রুবাব ও একটি কলম – কামাল হোসাইন

রুবাব ও একটি কলম – কামাল হোসাইন

চমৎকার বিদেশি কলমটা তাসিনের। খুবই সুন্দর একটা কলম। দেখলেই হাতে নিতে ইচ্ছা করবে।

তাসিনের সাকিব মামা থাকেন সুইডেনে। কিছুদিন হলো তিনি দেশে বেড়াতে এসেছেন। বাড়ির অনেকের জন্য অনেক কিছু এনেছেন সঙ্গে করে। যার জন্য যেটা মানায়, তার জন্য ঠিক সেই জিনিসই এনেছেন সাকিব মামা। একমাত্র ভাগনে তাসিন। সাকিব মামা তাই আরও কিছু খেলনার সঙ্গে এনেছেন চমৎকার এই কলম। তাসিন তো কলমটি পেয়ে মহাখুশি। বড় খুশির কারণ হলো, এটা দেখিয়ে ক্লাসে কদিন খুব ভাবে থাকা যাবে। এ রকম কলম তো তার বন্ধুরা জীবনে কখনো চোখেই দেখেনি। তাই এটা দেখলে সবাই চোখ ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকবে। একটু ধরে দেখার জন্য, সুন্দর এই কলম দিয়ে দু-এক লাইন লেখার জন্য তাসিনকে বেশ খাতির করবে সবাই। কদিন ধরে এই কলমটার জন্য সে আলোচনার বস্তু হয়ে থাকবে বৈকি!

আর তাই সে ওই দিন কলমটা সঙ্গে করে নিয়েই ইশকুলে গেল একটু আগেভাগে।

স্কুলে গিয়ে ক্লাসের আগে তাসিন যখন কলমটা বের করল, অমনি সবাই যেন হুমড়ি খেয়ে পড়ল কলমটার ওপর।

মুহূর্তে কতকগুলো মাথা এক জায়গায় হয়ে গেল। এ বলে দেখি, ও বলে দেখি। কেউ বলে একটু লিখতে দে না রে ভাই! আহা কী সুন্দর কলম! বাপের জন্মেও দেখিনি!

যেমন সুন্দর দেখতে, তার চেয়ে সুন্দর চিকন রেখায় লেখে কলমটা। ধরতেও আরাম, লিখতেও আরাম। লিখতে শুরু করলে মনে হয়, লিখতেই থাকে, লিখতেই থাকে।

তাসিনও বেশ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছে মজাটা। খুব আনন্দ লাগছে ওর। ভাগ্যিস সাকিব মামা এই কলমটা এনেছিলেন ওর জন্য। ক্লাসের যে ছেলেটি ওকে ঠিক পাত্তাও দেয় না, সে-ও আজ তাসিনের কাছে এসে কলমটা দিয়ে একটু লেখার বায়না ধরছে!

এই যেমন নাদিম। ক্লাসে ফার্স্টবয় বলে ওর যেন মাটিতে পা পড়ে না। সবার সঙ্গে ঠিকমতো কথা বলে না, মেশে না পর্যন্ত। বেশ একটা দেমাগ নিয়ে থাকে। আজ তিনিও হাজির তাসিনের কাছে। বলছে, ‘ফ্রেন্ড, দাও না দেখি কলমটা! দেখে তো বেশ দামি বলে মনে হচ্ছে।’

সত্যিই সুন্দর কলমটা। লাল এবং খয়েরির মিশেলে চমৎকার এক ফাউন্টেন পেন। যাকে বলে ঝরনা কলম। একেবারে মনকাড়া। দেখলেই ছুঁতে ইচ্ছে করে, নিজের করে পেতেও ইচ্ছে করে।

রুবাবও চাইল একটু হাতে নিয়ে দেখতে। কিন্তু তাসিন কেন যেন রুবাবকে দেখতে দিল না। ও যেই না হাতে নিয়ে দেখতে চাইল, আর অমনি প্রায় ছোঁ মেরে কলমটা নিজের পকেটে ঢুকিয়ে ফেলল তাসিন।

রুবাবের ফরসা মুখটা অপমানে মুহূর্তে টুকটুকে লাল আমের মতো হয়ে গেল। ক্লাসের প্রায় সবাই কমবেশি দেখল, অথচ ওর বেলায় এ রকমটা করল তাসিন? আর এতে কেমন হতবুদ্ধি হয়ে পড়ল রুবাব। মনের ভেতর গভীর একটা ক্ষতের সৃষ্টি হলো রুবাবের।

সপ্তম শ্রেণির সেকেন্ড বয় রুবাব। যেমন লেখাপড়ায়, তেমনই অমায়িক ব্যবহার তার। ক্লাস ক্যাপটেনও। স্যারেরা তো বটেই, ক্লাসের সবাই ভালোবাসে ওকে। তাই তাসিনের এই অদ্ভুত আচরণটা ঠিক নিতে পারল না ও। উচ্ছল মুখটা থমথমে হয়ে গেল নিমেষেই।

তাসিনও যেন এমনটাই চেয়েছিল।

এভাবেই স্কুল শেষ হলো সেদিন। ছুটি হলে প্রতিদিনের মতো যে যার বাড়িতে রওনা দিল সবাই।

বেশ কিছুদিন পার হলো এভাবে। হঠাৎ একদিন ক্লাসে হইহই কাণ্ড। কী হয়েছে? জানা গেল, তাসিনের সেই কলমটা পাওয়া যাচ্ছে না। প্রতিদিনের মতো ও প্রিয় কলম আজও এনেছিল স্কুলে। রেখেছিল ব্যাগের পকেটে। কিন্তু টিফিন পিরিয়ডের পর আর পাওয়া যাচ্ছে না কলমটা। ক্লাসের সমস্ত জায়গা আঁতিপাঁতি করে খুঁজল। কলমটার বুঝি পাখা গজিয়েছে। ক্লাসে ওর কজন বন্ধুও দেখেছে আজ, তাসিনের কাছে ছিল কলমটা। তাহলে কে নিল? প্রিয় কলম হারিয়ে তাসিনের মন ভীষণ খারাপ হলো। প্রায় কাঁদো কাঁদো অবস্থা তার।

টিফিন শেষে ক্লাসে এলেন মতিউল স্যার। তিনি বিজ্ঞানের শিক্ষক। আইডিয়াল বয়েজ স্কুলের ছাত্রদের কাছে খুবই প্রিয় শিক্ষক তিনি। তাঁর ক্লাসে কেউই অনুপস্থিত থাকে না। চমৎকার করে পড়ান মতিউল স্যার। বিজ্ঞান খটোমটো বিষয় হলেও মতিউল স্যারের অসাধারণ বিশ্লেষণে বিষয়টি হয়ে ওঠে অতীব সুখপাঠ্য। একেবারে পানির মতো সোজা। তিনি যখন কোনো বিষয় ব্যাখ্যা করেন, মনে হয় সেই জিনিস যেন চোখের সামনে হাজির হয়ে গেছে। ফলে খুবই মনোযোগ দিয়ে তাঁর ক্লাস করে সবাই।

তাসিন আর নিজেকে সামলাতে পারল না। অবশেষে কলম হারানোর কথা বলেই ফেলল স্যারের কাছে।

তাসিনের মা বারবার নিষেধ করেছেন, যাতে কলমটা আর ইশকুলে না নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু তাসিন তা শোনেনি। এখন যদি কলমটা হারানোর কথা তিনি জানতে পারেন, তাহলে ওর কপালে অনেক দুঃখ আছে।

কলমটা একদিন মতিউল স্যারও দেখেছেন তাসিনের কাছে।

কলম হারানোর কথায় তিনি বেশ ব্যথিত হলেন। যেহেতু আজ অনেকেই দেখেছে কলমটা তাসিন সঙ্গে করে ইশকুলে এনেছে, তার মানে ওটা এখান থেকেই হারিয়েছে। রাস্তায় পড়ে যায়নি বা বাড়িতেও ফেলে আসেনি ও। ক্লাসে এসে কোনো জিনিস হারিয়ে যাবে, এটাও ভালো কথা নয়। সুতরাং এর একটা বিহিত করতে হবে।

মতিউল স্যার বললেন, ‘কারও জিনিস না বলে নিজের কাছে রাখা বা নিয়ে নষ্ট করে ফেলা ঠিক নয়। হয়তো তোমাদের কারও ওই কলমটা খুব পছন্দ হয়েছে। হতেই পারে। তার মানে এই নয় যে সেটা নিজের করে পেতে হবে। হয়তো ভুল করে কেউ নিয়েছ। এমনটা হলে চুপচাপ আমার কাছে দিয়ে দাও। কিছুই বলব না আমি। সময় পাঁচ মিনিট। এই পাঁচ মিনিট পার হয়ে গেলে যদি ওটা ফেরত না দাও, তাহলে আমি কিন্তু প্রত্যেকের পকেট-ব্যাগ চেক করব।’

নির্ধারিত পাঁচ মিনিট পার হয়ে গেল। কিন্তু কেউই কলমটা ফেরত দিল না। বেশ চিন্তায় পড়ে গেলেন মতিউল স্যার। এমনটা হওয়ার তো কথা নয়। আরও কিছুটা সময় নিলেন তিনি। ফলাফল একই।

শেষমেশ তিনি উঠে এলেন তাঁর চেয়ার থেকে। সত্যি সত্যিই তিনি সবার পকেট চেক করতে শুরু করলেন।

আগে ব্যাগ চেক করলেন। তারপর পকেট। সিয়াম, রবি, সজীব, তমাল, হারুন—একে একে প্রায় সবার পকেট চেক করা শেষ হলো।

মতিউল স্যার এবার রুবাবের পকেটে হাত দিলেন। ওর গায়ে হাত দিতেই স্যার বুঝতে পারলেন, থরথর করে কাঁপছে রুবাব। স্যার বুঝে গেলেন রুবাবের কাছেই রয়েছে কলমটা। যেহেতু তিনি সবার পকেটেই হাত দিয়েছেন, তাই রুবাবের পকেটেও হাত ঢোকালেন। ঠিকই ধরেছেন স্যার। কলমটা আছে সেখানে। কিন্তু তিনি কিছুই বললেন না।

সবার পকেট চেক করার পর নিজের চেয়ারে ফিরে গিয়ে স্যার বললেন, ‘সবার পকেটই তো দেখলাম। পেলাম না কিছুই। তাসিন, তুমি আজ ক্লাস শেষে বাড়ি যাও, আমি দপ্তরি জয়নালকে ডেকে পরে খুঁজে দেখব। এ কথা আবার বাড়িতে এখনই বোলো না যেন।’

কথাগুলো বলে তিনি তখন আর ক্লাস না নিয়ে বের হয়ে গেলেন ক্লাসরুম থেকে।

মতিউল স্যার রুবাবের পকেটে তাসিনের কলম থাকার বিষয়ে সবার সামনে কিছু না বলায় তাজ্জব হয়ে গেল রুবাব। তিনি তো তার পকেটে কলমটা পেয়েছেন, তখনই তো তাকে চোর বলে সাব্যস্ত করতে পারতেন। কিন্তু…

এর মধ্যে স্কুলের দপ্তরি জয়নাল আঙ্কেল এলেন। রুবাবকে বললেন, ‘হেডস্যার তোমাকে ডেকেছেন। এখনই চলো।’

ক্লাস ক্যাপ্টেন রুবাব। মাঝেমধ্যেই স্যারেরা অফিসকক্ষে ডেকে পাঠান ওকে। আর সে জন্য কেউ কিছু মনেও করল না ব্যাপারটা নিয়ে। ভয়ে ভয়ে হেডস্যারের কক্ষের দিকে এগিয়ে গেল রুবাব। আসলে হেডস্যার ডাকেননি তাকে। ডেকেছেন মতিউল স্যারই। হেডস্যারের নাম করে ডেকে এনেছেন, যাতে বিষয়টা অন্য কেউ আঁচ করতে না পারে।

রুবাব স্যারের সামনে গিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়াল। তখনো ভয়ে কাঁপছে ও।

স্যার একটা গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, ‘তোমার কাছে এটা কোনোভাবেই আশা করিনি রুবাব! কলমটা তুমিই নিয়েছ, অথচ ফেরত দিলে না। কেন নিয়েছ? আমার জানামতে তুমি তো তেমন ছেলে নও! অন্যের জিনিসের প্রতি তোমার লোভ আছে বলেও তো মনে হয় না। ব্রিলিয়ান্ট ছেলে তুমি। এটা তোমার ক্ষেত্রে মানায় না। আজ ক্লাসে তোমার পকেটে থাকা কলমটা যদি আমি বের করে আনতাম, তাহলে তোমার সম্মান কোথায় থাকত বলো তো?’

রুবাব এরপরও চুপ করে আছে। পাথর হয়ে গেছে যেন। মুখ দিয়ে ওর কোনো কথা বেরোচ্ছে না।

স্যার এবার কিছুটা ধমকে উঠলেন, ‘রুবাব, কিছু তো বলো? আমি তো তোমার সঙ্গেই কথা বলছি, কিছু জানতে চাইছি।’

এবার হাউমাউ করে কেঁদে উঠল রুবাব। বলল, ‘স্যার আমাকে মাফ করে দিন। আমি আসলেই এই কলম নিতে চাইনি। আমি কেবল ওর এই কলমটা দেখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ও তো কলমটা দেখালই না, উল্টো আমাকে সবার সামনে রীতিমতো অপমান করল। কেন জানি ও আমায় দেখতে পারে না। তাই কলমটা আমি সরিয়ে রেখে ওকে শান্তি দিতে চেয়েছিলাম। এটা আমার কাছেই যে রেখে দেব, এ জন্য নিইনি স্যার, বিশ্বাস করুন।’

রুবাবের মাথায় হাত বোলালেন মতিউল স্যার। বললেন, ‘আমি বুঝেছি সব। এ জন্যই তোমাকে ক্লাসে সবার সামনে ফেস করাইনি। তাতে তুমি সবার চোখে ছোট হয়ে যেতে। এতে আমারও খারাপ লাগত। আর তোমাকে তো আমরা জানি বাবা। মন খারাপ কোরো না। এখন কলমটা দাও। আগামীকাল ওকে দিয়ে দেব। ভেবো না, তোমার কথা বলব না। কিছু একটা বলে দেব ওকে।’

রুবাব কলমটা পকেট থেকে বের করে স্যারের হাতে দিল। কলমটা ভালো করে নেড়েচেড়ে দেখলেন স্যার। আসলেই কলমটা সুন্দর। বললেন, ‘আর একটা কথা শোনো, কখনো আর এ রকম কাজ করবে না। এটা কিন্তু অন্যায়। মানে হচ্ছে অন্যায় নিজে করা আর প্রশ্রয় দেওয়া, একই কথা।

আর আমি চাইব, তাসিনের সঙ্গে তুমি অবশ্যই বন্ধুত্ব করে ফেলবে। একই ক্লাসে পড়ো, এটা তো ঠিক নয়। জানি, তাসিনই তোমাকে ঠিক বন্ধু ভাবে না। অসুবিধা নেই, এ ব্যাপারে তোমাকে আমি সাহায্য করব। এখন খুশি তো?’

মতিউল স্যার আবার হাত বোলালেন রুবাবের চুলে। মাথা নাড়ল রুবাব। তখনো জলে ছলছল তার চোখ দুটো।

No comments