চীনের রূপকথা: সাত বোন
অনেক বছর আগের কথা। সেদিন রাতে চাঁদ ওঠেনি, আকাশভরা তারা ঝিকঝিক করছিল। খাবার জোগাড় করতে সাতটা নেকড়ে বাঘ নিজেদের আকার বদলে সাত যুবকের রূপ ধরে পাহাড়ের নিচে নেমে গেল। অল্প দূরেই একটি বাড়িতে থাকত সাতটি কুমারী মেয়ে। তারা প্রায় সারা দিনই ঘরে বসে সুতো কাটত। তাদের বাড়ির দরজার এক ফুটো দিয়ে সাতটি নেকড়ে সাত বোনকে দেখল। ভেতরে ঢুকে মেয়ে কটাকে খেয়ে ফেলার জন্য নেকড়ে বাঘগুলো দরজায় ঘা দিতে লাগল। দরজার সেই ফুটো দিয়েই সাত বোন বাইরে সাতজন অচেনা যুবককে দেখে অবাক হয়ে গেল। কিন্তু দরজা খোলার সাহস পেল না তারা।
মেয়েরা দরজা খুলছে না দেখে নেকড়ে বাঘগুলো বলল, ‘আমাদের ভীষণ খিদে পেয়েছে। আমাদের একটা গরু হারিয়ে গিয়েছে। গরু খুঁজতে খুঁজতে অন্ধকারে আমরা নিজেরাই পথ হারিয়েছি। আমরা কি আপনাদের বাড়িতে রাতটা কাটাতে পারি?’
সাত বোন বলল, ‘আমাদের বাবা-মা বাইরে। আপনাদের এখানে থাকতে দিতে অনেক অসুবিধা হবে। আপনারা কষ্ট করে আর এক বাড়িতে যান।’
যুবকদের বেশ ধরা নেকড়ে বাঘগুলো বলল, ‘তাহলে আমরা আপনাদের বাড়িতে রাত কাটাতে চাই না। একটু বিশ্রাম নিতে না পারলে আমাদের চলার সাধ্যি নেই। আমরা এখানে শুধু একটু বিশ্রাম নেব, কেমন?’
কোনো উপায় না দেখে সাত বোন দরজা খুলল, অতিথিদের দিকে সাত বোন চেয়ার এগিয়ে দিল। অতিথিরা চেয়ারে বসার সময় বড় বোনের চোখে পড়ল অতিথিদের প্রত্যেকেরই পেছন দিকে একটা করে লেজ গোটানো আছে। তা দেখে বড় বোন ভীষণ ভয় পেয়ে কাউকে কিছু না বলে পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে গেল।
আতিথেয়তা করে অতিথিদের হাতে একটা করে পানির গ্লাস দেওয়ার সময় মেজো বোন দেখল প্রত্যেক অতিথির হাতে কালো কালো বন লোম। ভয়ে আর টুঁ শব্দটি না করে সেও পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে গেল।
অতিথিরা যাতে পা ধুতে পারে সে জন্য সেজো বোন একটা গামলায় পানি ঢালতে ঢালতে হঠাৎ দেখল অতিথিদের পায়ে ঘন কালো কালো লোম, আতঙ্কে শিউরে উঠে সেজো বোনও পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে গেল। চার নম্বর বোন অতিথিদের কতকগুলো চালের পিঠে খেতে দিল, অতিথিরা পিঠে নেওয়ার সময় সে দেখল অতিথিদের হাতের ছুঁচলো নখে পিঠেগুলোতে পাঁচটা করে ছ্যাঁদা হয়ে যাচ্ছে। ভয়ে তার শরীর অবশ হয়ে গেল, তার হাতের পিঠাগুলোও মাটিতে পড়ে গেল।
তার অবস্থা দেখে নেকড়েগুলো পা ধোয়া, পানি খাওয়া আর পিঠে খাওয়া থামিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘ব্যাপার কী? কী হলো?’
চার নম্বর বোন আতঙ্কে চিৎকার করে ছুটে পালিয়ে যেতে চাইল, কিন্তু ভয়ে তার গলা থেকে কোনো স্বর বেরোল না, তার পা-দুটোও যেন অশক্ত হয়ে পড়ল।
কোনো উপায় না দেখে সে চুপচাপ পিঠেগুলো মাটি থেকে কুড়িয়ে নিয়ে একপাশে আবার বসে সুতো কাটতে শুরু করে দিল। বাইরে তার চালচলন স্বাভাবিক দেখে সাতটি নেকড়ে আবার বসল, বসে আবার পিঠে খেতে শুরু করল। চার নম্বর বোন সুতো কেটেই চলল, চরকার বনবন শব্দ চাপা কান্নার মতো শোনাতে লাগল।
সেই শব্দের মধ্যে গলা মিশিয়ে চার নম্বর বোন তার ছোট তিনটে বোনকে বলল, ‘যারা এসেছে তারা মানুষ নয়, নেকড়ে। মানুষ খাওয়ার জন্য ওরা মানুষের রূপ ধরেছে। এখন একটা কোনো বিহিত করতে না পারলে ওরা আমাদের মেরে ফেলবে।’ এ কথা শুনে ছোট বোন তিনটে নিদারুণ ভয়ে চাপা সুরে কাঁদতে শুরু করল, পাছে, নেকড়েগুলো শোনে এই ভয়ে জোরে কাঁদতেও সাহস পেল না। সবচেয়ে ছোট বোন অর্থাৎ সাত নম্বর বোন ছয় নম্বর বোনকে বলল, ‘তুমি আমার বড়, তুমি আমাকে বাঁচার একটা উপায় ঠাওরাও।’
ছয় নম্বর বোন পাঁচ নম্বর বোনকে বলল, ‘তুমি আমার বড়, আমাকে নেকড়ে বাঘের কবল থেকে বাঁচানো তোমার দায়।’
পাঁচ নম্বর বোন কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে থেকে শেষ পর্যন্ত চার নম্বর বোনকে বলল, ‘আমাদের চার বোনের মধ্যে তুমিই বড়, তোমার উচিত একটা উপায় বের করে আমাদের সবাইকে বাঁচানো।’ কিন্তু চার নম্বর বোন ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছিল নেকড়ে বাঘদের সামনে থেকে চার বোনের পালানো খুবই কঠিন। সে ছোট বোন তিনটিকে বলল, ‘আমাদের বড় তিন বোন বিপদের সামনে শুধু নিজের নিজের কথা চিন্তা করে চুপ করে পালিয়ে গেল, এখন নেকড়ে বাঘদের কবল থেকে আমাদের বাঁচতে হলে আমাদের নিজেদেরই একটা মতলব বের করতে হবে। নইলে আর রক্ষা নেই।’ চার নম্বর বোনের কথায় ছোট তিন বোন সায় দিল। চার বোনই বসে বসে সুতো কাটার ছলে ফিসফিস করে পরামর্শ করতে লাগল। চার চরকার বনবন শব্দের ধরন ক্রমে ক্রমে বদলে গেল, চাপা কান্নার শব্দ যেন থেমে গেল। মাথা ঘামিয়ে চার বোন একটা চমৎকার মতলব বের করল।
একটু পরে চার নম্বর বোন উঠে দাঁড়িয়ে নেকড়ে বাঘদের বলল, ‘আমাদের ভীষণ ঘুম পেয়েছে, আপনাদের কি খাওয়া শেষ হয়নি?’ নেকড়েগুলো বলল, ‘বেশি রাত তো হয়নি। তা ছাড়া তোমাদের বড় তিন বোন এখনো ফিরে আসেনি। তোমরা বরং আগুনের কাছে এসে বসো, গা গরম হবে।’
চার নম্বর বোন রাজি হওয়ার ভান করে বলল, ‘তাই ভালো, শুতে যাওয়ার আগে একটু আগুন পুইয়ে নিই। তবে আগুনটা তো আরও চাঙা করা দরকার। আমি বরং ওপরতলা থেকে আরও কিছু কাঠ নিয়ে আসি?’
এ কথায় নেকড়ে বাঘগুলোর কোনো সন্দেহ হলো না, চার নম্বর বোন ঘর থেকে বেরিয়ে কাঠের সরু সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠল। একটু পর ওপরতলা থেকে সে তার ছোট বোন তিনটিকে ডেকে বলল, ‘আমি একা এত কাঠ বয়ে আনতে পারছি না, তোমরা তাড়াতাড়ি এসো, তোমরাও কিছু কাঠ বয়ে নিয়ে যাবে।’
এ কথায় ছোট বোন তিনটিও ঘর থেকে বেরিয়ে ওপরতলায় উঠল। নিচে সাতটা নেকড়ে বাঘ পা ধুয়ে সমস্ত পিঠে খেয়ে পানি খেয়ে বসে বসে আগুন পোহাতে পোহাতে অপেক্ষা করতে লাগল কখন চার বোন কাঠ নিয়ে ফিরবে। বহুক্ষণ কাটল তবু চার বোনের ওপর থেকে ফেরার নাম নেই। শেষে নেকড়েগুলোর আর ধৈর্য রইল না। নেকড়েগুলোর মধ্যে যে সবচেয়ে বড় সে লাফ মেরে মেয়েগুলোর খোঁজে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। বেরিয়ে গেল বটে কিন্তু আর ফিরল না। তখন দ্বিতীয় নেকড়েটা আর তারপর তৃতীয় নেকড়েটা একইভাবে ওপরে খোঁজ নিতে গিয়ে আর ফিরে এল না। বাকি চারটে নেকড়ে ব্যাপার কী কিছুই বুঝে উঠতে পারল না, তবে তাদের মনে হলো হয়তো কোনো অঘটন ঘটছে, একা একা আর ওপরে যাওয়া ঠিক হবে না।
চার নম্বর নেকড়ে বাকি তিন নেকড়েকে তার নিজের পেছনে দাঁড় করাল। প্রত্যেক নেকড়ে তার সামনের নেকড়ের লেজ শক্ত করে ধরে রইল, তারপর এমনি মজবুত লাইনবন্দী অবস্থায় নেকড়েগুলো কাঠের সরু সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে লাগল। সবচেয়ে সামনে ছিল চার নম্বর নেকড়ে, আর সিঁড়ি যেখানে শেষ হয়েছে সে জায়গা ঘিরে চার বোন অপেক্ষা করছিল চারটে মোটা মোটা রক্তমাখা কোঁৎকা হাতে নিয়ে।
নেকড়ে সারির প্রথম নেকড়ের মাথাটা ওপরতলা বরাবর পৌঁছাতে না পৌঁছাতে মাথাটা প্রচণ্ড কয়েক ঘায়ে চৌচির হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে খতম হয়ে গিয়ে সে সিঁড়ি থেকে পড়ে গেল। সেই সঙ্গে পড়ে গেল বাকি তিনটে নেকড়েও। কারণ ওরা শক্তভাবে লেজ ধরাধরি করে ছিল। সিঁড়ি থেকে পড়ে গড়াতে গড়াতে নেকড়ে তিনটে একেবারে আগুনের ভেতরে পড়ল, ওদের লোমে আগুন ধরে গেল, ছাল ঝলসে গেল। বিকট চিৎকার করতে করতে ওরা আগুন থেকে কোনোমতে বেরিয়ে ছুটে বাইরে চলে গেল, বোন চারটেও তাড়াতাড়ি নিচে নেমে দরজায় খিল এঁটে দিল।
ওদের খিল আঁটতে দেখে নেকড়ে তিনটে বুঝতে পারল চার বোন ফন্দি করে ওদের এই হাল করেছে আর আগের চারটে নেকড়েকে খতম করেছে। এটা বুঝতে পারামাত্র নেকড়ে তিনটে খেপে গেল। প্রচণ্ড আক্রোশে ওরা ওদের আসল রূপ ধরে বন্ধ দরজার ওপর বারবার ঝাঁপিয়ে পড়তে লাগল, বারবার গর্জন করে, থাবা মেরে মেরে দরজা ভেঙে ফেলার চেষ্টা করল। কিন্তু দরজাটা ছিল খুব শক্ত, অনেক চেষ্টা করেও ওরা দরজাটা একটুও নড়াতে পারল না, ভেতর থেকে চরকা ঘোরার শন শন শব্দ আসতে লাগল, আর সেই শব্দের মধ্যে যেন কাদের খুশি ঢেউ। সামনের দিক থেকে সুবিধে করতে না পেরে নেকড়ে তিনটে বাড়ির পেছন দিকে গেল। তারা পেছনের দরজা দিয়ে কোনো কায়দায় বাড়ির ভেতরে ঢুকতে চাইল। কিন্তু দেখা গেল পেছনের দরজাও প্রায় বন্ধ। সুইয়ের আকার ধরলেও ওরা পেছনের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকতে পারবে না।
আক্রোশে গজরাতে গজরাতে নেকড়ে তিনটে এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করতে লাগল। হঠাৎ পেছনের দরজার কাছে পাঁচ নম্বর নেকড়ে একটা পিপে দেখতে পেল, পিপের ঢাকনাটা যেন পুরোপুরি লাগেনি। পাঁচ নম্বর নেকড়ে উঁকি মারতেই তার চোখে পড়ল দুলপরা একটা কান। সঙ্গে সঙ্গে নেকড়েটা এক কামড়ে পুরো কানটা ছিঁড়ে নিল। কানটি ছিল সবচেয়ে বড় বোনের। সে পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে এসে পিপেটার মধ্যে লুকিয়েছিল। তার একটা কান যে ঢাকনার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছিল তা সে খেয়ালই করতে পারেনি। নেকড়ের মুখে তার কান চলে যাওয়ায় সে ক্ষোভে দুঃখে যন্ত্রণায় কাঁদতে লাগল।
ওদিকে ছয় নম্বর নেকড়ে ঘোরাঘুরি করতে করতে দেখতে পেল মাথার ওপর একটা গাছের ডাল থেকে কার যেন একটা পা ঝুলছে। নেকড়েটা লাফ দিয়ে উঠে এক কামড়ে সেই পায়ের একটা আঙুল ছিঁড়ে নিল। পা-টা ছিল মেজো বোনের। সে পালিয়ে এসে গাছে উঠে লুকিয়েছিল, কিন্তু একা একা ভয়ে সে স্থির থাকতে পারছিল না। তাতেই নেকড়ে বাঘটা তার পা দেখতে পেয়েছিল, তাড়াতাড়ি পা গুটিয়ে নিতে পারার আগেই নেকড়েটা তার পায়ের আঙুল কামড়ে ছিঁড়ে নিয়েছিল। সে পা গোটানোর চেষ্টা না করলে হয়তো তার পুরো পা-ই নেকড়ের গ্রাসে চলে যেত।
সাত নম্বর নেকড়েও অনবরত গোঁ গোঁ করতে করতে ছোটাছুটি করছিল। হঠাৎ তার চোখে পড়ল এক ঘন ঝোপের ভেতর থেকে কার যেন পেছনের অংশ বেরিয়ে রয়েছে। অমনি নেকড়েটা ঝাঁপিয়ে পড়ে সেই পেছনের অংশ থেকে এক কামড় মাংস ছিঁড়ে নিল। আসলে সেজো বোনটা একা একা পালিয়ে এসে ঝোপের মধ্যে গা ঢাকা দিয়ে উবু হয়ে বসে ছিল উটপাখির মতোই। সে বুঝতে পারেনি যে তার পেছনের অংশ বেরিয়ে রয়েছে। ফলে নেকড়ের গ্রাসে তার বেশ খানিকটা মাংস চলে গেল। বোঝা গেল কোথাও বসার উপায় তার বহুদিন থাকবে না।
বড় বোন, মেজো বোন, সেজো বোন শুধু তাদের ভীরুতার জন্য নয়, তাদের স্বার্থপরতার জন্যই ক্ষতিগ্রস্ত হলো। অথচ তাদের ছোট চার বোন, জোট বেঁধে কৌশল করে চারটে নেকড়ে বাঘ মেরে ফেলল, তিনটি নেকড়ে বাঘকে ফন্দি করে তাড়াল এবং নিজেদের বিয়ের পোশাকের জন্য চারটে মরা নেকড়ে বাঘের ছালও পেল।
(চীনের মিয়াও জাতির এই লোককাহিনিটি চীন থেকে প্রকাশিত সাত বোন বই থেকে সংগৃহিত)
Post a Comment