হুইলচেয়ার – আদনান মুকিত
‘তুমি আবার মেরেছ ওকে?’
উরির প্রশ্নের কোনো উত্তর দিল না নূর। বড় করে একটা শ্বাস নিলেন উরি। তাঁর বড় মেয়েটা জেদি খুব। বাবার আদর পেয়েই এমন হয়েছে, ভাবলেন তিনি। মেঝেতে পড়ে থাকা প্লেট-গ্লাসের দিকে তাকালেন একবার। কড়া গলায় বললেন আবার—
‘নূর! আমি তোমার সঙ্গে কথা বলছি। জবাব দিচ্ছো না কেন?’
মায়ের প্রশ্নে কোনো ভাবান্তর হলো না নূরের। জানালা দিয়ে সামনের বাড়িটার দিকে তাকিয়ে রইল সে। ছাদ ভেঙে গেছে বাড়িটার। ত্রিপল দিয়ে কৃত্রিম ছাদ বানিয়েছেন বাড়ির মালিক। সেই ত্রিপলও ফুটো হয়েছে কয়েক জায়গায়। ত্রিপলের ফুটো দিয়ে গোল হয়ে রোদ ঢুকছে ঘরে। মায়ের প্রশ্নের চেয়ে রোদের খেলা দেখাকেই বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হলো নূরের কাছে। একটু নড়েচড়ে বসল সে। উরি এবার নূরের সামনে এসে বসলেন। বেয়াদবি একদম মেনে নিতে পারেন না তিনি। মেয়ের কাঁধে ঝাঁকি দিয়ে বললেন—
‘কী ব্যাপার, কথা কানে যাচ্ছে না?’
মায়ের দিকে সরাসরি তাকিয়ে ঝাঁজালো কণ্ঠে নূর বলল,
‘না, যাচ্ছে না। এক কানে শুনতে পাই না আমি। ভুলে গেছো সেটা?’
রক্ত উঠে গেল উরির মাথায়। কষে একটা চড় বসিয়ে দিলেন মেয়ের গালে। ‘বেয়াদবের চূড়ান্ত হয়েছিস তুই! বেতমিজ! মায়ের সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হয় ভুলে গেছিস? এক চড় দিয়ে তোর…’
‘দাও না, একটা কেন? যত ইচ্ছা চড় দাও। বাম কানটা তো গেছেই, এবার ডান কানটাই নষ্ট করে দাও মা। তাহলেই ভালো। তোমাদের এই একই কথা আর শুনতে হবে না।’
দমে গেলেন উরি। বুঝলেন মেরে-বকে কাজ লাভ হবে না কোনো। বয়ঃসন্ধি পার করছে নূর। মেজাজটা চড়ে থাকে সব সময়। জোর খাটালে হিতে বিপরীত হতে পারে। মেয়ের মাথায় হাত রাখলেন উরি। ঝট করে হাতটা সরিয়ে দিল নূর। কারও ভালোবাসা দরকার নেই ওর। এ বাড়ির একটা মানুষও বুঝতে পারে না ওকে।
নূরের হাত দুটো ধরলেন উরি। আদুরে গলায় বললেন, ‘কিরে, নখ কাটিস না কেন? আলু ছিলার মেশিনটা ফেলে দেব? তোর নখ দিয়ে আরামে আলু-শসা ছিলে ফেলা যাবে।’
অনেক চেষ্টা করেও হাসি আটকাতে পারল না নূর। মায়ের সঙ্গে বেশিক্ষণ রাগ করে থাকতে পারে না ও। মাঝে মাঝে ওর মনে হয়, জাদু জানে এই মহিলা!
‘কী হয়েছে তোর? শুধু শুধু মারলি কেন ওকে?’
‘খুব জ্বালাচ্ছিল মা।’
‘ছোট ভাই একটু তো বিরক্ত করবেই। তাই বলে এত জোরে মারবি?’
‘মেজাজ ঠিক ছিল না মা। সরি। আসলে ‘বাইরে নিয়ে চল, বাইরে নিয়ে চল’ বলে কানটা ঝালাপালা করে ফেলছিল ও। ওই বদমাশ কুকুরটা নাকি একবারও আসেনি আজ। ওকে নিয়ে খুঁজতে যেতে হবে। আমার আর কাজ নাই? এই ধ্বংসস্তূপের মধ্যে কুকুর খুঁজব? আর বিশাল এই কুকুরটাকে সহ্য হয় না আমার। কতবার বললাম, এ সময়টায় আমি বাইরে যাব না। শুনলই না। শেষে দিলাম এক চড়। ব্যস, চুপচাপ ওই ঘরে গিয়ে বসে রইল।
‘আর মেঝেতে প্লেট ফেলল কে?’
‘আমিই ফেলেছি। খুব খারাপ লাগছিল মা। এভাবে লুকিয়ে থাকতে থাকতে আমার দম আটকে আসছে। কত দিন থাকব এভাবে?’
মেয়ের অবস্থাটা বুঝতে পারলেন উরি। কিন্তু প্রশ্নটা খুব কঠিন তাঁর জন্য। পৃথিবীর বড় বড় জ্ঞানী-ক্ষমতাধর ব্যক্তিই এর কোনো সুরাহা করতে পারছেন না, আর তিনি একজন গৃহবধূ। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘দেশের এই অবস্থায় ধৈর্য ধরা ছাড়া আর কিছু কি করার আছে? ধৈর্য ধর। বাড়ির বড় মেয়ে তুই। ছোট ভাইটাকে তো তুই-ই বড় করলি। ওকে মারিস না আর, ঠিক আছে? ও তো কাউকে কিছু বলে না। কিন্তু ভেতরে-ভেতরে কষ্ট পায় খুব।’
মেয়ের চুলে হাত বুলিয়ে ছেলের খোঁজে গেলেন উরি। এ দুটোকে সামলাতেই সারা দিন চলে গেল তাঁর। অথচ কত কাজ বাকি। অন্ধকার হলেই আবার গোলাগুলি শুরু হয়ে যাবে। তার আগে সব ঠিকঠাক করে না রাখলে বেশ ঝামেলা পোহাতে হবে।
‘আলীইইই…!’ আদুরে গলায় ছেলেকে ডাকতে ডাকতে পাশের ঘরে যেতে লাগলেন উরি। মা চলে যাওয়ামাত্র অপরাধবোধে ভুগতে শুরু করল নূর। মায়ের সঙ্গে এভাবে কথা বলা তার উচিত হয়নি। আলীকে মারাটাও ঠিক হয়নি। বাইরে থেকে ওকে একটু ঘুরিয়ে আনলেই পারত সে। ও তো আর হাঁটতে পারে না।
‘নূর!’ ভয়ার্ত কণ্ঠে ও ঘর থেকে ডেকে উঠলেন উরি। সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গেল নূর। মায়ের চোখমুখে আতঙ্কের ছাপ। সে-ও ভয় পেয়ে গেল।
‘কী হলো?’
‘আলী তো ঘরে নেই।’
‘ঘরে নেই মানে? কী বলো তুমি? যাবে কোথায়?…আলী…আলী…’
‘ডেকে লাভ নেই নূর। ও ক্র্যাচ নিয়ে গেছে।’
হাত-পা অবশ হয়ে এল নূরের। কী ভয়ংকর ব্যাপার! ভয়ে সাদা হয়ে গেল ওর মুখ। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন উরি। ‘কতবার বলেছি ও খুব সেনসিটিভ। সব সময় খেয়াল রাখবি ওর দিকে। তুই এটা কী করলি নূর? ও তো ক্র্যাচ নিয়ে হাঁটতে পারে না ঠিকমতো। বাচ্চা ছেলে…দাঁড়িয়ে আছিস কেন? বাইরে যা, খুঁজে দেখ কোথায় গেছে বাচ্চাটা…’
কান্নায় ভেঙে পড়লেন উরি। ফোঁপাতে লাগল নূরও। মায়ের ভয়ের কারণটা ঠিকই বুঝেছে সে। সন্ধ্যা হতে বেশি বাকি নেই আর। অন্ধকার হয়ে গেলে বাড়ি চিনতে পারবে না আলী। ছয় বছরের ছোট্ট ভাইয়ের খোঁজে বাইরে ছুটে এল সে। উঠানেই রাখা আছে আলীর ছোট্ট হুইলচেয়ারটা। ঢালু পথটা দিয়ে নামতেই মধ্যপ্রাচ্যের গরম বাতাস ঢুকে গেল নাকমুখে। সেই সঙ্গে একরাশ ধুলো। দ্রুত ওড়না দিয়ে মুখ ঢাকল সে। গতকালও শেল পড়েছে আকাশ থেকে। মোড়ের ডান পাশের বাড়িটা গুঁড়ো হয়ে মিশে গেছে ধুলায়। একদিন কি ওদের বাড়িটার এই দশা হবে? কে জানে, হয়তো এত দিনে ধ্বংস হয়ে গেছে ওদের বাড়িটা। হু হু করে কেঁদে উঠল নূর।
এখন যে বাড়িটায় নূররা থাকে, এটা তাদের এক আত্মীয়ের। যুদ্ধে ধ্বংস হচ্ছে একের পর এক শহর। প্রাণ বাঁচাতে সীমান্তের কাছাকাছি এই গ্রামটায় এসেছে ওরা। এখান থেকে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ইউরোপ চলে গেছে নূরদের আত্মীয়রা। শুধু বুড়ো দাদু সাঁতরে পৌঁছাতে পারেননি পাড়ে। ডুবে গেছেন সাগরে। অবশ্য তিনি একা নন, পিঠে বেঁধে রাখা তিন বছরের নাতিটাও গেছে সঙ্গে। দাদুকে ছাড়া থাকতেই পারত না ছেলেটা। পারল না শেষ মুহূর্তেও।
বছরের পর বছর ধরে যুদ্ধটা চলছে। কারণটা জানে না নূর কিংবা ওর বাবা-মাও। কেউই জানে না। ওরা শুধু জানে পালাতে হবে ওদের। যুদ্ধে অনেক কিছু হারিয়েছে ওরা। নূরের বাঁ কানের শ্রবণশক্তি, আলীর দুটো পা, ওদের বাড়ি, অ্যাকুরিয়াম, বাড়ির পেছনের ফুলের বাগান, স্কুল, বাবার অফিস…সব।
আলীর মুখটা ভেসে উঠতেই কান্না বেড়ে গেল নূরের। সঙ্গে ছোটার গতিও। কিন্তু কোন দিকে যেতে পারে তার পিচ্চি ভাইটা? ‘আলীইইই!’ গলা ফাটিয়ে কয়েকবার ডাকল নূর। আশপাশের ভাঙা বাড়িগুলো থেকে তাকাল কয়েকজন। এমন আর্তচিৎকার নতুন কিছু নয় এখানকার মানুষের কাছে। কে জানে, হয়তো তাদের কারও নামও আলী। কিন্তু তার ভাইটা কোথায়? নূর ঠিক করে ফেলল, আর কোনো দিনও আলীর গায়ে হাত তুলবে না সে। কয়েকটা সংগঠন থেকে ঈদের উপহার হিসেবে কিছু খেলনা দিয়েছিল ওদের। আলীকে না দিয়ে লুকিয়ে রেখেছিল সে। এখন মনে হলো, খুব অন্যায় করেছে নূর। আজ আলী ফিরলেই ওকে দিয়ে দেবে খেলনাগুলো।
ছুটতে ছুটতে অনেক দূর চলে এসেছে নূর। ক্র্যাচ নিয়ে কোনোভাবেই এত দূর আসার কথা নয় আলীর। হাঁপাতে হাঁপাতে তিন রাস্তার মাথায় চলে এল নূর। বোমায় উড়ে যাওয়া একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের বেঁচে যাওয়া ছাউনির নিচে বসে পড়ল ধপ করে। কান্না থামাতে পারল না কোনোভাবেই। ওর কারণেই তো এত কিছু। আলীকে না পেলে বাড়ি ফিরে কী করে মুখ দেখাবে মা-বাবাকে?
হঠাৎ পেছন থেকে কে যেন হাত রাখল নূরের মাথায়। চমকে তাকিয়ে দেখল তার বাবা। বাবাকে দেখেই জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল নূর।
সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার বন্দোবস্ত করতে রোজই এদিক-সেদিক ছুটছেন নূরের বাবা বুরহান। মেয়ের কাছে সব শুনে দিশেহারা হয়ে পড়লেন তিনি। মনে পড়ল, কদিন আগে বাড়ি থেকে বেরিয়ে ঘুড়ি ওড়াচ্ছিল একটা ছেলে। শেলের আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল ছেলেটার ঘুড়ি, ছেলেটাও। মাথা থেকে কিছুতেই তাড়াতে পারছেন না সেটা। দ্রুত বাড়ির দিকে ছুটলেন তিনি। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। মনে ক্ষীণ আশা, বাড়ি ফিরেছে তাঁর ছেলে।
মেয়েকে নিয়ে ছুটতে শুরু করলেন বুরহান। নিস্তব্ধ হয়ে গেছে পুরো এলাকা। ঘুটঘুটে অন্ধকার। অন্ধকারে পঙ্গু ছেলেটা কোথায় আছে কে জানে। অনেক কষ্টে কান্না চাপালেন তিনি। নিজেকে এক ব্যর্থ বাবা মনে হলো তাঁর। কিছুই করতে পারলেন না ছেলেমেয়েদের জন্য।
‘বাবা, থামো!’ মেয়ের কথায় হুঁশ ফিরল বুরহানের। থামলেন তিনি। রুটি নিয়ে ছুটছে একটা ছেলে। আলীরই বয়সী, মাঝে মাঝে একসঙ্গে খেলে ওরা। ওর কাছে কোনো খবর থাকতে পারে ভেবে ছেলেটাকে ডাকল নূর।
‘আলীকে খুঁজে পাচ্ছি না সামি। ওকে দেখেছ?’
মাথা নাড়ল ছেলেটা—দেখেনি। আবার বাড়ির দিকে ছুটল বাবা-মেয়ে। ‘তবে, তোমাদের কুকুরটাকে দেখেছি। বাড়ির দিকে গেছে।’ পেছন থেকে বলল ছেলেটা।
‘ঠিক দেখেছ?’
কথাটা যেন খুব গায়ে লাগল সামির। ‘আমার চোখ একটা, কিন্তু ওটা দিয়ে আমি কখনো ভুল দেখি না।’ বলেই উল্টো দিকে দৌড় দিল ছেলেটা।
অস্বস্তিতে পড়ে গেল নূর। কথাটা ওভাবে বলবে সামি ভাবতে পারেনি সে। বোমার স্প্লিন্টার লেগে একটা চোখ অন্ধ হয়ে গেছে সামির। দৃষ্টিশক্তি নিয়ে কিছু বললেই ভীষণ খেপে যায় ও। কিন্তু ওকে আঘাত দিয়ে কিছু বলতে চায়নি নূর। এ নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় না এটা। ‘কুকুরটা যেহেতু এসেছে, তার মানে আলীও এসেছে বাবা। ও তো কুকুরটাকেই খুঁজতে গিয়েছিল।’ বাবার দিকে তাকিয়ে বলল সে।
‘তাই যেন হয়।’ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন বুরহানও। দেশের শিশুদের এমনই অবস্থা এখন। কারও হাত নেই, কেউ অন্ধ, কেউ পা হারিয়েছে তাঁর আলীর মতো। কবে যুদ্ধ থামবে আর কবে এদের চিকিৎসা হবে কে জানে। আলী কি আবার হাঁটতে পারবে? কানটা কি ঠিক হবে নূরের?
হুইলচেয়ার
অলংকরণ: বিপ্লব চক্রবর্তী
বাড়ির কাছাকাছি এসেই আলীর নাম ধরে ছুটল নূর। উঠানে বসে থাকা কুকুরটাকে এড়িয়ে ভেতরে ঢুকল সে। ভাইকে ডাকল কয়েকবার। কোনো সাড়া নেই। বিছানায় বসে আছে তার মা। কাঁদছেন অনবরত।
‘কোথাও খুঁজে পেলি না ওকে?’
কোনো জবাব দিতে পারল না নূর। বাইরে চলে এল। সব রাগ গিয়ে পড়ল কুকুরটার ওপর। এখানে আসার পর আলীর পোষ মেনে গিয়েছিল ও। কিন্তু শুরু থেকেই কেমন যেন অশুভ লাগত নূরের। একটা লাঠি কুড়িয়ে নিয়ে কুকুরটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল নূর। ওকে দেখেই লেজ নাড়তে শুরু করল কুকুরটা। নূরের পাজামার একটা অংশ কামড়ে ধরল কয়েক মুহূর্ত। তারপর ঘেউ ঘেউ করে ছুটে গেল সামনে। বেশ কয়েকবার একই কাজ করল বোবা প্রাণীটা। বুরহান বললেন, ‘কিছু একটা বোঝাতে চাইছে ওটা।’
‘বাড়িতে এসে আমার সঙ্গেও এমন করেছে।’ ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন উরি।
‘এমন কি হতে পারে, ও জানে আলী কোথায়? ওর সঙ্গে যাব?’ লাঠিটা ফেলে বলল নূর।
‘না না। কোনো দরকার নেই।’ বাধা দিলেন বুরহান।
ঠিক এমন সময় সাইরেন বেজে উঠল এলাকাজুড়ে। শব্দটা খুব চেনা ওদের। বোমা পড়বে কিছুক্ষণের মধ্যেই। কোথায় তা কেউ জানে না। আতঙ্কে পাথর হয়ে গেল পুরো পরিবার।
‘টর্চটা নিয়ে এসো উরি! এক্ষুনি!’
কুকুরটার পেছন পেছন ছুটছে ওরা। বুরহানের হাতে টর্চ। কুকুরটার সঙ্গে পাল্লা দিতে কষ্ট হচ্ছে তাদের। ঢালু পথটা সাবধানে পার হতেই গোলাগুলি শুরু হলো। গুলির প্রচণ্ড শব্দ ছাপিয়ে শোনা গেল উরি আর নূরের কান্না। হতভম্ব হয়ে গেলেন বুরহান। ওদের দুজনকে কতবার নিষেধ করলেন, শুনল না। এখন কী হবে? সবাই মারা পড়বে এবার।
‘হায় খোদা! কুকুরটা তো কবরস্থানের দিকে যাচ্ছে!’ চিৎকার করে উঠলেন উরি।
‘আলী!’ কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে বসে পড়ল নূর। ওকে টেনে ওঠালেন উরি। পুরো এলাকা আলোকিত করে খুব কাছে কোথাও বোমা পড়ল। কানে তালা লেগে গেল ওদের। সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে শুয়ে পড়ল ওরা। নূরের ওপর শুয়ে পড়লেন উরি। অনবরত চিৎকার করছে কুকুরটা। আবার এগোল ওরা। সত্যি সত্যি ওদের কবরস্থানে নিয়ে এল কুকুরটা। ভেতরে ঢুকেই মাথায় হাত দিয়ে কাঁদতে লাগলেন উরি। তিনি বুঝে গেছেন, মারা গেছে তাঁর ছেলে। একেবারে শেষ মাথায় একটা সদ্য খোঁড়া কবরের কাছে এসে দাঁড়াল কুকুরটা। এখনো মাটি ফেলা হয়নি কবরে। কবরটার একেবারে ধারে গিয়ে চিৎকার করল কুকুরটা।
‘জুজু!’ ভেতর থেকে ডাকল কেউ। কুকুরটাকে তো এই নামেই ডাকে আলী। সঙ্গে সঙ্গে লাফ দিয়ে নেমে গেলেন বুরহান। ছেলের কণ্ঠ চিনতে একটুও ভুল হয়নি তাঁর। চিৎকার করে ডাকলেন স্ত্রী আর মেয়েকে। ভেতরে নেমে গেল তারাও। মাটির দেয়ালে হেলান দিয়ে চুপচাপ বসে আছে আলী। ভয়ে রক্তশূন্য হয়ে গেছে মুখ।
‘তুই এখানে এলি কী করে?’ ছেলেকে জড়িয়ে ধরে বললেন উরি।
‘জুজুর পেছন পেছন চলে এসেছি। হঠাৎ পড়ে গেলাম।’ কাঁদতে কাঁদতে বলল আলী। এমন সময় বিকট শব্দে বোমা পড়তে লাগল। একের পর এক। শক্ত করে আলীর একটা হাত ধরল নূর। অন্য হাতটা দিয়ে ধরল মাকে।
ওদের দিকে খেয়ালই নেই বুরহানের। তিনি এতক্ষণে টের পেলেন এটা আসলে কবর নয়। বোমা থেকে বাঁচতে পরিখা খুঁড়েছে কেউ। ভেতরে এক পাশে ঢাকনার মতো আছে, টেনে দিলেই নিশ্চিন্তে লুকিয়ে থাকা যাবে। ঢাকনটা টেনে দিলেন বুরহান। একটু ফাঁকা রাখতে হলো বাতাস চলাচলের জন্য। তবু গরমে সেদ্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। টর্চের আলোয় দেখলেন ঢাকনার গায়েই প্রয়োজনীয় বেশ কিছু জিনিসপত্র। শুকনো খাবারও আছে। বোঝাই যাচ্ছে, খুব ভেবেচিন্তে পরিখাটা খুঁড়েছে কেউ। হয়তো লুকানোর সুযোগটা পায়নি আজ। কে জানে, হয়তো মারাই গেছে লোকটা। যুদ্ধ সব সময়ই নিষ্ঠুর। একজনের মৃত্যু সুযোগ করে দেয় আরেকজনকে। আজ সুযোগ পেয়েছে ওরা। গোলাগুলি আর বোমার প্রচণ্ড শব্দের মধ্যেই কীভাবে যেন ঘুমিয়ে পড়েছে নূর-আলী। বুরহান আর উরি জেগে রইলেন চুপচাপ। আরও একটি নির্ঘুম রাত তাঁদের জীবনে।
গোলাগুলি থেমেছে মাঝরাতে। ভোরের দিকে বাইরে বেরিয়ে এল ওরা। আলো ফোটেনি পুরোপুরি। কেমন আধখানা একটা সূর্য উঠেছে। নূরের মনে হলো বোমা মেরে কেউ উড়িয়ে দিয়েছে সূর্যের অর্ধেকটা। বাতাসে বারুদের দম আটকানো গন্ধ। ‘বাড়ি চলো এবার।’ আলীকে কোলে নিয়ে বললেন বুরহান। কুকুরটাকে কোথাও দেখা গেল না। ‘জুজু!’ চিৎকার করে ডাকল আলী। সাড়া এল না কোনো। ‘ও ঠিকই বাড়ি চলে আসবে আবার।’ ক্র্যাচ দুটো হাতে নিতে নিতে বললেন উরি। বাড়ির দিকে এগোল বিধ্বস্ত পরিবারটি।
বাড়ির কাছাকাছি ঢালু পথটার মুখে আসতেই চমকে উঠল সবাই। ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে এখান থেকেই। হাসপাতালটা পুড়ে গেছে? ইশ্! শিউরে উঠল ওরা।
‘ওটা কী?’ সামনে পড়ে থাকা কিছু একটার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করল আলী। ‘ওটা তো আমার হুইলচেয়ার!’ দ্রুত সেদিকে ছুটে গেল নূর। সত্যিই তো। হুইলচেয়ারটা এখানে এল কী করে? নিশ্চয়ই কেউ ঢালে ফেলে দিয়েছে এটাকে! এখন আবার টেনে তুলতে হবে। ক্লান্ত পায়ে ঢাল বেয়ে উঠেই হতভম্ব হয়ে গেল ওরা।
‘জুজু! চিৎকার করে কেঁদে উঠল আলী। সঙ্গে সঙ্গে হাত দিয়ে ওর চোখ ঢেকে দিলেন বুরহান। সামনে ক্ষতবিক্ষত হয়ে নিথর পড়ে আছে কুকুরটা, আলীর জুজু। এই দৃশ্য তিনি ছেলেকে দেখতে দেবেন না। ‘বাড়ি চলো সবাই।’ চিৎকার করে আদেশ দিলেন তিনি। নড়ল না কেউ। ‘কিসের বাড়ি?’ পেছন থেকে শীতল কণ্ঠে বললেন উরি।
একবার স্ত্রীর দিকে তাকালেন বুরহান। হাত-পা ছড়িয়ে মাটিতে বসে আছেন উরি। চোখে পানি।
‘মানে?’ স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করেই থেমে গেলেন বুরহান। স্ত্রীর শূন্য দৃষ্টি অনুসরণ করে দেখলেন, তাঁদের বাড়িটা এখন অতীত। ধোঁয়ার উৎস আসলে ওটাই। কয়েকটা পিলার ছাড়া আর কিছু অবশিষ্ট নেই সেখানে। ধপ করে মাটিতে বসে পড়লেন বুরহান। কোল থেকে নেমে হামাগুড়ি দিয়ে আলী চলে গেল জুজুর কাছে, খেয়ালও করল না কেউ।
‘কুকুরটা আগেই টের পেয়েছিল এমন কিছু হবে। ও-ই ঠেলে সরিয়েছে হুইলচেয়ারটা। একেবারে শেষ পর্যন্ত…আর কিছু না পারুক, মনিবের সবচেয়ে দরকারি জিনিসটাকে ঠিকই বাঁচিয়েছে ও।’ কাঁদতে কাঁদতে বললেন উরি। ‘আমাদের সবাইকে নিরাপদে রেখে নিজে মরে গেল! তুমি ওদের বিচার কোরো খোদা! বিচার কোরো।’
‘ওরা সবাইকে মারবে। কেউ বাঁচবে না।’ বুক চাপড়ে কেঁদে উঠলেন বুরহান। ‘একদিন আমাদেরও মারবে এই কুকুরের মতো।’
‘জুজু কিন্তু বীরের মতোই মরেছে বাবা।’ এতক্ষণে মুখ খুলল নূর। কান্না সামলে বলল, ‘মরলে বীরের মতোই মরব।’ আলীকে কোলে তুলে নিল সে। ‘এখানে বসে থেকে লাভ নেই বাবা। চলো এগোই।’
‘কোথায়?’
‘জানি না।’
মেয়ের মাঝে অদ্ভুত একটা শক্তি খুঁজে পেলেন উরি-বুরহান দম্পতি। উঠে দাঁড়ালেন দুজনই। আলীর ক্র্যাচ দুটো হাতে নিলেন উরি। হুইলচেয়ারটা সামনে বাড়ালেন বুরহান। সবার সামনে এগোচ্ছে নূর। বোনের কোলে বসে পেছনের দিকে তাকিয়ে আছে আলী। পেছনে ধুলায় পড়ে আছে ওর বন্ধু জুজু।
Post a Comment