ওস্তাদের মার – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়
রেলগাড়ির সঙ্গে কুঁড়ির যে এমন আড়াআড়ি সম্পর্ক, এর আগে কোনওদিন সেটা টেরও পাননি শিবুমামা। ঝটাং ঝট–ঝটাং ঝট দিল্লি মেল ছুটছে। সেই সঙ্গে ছুটছেন শিবুমামাও। নামবেন হাথরাসে–সেখান থেকে বেড়াতে যাবেন মথুরায়। কিন্তু দুলুনির চোটে সন্দেহ হচ্ছে সশরীরে নয়, অশরীরী হয়েই তাঁকে মথুরায় পৌঁছুতে হবে।
চিত হয়ে শুলেন–ভুঁড়িটা অ্যাটলান্টিকের মতো দুলতে লাগল। কাত হয়ে শুলেন–পেটের মধ্যে সোডার বোতলের মতো ঝাঁকাতে লাগল। উপুড় হয়ে শুলেন সারা শরীর বলের মতো লাফাতে লাগল।
নাঃ–অসম্ভব!
টাকার শোকে শিবুমামার হৃদয় হাহাকার করতে লাগল। মিথ্যে মিথ্যিই এতগুলো টাকা খরচ করে সেকেন্ড ক্লাসে বার্থ রিজার্ভ করলেন। ঘুমোনোই যদি না গেল তা হলে ঘুষোঘুষি করে জানালা দিয়ে থার্ড ক্লাস কামরায় চাপলেই বা ক্ষতি ছিল কী? বরং সেইটেই ঢের ভালো হত, শিবুমামা ভেবে দেখলেন। ভিড়ের চাপে নড়াচড়া করা তো দুরের কথা, ট্যাঁ-ফোঁ করার জো থাকত না ভুড়ির। বরং একফাঁকে মোটাসোটা কারও কাঁধের উপর মাথাটাকে চড়িয়ে দিয়ে ঘুমিয়েও নিতে পারতেন খানিকটা।
কিন্তু সেকেন্ড ক্লাসের এই সুখশয্যা শরশয্যা বলে মনে হচ্ছে তাঁর।
কামরায় দুটি মাত্র প্রাণী। ও-পাশের বার্থে রোগাপটকা এক ছোকরা অঘোরে ঘুমুচ্ছে। শিবুমামার হিংসে হতে লাগল। এই রাত বারোটায় তিনি যখন ঠায় জেগে, তখন আর একজন এমন করে সুখনিদ্রা দিচ্ছে। তাঁর নাকে যখন শ্যামা পোকা ঢুকে সুড়সুড়ি দিচ্ছে, তখন আর-একজন নাক ডাকাচ্ছে। এ কী নির্মম নিষ্ঠুরতা! কী হৃদয়হীন স্বার্থপরতা।
এ কিছুতেই বরদাস্ত করা যাবে না।
শিবুমামা আস্তে আস্তে উঠে এলেন।
মশাই শুনছেন?
সাড়া নেই।
শুনতে পাচ্ছেন, অ মশাই?
–উ?–ঘুমন্ত ছোকরার নাকের ডাক বন্ধ হল।
–শুনুন না একবার
–অ্যাঁ–কী হয়েছে?–বলে ছোকরা ধড়মড় করে উঠে বসল : ব্যাপার কী? এত রাতে এমন করে ডাকাডাকি করছেন কেন?
শিবুমামা টাক চুলকে নিলেন একবার।
না ইয়ে, এই জিজ্ঞেস করছিলুম, আপনি ঘুমোচ্ছেন কি না।
খানিকক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে শেষে ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে উঠল ছোকরা।
–আচ্ছা লোক তো মশাই! ঘুমুচ্ছি কি না জানবার জন্যে আমাকে ঘুম থেকে জাগালেন!
শুনে শিবুমামা ফ্যাক-ফ্যাক করে হাসলেন।
–আহা তা নইলে বুঝব কেমন করে যে সত্যিই ঘুমোচ্ছন না চালাকি করে মটকা মেরে পড়ে আছেন।
–এই মাঝরাতে দিল্লি মেলে কোন দুঃখে মটকা মেরে পড়ে থাকব মশাই! চালাকিই বা করতে যাব কার সঙ্গে? আপনি ত ভারি ফেরেব্বাজ লোক! যান যান, কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান করে বিরক্ত করবেন না। ঘুমুতে দিন।
–চটছেন কেন দাদা?–মুখভরা হাসি টেনে শিবুমামা লোকটির বিছানার পাশে বসে পড়লেন, বসে পড়লেন একেবারে গা ঘেঁষেই! বললেন–সত্যিই তো আর ঘুমুচ্ছিলেন না। দিব্যি নিরিবিলিতে শুয়ে-শুয়ে হাঁসের ডিম খাচ্ছিলেন।
কী যা তা বকছেন মশাই! মাথা খারাপ নাকি আপনার? শান্তিপুরের গোঁসাই বংশের ছেলে আমি। হাঁসের ডিম খাওয়া কী বলছেন, হাঁস দেখলে গঙ্গা স্নান করে ফেলি।
–সেই জন্যেই তো দিল্লি মেলে চাদর মুড়ি দিয়ে চুপিচুপি ডিম খাচ্ছিলেন!
লোকটা এবার তেড়ে উঠল–মিথ্যে বদনাম দেবেন না মশাই, জানেন এর জন্যে আপনার নামে মানহানির মামলা করতে পারি আমি?
না, পারেন না–শিবুমামা আবার ফ্যাক-ফ্যাক করে হাসলেন : হাতে-হাতে ধরা পড়ে গেছেন।–বলেই খপ করে লোকটার চাদরের তলায় হাত দিয়ে একটা ডিম বার করে আনলেন : এটা কী?
–অ্যাঁ–ডিম!–লোকটার চোখ ছানাবড়া হয়ে উঠল।
–হ্যাঁ, ডিম।
–অসম্ভব, হতেই পারে না।
হতেই পারে না! তা হলে বালিশে ডিম পাড়ল বলতে চান? হাঁসে ডিম পাড়ে মশাই, মুরগিতেও পাড়ে, ঘোড়ও পাড়ে কখনও কিন্তু বালিশে ডিম পাড়ে–এ তো কখনও শোনা যায়নি! তাও আবার সেদ্ধ ডিম!
–তা হলে আপনিই চালাকি করে বালিশের নীচে ডিম রেখেছেন। লোকটা চেঁচিয়ে উঠল।
–আমি? আমি কেন রাখতে যাব? কী দায় আমার? পরের বিছানায় সেদ্ধ ডিম রাখার চেয়ে নিজের পেটে রাখাই আমি ঢের বেশি বুদ্ধিমানের কাজ মনে করি।
চক্রান্ত! ভীষণ ভয়ঙ্কর চক্রান্ত।–লোকটা প্রায় কেঁদে ফেলল : আমার সর্বনাশ করবার ফন্দি! জানেন, আমি ডিম খেয়েছি শুনলে বাবা দারোয়ান দিয়ে আমাকে বের করে দেবেন? তিন লাখ টাকার সম্পত্তি একেবারে বরবাদ!
শিবুমামা বললেন : আহা-হা, চুক চুক!
-চুক চুক? চুক চুক করেই চুকিয়ে দিলেন আপনি?–এদিকে যে আমার বুক ধুক ধুক করছে মশাই! উঁহু, এ সব আপনার ষড়যন্ত্র। হীন, কুটিল ষড়যন্ত্র। নিশ্চয়ই কোনও গুণ্ডাদলের লোক আপনি! নির্ঘাত লোকটার গলা কাঁপতে লাগল, চিড়বিড় করে উঠে দাঁড়াল সে : আমি–আমি এখুনি চেন টানব
চেন টানবার আগেই তাকে টেনে বসিয়ে দিলেন শিবুমামা।
–আহা-হা, অত খেপছেন কেন? আমার সামনে ডিমটা খেতে যদি আপনার চক্ষুলজ্জা হয়, তা হলে আমিই খেয়ে নিচ্ছি না হয়। সশব্দে ডিমটাকে মুখে পুরলেন শিবুমামা, চোখ বুজে পরম আরামে চিবুতে লাগলেন : হুঁ, ভালোই ডিমটা। পচা নয়।
রাখুন আপনার ভালো ডিম। ছাড়ুন আমাকে আমি চেন টানব।
–অত ঘাবড়াচ্ছেন কেন?-ডিমটাকে ম্যানেজ করে শিবুমামা বললেন : কেন ভয় পাচ্ছেন এমন করে? আমার মতো নিরীহ একটা ভালো লোককে দেখে গুণ্ডা বলে ভ্রম হচ্ছে আপনার? দুটোর জায়গায় চারটে চোখ নিয়েছেন, তবু মানুষ চিনতে পারেন না?
বলেই ধাঁ শিবুমামা ছোরার নাকের ওপর থেকে চশমাটা তুলে নিলেন।
–আহা করছেন কী? চশমা দিন মশাই।
কী হবে চশমা দিয়ে? যে-চশমা পরে ভদ্রলোককে গুণ্ডা বলে মনে হয়, সে চশমা থাকলেই কী, আর গেলেই কী?–বলেই শিবুমামা জানলা দিয়ে হাত গলিয়ে দিলেন বার করে আনলেন খালি হাত।
ছোকরা আর্তনাদ করে উঠল।
–অ্যাাঁ! করলেন কী? ফেলে দিলেন চশমাটা?
–দিলাম বই কি! চুকিয়ে দিলাম আপদ।
-সোনার ফ্রেমের চশমা মশাই, বাইফোকাল লেন্স। কমসে কম দুশো টাকা দাম। জানলা দিয়ে ফেলে দিলেন–আপনি তো বদ্ধ পাগল!
ছোকরা আবার চেঁচিয়ে উঠল : এইবার আমায় কামড়ে দেবেন দেখছি! আর পাগলে কামড়ালেই জলাতঙ্ক! আমি চেন টানব-নির্ঘাত চেন টানব
বলেই এক লাফে চেন ধরে ঝুলে পড়তে গেল। কিন্তু তার আগেই তাকে ধরে ঝুলে পড়লেন শিবুমামা। একেবারে চিত করে ফেললেন মেজের ওপর।
ছোকরা গ্যাঙাতে গ্যাঙাতে বলল : হেলপ হেলপ–মার্ডার! মার্ডার।
–কিসের মার্ডার? কে কাকে মার্ডার করে?–শিবুমামা ছোকরার ঘাড় ধরে বার্থের ওপর তুলে নিলেন : আমি থাকতে কে মার্ডার করবে আপনাকে?
আমার দুশো টাকা দামের চশমা–
চশমা চশমা করে খেপে গেলেন যে। ওই তো আপনার বুক পকেটে চশমা। রয়েছে বলেই ঝাঁ করে তার পকেট থেকে চশমা বের করে আনলেন শিবুমামা।
অ্যাঁ।
–অ্যাঁ কী মশাই। নিজের পকেটে চশমা রেখে চেন টানতে যাচ্ছিলেন। এক্ষুনি পঞ্চাশ টাকা ফাইন হত, খেয়াল আছে!
–আপনি–আপনি ভেলকি জানেন মশাই।–ছোকড়া বিড়বিড় করে বললে।
–ভেলকি! ভেলকি-টেলকির কোনও ধার ধারি না আমি। একরাশ ডিম খেয়ে আপনার পেট গরম হয়েছে, তাই ও-সব খেয়াল দেখছেন।
খবরদার বলছি, ডিম ডিম করবেন না।–এত দুঃখের মধ্যেও খেঁকিয়ে উঠল লোকটা : জানেন বাবার কানে গেলে কী অবস্থা হবে আমার? স্রেফ কান ধরে রাস্তায় নামিয়ে দেবেন। আমাকে!
ভয় নেই মশাই–আশ্বাস দিয়ে শিবুমামা খ্যাঁক-খ্যাঁক করে হাসলেন : আমি কাউকে বলতে যাচ্ছি না। বলেই বা আমার লাভ কী? আপনাকে ত্যাজ্যপুত্র করে আপনার বাবা তো আর আমাকে সম্পত্তি তুলে দেবেন না। সে-ভরসা থাকলে না হয় দেখা যেত চেষ্টা করে। আমি বলছিলাম, ভবিষ্যতে অমন করে আর রাত জেগে ডিম খাবেন না। মাথা গোলমাল হয় ওসব খেলে।
শিবুমামা উঠে পড়লেন।
–নিন, ঘুমুন এবার।
নিজের সিটে ফিরে এলেন শিবুমামা, একটা সিগারেট ধরিয়ে নিশ্চিন্তে টানতে লাগলেন। ছোকরা কিছুক্ষণ হাঁ করে তাঁর দিকে তাকিয়ে বসে রইল। অনেকগুলো কথা তার গলার ভেতর গজগজ করে উঠছিল, কিন্তু বলবার মতো সাহসই খুঁজে পেল না সে।
তারপর সত্যিই মাথা গরম হয়ে গেছে মনে করে নিজের ব্রহ্মতালুতে টক-টক করে টোকা দিলে গোটা তিনেক। দুবার পেটে থাবড়া দিয়ে বুঝতে চাইল সত্যি সত্যিই পেট গরম হয়েছে কি না। শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দিয়ে আবার চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ল–পাঁচ মিনিটের মধ্যে নাক ডাকতে শুরু করল তার।
শিবুমামা চুপচাপ বসে সিগারেট টানতে লাগলেন।
ঝটাং ঝট–ঝটাং ঝট
দিল্লি মেল অন্ধকারের মধ্য দিয়ে সমানে ছুটছে। রাত প্রায় দুটো, গভীর ঘুমের মধ্যে তলিয়ে আছে ছোকরা।
-খুন-খুন বাঁচাও
বিকট বিকৃত চিৎকার উঠল একটা। সে-চিৎকারে, ধড়মড় করে লাফিয়ে উঠতে গেল ছোকরা, তারপর চাদরে পা জড়িয়ে হুড়মুড় করে পড়ে গেল মেজের ওপর।
কিন্তু উঠে দাঁড়াতেই যে-দৃশ্য তার চোখে পড়ল, তাতে চোখ ঠিকরে বেরিয়ে এল তার। এর মুহূর্তে সারা শরীর হিম হয়ে গেল, গলা দিয়ে বেরিয়ে এল একটা ভয়ঙ্কর আর্তনাদ।
নিজের বার্থে হাত-পা ছড়িয়ে চিত হয়ে পড়ে আছেন শিবুমামা। একটা ধারালো চকচকে ছোরা তাঁর গলায় বসানো। একরাশ রক্ত জমেছে তাঁর বুকের ওপর। চোখ দুটো বিস্ফারিত–ট্রেনের তালে-তালে শুধু তার ভুড়িটাই দোল খাচ্ছে।
আর একটা আর্তনাদ তুলেই সে পেছন ফিরে চেনের দিকে লাফ মারল। এবার আর তাকে বাধা দিলে না কেউ। চেন ধরে সটান ঝুলে পড়ল সে।
ঘটাং ঘট–ঘ্যাস-ঘ্যাস-ঘ্যাস–দিল্লি মেল থেমে গেল।
বাইরে কোলাহল উঠল। ট্রেন থেকে নেমে পড়ল লোকজন। খানিক পরেই ঘটাং করে খুলে গেল কামরার দরজা। লণ্ঠন হাতে ঢুকলেন গার্ড, তার পেছনে আরও পাঁচ-সাতজন। ছোকরা তখনও চেন ধরে ঝুলছে চোখ বুজেই।
ব্যাপার কী? অমন করে ঝুলছেন কেন চেন ধরে?–হেঁড়ে গলায় জানতে চাইলেন গার্ড।
–খুন হয়েছে তেমনি চোখ বুজে জবাব দিলে ছোকরা।
–খুন? কোথায় খুন? হকচকিয়ে গার্ড উঠে এলেন ভেতরে।-কে খুন হল? লাশ কই?
পাশের বার্থে।
পাশের বার্থে!–গার্ডের বিস্ময় সীমাহীন : পাশের বার্থে তো কেউ নেই মশাই। একটা বিছানা আছে বটে, কিন্তু লাশফাশ তো দেখছি না।
–আছে–আছে, ভালো করে দেখুন।
ভালো করে দেখব? লাশ কি ছারপোকা মশাই যে বিছানার ভেতর ফস করে লুকিয়ে যাবে?–গার্ড বার্থের নীচে উবু হয়ে উঁকিঝুঁকি মারলেন : কিচ্ছু না–কোথাও কিছু নেই। লাশ গেল কোথায়?–গার্ড বিরক্ত হয়ে ছোকরার জামা ধরে টান মারলেন, নেমে পড়ুন না মশাই! খামকা ছিঁড়ছেন কেন কোম্পানির চেন?
টয়েলেটের দরজা খুলে শিবুমামা বেরিয়ে এলেন।
ব্যাপার কী, এত চেঁচামেচি কিসের? আবার গাড়িতে গার্ড সাহেব যে। কী হল?
শিবুমামার গলা শুনে ছোকরা চেন ছেড়ে দিয়ে ধপ করে পড়ে গেল মাটিতে।
–আপনি-আপনি!
–হাঁ আমি। আমি বই কি। অত ঘাবড়ে গেলেন কেন? চেন ধরেই বা ঝুলছেন কী জন্য?
–আপনি, আপনি খুন হননি?–ছোকরার গলা দিয়ে অদ্ভুত আওয়াজ বেরুল একটা।
-আমি খুন হব? কেন, কোন দুঃখে? খুন হওয়ার কী দায় আমার? এখনও খেয়াল দেখছেন বুঝি?–শিবুমামার স্বরে ভর্ৎসনা : বললাম রাত্তিরে অত ডিম খাবেন না–পেট গরম হবে…।
থামুন–গার্ড হেঁড়ে গলায় বাধা দিলেন, এগিয়ে গেলেন ছোকরার দিকে : ইনিই খুন হয়েছিলেন বলছেন আপনি?
মুখ দিয়ে আর কথা বেরল না ছোকরার। শুধু ঘাড় নাড়ল বোকার মতো।
কতটা সিদ্ধি খেয়েছিলেন?
ছোকরা ফ্যাঁচ করে উঠল : সিদ্ধি খাই না আমি।
শিবুমামা মাথা নাড়লেন : ঠিক সিদ্ধি উনি খান না। কয়েকটা ডিম খেয়েছিলেন খালি। তাইতেই পেট গরম হয়ে এই কাণ্ড।
খবরদার, ডিম-ডিম করবেন না।-ছোকরা চেঁচিয়ে উঠল।
গার্ড বললেন : হুম, চুপ করুন এবার। আপনার নাম?
ঘনশ্যাম গোঁসাই।
যাবেন কোথায়?
–এটাওয়া।
একটা নোটবই বের করে টুকে নিলেন গার্ড : নামবার আগে পঞ্চাশ টাকা দিয়ে যাবেন কোম্পানিকে।
সদলবলে গার্ড বিদায় নিলেন। আবার গাড়ি ছাড়ল।
ঘনশ্যাম ঝিম মেরে বসেছিল। খানিক পরেই মাথা তুলে বললে : বুঝেছি!
শিবুমামা মিটমিট করে হাসছিলেন, বললেন কী বুঝেছেন?
–আপনি ম্যাজিসিয়ান।
খেলা যথেষ্ট দেখানো হয়েছে মনে করে খুশিতে হা হা করে হেসে উঠলেন শিবুমামা : এতক্ষণে বুঝেছেন দেখছি। বড্ড দেরিতে বোঝেন আপনি।
ঘনশ্যাম বুললে : হুঁ!
শিবুমামা বললেন : মিথ্যে ঘুমিয়েই সময় নষ্ট করতেন। তার চাইতে দিব্যি সারারাত ম্যাজিক দেখলেন। ভালো লাগল না?
ঘনশ্যাম বললে : চমৎকার! কিন্তু আপনার ম্যাজিকের টিকিটের হার বড় বেশি। পঞ্চাশ টাকা।
শিবুমামা আবার হা-হা করে হেসে উঠলেন।
ঘনশ্যাম বললে : আপনার ম্যাজিক খুব এনজয় করলাম মশাই। শুধু মনেপ্রাণে নয়, দেহেও বটে। দু-দুবার যা আছাড় খেয়েছি মেঝের ওপর, সাতদিনে গায়ের ব্যথা সারলে হয়। ঘনশ্যাম একবার ঘড়ির দিকে তাকাল : কিছু যদি মনে না করেন আমিও একটু-আধটু ম্যাজিক জানি।
–আপনিও ম্যাজিক জানেন?–এবার শিবুমামার তাজ্জব লাগবার পালা।
–হাঁ, অল্প-স্বল্প।–ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ঘনশ্যাম মনে-মনে কী একটা হিসেব করল : তবে আপনার মতো অত ভালো নয়। এতক্ষণ পরে এই প্রথম হাসল সে: দশ মিনিটের মধ্যে ট্রেনের এই কামরাটাকে আমি ফুলবাগান বানিয়ে দিতে পারি।
ফুলবাগান!-শিবু মামা হাঁ করলেন।
হাঁ, ফুল রাশি রাশি ফুল–গাছভরা ফুল
বলেন কী মশাই। অনেক ম্যাজিক দেখেছি করেছিও অনেক, কিন্তু দশ মিনিটে রেলের কামরাকে ফুলবাগান বানিয়ে দেওয়া যায়, এমন তো কখনও শুনিনি।
–এটা আফ্রিকান ম্যাজিক! সারা ভারতবর্ষে একমাত্র আমিই জানি।
বটে! তবে তো দেখতে হচ্ছে। শিখেও নিতে পারি। আজকাল ম্যাজিক দেখে কেউ পয়সা দেয় না মশাই, তাই বিনা পয়সায় দেখাতে হয় সব জায়গায়। এরকম একটা ম্যাজিক করতে পারলে তো লাল হয়ে যাব–অন্ন মারা যাবে পি সি সরকারের!–শিবুমামা ছটফট করে উঠলেন : কই দেখান ম্যাজিক।
ঘনশ্যাম এগিয়ে এল শিবুমামার দিকে।
–রেডি?
–রেডি।
শিবুমামার চোখের সামনে হাওয়ায় হাত বুলোত লাগল ঘনশ্যাম : চোখ বুজুন। একদম বুজে থাকুন। ঠিক দশ মিনিট পরে যেই বলব চোখ খুলবেন। দেখবেন।–চারিদিকে ফুল–রাশিরাশি ফুল
বাইরে গাড়ির বেগ একটু একটু করে কমে আসছে। একটা স্টেশন এল বোধ হয়।
শিবুমামা চোখ বুজলেন।
–ভালো করে চোখ বুজুন। দশ মিনিটের আগে খুলবেন না। তারপর চারিদিকে দেখবেন ফুল–শুধু ফুল–অজস্র ফুল
গাড়িটা স্টেশনে ইন করল।
ঠিক দশ মিনিট পরেই চোখ খুললেন শিবুমামা। ট্রেন ততক্ষণে আবার চলতে শুরু করেছে।
ফুল দেখলেন শিবুমামা। অজস্র অপর্যাপ্ত ফুল
কামরায় ঘনশ্যাম নেই। তার অ্যাটাচি নেই, সেই সঙ্গে নেই শিবুমামার স্যুটকেশটাও।
নগদে আর জিনিসপত্রে তাতে সাত-আটশো টাকা ছিল কমসে কম।
মোক্ষম ম্যাজিক দেখিয়েছে ঘনশ্যাম–একেবারে ভ্যানিশিং ম্যাজিক! আর শিবু মামা গাড়ি-ভর্তি অজস্র ঝুল দেখতে লাগলেন! সর্ষে ফুল।
Post a Comment