পঙ্খিরাজ ঘোড়া – রাসেল রায়হান
এই মুহূর্তে নীতুর মন একটু খারাপ।
জন্মদিনে দিপু একটা ঘোড়া উপহার পেয়েছে। ওর বাবা একটু পাগলাটে ধরনের। ছেলের কাছে তিনি জানতে চেয়েছিলেন, জন্মদিনে কী চায় সে। দিপু ঘোড়া চেয়েছিল। দিপুর বাবা ঠিকই একটা ঘোড়া কিনে এনেছেন। সেই ঘোড়া এখন ওদের বাসার সামনে বাঁধা। কী সুন্দর বাদামি একটা ঘোড়া! মাঝে মাঝে চিঁহিঁহিঁ করে ডাক দিচ্ছে। গা ঝাড়া দিচ্ছে।
দিপু তো মহাখুশি।
নীতু ওদের বাসায় গিয়েছিল সেটা দেখতে। সে-ও ঘোড়া দেখে মহাখুশি।
সন্ধ্যা হয়ে গেছে, তবু নীতুর বাসায় ফিরতে মন চাইছিল না। অথচ দিপুর মা বারবার বলছেন, নীতু, বাসায় ফিরে যাও। তোমার বাবা দুশ্চিন্তা করবেন।
কী আর করবে নীতু! সে মন খারাপ করে বাসায় ফিরে এল। ঠিক করল, খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠবে। উঠেই চলে যাবে দিপুদের বাড়ি।
নীতুকে তার বাবা বলেছেন, ঘোড়া দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুমায়। তার একটি ঘুমন্ত ঘোড়া দেখার খুব শখ।
পড়ায় কিছুতেই মন বসছিল না নীতুর। রোজ বাবা অফিস করে এসে তাকে পড়তে বসান। তার তো মা নেই, তাই সবকিছু বাবাকেই করতে হয়। নীতুকে একটি অঙ্ক কষতে দিয়ে রান্নাঘরে গিয়েছিলেন বাবা। চোখভর্তি পানি নিয়ে নীতুর কাছে এলেন।
বাবাকে কাঁদতে দেখেই নীতুর বুকটা কেঁপে উঠল। সে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে বাবা? কাঁদছ কেন?
বাবা হো হো করে হেসে ওঠেন। বলেন, কাঁদছি না রে বোকা মেয়ে। পেঁয়াজ কেটে এলাম।
নীতুর বুক থেকে ভার নেমে যায়।
বাবা দেখেন, নীতুর খাতা একদম সাদা। কিচ্ছু লেখেনি। উত্সুক হয়ে তিনি জিজ্ঞেস করেন, কী হয়েছে মা? শরীর খারাপ?
নীতু ডানে-বাঁয়ে মাথা নাড়ে। না।
তাহলে? মন খারাপ?
এবার নীতু ওপর-নিচে মাথা নাড়ে। হুম।
কী হয়েছে আমার মায়ের? মন খারাপ কেন?
দিপুরা ঘোড়া কিনেছে। জন্মদিন ছিল দিপুর। ওর বাবা উপহার দিয়েছেন।
বাবা হাসেন। ঘোড়া কিনেছে, তাতে মন খারাপ হবে কেন? দিপু খুশি না?
নীতু আবার ওপর-নিচে মাথা নাড়ে।
বাবা হাসতে হাসতে বলেন, ঘোড়াটা নিশ্চয়ই খোঁড়া নয়।
নীতু মাথা নাড়ে।
তাহলে? বন্ধুর খুশিতে মন তো আরও ভালো হওয়ার কথা। খারাপ কেন?
হঠাৎ বাবার চোখেমুখে উদ্বেগ ফুটে ওঠে। নীতুকে কাছে টেনে আনেন তিনি। এপাশ-ওপাশ ঘুরিয়ে দেখেন। জিজ্ঞেস করেন, ঘোড়া লাথিটাথি দেয়নি তো?
না না না। নীতু তিনবার না বলে। ওসব কিছু হয়নি, বাবা।
নীতুর বাবা মেয়ের মন খারাপের আর কোনো কারণ খুঁজে পান না। কৌতূহলী হয়ে তাকিয়ে থাকেন শুধু।
নীতু বলে, বাবা, জন্মদিনে আমারও একটি ঘোড়া লাগবে।
যেহেতু নীতুর মা নেই, তাই বাবা তাকে দ্বিগুণ ভালোবাসেন। সমস্যা হলো, শাসনও করেন দ্বিগুণ। তিনি চোখমুখ শক্ত করে নীতুকে বললেন, মা, আমি তো তোমাকে জন্মদিনে ঘোড়া কিনে দেব না। আগে চাইলে ভেবে দেখতাম।
নীতু বুঝতে পারে বাবা রাগ করেছেন। তবু সাহস করে সে বাবাকে জিজ্ঞেস করে, কেন বাবা?
বাবা বলেন, অন্যেরটা দেখে তোমার লোভ হয়েছে। এটা ভালো নয়। তুমি রোজ দিপুদের বাড়িতে যাবে। অবশ্যই নিরাপদ দূরত্বে থেকে ঘোড়া দেখবে। যেদিন ঘোড়ার প্রতি আর কোনো লোভ হবে না তোমার, সেদিন আমি ঘোড়া উপহার দেওয়ার কথা ভাবতে পারি। তবে অবশ্যই মিথ্যা বলবে না, মা। সেটা ধরে ফেললে আমি খুব কষ্ট পাব।
নীতু ঘাড় কাত করল সামান্য।
পরদিন সত্যি সত্যি ভোরবেলা দিপুদের বাড়িতে চলে গেল নীতু। মাত্র আলো ফুটে উঠেছে। তখনো দিপুরা কেউ ঘুম থেকে ওঠেনি। পা টিপে টিপে আস্তাবলের দিকে এগোল নীতু। কাঠের ফাঁক দিয়ে ভেতরে তাকাল।
দিপুর বাবা রফিক সাহেব বেশ আগে থেকেই একটি ঘর উঠিয়ে রেখেছিলেন। তখন কেউ বুঝতে পারেনি, সেটি আসলে ঘোড়ার ঘর—আস্তাবল। কেউ জিজ্ঞেস করলেই দিপুর বাবা কথা ঘুরিয়ে নিতেন।
সেই গত জন্মদিনে ঘোড়ার আবদার করেছিল দিপু। এত দিনে সে নিজেও ভুলে গিয়েছিল। ফলে সে-ও বুঝতে পারেনি। ভুলেই গিয়েছিল বোধ হয়।
রফিক সাহেব ঠিকই মনে রেখেছিলেন। ঠিক জন্মদিনের দিন ছেলের জন্য ঘোড়া নিয়ে এসেছেন তিনি। কিনেছেন নাকি আরও কদিন আগে। এত দিন তার এক বন্ধুর বাড়িতে বেঁধে রেখেছিলেন।
ছেলেকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলেন রফিক সাহেব। হরিণখানা এলাকার সবাই তাকে পাগলা ডাক্তার বলে ডাকে।
দিপুর বাবা আসলে অনেক বড় ডাক্তার। বিদেশেও অনেক খ্যাতি তার। নীতুকে তার বাবা বলেছেন, দিপুর বাবা আর তার বেশ কয়েকজন বন্ধু নাকি বিদেশে পড়াশোনা শেষ করে দেশে চলে এসেছেন, দেশকে ভালোবাসেন বলে। দেশকে খুব সুন্দর করার স্বপ্ন তাদের। যা করার দেশে বসেই করবেন তারা।
আস্তাবলের দরজার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে নীতু হতাশই হলো। ঘোড়াটা জেগে আছে। বাঁশের ঝুড়ি থেকে ঘাস খাচ্ছে। চুপি চুপি বাড়ি ফিরে গেল নীতু।
দুই
কাল নীতুর জন্মদিন। যদিও নীতুর মনে ক্ষীণ আশা, তার বাবাও তাকে সারপ্রাইজ দেবেন। একটি ঘোড়া কিনে আনবেন। কিন্তু নীতু জানে, বাবা সেটা করবেন না। এখনো ঘোড়ার প্রতি লোভ যায়নি তার, বাবার কাছে স্বীকার করেছে সে। ফলে বাবা কক্ষনো ঘোড়া কিনবেন না।
এখন অবশ্য প্রতিদিন দিপুদের বাড়িতে যায় না নীতু। দিপুই রোজ বিকেলে ঘোড়া নিয়ে ঘুরতে বের হয়। তখন এলাকার যত ছেলেমেয়ে আছে, সব তার পেছন পেছন ঘোরে।
মাঝখানে একটা বাচ্চাকে লাথি দিয়েছিল ঘোড়াটা। সেটা নিয়ে মহাঝামেলা গেছে। খুব ক্ষতি হয়নি বাচ্চাটার। অল্পের ওপর দিয়ে গেছে। তা ছাড়া দিপুর বাবাকে এলাকার লোকজন খুব পছন্দ করেন বলে সামলানো গেছে। ছেলেমেয়েরাও বেশ সাবধানে থাকে এখন।
নীতু একদিন উঠেছিল ঘোড়াটার পিঠে। কী যে আনন্দ! এখন লোভ আরও বেড়ে গেছে। সেটাও সে ইতিমধ্যে তার বাবা কাওসার সাহেবের কাছে স্বীকার করেছে। বাবার সঙ্গে কখনো মিথ্যা বলে না সে। কারও সঙ্গেই বলে না। বাবা বারণ করেছেন।
তবে এরই মধ্যে নীতু একদিন ঘোড়াটিকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুমাতে দেখে ফেলেছে। কী আশ্চর্য! দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কেউ ঘুমায়?
জন্ম-‘দিন’ বললেও তো জন্মদিনের কেক আসলে রাতে কাটা হয়। উপহার তখন দিতে হয়। অথচ জন্মদিনের দিন সকালেই ঘোড়া পাওয়ার যে ক্ষীণ আশা নীতুর মনে ছিল, তা-ও কেটে গেল। মন খারাপ করতে গিয়েও একদমই পারল না নীতু। বাবা তার জন্য একটি রাজহাঁস কিনে এনেছেন। ধবধবে সাদা রং, দিপুর ঘোড়াটার মতো। কী সুন্দর রাজহাঁস!
নীতু ‘থ্যাংক ইউ বাবা’ বলে দৌড়ে রাজহাঁসের কাছে ছুটে যাচ্ছিল। বাবা আটকালেন তাকে। বললেন, নীতু, রাজহাঁসটা খুব বজ্জাত। আমাকে দুবার ঠুকরে দিয়েছে এর মধ্যে।
নীতু বলল, তুমি নিশ্চয়ই ব্যথা দিয়েছ, বাবা। নইলে শুধু শুধু ঠোকরাবে কেন?
আরে, একটা পাখির কি আর অত বুদ্ধি আছে? এমনি এমনি ঠুকরেছে।
মোটেও না। তুমিই বলেছ, পশুপাখি শুধু শুধু কাউকে আঘাত দেয় না।
নীতুর বাবা চুপ করে যান। সত্যি সত্যি তিনি মেয়েকে বলেছিলেন এ কথা। তখন কে ভেবেছিল এমন এক বজ্জাত পাখির ঠোকর খেতে হবে তাকে। রাজহাঁস কেনাটাই ভুল হয়েছে। তার মনে হয়েছিল, রাজহাঁস দেখে খুব খুশি হবে নীতু।
নীতু খুশি হয়েছে। অনেক খুশি হয়েছে। সে ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরল রাজহাঁসটি।
আশ্চর্য হয়ে নীতুর বাবা লক্ষ করলেন, রাজহাঁসটিও পরম মমতায় নীতুর কাঁধে ঠোঁট ঘষছে।
বাড়িতে নিয়ে আসার সময় রাজহাঁসটি দুবার তো কাওসার সাহেবকে ঠুকরেছেই, আরও ঠোকরানোর চেষ্টা করেছিল। বহু কষ্টে নিজেকে বাঁচিয়ে রেখেছেন ঠোকর থেকে। অথচ নীতুর কোলে উঠে রাজহাঁসটি এমন ভাব করছে, যেন কত দিনের চেনা।
সারা দিন রাজহাঁস নিয়ে কাটাল নীতু। রাজহাঁসকে আদর করে রাজু ডাকছে সে—রাজু এদিকে আয়। রাজু ওদিকে যাসনে।
নীতুর পেছন পেছন ঘুরে ঘাস খেতে থাকল রাজু। রাজহাঁস যে ঘাস খায়, কাওসার সাহেবের জানা ছিল না।
তিন
নীতুর যে ঘোড়ার লোভ কেটে গেছে, এটা আর আলাদা করে বলতে হলো না বাবাকে। সামান্য একটি রাজহাঁস তাকে ঘোড়ার কথা ভুলিয়ে দেবে—এই আশা কাওসার সাহেব করেননি। তিনি শুধু চেয়েছিলেন, মেয়েটা কিছু একটা নিয়ে মেতে থাকুক। বিকেল পর্যন্ত অফিসে থাকতে হয় তাকে। সারা দিন বাসায় একা থাকে নীতু। ভেবেছিলেন, রাজহাঁসটা থাকলে সময় ভালো কাটবে নীতুর। সেটা যে খুব ভালো কাটছে, আলাদা করে কাউকে বলতে হবে না।
নীতু ঘুমিয়ে আছে। তার ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে কাওসার সাহেব ঠিক করলেন, এবার জন্মদিনে নীতুকে সত্যি সত্যি একটা ঘোড়ার বাচ্চা কিনে দেবেন।
সেদিন সকালবেলা একটি ডিম পাড়ল রাজু। কাওসার সাহেব ভেবেছিলেন, রাতেই ডিমটি ভেজে খাবেন। সেটা আর হলো না। নীতু ভাজতে দিল না। সে একটা ঝুড়িতে কিছু খড়কুটা দিয়ে ডিমটি রেখে দিল। বলল, সব কটি ডিম এখানে রাখব, বাবা। আরও কিছু ডিম জমুক।
জমলে? উত্সুক হয়ে জানতে চান কাওসার সাহেব।
নীতু বলল, ডিম দিয়ে অনেক বাচ্চা ফুটবে।
হাঁসকে কিন্তু নিজেই ডিমে তা দিতে হবে। তুই আবার তা দিতে বসে যাস না টমাস আলভা এডিসনের মতো।
নীতু কপট রেগে বলল, বাবা, তুমি খুব দুষ্টু!
রাজহাঁসের ডিম খাওয়া যায় কি না, এটা নিয়ে বেশ সন্দিহান কাওসার সাহেব। ফলে ডিমটা খাওয়া হলো না। কিন্তু পরদিন আর কোনো ডিম পাড়ল না রাজু।
পরদিনও না।
তার পরদিনও না।
চতুর্থ দিন দেখা গেল রাজু এসে ওই একটি ডিমেই তা দিতে বসে গেছে। প্রায় দেড় মাস ধরে সে ডিমে তা দিতে থাকল। বাচ্চা আর বেরোয় না। নীতু রোজ গিয়ে পেট ঠেলে উঠিয়ে দেখে, ডিম ফুটে বাচ্চা বের হলো কি না, হয় না। তবু সে হতাশ হয় না। প্রতিদিন একবার দেখতেই যত আনন্দ তার।
কাওসার সাহেব খোঁজ নিয়ে জানতে পারলেন, রাজহাঁসের ডিম মাসখানেকের মধ্যে ফোটে। দেড় মাস লাগার কোনো কারণ নেই। তিনি একবার দেখতে চেয়েছিলেন রাজুকে ঝুড়ি থেকে সরিয়ে। পেটের কাছে হাত দিতেই এমন ঠোকর দিয়েছে, চামড়া উঠে গেছে।
এরপর আর ঘাঁটাতে যান না কাওসার সাহেব। যা করে করুক। নীতুকে সাবধান করে দিয়েছেন, ঠোকরাতে পারে—এই ভয় দেখিয়ে। নীতু শোনে না। আসলে তাকে তো ঠোকরায় না রাজু।
তিন মাসের মাথায় ডিম ফুটে যা বের হলো, দেখে চোখ আক্ষরিক অর্থেই কপালে উঠে গেল কাওসার সাহেবের। ডিম ফুটে যেটা বের হয়েছে, সেটা ঘোড়ার বাচ্চা।
চার
বাচ্চা ঘোড়াটিরও একটি নাম দিয়েছে নীতু। ঘোড়ু।
কাওসার সাহেব প্রথমেই যেটা করলেন, ঘোড়ুকে লুকিয়ে ফেললেন। তারপর অনেক অনেক উঁচু একটি পাঁচিল দিয়ে ঘিরে ফেললেন সারা বাড়ি। কোনোভাবে এই খবর কেউ জানতে পারলে এলাকায় তোলপাড় তৈরি হয়ে যাবে। লোকজন হুমড়ি খেয়ে পড়ে ভিডিও করতে শুরু করবে মোবাইলে। ধীরে ধীরে সারা দেশ হয়ে তা ছড়িয়ে পড়বে পৃথিবীতে।
এত সব সামলাতে পারবেন না কাওসার সাহেব। তার চেয়ে কিছুদিন যাক। সবাইকে হঠাৎ জানাবেন যে ঘোড়া কিনে এনেছেন। তাকে ও নীতু—দুজনকেই মিথ্যা বলতে হবে। মিথ্যা বলা একদম পছন্দ করেন না তিনি। এই মুহূর্তে উপায় নেই।
রাজু আক্রমণাত্মক হয়ে উঠছে ক্রমশ। কাওসার সাহেব কাছে ঘেঁষতে গেলেই হংস-হুংকার ছেড়ে তেড়ে আসে। এখন আরও সতর্ক হয়ে গেছেন তিনি। নীতু অনেকবার রাজহাঁসকে ধমকে দিয়েছে—অ্যাই রাজু, এ হলো আমার বাবা। তাকে ঠোকরাবে না। সে তোমার বন্ধু।
রাজু সেসব শোনে না। সম্ভবত নীতু ছাড়া পৃথিবীতে অন্য কাউকে বন্ধু মানতে খুব একটা আগ্রহী নয় সে।
কাওসার সাহেব দিপুর বাবা রফিক সাহেবকে শুধু জানিয়েছেন এ ঘটনা। কারও সঙ্গে শেয়ার না করে পুরোপুরি পেটে আটকে রাখলে একদিন পেট ফেটে মারা যাবেন—এই ভয়ে বলে ফেললেন।
তা ছাড়া তিনি বুঝতে পারছেন, এই ঘটনা এভাবে একদম গোপন রাখা পৃথিবীর প্রতি মহা অন্যায় হবে। বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে নিশ্চয়ই অতি প্রয়োজনীয় কিছু বের করে ফেলবেন। তিনি তো কোনো বিজ্ঞানীকে চেনেন না। চেনেন রফিক সাহেব। অনেক বড় বড় বিজ্ঞানীর সঙ্গে খাতির তার।
সেদিন দিপু এল ওর মা-বাবার সঙ্গে ঘোড়ুকে দেখতে। নীতু বলেছিল, সাবধান দিপু, কাছ যেয়ো না, ঠুকরে দেবে।
তবু দিপু ধীরে ধীরে এগোল। আশ্চর্য! তাকেও ঠোকরাতে এল না রাজু।
দিপু গিয়ে ঘোড়ুর গায়ে হাত বুলিয়ে অনেক আদর করল। দিপুর দেখাদেখি তার বাবাও পা টিপে টিপে এগোচ্ছিলেন, তখনই একছুটে এসে ঠোকর বসিয়ে দিল রাজু। ‘আহ’ বলে এক চিত্কার দিয়ে সরে গেলেন রফিক সাহেব।
নীতু আর দিপু ঘোড়ার বাচ্চার পাশে দাঁড়িয়ে গল্প করতে লাগল। একটু দূরে দাঁড়িয়ে নীতুর বাবার সঙ্গে কথা বলছেন দিপুর মা-বাবা। এখান থেকে তাদের কথা কিছুটা শোনা যাচ্ছে।
রফিক সাহেব বলছেন, কাওসার ভাই, কী আশ্চর্য! পৃথিবী এখনো কত রহস্যময়। আমরা যারা বিজ্ঞান বিজ্ঞান করি, মাঝে মাঝে মনে হয়, সব বোগাস!
কাওসার সাহেব বললেন, তা হবে কেন? অনেক কিছুর ব্যাখ্যা হয়তো বিজ্ঞান দিতে পারে না, তবে পারবে।
রফিক সাহেব মাথা নেড়ে বলেন, আচ্ছা। কিন্তু এর কী ব্যাখ্যা দেবে বিজ্ঞান?
দিপুর মা বলেন, রাজহাঁসের ডিম থেকে ঘোড়ার বাচ্চা। সারা জীবন যে ‘ঘোড়ার ডিম, ঘোড়ার ডিম’ বলে এসেছি, কবে দেখব এই ঘোড়াই সেটা পেড়ে বসে আছে। তার মধ্য দিয়ে কী বের হয় কে জানে। আবার না রাজহাঁস বের হয়।
কাওসার সাহেব বলেন, বিজ্ঞান হয়তো ব্যাখ্যা দিতে পারবে না এখন। কিন্তু আমার কাছে একটা ব্যাখ্যা আছে।
দিপুর মা-বাবা দুজনই কৌতূহলভরে তাকান। তারা ব্যাখ্যাটি শুনতে ইচ্ছুক।
কাওসার সাহেব বলেন, অত সিরিয়াস হবেন না, প্লিজ। খেলো ব্যাখ্যা। আমি আসলে বলতে চাইছিলাম, রবীন্দ্রনাথের একটা কবিতা আছে না, ছোট্ট শিশু তার মাকে প্রশ্ন করছে, আমি কোথা থেকে এলাম? তখন মা জবাব দেয়, ‘ইচ্ছা হয়ে ছিলি মনের মাঝারে।’ এই ঘোড়া আসলে ইচ্ছা হয়ে ছিল। নীতুর মনের মাঝে। সেটা এই রাজহাঁসকে মাধ্যম করে এসেছে।
রফিক সাহেব ঠিক কতটা কী বোঝেন কে জানে। তিনি প্রসঙ্গ বদলে বলেন, আমার এক বন্ধু আসছে—সালমান। খুব বড় জীববিজ্ঞানী। পথে আছে। একটু আগে কথা হয়েছে ফোনে। সে একটু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখতে চায় ঘোড়ার বাচ্চাটাকে। সরি, বাচ্চা ঘোড়াটাকে।
কাওসার সাহেব বললেন, নিশ্চয়ই দেখবেন।
রফিক সাহেব বলেন, কিন্তু ততক্ষণ রাজহাঁসটিকে কোথাও সরিয়ে রাখবেন? বা বেঁধে?
বেঁধে রাখা যাবে না। এখন পর্যন্ত কখনো বেঁধে রাখিনি। আমি নীতুকে বলছি দূরে কোথাও নিয়ে যেতে। দ্রুত দেখে ফেলতে বলবেন।
একটু পরেই সালমান সাহেব চলে আসেন। তিনিও বন্ধুর মতোই পাগল হবেন। উষ্কখুষ্ক চুল। বড় গোঁফ। আইনস্টাইনের মতো দেখতে অনেকটা। নীতু আর দীপু হাঁসটিকে নিয়ে ঘরের উল্টো পাশে চলে যায়।
অনেকক্ষণ পরে তাদের ডাক পড়ে।
পাঁচ
কাওসার সাহেব বলেন, নীতু, মা আমার, সালমান সাহেব ঘোড়ু আর রাজুকে কিছুদিনের জন্য তার ওখানে নিয়ে যেতে চান। তোমার কি কোনো আপত্তি আছে?
নীতুর বুকটা ধক্ করে উঠল। সে স্পষ্টভাবে বলল, আছে। ওদের আমি কোথাও যেতে দেব না।
এমন বলে না মা। বিষয়টি নিয়ে গবেষণা হওয়া দরকার। তাতে পৃথিবীরই ভালো। ভাবতে পারো, রাজহাঁস ডিম পাড়ছে, তা থেকে একের পর এক ঘোড়া বেরোচ্ছে?
নীতু ভাবে। বলে, ভাবতে পারছি। কিন্তু তাতে লাভ কী, বাবা? এত ঘোড়া দিয়ে কী হবে?
কাওসার সাহেব জবাব দেন না। তিনি আসলে এর উত্তর জানেন না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলেন, জেনেটিক কী সব বিষয়-আশয় দেখবে। ওরাই ভালো বলতে পারবে। আমি তো ওসব বুঝি না। তবে আমার মনে হয়, তোমার রাজি হওয়া উচিত।
নীতু কিছু বলে না।
কাওসার সাহেব নড়েচড়ে বসেন। নীতুর মাথায় স্নেহের হাত রেখে বলেন, সবচেয়ে বড় ব্যাপার কী জানো, সালমান সাহেব বলেছেন, ঘোড়ুর পিঠের দিকে অস্বাভাবিক কিছু বেরোচ্ছে। তার ধারণা, ডানা। এটি সত্যি হলে কী হবে, বুঝতে পারছ?
ঘোড়ার ডানা বেরোবে? তার মানে দ্রুতই সে একটা পঙ্খিরাজ ঘোড়া পেতে যাচ্ছে—ভাবতেই আনন্দে বুক ভরে যায় নীতুর। সে বলে, আমি রাজু-ঘোড়ুকে কোথাও নিয়ে যেতে দেব না।
পুরো বাড়ি খাঁ খাঁ করছে। অবশেষে সালমান সাহেব ঘোড়ু আর রাজুকে নিয়ে গেছেন। নীতুকে মানিয়েছেন তার বাবা। সালমান সাহেব বলে গেছেন, কিছুদিনের মধ্যেই তিনি রাজু-ঘোড়ুকে ফেরত দেবেন। আপাতত গোপনে এদের নিয়ে গবেষণা করবেন। বাইরের পৃথিবী জেনে গেলে চুরি করে নিয়ে যেতে পারে।
বড় একটি ট্রাক নিয়ে এসেছিলেন। নীতুর কান্নাভেজা চোখের সামনে দিয়ে সেই ট্রাকে ভরে তিনি রাজু আর ঘোড়ুকে নিয়ে গেলেন।
নীতু মাঝে মাঝে ভিডিও কলে দেখে রাজু আর ঘোড়ুকে। ঘোড়ুর ডানা বেশ বড় হয়েছে এখন। সালমান সাহেব জানিয়েছেন, শিগগিরই ওড়া শুরু করে দিতে পারে ঘোড়ু। তাই এখন থেকে একে তিনি বেঁধে রাখতে চান।
আর কদিন মাত্র। তার গবেষণা শেষ পর্যায়ে। অদ্ভুত এক জিনিস আবিষ্কার করে ফেলতে যাচ্ছেন তিনি। এবার চিকিত্সায় নোবেল পেয়ে যেতে পারেন। তা ছাড়া এখন সময় এসেছে রাজহাঁসের ডিম থেকে পঙ্খিরাজ ঘোড়া জন্মানোর ঘটনা সবার সামনে আনার।
ঠিক পাঁচ দিন পর থেকে বিজ্ঞানী সালমান হককে আর পাওয়া গেল না। ফোন বন্ধ। কাওসার সাহেব আর রফিক সাহেব একসঙ্গে গিয়েছিলেন বিজ্ঞানীর বাসায়। গিয়ে দেখেন সব ফাঁকা। কেউ কিছু বলতে পারছে না। হঠাৎ নাকি উধাও হয়ে গেছেন। তার বাবুর্চি মোহনও উধাও।
শেষ পর্যন্ত থানায় গেলেন কাওসার সাহেবরা। সমস্যা হলো, পুলিশ তাদের কথা বিশ্বাস তো করলই না, উল্টো ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিল।
নীতু এখন দিপুদের বাসায়। কদিন ধরে সে শুধু কাঁদছে। নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। কদিনেই এমন রোগা হয়ে গেল নীতু!
কাওসার সাহেবকে খালি ফিরে আসতে দেখে তার জিজ্ঞাসু চোখ বেয়ে কেবল পানি গড়াতে লাগল। সে বুঝতে পারল, তার রাজু-ঘোড়ুকে আর কোনো দিন পাওয়া যাবে না।
ছয়
বার্ষিক পরীক্ষায় রেজাল্ট খুব খারাপ হয়েছে নীতুর। তার আসলে পড়াশোনায় মন বসে না। খেতে ভালো লাগে না। ঘুমও হয় না ঠিকমতো। সারা দিন মুখ শুকনো করে ঘুরে বেড়ায়।
দিপু তার বাদামি ঘোড়াটা নীতুকে দিয়ে দিল। তাতেও মন ভালো হলো না নীতুর। তার ঘোড়ুকে দরকার।
হঠাৎ দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে যায় নীতুর। বাইরে ঘোড়া ডাকছে। নিশ্চয়ই দিপুর ঘোড়াটা। এখন অবশ্য এটা নীতুর ঘোড়া।
এমন সময় ঘরের দরজায় জোরে জোরে ধাক্কা পড়তে লাগল। নীতু টের পেল, বাবা উঠে দরজা খুলে দিয়েছেন। তারপর খুব জোরে চিত্কার ভেসে এল, আপনি? এত দিন কোথায় ছিলেন?
খুব দুর্বল লাগলেও নীতু অনেক কষ্টে পা টেনে টেনে নিজের ঘর থেকে বের হলো। ড্রয়িংরুমে উঁকি দিতেই চমকে উঠল সে। সোফায় বসে আছেন সালমান সাহেব।
শরীরে অদ্ভুত এক শক্তি ফিরে আসে নীতুর। এক দৌড়ে সিঁড়ি টপকে নেমে পড়ে সে। সালমান হকের পাশে গিয়ে সোফায় বসে হাঁপাতে থাকে। শ্বাস টানতে টানতে জিজ্ঞেস করে, এত দিন কোথায় ছিলেন, আঙ্কেল? আমার ঘোড়ু কই? রাজু কই?
সালমান হক সামান্য হাসেন। বলেন, ঘোড়ু বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।
এক দৌড়ে ঘরের বাইরে চলে যায় নীতু। তার পেছন পেছন ছোটেন কাওসার সাহেব আর সালমান সাহেব।
বাইরে দাঁড়িয়ে আছে ঘোড়ু। মাথা ঝাঁকাচ্ছে। বেশ বড় হয়ে গেছে সে। আর তার পিঠে?
ঘোড়ুর পিঠে বড় বড় দুটি ডানা গুটিয়ে রাখা। নীতুকে দেখেই দুই পা উঁচিয়ে একবার চিঁহিঁহিঁঁ করে ডাক দিল সে। নীতু ধীরে ধীরে তার কাছে যায়। পেটে হাত বোলায়। ঘোড়ুর চোখ ভেজা। সে কাঁদছে।
সালমান সাহেবের দিকে ঘোরে নীতু। জিজ্ঞেস করে, রাজু কই?
সালমান সাহেব মাথা নিচু করে ফেলেন।
সাত
বিজ্ঞানী সালমান হক বললেন, আমার বাড়িতে যে লোকটি রান্নাবান্নার কাজ করত, মোহন, বুঝতে পারিনি, সে আসলে এক গুপ্তচর। অন্য দেশের কাছে টাকার বিনিময়ে তথ্য বেচে দিত। সে-ই রাজু-ঘোড়ুর কথা ওদের জানিয়ে দিয়েছে। একদিন কয়েকজন লোক এসে বন্দুক ধরে আমাদের সবাইকে উঠিয়ে নিয়ে গেল। নিয়ে ওঠাল একটি জাহাজে। তখনো উড়তে শেখেনি ঘোড়ু।
একনিশ্বাসে কথাগুলো বলে সালমান হক থামেন। কাওসার সাহেব তাকে পানি এনে দেন এক গ্লাস। পানিটুকু খেয়ে আবার বলতে শুরু করেন সালমান সাহেব, ওরা আসলে খুব গোপনে রাজু-ঘোড়ুকে নিয়ে গবেষণা করছিল। একদিন হলো কী শোনো, রাজুর ঠোঁট ওরা আটকে রেখেছিল। খাওয়াতে গিয়ে যে–ই না মোহন ওর ঠোঁটের বাঁধন খুলল, এমন ঠোকর দিল, রাজুকে ছেড়ে দিয়ে ‘ওরে বাবা রে মা রে’ বলে ছুটল মোহন। রাজু তখন যাকে পেল ঠোকরাতে লাগল। শেষ পর্যন্ত এক লোক রাজুকে গুলি করল। ওই দেশের বিজ্ঞানীরা খুব আফসোস করেছিল রাজুর মৃত্যু নিয়ে।
নীতুর চোখ ভিজে উঠেছে। সেদিকে তাকিয়ে থেমে যান সালমান সাহেব । তার চোখেও একরাশ বেদনা। নীতুর মাথায় একটা হাত রাখেন তিনি। মলিন স্বরে বলেন, সরি মা।
নীতু কিছু বলে না। তার গাল বেয়ে পানি গড়াচ্ছে।
সালমান সাহেব বলেন, আজ নিউ ইয়ার উপলক্ষে উত্সবে মেতে ছিল সবাই। বাড়ি ফিরে বেহুঁশের মতো ঘুমিয়ে পড়েছে একেকজন। সুযোগ বুঝে পালানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। আমার বিশ্বাস ছিল, পালাতে পারব। কারণ, ঘোড়ু উড়তে শিখে গেছে। সিকিউরিটি গার্ড জেগে ছিল একজন। সে ব্যাটার মাথায় বাড়ি মেরে অজ্ঞান করে দিলাম। তারপর ঘোড়ুকে নিয়ে উড়াল দিলাম। এক উড়ালে ঘোড়ু আমাকে নিয়ে চলে এসেছে এখানে।
নীতুর কাছে আবারও ক্ষমা চান সালমান সাহেব। বলেন, সরি মা। আমি বুঝতে পারিনি। কেঁদো না, প্লিজ। রাজুকে আমিও ভালোবাসতাম। আমার এখন মনে হচ্ছে, এভাবে গোপনে গবেষণা করার প্রয়োজন নেই। আমি চাই, আমাদের দেশের সরকার সব জানুক। তারাই রক্ষা করবে ঘোড়ুকে। ঘোড়ু আমাদের দেশের সম্পদ। যেকোনো মূল্যে তাকে রক্ষা করা জরুরি।
নীতু চোখ মোছে। তার আপত্তি নেই। ঘোড়ু বেঁচে আছে, এতেই সে মহাখুশি।
Post a Comment