লোভ – হুমায়ূন আহমেদ

লোভ – হুমায়ূন আহমেদ

ভদ্রলোক চেইন স্মোকার।

চেইন স্মোকারের যে অভ্যাস, একটা সিগারেট পুরোপুরি শেষ না করেই অন্য একটা ধরাচ্ছেন। ভদ্রলোককে ঠিক স্বাভাবিক বলে মনে হল না। কেমন অস্থির ভাবভঙ্গি। কিছুক্ষণ পর পর জিব দিয়ে ঠোট ভেজাচ্ছেন। মাথা চুলকাচ্ছেন।

আমার দিকে তাকিয়ে তিনি চাপা গলায় বললেন, আমার একটাই মেয়ে। তার নাম আনান। আপনি কি আনান শব্দটার মানে জানেন?

জ্বি-না।

আনান শব্দের মানে হল মেঘ। আমি ডাকতাম মেঘবতী।

ডাকলাম বলতেন কেন? মেয়েটি কি বেঁচে নেই?

জ্বি না। সেই গল্পটাই বলতে এসেছি। লেখকরা সাইকিয়াট্রিস্টের মত। তাদের কাছে কথা বললে মন হালকা হয়। মেঘবতীর গল্প আপনাকে বলব?

বলুন।

আমি বেশি সময় নেব না। ধরুন দশ মিনিট। দশ মিনিটে গম্প শেষ করে চলে। যাব।

ভদ্রলোক আরেকটা সিগারেট ধরালেন। আমি দুঃখময় গল্প শোনার জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিলাম। ছুটির দিনে ভোরবেলায় কষ্টের গল্প শুনতে ভাল লাগে না–ভদ্রলোককে তা বলা যাবে না। তিনি তার মেঘবতীর গল্প বলে মন হালকা করতে এসেছেন।

মেয়েটার লিউকেমিয়া হয়েছিল।

আপনার কি একটাই মেয়ে?

জ্বি একটাই। ওর লিউকেমিয়া হয়েছে শুনে আমার মাথা খারাপের মত হয়ে গেল। যে ডাক্তার বললেন, ইচ্ছা করছিল গলা চেপে ধরে তাকেমেরে ফেলি। আমি বোধহয়। আমার মনের ভাব আপনাকে বুঝাতে পারছি না। আমি গুছিয়ে কথা বলতে পারি না।

আপনি বেশ গুছিয়েই কথা বলছেন।

ডাক্তার আমাকে বললেন মেয়েকে বোম্বের ক্যান্সার হাসপাতালে নিয়ে যেতে। হিসেব করে দেখি তিন লাখ টাকার মত লাগে। কোথায় পাব তিন লাখ টাকা? আমি নিম্ন-মধ্যবিত্তের একজন। নিম্ন-মধ্যবিত্তের সহায় বলতে বিয়ের সময় স্ত্রী সঙ্গে করে যা সামান্য গয়না আনেন–তা। কত আয় হবে গয়না বিক্রি করে! তবু রুমালে বেঁধে সব। গয়না একদিন বিক্রি করতে নিয়ে গেলাম। মাত্র তেইশ হাজার টাকা হল। আর টাকা। কোথায় পাই? কার কাছে যাব ধার করতে? পত্রিকায় মেয়ের ছবি দিয়ে বিজ্ঞাপন দিতে পারি। মৃত্যু পথযাত্রী মেঘবতীর জীবন রক্ষায় সাহায্য করুন। সেই অপমান, সেই লজ্জাও মৃত্যুসম। কি করব কিছুই বুঝতে পারছি না। তখন একটা ব্যাপার হল।

আন্দাজ করুন তো মজার ব্যাপারটা কি?

আন্দাজ করতে পারছি না। আপনিই বলুন।

মেয়ে মারা যাচ্ছে–মেয়ের জন্যে স্ত্রীর গয়না-টয়না সব বিক্রি করেছি এই খবরটা জানাজানি হয়ে গেল। সাহায্য আসতে শুরু করল এমন সব জায়গা থেকে যে কল্পনাও করিনি। মেয়ে যে স্কুলে পড়ত সেই স্কুলের হেডমিসট্রেস একদিন এসে দশ হাজার টাকা দিয়ে গেলেন। স্কুলের মেয়েদের কাছ থেকে চাঁদা তুলেছেন। তার দুদিন। পর মেয়ে যে ক্লাসে পড়ে সেই ক্লাসের একটি মেয়ে তার বাবাকে নিয়ে উপস্থিত। ভদ্রলোককে চিনি না, জানি না। তিনি এক লক্ষ টাকার একটা চেক নিয়ে এসেছেন। আমি আনন্দে কেঁদে ফেললাম। আমার কান্না দেখে মেয়েও কাঁদতে লাগল। নাটকের ক্রন্দন-দৃশ্যের মত রীতিমত ক্রন্দন-দৃশ্য।

একদিন আমার অফিসের কলিগরা এলেন। তারা এক দিনের বেতন নিয়ে এলেন।–আমার আত্মীয়স্বজনরা টাকা নিয়ে আসতে শুরু করলেন। ভয়ংকর কৃপণ বলে। যাকে জানতাম, যার হাত দিয়ে এলুমিনিয়ামের দশ পয়সাও গড়িয়ে পড়ে যায় না–তিনি এলেন পঞ্চাশ হাজার টাকা নিয়ে। আমার এক প্রতিবেশী, যার অবস্থা আমার। মতই, তিনি পর্যন্ত এসে আমার স্ত্রীর হাতে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে গেলেন। আমি অভিভূত হয়ে গেলাম।

যাঁরা অর্থ সাহায্য করতে পারলেন না তারা এগিয়ে এলেন বুদ্ধি ও পরামর্শ নিয়ে। তাদের বুদ্ধিতেই আমি বিভিন্ন এনজিওর কাছে চিঠি লিখলাম। সাহায্য চেয়ে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এইসব বড় বড় মানুষের কাছে চিঠি। লিখলাম। সেভ দি চিলড্রেন–এ লিখলাম। চিঠি লিখলাম আমাদের দেশের মন্ত্রীদের। কাছে–কেউ বাদ পড়ল না। এমন কি একটা চিঠি পাঠানো হল কোলকাতায় মাদার তেরেসার কাছে।

চিঠির উত্তর আসতে শুরু করল। বেশিরভাগই মেয়ের জন্যে শুভ কামনা এবং আর্থিক সাহায্যের বিধান নেই বলে দুঃখ প্রার্থনা; তবে তাদের মধ্যেও কেউ কেউ চেক পাঠালেন। মোটা অংকের চেক। একটা চেক ছিল পাঁচ হাজার পাউণ্ডের।

একদিন টাকাপয়সা হিসেব করে দেখি চৌদ্দ লাখ সত্তর হাজার টাকা জমা হয়েছে। তখন লোভ নামক ব্যাপারটা আমার মধ্যে দেখা দিল। মাথার মধ্যে ঘুরতে লাগল–আরো কিছু টাকা জোগাড় করা যাক। আরো কিছু। স্ত্রীকে বললাম, এই টাকায় হবে। না–মেয়েকে আমি আমেরিকায় নিয়ে যাব। মিনিমাম কুড়ি লাখ টাকা আমার দরকার। সাহায্য চেয়ে, ছবি দিয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেবার ব্যাপারে আমার যে প্রচণ্ড দ্বিধা ছিল সেটা কেটে গেল। আমি সব পত্রিকায় মেয়ের ছবি দিয়ে বিজ্ঞাপন দিলাম।

টিভির একটা ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানে মেয়েকে নিয়ে গেলাম। উপস্থাপক সেই অনুষ্ঠানে মেয়েটির জীবন রক্ষার জন্যে বিত্তবানদের এগিয়ে আসার অনুরোধ জানালেন। সেই অনুষ্ঠানে আমার মেয়ে একটা গান গাইল —

আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে…

আপনি কি অনুষ্ঠানটি দেখেছিলেন?

জ্বি না।

অনেকেই দেখেছেন। অনুষ্ঠানটির কারণে আমার জন্য অর্থ সংগ্রহ সহজ হয়ে গেল। দেশে কোন বড়লোকদের কাছে টাকার জন্যে যখন যাই–কিছুক্ষণ কথা বলার পরই তারা বলেন–ও আচ্ছা, বড় বড় চোখের মেয়েটি যে গান গাইল–আমরা। সবাই রাজা?… আচ্ছা আচ্ছা, ভেরি স্যাড। আপনি বসুন, আপনাকে একটা চেক লিখে দিচ্ছি…

একুশ লক্ষ টাকা জমিয়ে ফেললাম এক মাসের মধ্যে।

একুশ লক্ষ টাকা?

সামান্য কম, তবে একশ লক্ষ ধরতে পারেন। বাংলাদেশ বিমান দিল দুজনের বোম্বে যাবার ফ্রি টিকেট। বোম্বে অবশ্যি যাওয়া হল না মেয়েটা তার আগেই মারা গেল।

ভদ্রলোক সিগারেট ধরালেন। কোন কথা না বলে অনেকক্ষণ সিগারেট টানলেন। ঘড়ি দেখলেন। তারপর উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন–আপনার দশ মিনিট সময় নেব বলেছিলাম, পনের মিনিট নিয়ে ফেলেছি। দয়া করে ক্ষমা করবেন। গল্পটা শেষ করেছি। এখন চলে যাব। গল্পের শেষটা বলা হয়নি–শেষটা হচ্ছে–আমার একাউন্টে এখন বাইশ লক্ষ টাকার মত আছে। ইন্টারেস্ট জমা হচ্ছে, টাকা বাড়ছে। মাঝে মাঝে ভাবি–টাকাটা কোন জনহিতকর কাজে ব্যয় করি, কোন সেবা প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে দেই। দিতে পারি না। লোভ আমাকে বাধা দেয়। আবার নিজেও খরচ করতে পারি না। অদ্ভুত একটা অবস্থা। এখন আমার কাজ কি জানেন? কাজ হচ্ছে প্রতি মাসে গিয়ে ব্যাংকে খোঁজ নেয়া–ইন্টারেস্ট কত হয়েছে। তিশ বছর পর কুড়ি লক্ষ টাকা কম্পাউন্ড ইন্টারেস্টে কত হবে জানতে চান? বলব?

No comments