কাদামাখা জুতো – লেনক্স রবিনসন

কাদামাখা জুতো – লেনক্স রবিনসন

ঠিক যেভাবে ঘটেছে, তেমনি সাদামাটাভাবে লিখে ফেলার চেষ্টা করছি আমি। এতটুকু বাড়িয়ে না বলার চেষ্টা করব।

আমার বয়স বাইশ। বাবা-মা দুজনই মারা গেছে। আমার কোনো ভাইবোন নেই। একমাত্র নিকটাত্মীয়টি আমার ফুফু মার্গারেট; অবিবাহিত এবং কর্ক কাউন্টির পশ্চিমে গ্রামের একটা বাড়িতে থাকে। আমাকে অনেক আদর করে সে। আমার গরিবি হাল আর বন্ধুবান্ধবের সংখ্যা কম হওয়ায় ছুটির দিনগুলো প্রায়ই তার ওখানে কাটাই আমি।

আমি স্কুলে পড়াই—মানে ছবি আঁকা আর গান শেখাই আরকি। ডাবলিনের দু-তিনটি স্কুলের ভিজিটিং টিচার আমি। একাকী মেয়ে হিসেবে বেঁচেবর্তে থাকার পক্ষে মোটামুটি চলনসই বেতন পাই। কিন্তু প্রচুর দেনা রেখে মারা গেছে বাবা। সেসব শোধরানোর আগে সাদামাটাভাবেই চলতে হচ্ছে। আমার বোধ হয় বেশি করে ভালো খাবার খাওয়া দরকার। অনেক সময় লোকে আমাকে ভীরু আর বেশি শুকনো ভাবে। আমাকে বেশ নাজুক এবং ভঙ্গুর দেখায়, কিন্তু আসলে তেমন নই। আমার পাণ্ডুর সরু আঙুলওয়ালা হাতজোড়া লিকলিকে—লোকে যে ধরনের হাতকে ‘শিল্পীর হাত’ বলে।

ফুফু বড়দিনের ছুটি তার সঙ্গে কাটানোর ডাক দেওয়ার খুব আশায় ছিলাম আমি। আমার হাতে খুব অল্প পরিমাণ টাকাপয়সা ছিল। বাবার ধারের একটা বড় অংশ শোধ করায় হাত টানাটানির অবস্থা হয়েছিল, তাই বেশ দুর্বল, অসুস্থ লাগছিল। ফুফুর ওখানে যেতে না পারলে ছুটির দিনগুলো কীভাবে কাটাব বুঝতে পারছিলাম না। অবশ্য বড়দিনের ১০ দিন আগে এল দাওয়াত। ধরে নাও, কৃতজ্ঞতার সঙ্গেই দাওয়াত কবুল করেছি আমি। ২০ তারিখে শেষবারের মতো স্কুল ছুটির পর আমার ট্রাংক গুছিয়ে নিলাম, মার্গারেট ফুফুর খুবই প্রিয় পুরোনো কিছু সেন্টিমেন্টাল গান একসঙ্গে করে রোসপ্যাট্রিকের পথ ধরলাম।

শীতে ওয়েস্ট কর্কে তুমুল বৃষ্টি হয়। মার্গারেট ফুফু স্টেশনে আমাকে নিতে আসার সময় বৃষ্টি ঝরছিল। ‘বিশ্রী একটা মাস চলছে, পেগি,’ স্টেশন থেকে রোসপ্যাট্রিকমুখী দীর্ঘ রাস্তার দিকে ঘোড়ার মুখ ঘোরানোর সময় বলল ও। ‘ছয় সপ্তাহ ধরে রোজই যেন বৃষ্টি ঝরে চলেছে। আর তুফান! দুদিন আগে একটা চিমনি খুইয়েছি আমরা: ছাদ গলে নেমে এসেছে ওটা, ফলে বাড়তি শোবার ঘরের সিলিংয়ে বৃষ্টি ঢুকে পড়েছে। জেরেমিয়া ড্রিসকল ছাদ মেরামত না করা পর্যন্ত বাতিল আসবাবের ঘরেই তোমার জন্য বিছানা পাততে বাধ্য হয়েছি।’

যেকোনো জায়গাতেই চলবে আমার, আশ্বস্ত করলাম ওকে; আমার শুধু দরকার ওর সঙ্গ আর কিছুটা নিরিবিলি সময়।

‘সে নিশ্চয়তা তোমাকে দিতে পারি আমি।’ বলল ও। ‘তোমাকে সত্যিই কাহিল দেখাচ্ছে: মনে হচ্ছে যেন মাত্র মারাত্মক কোনো রোগ থেকে সেরে উঠেছ, নয়তো কোনো অসুখ বাঁধাতে চলেছ। মাস্টারি তোমার সর্বনাশ করে ছাড়ছে।’

বাতিল আসবাবের কামরাটা সত্যিই আরামদায়ক। নিচের তলায় দুটো বিরাট জানালাওয়ালা বিশাল একটা ঘর। লোকে প্রায়ই নিচের তলায় ঘুমাতে ভয় পায় বলে মার্গারেট ফুফু আগে কখনো ওটাকে শোবার ঘর হিসেবে ব্যবহার করেনি।

আগুনের সামনে বসে গল্পগুজব করতে গিয়ে অনেক রাত অবধি জেগে ছিলাম আমরা। আমার সঙ্গে কামরা পর্যন্ত এল মার্গারেট ফুফু। ঘরের অবস্থা নিয়ে বকবক করতে করতে অনেকক্ষণ থাকল ও, চেয়ার-টেবিল টানাহ্যাঁচড়া করে বিছানার চাদর পরখ করে আমি আরামেই থাকতে পারব বলে আশা করল।

অবশেষে ওকে নিয়ে হাসতে শুরু করলাম। ‘আরাম লাগবে না কেন শুনি? ব্রান্সউইক স্ট্রিটে আমার ভয়ংকর ছোট রুমটার কথা একবার ভাবো! এই কামরার সমস্যা কী?’

‘কোনো সমস্যা নেই—বিলকুল না।’ কিছুটা হড়বড় করেই বলল ও। আমার গালে চুমু খেয়ে বিদায় নিল।

চমৎকার একটা ঘুম দিলাম আমি। আয়া ডাকার আগ পর্যন্ত একবারের জন্যও চোখ মেলিনি। সে বিদায় নেওয়ার পর ফের ঝিমুুনি এসে গেল। হাস্যকর একটা স্বপ্ন দেখলাম। স্বপ্নে দেখলাম এক ধনী বয়স্ক মহিলার সাক্ষাত্কার নিচ্ছি: একটা আরামদায়ক কামরায় থাকার বিনিময়ে বছরে হাজার টাকা দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে সে। মথের কবল থেকে ওর কাপড়চোপড় বাঁচানোই আমার একমাত্র কাজ; প্রচুর পরিমাণ চমৎকার দামি পোশাক রয়েছে তার, মথ সেগুলো খেয়ে ফেলবে ভেবে ভীষণ ভয় পাচ্ছে বলে মনে হলো। মনে আছে সানন্দে ওকে বলছিলাম, ‘এ কাজে আমার কোনোই সমস্যা হবে না। মথ মারতে ভালোই লাগে।’

আমার ও কথা বলাটা বেশ অদ্ভুত। কারণ মথ মারতে মোটেও পছন্দ করি না আমি। অবশ্য আমার স্বপ্নের সহজ ব্যাখ্যা মিলে গেছে। এক সেকেন্ড বাদে (সে রকমই মনে হয়েছে) জেগে ওঠার সময় আমার তর্জনী আর বুড়ো আঙুলে একটা মরা মথ ধরা ছিল। দুই আঙুলে চেপে ধরা মরা মথটা দেখে একটু ঘেন্নাই লাগছিল, কিন্তু চট করে ঝেড়ে ফেলে লাফিয়ে উঠে পোশাক পরে নিয়েছি।

মার্গারেট ফুফু ডাইনিং রুমেই ছিল। রাতটা কেমন কাটিয়েছি সে নিয়ে বেহিসাবি উদ্বেগ মেশানো প্রশ্নে ভরা। অল্পক্ষণের মধ্যেই তার উদ্বেগ তাড়ালাম। আমার স্বপ্ন আর নতুন চাকরি নিয়ে দুজনই খুব একচোট হাসলাম। সারা দিন বৃষ্টি ঝরে চলল, ঘরের বাইরে পা রাখিনি আমি। অনেক কটা গান গাইলাম, পেনসিলে ফুফুর একটা ছবি আঁকতে শুরু করলাম—অনেক বছর ধরেই কাজটা করার কথা ভাবছিলাম—কিন্তু শরীরটা ভালো লাগছিল না, কেমন যেন মাথাধরা আর ভয়ভয় একটা ভাব—বোধ হয় সারা দিন ঘরে থাকার ফল। বিছানায় যেতে দারুণ অনীহা লাগছিল। কী কারণে যেন ভয় পাচ্ছিলাম।

মার্গারেট ফুফুকে অবশ্যই এ নিয়ে কিছু বলিনি।

সে রাতে ঘুমিয়ে পড়তেই স্বপ্ন দেখা শুরু করলাম। মনে হলো যেন অনেক উঁচু থেকে নিচের দিকে তাকিয়ে আছি। শোবার ঘরের এক কোণে নাইটড্রেস গায়ে উবু হয়ে বসে আছি। ওখানে গুটিশুটি হয়ে পড়ে থাকার কারণ ভাবার কথা মনে আছে, কাছে এসে নিজের দিকে আবার ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম ওখানে জবুথবু হয়ে বসে থাকা ওটা আমি নই—ইয়া বড় একটা সাদা বিড়াল। একটা ইঁদুরের গর্তের দিকে তাকিয়ে আছে। স্বস্তির সঙ্গে ঘুরে দাঁড়াতে গিয়েই দেখলাম বিড়ালটা লাফিয়ে উঠেছে। থাবায় একটা ইঁদুর ধরে আছে ওটা, চোখ মেলে আমার দিকে তাকিয়ে বিড়াল যেভাবে গরগর করে, সেভাবে গর্জাচ্ছে। ওটার মুখটা এক মহিলার—আমার চেহারার মতো। তোমার কাছে হয়তো মোটেই ভীতিকর ঠেকছে না, কিন্তু ব্যাপার হলো ইঁদুর ভীষণ ভয় পাই আমি। নিজের হাতে ইঁদুর ধরা, মুখ ছোঁয়ানোর চিন্তা—ইশ্, এমনকি লেখার কথাও ভাবতে পারি না।

বোধ হয় চিৎকার ছেড়ে জেগে উঠেছিলাম। হুঁশ ফিরলে একলাফে বিছানা থেকে মেঝেতে নেমে দাঁড়ালাম। মোমবাতি জ্বেলে পুরো ঘরে তল্লাশি চালালাম। এক কোণে গোটা কতক বাক্স আর ট্রাংক রাখা; ওগুলোর পেছনে ইঁদুরের গর্ত থাকতেও পারে, কিন্তু ওগুলো টেনে সরিয়ে উঁকি দেওয়ার সাহসে কুলোল না। মোমবাতি জ্বালিয়েই সারারাত নির্ঘুম কাটিয়ে দিলাম আমি।

পরের দিনটা চমৎকার তুষারময় ছিল। সকালে লম্বা রাস্তা হাঁটতে বেরোলাম। বিকেলেও একবার বের হলাম। শোবার সময় হলে বেশ কাহিল আর ঘুমঘুম লাগছিল। তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লাম। সারারাত স্বপ্নহীন ঘুমালাম।

পরদিন খেয়াল করলাম আমার হাত দুটো কেমন যেন অদ্ভুত চেহারা নিচ্ছে। ‘অদ্ভুত’ কথাটা বোধ হয় ঠিক খাটে না, কারণ ঠান্ডায় চামড়া কর্কশ এবং রুক্ষ হয়ে পড়াই স্বাভাবিক এবং আবহাওয়া তেমন কিছু হওয়ার পক্ষে যথেষ্ট তুষারাচ্ছন্ন ছিল। কিন্তু কেবল চামড়াই কর্কশ হয়ে ওঠেনি, গোটা হাতই যেন আরও বড় ঠেকছিল, আমার নিজের হাতের মতো নয়। কথাটা কেমন হাস্যকর শোনাচ্ছে, কিন্তু পুরো গল্পটাই তো হাস্যকর।

ছোটবেলায় স্কুলে থাকতে একবার ভুল করে অন্য এক মেয়ের জুতো পরার কথা মনে পড়ল। ওগুলো পায়েই সন্ধ্যা পর্যন্ত কাটাতে হয়েছিল আমাকে, রীতিমতো শোচনীয় অবস্থা হয়েছিল আমার। বারবার নিজের পায়ের দিকে না তাকিয়ে থাকতে পারছিলাম না, অন্য কারও পা বলে মনে হচ্ছিল ওগুলোকে। জানি না কেন, ব্যাপারটা অসুস্থ করে তুলেছিল আমাকে। এখন নিজের হাতের দিকে তাকাতে গিয়ে অনেকটা সে রকমই লাগছিল। হাতজোড়া কতখানি কর্কশ এবং ফুলে উঠেছে, সেটা লক্ষ করেছে মার্গারেট ফুফু। আমাকে কোল্ড ক্রিম দিল ও, শুতে যাওয়ার আগে হাতে লাগালাম।

অনেকক্ষণ জেগে থাকলাম আমি। হাতের কথা ভাবছিলাম। ওগুলোর কথা না ভেবে যেন থাকতে পারছিলাম না। অন্ধকারে যেন ক্রমেই আরও বড় হয়ে উঠছিল ওগুলো। দানবীয় হাতের মতো লাগছিল, ভয়ংকর কোনো শিম্পাঞ্জির হাত, পুরো কামরা ভরে তুলেছিল। অবশ্য দেশলাই জ্বালিয়ে মোমবাতি ধরালেই মিনিটখানেকের মধ্যে নিজেকে শান্ত করতে পারতাম, কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি, সাহস হচ্ছিল না। এক হাত দিয়ে আরেক হাত ধরার সময় ছেলেদের হাতের মতো কর্কশ, লোমশ ঠেকছিল।

অবশেষে ঘুমিয়ে পড়লাম। স্বপ্ন দেখলাম বিছানা থেকে নেমে জানালা খুলেছি। বেশ কয়েক মিনিট বাইরে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। চাঁদের আলোয় ঝলমল করছে চারপাশ। হিম ঠান্ডা পড়েছে। বাইরে হাঁটতে বেরোনোর খুব ইচ্ছা হলো। স্বপ্ন দেখলাম ঝটপট পোশাক পরে পায়ে স্লিপার গলিয়েছি। মনে হলো যেন এমন একটা রাস্তা ধরে মাইলের পর মাইল হাঁটছি; রাস্তাটা আগে কখনো দেখেছি বলে মনে পড়ে না। ঢালু হয়ে ওপরে উঠে গেছে ওটা। এগোনোর সময় কারও দেখা মিলল না।

অচিরেই টিলার চূড়ায় পৌঁছালাম। রাস্তার ধারে বিরান একটা ময়দানের মাঝখানে বিরাট একটা বাড়ি দাঁড়িয়ে। তিনতলা, জীর্ণতার ছাপ পড়া। হয়তো কোনোকালে কোনো ভদ্রলোকের বাড়ি ছিল, এখন অন্যরা আস্তানা গেড়েছে। আয়ারল্যান্ডে এ রকম বহু জায়গা আছে। একেবারে ওপরতলার জানালায় আলো জ্বলছে। ও বাড়িতে গিয়ে ঘরে ফেরার রাস্তার হদিস জানব বলে স্থির করলাম। রাস্তা থেকে ভেতরে যাওয়ার ঘাসে ঢাকা পথটা আটকে রেখেছে একটা গেট। দড়ি দিয়ে বাঁধা থাকায় খুলতে না পেরে উঁচু হলেও অনায়াসে টপকে গেলাম ওটা। মনে আছে স্বপ্নের ভেতরই ভাবছিলাম, ‘স্বপ্ন না হলে কোনো দিনই এত সহজে পেরোনো হতো না।’

দরজায় কড়া নাড়লাম। দ্বিতীয়বার কড়া নাড়ার পর আলোজ্বলা কামরার জানালা খুলে গেল। একটা কণ্ঠস্বর জানতে চাইল, ‘কে ওখানে? কী চাই?’

পাণ্ডুর চেহারার মধ্যবয়সী মহিলার কণ্ঠস্বর ওটা, কাঁধের ওপর নোংরা ধূসর চুলের গোছা নেমে এসেছে।

বললাম, ‘নিচে এসে আমার সঙ্গে কথা বলো; রোসপ্যাট্রিকে ফেরার পথটা জানতে চাই।’

দুই কি তিনবার কথা বলতে হলো ওর সঙ্গে, তবে শেষতক নিচে নেমে সন্দিহান অবস্থায়ই দরজা খুলল সে। মাত্র কয়েক ইঞ্চি কবাট ফাঁক করে আমার পথ আগলে দাঁড়াল। বাড়ি ফেরার পথের দিশা জানতে চাইলাম আমি। ভীত, হকচকিত ঢঙে পথ বাতলে দিল সে।

তারপর স্বপ্নে নিজেকে বলতে দেখলাম, ‘আমাকে ভেতরে ঢুকতে দাও, একটু উষ্ণ হয়ে নিই।’

‘অনেক রাত হয়েছে, ঘরে ফিরে যাওয়া উচিত তোমার।’

কিন্তু হেসে উঠলাম আমি, আচমকা পায়ের ধাক্কায় দরজার পাল্লা খুলে ওকে পাশ কাটিয়ে পিছলে ভেতরে ঢুকে পড়লাম।

কাদামাখা জুতো
অলংকরণ: জাহিদুল হক
মনে আছে, অসহায় সন্ত্রস্ত কণ্ঠে ‘হায় খোদা’ বলে উঠেছিল সে। ওর ভয় পাওয়া আর আমার মতো সম্পূর্ণ একা, চেনাজানা কারও কাছ থেকে বহু মাইল দূরে, অচেনা একটা বাড়িতে এক অচেনা মহিলার সঙ্গে অল্প বয়সী একটা মেয়ের বিন্দুমাত্র ভয় না পাওয়া কেমন যেন বেখাপ্পা ঠেকেছে। অবশেষে মহিলা কেটলি গরম করার অবসরে (কারণ ওর কাছে চা খেতে চেয়েছিলাম) আগুন পোহানোর পর খানিকটা উষ্ণ হয়ে উঠলে তার ভীরু, সন্ত্রস্ত ভাবভঙ্গি থেকে পরিস্থিতির অদ্ভুত দিকটা চোখে লাগল। হাসিমুখে বললাম, ‘তুমি মনে হয় আমাকে ভয় পাচ্ছ।’

‘মোটেই না, মিস।’ প্রায় কাঁপা কণ্ঠে জবাব দিল সে।

‘ভয় পাওয়ার কিছু নেই।’ বলে ওর হাতে হাত রাখলাম।

চোখ নামিয়ে আমার হাতের দিকে তাকাল সে। আবার বলে উঠল, ‘হায় আমার খোদা।’ তারপর টলমল পায়ে চুলোর দিকে সরে গেল।

আধা মিনিটের মতো ওভাবেই থাকলাম আমরা। আমার কোলে ফেলে রাখা হাতের দিকে স্থির হয়ে আছে ওর চোখজোড়া। যেন কিছুতেই নজর সরাতে পারছে না।

‘কী ব্যাপার?’ জানতে চাইলাম।

‘তোমার চেহারাটা মেয়েদের।’ ফিসফিস করে বলল সে। ‘আর—খোদা রক্ষা করো—হাতজোড়া ছেলেদের।’

নিজের হাতের দিকে তাকালাম। বিরাট, শক্তিশালী, পেশল, কর্কশ লাল পশমে ঢাকা। বলতে অবাক লাগছে ওগুলো আর বিতৃষ্ণা জাগাচ্ছিল না। ওগুলোর জন্য গর্ব হচ্ছিল—ওগুলোর ভেতর লুকিয়ে থাকা শক্তি এবং ক্ষমতার জন্য গর্ব হচ্ছিল।

‘এগুলো দেখে তোমার ভয় পাওয়ার কী কারণ।’ জিজ্ঞেস করলাম। ‘চমৎকার শক্তিশালী একজোড়া হাত।’

কিন্তু অসহায়, নিশ্চল ভঙ্গিতে তাকিয়েই রইল সে।

‘এমন শক্তিশালী হাত আগে দেখেছ কখনো?’ ওর উদ্দেশে হাসলাম আমি।

‘ওগুলো—ওগুলো নেডের হাত।’ শেষে ফিসফিস করে বলল সে।

গলার কাছে হাত উঠে গেল তার, যেন দম আটকে গেছে। ব্লাউজের ফিতে খুলে গেল। খসে পড়ল ওটা। দীর্ঘ গলা ওর; যেন ঢোঁক গিলতে কষ্ট হচ্ছে। এমনিভাবে ওঠানামা করছে। আমার হাতজোড়া ওটা পেঁচিয়ে ধরতে পারবে কি না, ভাবলাম মনে মনে।

সহসা বুঝতে পারলাম, পারবে এবং আমার হাতজোড়া বিরাট ও পেশিবহুল হওয়ার কারণ, কেন ওগুলোতে শক্তি দেওয়া হয়েছে জানা হয়ে গেল। উঠে গিয়ে ওর গলা টিপে ধরলাম। দুর্বলভাবে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করল সে। চুলোর সঙ্গে মাথা ঠুকে গেল, পিছলে লাল টাইলসের মেঝেয় লুটিয়ে পড়ল। স্থির হয়ে গেল তারপর। কিন্তু আমার হাতের নিচে তখনো নড়ছিল ওর গলাটা। একমুহূর্তের জন্যও হাতের মুঠি শিথিল করলাম না।

একটু পরেই মহিলার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে ওর মাথা তুলে ধরে মেঝের ওপর আস্তে আস্তে ঠুকতে শুরু করলাম। ডিমের খোসার মতো ভেঙে চুরচুর হয়ে যাওয়া পর্যন্ত ক্রমাগত চালিয়ে গেলাম কাজটা। নিথর পড়ে রইল সে। দম আটকে মারা গেছে।

ওকে ওভাবে ফেলেই ও বাড়ি থেকে ছুটে পালিয়ে এলাম। রাস্তায় ওঠার পর মুখের ওপর বৃষ্টির ছাট টের পেলাম। তুষার গলার সময় এসেছে।

ঘুম থেকে যখন জেগে উঠলাম, সকাল হয়ে গেছে। আস্তে আস্তে স্বপ্নের কথা মনে পড়তেই ত্রস্ত হয়ে পড়লাম আমি। নিজের হাতের দিকে তাকালাম। একদম কোমল, ফ্যাকাশে, নাজুক। মুখের কাছে এনে চুমু খেলাম ওগুলোয়।

কিন্তু আধা ঘণ্টা বাদে আমাকে ডাকতে এসে আগের রাতে এক মহিলার খুন হওয়ার বিরাট কাহিনি বলতে শুরু করল মেরি। ডাকপিয়ন কীভাবে দরজা খোলা দেখে লাশের দেখা পেয়েছে জানাল। ‘ইয়ে, মিস, অনেক আগে এখানেই থাকত সে; একবার তো স্বামীর হাতে ঠিক এই কামরাতেই খুন হওয়ার দশা হয়েছিল। গলা টিপে ওকে মারতে চেয়েছিল লোকটা, প্রায় মরতেই বসেছিল। সে জন্যই মালকিন পুরোনো আসবাবের গুদাম বানিয়েছে এটাকে। পরে লোকটাকে পাগলাগারদে পাঠিয়ে দিয়েছিল ওরা। শুনেছি মাসখানেক আগে ওখানেই মারা গেছে।’

আমার মা স্কচ ছিল, দিব্যদৃষ্টির ক্ষমতা থাকার দাবি করত ও। বোঝাই যাচ্ছে, আমাকে সেই গুণ দিয়ে গেছে। দারুণ উত্তেজনা বোধ হচ্ছিল আমার। বিছানায় উঠে বসে মেরিকে আমার স্বপ্নের কথা বললাম।

খুব একটা আগ্রহ দেখাল না সে। লোকে খুব কমই অন্যের স্বপ্নের ব্যাপারে আগ্রহ দেখায়। তা ছাড়া আমার মনে হয় ঘটনাটা মার্গারেট ফুফুকে বলতে অধীর হয়েছিল। চটপট বিদায় নিল সে। বিছানায় শুয়ে পুরো ব্যাপারটা উল্টেপাল্টে দেখলাম। সেটা এত অদ্ভুত আর অকল্পনীয় যে হেসেই ফেলছি।

কিন্তু বিছানা থেকে নামতেই একটা কিছুর সঙ্গে হোঁচট খেলাম। খানিকটা কাদামাখা একপাটি জুতো। প্রথমে তো চিনতেই পারছিলাম না, পরক্ষণেই বুঝলাম আমার সান্ধ্য জুতোর একপাটি ওটা; অন্য পাটিটাও কাছেই পড়ে ছিল। গাঢ় নীল সাটিনের ছোট্ট একজোড়া জুতো, আমার খুব পছন্দের একটা মেয়ের কাছ থেকে পাওয়া উপহার, মাত্র এক সপ্তাহ আগেই ওগুলো আমাকে দিয়েছিল সে।

গত রাতেই কত টাটকা আর স্মার্ট ছিল। এখন আঁচড় লেগে আছে, সাটিন ছিঁড়ে গেছে। কাদা লেপ্টে আছে। কেউ একজন ওগুলো পায়ে বেশ কয়েক মাইল হেঁটেছে।

স্বপ্নে জুতো খুঁজে পেয়ে পরার কথা মনে পড়ে গেল।

কাদামাখা জুতো হাতে সহসা অসুস্থ লাগল, ঝিমুনি এসে গেল; বিছানায় বসেই চকিতে এই রুমেই রাতের পর রাত কাটানো সেই লাল-চুলো লোকটার শুয়ে থাকার চোখ ধাঁধানো ছবি দেখতে পেলাম। পাশে শোয়া ফরসা চেহারার মহিলাকে ঘৃণা করত সে, তাকে গলা টিপে মারার শক্তি আর সাহস চাইত। বহু বছর পর—মৃত্যুতে মুক্তি পেয়ে—এই কামরায় আবার ফিরে আসতে দেখলাম তাকে। দেখলাম তাকে বাধা দিতে দুর্বল, নাজুক একটা মেয়েকে দখল করে নিয়েছে, তাকে পরখ করতে, তার হাত শক্তিশালী করে তুলতে দেখলাম এবং অবশেষে—তার মারফতই—নিজের অসমাপ্ত কাজ শেষ করছে…যেভাবে দেখা দিয়েছিল তেমনি ঝলকের মতো হারিয়ে গেল দৃশ্যটা। নিজেকে সামলে নিলাম আমি। ‘একদম অসম্ভব, যুক্তিহীন।’ বললাম আপনমনে। ‘সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার আগেই ধরা পড়বে খুনি।’

কিন্তু কাদামাখা জুতোজোড়া তখনো আমার হাতে ধরা ছিল। যেন চিরকাল ওভাবে ধরে আছি।

মূলগল্প: লেনক্স রবিনসন
অনুবাদ: শওকত হোসেন

No comments