মেছো ভূত – আহসান হাবীব

মেছো ভূত – আহসান হাবীব

মইনু বাজার করে ফিরছিল। আজ শুক্রবার, শুক্রবারে মইনুকে বাজার করতে হয়। বাধ্যতামূলক। মামা বলেন, ‘এখন থেকেই তোকে বাজার করা শিখতে হবে, কারণ বাজার করাও একটা আর্ট!’ তো মইনু সেই কাঁচাবাজারের আর্ট কালচার শেষ করে বাজারের ব্যাগ হাতে বাড়ি ফিরছিল। ব্যাগটা বেশ বড়ই তার তুলনায়, মাঝেমধ্যেই মাটির সঙ্গে ঘষে যাচ্ছিল।

তবে তার ব্যাগে আছে চারটা সরপুঁটি, তিনটা বড় সাইজ, একটা একটু ছোট। পটোল আধা কেজি, লালশাক দুই আঁটি, আলু এক কেজি, মরিচ লেবু…সব মিলিয়ে প্রায় সাড়ে চার শ টাকার বাজার।

আজ প্রচণ্ড গরম। দর দর করে ঘামছে মইনু। ভাবল কোথাও বসে একটু বিশ্রাম নেওয়া যাক। মইনু মোড়ের আমগাছটার ছায়ায় একটা গাছের গুঁড়ির ওপর বসল। গতকালও এই গাছের গুঁড়িটা ছিল না। আজ এল কোত্থেকে কে জানে। তবে বসামাত্রই একটা ফুরফুরে বাতাস বয়ে গেল তার ওপর দিয়ে।

মাছ তো ভালোই কিনছ।

চমকে উঠল মইনু! সে খেয়ালই করেনি ওই গাছের গুঁড়ির ওপর আরেক মাথায় একটা লোক বসে আছে। লোকটার পরনে দলামোচড়া ময়লা কাপড়। মাথাভর্তি উষ্কখুষ্ক চুল। খোঁচা খোঁচা দাড়ি। তবে চোখ দুটো উজ্জ্বল আর লোকটা অসম্ভব ফরসা।

কইলাম মাছ দুইটা ভালো কিনছ। মিঠা পানির তাজা মাছ। কত নিল?

কেজি হিসাবে চারটার দাম পড়েছে এক শ আশি টাকা

জিতছ, লোকটা প্রশংসার দৃষ্টিতে মাছগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। মইনুর অবশ্য শুনে ভালোই লাগে। কারণ সে বাজার করে বাসায় গেলেই মামা বলেন,

কিরে মনু, পচা মাছ এনেছিস তো? মামি রেগে যান। বলেন, ‘কী সব বলো? ও ছোট মানুষ বাজারে যাচ্ছে এটাই বেশি, ও মাছের কী বোঝে?’ মামা তারপরও বলতে থাকেন। ‘বুঝলে নাজু, আমাদের মইনুকে দেখলেই বাজারের সব মাছঅলার মুখের হাসি দুই কানে গিয়ে ঠেকে।’

কেন, ওদের হাসি দুই কানে ঠেকবে কেন?

বাহ্, ওরা ওদের পচা মাছ মইনুকে গছাতে পারে যে। মামা অবশ্য এসব মজা করে বলেন, মইনু কিছু মনে করে না, মামা এমনটাই। সব সময় তাঁর মজা করা চাই।

মইনুর পকেটে একটা চুইংগাম ছিল। সেটা বের করে চিবাতে লাগল।

কী চিবাও? লোকটা জানতে চায়

চুইংগাম। খাবেন?

থাকলে দাও, একটা চিবাই। মইনুর কাছে আরেকটা ছিল, দিল। লোকটা চোখ বন্ধ করে চিবাতে লাগল। ওই ফাঁকে বাড়ির পথ ধরল মইনু।

আজ অবশ্য তেমনটা হলো না, মানে মামা পচা মাছ কেনাবিষয়ক ফানের দিকে গেলেন না। বারান্দায় গভীর মনোযোগ দিয়ে পত্রিকা পড়ছেন। তাকে দেখেও দেখলেন না যেন। মইনু ব্যাগ নিয়ে সোজা চলে গেল রান্নাঘরের দিকে।

তার আগে মামা-মামি ও মইনু সম্পর্কে একটু বলা জরুরি। মামা-মামির কোনো ছেলেপেলে নেই বলে মইনু থাকে মামা-মামির সঙ্গে। তাঁরা দুজন খুবই ভালো মানুষ। দুজনই মইনুর জন্য খুব ব্যস্ত, যদিও মামা মইনুকে একা পেলেই নানা বিষয়ে একটু খোঁচাখুঁচি করেন। মামা চান মইনু খেপে উঠে একটু প্রতিবাদ করবে, মইনু অবশ্য তা কখনোই করে না, কারণ সে ভালো করেই জানে, তার মামার মতো চমৎকার মানুষ এই ভূ-ভারতে নেই…থুরি ভূ-বাংলাতে আর দুটি নেই।

মইনু ক্লাস এইটের ছাত্র, রোল ৩২। আপাতত উচ্চশিক্ষার্থে এই ছোট্ট মফস্বল শহরটাতে আছে। কারণ এই শহরের স্কুলটা অনেক নামকরা। বিজ্ঞানী স্যার জগদীশ চন্দ্রের নামে স্কুল। এই স্কুলে পড়তে পারাও একটা ভাগ্যের কথা।

বাজার দেখে মামি বললেন,

কী মাছ এনেছিস?

সরপুঁটি মাছ

উফ্…তুই নিজে খাস সরপুঁটি মাছ?

আমি সবই খাই। এই মাছ তো মামার পছন্দ।

আচ্ছা খাবার সময়ে দেখা যাবে তুই কটা খাস আর তোর মামা কটা খায়। মইনু চলেই আসছিল, মামি বললেন, ‘কিরে, তোর মাছ কই?’

মইনু তাকিয়ে দেখে চারটা মাছ যে দড়িটাতে বেঁধে দিয়েছিল, মাছওয়ালার সেই দড়িটা আছে কিন্তু তাতে একটা মাছও নেই! তবে কি মাছগুলো রাস্তায় পড়ে গেছে। কী সর্বনাশ! ছুট লাগাল মইনু।

গাছের গুঁড়ির ওপর লোকটা তখনো বসে আছে। লোকটার দিকে তাকাল মইনু, লোকটা চোখ বন্ধ করে চিবাচ্ছে। এখনো চুইংগামটা চিবাচ্ছে!

লোকটা ওকে দেখে চোখ খুলে তাকাল। মইনু এদিক-ওদিক তাকাল, এখানে যখন বসেছিল তখনো মাছ চারটা তার সঙ্গে ছিল…তার মানে এখানেই কোথাও পড়ে গেছে মাছগুলো। লোকটার দিকে তাকিয়ে মইনু বলল—

আমার মাছগুলো কি দেখেছেন?

দেখছি। বলে লোকটা হাসে।

কোথায়?

এইখানে বলে লোকটা তার ময়লা শার্ট সরিয়ে ফরসা পেট দেখায়। মইনু বুঝে গেল লোকটা পুরোপুরি পাগল! সে এখন কী করবে বুঝতে পারছে না। সত্যি মাছগুলো গেল কই?

তুমি বিশ্বাস করলা না?

কী?

আমি যে তোমার মাছগুলো খাইছি। তুমি ছোট মানুষ, তোমার মাছগুলো খাওয়াটা ঠিক হয়নি, তার ওপর তুমি চুইংগাম দিলে। কিন্তু কী করমু, হঠাৎ এত খিদা পাইল…

কাঁচা মাছ কেউ খায় নাকি?

খায় খায়। এই যেমন আমি খাইলাম। এই দেখো বলে যা দেখায় তা দেখে মইনু চমকে উঠল। চারটা সরপুঁটি মাছের মাথা, ওর পায়ের কাছে এলোমেলোভাবে পড়ে আছে। এগুলো তো তারই কেনা সরপুঁটি মাছের মাথা! তিনটা বড়, একটা ছোট। তার মানে এই লোকটাই তার মাছগুলো খেয়েছে?

মাছের মাথা খাই না, নিষেধ আছে।

আপনি আমার মাছ খেয়েছেন কেন? রেগে ওঠে মইনু।

তোমার কাছে তো স্বীকার গেলাম আমিই খাইছি। বলে লোকটা এবার গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বলে, ‘তোমারে একটা সত্য কথা কই…আমি আসলে মানুষ না, ভূত, মেছো ভূত!’

মইনু হতভম্ব হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে লোকটার দিকে। এই পাগলের সঙ্গে কথা বলে লাভ নেই। মইনু বাড়ির দিকে হাঁটা দেয়। লোকটা অবশ্যই বদ্ধ পাগল, নইলে এভাবে কেউ কাঁচা মাছ খায়? আবার বলে সে নাকি মেছো ভূত…উফ্! কিন্তু মাছগুলো তার হাত থেকে নিল কীভাবে? তবে কি হাত ফসকে পড়ে গিয়েছিল? কিংবা যখন সে গাছের গুঁড়িতে বসেছিল তখন ভুলে ফেলে গেছে?

এই ছেলে, শোনো শোনো। পেছন থেকে মেছো ভূত লোকটা তাকে ডাকে।

কিন্তু মইনু দাঁড়ায় না। হনহন করে বাসার দিকে হাঁটা দেয়। বাসায় গিয়ে মামা-মামিকে কী বলবে ঠিক বুঝতে পারছে না। মেছো ভূতের কথা বলবে? মামা নিশ্চয়ই হাসবেন।

কিন্তু না, মেছো ভূতের ব্যাপারটা মামা-মামি দুজনই সিরিয়াসলি নিলেন।

ভূতটা নিজ থেকেই বলল সে মেছো ভূত?

হু ।

তুই ভয় পেলি না?

না, আমি ওকে একটা চুইংগামও দিয়েছিলাম।

মেছো ভূত তোর দেওয়া চুইংগাম খেলো?

—খেলো তো…আমি তো প্রথমে ভাবলাম লোকটা পাগল। পরে যখন চারটা মাছের মাথা দেখাল তখন বিশ্বাস হলো।

তারপরও তুই ভয় পেলি না?

না, ভয় তো লাগেনি, লোকটা তো মানুষের মতোই। প্যান্ট-শার্ট পরা। যদিও খুব ময়লা কাপড়চোপড়।

ওরা নানা ধরনের আকার নিতে পারে। মামি বলেন। মামা চিন্তিতভাবে মাথা নাড়লেন। ‘না, তোর বাজারে যাওয়া বন্ধ, মাছ-মাংস যা কেনার আমিই কিনব।’

কিন্তু রাতে শোয়ার সময় মইনু নিজের ঘরে যাওয়ার পথে শুনল মামা-মামি কথা বলছেন তাকে নিয়েই।

দেখলে আমার ভাগনে কী রকম গল্প বানাতে শুরু করেছে? ওকে নাকি মেছো ভূতে ধরেছে হা হা হা।

আহা ছোট মানুষ। মাছগুলো হারিয়ে লজ্জায় পড়েছে। তাই ওই গল্প বানিয়েছে হয়তো।

না না বিষয়টা তো আমি পজিটিভলি নিয়েছি। সত্যি কথা বলতে কী, একটা মিথ্যা কথা বললে ওটা ঢাকতে আরও দশটা মিথ্যা কথা বলতে হয়, তার মানে কী? এগারটা মিথ্যা কথা বলা হলো। কিন্তু এগারোটাই নতুন, এগারোটা গল্প একেকটি ক্রিয়েশন…ঠিক কি না?

হয়েছে তোমার বক্তৃতা বন্ধ করো তো। ঘুমাও, অনেক রাত হয়েছে। আর দয়া করে তোমার ভাগনেকে বাজারে পাঠিয়ো না। ছোট মানুষ, ছোট মানুষের মতোই বড় হোক। ওর বাপ-মা কী ভাববে, যদি শোনে ওকে দিয়ে আমরা বাজার করাই।

আরে এটা তো বড় হওয়ার একটা ট্রেনিং, মাছ-মাংস, শাকসবজি এসব চিনতে হবে না? আমি কত ছোটবেলা থেকে বাজার করতাম তা জানো?

জানার দরকার নেই, এখন ঘুমাও তো।

মইনু তার ঘরে এসে শুয়ে পড়ল। তার মানে মামা-মামি তার মেছো ভূতের গল্প বিশ্বাস করেননি। অবশ্য সেই কি বিশ্বাস করেছে? এ নিয়ে ভাবতে ভাবতে মইনু ঘুমিয়ে পড়ল…ঘুমিয়ে ভয়ানক একটা স্বপ্ন দেখল।

…যেন একটা হাত-পা’ওয়ালা অদ্ভুত মাছ তাকে তাড়া করেছে। কুকুর যেমন রাস্তাঘাটে তাড়া করে, তেমন করে অদ্ভুত এই মাছটা তাকে তাড়া করেছে, রাস্তার ওপর দিয়ে কেমন হাঁচড়ে-পাঁচড়ে পানি ছাড়াই তাকে তাড়া করছে মাছটা। জান দিয়ে ছুটছে মইনু। কিন্তু মাছটা প্রায় তাকে ধরে ফেলেছে…বলতে না বলতেই ভয়ংকর মাছটা পেছন থেকে খপ করে মইনুর একটা পা কামড়ে হাঁটু পর্যন্ত খেয়ে ফেলল। আশ্চর্য, খুব একটা ব্যথা পেল না মইনু। এক পা নিয়েই ছুটতে লাগল লাফিয়ে লাফিয়ে, যদিও তখন আর পেছনে মাছটা ছিল না।

এ সময় হঠাৎ কোত্থেকে মামা এসে হাজির, তিনি তো মহা অবাক এবং মনে হলো বেশ বিরক্তও!

—কিরে মইনু, তোর না বাজারে যাওয়ার কথা।

—দেখছ না আমার একটা পা নেই।

—তাই তো, তুই এক পায়ে লাফাচ্ছিস? তোর আরেক পা কই?

—একটা মাছ খেয়ে ফেলেছে।

—বলিস কী, তা-ও ভালো, বাম পা’টা খেয়েছে।

—কেন, ভালো কেন? এই যে আমাকে লাফাতে হচ্ছে। ডান পা খেলেও তো বাম পায়ে লাফাতে হতো। মামা এবার চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন, ‘তোর বিরাট সমস্যা হবে এখন।’

—কী সমস্যা?

—ফেনটম লিম্ব প্রবলেম।

—মানে?

—যেমন ধর তোর ডান পায়ের গোড়ালিতে চুলকানি উঠল। তুই চট করে চুলকালি। কিন্তু তোর যদি বাম পায়ের গোড়ালিতে চুলকানি ওঠে কী করবি?

—কেন, চুলকাব।

—গাধা, তোর তো বাম পা-ই নেই।

—তাই তো, তাহলে কী হবে?

—এটাই তো ফেনটম লিম্ব…অন্যভাবে এটাকে ভৌতিক চুলকানিও বলা যায়। পা নেই অথচ পা চুলকাচ্ছে…হা হা হা। মইনুর এ রকম বিপদ আর মামা হাসছে! এটা হলো কিছু? আর ঠিক তখন মইনুর বাম পায়ের গোড়ালিতে চুলকানি উঠল। আর তখনই তার ঘুমটা ভেঙে গেল। দেখে তার বাম পা’টা মশারির বাইরে চলে গেছে। সেখানে গোড়ালির কাছে তিনটা মশা রক্ত খেয়ে ফুলে মোটামুটি একেকটা পাঁচ নম্বর ফুটবল হয়ে বসে আছে। ঠাস করে মশারিসুদ্ধ থাপ্পড় মারল মইনু। তিনটা মশাই স্কিন স্পট ডেড। মানে স্কিনের ওপর স্পট ডেড। পায়ের গোড়ালিতে মশার রক্তে মাখামাখি। তারপর আর কী, মনের সুখে কিছুক্ষণ চুলকালো ওই জায়গাটায় মইনু।

একটু বাদেই বাইরে আজানের শব্দ শোনা গেল। এত সকালেই ঘুম ভেঙে গেল কেন আজ? বারবার ওই পাগলটার কথা মনে হচ্ছিল। আসলেই কি ও পাগল, না সত্যি কোনো মেছো ভূত? কে জানে…!

কিন্তু কদিন বাদেই দেখা গেল এই মাছ চুরি বা মাছ গায়েব হওয়ার ঘটনা আরও ঘটতে লাগল তাদের পাড়ায়। আশপাশে অনেকেরই এ ঘটনা ঘটতে শুরু করল। হয়তো বাজার থেকে কেউ বড়সড় মাছ কিনে ফিরছে হঠাৎ দেখে হাতে মাছ নেই। মাছের কানকোতে বাঁধা দড়িটা শুধু ঝুলছে। কী কাণ্ড! এ নিয়ে একদিন মারামারি পর্যন্ত হয়ে গেল…শেষ পর্যন্ত পুলিশ এল এলাকায়। ঘটনাটা এ রকম—এলাকার বদরুল সাহেব বড়সড় একটা চিতল মাছ কিনে বাড়ি ফিরছিলেন। পথে মাতবরের টংয়ের দোকানে চা খেতে বসলেন। তাঁর চিতল মাছ দেখে দোকানের উপস্থিত সবাই প্রশংসা করল। দাম বেশি নিয়েছে কিন্তু মাছ তাজা…মাছের চোখ লাল মানে বৃষ্টির সময় ধরা মিঠা পানির তাজা মাছ…ইত্যাদি ইত্যাদি নানা মন্তব্য। এর মধ্যে একসময় দোকান খালি হয়ে গেল। বদরুল সাহেব চা শেষ করে একটা সিগারেট ধরিয়ে মাছ নিয়ে উঠতে যাবেন দেখেন, তাঁর মাছ নেই। শুধু কানকোর বাঁধা দড়িটা আছে।

তারপর তো হাউমাউখাউ অবস্থা। বদরুলের কথা হচ্ছে এটা মাতবরের ষড়যন্ত্র, তাঁর লোকজন দিয়ে সে এই মাছ হাপিশ করেছে। প্রথমে উত্তপ্ত বাক্যালাপ, তারপর হাতাহাতি, তারপর দোকান ভাঙচুর…শেষ পর্যন্ত পুলিশ আসতে বাধ্য হলো। পুলিশ এসে বদরুল আর মাতবর দুজনকেই থানায় নিয়ে গেল।

এ ঘটনার পর সবাই টের পেল আসলেই তাদের এলাকায় কিছু একটা ঘটছে। মাছ অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। কেউ ঘর পর্যন্ত মাছ আনতেই পারছে না। তার আগেই মাছ গায়েব! মামা পর্যন্ত একদিন মইনুকে ডেকে মিটিংয়ে বসলেন।

—আচ্ছা মইনু, ব্যাপার কী বল তো?

—কোন ব্যাপার?

—তোর ওই মেছো ভূত তো মনে হচ্ছে সত্যিই আছে।

—তা তো আছেই। আমার মাছই তো প্রথম নিল…

—আচ্ছা, তোর সঙ্গে আর দেখা হয়নি ওই মেছো ভূতের?

—না, ওই একবারই। আর দেখিনি লোকটাকে।

—আশ্চর্য, বুঝলি সেদিন আমার মাছটাও…

—তোমার মাছও নিয়েছে? বলোনি তো।

—শশশ…তোর মামিকে কিছু বলিস না। হ্যাঁ, আড়াই শ টাকা কেজি দরে তিন কেজির একটা বেশ বড় রুই মাছ কিনেছিলাম। তবে পরে অবশ্য শুধু মাছের মাথাটা পেয়েছিলাম।

—হ্যাঁ, ওরা নাকি মাছের মাথা খায় না।

—তোকে বলেছে?

—হ্যাঁ, ওই দিনই যখন মাছ খুঁজতে গেলাম তখন বলেছে।

—আমার মনে হয় ব্যাপারটা পুলিশকে জানানো দরকার।

—পুলিশ জেনে গেছে।

—মানে?

—ওই দিন মাতবরের দোকানে মারামারি হলো না? ওই দিনই পুলিশ মনে হয় জেনে গেছে।

—মেছো ভূতের ব্যাপারটা জেনেছে?

—তা জানি না। তবে মাছ গায়েব হওয়ার ব্যাপারটা জেনে গেছে।

—কী জানি কী হয়। তবে এসব ভৌতিক ব্যাপারে পুলিশ কী করবে বুঝতে পারছি না। ভূতের ওঝা ডাকা দরকার।

ঠাট্টা-তামাশা করা মামাকে এবার বেশ সিরিয়াস মনে হলো। আসলে মেছো ভূতের কারণে মামা…শুধু মামা কেন, পাড়ার অনেকেই মাছ খেতে পারছে না! সবাই বেশ শঙ্কিত। মাছের বাজারেও লোকজন কমে গেছে।

বৃহস্পতিবার মইনুদের স্কুল হাফ। ছুটির পর মইনু আর রুবেল স্কুল থেকে ফিরছিল। রুবেল বলল:

—আজ আমরা মাছ দিয়ে ভাত খাব…মাছে-ভাতে বাঙালি।

—বাজার থেকে মাছ কিনে আনতে পারলি? মেছো ভূত নিয়ে যায়নি?

—মেছো ভূত? থমকে দাঁড়ায় রুবেল।

—হ্যাঁ, মেছো ভূত ছাড়া মাছ আর গায়েব করছে কে?

—তাই তো! তা-ই হবে হয়তো…দারুণ বলেছিস। তবে আমরা বাজার থেকে মাছ কিনিনি। বাবা ঢাকা থেকে টুনা ফিশ এনেছে। ক্যানে করে বিক্রি হয় ঢাকায়। দারুণ স্বাদ নাকি।

টুনা ফিশের অনেক গুণ বুঝলি? তারপর টুনা ফিশের গুণাগুণ নিয়ে বলতে লাগল। যেমন টুনা ফিশ লবণ পানির মাছ, এই মাছ যে পানিতে থাকে সেই পানির উষ্ণতা থেকে বেশি উষ্ণতা তার নিজের শরীরে ধরে রাখতে পারে। অসম্ভব দ্রুতগতির এই মাছ ঘণ্টায় ৭৫ কিলোমিটার পর্যন্ত ছুটতে পারে।

—এত কিছু জানলি কীভাবে?

—ক্যানের গায়েই এসব লেখা আছে। আর এই মাছ কুচি পেঁয়াজ দিয়ে ঝাল ঝাল করে রাঁধলে…

সব শুনে মইনুর জিবে জল এসে গেল। ইশ্শশ…যদি টুনা ফিশ খাওয়া যেত। কেমন দেখতে মাছটা?

পরদিন একটা কাণ্ড হলো। স্কুল বন্ধ। মইনু তার ঘুড়ি আর নাটাই নিয়ে জংলার মাঠে গিয়ে দেখে কেউ নেই। রকিব আর তাজুলের আসার কথা, তাদের ঘুড়ি নিয়ে কেউই আসেনি।

—এই ছেলে?

চমকে ঘুরে তাকায় মইনু। দেখে সেই লোকটা…সেই মেছো ভূত! একটা আমগাছের নিচে দুই হাঁটু জড়িয়ে ধরে অদ্ভুত ভঙ্গিতে বসে আছে। ওই দিন ভয় লাগেনি। আজকে কেমন যেন গা-টা শিরশির করে উঠল মইনুর।

—আ-আপনি মেছো ভূত?

—হ্যাঁ, মনে আছে তাহলে

—আপনি থাকেন কোথায়?

—আমরা আসলে শরীরে থাকি না…মাঝেমধ্যে মানুষের শরীর নেই…এই এখন যেমন নিলাম। তবে ভয়ের কিছু নেই।

—আমি ভয় পাচ্ছি না।

—না পাওয়াই ভালো।

—কিন্তু আপনার জন্য আমরা তো মাছই খেতে পারছি না। সব মাছ আপনি খেয়ে ফেলছেন।

—তা ঠিক…গ্রামেই ভালো ছিলাম বুঝলে, খাল-বিলের তাজা মাছ খেতাম। কেন যে তোমাদের এই শহরে এলাম। এখানে তো মনে হচ্ছে সব মাছে ফরমালিন দেওয়া। সত্যি কথা বলতে কী, আমি আসলে চলেই যেতাম। কিন্তু কাল রাতে হঠাৎ একটা বাসায় টুনা ফিশ পেলাম…দারুণ স্বাদ, তাই ভাবছি আর কটা দিন থাকি। এ সময় পেছনে হইচই শোনা গেল, নিশ্চয়ই রকিব-তাজুলেরা আসছে। ঘুরে তাকিয়ে দেখে তারাই…ফিরে দেখে গাছের নিচটা শূন্য, একটু আগেও ওখানে মেছো ভূতটা বসে ছিল, এখন নেই!

পরদিন স্কুলে রুবেলকে দেখে এগিয়ে গেল মইনু।

—কিরে, টুনা ফিশ খেয়েছিলি?

রুবেল কেমন ফ্যাকাশে দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল, তারপর ঠোঁট চেটে বলল, ‘না।’

—কেন?

—টিন খুলে দেখা গেল ভেতরে কিছু নেই। দুটো টিনই খালি। একেবারে চেঁছেপুঁছে খালি।

—বলিস কী?

মইনুর একবার ইচ্ছে হলো বলে যে সে জানত তাদের টুনা ফিশ খাওয়া হয়নি, সেটা সে জানে। মেছো ভূত তাকে বলেছে। সেটা বলল না। বলল:

—তোকে একটা কথা বললে শুনবি?

—কী কথা?

—ওই টিনের টুনা ফিশ ঢাকা থেকে আর আনিস না তোরা। তোর বাবাকে নিষেধ করে দিস।

—কেন?

—তাহলে মেছো ভূত আমাদের পাড়া থেকে চলে যাবে।

—তুই কীভাবে জানলি?

—আমি জানি।

রুবেল সন্দেহজনক চোখে তাকিয়ে থাকল মইনুর দিকে। মইনুর কেমন অস্বস্তি বোধ হলো। রুবেল ওর দিকে এমনভাবে তাকাচ্ছে যেন ওদের টুনা ফিশ ও-ই খেয়ে ফেলেছে। কিংবা মেছো ভূতকে দিয়ে ও-ই খাইয়েছে।

তবে ওই দিন সন্ধ্যায় মইনুর বাসায় পুলিশ এল। লোকাল থানার ওসি সাহেব। মামা-মামি কেউ ছিল না, দরজা খুলল মইনু। পুলিশ দেখে অবাক হলো মইনু, ওসি সাহেবকে সে আগেও দেখেছে। ভাবল হয়তো মামার কাছেই এসেছে কোনো কারণে।

—কাকে চান?

—তুমি আফজাল সাহেবের ভাগনে মইনু?

—হ্যাঁ।

—তোমাকেই দরকার। বলে ওসি সাহেব আয়েশ করে বসলেন সোফায়। বললেন, ‘তুমি ওই চেয়ারটায় বসো’ মইনুর বুকটা ঢিব ঢিব করছে। তারপর ওসি সাহেবের সঙ্গে তার নিম্নরূপ কথাবার্তা হলো—

—কিছুদিন ধরে মানুষের হাত থেকে এই এলাকায় মাছ চুরি হচ্ছে জানো তো?

—জানি।

—তুমি নাকি বলে বেড়াচ্ছ এটা মেছো ভূতের কাজ? মেছো ভূত সব মাছ খেয়ে ফেলছে।

—মেছো ভূতের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। সে-ই বলেছে।

—কী বলেছে?

—বলেছে মাছ নিয়ে খেয়ে ফেলে, তবে মাথাটা খায় না। মাথা খাওয়া ওদের নিষেধ।

হঠাৎ গা কাঁপিয়ে শব্দ করে হাসতে লাগলেন ওসি সাহেব। যেন খুব মজার কথা শুনলেন। তারপর হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেলেন।

—তোমার মামাকে ডাকো।

—মামা-মামি কেউ বাসায় নেই।

—তাহলে শোনো, তোমাকেই বলি। এবার বেশ কড়া গলায় বললেন ওসি সাহেব। ‘এসব মেছো ভূতের গল্প আর বলবে না…মেছো ভূতফুত বলে কিছু নেই। এসব বলে প্যানিক সৃষ্টি করা যাবে না…পাবলিক নুইস্যান্স। ঠিক আছে?’

মইনুর রাগ উঠে যায়। তারপরও সে মাথা নাড়ে।

আর এসব কারা করছে আমি জানি। বাইরে থেকে একটা চক্র এসেছে এখানে। একটাকে ধরেছিও…এখনো ডলা দিইনি…বাঁশডলা যখন দেব তখন সব কথা ফরফর করে বলে দেবে, তবে দলে নাকি আরেকটা আছে। তারপর হঠাৎ গলা নামিয়ে ফেললেন ওসি সাহেব। বললেন, ‘আমি সিভিল ড্রেসে কেন এসেছি জানো?’

মাথা নাড়ে মইনু।

আমি এখন মাছের বাজারে যাব, তারপর বাজারের সবচেয়ে বড় মাছটা কিনব, তারপর হেঁটে হেঁটে থানায় ফিরব দেখি সেকেন্ডটাকে ধরতে পারি কি না। এদের হাতের কাজ মারাত্মক। হাইলি ট্রেইন্ড। কিন্তু শুধু মাছ চুরি করছে কেন এটাই বুঝতে পারছি না। নিশ্চয়ই এর মধ্যে কোনো রহস্য আছে। তবে সেকেন্ডটাকে ধরে ঠিক বের করে ফেলব দেখো…।

ওসি সাহেব যেমন হুড়মুড় করে এসেছিলেন, তেমনি হুড়মুড় করে চলে গেলেন।

ঘণ্টা খানেক পর ওসি সাহেব থানায় তাঁর কথামতো হেঁটে হেঁটে ফিরলেন। হাতে দড়িতে বাঁধা বাজারের সবচেয়ে বড় রুই মাছটা। পথে কোথাও কোনো সমস্যা হলো না। তবে থানার কাছে এসে মাছটা আর আগের মতো ভারী লাগছে না, হালকা লাগছে। এটা হতেই পারে…ভরকেন্দ্রের ব্যাপার। মাছটা হাতে ধরায় পরিবর্তন আনায় এই ব্যাপারটা হয়েছে। তাঁর আর মাছের শরীরের ভরকেন্দ্র একসঙ্গে নিশ্চয়ই জায়গা বদল করেছে। ফিজিকসের বিষয়। ওসি সাহেব অনার্স করেছেন ফিজিকসে। কিছু কিছু বিষয় এখনো মাথায় আছে তাঁর, ব্যাপারটা চিন্তা করে তাঁর বেশ ভালো লাগল। শুধু থানার গেটে ডিউটিরত সেপাই ওসি সাহেবের মাছটার দিকে চোখ গোল গোল করে তাকিয়ে থাকলেন। কিছু বললেন না। ওসি সাহেব ভাবলেন, ‘বলবেন কি এত বড় মাছ বাপের জন্মে দেখেছে কেউ?’ কিন্তু এসআই মুকুল হাসিমুখে বলে উঠলেন, ‘স্যারের নিশ্চয়ই রুই মাছের মুড়িঘন্ট খাওয়ার শখ হয়েছে? তাই বাজার থেকে শুধু মাথা কিনেছেন?’

ওসি সাহেব তাকিয়ে দেখেন, সে কী, তাঁর হাতের দড়িতে শুধু রুই মাছের মাথাটা ঝুলছে! শরীরটা নেই!!

এ ঘটনার পর, মানে পরদিনই। ওসি সাহেব এলেন মইনুদের বাসায়, সঙ্গে দুজন সেপাই। আগের সেই মারদাঙ্গা ভাবটা নেই, কেমন যেন চুপসে গেছেন। সেদিন অবশ্য বাসায় মামা-মামি দুজনই ছিলেন। মামা আর মইনুকে নিয়ে বৈঠকে বসলেন ওসি সাহেব। টানা মিটিং, মাঝখানে অবশ্য ওসি সাহেবকে একপ্রস্থ চা-বিস্কুট দেওয়া হলো। মিটিংয়ে মইনুর পরামর্শ গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া হলো (মইনু রুবেলের বাসায় টুনা ফিশ আনা আর ওই কারণে মেছো ভূতের থেকে যাওয়াটা বিতং ব্যাখ্যা করল)। ওসি সাহেব পুরো বিষয়টি যথেষ্ট গুরুত্বসহকারে নিলেন। টিনজাত মাছ (টুনা ফিশ বা অন্যান্য সুস্বাদু বিদেশি মাছ) যেন আপাতত এলাকায় না ঢোকে।

বিষয়টি মাইকিং করে জানিয়ে দিলে কেমন হয়? ওসি সাহেব বলেন।

না না, তাহলে মেছো ভূত জেনে যাবে। ও তো মানুষের শরীর নিয়ে ঘুরে। মইনু বলে।

তা অবশ্য। তাহলে উপায়?

পাড়ার অবস্থাপন্ন বাড়িগুলোতে জানালেই হবে। টুনা ফিশ তো অনেক দামি মাছ। মামা বলেন। সবাই কিনবে না নিশ্চয়ই

তাহলে তা-ই করি। ওসি সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। তারপর মইনুর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আচ্ছা, মেছো ভূতের সঙ্গে তুমি কোনো সেলফি তোলোনি?’

নাহ্, আমার মোবাইল নেই তো।

হুম, বাচ্চাকাচ্চার হাতে মোবাইল না থাকাই ভালো। তবে একটা সেলফি থাকলে মানে একটা ছবি থাকলে মেছো ভূতের একটা রেকর্ড থাকত থানায়। আফসোসের সঙ্গে মাথা ঝাঁকালেন ওসি সাহেব।

সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই মাছের বাজার আবার চালু হয়ে গেল, সবাই মাছ কিনে নিরাপদে বাড়ি ফিরতে লাগল। ফের মাছে-ভাতে বাঙালি হয়ে উঠল যেন পাড়াটা।

তবে পাড়ার একটা বিষয় কেউ জানল না। যেদিন থেকে সবাই মাছ নিয়ে বাড়ি ফিরতে শুরু করল নিরাপদে, সেদিন সবার ঘরেই কোনো না কোনো মাছ ছিল। শুধু মইনুদের বাসায় কোনো মাছ কেনা হয়নি। মামা সেদিন বাজারে যাননি। কিন্তু কী আশ্চর্য, তাদের সদর দরজার হুকে চারটি সরপুঁটি মাছ ঝুলছে, চারটিই বেশ বড়সড়! তবে কি মেছো ভূত প্রথম খাওয়া তার চারটি সরপুঁটি মাছই ফেরত দিয়ে গেল মইনুকে? কিন্তু কেন? এর উত্তর অবশ্য মইনু এখনো খুঁজে পায়নি!

No comments