‘আপনি এই ঘটনা ডিটেইল করে একটা উপন্যাস লেখেন। আমি আপনাকে সব তথ্য দেব। আমরা তো একই গেস্টহাউসেই থাকব। আমার উপন্যাসগুলো আপনাকে দেখাবে। আমি তো লিখি ভূতসমাজের জন্য। আমার পাঠক ভূত। আপনি বলছিলেন, আপনি ভূতে বিশ্বাস করেন না। আমি বলি, আমি মানুষে বিশ্বাস করি না। মানুষ খুব ভয়ংকর প্রাণী। খুব। তাকে বানানো হয়েছে আত্মপর করে। স্বার্থপর করে। সে শুধু নিজের জন্য বাঁচে। নিজের খাওয়া। নিজের পরা। নিজের টাকা। নিজের নারী। নিজের সন্তান। নিজের সম্পত্তি। নিজের প্রশংসা। নিজের ক্ষমতা। এই করতে গিয়ে সে করতে পারে না এমন কোনো খারাপ কাজ নাই। আমি মানুষে বিশ্বাস করি না। আমি বিশ্বাস করি ভূতে। ভূতদের মধ্যে আমি বলতে কিছু নাই। আমার বলতেও কিছু নাই। কাজেই কোনো খারাবি নাই।
‘আপনি জিজ্ঞেস করছিলেন, আমার নাম কী। উপন্যাসগুলোয় আমার নাম কী থাকে? কোনো নাম থাকে না। ভূতদের সব উপন্যাস সবার। নিজের বলে কিছু নাই।
‘চলেন, আমরা ঘরে ফিরি। ভূতেরা আপনার কোনো ক্ষতি করবে না। সেই ভয় নাই। তবে এলাকাটায় অনেক সাপের উপদ্রব। আর দু–চারজন মানুষও এদিকটায় আসে। খারাপ মানুষ। খুনখারাবি করে। তারপর এখানে এসে মদটদ খায়। ভূতকে আপনার ভয় না পেলেও চলবে। কিন্তু মানুষকে ভয় তো পেতেই হবে। চলেন যাই। আমি নিচতলায় থাকব। আপনি দোতলায়।’
এরপর আমি আর কিছু জানি না। যখন হুঁশ হলো, তখন দেখি, আমি খাটে শুয়ে আছি। গেস্টহাউসের দোতলার রুমটাতে। রতন এসেছে। সে বলছে, ‘স্যার, মুরগির মাংস আনছি। রুটি গরম আছে। খায়া নেন। দরজা খুইলা ঘুমাইছেন কেন। এলাকাটা ভালো না। চোর–ডাকাত–খুনিদের আখড়া।’
আমি বলি, ‘রতন, আমি যে এখানে আসব, তোমাকে কে বলেছে? জয়নাল সাহেব না?’
‘জয়নাল স্যার তো বাঁইচা নাই, স্যার। গুম হইয়া গেছেন। আপনের কথা আমারে কইছেন আমার বড় স্যার—আদনান স্যার।’
‘আদনান স্যারকে তো আমি চিনি না। উনি জানলেন কী করে?’
‘তা তো স্যার আমি কইতে পারুম না।’
‘রতন, নিচতলার ঘরটায় কে থাকে জানো?’ জানালার বাইরে ঝকঝকে রোদ থেকে সাহস নিয়ে আমি বললাম!
‘ওই রুমটার দিকে যাইয়েন না, স্যার। লোকে বলে, ওই রুমে তেনারা থাকেন।’
‘রতন, আমি আজই চলে যাব।’
‘আজকার রাতটা থাইকা যান স্যার। আজকা অমাবস্যা। আজকা রাইতে এই মাঠে জয়নাল স্যারে আইব। আপনের না বন্ধু হয়। আপনি তার লগে কথা কইতে পারবেন…’
Post a Comment