ব্যারন মুনশাউজেনের রোমাঞ্চকর অভিযান

ব্যারন মুনশাউজেনের রোমাঞ্চকর অভিযান

চাঁদে খড়ের গাদা

কোনো কোনো অপমানের স্মৃতি মানুষ আমৃত্যু বহন করে চলে। টিকটিকির লেজ কাটা পড়লে টিকটিকি খুব দুঃখিত হয়, এমন মনে হয় না। লেজ আবার গজায়। কিন্তু মানুষের একটি পা কাটা পড়লে মানুষ খঞ্জ হয়ে যায়। হারানো পায়ের দুঃখে মানুষ দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে। পা আর ফিরে পায় না। সত্যিই মানুষে ও জানোয়ারে অনেক তফাত। জন্তু-জানোয়ার প্রহূত হলেও অপমানিত হয় বলে মনে হয় না। মানুষ হয়। আত্মমর্যাদাশীল মানুষ কখনো অপমান ভুলতে পারে না।

জীবনের স্রোত নিরন্তর বয়ে চলে। কিন্তু স্রোত সর্বদা একরূপ থাকে না। আমার জীবনেও তার অন্যথা ঘটেনি। আমি যে সর্বদাই অনুকূল স্রোতে নৌকা ভাসাতে পেরেছি, এমন কথা বললে আপনারা নিশ্চয় তা প্রবঞ্চনাবাক্য বলেই ধরে নেবেন। কারণ, সাধারণ মানুষ দূরে থাক, অসাধারণ মানুষের দিনও কখনো সমান যায় না। আমারও যায়নি। এক সৈনিকের মূর্খতাহেতু আমি একবার তুর্কিদের হাতে বন্দী হতে বাধ্য হই। আমার সান্ত্বনা, যুদ্ধে পরাজয়ের জন্য আমাকে যুদ্ধবন্দী হতে হয়নি। আমি বন্দী হয়েছিলাম এক অপোগণ্ড সৈনিকের অমার্জনীয় মূর্খতায়।

বন্দী হিসেবে তুর্কি সুলতানের নিকট আনীত হই। আমাকে দর্শনপূর্বক সুলতান যে তত্ক্ষণাত্ আমার গুণকীর্তনে রত হবেন কিংবা তার অন্তঃকরণ যে এক বিদেশি ব্যারনের প্রতি প্রীতিরসে পূর্ণ ভক্তিরসে আর্দ্র হবে, এমন অসম্ভব প্রত্যাশা আমি করিনি।

কিন্তু আনন্দিত চিত্তে আমি দেখলাম, সুলতান অবলীলাক্রমে ধর্মাধর্ম বিবেচনা ও উচিতানুচিত বিবেচনা বিসর্জন দিলেন না। তিনি বিনয়নম্রবচনে আমাকে তাঁর মধুমক্ষীকাশালার দায়িত্ব গ্রহণের অনুরোধ জানালেন।

যাঁরা আমাকে জানেন, তাঁরা মনে করেন, আমি বড় সাহসী ব্যারন, মানুষ হিসেবে বুদ্ধিমান ও মহত্ বুদ্ধিজীবী এবং সে কারণে সর্বত্রই আমি সমাদরযোগ্য। আমাকে মুক্তকণ্ঠে অকপট সাধুবাদ প্রদান করা যে সর্বদেশীয় সর্ববিধ ব্যক্তিমাত্রেরই সর্বতোভাবে অবশ্যকর্তব্য কর্ম, এমন উন্মাদসুলভ প্রত্যাশা আমি কখনোই করি না। তাই সুলতানের কর্মচারীরা আমাকে যখন সাধারণ বন্দীর সারিতে রাখল, তখন আমি বিস্মিত হইনি। তারা সুলতান নয় এবং সুলতানের পক্ষে সবকিছুর খবর রাখাও যে সম্ভব নয়, সে বিষয় আমার বিবেচনা ছিল। সুলতানের সন্দিগ্ধ কর্মচারীরা আমাকে অসম্মান না করলেও অপসারণ করল। আমি হলাম সাধারণ মৌমাছি রক্ষক।

কাজের যেসব বৈচিত্র্য রয়েছে, তার একটিও আমার নতুন কাজের মধ্যে ছিল না। এত দিন কাজ সম্পর্কে আমার ধারণা ছিল, কাজ হয় সফল, নয় নিষ্ফল। আমার জ্বালাময়ী প্রতিভা কোনো উপযোগী কাজ না পেয়ে জ্বলে ওঠার সুযোগ পেল না। তুর্কিরা আমার সম্পর্কে যা শুনেছিল, এক মাসের মধ্যে তা বিস্মৃত হলো। আমি নিষ্ফল কাজের কর্মী হলাম।

আমার প্রতিদিনের কাজ ছিল ৯১টি মৌচাকের মৌমাছি সকালে মৌমাছি-চারণভূমিতে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া এবং দিনের শেষে তাদের ফিরিয়ে আনা। আমার পদাপহরক তুর্কি অধ্যক্ষ অতিশয় নিষ্ঠুর প্রকৃতির ছিল। তাকে প্রতিদিন গুনে গুনে প্রতিটি মৌমাছির হিসাব দিতে হতো। যাকে বলে অনৈসর্গিক, তা আমি বিশ্বাস করি না। বোধ করি আপনারাও করেন না। কিন্তু কোন ঘটনা নৈসর্গিক আর কোনটা অনৈসর্গিক, তা চিহ্নিত করবেন কোন যুক্তিবলে? আমি চাঁদে গিয়েছিলাম, এ ঘটনা আপনাদের কাছে অনৈসর্গিক বলেই বিবেচিত হবে। অথচ এটি ছিল বাস্তব ঘটনা। অবশ্য, আমি যে খুব আনন্দিত চিত্তে চাঁদে গিয়েছিলাম, তা কিন্তু নয়। সে জন্যই এ ঘটনা আপনাদের এত দিন বলা হয়নি।

একটি মৌমাছি এক সন্ধ্যায় হারিয়ে গেল। হারানো মৌমাছিটির ব্যাকুল সন্ধানে যখন এক ফুলের ঝাড় থেকে অন্য ফুলের ঝাড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি, তখন দেখি দুটি ভালুক সেই মৌমাছিকে তেড়ে বেড়াচ্ছে। ভালুক দুটির উদ্দেশ্য মৌমাছিকে মেরে তার পেটের সঞ্চিত মধু লুট করা।

সুলতান আমাকে সম্মান দেখালেও অস্ত্র বহনের অধিকার হরণ করেছিলেন। তাই ভালুক দুটির দস্যুতাবৃত্তি রোধের কেনো উপায় আমার হাতের কাছে ছিল না। মধুমক্ষিকা পালকের পরিচয়বাহী একটি রৌপ্য চাকতি আমার হাতে বাঁধা ছিল। সেই চাকতি ছুড়ে মারলাম দস্যু ভালুকদ্বয়ের উদ্দেশে। বিধি বাম। আমার হাত একটু ঘুরে গিয়েছিল। চাকতিটি ভালুকের দিকে ধাবিত না হয়ে ঊর্ধ্বলোকে ধাবিত হলো। মনে হলো চাকতিটির যেন পাখা গজিয়েছে। চাকতি উড়তেই থাকল, উড়তেই থাকল এবং আমি বিনা দুরবিনেই দেখলাম চাকতিটা চাঁদে পৌঁছে গেছে। এখন উপায়? আমি যদি চাকতি ছাড়া ফিরি, তাহলে সুলতানের কর্মচারীদের কাছে আমাকে যথোপযুক্ত আক্কেলসেলামি দিতে হবে। আমি অস্থির হয়ে পকেটে হাত দিলাম। পকেটে তুর্কি শিমের একটা বিচি।

আগেই শুনেছিলাম, তুর্কি শিমের চারা দ্রুত বৃদ্ধি পায়। বীজ যদি সকালে বপন করা হয়, তবে বিকেলের মধ্যেই গাদাগাদা ঝুড়িভর্তি টাটকা তাজা শিম পাওয়া যায়। আমি যত্নসহকারে বিচিটি মাটিতে পুঁতে জলসেচ শুরু করলাম। অদৃষ্টপূর্ব ঘটনা আমার চোখের সম্মুখে ঘটে গেল। শিমের চারা অসম্ভব দ্রুততার সঙ্গে বৃদ্ধি পেতে লাগল। অনির্বচনীয় সে দৃশ্য। আকাশে সেদিন তৃতীয়ার চাঁদ। চারটি নধরকান্তি রূপ ধরে দৃষ্টির সীমা পেরিয়ে গেল। চাঁদের দিকে চেয়ে দেখি, শিমগাছের চারা চাঁদের ফালির একদিক পেঁচিয়ে ধরেছে। আমি শিমগাছ বেয়ে চাঁদের দেশে রওনা দিলাম হারানো চাকতির সন্ধানে। ততক্ষণে ভালুক দুটি মৌমাছিটা টিপে সবটুকু মধু শুষে নিয়েছে।

চাঁদে যাওয়ার ঝকমারি কাণ্ডে লিপ্ত হওয়ার বিন্দুমাত্র বাসনা আমার ছিল না। তাই অনাকাঙ্ক্ষিত চন্দ্র ভ্রমণ আমার কাছে মোটেও প্রীতিপ্রদ বোধ হয়নি। কেবলই ভাবছিলাম, চাকতি হাতে না ফিরলে সুলতানের কর্মচারীদের কাছে আমাকে নাকালের চূড়ান্ত হতে হবে।

কতক্ষণে চাঁদে পৌঁছেছিলাম, এত দিন পর সে কথা আমার একটুও মনে নেই। মানসিক উত্তেজনাহেতু আমি সময় গণনা করিনি। সম্ভবত, সেই একই কারণে মানুষ হিসেবে যখন চাঁদের মাটিতে পদার্পণ করলাম, তখনো আমার মনে কোনো বাড়তি উত্তেজনার সঞ্চার হয়নি। খুব সাদামাটাভাবে আমি চাঁদের মাটিতে পা রেখেছিলাম।

চন্দ্রপৃষ্ঠ রৌপ্যের মতো উজ্জ্বল ও চকচকে। চাঁদের ধবল রুপালি মাটিতে তাই আমার রৌপ্য চাকতি খুঁজে পাওয়ার প্রত্যাশা সুদূরপরাহত মনে হলো। নির্বোধ-নির্বিবেক তুর্কি কর্মচারীদের আমি অভিশাপ দিলাম। এদের হাতে স্বীয় মানসম্ভ্রম ভ্রষ্ট হওয়ার ভয়ে আমি একাই চাঁদে গেলাম। কেউ আমার সাক্ষী রইল না। আমার চন্দ্র ভ্রমণের বৃত্তান্ত ভাবীকালের মানুষের কাছে উন্মাদের লক্ষণ ব্যতীত আর কিছুই প্রতীয়মান হবে না। আমার দুর্ভাগ্য, চন্দ্র ভ্রমণের অভিজ্ঞতা হরিষে বিষাদ হয়ে চিরটাকাল থেকে যাবে।

চাঁদের খড়ের গাদা দেখব, এমন কথা আগে ভাবিনি। অথচ খড়ের গাদাই দেখলাম। রুপালি খড়। খড় দর্শনে আমি মুগ্ধ হইনি। আহ্লাদিতও হইনি। যারপরনাই বিস্ময় নিয়ে আমি খড়ের গাদা দেখছি আর ভাবছি আর ঠিক সে সময়েই চোখে পড়ল খড়ের গাদায় লটকে আছে আমার রুপালি চাকতি।

আমাকে দ্রুত পৃথিবীতে ফিরতে হবে। প্রত্যাবর্তনের ত্বরা নিয়ে শিমগাছের কাছে গিয়ে চক্ষু চড়কগাছ। প্রখর রৌদ্রতাপে শিমগাছ শুকিয়ে গেছে। ওটি বেয়ে ওপরে বা নিচে কোথাও যাওয়া সম্ভব নয়। সূর্য ও চন্দ্র একই আকাশে যে ঘোরাফেরা এবং ওঠা-নামা করে, সে কথা আমি বেমালুম বিস্মৃত হয়েছিলাম।

চাঁদের খড়ের গাদা বোধ করি আমার জন্যই ছিল। আপনাদের অপ্রতিহত তর্কশক্তির প্রভূত প্রশংসাকীর্তন করেই বলি, তর্ক দিয়ে কিন্তু সবকিছুর মীমাংসা হয় না। সমস্যা সমাধানের জন্য বুদ্ধির প্রয়োজন হয়। তা-ও আবার উপস্থিত বুদ্ধি। খড় দিয়েও যে দড়ি বানানো যায়, সে কথা নিশ্চয় আপনাদের বুঝিয়ে বলতে হবে না।

খড়ের দড়ি চাঁদ থেকে নামিয়ে দিলাম নিচে পৃথিবীর দিকে। আমাকে দ্রুত নেমে যেতে হবে। দড়ি যে কতখানি লাগবে, সেটাও জানা নেই। তাই খড়ের এক বিশাল আঁটি পিঠে নিয়ে দড়ি ধরে ঝুলে পড়লাম।

নামছি তো নামছিই। হঠাত্ দেখলাম দড়ি গেল ফুরিয়ে। অতঃপর খড়ের আঁটি থেকে খড় টেনে দড়ি বানাই আর নামি। নামি আর দড়ি বানাই। আমার দুর্ভাগ্য, পিঠের বোঝাও হালকা হয়ে এল। আর কোনো কাজ নেই হাতে। খড় শেষ। আপনারা এখন প্রশ্ন করতে পারেন, পৃথিবী তখন কত দূর? সুলতানের প্রাসাদই বা কোথায়? কিন্তু আপনাদের অবাস্তব, অবাঞ্ছিত প্রশ্নের জবাব আমি দেব না। কারণ, আমি মাপের ফিতা নিয়ে চাঁদে চড়িনি।

খড়ের দড়ির শেষ প্রান্ত ধরে আমি ঝুলছি অনন্ত আকাশে। আকাশে ঝুলে আকাশকুসুম কল্পনা করা বালখিল্য ব্যাপার। পায়ের নিচে মেঘের সারি। এ মেঘ পৃথিবীর সব মানুষই দেখে। তবে নিচ থেকে ওপরে তাকিয়ে। আমার মতো ওপর থেকে নিচে তাকিয়ে নয়। আমি দড়ির প্রান্ত ছেড়ে দিলাম।

কোনো ভদ্রলোক অনর্থক পুনরুক্তি দ্বারা অন্যের বিরক্তি উত্পাদন করেন না। চাঁদে গিয়ে আমি চন্দ্রাহত হইনি। তাই আমার কথা যে উন্মাদের প্রলাপ নয়, এ কথাটা আপনাদের মানতেই হবে। দড়ি ছেড়ে দিয়ে আমি আকাশে ঝুলন্ত অবস্থায় থাকিনি। গাছের আপেল যেভাবে মাটিতে পড়ে, আমিও সেভাবে সবেগে ধরণিস্পৃষ্ট হয়েছিলাম। যাকে বলে পপাত ধরণিতল।

সুলতানের কর্মচারীরা এতক্ষণ আমাকে দেখতে না পেয়ে ভেবেছিল, আমি বুঝি পালিয়ে গেছি। তবু ওরা আমাকে খুঁজছিল। আমি যখন গভীর এক গর্ত থেকে উদ্ধার পাওয়ার চেষ্টা করছি, সে অবস্থায় ওরা আমাকে খুঁজে পায়। আমাকে গর্তে দেখে ওরা হাসাহাসি করছিল। ওদের তামাশার আমি কোনো উত্তর দিতে পারিনি।

বিজিত কোনো সৈনিকের কথা বিজয়ী সৈনিকেরা বিশ্বাস করে না। আমি তো সেনাপতি। সাম্মানিক ব্যক্তি। সম্ভ্রান্ত মানুষ নিজের সম্মানের ত্রুটি হয়েছে বিবেচনা করে ইতরশ্রেণির মানুষের মতো রাগান্ধ হয়ে আবোলতাবোল কথা বলে না। তুর্কিরা ভেবেছিল, আমি অন্ধের মতো হাঁটতে গিয়ে গর্তে পড়ে গিয়েছি। কিন্তু গর্তটা যে আকাশ থেকে আমার মাটিতে পড়ার কারণেই সৃষ্টি হয়েছিল—সেই সত্য কথাটা ওদের জানতে রুচি হলো না। আচ্ছা, ভেজা মাটিতে একটা ছোট্ট আপেল পড়লেও যে মাটি সামান্য দেবে যায়, এটা কি ওরা কখনো লক্ষ করেনি?

লেখা: রুডলফ এরিখ রাসপে
ভাষান্তর: ফরহাদ খান

No comments