রিমি ও কালো বিড়াল – আহমেদ রিয়াজ
তখন সন্ধে হয় হয়। মল্লিকদের বাড়ির পাশ দিয়ে আসতেই সাইনবোর্ডটা চোখে পড়ল রিমির।
‘এখানে ভূত ভাড়া দেওয়া হয়’।
ও কি ভুল দেখেছে? বাড়িভাড়ার কথা বলা হয়নি তো? নাকি দূর থেকে লেখাটা ঠিকমতো দেখতে পাচ্ছে না? লেখাটা ভালোমতো দেখার জন্য যেই একটু সামনে এগিয়েছে, অমনি চেঁচিয়ে উঠল নাদিম, ‘কোথায় যাচ্ছিস?’
সাইনবোর্ড দেখিয়ে রিমি বলল, ‘ওই যে সাইনবোর্ডের লেখাটা ঠিকমতো পড়তে পারছি না। কী লেখা আছে, দেখে আসি।’
আপত্তি জানাল নাদিম, ‘ওদিকে যাস নে। জায়গাটা ভালো নয়।’
‘ভালো নয় মানে?’
‘ওখানে ভূতেরা ঘুরে বেড়ায়। সুযোগ পেলে…’
নাদিমকে বাকিটা বলতে দিল না রিমি। বলল, ‘ধ্যাৎ! ভূত বলতে কিছু আছে নাকি?’
‘আছে। দেখছিস না কী লেখা? ভূত ভাড়া দেওয়া হয়। না থাকলে ভূতদের ভাড়া দেওয়া হয় কী করে?’
আর এগোয়নি রিমি। নাদিমের কথা রাখতেই হয়। নাদিমদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছে ও। মানে ছোট ফুফুর বাড়ি। আবারও সাইনবোর্ডের দিকে তাকাল রিমি, ‘এখানে ভূত ভাড়া দেওয়া হয়’।
তার নিচে আরও কিছু লেখা আছে। কিন্তু লেখাটা দেখতে পাচ্ছে না। ছোট করে লেখা। এবার আর কৌতূহল আটকে রাখতে পারল না রিমি। ওটা পড়ার জন্য এগোল আরেকটু সামনে।
পেছন থেকে আবারও নাদিমের বাজখাঁই গলা, ‘করছিস কী! বললাম না আর সামনে যাওয়া ঠিক না।’
নাদিমটা এত ভিতু! ওকে নিয়ে কোথাও বেড়িয়ে শান্তি নেই। কিন্তু সাইনবোর্ডের নিচের কথাটুকু না পড়ে ও আসতে পারবে না। কৌতূহলের কারণে সারা রাত ঘুমও হবে না ওর।
অন্ধকার নেমে এসেছে প্রায়। নিচের লেখাটার দিকে তাকাল রিমি। কিন্তু কোথায় লেখা? মনে হচ্ছে, হঠাৎ লেখাটার ওপর কালি লেপ্টে দিয়েছে কেউ। আরেকটু সামনে না গেলেই নয়!
আরেকটু এগোতেই ধুক করে উঠল রিমির বুক। লেখাটাকে শুধু কালি দিয়ে লেপ্টেই দেওয়া হয়নি, লেপ্টে দেওয়া কালিটা নড়ছেও!
চোখের ভুল! হতে পারে। চোখ কচলে আবারও তাকাল ওদিকে। লেখা লেপ্টে দেওয়া কালিটা আবারও নড়ে উঠল!
তখনই হঠাৎ ধুপ করে কিছু একটা পড়ল রিমির সামনে। ভয়ে লাফ দিয়ে উঠল রিমি। ভয়ে চেঁচিয়েই উঠেছিল প্রায়, ভূ-উ…
হঠাৎ থেমে গেল। কিসের ভূত? একটা বিড়াল। কালো বিড়াল। কুচকুচে কালো। সাইনবোর্ডের ওপর বিড়ালটাই তাহলে বসা ছিল এতক্ষণ। আর যে লেখা ও ভেবেছিল কালো কালিতে লেপ্টে দেওয়া হয়েছে, আসলে ওটা ছিল বিড়ালের লেজ। বিড়ালের লেজ এত বড় হয়! অবাক দৃষ্টিতে বিড়ালের দিকে তাকিয়ে রইল ও। হঠাৎই মনে হলো, সাইনবোর্ডের নিচের লেখাটা তো পড়া হয়নি!
আবারও সাইনবোর্ডের দিকে তাকাল রিমি। প্রায় অন্ধকারে ছোট করে লেখা বাক্যটা তবু পড়তে পারল।
‘কালো বিড়াল থেকে সাবধান!’
কালো বিড়াল! এবার ভয়টা জেঁকে ধরল ওকে। নাহ্। এখানে থাকা আর ঠিক হবে না। উল্টো দিকে ঘুরেই চেঁচিয়ে ডাকতে লাগল, ‘নাদিম, নাদিম!’
কোথায় নাদিম? নাদিমের কোনো সাড়া মিলল না। নিশ্চয়ই এতক্ষণে বাড়ির পথ ধরে অনেকখানি এগিয়ে গেছে। ভীষণ আতঙ্কিত হয়ে পড়ল রিমি। ও জানে, ভয়কে পাত্তা দিতে নেই। বাবার কথাটা মনে পড়ল, ‘আহার নিদ্রা ভয়, যত করিবে তত হয়।’ কিন্তু আতঙ্কিত হওয়ার সময় এসব কথা কি আর মনে থাকে? তবু মন থেকে ভয় তাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগল রিমি। পা চালাল জোরে জোরে।
কিন্তু এ কী! হঠাৎ দেখল, কালো বিড়ালটা ওর পায়ের কাছে ঘুর ঘুর করছে। ওর পায়ের সঙ্গে গা ঘেঁষার চেষ্টা করছে। যতবারই এগিয়ে আসছে, ততবারই সরে যাচ্ছে রিমি। আর বিড়ালটা ততবারই ডেকে উঠছে, মি-উ-উ-উ…
সামনে তাকাল রিমি। বিশাল ভুট্টাখেত। বুকসমান উঁচু ভুট্টাগাছ। এই ভুট্টাখেতের ওপারেই ফুফুর বাড়ি। এপাশ থেকেও বাড়িটা দেখতে পাচ্ছে। ভুট্টাখেতের মাঝ দিয়ে গেলে দূরত্বটা কম। আর ঘুরে রাস্তা দিয়ে গেলে অনেকটা পথ।
তাড়াতাড়ি বাড়ি যাওয়া দরকার। ভুট্টা খেতে নেমে পড়ল রিমি। ছুটতে লাগল সামনের দিকে তাকিয়ে।
হঠাৎ নিচের দিকে চোখ গেল ওর। আরেকবার চমকে উঠল রিমি। একটা সাদা বিড়ালও ছুটছে ওর সঙ্গে।
কালো বিড়ালটার মতো এটাও ওর পায়ে–পায়ে ঘুরছে। পায়ের সঙ্গে গা–ঘেঁষাঘেঁষি করতে চাইছে। এবারও বিড়ালের ছোঁয়া এড়িয়ে চলার চেষ্টা করতে লাগল রিমি।
একটু পর সাদা বিড়ালটা ওর সামনে দিয়ে ছুটতে লাগল। ছুটতে ছুটতে একসময় হারিয়ে গেল। কাঁধ ঝাঁকাল রিমি। হয়তো ভুট্টাগাছের আড়ালে ঢুকে পড়েছে! এতক্ষণ সাদা বিড়ালের কারণে কিছুটা ভয় ভয় লাগছিল। এখন সাদা বিড়ালটা ওর আশপাশেও নেই। তবু ভয় লাগছে। কী অদ্ভুত ব্যাপার!
ভুট্টাখেতটা যেন ফুরোতেই চাইছে না। আরও জোরে পা চালাতে লাগল রিমি। কিন্তু পা যেন চলছেই না। চলবে কী করে? একটু পরপর ভুট্টাগাছগুলো ওর গায়ে জড়িয়ে যাচ্ছিল। যেন ওকে আটকে রাখতে চাইছে। ত্যক্তবিরক্ত হয়ে দুই হাত দিয়ে গাছ সরিয়ে চলতে লাগল রিমি।
শেষমেশ ভুট্টাখেত পেরোল রিমি। আর ভুট্টাখেতে পেরিয়েই লম্বা একটা নিশ্বাস নিল। লম্বা করে শ্বাস নিলে কেন যেন ভয়টা কমে যায়। ভয় কমেছে, কিন্তু বুকের ধুকপুকানি কমেনি। মনে হচ্ছে, বুকের ভেতর ড্রাম বাজছে। বাজুক। ভয় পাওয়া জায়গাটা তো পেরিয়েছে! একছুটে বাড়ির সামনে চলে এল ও।
আলো জ্বলে উঠেছে ঘরে। সৌরবিদ্যুতের আলো। ঝকঝকে নয়, ঝাপসা ধরনের। বই পড়া যায় না, তবে সবকিছু দেখা যায়।
বাড়ির সদর দরজা খোলা। বাড়ির ভেতরে তাকাল রিমি। আর তাকিয়েই চমকে উঠল। ঘরের ভেতর আরেকটা রিমি!
এ–ও কি সম্ভব! বুকের ধুকপুকানি কিছুটা কমে এসেছিল। হঠাৎ তুমুল বেগে শুরু হলো আবার। শিরশিরে শীতল একটা স্রোত নামতে লাগল মেরুদণ্ড বেয়ে।
স্পষ্ট দেখতে পেল, ছোট ফুফুর সঙ্গে কথা বলছে ওই রিমি। ওর নতুন বানিয়ে আনা এক সেট কাপড় পরে আছে। এবার আর ভয় নয়, ভীষণ মেজাজ খারাপ হয়ে গেল ওর। ধুপধাপ পা ফেলে ঢুকে পড়ল ঘরে।
ওকে দেখেই অবাক হয়ে গেলেন ছোট ফুফু। নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। তাঁর বড় চোখ দুটি লাফাতে লাগল। যেন কোটর ঠেলে বেরিয়ে আসার জন্য ছটফট করছে।
একবার এই রিমির দিকে, আরেকবার ওই রিমির দিকে তাকালেন ছোট ফুফু। এ কী করে সম্ভব!
হঠাৎ ছোট ফুফুর মনে হলো, অসম্ভবও নয়।
ছোট ফুফার বদলির কারণে তাঁরা এখানে এসেছেন সাত দিনও হয়নি। আশপাশের পড়শি বলতে একমাত্র মল্লিক বাড়ি। তা-ও বেশ দূরে, বিশাল ভুট্টাখেত ছাড়িয়ে। শুনেছেন মল্লিক বাড়ি এখন ভূতের ভিটে। আশপাশে যত ভূত আছে, সব এসে আস্তানা গেড়েছে ওখানে। কে যেন মল্লিক বাড়ির সামনে একটা সাইনবোর্ডও টাঙিয়ে রেখেছে—এখানে ভূত ভাড়া দেওয়া হয়। অনেকে বলে, ওটা ভূতেরাই টাঙিয়েছে। মল্লিক বাড়ির ভূতগুলো নাকি প্রায়ই আশপাশে উৎপাত চালায়। তা চালাক।
তাই বলে পড়শির বাড়ির ভেতরে এসে উৎপাত চালাবে? এটা তো মেনে নেওয়া যায় না। এখন যেমন চোখের সামনে দুটো রিমিকে মেনে নিতে পারছেন না।
নিশ্চয়ই ভূতের আস্তানায় গিয়েছিল নাদিম। আর সে কারণেই ওদের বাড়িতে আসার সাহস পেয়েছে ভূতগুলো। হাঁক দিলেন ছোট ফুফু। ‘নাদিম! রিমিকে নিয়ে মল্লিকদের বাড়ির আঙিনায় গিয়েছিলি?’
কোনো সাড়া নেই। কোথায় গেল নাদিম?
আবার হাঁক দিলেন ছোট ফুফু। ‘নাদিম!’
এবার সাড়া পেলেন। ‘জি মা! আমায় ডেকেছ?’
কণ্ঠ শুনে চমকে উঠলেন ছোট ফুফু। মনে হলো একটা নয়, একসঙ্গে দুটো কণ্ঠ শুনতে পেয়েছেন। তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই আরও ঘাবড়ে গেলেন। তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে আছে দুটো নাদিম।
দুটো নাদিমকে দেখে তাঁর মাথাটা দুলে উঠল। মনে হলো, এই বুঝি মাথা ঘুরে পড়ে যাবেন।
সদর দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকতেই খাবার ঘর। খাবার টেবিলের কিনারায় দাঁড়িয়ে ছিলেন ছোট ফুফু। শক্ত করে টেবিলটা ধরে ফেললেন। মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়া থেকে বাঁচালেন নিজেকে। হাতের কাছে পানির বোতল। ছিপি খুলে তিন চুমুক পানি খেলেন।
তারপর চোখের পলক ফেললেন পরপর তিনবার। আবার তাকালেন সামনে। ঘরের একদিকে দাঁড়িয়ে আছে দুটো নাদিম। আরেক দিকে দুটো রিমি। ভাগ্যিস তাঁর নিজের আরেকটা কপি এসে দাঁড়ায়নি! নইলে এতক্ষণে মাথা ঘুরে পড়েই যেতেন।
কিন্তু মাথা ঘুরে পড়ে গেলে তো হবে না। মনে সাহস জোগানোর চেষ্টা করতে লাগলেন ছোট ফুফু। আর ভাবতে লাগলেন। ভাবতে ভাবতেই বুদ্ধিটা পেয়ে গেলেন।
ভূতগুলো এখন নাদিম আর রিমির রূপ ধরে আছে। কোনগুলো ভূত, আগে নির্দিষ্ট করতে হবে। তারপর কৌশলে আটকাতে হবে। আটকানোর পর এমন শায়েস্তা করতে হবে, যাতে আর কখনো এখানে আসার সাহস না পায়। নইলে ভূতের উৎপাতে টেকা যাবে না। ভুতুড়ে উৎপাত তার একেবারেই ভালো লাগে না।
দুটো নাদিমের দিকে তাকালেন ছোট ফুফু। গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখলেন দুজনকেই। একবার এর দিকে, আরেকবার ওর দিকে। নাহ্। কে আসল নাদিম আর কে ভূত নাদিম, বোঝা অসম্ভব। হতাশ হয়ে বললেন, ‘সত্যিকারের নাদিম কে?’
দুই নাদিমই নিজেকে দেখিয়ে বলল, ‘আমি।’
ডানে–বাঁয়ে মাথা ঝাঁকালেন ছোট ফুফু। বললেন, ‘কিন্তু দুজনই সত্যিকারের নাদিম হতে পারে না। এর মধ্যে একটা সত্যি নাদিম, আরেকটা ভূত নাদিম। সাহস থাকে তো বলো ভূত নাদিম কে?’
এবার এক নাদিম আরেক নাদিমকে দেখিয়ে বলল, ‘ও ভূত।’
আরেক নাদিমও অন্য নাদিমকে দেখাল, ‘আমি না। ও ভূত!’
একটা নাদিম বলল, ‘মা হয়ে নিজের ছেলেকেই চিনতে পারছ না?’
আরেকটা নাদিমও বলল, ‘মা হয়ে নিজের ছেলেকে চিনতে কষ্ট হচ্ছে?’
আবার এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে ছোট ফুফুর মাথা। আবারও নিজেকে সামলে নিলেন। বললেন, ‘বলবি না? ঠিক আছে, এখনই প্রমাণ হয়ে যাবে কে আসল নাদিম আর কে আসল রিমি?’
দুই নাদিম আর দুই রিমি একসঙ্গে জানতে চাইল, ‘কীভাবে?’
পানির বোতলটা তখনো ছোট ফুফুর হাতেই ধরা ছিল। বোতল দেখিয়ে বললেন, ‘নাদিম আর রিমিকে আমি একটা ম্যাজিক শিখিয়েছিলাম। এখন সে ম্যাজিক কাজে লাগাব।’
ম্যাজিক! চারজনই অবাক হয়ে তাকাল ছোট ফুফুর মুখের দিকে। একটু দম নিয়ে আবার ছোট ফুফু বললেন, ‘নাদিম ও রিমিকে বোতলে ঢোকার ম্যাজিক শিখিয়ে দিয়েছিলাম। মনে আছে তো? ম্যাজিকটা এবার কাজে লাগাও। দুজনই বোতলে ঢুকে যাও। যে নাদিম আর যে রিমি বোতলে ঢুকতে পারবে, বুঝব তারাই সত্যিকারের নাদিম ও রিমি।’
অমনি লাফিয়ে উঠল একটা নাদিম। চটপট গায়ের কাপড়চোপড় ফেলে ঢুকে পড়ল বোতলের ভেতর। এবার আরেকটা ভূতের ঢোকার অপেক্ষায় রিমিদের দিকে তাকালেন ছোট ফুফু।
কিন্তু দুই রিমির কেউ-ই নড়ল না। বিড়বিড় করল একটা রিমি, ‘বোতলে ঢোকার ওই গল্প আমি জানি। আমরাও ভূতের গল্পটল্প পড়ি।’
কথাটা কোন রিমি বলল, বোঝা গেল না। ছোট ফুফু জানতে চাইলেন, ‘কে বলল কথাটা!’
এক রিমি আরেক রিমিকে দেখিয়ে বলল, ‘ও বলেছে।’
আরেক রিমিও অন্য রিমিকে দেখিয়ে বলল, ‘আমি বলিনি। ও বলেছে।’
নাহ্। কৌশলটা রিমির ভূতের বেলায় কাজে লাগল না। কিছুটা হতাশ হলেন ছোট ফুফু। যা–ই হোক, একটা ভূত তো বন্দী হয়েছে! কিন্তু আরেকটা ভূতকে জব্দ করবেন কী করে?
ভূতের গল্পে নেই, এমন কৌশল খুঁজতে লাগলেন ছোট ফুফু। কিন্তু মাথায় আসছে না। হঠাৎ টিরি রিরি টিং…টিরি রিরি টিং…। টেবিলের ওপর রাখা ছোট ফুফুর মোবাইল ফোন বেজে উঠল। স্ক্রিনজুড়ে ভেসে উঠল ছোট ফুফার ছবি। আর তখনই কৌশলটা ঝিলিক দিয়ে উঠল ছোট ফুফুর মাথায়। মোবাইলের কলটাকেই তো ভূত চেনার ফাঁদ হিসেবে কাজে লাগানো যায়!
দুই রিমির দিকে তাকালেন ছোট ফুফু। আর এতক্ষণে খেয়াল করলেন, এক রিমির গায়ে হলুদ জামা। আরেক রিমির গায়ে নীল জামা। বললেন, ‘তোমার ফুফা কল দিয়েছেন। কলটা রিসিভ করো রিমি।’
হলুদ জামা পরা রিমি বলল, ‘তোমার কল তুমি রিসিভ করো।’
কিন্তু নীল জামা পরা রিমি কিছু বলল না; বরং লাফাতে লাফাতে এগিয়ে এল মোবাইলের দিকে। হলুদ জামা পরা রিমির দিকে সন্দেহের চোখে তাকালেন ছোট ফুফু ও নাদিম।
এতক্ষণে নাদিমও কৌশলটা বুঝে গিয়েছে। একটু আগে ম্যাজিকের ফাঁদে পড়ে বোতলে বন্দী হয়েছে একটা ভূত। এখন মোবাইলের ফাঁদে পা দিয়েছে রিমির ভূত। ওই হলুদ জামা পরা রিমিটাই তাহলে ভূত। এবার ধরা পড়ে গেছে।
ওদিকে কিছুক্ষণ বেজে হঠাৎ থেমে গেল রিং। নীল জামা পরা রিমির দিকে তাকালেন ছোট ফুফু। বললেন, ‘কলটা রিসিভ করতে পারলে না?’
আমতা আমতা করে নীল জামা পরা রিমি বলল, ‘কেটে গেল যে!’
নাদিম বলল, ‘অসুবিধা নেই। বাবা আবার কল দেবেন। কেউ না ধরা পর্যন্ত বাবা কল দিতেই থাকেন।’
সত্যি সত্যি আবার বেজে উঠল মোবাইল ফোন। তাড়া দিলেন ছোট ফুফু, ‘কলটা ধরো, রিমি!’
মোবাইলের স্ক্রিনে টাচ করল রিমি। কিন্তু কল রিসিভ হলো না। মোবাইল বেজেই চলল। ফোনের স্ক্রিনে চাপড় মারতে শুরু করল রিমি। তবু কোনো রেসপন্স নেই।
হলুদ জামা পরা রিমির দিকে তাকালেন ছোট ফুফু। বললেন, ‘ওই রিমি কলটা ধরতে পারছে না। তুমি পারবে?’
মুচকি হেসে এগিয়ে গেল হলুদ জামা পরা রিমি। টেবিলের ওপর থাকা মোবাইলটা হাতে তুলে নিল। তারপর স্ক্রিনে টাচ করতেই ভেসে এল ফুফার কণ্ঠ, ‘হ্যালো…’
চমকে উঠলেন ছোট ফুফু আর নাদিম। এতক্ষণ হলুদ জামা পরা রিমিকেই ভূত ভেবেছিলেন দুজন। কিন্তু ও-ই সত্যিকারের রিমি। আর নীল জামা পরা রিমিকে ভেবেছিলেন সত্যিকারের রিমি। ওটাই আসলে ভূত। ভূত হওয়ায় ওর হাতের স্পর্শ পায়নি মোবাইল। আর সে কারণেই কল রিসিভ হয়নি।
ধরা পড়ে ভীষণ ভয় পেয়ে গেল রিমির ভূত। বোতলের ভেতরে আটক নাদিমের ভূতের দিকে তাকাল করুণ চোখে। নাদিমের ভূতটা বেরোনোর জন্য ছটফট করছে। কিন্তু বোতলের ছিপি আটকানো। বেরোতে পারছে না।
নাদিমের ভূতের করুণ দশা দেখে এবার ভয়ে কাঁপতে শুরু করল রিমির ভূত।
ভূত আর মানুষের মাঝে একটামাত্র আবেগ কাজ করে। ভয়। মানুষকে ভয় দেখালে যদি মানুষ ভয় পায়, তবে ভূতের জয়। আর যদি মানুষ ভয় না পেয়ে উল্টো ভূতকেই ভয় দেখায়, তবে ভূত তো কাবু হবেই। এই যেমন রিমির ভূতটা। নিজেই এবার ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে হঠাৎ লুটিয়ে পড়ল মেঝেতে।
কিন্তু এ কী! কোথায় ভূত? ভূতের পরনে থাকা রিমির জামাকাপড়ই কেবল মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল? তারপর গড়াগড়ি খেতে লাগল।
অবাক হয়ে জামাকাপড়ের গড়াগড়ি দেখতে লাগল ছোট ফুফু, নাদিম আর রিমি। কিছুক্ষণ পর ওই গড়াগড়িও থেমে গেল। হাহাকার করে উঠল রিমি। ওর পরিপাটি জামাকাপড়গুলো দুমড়েমুচড়ে গেছে। একেবারে নতুন জামা-পায়জামা। এখানে আসার আগে বাবা বানিয়ে দিয়েছিলেন।
কিছুটা ঝুঁকে যেই ও কাপড়ে হাত দিতে গেল, আর অমনি হঠাৎ…
কাপড়ের ভেতর থেকে কালো ধোঁয়ার মতো কিছু একটা বেরোল। তারপর সেই ধোঁয়াই চোখের পলকে সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল কালো বিড়াল হয়ে।
চেঁচিয়ে উঠল নাদিম, ‘পালিয়ে গেল! রিমি পালিয়ে গেল!’
ধমক দিলেন ছোট ফুফু, ‘ওটা রিমি নয়, হাঁদা! ভূত। কিন্তু একটা পালিয়েছে তো কী হয়েছে, আরেকটা তো আছে।’
বলেই টেবিলের ওপর থাকা পানির বোতলের দিকে তাকালেন। আর তখনই হঠাৎ বোতলের মুখ থেকে ছিটকে এল ছিপি। কোথায় পড়ল কে জানে। ছিপির দিকে কারও নজরই নেই তখন। সবাই তাকিয়ে আছে বোতলের দিকে। সবার চোখের সামনেই বোতলের মুখ থেকে একরাশ জমাট বাঁধা ধোঁয়া বেরোল। সাদা রঙের ধোঁয়া। আর বেরিয়েই লাফ দিল সেই সাদা ধোঁয়া। তারপর খোলা সদর দরজা দিয়ে দ্রুত বেগে ছুটে বেরিয়ে গেল।
না, সাদা বিড়াল হয়ে নয়। নাদিম হয়ে।
Post a Comment