রন্টুর ঘর – আহসান হাবীব

রন্টুর ঘর – আহসান হাবীব

অবশেষে রন্টুর একটা ঘর হয়েছে। মানে নিজস্ব ঘর আরকি। রান্নাঘরের পাশে একটা স্টোর রুম ছিল, সেটাকে পরিষ্কার–টরিষ্কার করে একটা নতুন সিঙ্গেল খাট ঢোকানো হলো। টেবিল তো আগেই ছিল…মা সুন্দর করে সব সাজিয়ে দিয়েছেন। জানালায় নতুন পর্দা, টেবিলের ওপর একটা ফুলদানিও আছে, তবে ফুল নেই। একটা শেলফ আছে এক কোনায়, সেখানে রন্টুর পাঠ্যবই আর গল্পের বই। রন্টুর ফাইনাল পরীক্ষা শেষ, হাতে এখন অফুরন্ত অবসর। রন্টু ঠিক করেছে আজই তার ঘরের উদ্বোধন হবে; মানে আজ রাত থেকেই এই ঘরে একা থাকতে শুরু করবে সে এবং রাত জেগে ‘আবার যক্ষের ধন’ বইটা পড়ে শেষ করবে। বইটা নাকি দারুণ ভয়ের। একা একা ভয় পেতে রন্টুর বেশ লাগে। তার ভার্সিটিতে পড়ুয়া শেলি আপু এসে উঁকি দিয়ে দেখে গেছে। মুখ বাঁকিয়ে বলেছে, ‘একা থাকবি, দেখিস রাতে ভূত এসে তোর ঘাড় মটকাবে…’

‘আপু, আমার ফুলদানিতে কী ফুল রাখা যায় বল না।’

‘ডুমুরের ফুল’ বলে আবার মুখ বাঁকিয়ে চলে গেল শেলি আপু। রন্টুর ধারণা, নিশ্চয়ই রন্টুর ঘর দেখে শেলি আপুর হিংসা হচ্ছে, তাই উল্টাপাল্টা বলছে।

সব যখন ঠিকঠাক, তখনই সর্বনাশটা হলো। মাথায় মস্ত একটা পচা কাঁঠাল নিয়ে হাজির হলেন তাদের দূরসম্পর্কের চাচা কুদরত উদ্দীন। লোকটা মোটেই সুবিধার নয়। বাবা তো বলে তাদের গ্রামের জমির অনেকটাই নাকি কায়দা করে দখল নিয়ে নিয়েছে এই চাচা। কিন্তু মা কিছু বলে না। বলে, থাক না, গ্রামের মানুষ কদিনের জন্য এসেছে বেড়াতে, থাকুক। কিন্তু এখন কী হবে? তিনি কোথায় থাকবেন মানে ঘুমাবেন। আর কোথায়, নতুন ঘর তো আছেই—রন্টুর ঘরে। রন্টুর মাথায় যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত হলো। কোনো মানে হয় এসবের?

এখানেই শেষ না, মা বললেন, ‘রন্টু তোর ঘর তো দখল হয়ে গেল রে কিছুদিনের জন্য। এক কাজ কর, মশারিটা টানিয়ে দিয়ে আয়।’ দাঁত কিড়মিড় করতে করতে মশারি টানাতে গেল রন্টু। রন্টুকে দেখে কুদরত চাচা নাক খুঁটতে খুুঁটতে বললেন,

‘রন্টু মিয়া খবর কী?’ রন্টুর মেজাজ আরও খারাপ হয়ে গেল। কেউ তাকে মিয়া বললে তার মেজাজ খারাপ হয়। সে কোনোমতে দাঁতে দাঁত ঘষে বলল, ‘ভালো।’

‘কোন ক্লাসে উঠছ?’

‘সেভেনে।’

‘রোল কত?’

রন্টুর মেজাজ ডাবল খারাপ হলো। তাকে রোল বলতে হবে কেন? তার রোল ৩, সে বলল ৩৩।

‘৩৩? এত পিছে…?’

রন্টু কোনো কথা না বলে ছিটকে বের হয়ে এল। তার ঘরের বারোটা বাজাবে নোংরা লোকটা। লোকটা বসে বসে আবার মাঝেমধ্যেই নাকও ঝাড়ছিল, সেটা আবার মুছছিল তার বিছানায়। হায় আল্লাহ! এ কী হলো! না, এভাবে চলতে পারে না।

রাতে সোফায় শুয়ে শুয়ে রন্টু ভাবতে লাগল কী করা যায়। সে এমনিতে শেলি আপুর সঙ্গে ঘুমাত, আজ ঘুমাবে না। কারণ, তার ঘর দখল হয়ে গেছে দেখে শেলি আপু টিটকারি মারছে, ‘কিরে, তোর ঘর তো কুদরত চাচার জবরদখলে। তুই আবার শরণার্থী হয়ে গেলি…’ ইত্যাদি ইত্যাদি।

শেষরাতের দিকে রন্টু একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখল। যেন সে কোনো একটা বরফের দেশে; বরফের ওপর দিয়ে পিছলে পিছলে আজব কায়দায় কোথায় যেন যাচ্ছে, খুব ঠান্ডা লাগছে। ঘুম থেকে উঠে দেখে তার গায়ের কম্বলটা মাটিতে পড়ে আছে। ঠান্ডা লাগার তাহলে এই কারণ! তবে স্বপ্নটা থেকে কিন্তু সে দারুণ একটা আইডিয়া পেল।

পরের রাতে কুদরত চাচা যখন তার ঘরে শুয়ে সারেগামা টাইপ নাক ডাকা শুরু করেছে, তখন রন্টু করল কি, ডিপ ফ্রিজ থেকে বেশ কয়েকটা বরফের টুকরা নিয়ে তার মশারির ওপরে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে রেখে এল। একটা রাখল ঠিক তার মুখের ওপর।

পরদিন কুদরত চাচা নাশতার টেবিলে বসে তার মায়ের সঙ্গে বলছে,

‘ভাবিসাব, আমার ঘরের ওপরে কি পানির টাংকি?’

‘হ্যাঁ, কেন?’

‘যা ভাবছিলাম।’

‘কী ভাবছিলা?’

‘আমার ঘরের ছাদে ফুটা আছে। পানি পড়ে, ওপরের টাংকির পানি। টাংকিও মনে হয় লিক। রাইতে ঘুমাইতে পারি নাই।’

‘কী বলছ? নতুন ঘর। ছাদ ফুটা হবে কেন?’

‘আরে এই সব শহরের ঘরবাড়ির কোনো গ্যারান্টি আছে? এমন চিকন ফাটল আপনি চোখেও দেখবেন না। আচ্ছা দেখি আমি ছাদে গিয়া দেখি কী করা যায়। আমি যখন আছি চিন্তা নাই। মাসখানেক আছি। সব ঠিক করে দিয়ে যাব। কিছু খরচা হবে আপনার…’

পরের রাতে রন্টু আবার কয়েক টুকরা বরফ রাখল মশারির ওপর, আগের মতো। ঘণ্টাখানেক পরে শুনে কুদরত চাচা বিছানা টেনে সরাচ্ছে। সে ভেবেছে বিছানা সরালেই পানি পড়া বন্ধ হবে। রন্টু বহু কষ্টে হাসি আটকাল।

পরদিন সকালে আবার কুদরত চাচা মায়ের সঙ্গে কথা বলছে—

‘ভাবিসাব, রাতে কি বৃষ্টি হইছিল?’

‘হ্যাঁ, একটু হয়েছিল বোধ হয়।’

‘যা ভাবছিলাম। বৃষ্টির পানি আবার জমছে আমার ঘরের ছাদে, টুপ টুপ পানি পড়ছে সারা রাত, বিছানা এদিক ওদিক টাইনা সরায়াও কুল পাই নাই।’

‘কী বলছ এসব! এ ঘরে পানি পড়বে কোত্থেকে?’

‘ভাবিসাব, এই সব শহর-বাড়ির ছাদে এমন ফাটল থাকে, চোখেও দেখবেন না কিন্তু পানি পড়ব চুয়ায়া চুয়ায়া।’

পরদিনও আবার একই কাহিনি। আজও বেশ কয়েক টুকরা বরফ রাখল মশারির ওপর রন্টু ছড়িয়ে–ছিটিয়ে। দুই টুকরো ঠিক কুদরত চাচার মাথার ওপর।

রাত দুটোর দিকে হঠাৎ হাউ মাউ খাউ করে কুদরত চাচা জেগে উঠল ‘ভাবিসাব! ভাবিসাব!’ বলে চেঁচাতে লাগল।

‘কী হয়েছে?’ মা তখনো ঘুমায়নি, ছুটে এলেন। রন্টু ‘আবার যক্ষের ধন’ পড়ছিল সোফায় শুয়ে, সে-ও উঠে এল। চিৎকারে ছুটে এল শেলি আপুও। শুধু বাবাই এলেন না, কারণ বাবা তো এক মাসের জন্য বিদেশে।

‘এই দেখেন।’ কুদরত চাচা তার হাতের তালু মেলে ধরে। সবাই দেখল চাচার হাতের তালুতে বরফের ছোট ছোট কয়েকটা টুকরা।

‘আমার মশারির ওপরে পাইছি।’

‘এর মানে কী? মা অবাক। রন্টুর বুক ঢিপ ঢিপ করছে। বুঝে ফেলেছে নাকি!’ শেলি আপু বলল—

‘ও কিছু না, শিলাবৃষ্টি। চাচা, আপনি বলছিলেন না বৃষ্টির পানি পড়ে মনে হয় আপনার ঘরের ছাদের ওই সূক্ষ্ম ফাটল দিয়ে, শিলা পড়ছে আপনার মশারির ওপর। তাই নারে রন্টু?’ রন্টু ঢোক গিলল। আপু কেমন এক চোখে তাকিয়ে আছে, বুঝে ফেলেছে নাকি?

‘না না, এটা মেছো ভূতের কাজ। মেছো ভূত ভর করছে এই বাড়িতে। আমার মশারির ওপর বসে এ বরফ দেওয়া মাছ খাইছে। ভাবিসাব, আপনে আজকে ফিরিজ থাইকা বরফ দেওয়া মাছ বাইর করছিলেন না? তখনই আমার সন্দেহ হইছিল…তখনই এই ভওত কয়েকটা বরফ দেওয়া মাছ সরাইছে, আপনে টেরও পান নাই। এরা আজকাল বরফ দেওয়া মাছ খাইতে পছন্দ করে। গ্রামের মাছ তো আইজকাল বরফ দিয়া শহরে চইলা আসে বুঝেন নাই?’

‘কী বলেন এসব?’ শেলি আপু চেঁচিয়ে ওঠে, ‘মশারির ওপর ভূত বসলে মশারি ছিঁড়ে আপনার ঘাড়ে পড়ত না?’

‘আরে কী কও? ভূতের ওজন আছে নাকি?’

‘কুদরত কী আবোলতাবোল বলছ তুমি?’ মা এবার ধমকে ওঠেন।

‘এই দেখেন, বরফে মাছের গন্ধ।’

ওরা অবশ্য বরফে কোনো মাছের গন্ধ পেল না। রন্টু উল্টো আইসক্রিমের গন্ধ পেল। ও যে ট্রে থেকে বরফ সরায়, সেখানে একটা আইসক্রিমের বাক্স আছে।

পরদিন সকালে ব্যাগ গুছিয়ে কুদরত চাচা তড়িঘড়ি করে বিদেয় হলেন। পেছন থেকে শেলি আপু চেঁচাল, ‘কুদরত চাচা, মেছো ভূতটাকে নিয়ে যান আপনার সাথে, ও তো মনে হয় আপনার সাথেই এসেছিল গ্রাম থেকে।’ মা ধমক দিলেন—‘ছি, এসব কী বলে!’ কুদরত চাচা একটা রক্তচক্ষু লুক দিয়ে লাফিয়ে রিকশায় উঠে বসল। কুদরত চাচা বিদায় হতেই শেলি আপু এসে ক্যাঁক করে রন্টুর কান ধরল!

‘তাই তো বলি, ফ্রিজের বরফ সব কই যায়! রাতে কোল্ড কফি বানাতে গিয়ে দেখি ট্রেতে একটাও বরফের টুকরা নেই। খুব বুদ্ধি হয়েছে না?’ এই সময় মা ঢুকলেন, ‘কী হয়েছে রে?’

‘কিছু হয়নি, রন্টুর মাথায় কুদরত চাচার মেছো ভূতের বরফ ঘষার প্ল্যান করছি।’

‘কেন, বরফ ঘষবি কেন?’

‘ওকে এখন ইন অ্যাডভান্স কয়েকটা গাট্টা দেব তো, তাই…’ এই সময় মার ফোন এল। বোধ হয় বাবা ফোন করেছে। মা ফোন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলেন। আর ওই ফাঁকে শেলি আপু সত্যি সত্যিই গোটা কয়েক গাট্টা দিয়ে ফেলল রন্টুর মাথায়। রন্টু চেঁচিয়ে উঠল

‘উফ আপু, লাগে তো!’

‘লাগার জন্যই তো দিচ্ছি…তবে তোর বুদ্ধিটা কাজে লেগেছে রে।’

রন্টু হি হি করে হাসে।

No comments