ভজরামের প্রতিশোধ – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়
এক আকাশে দুই সূর্য কখনও শোভা পায়? উহুঁ!
আর এক পাড়ায় দুজন সাহিত্যিক থাকলে? কী যে নিদারুণ অঘটন ঘটতে পারে সেটা বোঝা গেল সাতান্ন নম্বর বাড়িতে দোলগোবিন্দবাবু আসবার পর।
এতদিন বেয়াল্লিশ নম্বরের ভজরামবাবুই ছিলেন পাড়ার একমাত্র লেখক। গল্প উপন্যাস দুই-ই তিনি লেখেন। উপন্যাস অবশ্য এখনও ছাপা হয়নি, তবে খানকুড়িক পাণ্ডুলিপি তাঁর ঘরে মজুত আছে–ভজরামবাবু আশা রাখেন ভবিষ্যতে একদিন প্রকাশকেরা তাঁর কদর বুঝবে–তাঁর বই ছাপার জন্যে বাড়িতে এসে লাইন দেবে। গল্প-টল্প প্রায়ই সম্পাদকের দপ্তর থেকে ফেরত আসে, হঠাৎ দু-একটা ছাপাও হয়ে যায়। তোমাদের চুপি চুপি বলি, দু-চারজন সম্পাদককে যখন-তখন বাড়িতে নেমন্তন্ন করে তিনি চর্ব-চূষ্য খাওয়ান, আর তাঁরাই নেহাত চক্ষুলজ্জার খাতিরে এবং ভোজের আশায়–।
সে যাই হোক, পাড়ার লোকে ভজরামবাবুকে বেশ সমীহ করে থাকে। যাই লিখুন, একজন জলজ্যান্ত সাহিত্যিক তো বটে। ছাপার অক্ষরে নাম বেরোয় শ্রীভজরাম বসু–সে তো চারটিখানি কথা নয়। আর তাইতেই তিনি পাড়ার সাহিত্য সভায় সভাপতি হন, ছোটদের হাতে-লেখা পত্রিকায় বাণী দেন, লম্বা পাঞ্জাবি পরে বাসন্তী রঙের চাদর কাঁধে ফেলে–চুল উস্কোখুস্কো করে উদাস হয়ে হেঁটে যান। চাকরিবাকরি করেন না, ওসব তুচ্ছ জিনিস কি সাহিত্যিকদের জন্যে! খান তিনেক বাড়ি আছে, মোটা রকমের ভাড়া পান, আর ভজরামবাবু ভালো-মন্দ খেয়ে-দেয়ে উঁচু-উঁচু সাহিত্য-বিষয় নিয়ে চিন্তা করেন।
এইভাবে দিনগুলো যখন চমৎকার কেটে যাচ্ছিল, তখন হঠাৎ সাতান্ন নম্বর বাড়িতে দোলগোবিন্দ দে এসে গেলেন। তিনি কোথায় ভালো একটা চাকরিবাকরি করেন, কিন্তু সেটাই তাঁর আসল পরিচয় নয়। তিনি বেশ নামডাকওলা কবি। তাঁর কবিতা কেউ ফেরত দেন না বরং সম্পাদকেরাই ধরনা দেন তাঁর কাছে। বাজারে তাঁর অনেক বই-টই আছে, ছোটরা তাঁর লেখার দারুণ ভক্ত।
ভজরামবাবু প্রথমে বিশেষ পাত্তা-টাত্তা দেননি। একে কবি, তায় বাচ্চাদের লেখক-ছোঃ! কবিতা লেখে কারা? গল্প-উপন্যাস লিখতে যাদের বিদ্যায় কুলোয় না। আর শিশুসাহিত্যিক? রামোঃ, তাদের কেউ আবার লেখক বলে গণ্য করে নাকি? ভজরামের ছেলে নকুল রোমাঞ্চিত হয়ে বলতে এল : জানো বাবা, পাড়ায় একজন বিখ্যাত লেখক এসেছেন। কবি দোলগোবিন্দ দে।
শুনে, ভজরাম দাঁত খিঁচিয়ে তাকে ধমক লাগালেন একটা।
ইঃ দোলগোবিন্দ আবার লেখক! আরশোলাও পাখি, গুবরে পোকাও এরোপ্লেন! তোকে বেশি ওস্তাদি করতে হবে না, এখন মন দিয়ে জিয়োগ্রাফি পড়গে। আর ফের যদি ওসব দোলগোবিন্দ ঢোলগোবিন্দের কথা আমাকে বলতে আসবি, তা হলে কান দুটো একেবারে উপড়ে নেব। মনে থাকে যেন।
নিজের ছেলের কান না হয় উপড়ে নেওয়া যায়, কিন্তু পাড়ার সব ছেলের কান যে অত সহজেই পাকড়ে ধরা যায় না, সেটা ভজরাম কিছুদিনের মধ্যেই টের পেয়ে গেলেন।
পাকুড়গাছি লেনের শুভ্রিকা বরণ উৎসব এসে গেল। আসলে ব্যাপারটা সরস্বতী পুজো কিন্তু আজকাল নানা কায়দায় সালু টাঙানো হয়–কেউ লেখে বাগদেবী বন্দন, কেউ লেখে শুক্লাবরণ, কেউ বা লেখে শুভ্রা অর্চনা। এই শুভ্রাকেই আর একটু কাব্যিক মতে ভজরাম শুভ্রিকা করে দিয়েছিলেন। এতদিন সেটাই চলছিল, কিন্তু হঠাৎ রাস্তায় বেরিয়ে শুভ্রা বরণে লেখা সালু টাঙানো দেখেই মেজাজ বিগড়ে গেল তাঁর।
পাড়ার দু-তিন জন পাণ্ডা গোছের ছেলে সামনেই রাস্তার ওপর উবু হয়ে বসে, বেশ মন দিয়ে, ফিরিওলার কাছ থেকে ফুচকা খাচ্ছিল। ভজরাম ডাকলেন, ওহে শ্যামল–নেবু–কেলো!
ফুচকা চিবোতে চিবোতে তিনজনেই এসে হাজির হল!
কী ব্যাপার?–কড়া গলায় ভজরাম জিজ্ঞেস করলেন, এর মানে কী? শুভ্রিকা বদলে সালুতে শুভ্রা লেখা হল কেন?
তিনজনেই চুপ।
রাস্তায় পা ঠুকে ভজরাম বললেন, চুপ করে থাকলে চলবে না–এর জবাব চাই।
ফুচকা গিলতে গিয়ে একটা বিষম খেয়ে নেবু বললে, আজ্ঞে দোলগোবিন্দবাবু
অঃ, সেই কবিবর?–ভজরাম ঠাট্টা করে বললন, তিনিই বুঝি ওস্তাদি করেছেন?
আজ্ঞে ওস্তাদি করেননি।–নেবু এবার ঢোক গিলল : তিনি বললেন, শুভ্রিকা বলে কোনও শব্দ ব্যাকরণে হয় না সরস্বতী পুজোয় এসব ভুল থাকা উচিত নয়। তা ছাড়া কুড়ি টাকা চাঁদাও দিয়েছেন–
বটে। কুড়ি টাকা চাঁদাই তবে আসল কথা। রাগের চোটে ভজরামের মগজের ভেতরে যেন তিন ডজন উচ্চিংড়ে লাফাতে লাগল : তা হলে আর আমাকে কেন? ওই কপিরাজকে নিয়েই থাকো। শুভ্রিকা হয় না? তা হলে কালী কালিকা হয় কী করে? বীথি বীথিকা হয়? পুঁটিমাছকে পুন্টিকা বলে কেন? ব্যাকরণ দেখাতে এসেছে। তা হলে ওই ব্যাকরণওলা ঢোলগোবিন্দকে নিয়েই তোমরা ব্যা ব্যা করো–তোমাদের সাহিত্য-সভায় আমাকে আর ডেকো না।
স্যার স্যার শ্যামল-নেবু-কেলো এক সঙ্গেই হাহাকার করে উঠল। কিন্তু ভজরাম আর দাঁড়ালেন না, হনহন করে বাড়িতে এলেন।
ফিরে এসে এক পেয়ালা চা খেয়ে মাথাটা একটু ঠাণ্ডা হল। ভাবলেন, এবার আচ্ছা জব্দ করে দিয়েছেন। প্রত্যেক বছর শুভ্রিকা বরণের দিন সন্ধেবেলায় প্যাণ্ডেলে একটা সাহিত্য-সভা হয়, পাড়ার ছেলেরা গল্প কবিতা পড়ে এবং সভাপতি হিসেবে ভজরাম তাঁদের নানারকম সদুপদেশ দেন। আট বছর ধরে বাঁধা সভাপতি হয়ে এই মহৎ কাজটি তিনি করে আসছেন। তিনি না গেলে সাহিত্য সভাই পণ্ড হয়ে যাবে।
ভজরাম ভাবলেন, ছেলেরা আজই তাঁর কাছে আসবে–ক্ষমা চাইবে-সালুতে শুভ্রা কেটে শুভ্রিকা লেখা হবে। কিন্তু একদিন–দুদিন–তিন দিন সাত দিন কেটে গেল, কোথায় কী! শুভ্রা তেমনি ঝুলতে লাগল, মিত্তিরদের বাড়ির সামনে খোলা জায়গাটায় প্যাণ্ডেলের বাঁশ পড়ল, শ্যামল-নেবু-কেলো-মন্টু-হাবু ন্যাদা চাঁদা আদায় করে, প্রতিমা বায়না দিয়ে, মাইকের ব্যবস্থা করে হয়রান হয়ে গেল, কিন্তু তাঁর কাছে আসবার জন্যে কারও এতটুকুও গরজ দেখা। গেল না।
এবং শেষ পর্যন্ত
হতভাগা নকুলটাই হাতে করে চিঠিখানা নিয়ে এল তাঁর কাছে।
সুধী! আমাদের শুভ্রা বরণে—
চিঠিটা তক্ষুনি ছুঁড়ে ফেলতেন, কিন্তু মনে হল সাহিত্যসভা? সাহিত্য সভার কী হবে?
স্বনামধন্য কবি শ্রীযুক্ত দোলগোবিন্দ দে সভাপতির আসন গ্রহণ করে
স্বনামধন্য! দাঁতে দাঁতে কিড়মিড় করলেন ভজরাম। কই, এই আট বছর ধরে তাঁর নামের আগে তো কখনও স্বনামধন্য লেখা হয়নি! শ্রীযুক্ত দিয়েই কাজ সারা হয়েছে। যত খাতির ওই ঢোলগোবিন্দের জন্যে! বটে!
নকুল গলা খাঁকারি দিয়ে বললে, বাবা!
বজ্ৰদৃষ্টিতে ভজরাম তার দিকে তাকালেন।
বাবা, ওরা তোমার কাছে আসবার সময় পেল না, আমাকে বলে দিয়েছে, দোলগোবিন্দবাবু মোটেই বক্তৃতা করতে পারেন না–তুমি যদি সভায় একটু ভাষণ দাও
পায়ের নখ থেকে চুলের ডগা পর্যন্ত পাঁচ হাজার ভোল্ট ইলেকট্রিসিটি বয়ে গেল ভজরামের। এমন আকাট মুখখু গাড়ল ছেলেও মানুষের হয়! পিতার এই জ্বালাময়ী অপমানে কোথায় মরমে মরে যাবে তা নয়-দাঁত বের করে বলছে : যদি একটু ভাষণ দাও।
নকুলকে লক্ষ্য করে দেড় মন ওজনের চাঁটি হাঁকড়ালেন একটা–নকুল লাফিয়ে পালিয়ে গেল, লক্ষ্যভ্রষ্ট চাঁটিটা একটা কালির শিশিতে গিয়ে পড়ল; সেটা ছিটকে চলে গেল দরজার বাইরে, ভেঙে গুঁড়ো হয়ে গেল আর ভজরামবাবুর শখের শাদা নাগরা জুতোজোড়াটার বারোটা বেজে গেল।
শুভ্রা কিংবা শুভ্রিকা বরণের সাহিত্য বাসর বসছে। কিছুতেই যাব না পণ করেও শেষ পর্যন্ত আসরে হাজির হয়েছেন ভজরাম, দোলগোবিন্দ লোকটাকে একবার ভালো করে দেখে নিতে চান। বাচ্চাদের কবিতা লেখে–সে আবার সাহিত্যিক! তা হলে তো যেসব গুবরে পোকা ঘুর ঘুর করে উড়ে বেড়ায় তাদেরও জেট-প্লেন বলতে হয়!
পাড়ার ছেলেরা ভজরামকে খাতির করে একেবারে মঞ্চের ওপর দোলগোবিন্দের পাশে বসিয়ে দিলে। হাজার হোক তিনিও তো লেখক, আর কমসে কম আটবার এই সভায় সভাপতি হয়েছেন। ছেলেরা পরিচয় করিয়ে দিলে, দোলগোবিন্দ মিষ্টি হাসিতে ভজরামকে অভ্যর্থনা করলেন, আর সেই হাসি দেখে ভজরামের পিত্তি পর্যন্ত জ্বালা করে উঠল।
তখন কবিতা-টবিতা পাঠ শুরু হয়েছে, কিন্তু কিছুই কানে যাচ্ছিল না ভজরামের। তিনি কটকটে চোখ মেলে এক দৃষ্টিতে দোলগোবিন্দকে–যাকে বলে অভিনিবেশ সহকারে পর্যবেক্ষণ তাই করতে লাগলেন। আরে ধ্যাৎ–ইনি আবার স্বনামধন্য। গুটগুটে ছোট চেহারা, রং কালো, মাথায় নিটোল একটা টাক–এ যদি কবি হয়, তা হলে তো চামচিকেও–কী বলে পক্ষিরাজ ঘোড়া। একে বরং বাঁধাকপি বলা যায়, অনেকটা সেইরকম দেখতে। আর ভজরাম? তাঁর লম্বা-চওড়া মস্ত চেহারা, ফুটফুটে গায়ের রং, সোজা সিঁথি কাটা চুলের দুপাশে বাবরি–চোখে সোনার চশমা–অচেনা লোকেও সমীহ করে ভাবে–একটা কেউকেটা হবেন! তাঁর জায়গায় এ সভাপতি? সিংহের আসনে শেয়াল?
সাহিত্যসভার কাব্য পাঠ-টাঠ হয়ে গিয়েছিল। মুচকি হেসে দোলগোবিন্দ উঠে দাঁড়ালেন। মিনমিন করে বললেন, তিনি অল্প-স্বল্প লেখেন বটে, কিন্তু বক্তৃতা-টক্তৃতা তাঁর আসে না। ছোটদের লেখা শুনে খুব খুশি হয়েছেন-এইটুকুই তাঁর বক্তব্য। তিনি এবারে পল্লীর বিশিষ্ট লেখক ভজরাম বসুকে আহ্বান জানাচ্ছেন কিছু বলবার জন্যে।
কাঁকড়া-বিছের ল্যাজেই বিষ!–ভজরাম ভাবলেন : কেন, স্বনামধন্যটন্য বলতে কি জিভ টাকরায় আটকে গেল? পল্লীর বিশিষ্ট লেখক! পল্লীর বাইরে তাঁর লেখা বুঝি কেউ পড়ে না?
আগুন হয়ে ভজরাম বলতে শুরু করলেন। মাইকের ভেতর দিয়ে তাঁর মেঘমন্দ্র স্বর ছড়িয়ে পড়ল : আমার আর বলবার কী আছে, যখন স্বনামধন্য একজন কবি এখানে হাজির আছেন। তিনি আবার যে-সে কবি নন বাচ্চাদের জন্যে কবিতা লেখেন। আমি তাঁর লেখা পড়িনি, পড়বার দরকার হয় না। আমার বলবার কথা হল, যেখানে বাচ্চাদের কোন এক কবিরাজকে এনে সভাপতি করা হয়, সেখানে আমার মতো ঔপন্যাসিককে ডেকে আনার কোনও প্রয়োজন
সভায় একটা গোলমাল শুরু হল। কে যেন চেঁচিয়ে বললে, ঔপন্যাসিক না হাতি। ছাই লেখেন। আর একজন চেঁচিয়ে উঠল : দোলগোবিন্দবাবু আমাদের সভাপতি–তাঁকে অপমান
ইউ শাট আপ!-বলে এক রাম-চিৎকার ছাড়লেন ভজরাম : অমন সভাপতি আমি ঢের দেখেছি! কবি না বাঁধাকপি।
অ্যাপোলজি চান শিগগির-আট দশ জন দাঁড়িয়ে উঠল।
অ্যাপোলজির নিকুচি করেছে–ডাকাত-পড়া হুংকার ছাড়লেন ভজরাম।
এবার শেয়াল-কুকুরের হাঁক উঠতে লাগল সভায়। ভজরাম চেয়ার উলটে দিয়ে দুড়দাঁড়িয়ে বেরিয়ে গেলেন। আর দোলগোবিন্দ উঠে দাঁড়িয়ে বলতে লাগলেন : আপনারা শান্ত হোন, আজ বাণী বন্দনার পবিত্র দিন–আজকে আপনারা স্থির হয়ে থাকুন। আর সত্যিই তো আমি সামান্য শিশু-সাহিত্যিক, উনি তো কোনও অন্যায় কথা ইত্যাদি ইত্যাদি।
ব্যাপারটা যে মিটল বটে, কিন্তু ভজরাম পরে বুঝলেন কাজটা ভালো হয়নি। ঢোলগোবিন্দ যেমনই লিখুক, ও-ভাবে সভায় বলাটা তাঁর অন্যায় হয়ে গেছে। আর ওই বক্তৃতা দিয়ে পাড়াতেও তিনি আনপপুলার হয়ে গেছেন, নকুল হাঁড়িমুখ করে কয়েক বারই এসে বলেছে : সবাই তোমার নিন্দে করছে বাবা বলছে দোলগোবিন্দবাবু কত মহত্ত্বের পরিচয় দিয়েছেন, আর তুমি
ইউ শাট আপ বলে নকুলকে থামিয়ে দিয়েও ভজরাম মনে-মনে লজ্জা পাচ্ছিলেন। দোলগোবিন্দের কাছে গিয়ে একটা ক্ষমা-টমা–উহঁ, সে-ও অসম্ভব। ভাবতে গিয়েই মাথা গরম হয়ে গেল। যদি সে বলত স্বনামধন্য ঔপন্যাসিক কিংবা বিখ্যাত লেখক–তাহলেও বরং সহ্য করা যেত। কিন্তু তার বদলে পল্লীর বিশিষ্ট লেখক–আর দোলগোবিন্দ থাকবে স্বনামধন্য হয়ে? তৎক্ষণাৎ ভজরাম ভাবলেন, যা করেছেন বেশ করেছেন।
দিন পনেরো বাদে ডাকে একটা পত্রিকা এল তাঁর নামে। খুলে দেখলেন, একটা বাচ্চাদের কাগজ। এ তাঁকে কে পাঠাল? তিনি তো এসব কাগজে কোনও লেখা কখনও দেন না!
পাতা ওলটাতেই একটা কবিতা। তার নাম গজাও আবার গল্প লেখে। লেখক শ্রীদোলগোবিন্দ দে। কবিতাটার মাথায় আবার লাল কালির একটা দাগ দেওয়া–যেন তাঁকে এইটেই বিশেষভাবে পড়তে বলা হচ্ছে।
লাইন কয়েক পড়বার পরেই আর সন্দেহ রইল না। সেই মিটিঙের জবাব দিয়েছে ঢোলগোবিন্দ। কী নিদারুণ জবাব।
শ্রীগজরাম ঘোষ
সেটাও যখন লেখক হল
রইল বাকি মোষ।
মোষের মতোই কাঁপিয়ে পাড়া
বাগদেবীকে করল তাড়া
ব্যাকরণের পিণ্ডি গিলে
ফোঁপায় সে ফোঁসফোঁস!
সভায় গিয়ে হাঁকড়ে বলে
কী যে আমি হনু
দেখল সবাই মোযটা তখন
ল্যাজকাটা এক হনু—
এরপরে কেউ আর পড়তে পারে না, ভজরামও পারলেন না। কাগজটা ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। ভজরাম আর গজরামের মিল কে না বুঝতে পারে। আর বোসকে ঘোষ করা তো
পরমুহূর্তেই রাস্তা থেকে শ্যামল-নেবু-কেলো-ন্যাদা-নেপালের কোরাস শোনা গেল :
শ্রীগজরাম ঘোষ।
সেটাও যখন লেখক হল—
ধড়াম করে জানলা বন্ধ করে দিয়ে ভজরাম মাথার চুল ছিঁড়তে লাগলেন। দোলগোবিন্দ তা হলে তো সত্যিই কাঁকড়া বিছে! শুধু কবিতাই লেখেনি, পাড়াসুদ্ধ ছেলেকে তা মুখস্থ করিয়েছে! আচ্ছা-দেখ লেঙ্গে।
তখন গায়ে জামা চড়িয়ে চলে গেলেন উকিলের বাড়ি। পথে যেতে যেতে গলির মোড়ে মোড়ে শুনতে লাগলেন : শ্ৰীগজরাম ঘোষ
দাঁত কিড়মিড় করে মনে-মনে ভজরাম বললেন, আচ্ছা ঢোলগোবিন্দ, দাঁড়াও! মানহানির দায়ে যদি ছমাস তোমার শ্রীঘর না ঘোরাই, তবে আমি ভজরাম বোসই নই।
উকিল সব শুনলেন, কবিতাটাও বেশ মন দিয়ে পড়ে দেখলেন। তারপর মাথাটাথা চুলকে বললেন, এতে মানহানির মামলা হবে না।
হবে না? আমাকে মোষ বলেছে, হনু বলেছে, কচ্ছপ বলেছে, আর শেষে বলেছে দুম্বা ওটা ধুম্বো লেজ চিবোয় বালাপোশ–এর পরেও মানহানি হবে না?
ভজরাম খেপে গেলেন।
উকিল বললেন, সবই তো বুঝছি মশাই, কিন্তু আপনাকেই যে বলেছে তা তো প্রমাণ করা যাবে না। আপনি তো মোষ নন, হনু নন, ধুম্বো ল্যাজওলা দুম্বাও নন, বালাপোশও আপনি কখনও চিবোন না। ওরা বলবে, বাচ্চাদের হাসির কবিতা। আর তা ছাড়া এ-ও ভেবে দেখুন মামলা করলে ব্যাপারটা দেশসুদ্ধ লোকে জেনে ফেলবে, যারা এখনও কবিতাটি। পড়েনি তারাও পড়ে ফেলবে–তাতে আপনারই কেলেঙ্কারি।
গুম হয়ে থেকে শেষ কথাটা চিন্তা করে দেখলেন ভজরাম। তারপর ভাঙা গলায় বললেন, তা হলে এই যে জ্বালাময়ী অপমান
আপনি পাল্টা একটা গল্প লিখে দিন না। তবে নাম-টাম একটু বদলে যেমন দোলগোবিন্দ দে-কে করুন গোবিন্দলাল ঢোল, শিশুকবি না করে করুন একটা নাট্যকার-ফাট্যকার–মানে পড়ে লোকে বুঝতে পারবে, অথচ মানহানিও হবে না।–উকিল পরামর্শ দিলেন : আর কবিতার জবাব গল্পেই তো দেওয়া ভালো, বিশেষ করে আপনি যখন নামজাদা লেখক।
নামজাদা শব্দটা কানে মধু ঢালল। ঠিক কথা-কবিতার জবাব গল্পেই দেবেন। ভজরাম মনঃস্থির করে উঠে পড়লেন।
.
লেখা হল গল্প। লাইনে লাইনে তার নিদারুণ ব্যঙ্গ। গোবিন্দলাল ঢোল নামটা ভালো লেগেছিল, সেইটেই রাখলেন ভজরাম। নাট্যকার করলেন না, করলেন কবি। লিখলেন, গোবিন্দলাল ঢোলের অখাদ্য কবিতা পড়ে দেশসুদ্ধ লোক তাকে লাঠি নিয়ে তাড়া করল– বাঁধাকপির মতো চেহারাওলা গোবিন্দ ঢোল শেষে জঙ্গলে পালিয়ে গেল, তারপর কপিদের দলে ভিড়ে গিয়ে গাছে উঠে কচি কচি পাতা চিবুতে লাগল।
লিখে, আনন্দে নাচতে ইচ্ছে করল। মোক্ষম গল্প। দোলগোবিন্দ এই গল্পে একেবারে বিধ্বস্ত হয়ে যাবে। তক্ষুনি চিঠি লিখে ডেকে আনলেন বর্ধমান সখা পত্রিকার সম্পাদককে, তাকে পেট পুরে মাংস পরোটা খাইয়ে, এক ঝুড়ি কমলালেবু উপহার দিয়ে অনুরোধ করলেন–এই সংখ্যাতেই লেখাটা ছাপতে হবে।
সম্পাদক কান চুলকে বললে, কিন্তু জায়গা নেই যে। আমরা আট পৃষ্ঠা নিলাম ইস্তাহার–
আমি খরচা দিচ্ছি। বাড়তি কাগজ দিয়ে ছাপুন। একশো দুশো টাকা লাগে দেব।
সম্পাদক খুশি মনে রাজি হয়ে গেল।
গল্প ছাপা হল। দশ কপি কাগজ চলে এল ভজরামের কাছে। ভজরাম নকুলের হাত দিয়ে পাড়ায় বিলি করতে আরম্ভ করলেন। দোলগোবিন্দের জন্যে ভাবনা নেই, তার কাগজ তো ডাকেই যাবে বর্ধমান সখার অফিস থেকে।
ময়ুরের মতো পেট পুরে সাতটা দিন আনন্দে পেখম মেলে কাটালেন ভজরাম। কিন্তু অষ্টম দিনে
অষ্টম দিনে ডাকে এল উকিলের চিঠি এল। মানহানির মকদ্দমার চিঠি।
না, দোলগোবিন্দ পাঠাননি। এসেছে হুগলি থেকে। এক সত্যিকারের গোবিন্দলাল ঢোলের পক্ষ থেকে। আমার মক্কেল শ্ৰীযুক্ত গোবিন্দলাল ঢোল বাঁধাকপির বিখ্যাত ব্যবসায়ী। তিনি অবসর সময়ে কিছু কিছু কাব্য রচনাও করেন। কিন্তু অদ্যাবধি কেহ তাঁহার কবিতাকে অখাদ্য বলে নাই, তাঁহাকে লাঠি লইয়া তাড়া করে নাই, তিনি কখনই চুটুপালুর জঙ্গলে গিয়ে গাছে চড়িয়া কচি পাতা ভোজন করেন নাই। আপনি বর্ধমান সখা পত্রিকায় তাঁহার নামে যে অকারণ নিন্দাবাদ করিয়াছেন, তাঁহাকে বাঁদর এবং অন্যান্য কুৎসিত বিশেষণ দিয়াছেন, সেজন্য কেন আপনার নামে মানহানির মকদ্দমা করা হইবে না ও পঞ্চাশ হাজার টাকার ক্ষতিপূরণ দাবি করা হইবে না, তাহার কারণ দর্শাইবার জন্য–।
কারণ দর্শাইবার আগেই ভজরাম ধপাৎ করে ঘরের মেজেতে বসে পড়লেন। আর সেই মুহূর্তে তাঁর মনে হল তিনি একটি বাঁধাকপি–ঠাসা, নিরেট অতিকায় একটি বাঁধাকপি!
Post a Comment