কনডরের ডানা – ইসমাইল আরমান

কনডরের ডানা – ইসমাইল আরমান

এত বড় পাখি আগে কখনো দেখেনি জিমি পারকার। দানব পাখি বলা চলে অনায়াসে, দুই ডানার বিস্তার অন্তত দশ ফুট—বসে আছে পাহাড়ি রাস্তার মাঝখানে, উড়াল দেওয়ার চেষ্টা করছে।

‘ওরেব্বাপ রে!’ বলে উঠল ও। মাথা ঘুরিয়ে তাকাল বন্ধু অয়ন হোসেনের দিকে। ‘কত বড় পাখি, দেখেছিস?’

‘কাছে যাস নে।’ বলল অয়ন, ‘ওটা ক্যালিফোর্নিয়া কনডর—উত্তর আমেরিকার সবচেয়ে বড় পাখি। মাংস খায়।’

চোখ পিটপিট করে পাখিটাকে ভালো করে দেখল জিমি। বিদঘুটে চেহারা। সাদা শরীর কুচকুচে কালো পালকে ঢাকা, কিন্তু মাথাটা ন্যাড়া। আবারও বিশাল দুই ডানা ঝাপটাল পাখিটা, দেখা গেল ডানার তলায় সাদা পালকে ঢাকা বেশ খানিকটা অংশ। কিন্তু উড়তে পারল না, লাফ দেওয়ার মতো খানিকটা উঠে আবার নেমে এল রাস্তায়। বিষণ্ন চোখে তাকাল অয়ন-জিমির দিকে।

‘অসুস্থ মনে হচ্ছে।’ জিমি বলল, ‘কিংবা আহত। সাহায্য করা দরকার।’

স্কুলের মিড-টার্ম ব্রেক চলছে। ছুটি কাটানোর জন্য ক্যালিফোর্নিয়ার উত্তরাঞ্চলে অয়নের দূর-সম্পর্কের চাচা মেহেদি হাসানের কাছে এসেছে ওরা দুই দিন আগে। অয়নদের মতো তিনি ও তাঁর স্ত্রী প্রবাসী বাঙালি, আমেরিকার নাগরিকত্ব পেয়েছেন। বর্তমানে লস পাদ্রেস ন্যাশনাল পার্ক নামের সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ফরেস্ট রেঞ্জার তিনি। ছেলেমেয়ে নেই মেহেদি চাচার, অয়ন-জিমিকে খুবই আদর করেন চাচা-চাচি। অনেক দিন থেকেই বেড়াতে আসতে বলছিলেন, সে জন্য আসা। তবে এখানে এসে টের পেয়েছে, না এলেই বরং ভুল করত। পাহাড় আর অরণ্যে ঘেরা লস পাদ্রেস ন্যাশনাল পার্ক সত্যিই এক অপূর্ব জায়গা। সভ্যতা থেকে দূরে, প্রকৃতির অকৃত্রিম সৌন্দর্যে অপরূপ। সাইকেলে চড়ে দিনভর বন-পাহাড় ঘুরে বেড়ায় অয়ন-জিমি, উপভোগ করে প্রকৃতিকে। আজও বেরিয়েছিল, পথে দেখা পেয়েছে পাখিটার।

এখনো ওড়ার চেষ্টা করছে কনডর। পারছে না। মায়া হলো জিমির। বলল, ‘গিয়ে ধরব নাকি?’

‘উহুঁ, খুব রিস্কি।’ অয়ন মাথা নাড়ল, ‘খালি হাতে ধরা যাবে না। নেট আর দড়ি লাগবে। কোথাও নিয়ে যেতে চাইলে খাঁচাও দরকার।’

‘ওসব কোথায় পাব?’

ঠোঁট কামড়ে একটু চিন্তা করল অয়ন। তারপর বলল, ‘একজনকে এখানে থাকতে হবে…পাখিটার কাছে। অন্যজন গিয়ে খবর দেবে মেহেদি চাচাকে। ওঁর কাছে পাখি ধরার সমস্ত সরঞ্জাম থাকার কথা। আমিই যাই।’

‘তুই ফেরার আগেই যদি উড়ে চলে যায়?’

‘পারবে বলে মনে হয় না। তা-ও যদি উড়ে যায়, পিছু নিস। কোথায় থামে দেখবি। পাখিটা অসুস্থ, চিকিৎসা দরকার।’

ওর কথা শেষ হতেই বিকট সুরে ডেকে উঠল কনডর, তারপর খ্যাপাটে ভঙ্গিতে ছুটে এল হামলা করার জন্য—ওদের শত্রু ভাবছে। সাইকেল ফেলে পিছিয়ে গেল দুই বন্ধু, প্রয়োজনে ছুট লাগাবে। কিন্তু তার প্রয়োজন হলো না, কিছুদূর এগিয়েই থেমে দাঁড়াল পাখিটা… দুর্বল, এগোতে পারছে না।

পাখিটাকে এখন আরও ভালোমতো দেখতে পাচ্ছে ওরা। বিস্মিত সুরে জিমি বলল, ‘আরে! পাখিটা দেখছি পুরোপুরি কালো না! পা আর ডানায় নীল রং আছে।’

‘অসম্ভব!’ বলল অয়ন, ‘কনডরের রং নীল হয় না।’

‘বললেই হলো?’ প্রতিবাদ করল জিমি, ‘পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি, পা দুটি নীল…ডানায় নীল রঙের পালক!’

‘আমিও দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু এ তো হতে পারে না।’

‘হয়তো অসুখের কারণে নীল হয়ে গেছে। ওই যে, মানুষের কালো চুল পেকে সাদা হয়ে যায় না? অনেকটা সে রকম।’

‘গাধার মতো কথা বলিস কেন?’ অয়নের গলায় বিরক্তি, ‘মানুষের চুল আর পাখির পালক এক জিনিস হলো?’

মুখ থেকে হাসি হাসি ভাবটা মুছে গেল জিমির, ‘তুই আমাকে গাধা বললি? তবে রে!’

মুঠো পাকিয়ে অয়নের দিকে এগোল ও, কিল মারবে।

‘অ্যাই, অ্যাই! করছিস কী!’ এক পা পিছিয়ে গেল অয়ন, ‘মারবি নাকি?’

‘অবশ্যই। নেক্সট টাইম কাউকে গাধা বলার আগে এক শবার চিন্তা করবি…’

তখনই আবার বিকট স্বরে ডেকে উঠল পাখিটা। থমকে গেল জিমি।

অয়ন বলল, ‘মারামারি করবি, নাকি পাখিটাকে সাহায্য করবি, তাড়াতাড়ি ডিসিশন নে।’

‘ধ্যাত্তরি!’ হাতের মুঠো নামিয়ে ফেলল জিমি, ‘ওর জন্য বেঁচে গেলি। এখন জলদি যা। আমি অপেক্ষা করছি।’

সাইকেল কুড়িয়ে নেওয়ার জন্য এগোল অয়ন, সঙ্গে সঙ্গে শোনা গেল ইঞ্জিনের আওয়াজ।

‘গাড়ি!’ আঁতকে উঠে বলল জিমি, ‘পাখিটাকে দেখতে না পেলে চাপা দেবে তো!’

‘থামাতে হবে ওটাকে।’ বলল অয়ন, ‘জলদি চল!’

মোড়ের কাছে ছুটে গেল দুজনে। হাত তুলে চেঁচাতে শুরু করেছে। খানিক পরেই একটা ধূসর রঙের পিকআপ দেখতে পেল। একেবারে ওদের কাছে এসে থামল সেটা। ভেতরে দুজন আরোহী—ড্রাইভিং সিটে ফরেস্ট রেঞ্জারের ইউনিফর্ম পরিহিত মেহেদি চাচা, তাঁর পাশে বসে আছে অচেনা এক যুবক। গাড়ি থামিয়ে দুজনই নেমে এলেন।

‘ওই তো পাখিটা!’ কনডরের দিকে তাকিয়ে বলল যুবক। এরপর চোখ ফেরাল অয়ন-জিমির দিকে, ‘তোমরা খুঁজে পেয়েছ? খুব ভালো।’

‘ইনি মি. শন ক্যাসিডি।’ পরিচয় করিয়ে দিলেন চাচা, ‘জিয়োলজিস্ট। এদিকে একটা মাইনিং সার্ভে টিম কাজ করছে…ওটার মেম্বার। মি. ক্যাসিডি, এ হলো আমার ভাতিজা অয়ন আর ওর বন্ধু জিমি।’

‘নাইস টু মিট ইউ।’ অভিবাদন জানাল অয়ন। তারপর জানতে চাইল, ‘আপনারা পাখিটাকে খুঁজছিলেন কেন?’

‘মি. ক্যাসিডি দূর থেকে পাখিটাকে দেখতে পেয়েছেন—আহত মনে হচ্ছিল, তাই স্টেশনে গিয়ে ডেকে এনেছেন আমাকে।’

‘আপনি কি পাখিরও বিশেষজ্ঞ?’ ক্যাসিডিকে জিজ্ঞেস করল অয়ন।

‘না, না।’ হাসল ক্যাসিডি, ‘আমার কাজকর্ম মাটি আর পাথর নিয়ে। তবে পশুপাখিও খুব ভালোবাসি। তাই কনডরটাকে দেখে মনে হলো, কাউকে খবর দেওয়া দরকার।’

‘পাখিটা নীল কেন, চাচা?’ জিজ্ঞেস করল জিমি, ‘অয়ন বলল, কনডর নাকি নীল হয় না?’

‘ঠিকই বলেছে।’ একমত হলেন চাচা, ‘ব্যাপারটা খুব অদ্ভুত তো! দেখেছেন, মি. ক্যাসিডি?’

‘রং নিয়ে পরে মাথা ঘামানো যাবে।’ ক্যাসিডি বলল, ‘পাখিটাকে আগে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া দরকার। চলুন।’

‘হুঁ। গাড়িতে নেট আর খাঁচা নিয়ে এসেছি। অয়ন-জিমি, এসো, সাহায্য করো আমাদের।’

পরের কাজগুলো বেশ দ্রুত সাড়া হলো। নেট ছুড়ে বন্দী করা হলো পাখিটাকে। এরপর ঢোকানো হলো খাঁচায়। খাঁচাটা তুলে ফেলা হলো পিকআপের পেছনে। সাইকেলসহ অয়ন আর জিমিও উঠল পেছনে।

‘কোথায় যাচ্ছি আমরা?’ জানতে চাইল অয়ন।

‘শহরে।’ চাচা জানালেন, ‘স্থানীয় চিড়িয়াখানায় ডা. মেরি ওয়াল্টার নামের একজন পশু চিকিৎসক আছেন। তাঁর কাছে।’

মুখ ঘুরিয়ে রওনা হলো পিকআপ।

দুই

ডা. মেরি ওয়াল্টারের অফিসটা একতলা একটা ভবনে। সামনের কামরায় বসে আছে সবাই। পাখিটাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ভেতরে। একটু পর বেরিয়ে এলেন ডা. ওয়াল্টার। এমনিতে হাসি-খুশি মহিলা তিনি, কিন্তু এই মুহূর্তে থমথম করছে চেহারা।

‘কী খবর?’ জিজ্ঞেস করলেন মেহেদি চাচা।

‘বিষ খাওয়ানো হয়েছে পাখিটাকে।’ জানালেন ডাক্তার।

‘মারা যাবে না তো?’ শঙ্কিত গলায় প্রশ্ন করল জিমি।

‘এখনো কিছু বলতে পারছি না, জিমি। বিষ খুব বেশি খায়নি, এটুকুই যা সান্ত্বনা। একেবারে সময়মতো উদ্ধার করেছ…ঘণ্টাখানেক পরে হলে কিছু করার থাকত না।’ হতাশায় মাথা নাড়লেন মহিলা, ‘খুবই দুঃখজনক। অতীতে আকাশের রাজা ছিল কনডর—শত শত পাখি উড়ে বেড়াত আমেরিকার এদিকটায়। রেড ইন্ডিয়ানরা ওদের ডাকত থান্ডারবার্ড বলে। বজ্রের মতো গতি ওদের, ঘণ্টায় ত্রিশ থেকে চল্লিশ মাইল গতিতে উড়তে পারে। কিন্তু এখন ওদের অস্তিত্ব বিপন্ন। সব মিলিয়ে মাত্র চল্লিশটা কনডর পাখি বেঁচে আছে বর্তমানে।’

‘এত কমল কীভাবে?’

‘মানুষের উত্পাতে। দিনে দিনে যতই মানুষের বসতি বেড়েছে, ততই কমেছে ওদের বাস করার জায়গা। বন-জঙ্গল ছাড়া খোলা জায়গায় থাকতে পারে না ওরা।’

‘একসময় কনডর পাখি শিকারও করত লোকে।’ যোগ করলেন চাচা, ‘বন্দুকের গুলিতে অনেক পাখি মরেছে অতীতে। শেষ পর্যন্ত আইন করে থামানো হয়েছে ওসব। ক্যালিফোর্নিয়ায় এখন সব ধরনের বড় পাখি…মানে বাজ, শকুন, ইগল আর কনডর শিকার করা নিষিদ্ধ। তারপরও চোরা শিকারিদের ঠেকানো যায় না। একেকটা পাখির মৃত্যু আমাদের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে দাঁড়ায়।’

‘কেন? বংশবৃদ্ধি হয় না ওদের?’

‘প্রতি দুই বছরে মাত্র একটা করে ডিম পাড়ে কনডর।’ এবার মুখ খুলল অয়ন। প্রচুর পড়াশোনা করে ও, কনডর সম্পর্কে জানা আছে তাই। ‘বুঝতেই পারছিস, একটা মারা গেলে সেটার অভাব পূরণ হওয়ার জন্য লাগে দু-দুটো বছর! এর মাঝে দেখা গেল আরও কয়েকটা মরেছে। জন্ম-মৃত্যুর আনুপাতিক হারে বিশাল পার্থক্য। তাই দিনে দিনে কমছে ওদের সংখ্যা।’

‘বাহ্।’ প্রশংসা করলেন ডা. ওয়াল্টার, ‘তুমি দেখছি অনেক কিছু জানো।’

‘স্কুলে সবাই ওকে সবজান্তা বলে ডাকে।’ ফোড়ন কাটল জিমি।

ওর দিকে তাকিয়ে চোখ পাকাল অয়ন।

ক্যাসিডি বলল, ‘কিন্তু কথা হচ্ছে, একটা নিরীহ পাখিকে কে বিষ খাওয়াবে?’

‘আমার মনে হয়, ব্যাপারটা দুর্ঘটনা।’ বললেন ডা. ওয়াল্টার, ‘হিংস্র কয়োট আর পাহাড়ি সিংহ মারার জন্য বিষ ব্যবহার করে স্থানীয় চাষি আর র্যাঞ্জাররা। সেই বিষই গেছে কনডরটার পেটে।’

‘কীভাবে?’ জানতে চাইল জিমি।

‘শকুনের মতো কনডরও ক্যারিয়ন ফিডার…মানে মরা পশুপাখির মাংস খায়। হয়তো বিষ খেয়ে মরা কোনো কয়োট বা সিংহের মাংস খেয়েছে ওটা।’

‘এ মা! কী বিশ্রী ব্যাপার! ওটা লাশ খায়?’

হেসে উঠলেন মেহেদি চাচা। ‘অত ঘেন্নার কিছু নেই, জিমি। এরা যদি না খেত, তাহলে লাশগুলো পচে পরিবেশ দূষিত হতো, রোগ ছড়াত। ক্যারিয়ন ফিডাররা প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করে।’

‘আমেরিকার জাতীয় পাখি, মানে বল্ড ইগলও কিন্তু ক্যারিয়ন ফিডার।’ অয়ন বলল, ‘সাগরতীরে পড়ে থাকা মরা মাছ খায় ওরা, সৈকতকে পরিচ্ছন্ন রাখে।’

‘হয়েছে, ক্যারিয়ন ফিডার নিয়ে আর জানতে চাই না।’ মুখ বাঁকা করে বলল জিমি, ‘এসব যত কম জানা যায়, ততই ভালো। যা হোক, ধরলাম বিষাক্ত মাংস খেয়েছে পাখিটা। কিন্তু ওটা নীল হলো কী করে?’

‘এখনো জানি না।’ ডা. ওয়াল্টার বললেন, ‘তবে খুব শিগগির জানতে পারব।’

তাঁর কথা শেষ হতেই বাইরে একটা জিপ এসে থামল। মোটাসোটা, লালমুখো এক লোক নেমে এল সেটা থেকে। ভেতরে ঢুকে খেঁকিয়ে উঠল বিশ্রীভাবে।

‘তুমি এখানে, ক্যাসিডি? আর আমি তোমাকে খুঁজে খুঁজে হয়রান! করছটা কী?’

‘দুঃখিত, মি. স্যান্ডার্স।’ বলল ক্যাসিডি। তারপর তাকে পরিচয় করিয়ে দিল সবার সঙ্গে, ‘ইনি মি. স্যামুয়েল স্যান্ডার্স। আমাদের মাইনিং সার্ভে টিমের চিফ…আমার বস।’

দায়সারা ভঙ্গিতে সবার উদ্দেশে মাথা ঝাঁকাল স্যান্ডার্স। অসুস্থ পাখিটার কথা তাকে খুলে বলল ক্যাসিডি।

‘চুলোয় যাক পাখি।’ বিরক্ত গলায় বলল স্যান্ডার্স, ‘আমাদের হাতে আরও জরুরি কাজ আছে। জলদি চলো।’

উল্টো ঘুরে বেরিয়ে গেল সে। ক্যাসিডিকে বিব্রত দেখাল। নিচু স্বরে বিদায় নিয়ে বসকে অনুসরণ করল সে। স্টার্ট দিয়ে চলে গেল জিপটা।

মেহেদি চাচা বললেন, ‘আমারও যাওয়া দরকার। পাখিটা কোথায় বিষাক্ত মাংস খেয়েছে, তা খুঁজে বের করব। মৃত পশু সরিয়ে না নিলে আরও পশুপাখি অসুস্থ হতে পারে।’

‘কীভাবে খুঁজবেন?’ জিজ্ঞেস করল অয়ন, ‘জঙ্গল তো অনেক বড়।’

‘কনডরটাকে প্রথম যেখানে দেখেছিলেন, সেই জায়গা চিনিয়ে দিয়েছেন মি. ক্যাসিডি। মৃত পশুটা কাছাকাছি কোথাও পাওয়া যাবে নিশ্চয়। অসুস্থ অবস্থায় পাখিটা খুব বেশি দূর উড়তে পেরেছে বলে মনে হয় না।’

এমন সময় ভেতর থেকে ডাক পড়ল ডা. ওয়াল্টারের। ওদের অপেক্ষা করতে বলে চলে গেলেন তিনি। ফিরে এলেন কয়েক মিনিট পর। খুশি খুশি গলায় বললেন, ‘সুখবর! বিপদ কেটে গেছে। পাখিটাকে বাঁচানো যাবে।’

স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল সবাই।

অয়ন জানতে চাইল, ‘নীল রঙের রহস্য ভেদ হয়েছে?’

‘হ্যাঁ। ওটা পেইন্ট…নীল রঙের পেইন্ট। তবে বাজারে যেসব পাওয়া যায়, সেই পেইন্ট নয়। বিশেষ ধরনের পেইন্ট।’

মাথা ঝাঁকালেন মেহেদি চাচা। ‘আমি তাহলে যাই। বনে গিয়ে তল্লাশি শুরু করি। অয়ন, জিমি, তোমরা নিজে নিজে বাড়ি ফিরতে পারবে তো?’

‘আপত্তি না থাকলে আমরা আপনার সঙ্গেই যেতে চাই, চাচা।’ বলল অয়ন, ‘তল্লাশিতে সাহায্য করতে পারব।’

‘আপত্তি কিসের? দলে ভারী হলে তো আমারই সুবিধে। ভালোমতো খুঁজতে পারব।’

ডা. ওয়াল্টারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে হাঁটতে শুরু করল তিনজনে।

‘কী খুঁজতে যাচ্ছি?’ অয়নকে জিজ্ঞেস করল জিমি, ‘লাশ?’

‘এবং নীল পেইন্ট।’ বলল অয়ন, ‘কোথাও একটা ঘাপলা আছে, জিমি। বিষের সঙ্গে পেইন্টের কী সম্পর্ক, সেটা জানতে চাই আমি।’

তিন

মেহেদি চাচার পিকআপে চড়ে পাহাড়ের গোড়ায় একটা খোলা জায়গায় পৌঁছাল অয়ন-জিমি। এখান থেকে মাইলখানেক দূরে কনডরটাকে খুঁজে পেয়েছিল ওরা। খোলা জমিনটার এক পাশে তারকাঁটার বেড়া, অন্য পাশে একটা শুকনো ঝরনা—পানি নেই, খটখট করছে মাটি। ঝরনার কিনার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে ওকগাছের সারি।

‘এদিক থেকেই পাখিটাকে উড়তে দেখেছিলেন মি. ক্যাসিডি।’ চাচা বললেন, ‘চলো, ছড়িয়ে পড়া যাক। কিছু খুঁজে পেলে আমাকে চিৎকার করে ডেকো।’

বেশি সময় লাগল না, দশ মিনিটের মাথায় একটা মরা কয়োট দেখতে পেল জিমি। ওর ডাক শুনে ছুটে এলেন মেহেদি চাচা আর অয়ন।

‘নাহ্, এটা না।’ লাশটা পরীক্ষা করে বললেন চাচা, ‘এর গায়ে কোনো ক্ষত নেই। তার মানে এটার মাংস খায়নি আমাদের কনডর। আরেকটু দেখতে হবে। দাঁড়াও, তার আগে এই লাশটার একটা বন্দোবস্ত করি।’

পিকআপ থেকে একটা বেলচা নিয়ে এলেন তিনি। মাটিতে গর্ত খুঁড়ে তাতে চাপা দিলেন লাশটা। এরপর আবারও খুঁজতে শুরু করল তিনজনে।

একটু পর অয়নের ডাক শোনা গেল। নীল পেইন্ট খুঁজে পেয়েছে ও। শুকনো ঝরনার তলদেশে, বড় একটা পাথরের গায়ে চকচক করছে নীল রং। প্রায় শুকিয়ে এসেছে রংটা, তার মাঝে দেখা যাচ্ছে আঁচড় আর ঘষাঘষির দাগ—কিছু একটা শরীর ঘষেছে ওখানে। কাছেই পড়ে আছে একটা খালি টিন।

এগিয়ে গিয়ে টিনটা পরীক্ষা করল অয়ন। কোনো লেবেল নেই। চাচাকে জানাল সেটা।

‘ডা. ওয়াল্টারের কথার সঙ্গে মিলে যাচ্ছে।’ বললেন মেহেদি চাচা, ‘বিশেষ ধরনের পেইন্ট। দোকান থেকে কেনা নয়।’

কনডরের ডানা
অলংকরণ: আরাফাত করিম
পেইন্ট থেকে দশ গজ দূরে লাশটাও পাওয়া গেল। আরেকটা মরা কয়োট, ঝোপের পেছনে থাকায় দূর থেকে দেখা যায়নি। লাশের শরীর থেকে ঠোকর দিয়ে তুলে নেওয়া হয়েছে অনেকখানি মাংস। সামনে একটা বড়সড় মাংসের টুকরাও পড়ে আছে—তবে সেটা ভিন্ন, কয়োটের নয়। ছুরি বা অন্য কোনো ধারালো অস্ত্র দিয়ে কেটে পিস করা।

‘এটাই মনে হচ্ছে।’ বললেন চাচা। অনুমান করলেন কী ঘটেছে, ‘বিষ মাখানো ওই মাংস খেয়ে মারা গেছে কয়োটটা। আর কনডর খেয়েছে কয়োটের মাংস। খেতে খেতেই নিশ্চয় অসুস্থ হয়ে পড়েছিল, তখন উড়তে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে ওই পেইন্টের মাঝখানে। সেখানেই কিছুক্ষণ ডানা ঝাপটে আবার ওড়ার শক্তি সঞ্চয় করেছে। কিন্তু বেশি দূর যেতে পারেনি, মাইলখানেক যেতেই দুর্বল হয়ে পড়ে গিয়েছিল রাস্তার মাঝখানে।’

‘কী যেন মিলছে না।’ অয়ন বলল, ‘কিন্তু এখানে পেইন্ট এল কোত্থেকে?’

কাঁধ ঝাঁকালেন মেহেদি চাচা। তাঁর জানা নেই।

খালি টিনটা পরীক্ষা করছে জিমি। ও বলল, ‘তলায় একটা ফুটো দেখতে পাচ্ছি। ফোঁটায় ফোঁটায় পেইন্ট পড়েছে ওখান দিয়ে। ফলো করা যেতে পারে।’

‘কেউ একজন পা-ও ফেলেছে পেইন্টে।’ কাছে এসে বলল অয়ন। ইশারা করল মাটির দিকে।

‘গুড অবজারভেশন।’ প্রশংসা করলেন চাচা, ‘চলো, দেখা যাক কোত্থেকে এসেছে এই পেইন্ট।’

একটু খুঁজতেই পাওয়া গেল আরও রঙের ফোঁটা। রওনা হওয়ার আগে লাশটা আবারও গর্ত করে মাটিচাপা দেওয়া হলো। বিষ মাখানো মাংসের টুকরোটা একটা প্লাস্টিকের ব্যাগে ভরে নিলেন চাচা। তারপর ফোঁটাগুলো অনুসরণ করতে শুরু করল ওরা। বেড়া পেরিয়ে পাহাড়ের ভেতর দিকে চলে গেছে ওগুলো।

কিছুক্ষণ পর একটা চওড়া ক্যানিয়নে পৌঁছাল ওরা। রঙের ফোঁটা চলে গেছে খোলা সমতলভূমিতে—সেখানে ফসলের খেত।

‘বাড়িঘর দেখতে পাচ্ছি।’ বললেন চাচা।

চোখ পিটপিট করল অয়ন। ধূসর রঙের দুটো বাড়ি, বড় একটা গোলাঘর আর বিশাল আঙিনা দেখতে পাচ্ছে। হঠাৎ ও উত্তেজিত গলায় বলল, ‘আরে! ওটা তো মি. আলভারেজের ফার্ম! জিমি, চিনতে পারছিস?’

‘তাই তো!’ জিমি সুর মেলাল।

মেহেদি চাচাও চেনেন হুয়ান আলভারেজকে। স্থানীয় চাষি। চাষাবাদ আর কুমোরের কাজ করে জীবিকা চালান। স্ত্রী আর দুই ছেলেকে নিয়ে থাকেন ওই ফার্মে। ছেলেরা বড় হয়ে গেছে, দুজনই বিবাহিত। ভালো করে তাকিয়ে নিশ্চিত হয়ে নিলেন চাচা—হ্যাঁ, আলভারেজের ফার্মই বটে। ছেলেদের জিজ্ঞেস করলেন, ‘ওদের তোমরা কীভাবে চেনো?’

‘সেদিন সাইকেল চালাতে চালাতে এসেছিলাম এদিকে।’ বলল অয়ন, ‘তেষ্টা পেয়েছিল, তাই গিয়ে পানি চাইলাম। তখনই পরিচয় হলো। খুব ভালো মানুষ। পানির সঙ্গে চা-নাশতাও খাওয়ালেন। অনেক গল্প করলেন আমাদের সঙ্গে।’

‘হুম।’ গম্ভীর হয়ে গেলেন চাচা, ‘চলো, ওদের সঙ্গে কথা বলা যাক।’

ক্যানিয়ন থেকে বেরিয়ে ফার্মে ঢুকে পড়ল ওরা। আঙিনায় ঘোরাফেরা করছে মুরগির দল, গরু চরছে ঘেসো জমিতে, খুঁটির সঙ্গে বাঁধা রয়েছে ঘোড়া। একপাশে একটা বড় চুল্লি দেখা গেল—আগুনে পুড়িয়ে মাটির পাত্র তৈরি করা হয়। সে রকম বেশ কিছু পাত্র শুকাতে দেওয়া হয়েছে রোদে। পাত্রগুলোর গায়ে লাল, নীল আর হলুদ রং।

ওদের দেখতে পেয়ে সামনের বাড়ি থেকে এলেন হুয়ান আলভারেজ। বয়স্ক মানুষ, মুখভর্তি কাঁচা-পাকা দাড়ি। দোরগোড়ায় মিসেস আলভারেজকেও দেখা গেল।

‘আ রে! মি. মেহেদি যে!’ হাসিমুখে বললেন আলভারেজ, ‘অয়ন-জিমিও আছে দেখছি! কী খবর?’

‘একটা কাজে এসেছি, মি. আলভারেজ।’ বললেন মেহেদি চাচা। সংক্ষেপে কনডর আর মৃত কয়োটের কথা জানালেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, ‘কিছু মনে করবেন না, আপনারা কি বনের ভেতরে বিষ মাখানো মাংস ছড়াচ্ছেন? কাজটা কিন্তু বেআইনি।’

‘মানে! আমরা বিষ ছড়াতে যাব কেন?’

‘হয়তো কয়োট আপনার মুরগি চুরি করছে। সে জন্য…’

‘অমন কিছুই ঘটেনি, মি. মেহেদি।’ একটু যেন রেগে গেলেন আলভারেজ, ‘ঘটলেও বিষ ছড়ানোর মানুষ নই আমরা।’

‘দেখতে পাচ্ছি আপনারা নীল পেইন্ট ব্যবহার করেন।’ শুকাতে দেওয়া মাটির পাত্রগুলোর দিকে ইশারা করলেন চাচা, ‘রংটা কোথায় রাখেন, দেখাতে পারেন?’

মাথা ঝাঁকালেন আলভারেজ। সবাইকে নিয়ে গেলেন গোলাঘরে। ভেতরে স্টোররুম রয়েছে, সেটার তালা খুলে মেলে ধরলেন পাল্লা। থরে থরে সাজানো অনেকগুলো টিনের দেখা মিলল। টিনগুলো বনে পাওয়া টিনটার মতো।

‘লেবেল দেখছি না একটাতেও।’ বললেন চাচা, ‘কী পেইন্ট এগুলো?’

‘আমাদের নিজেদের বানানো।’ বললেন আলভারেজ, ‘সাধারণ পেইন্ট তো চুল্লির তাপ সইতে পারে না। তাই নিজেদেরই বানিয়ে নিতে হয়। ভালোই খরচা আছে ওতে, উপকরণগুলো বেশ দামি কিনা।’

‘কোনোটা কি খোয়া গেছে এখান থেকে?’ জানতে চাইলেন চাচা।

‘মনে হয় না।’ মাথা নাড়লেন আলভারেজ। হাতছানি দিয়ে ডাকলেন গোলাঘরে কাজ করতে থাকা এক যুবককে, ‘এ আমার ছেলে হিউগো।’ পরিচয় করালেন তিনি। তারপর ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘হিউগো, আমাদের কোনো রঙের টিন কি হারিয়েছে?’

‘না।’ বলল হিউগো, ‘স্টোরটা সব সময় তালা দিয়ে রাখি। হারানোর সুযোগ নেই।’

ঝুঁকে দরজার পাল্লা পরীক্ষা করলেন মেহেদি চাচা। বললেন, ‘তালাটা খুব ভালো কোয়ালিটির নয়। চেষ্টা করলে চাবি ছাড়াই খোলা যাবে।’

‘আপনি আমার পেইন্ট নিয়ে ব্যস্ত হলেন কেন?’ জিজ্ঞেস করলেন আলভারেজ।

মরা কয়োটের কাছে পেইন্ট পাওয়ার কথা বললেন চাচা। তারপর বললেন, ‘আমরা ওই পেইন্টের দাগ অনুসরণ করে এ-পর্যন্ত এসেছি।’

‘কোথাও ভুল হচ্ছে আপনার, মি. মেহেদি।’ বললেন আলভারেজ, ‘আমরা বিষ মাখানো মাংস ছড়াইনি।’

গোলাঘরের ভেতরটা ঘুরে ঘুরে দেখছিল অয়ন আর জিমি। হঠাৎ অয়ন চেঁচিয়ে উঠল, ‘চাচা! দেখে যান!’

এগিয়ে গেলেন মেহেদি চাচা। নীল রঙের কতগুলো পায়ের ছাপ ফুটে আছে মাটিতে, সেগুলো চলে গেছে একটা পুরোনো রেফ্রিজারেটরের দিকে।

‘পোষা কুকুরটাকে খাওয়ানোর জন্য আমরা মাংস রাখি ওখানে।’ হিউগো জানাল।

ফ্রিজ খুললেন চাচা। ভেতরে রাখা হয়েছে কিছু মাংসের টুকরো। হাত বাড়িয়ে দুটো টুকরো বের করে আনলেন তিনি। নাকের কাছে নিয়ে গন্ধ শুঁকলেন। সঙ্গে সঙ্গে ভাঁজ পড়ল তাঁর কপালে।

‘কী হয়েছে, চাচা?’ জিজ্ঞেস করল অয়ন।

‘মাংসটায় অদ্ভুত একটা গন্ধ পাচ্ছি।’ বললেন চাচা। পকেট থেকে প্লাস্টিকের প্যাকেট বের করে তাতে ভরে ফেললেন টুকরো দুটো, ‘এগুলো আমি টেস্ট করাব। কিছু মনে করবেন না, মি. আলভারেজ, টেস্টের রেজাল্ট না পাওয়া পর্যন্ত আপনারা দয়া করে ফার্ম ছেড়ে কোথাও যাবেন না।’

অপমানিত বোধ করলেন আলভারেজ। রাগী গলায় বললেন, ‘মানে কী? আপনার কি ধারণা, আমরা পালিয়ে যাব?’

‘আমি সে-কথা বলিনি…’

‘কী বলেছেন, তা আমি খুব ভালো করেই বুঝতে পেরেছি, মি. মেহেদি। ভয় নেই, আমরা কোথাও যাচ্ছি না। কারণ আমরা নিরপরাধ। যান, যত খুশি টেস্ট করুন মাংসের।’

চার

লাঞ্চের পর চাচার বাড়ির বারান্দায় বসে আছে অয়ন-জিমি। বারান্দা থেকে বন আর পাহাড়ের অনেকখানি চোখে পড়ে, চুপচাপ সেদিকে তাকিয়ে রইল ওরা। খানিক পর অয়নের কপালে ভাঁজ লক্ষ করে জিমি জিজ্ঞেস করল, ‘কী ভাবছিস?’

‘মি. আলভারেজের কথা।’ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল অয়ন, ‘কেন যেন মনে হচ্ছে, চাচা ভুল করছেন।’

‘বিষ মাখানো মাংস অন্য কেউ ছড়াচ্ছে বলতে চাস? কিন্তু সমস্ত প্রমাণ তো আলভারেজদের ফার্মের দিকে গেছে।’

‘তা ঠিক। কিন্তু তারপরও কেন যেন বিশ্বাস করতে পারছি না।’

‘আমারও মন খুঁতখুঁত করছে।’ স্বীকার করল জিমি, ‘কিন্তু আর কোনো ব্যাখ্যা তো নেই।’

‘হয়তো কেউ ফাঁসাতে চাইছে মি. আলভারেজকে।’ অনুমান করল অয়ন।

‘কেন? কী লাভ তাতে? আলভারেজরা ধনী নয়, টাকাপয়সা নেই ওদের। ছোট্ট একটা ফার্ম আর সামান্য জমিজমার মালিক। কে শত্রুতা করবে তাঁদের সঙ্গে?’

‘বুঝতে পারছি না। কিন্তু এর ভেতরে কিছু একটা রহস্য থাকতে বাধ্য। তদন্ত করে দেখা দরকার।’

‘কিসের তদন্ত করবি? কোনো সূত্রই তো চোখে পড়ছে না। কেউ যদি ফাঁসিয়েও থাকে, খুব ভালোমতো ফাঁসিয়েছে। আলভারেজদের পেইন্ট লেগে আছে কনডরের গায়ে…ফ্রিজে মাংসের টুকরা…আর গোলাঘরে নীল রঙের পায়ের ছাপ…’

ঝট করে বন্ধুর দিকে তাকাল অয়ন। চোখ জ্বলজ্বল করছে উত্তেজনায়।

‘কী হলো?’ বিস্মিত হয়ে বলল জিমি, ‘ওভাবে তাকাচ্ছিস কেন?’

‘পায়ের ছাপ!’ উত্তেজিত গলায় বলল অয়ন। ‘পায়ের ছাপগুলো অনুসরণ করিনি আমরা!’

‘করলেই বা কী লাভ হতো?’ ঠোঁট ওল্টাল জিমি, ‘বন থেকে আলভারেজদের গোলাঘরেই এসেছে ওগুলো—দেখিসনি?’

‘আসার কথা বলছি না রে, গাধা! বলছি যাওয়ার কথা!’

স্থির হয়ে গেল জিমি। বলল, ‘আবারও আমাকে গাধা বললি তুই?’

‘ধ্যাত্তরি! ওটা তো কথার কথা। খামোখা মাথা গরম না করে আমি যা বলছি, সেটা ভেবে দেখ।’

‘কী ভাবব? হিব্রু ভাষায় কথা বললে বুঝব কী করে?’

‘আমি হিব্রু ভাষায় কথা বলছি?’

‘নয়তো কী? কিসের যাওয়া, আর কিসের আসা? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।’

‘পায়ের ছাপের কথা বলছি। বন থেকে গোলাঘর পর্যন্ত এসেছে ধরে নিলাম। কিন্তু তারপর? কোথায় গেল ওগুলো? ফ্রিজের সামনে থেকে নিশ্চয় লোকটা হাওয়ায় মিলিয়ে যায়নি?’

‘তাই তো!’ এবার জিমির টনক নড়ল, ‘ওগুলো ফলো করলেই সব পরিষ্কার হয়ে যায়! যদি মি. আলভারেজের বাড়ির ভেতরে ঢোকে, তাহলে ধরে নিতে হবে, তারাই দোষী। আর যদি সেটা না হয়…’

‘অন্য কেউ জড়িত।’ বলল অয়ন, ‘পায়ের ছাপ অনুসরণ করলেই তার খোঁজ পাওয়া যাবে।’

‘কিন্তু লোকটা কি ইচ্ছে করে ছাপ রেখে যাবে?’ জিমির গলায় দ্বিধা।

‘আমার মনে হয় না ছাপের ব্যাপারটা ইচ্ছাকৃত।’ অয়ন মাথা নাড়ল, ‘মি. আলভারেজকে ফাঁসানোর জন্য পেইন্টের ফোঁটাগুলোই যথেষ্ট ছিল। আমার ধারণা, নিজের অজান্তে জুতায় রং লেগেছিল লোকটার। ওভাবেই হেঁটে চলে এসেছিল গোলাঘর পর্যন্ত। আর সে ক্ষেত্রে ফিরে যাওয়ার পথেও ছাপ থাকতে বাধ্য।’

‘গিয়ে দেখা দরকার।’ বলল জিমি, ‘কখন যেতে চাস?’

‘এখনই।’ উঠে দাঁড়াল অয়ন, ‘প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে নে—পানির বোতল, টর্চলাইট আর অন্যান্য টুকিটাকি। কত দূর যেতে হয়, কোনো ঠিক নেই।’

সাইকেলে চেপে বিশ মিনিটের মাথায় আলভারেজের ফার্মে পৌঁছাল দুই বন্ধু। মি. আলভারেজ ও তাঁর দুই ছেলে বাড়িতে নেই, ফসলের মাঠে কাজ করতে গেছেন। মিসেস আলভারেজের সঙ্গে দেখা করল ওরা, ফার্মের ভেতরটা একটু ঘুরেফিরে দেখতে চাইল। আপত্তি করলেন না ভদ্রমহিলা, খুশিমনেই অনুমতি দিলেন।

প্রথমে গোলাঘরের ভেতরটা দেখল দুই বন্ধু, এরপর ঘুরে দেখল বাইরের চারপাশ। নীল রঙের পায়ের ছাপ পাওয়া গেল গোলাঘরের পেছন দিকে। পাহাড়সারির মাঝে, একটা গিরিপথের দিকে চলে গেছে ছাপগুলো।

‘যাবি ওদিকে?’ অয়নকে জিজ্ঞেস করল জিমি।

‘অবশ্যই।’ অয়ন বলল, ‘না গেলে ছাপের মালিককে খুঁজে পাব কী করে?’

‘বড় কাউকে সঙ্গে নিয়ে গেলে কেমন হয়?’

‘কাকে নেব? কেউ তো নেই ফার্মে। তা ছাড়া সন্ধ্যাও হয়ে যাবে খুব শিগগির। রাতে আর অনুসরণ করা যাবে না ছাপগুলো। আগামীকাল সকাল নাগাদ মুছেও যেতে পারে। উহুঁ, যা করার এখনই করতে হবে…এবং সেটা আমাদেরই।’

কাঁধ ঝাঁকাল জিমি, ‘বেশ!’

মিসেস আলভারেজের সঙ্গে আবার দেখা করল দুই বন্ধু। সাইকেল দুটি রেখে যাওয়ার কথা বলে রওনা হলো গিরিপথের দিকে।

শুরুতে মোটামুটি সহজেই অনুসরণ করা গেল ছাপগুলো। তবে খানিক পরেই আবছা হতে থাকল ছাপ—নীল রং মুছে যেতে শুরু করেছে। মাটিতে দাগ দেখে কোনোমতে এগিয়ে চলল দুই বন্ধু। মাইল তিনেক যাওয়ার পর একেবারেই হারিয়ে ফেলল ট্র্যাক। থেমে দাঁড়াল দুজনে।

সামনে একটা খাড়া পাহাড়ি ঢাল। ওপরের দিকে তাকিয়ে অয়ন বলল, ‘একটা গুহা দেখতে পাচ্ছি।’

‘ওপরে উঠেছে লোকটা?’ জিমির প্রশ্ন।

‘সে রকমই মনে হচ্ছে। আর কিছু না হোক, ওপরে উঠলে আশপাশটা ভালো করে দেখতে পাব।’

পিঠ থেকে হ্যাভারস্যাক নামিয়ে রাখল দুই বন্ধু। বাড়তি ওজন বইবার প্রয়োজন দেখছে না। এরপর ঢাল ধরে উঠতে শুরু করল ওপরে। খানিক পরেই পৌঁছে গেল চাতালের মতো একটা খোলা জায়গায়। সামনেই গুহামুখ, ভেতরটা অন্ধকারে ছাওয়া।

‘সাপ-টাপ নেই তো?’ শঙ্কা প্রকাশ করল জিমি।

নিচের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট কামড়াল অয়ন। ‘টর্চগুলো হ্যাভারস্যাকে ফেলে এসেছি। খুব ভুল হয়েছে।’

‘তাহলে?’

পকেট হাতড়াল অয়ন, ‘দেশলাই আছে আমার কাছে। তা-ই দিয়ে কাজ চালাতে হবে। আয়।’

একটা কাঠি জ্বালল ও। সেটা সামনে ধরে ঢুকে পড়ল গুহায়। ছোট গুহা, ভেতরটা খালি। প্রথম কাঠিটা নিভে গেলে আরেকটা জ্বালল অয়ন, স্বল্প আলোয় খুঁটিয়ে দেখল ভেতরটা। নাহ্, কিছুই নেই। চারদিকে পাথুরে দেয়াল আর ধুলোর রাজত্ব। হতাশ হয়ে উল্টো ঘুরতে যাবে, এমন সময় ভেসে এল একটা বাজখাঁই গলা।

‘খবরদার! একচুল নড়বে না!’

পাঁই করে ঘুরল দুই বন্ধু। স্থির হয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে। বিদ্ঘুটে চেহারার এক বুড়ো দাঁড়িয়ে আছে গুহার সামনে। গায়ে ঢোলা ওভারঅল আর তালি মারা শার্ট। মুখে দাড়ি-গোঁফের জঙ্গল। চোখ দুটি টকটকে লাল। হাতে পুরোনো আমলের একটা রাইফেল।

‘পালা!’ নিচু গলায় জিমিকে বলল অয়ন।

পরক্ষণে ছুট লাগাল দুজনে।

‘অ্যাই! অ্যাই!! কোথায় যাচ্ছ?’ চেঁচিয়ে উঠল বুড়ো। দুই হাত বাড়িয়ে ধরার চেষ্টা করল ওদের।

বাউলি কেটে তাকে ফাঁকি দিল অয়ন-জিমি। নিচু হয়ে হাতের তলা দিয়ে বেরিয়ে এল গুহা থেকে। থামল না, চাতাল পেরিয়ে নেমে পড়ল ঢালে। বিপজ্জনক গতিতে নেমে যাচ্ছে পাহাড় থেকে।

‘থামো বলছি!’ আবার চেঁচাল বুড়ো। বন্দুক উঁচিয়ে তাড়া করল ওদের।

কে শোনে কার কথা! পাগলের মতো ছুটছে অয়ন-জিমি। আছাড় খেতে খেতে খেল না, ঢাল পেরিয়ে নেমে এল মাটিতে। নিচে পৌঁছেও গতি কমাল না, একদিকে মোড় নিয়ে ছুটে চলল। সামনে ঘন গাছগাছালি, ঢুকে পড়ল তার ভেতরে। পেছনে আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেল বন্দুকধারী লোকটার পায়ের আওয়াজ। তা-ও থামল না দুজনে, দৌড়ে চলেছে প্রাণপণে।

হঠাৎ কার সঙ্গে যেন ধাক্কা খেল জিমি। একজন মানুষ…বেরিয়ে এসেছে ছায়া থেকে। তার গায়ের ওপর গিয়ে পড়ল ও। ধাক্কা খেয়ে ভারসাম্য হারাল, আধপাক ঘুরে পড়ে যেতে থাকল মাটিতে। খপ করে ওর হাত ধরে ফেলল লোকটা।

‘অ্যাই! হচ্ছে কী?’ শোনা গেল কড়া গলা, ‘দেখে চলতে পারো না?’

মোচড় দিয়ে হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করল জিমি, কিন্তু একচুল আলগা হলো না লোকটার হাতের মুঠি। বরং একটা ঝাঁকি দিয়ে ওকে সিধে করানো হলো।

‘সোজা হয়ে দাঁড়াও।’ ধমকে উঠল লোকটা।

‘অয়ন!’ চেঁচিয়ে উঠল জিমি।

পাঁচ

চোখ পিটপিট করল লোকটা। তারপর বিস্মিত গলায় বলে উঠল, ‘আরে! তুমি জিমি না?’

পায়ের শব্দ শোনা গেল। অয়ন এসে পড়েছে। সে-ও থমকে দাঁড়াল। অবাক হয়ে বলল, ‘মি. ক্যাসিডি?’

এবার সোজা হয়ে লোকটার মুখের দিকে তাকাল জিমি। শন ক্যাসিডিই বটে। পেছনে তার জিপ দাঁড়িয়ে আছে। বিব্রত গলায় বলল, ‘সরি, মি. ক্যাসিডি। আপনাকে দেখতে পাইনি।’

‘বনের ভেতর তোমরা এভাবে ছোটাছুটি করছ কেন?’ জিজ্ঞেস করল ক্যাসিডি, ‘খেলাধুলার জন্য আর কোনো জায়গা পেলে না?’

‘আমরা খেলছি না, মি. ক্যাসিডি।’ অয়ন বলল, ‘বন্দুক হাতে একটা লোক তাড়া করেছে আমাদের।’

‘বন্দুক?’ ভ্রুকুটি করল ক্যাসিডি। দুই বন্ধুর পেছন দিকটায় ইতিউতি তাকাল, ‘কই, কাউকে দেখছি না তো।’

‘বোধ হয় আপনাকে দেখে পালিয়েছে।’ বলল জিমি, ‘বুড়োমতো একটা লোক—মুখভর্তি কাঁচাপাকা দাড়িগোঁফ, গায়ে ওভারঅল।’

‘হুম। নিশ্চয়ই বুড়ো কালাহান। এদিকেই থাকে সে।’

‘কে এই কালাহান?’ জানতে চাইল অয়ন।

‘পাগলাটে এক বুড়ো। চালচুলো নেই। বনের ভেতরে একটা কুঁড়েঘরে থাকে। বাইরের লোকজনকে একদমই পছন্দ করে না। শুরুর দিকে আমাদের সার্ভে টিমকেও প্রচুর যন্ত্রণা দিয়েছে।’

‘আরেকটু হলেই আমাদের খুন করত।’ বলল জিমি।

‘আরে নাহ্।’ হাসল ক্যাসিডি, ‘অত খারাপ ও না। ভয় দেখিয়ে সবাইকে দূরে সরিয়ে রাখতে চায়, এই আর কি।’

‘কাজটায় ও শতভাগ সফল।’ তিক্ত গলায় বলল জিমি, ‘আমার বুকের ধড়ফড়ানি জিন্দেগিতে যাবে না। বাপ রে বাপ, কী দৌড়টাই না দিয়েছি! আমাদের ব্যাগট্যাগ সব রয়ে গেছে ওখানে।’

‘ব্যাগ ফেলে এসেছ? চলো, নিয়ে আসা যাক। তারপর আমাদের ক্যাম্পে নিয়ে যাব তোমাদের।’

‘বুড়ো আবার তাড়া করবে না তো?’ শঙ্কা প্রকাশ করল অয়ন।

‘ভয়ের কিছু নেই।’ ক্যাসিডি বলল, ‘আমি তো আছি তোমাদের সঙ্গে। চলো।’

পাহাড়ের কাছে ফিরে গেল ওরা। ঢালের গোড়ায় পড়ে আছে দুই বন্ধুর হ্যাভারস্যাক। পাগলাটে বুড়োকে দেখা গেল না কোথাও। হ্যাভারস্যাক কুড়িয়ে নিল অয়ন-জিমি, খানিক পরেই ক্যাসিডির জিপে চড়ে রওনা হলো মাইনিং সার্ভে টিমের ক্যাম্পের উদ্দেশে।

বেশিক্ষণ লাগল না পৌঁছাতে। খোলা এক টুকরো জমিতে স্থাপন করা হয়েছে ছোট্ট ক্যাম্পটা। সব মিলিয়ে ছয়টা তাঁবু খাটানো হয়েছে। ট্রাক, জিপ আর মাইনিংয়ের বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি দেখা গেল সেগুলোর আশপাশে। তাঁবুগুলোর সামনে, খোলা আকাশের নিচে রাখা হয়েছে লম্বা কিছু টেবিল, সেখানে বসে কাজ করছে টিমের সদস্যরা। তাদের সামনে ল্যাপটপ কম্পিউটার, বইপত্র আর ম্যাপ।

জিপ থামতেই একটা তাঁবু থেকে বেরিয়ে এল মাইনিং টিমের চিফ স্যান্ডার্স। অয়ন-জিমিকে দেখেই ভ্রু কুঁচকে গেল তার, চেহারায় ফুটে উঠল বিরক্তি।

‘এরা এখানে কেন, ক্যাসিডি?’ জিজ্ঞেস করল সে, ‘তোমাকে বলেছি না, যাকে-তাকে ক্যাম্পে ঢুকতে দেবে না?’

‘ওরা বিপদে পড়েছিল, মি. স্যান্ডার্স।’ বলল ক্যাসিডি, ‘বুড়ো কালাহান বন্দুক নিয়ে তাড়া করেছিল ওদের।’

‘সেই পাগলটা? ব্যাটা বড্ড বাড় বেড়েছে…কিছু একটা না করলেই নয়।’

‘লোকটার সমস্যা কী, স্যার?’ জিজ্ঞেস করল অয়ন। ‘এমন করে কেন?’

‘ব্যাটা পরিবেশবাদী!’ ঝাঁজালো গলায় বলল স্যান্ডার্স, ‘বড় একটা কোম্পানির হয়ে কাজ করছি আমরা, এই অঞ্চলে জিপসাম খুঁজছি, কিন্তু সেটা পছন্দ নয় ওর। বলে, আমরা নাকি পরিবেশের বারোটা বাজাতে চলেছি।’

‘জিপসামটা কী?’ প্রশ্ন করল জিমি।

‘একধরনের খনিজ পদার্থ।’ অয়ন বলল, ‘সাদা রঙের নরম পাথরের মতো…মাটির গভীরে থাকে। প্লাস্টার আর নির্মাণসামগ্রী তৈরিতে ব্যবহার করা হয়।’

‘কিন্তু ওই জিনিস তুললে পরিবেশের ক্ষতি হবে কেন?’

‘তুললে ক্ষতি হবে না।’ বলল ক্যাসিডি, ‘কিন্তু খনি থেকে জিপসাম পরিবহনের জন্য চওড়া রাস্তা তৈরি করতে হবে, যাতে বড় বড় ট্রাক আসা-যাওয়া করতে পারে। অনেক গাছ কাটা পড়বে, বন্য প্রাণীরাও আগের মতো স্বাধীনভাবে ঘুরতে পারবে না এদিকে। কালাহানের আপত্তিটা সেখানেই।’

‘যুক্তি আছে তার কথায়।’ গম্ভীর গলায় বলল অয়ন, ‘এর মধ্যে পাগলামির কিছু দেখছি না।’

‘অবশ্যই পাগলামি!’ গোঁয়ারের মতো বলল স্যান্ডার্স, ‘জঙ্গল কি তার বাপের সম্পত্তি? সে আমাদের বাধা দেবার কে?’

‘সচেতন নাগরিক হিসেবে বাধা দিতেই পারে। জঙ্গলের ওপর সবারই অধিকার আছে।’

‘ওরে বাবা! এই ছেলেও দেখি নীতিকথা আওড়াচ্ছে!’ বাঁকা সুরে বলল স্যান্ডার্স, ‘শোনো বাছা, পরিবেশ নিয়ে মাথা ঘামানোর জন্য দেশের সরকার আছে। সেই সরকারই আমাদের সার্ভে করার অনুমতি দিয়েছে।’

‘আমি বলছি না আপনারা এখানে অবৈধভাবে সার্ভে করছেন।’ অয়ন বলল, ‘তাই বলে পরিবেশের ক্ষতি করাও তো ঠিক নয়। যারা অনুমতি দিয়েছে, তারা হয়তো বিপদটা বুঝতে পারেনি…’

‘থামো!’ গর্জে উঠল স্যান্ডার্স, ‘জ্ঞান দিতে হবে না আমাকে! ক্যাসিডি, এক্ষুনি বিদায় করো এদের। ক্যাম্পের ত্রিসীমানায় ওদের আর কখনো দেখতে চাই না আমি।’

‘ঠিক আছে, মি. স্যান্ডার্স।’ তাড়াতাড়ি বলল ক্যাসিডি, ‘আমি ওদের বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসছি।’

‘না, পৌঁছে দেওয়ার দরকার নেই। এখানে প্রচুর কাজ আছে তোমার। শুধু পথ দেখিয়ে দাও। নিজেরা পারলে ফিরবে, নইলে নেই।’

ঝট করে ঘুরল স্যান্ডার্স। গটমট করে চলে গেল দুই বন্ধুর সামনে থেকে।

‘সরি।’ বিব্রত গলায় বলল ক্যাসিডি, ‘তোমরা কিছু মনে কোরো না। মানুষটা একটু রগচটা, কেউ মুখে মুখে কথা বললেই খেপে যান। তোমরা নিজেরা বাড়ি ফিরতে পারবে তো?’

‘জি, পারব।’ অয়ন মাথা ঝাঁকাল।

‘তাহলে এসো, জিপ থেকে তোমাদের হ্যাভারস্যাক নিয়ে নাও। সঙ্গে যেতে পারছি না বলে কিছু মনে কোরো না। হাজার হোক, চাকরি করি তো…বসের নির্দেশ অমান্য করলে সমস্যা হতে পারে।’

‘কিচ্ছু ভাববেন না। আমাদের কোনো অসুবিধে হবে না। চলুন।’

হ্যাভারস্যাক নিয়ে ক্যাসিডিকে বিদায় জানাল দুই বন্ধু। বেরিয়ে এল ক্যাম্প থেকে।

‘আস্ত ছোটলোক!’ কিছু দূর গিয়ে সখেদে বলল জিমি, ‘ওই স্যান্ডার্স লোকটার কথা বলছি। দেখলি, কেমন আচরণ করল আমাদের সঙ্গে?’

ঠোঁট কামড়াচ্ছে অয়ন। বলল, ‘আমি অন্য কথা ভাবছি। মি. স্যান্ডার্সের তাঁবুর সামনে পায়ের কয়েকটা ছাপ ছিল…আমরা যে ছাপগুলো অনুসরণ করছিলাম, ঠিক সে রকম। খেয়াল করেছিস?’

‘বলিস কী!’ চমকে উঠল জিমি, ‘তুই শিওর?’

‘পুরোপুরি শিওর হওয়া সম্ভব না, ভালো করে তো দেখতে পারলাম না। কিন্তু ও রকমই লাগল। তা ছাড়া ছাপগুলো এদিকে এসেছে…আর এখানে ওই ক্যাম্প ছাড়া যাওয়ার মতো আর কোনো জায়গা নেই।’

‘মানে কী? স্যান্ডার্সই আলভারেজদের ফাঁসানোর চেষ্টা করছে? কিন্তু তা-ই বা কী করে হয়? তার শত্রুতা তো কালাহানের সঙ্গে। ফাঁসালে কালাহানকে ফাঁসাবে।’

‘দুজনই সন্দেহজনক চরিত্র। এদের সঙ্গে মি. আলভারেজের কী সম্পর্ক, সেটা বের করতে হবে। অবশ্য ছাপগুলো মি. স্যান্ডার্সের না-ও হতে পারে। টিম লিডারের তাঁবুতে দলের সবারই আসা-যাওয়া করার কথা।’

‘এখন তাহলে কী করতে চাস?’

‘ক্যাম্পের তাঁবুগুলো তল্লাশি করতে পারলে ভালো হতো…’

‘অসম্ভব।’ মাথা নাড়ল জিমি, ‘ফিরে গেলে এবার ওই স্যান্ডার্সই বন্দুক হাতে আমাদের তাড়া করবে।’

‘বলে-কয়ে যাব নাকি?’ মুখ বাঁকাল অয়ন, ‘একটু অপেক্ষা করি। আঁধার নামলে চুপি চুপি ঢুকব ওখানে।’

‘যদি ধরা পড়ে যাই?’

‘কী আর করবে? বড়জোর দু-একটা চড়-থাপ্পড় দিতে পারে। তদন্তের স্বার্থে না হয় দুটো চড় খেলাম।’

‘কাজ নেই বাপু আমার চড় খাওয়ার…’

বলতে বলতে থেমে গেল জিমি। কানে ভেসে আসছে খসখস আওয়াজ।

অয়নও শুনতে পেয়েছে। ফিসফিস করে ও বলল, ‘কে যেন লুকিয়ে আছে ঝোপঝাড়ের ভেতরে।’

‘কে?’

‘জানি না। কিন্তু মতলব সুবিধার ঠেকছে না। আমাদের পেছনেই লেগেছে কি না, কে জানে!’

‘তাহলে?’

‘আমাদের কথাবার্তা শুনে থাকতে পারে। তার মানে, এখন আর ক্যাম্পে হানা দেওয়া যাবে না। তাড়াতাড়ি কেটে পড়া দরকার। চল।’

দ্রুত পা চালিয়ে হাঁটতে শুরু করল ওরা। খানিক পর আবারও শোনা গেল খসখস আওয়াজ। সামনে নড়ে উঠল একটা ঝোপ।

‘আয় হায়!’ আঁতকে উঠল জিমি, ‘সামনে পৌঁছে গেছে তো!’

‘এদিকে!’ বন্ধুর হাত ধরে টান দিল অয়ন। ঘুরে গেল আরেক দিকে। হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিয়েছে, বলতে গেলে প্রায় ছুটছে এখন।

ছোট এক চড়াই পেরিয়ে একটা ক্যানিয়নে ঢুকে পড়ল দুজন। ক্যানিয়নের ভেতরে উঁচু উঁচু ঘাস—প্রায় ওদের মাথার সমান লম্বা। তার ভেতরে ঘাপটি মারল দুই বন্ধু। চুপচাপ অপেক্ষা করল খানিকক্ষণ, কিন্তু কোনো শব্দ শুনল না। পেছনে যে-ই লেগে থাকুক, সে ওদের হারিয়ে ফেলেছে কিংবা অনুসরণ করছে না আর।

নিশ্চিন্ত হওয়ার পর উঠে দাঁড়াল অয়ন। বলল, ‘চল, ফেরা যাক।’

আগে আগে চলল জিমি, ওর দিক-জ্ঞান ভালো। ঘাসের জঙ্গলের মাঝ দিয়ে ক্যানিয়নের আরেক প্রান্তের দিকে নিয়ে চলল অয়নকে। খানিক পর পাহাড়ি ঢাল বেয়ে উঠে এল একটা শৈলশিরায়। সামনে তাকিয়ে চোখ পিটপিট করল জিমি। চেহারায় দ্বিধা।

‘কী হয়েছে?’ জিজ্ঞেস করল অয়ন।

পাহাড়সারির দিকে ইশারা করে জিমি বলল, ‘ওদিকে আরেকটা ক্যানিয়ন থাকার কথা। কিন্তু দেখতে পাচ্ছি না।’

‘মানে কী?’

‘বোধ হয় ভুল দিকে চলে এসেছি। ওই পাশের ঢালে চড়তে হবে।’

তা-ই করা হলো। কিন্তু লাভ হলো না। ক্যানিয়ন একটা দেখতে পাচ্ছে বটে, কিন্তু সেটা চলে গেছে পার্বত্য এলাকার গভীরে। ও-পথে বাড়ি ফেরা যাবে না।

‘দুঃসংবাদ।’ গম্ভীর গলায় বলল জিমি, ‘আমরা পথ হারিয়েছি।’

আশপাশে তাকাল অয়ন। সূর্য ডুবে গেছে। গাঢ় ছায়ায় ঢাকা পড়তে শুরু করেছে প্রকৃতি। আকাশে একে একে জ্বলে উঠছে তারার দল।

‘এই অন্ধকারে কিছুতেই রাস্তা খুঁজে পাব না।’ হতাশ গলায় বলল জিমি।

‘এখানেই অপেক্ষা করা যাক।’ শান্ত গলায় বলল অয়ন, ‘অন্ধকারে খামোকা ঘুরে মরার কোনো মানে হয় না। ফিরতে দেরি হলে নিশ্চয়ই আমাদের খুঁজতে বেরোবেন চাচা।’

‘যদি খুঁজে না পান?’

‘তাতেও সমস্যা নেই। রাত কাটানোর মতো সবই আছে আমাদের হ্যাভারস্যাকে—শুকনো খাবার, সোয়েটার, টর্চ, দেশলাই…সকালে আলো ফুটলে নিজেরাই পথ খুঁজে নিতে পারব।’

‘আইডিয়াটা খারাপ নয়।’ স্বীকার করল জিমি।

হাত-পা ছড়িয়ে দুজন বসে পড়ল পাহাড়ি ঢালে। হঠাৎ গুরুগম্ভীর আওয়াজে সচকিত হলো অয়ন। জিমিকে কনুইয়ের গুঁতো দিয়ে তাকাল নিচে। ক্যানিয়ন ধরে একটা গাড়ি এগিয়ে আসছে। দেখা যাচ্ছে হেডলাইটের আলো।

‘এত তাড়াতাড়িই চলে এসেছেন মেহেদি চাচা?’ জিমির গলায় বিস্ময়।

‘না, চাচা না।’ অয়ন মাথা নাড়ল, ‘অন্য কেউ।’

ক্যানিয়ন থেকে বেরিয়েই হেডলাইট নিভিয়ে দিল গাড়িটা।

‘ব্যাপার কী!’ বলল জিমি, ‘লাইট নেভাল কেন? অ্যাকসিডেন্ট করবে তো!’

‘আমার তা মনে হয় না।’ বলল অয়ন, ‘ওই দেখ, থামছে।’

সত্যিই তা-ই। পাহাড়ের গোড়ায় এসে থেমে দাঁড়াল গাড়িটা। দরজা খুলে নেমে এল একজন। হাতে লম্বামতো কী যেন। অন্ধকারে বোঝা যাচ্ছে না। টর্চ জ্বালল না মানুষটা, নিঃশব্দে ঢুকে পড়ল ঝোপঝাড়ের ভেতরে।

‘ইন্টারেস্টিং!’ মন্তব্য করল অয়ন, ‘অন্ধকারে ঘোরাফেরা করছে…তার মানে কিছু একটা লুকাতে চাইছে লোকটা।’

‘নিচে চল।’ জিমি বলল, ‘ব্যাটা কী করছে, দেখা দরকার।’

ঢাল ধরে নামতে শুরু করল দুই বন্ধু। একটু পরেই শোনা গেল ধুপধাপ আওয়াজ, যেন মাটি খোঁড়া হচ্ছে। একটা ঝোপের পেছনে আশ্রয় নিল অয়ন-জিমি। পাতার ফাঁক দিয়ে দেখার চেষ্টা করল লোকটা কী করছে, কিন্তু লাভ হলো না। অন্ধকারে কিছুই দেখা যায় না।

হঠাৎ আওয়াজ থেমে গেল। একটু পর ভেসে এল খসখস শব্দ। ঝোপঝাড় থেকে বেরিয়ে আসছে লোকটা। তাড়াতাড়ি মাটিতে শুয়ে পড়ল অয়ন-জিমি, ওদের খুব কাছ দিয়ে চলে গেল সে। গাড়ির কাছে ফিরে যাচ্ছে।

‘চল, ফলো করব।’ জিমির হাত ধরে টানল অয়ন।

পা টিপে টিপে এগোল দুজন। কিন্তু গাড়িটার কাছে পৌঁছানোর আগেই জ্যান্ত হয়ে উঠল ওটার ইঞ্জিন। জ্বলে উঠল হেডলাইট। মুখ ঘুরিয়ে চলতে শুরু করল ওটা।

‘পালিয়ে যাচ্ছে তো!’ উত্তেজিত গলায় বলল জিমি, ‘জলদি চল!’

দৌড়াতে শুরু করল দুই বন্ধু। তবে চলন্ত একটা গাড়িকে ধরা সহজ কর্ম নয়, ধীরে ধীরে দূরত্ব বাড়ল ওদের। তারপরও যতক্ষণ টেইললাইটের লাল আলো দেখা গেল, পিছু পিছু এগোল ওরা। শেষে হাল ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। গাড়িটা ততক্ষণে মিলিয়ে গেছে সামনে থেকে।

‘ধ্যাৎ!’ হাঁপাতে হাঁপাতে বলল অয়ন, ‘হারালাম ব্যাটাকে। গাড়ির নম্বর-প্লেটটাও দেখতে পেলাম না।’

‘একেবারে পণ্ডশ্রম হয়নি বোধ হয়।’ চারদিকে নজর বোলাচ্ছে জিমি, ‘জায়গাটা চিনতে পারছি। এখান দিয়ে গত পরশু সাইকেল চালিয়েছি আমরা।’

‘যাক, অন্তত একটা ভালো খবর শোনালি। পাহাড়ের গোড়ার জায়গাটা চিনতে পারবি এখান থেকে?’

‘নিশ্চয়ই। যেতে চাস?’

‘এখন না। রাত হয়ে গেছে। চাচা-চাচি চিন্তায় পড়ে যাবেন। কাল সকালে চাচাকে নিয়েই না-হয় আসব।’

‘তাহলে বাড়ি ফিরব এখন?’

‘হ্যাঁ। চল।’

প্রথমে আলভারেজ ফার্মে গেল দুজন। ওখান থেকে সাইকেল নিয়ে ফিরে এল বাড়িতে। ভেতরে ঢুকতেই চাচির উদ্বিগ্ন চেহারা দেখল দুই বন্ধু। সত্যিই চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলেন। চাচাও নাকি খুঁজতে বেরিয়েছেন ওদের। ফরেস্ট অফিসে ফোন করে জানিয়ে দেওয়া হলো অয়ন-জিমির ফেরার খবর। চাচাকে ওরাই খবর দেবে।

‘খেতে বসো।’ বললেন চাচি, ‘খেয়েদেয়ে সোজা বিছানায়। সারা দিন অনেক ঘুরেছ, এখন বিশ্রাম নেবে।’

‘কিন্তু চাচার সঙ্গে আমাদের জরুরি কথা আছে, চাচি!’ প্রতিবাদ করল অয়ন।

‘সেটা সকালে বললেও চলবে।’ চাচি অনড়, ‘আর কোনো কথা নয়, এসো বলছি!’

ছয়

কতটা ক্লান্ত ছিল, তা শোয়ার আগে টের পায়নি অয়ন-জিমি। রাতভর মড়ার মতো ঘুমাল ওরা। জেগে উঠল বেশ দেরিতে। ঘড়িতে তখন সকাল সাড়ে নয়টা বাজে। মুখ-হাত ধুয়ে তাড়াতাড়ি হাজির হলো ডাইনিং রুমে—ব্রেকফাস্ট করবে, সেই সঙ্গে চাচাকে খুলে বলবে আগের দিনের সব ঘটনা।

‘ও তো আটটা না বাজতেই বেরিয়ে গেছে।’ বললেন চাচি, ‘অফিস থেকে ফোন এসেছিল।’

‘সে কী!’ অয়ন ক্ষুব্ধ হলো, ‘আমাদের ডাকলেন না কেন? আপনাকে তো কাল রাতেই বললাম, চাচার সঙ্গে জরুরি কথা আছে।’

‘যেভাবে ঘুমোচ্ছিলে তোমরা, ডাকি কী করে? তা ছাড়া তোমাদের চাচা তো পালিয়ে যাচ্ছে না। লাঞ্চের সময় না-হয় কথা বোলো।’

‘কিন্তু উনি সাতসকালে বেরিয়ে গেলেন কেন?’ জানতে চাইল জিমি।

‘কাকে নাকি গ্রেপ্তার করতে হবে। একটা নমুনা পাঠিয়েছিল ল্যাবে, সেটার রিপোর্ট এসেছে। তাই তাড়াহুড়া করে চলে গেল। গ্রেপ্তারি পরোয়ানা তৈরি করতে সময় লাগে তো। অপরাধী যদি খবরটা পেয়ে যায়, তো পালিয়ে যেতে পারে। সে জন্যই তাড়া।’

মুখ চাওয়াচাওয়ি করল অয়ন-জিমি।

‘কাকে অ্যারেস্ট করতে গেছেন চাচা?’ জিজ্ঞেস করল অয়ন, ‘হুয়ান আলভারেজকে?’

‘হ্যাঁ, ওই নামটাই তো শুনলাম মনে হলো। লোকটা নাকি বিষ মেশানো মাংস দিয়ে বনের পশুপাখি মারছে। তোমরা কিছু জানো এ ব্যাপারে?’

‘কিছুটা। রই কথা বলতে চাইছিলাম।’ চঞ্চল হয়ে উঠল অয়ন, ‘আমাদের এখনই বেরোতে হবে, চাচি।’

‘উহুঁ, নাশতা না সেরে এক পা-ও নড়তে দিচ্ছি না কাউকে। বসো টেবিলে।’

চাচির চাপাচাপিতে বাধ্য হয়ে পাউরুটি আর ফলের জুস দিয়ে নাশতা সারল অয়ন-জিমি। তারপর তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে এল বাড়ি থেকে।

‘কোথায় যেতে চাস?’ অয়নকে জিজ্ঞেস করল জিমি, ‘আলভারেজদের ফার্মে?’

‘ওখানে গিয়ে লাভ হবে না।’ অয়ন বলল, ‘প্রমাণ ছাড়া বাঁচানো যাবে না মি. আলভারেজকে।’

‘প্রমাণ কোথায় পাব?’

‘পাহাড়ের গোড়ায়। গতকাল সন্ধ্যায় লোকটা ওখানে কী করছিল, খুঁজে বের করব। আমার বিশ্বাস, পুরো রহস্যের সঙ্গে তার সম্পর্ক আছে।’

সাইকেল নিয়ে প্রায় উড়ে চলল দুই বন্ধু। খুব দ্রুত পৌঁছে গেল আগের সন্ধ্যার সেই পাহাড়সারির কাছে। ঢুকে পড়ল ঢালের গোড়ার জঙ্গলে। শুরু করল তল্লাশি। কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ কেটে যাওয়ার পরও কিছু পাওয়া গেল না।

‘ভুল জায়গায় আসিনি তো?’ সন্দিহান গলায় বলল অয়ন।

‘উহুঁ।’ মাথা নাড়ল জিমি, ‘ঠিক জায়গাতেই এসেছি। আমি শিওর।’

‘তাহলে কিছু পাচ্ছি না কেন? লোকটা তো মাটি খুঁড়ছিল…তার চিহ্ন থাকার কথা।’

‘হয়তো আবার বুজে দিয়েছে গর্তটা।’ অনুমান করল জিমি, ‘ভালো করে দেখ, কোথাও আলগা মাটি আছে কি না।’

ওর কথাই ঠিক। খানিক পর একটা ছোট্ট গাছের দিকে ইশারা করে অয়ন বলল, ‘ওই যে…ওই গাছটার গোড়ার মাটি ঝুরঝুরে মনে হচ্ছে।’

গাছ না বলে গাছের চারা বলাই ভালো—উচ্চতায় বড়জোর দুই ফুট। কাছে গিয়ে গাছটা মুঠো করে ধরল জিমি, টান দিল ওপরে। সঙ্গে সঙ্গে মাটি থেকে উঠে এল ওটা। নিচ থেকে উঁকি দিল একটা চওড়া গর্ত।

হাঁটু গেড়ে বসল অয়ন-জিমি। তাকাল নিচে। গর্তটা ফাঁকা।

‘কই, কিছুই তো নেই!’ হতাশ গলায় বলল জিমি।

সঙ্গে সঙ্গে পেছন থেকে ভেসে এল একটা পরিচিত গলা, ‘এই যে, পেয়েছি এবার তোমাদের!’

ঝট করে ঘাড় ফেরাল দুই বন্ধু, আঁতকে উঠল সঙ্গে সঙ্গে। একেবারে ঘাড়ের ওপর বন্দুক বাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বুড়ো কালাহান। ক্রুদ্ধ চেহারা। মুখ থেকে রক্ত সরে গেল অয়ন-জিমির। ধরা পড়ে গেছে, পালানোর উপায় নেই।

‘খবরদার, পালানোর চেষ্টা কোরো না।’ বলল কালাহান। বন্দুক তাক করল ওদের দিকে, ‘গতকালের মতো বোকা বনছি না আমি।’

ঢোঁক গিলে সাহস সঞ্চয় করল অয়ন। তারপর বলল, ‘আমরা পালাব না, মি. কালাহান। পালাতে যদি হয় তো আপনার পালানো উচিত। বিষ ছড়িয়ে কয়োট আর কনডর মারছেন আপনি—ধরা পড়লে নির্ঘাত জেলে যাবেন।’

‘কী!’ অবাক হলো কালাহান, ‘মাথাটাথা ঠিক আছে তো? আমি কেন বিষ ছড়াতে যাব? আমি তো এই পাহাড়-জঙ্গল আর সমস্ত বন্য পশুপাখিকে বাঁচানোর চেষ্টা করছি!’

‘তাহলে গতকাল আমাদের ওভাবে তাড়া করলেন কেন?’

‘সে তো দেশলাই জ্বেলেছিলে বলে! শুকনো মৌসুমে জঙ্গলে আগুন জ্বালানো কতটা বিপজ্জনক, তা জানো? মুহূর্তের অসাবধানতায় দাবানল শুরু হতে পারে। আর আজ তো দেখছি টেনে টেনে গাছের চারা তুলছ মাটি থেকে! এই জঙ্গলের সঙ্গে তোমাদের শত্রুতা কিসের?’

‘আমরা কিছু করিনি।’ প্রতিবাদ করল জিমি, ‘গাছটা আগেই তুলেছে অন্য কেউ। তারপর আবার আলগা মাটি দিয়ে বসিয়ে রেখেছে তলার গর্তটা লুকিয়ে ফেলার জন্য।’

‘গর্ত!’ ভ্রুকুটি করল কালাহান, ‘কিসের গর্ত?’

সংক্ষেপে গত সন্ধ্যার ঘটনা খুলে বলল দুই বন্ধু। শেষে অয়ন বলল, ‘কিন্তু গর্তটা খালি। ভেতরে কিচ্ছু নেই।’

কনডরের ডানা
অলংকরণ: আরাফাত করিম
‘দেখতে দাও আমাকে।’ বন্দুক নামিয়ে হাঁটু গেড়ে বসল কালাহান। প্রথমে একটু উঁকি দিল, এরপর উপুড় হয়ে শুয়ে মাথা আর কাঁধ ঢুকিয়ে দিল গর্তে। হাত দিয়ে হাতড়াল ভেতরটা, এরপর উঠে বসল।

‘দেখলেন তো, ওখানে কিছুই নেই।’ বলল জিমি।

‘আছে।’ গম্ভীর গলায় বলল কালাহান।

‘কী আছে?’

হাতের মুঠো খুলল কালাহান। সাদা রঙের মাটি তার হাতে। ‘জিপসাম।’ বলল সে, ‘নিচে জিপসামের স্তর রয়েছে। এই জিনিসই খুঁজে বেড়াচ্ছে ওই সার্ভে টিম।’

‘কী বলছেন আপনি!’ জিমির চোয়াল ঝুলে পড়েছে।

‘কিন্তু মি. স্যান্ডার্স তো বললেন, এদিকে কোনো জিপসাম পাননি তাঁরা।’ বলল অয়ন।

‘তাহলে অন্য কেউ পেয়েছে।’ চেহারায় মেঘ জমল কালাহানের, ‘নাহ্, জঙ্গলটাকে বুঝি আর বাঁচানো গেল না। এবার নির্ঘাত খনি খুলবে ওরা, গাছপালা কেটে রাস্তা তৈরি করবে।’

ঠোঁট কামড়ে কী যেন ভাবল অয়ন। পরক্ষণে ওর চোখজোড়া উজ্জ্বল হয়ে উঠল। উত্তেজিত গলায় বলল, ‘জিমি, সব পানির মতো পরিষ্কার! এখন আমি জানি, কেন বনে বিষ ছড়ানো হচ্ছে…কেনই-বা মি. আলভারেজকে ফাঁসানো হচ্ছে!’

‘মর জ্বালা।’ কপাল চাপড়াল জিমি, ‘ভণিতা না করে সব খুলে বলছিস না কেন?’

‘সময় নেই।’ তড়াক করে উঠে দাঁড়াল অয়ন, ‘জলদি চল, মি. আলভারেজকে বাঁচাতে হবে।’

আর কিছু না বলে দৌড়াতে শুরু করল ও। জিমি আর বুড়ো কালাহান পিছু নিল ওর।

সাত

আলভারেজ ফার্মের উঠানে দাঁড়িয়ে আছে মেহেদি চাচার জিপ, পাশে পুলিশের কার। ওখানে পৌঁছাতেই চাচাকে দেখতে পেল অয়ন-জিমি। স্থানীয় শেরিফও আছেন। ঘটনা দেখার জন্য উপস্থিত হয়েছে ক্যাসিডি আর স্যান্ডার্স। মি. আলভারেজকে হাতকড়া পরিয়ে গাড়ির দিকে নিয়ে চলেছে ইউনিফর্ম পরা এক ডেপুটি। পিছু পিছু বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছে পরিবারের সব সদস্য। ছোটখাটো একটা ভিড় সৃষ্টি হয়েছে উঠানে।

‘তোমরাও এসে গেছ?’ দুই বন্ধুকে দেখতে পেয়ে বললেন মেহেদি চাচা।

‘ওই পাগলটা এখানে কী করছে?’ কালাহানকে দেখতে পেয়ে গরগর করে উঠল স্যান্ডার্স।

তাঁর কথা না শোনার ভান করল কালাহান। এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘হচ্ছেটা কী এখানে?’

‘মি. আলভারেজকে অ্যারেস্ট করছি আমরা।’ শেরিফ বললেন, ‘প্রমাণ পাওয়া গেছে, বিষ মাখানো মাংস খাইয়ে বুনো পশুপাখি হত্যা করছেন তিনি।’

‘মিথ্যে কথা!’ রাগী গলায় বললেন আলভারেজ, ‘আমি ওসবের কিচ্ছু করিনি।’ মিসেস আলভারেজ ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। সেদিকে ফিরলেন তিনি, ‘শান্ত হও, আমার কিচ্ছু হবে না। আমি নির্দোষ।’

‘আমারও তা-ই ধারণা।’ শান্ত গলায় বলল অয়ন।

‘সরি, অয়ন, তোমার ধারণা ভুল।’ চাচা বললেন, ‘ল্যাব টেস্টে মি. আলভারেজের ফ্রিজের মাংসে বিষ পাওয়া গেছে। ঘটনাস্থলে পাওয়া ওই নীল পেইন্টও তাঁর।’

‘কী করবেন আপনারা তাঁকে নিয়ে?’ জিমি জানতে চাইল।

‘সেটা আদালতের ব্যাপার।’ শেরিফ বললেন, ‘জেল হবে, নাকি জরিমানা দিয়ে পার পেয়ে যাবেন, তা জজ সাহেব ঠিক করবেন।’

‘কিন্তু আমাদের তো অত টাকা নেই!’ ভাঙা গলায় বলল হিউগো, ‘মামলা-মোকদ্দমা চালাব কীভাবে? জরিমানাই-বা দেব কোত্থেকে?’

‘চিন্তা কোরো না।’ ছেলেকে বললেন আলভারেজ, ‘টাকার বন্দোবস্ত করে রেখে যাচ্ছি আমি।’

‘কিসের কথা বলছ?’

‘ওই যে পাহাড়ের গোড়ার জমিটা…বক্স ক্যানিয়নের পাশে…আমরা তো ওটা ব্যবহার করি না। মি. ক্যাসিডি ওটা ভালো দামে কিনে নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন।’

শব্দ করে হেসে উঠল অয়ন, ‘সত্যি? ওটা আপনাদের জমি? আমি আগেই সন্দেহ করেছিলাম।’

অবাক হয়ে ওর দিকে তাকাল সবাই। চোখে প্রশ্ন।

অয়ন বলল, ‘রহস্যটা এখন পানির মতো পরিষ্কার। সব খাপে খাপে জোড়া লেগে গেছে। মি. আলভারেজ নন, নাটের গুরু আসলে মি. ক্যাসিডি।’ তরুণ জিয়োলজিস্টের দিকে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল ও, ‘কী, ঠিক বলিনি?’

থতমত খেয়ে গেল ক্যাসিডি। বলল, ‘অ্যাই! কী বলছ এসব? মানে কী?’

‘মানে হচ্ছে, বনের ভেতরে আপনিই বিষ মাখানো মাংস ছড়িয়েছেন। তারপর আবার গোপনে সেই মাংসের টুকরো রেখে দিয়েছেন মি. আলভারেজের ফ্রিজে। গোলাঘর থেকে পেইন্টের টিনও আপনিই চুরি করেছেন।’

‘বাজে কথা!’ প্রতিবাদ করল ক্যাসিডি, ‘ওরা কী বলেছে, ওদের কোনো টিন চুরি গেছে? বিশ্বাস না হলে গুনে দেখুক।’

‘তার কোনো প্রয়োজন নেই। আমার ধারণা, পেইন্টভর্তি একটা টিন সরিয়ে সেখানে একই রকম দেখতে একটা খালি টিন রেখে দিয়েছেন আপনি—গুনতে গেলে যেন কমতিটা ধরা না পড়ে। অবশ্য যদি চান তো চেক করে দেখতে পারি, সত্যি সত্যি কোনো খালি টিন আছে কি না ওখানে।’

নার্ভাস দেখাল ক্যাসিডিকে। দুর্বল গলায় বলল, ‘এই ছেলের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। এসব আমি কেন করতে যাব?’

‘মি. আলভারেজকে বিপদে ফেলার জন্য।’ এবার জিমি বলল, ‘যাতে তিনি টাকার অভাবে জমি বিক্রি করতে বাধ্য হন।’

‘কেন? কী আছে ওই জমিতে?’ বিস্মিত গলায় জিজ্ঞেস করলেন মেহেদি চাচা।

‘জিপসাম।’ বলল কালাহান, ‘খাঁটি জিপসাম।’

‘বক্স ক্যানিয়নের পাশে?’ বাঁকা চোখে ক্যাসিডির দিকে তাকাল স্যান্ডার্স। ‘ওদিকটা ও-ই সার্ভে করেছে। আমাকে এসে বলেছিল, ক্যানিয়নের আশপাশে কিছু পাওয়া যায়নি।’

‘কারণ, মি. ক্যাসিডি নিজেই জমিটা কিনে জিপসাম খনির মালিক হতে চেয়েছিলেন।’ অয়ন বলল, ‘সে জন্যই এত ষড়যন্ত্র। ভীষণ চালাক উনি—নিজে বিষ ছড়িয়েছেন…আবার নিজেই ফরেস্ট রেঞ্জার অফিসে খবর দিয়ে উদ্ধার করেছেন অসুস্থ কনডরটাকে। এতে আরেকটা লাভ হয়েছে—যেখানে গেলে মরা কয়োট আর পেইন্টের টিন পাওয়া যাবে, সেটা চিনিয়ে দিয়েছেন কৌশলে।’

পায়ে পায়ে পেছাতে শুরু করেছে ক্যাসিডি। বলল, ‘সব মিথ্যে কথা। বানোয়াট অভিযোগ। আমি যে ওসব করেছি, তার কোনো প্রমাণ নেই।’

‘আছে, মি. ক্যাসিডি।’ মুচকি হাসল অয়ন, ‘একটা ভুল করেছেন আপনি—বনের ভেতরে ছড়ানো পেইন্টে ভুল করে পা দিয়ে ফেলেছিলেন। আপনার তাঁবুতে তল্লাশি চালালেই রং-মাখা সেই জুতা জোড়া পাওয়া যাবে। ব্যস, তাহলেই প্রমাণ হয়ে যাবে সব।’

মুখ থেকে রক্ত সরে গেল ক্যাসিডির। উল্টো ঘুরে ছুট লাগাল সে, পালিয়ে যেতে চায়। কিন্তু তৈরি ছিল জিমি, একটা পা বাড়িয়ে ল্যাং মারল তাকে। হুড়মুড় করে মুখ থুবড়ে মাটিতে আছড়ে পড়ল দুষ্ট জিয়োলজিস্ট, ককিয়ে উঠল ব্যথায়। তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন শেরিফ ও তাঁর ডেপুটি। হাতে হাতকড়া পরিয়ে দাঁড় করানো হলো তাকে।

‘থ্যাংক ইউ, অয়ন-জিমি।’ কৃতজ্ঞ চোখে দুই বন্ধুর দিকে তাকালেন মি. আলভারেজ, ‘থ্যাংক ইউ ভেরি মাচ।’

দুই দিন পর। আলভারেজ ফার্মের ঘাসে-ঢাকা এক টুকরা খোলা জমিতে দাঁড়িয়ে আছে অয়ন-জিমি। সঙ্গে মেহেদি হাসান, মি. আলভারেজ, বুড়ো কালাহান আর ডা. মেরি ওয়াল্টার। ডাক্তারের হাতে অতিকায় এক খাঁচা, তাতে সেদিনের কনডরটা—সুস্থ হয়ে উঠেছে। পাখিটাকে মুক্ত করার জন্য সমবেত হয়েছে সবাই।

মাটিতে খাঁচা নামালেন ডাক্তার, নিচু হয়ে খুলে দিলেন দরজা। ইতস্তত করে বেরিয়ে এল পাখিটা। কর্কশ স্বরে ডাক ছাড়ল একটা, তারপর ডানা ঝাপটে উড়াল দিল আকাশে। আজ তার শরীরে নীল রঙের কোনো ছাপ নেই।

বিশাল দুই ডানা মেলে আকাশের বুকে ভেসে চলেছে কনডর, সেদিকে তাকিয়ে বড় করে শ্বাস ফেলল কালাহান। বলল, ‘এ-ই হলো সত্যিকার প্রকৃতির রূপ। একে বাঁচানোর জন্যই যুদ্ধ করছি আমি।’

‘জমিটার ব্যাপারে কী করবেন বলে ঠিক করেছেন, মি. আলভারেজ?’ জিজ্ঞেস করল অয়ন, ‘খনি চালু করবেন?’

‘না।’ হাসলেন আলভারেজ, ‘তেমন কোনো ইচ্ছে আমার নেই…বাড়ির কারোরই নেই।’

‘কী বলছেন!’ অবাক হলো জিমি, ‘জিপসাম তুলে তো বড়লোক হয়ে যেতে পারবেন আপনি!’

‘টাকার লোভ আমার নেই।’ বললেন আলভারেজ, ‘কোনো কালেই ছিল না। যা আছে, তা নিয়েই আমি সন্তুষ্ট। তা ছাড়া, ওই জিপসামের চেয়ে এখানকার পাহাড় আর অরণ্য আমার চোখে অনেক বেশি দামি।’

সবকিছু ভুলে আনন্দে তাঁকে জড়িয়ে ধরল অয়ন-জিমি। স্মিত হেসে ওদের দিকে তাকিয়ে রইলেন মেহেদি চাচা, ডা. ওয়াল্টার আর কালাহান।

মাথার ওপর বিশাল দুই ডানা ঝাপটাল কনডর, ডেকে উঠল নিজস্ব সুরে। ওটাও যেন আনন্দ প্রকাশ করছে সবার সঙ্গে।

No comments