ডাস্ক – হেক্টর হাগ মুনরো

ডাস্ক – হেক্টর হাগ মুনরো
নর্মান গর্টসবি পার্কে এসে বসল। বেঞ্চখানার পিছনেই যা-একটু সবুজের অস্তিত্ব, খানিকটা ঘাসের জমিতে রঙবেরঙ ঝোপঝাড় এক লাইন। সম্মুখে সুরকি-বিছানো চওড়া পথ, তাতে হরেক রকম গাড়ির নিরবচ্ছিন্ন চলাচল। রাস্তার পরেই লোহার বেড়া।

নর্মান লোকটি গোড়ায় মন্দ ছিল না। জীবনযুদ্ধে আরও একটু সাফল্য যদি বরাতে জুটত তার, রীতিমত মানবদরদী হতে পারত সে। জোটে নি তেমন সাফল্য। পয়সার অভাব তার হয় নি কোনদিন, তা সত্য। কিন্তু একটাও উচ্চাশা পূর্ণ হয় নি জীবনে, তার চেয়ে নীচু পর্যায়ের সহকর্মীরা একে একে তাকে ছাড়িয়ে গিয়েছে ধনে, মানে ও প্রতিষ্ঠায়। ফলে সে হয়ে পড়েছে কতকটা নৈরাশ্যবাদী, কতকটা-বা সন্দিগ্ধচেতা।

কোন লোকেরই ভিতরে ভাল-কিছু সে সহজে দেখতে চায় না। সততার অকাট্য প্রমাণ, না পাওয়া যায় যতক্ষণ, প্রত্যেকটা জীবকেই ততক্ষণ সে অসৎ বিবেচনা করে। কিন্তু সে প্রমাণ আসুক একবার, তক্ষুণি নর্মান তৎপর হয়ে উঠবে আগেকার বিরোধী মনোভাবের যথোচিত প্রায়শ্চিত্ত করবার জন্য। প্রয়োজনের চাইতে অনেক বেশী সমাদর করবে অবহেলিত জীবটাকে, আপনাকে উজাড় করে দেবে তার সত্যিকার এবং কাল্পনিক সবকিছু অভাব মোচন করবার জন্য।

তার জন্যও হয়ত পরে একসময়ে অনুতাপ করতে হবে তাকে। হয়েছে এমন কয়েকবার, কিন্তু তাতে সে দমে নি। একবারের তিক্ত অভিজ্ঞতাকে পরের বার পাথর চাপা দিতে দেয় নি উৎসাহের উৎসমুখে।

বেঞ্চিখানা খালিই ছিল দৈবাৎ। মানে, বিকালের বায়ুসেবনার্থীরা আকণ্ঠ বায়ু গিলে এখন যার যেমন রুচি, হয় ফ্লাটবাড়ির খুপরিতে, নয়ত সিনেমা-হোটেলের হলঘরে ঢুকেছে। সন্ধ্যা হয়েছে, বাতি জ্বলেছে, এমন সময়ে পার্কের জনপ্রবাহে ভাটির টান লাগবারই কথা।।

জীবনে যাদের চাঞ্চল্য আছে, উদ্দীপনা আছে, কর্মব্যস্ত বা প্রমোদসন্ধানী যারা, তারা চলে গিয়েছে পার্ক থেকে। এখন পড়ে আছে তারাই শুধু, কাজের বা অকাজের কোন আকর্ষণই যাদের নেই, জীবন যাদের বদ্ধ-জলার মত নিস্তরঙ্গ নিশ্চল, সময় কাটানোর সমস্যাই যাদের সবচেয়ে গুরুতর দৈনন্দিন সমস্যা। এমন লোকের সংখ্যা কম। হোক কম-তারাও সবাই যে বেঞ্চেই বসে আছে, তাও নয়। বেঞ্চের কাঠ শক্ত, গাছতলার ঘাস নরম। তাতে বসা আরামের জিনিস, শোয়া আরও আরামের। দূরে দূরে অস্পষ্ট মূর্তি-ঐ তাদের দেখা যায়–দুটো একটা, দুটো একটা-পাঁচ জন একসাথে বসে আড্ডাবাজি করবে, এতখানি উৎসাহও নেই তাদের।

নতুন কেউ আর পার্কে ঢুকছে না তেমন। কিন্তু একজন এল—এক বুড়ো।

বয়সে বুড়ো, তাতে সন্দেহ নেই, কারণ টুপি খুলতেই সাদা চুল বেরিয়ে পড়ল একমাথা। বুড়ো, কিন্তু অথর্ব-নয়। বেশ জোর কদমে এসে বেঞ্চিতে বসল। নর্মানের বেঞ্চিরই অন্য প্রান্তে।

“এই সওদাগুলো – কচুপোড়া খেলে যা—-” বিরক্তভাবে এই কথা বলে ছোট ছোট কয়েকটা কাগজে-মোড়া প্যাকেট বুড়ো কোটের পকেট থেকে টেনে টেনে বার করল, বেঞ্চের উপরে সেগুলি ছড়িয়ে রেখে আরাম করে বসল, এক হাঁটুর উপরে আর এক হাঁটু তুলে। মাথা তার পিছনে হেলে পড়ল, দুই হাত গিয়ে জোড় বাঁধল সেই মাথার পিছনে, বুড়োর দু’চক্ষু বুজে এল আয়েসে।

নর্মান গর্টসবির কোন-একটা শক্তি যদি বেশী চোখা থেকে থাকে অন্য সব শক্তির চেয়ে, তবে সেটা হল পর্যবেক্ষণের। বুড়ো তার দৃষ্টিসীমার ভিতরে এসে ঢুকবার পর থেকেই সে তার প্রতিটা ভাবভঙ্গী লক্ষ্য করে যাচ্ছে হুঁশিয়ার গোয়েন্দার মত, যদিও ভালই জানে সে নিজের মনে মনে যে এ-হুঁশিয়ারিটা একান্তই নিষ্প্রয়োজন, স্রেফ বেনুবনে মুক্তো ছড়ানো। কী করা যাবে, ওটা তার স্বভাব। বুড়ো চোখ বুজে আছে, নর্মান তার দিকে তাকিয়ে আছে, হঠাৎ বুড়ো আড়ামোড়া ভেঙে উঠে বসল, দুই হাত মাথার পিছন থেকে সমুখে এনে তাদের নিয়োজিত করল ইতস্ততঃ ছড়ানো প্যাকেটগুলো গুছিয়ে পকেটে তুলবার জন্য, তারপরে কোনদিকে একবারও না তাকিয়ে সোজা উঠে বেরিয়ে গেল পার্ক থেকে, যেদিক দিয়ে এসেছিল, তার উলটো দিকের পথ ধরে। জোর কদমেই গেল, চালচলন তার মোটেই অথর্বের মত নয়।

বুড়ো বেঞ্চির মায়া কাটিয়ে চলে যাওয়ার পরে দুটো মিনিটও হয় নি নিশ্চয়, আর-একটা লোক মাথা নাড়তে নাড়তে, দুই হাত শূন্যে এলোমেলো ভাবে ছুড়তে ছুড়তে এসেই ধপাস্ করে বসে পড়ল ঠিক বুড়োর পরিত্যক্ত জায়গাটিতেই, আর হতাশভাবে, তিক্তস্বরে, ক্রুদ্ধকণ্ঠে বেশ জোর গলায় বলে উঠল—“কী গেরো! কী মুশকিল! আরে ছি ছি ছি—”

নর্মানের ধারণা হল বিরক্তির এই আতিশয্য-প্রকাশ—এটা একান্তই একটা অভিনয় শুধু। আর এ-অভিনয় তাকেই অর্থাৎ নর্মান গর্টসবিকেই দেখানো উদ্দেশ্য এই লোকটার। তার স্বভাবই অজানা লোককে সন্দেহের চোখে দেখা, এর অস্বাভাবিক হাবভাব দেখে একটা ঘোরর সন্দেহই এলো তার মনে।।

তবে এ লোকটা আর তার করবে কী? নর্মান রীতিমত পোড়-খাওয়া মানুষ, অনেক জোচ্চোরই সে চরিয়ে এসেছে এযাবৎ। নিজের মনকে সে ইশারায় বলল—“হুশিয়ার!” আর সঙ্গে সঙ্গেই মিষ্টি গলায় সম্বোধন করল তারই অর্ধাসনের অধিকারীকে—‘মশাইকে বড়ই উত্তেজিত মনে হচ্ছে—”

লোকটা বসে বসেই হাঁসফাঁস করছে যেন, ঠিক যেমনটা করে মানুষে জলে ডুবতে ডুবতে।

“উ-উত্তেজিত? তা বলতে পারেন। উত্তেজনার আর দোষ কী? এমন একটা অবস্থায় আমি ফেলেছি নিজেকে নিজেরই আহাম্মকির দরুন—ছিঃ ছিঃ ছিঃ—রাতটা আমায় টেমস নদীর বাঁধের উপরে কাটাতে হবে দেখছি—।”

“ভারি মুশকিল সত্যি”—নর্মান তাকে সহানুভূতি জানাচ্ছে, না ঠাট্টা করছে—অন্য পক্ষের তা বোঝা দুঃসাধ্য ছিল রীতিমত। কিন্তু সেইটিই যে সর্বাগ্রে তার বোঝা দরকার, এমন ভাবভঙ্গী সে-পক্ষ থেকেও পেলো না কিছু। সে হা-হুতাশের ফাকে ফাকে নিজের গল্পটাই বলে চলল কখনো করুণ, কখনো বীভৎস রসের অবতারণা করে। সে-গল্পের প্রতিক্রিয়ায় ঝানু শ্রোতাটির মনে যে হাস্যরস ছাড়া অন্যকিছুর সৃষ্টি হচ্ছে না, তা সে আনাড়ী বেচারী বুঝবে কেমন করে?

গল্পটা তার এইরকম—-

আজই দুপুরে সে ম্যাঞ্চেস্টার অঞ্চল থেকে লণ্ডনে এসেছে। প্যাডিংটন হোটেলে সে দুই একবার বাস করে গিয়েছে ইতিপূর্বে, এবারেও সেইখানেই ওঠার পরিকল্পনা ছিল। ট্যাক্সি করে সেইখানেই গিয়েছিল, গিয়ে দেখে—হায় ঈশ্বর!-গিয়ে দেখে হোটেলের টিকিটিও নেই, সেটা ভেঙে ফেলে কারা যেন সিনেমাহল গড়ছে সেখানে—

মরুক গে! লণ্ডন শহরে হোটেলের আকাল পড়ে নি, সে ট্যাক্সিওয়ালাকে বলল অন্য কোন ভাল হোটেলে তাকে নিয়ে যেতে। ট্যাক্সিওয়ালা অনেক রাস্তা ঘুরিয়ে তাকে পৌঁছে দিল আর এক আশ্রয়ে। তা হোটেলটার ব্যবস্থা ভাল, ঘরখানাও সে পেয়েছিল পছন্দমতই।।

লগেজপত্র খুলে সে সবকিছু যথাস্থানে সাজিয়ে গুছিয়ে নিয়ে বসেছে, এমন সময় তার খেয়াল হল বাড়ি থেকে সাবান আনা হয় নি। হোটেলে অবশ্য সাবান ওরা সরবরাহ করে থাকে, কিন্তু ঐ এক কেমন খুঁতখুঁতে স্বভাব তার, অন্যের ব্যবহার করা সাবান যে কোনমতেই গায়ে ছোঁয়াতে পারে না। সে সাবান কিনতে বেরুলো।

কিনলও সাবান। তারপর গিয়ে ঢুকল এক রেস্তোরাঁতে কিছু খেয়ে নেওয়ার জন্য। বেশ কিছুক্ষণ সেখানে কাটিয়ে সে বেরুলো যখন, ডানদিকের বড় রাস্তাটাই মনে হল তার হোটেলের রাস্তা।। ঢুকল তাতে, হাঁটতে লাগল—

নাঃ, এতক্ষণ ধরে হাঁটার কথা নয়। রাস্তা ভুল হয়নি তো?

এই মরেছে! ভুলই হয়েছে নিঃসন্দেহে, জিজ্ঞাসা করে জানা গেল আধ মাইলের ভিতর এ রাস্তায় একটাও হোটেল নেই–

সবচেয়ে মারাত্মক ব্যাপার হল এই—নিজের হোটেলের নাম সে বলতে পারছে না। ট্যাক্সিওয়ালা তাকে বলে নি, দরোজায় সাইনবোর্ড ছিল কি না সে লক্ষ্য করে নি ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলার সময়, হোটেলের নাম সে জিজ্ঞাসা করে নি, অগ্রিম যেটা সে জমা রাখল হোটেলে, তার দরুন রসিদও সে পায় নি সাথে সাথে। আগাগোড়াই এমন একটা কাণ্ড সে করে গিয়েছে যা পাড়াগেঁয়ে ভূতেরাই করে, করে তারাই যাদের বত্রিশ পুরুষ সবাই গাড়োল (বোকা)।

হতাশায়, আত্মধিক্কারে ছোকরা দুই হাত দিয়ে নিজেরই দুই গালে ঠাস ঠাস করে চড়াতে লাগল।

ঠোটের কোণের হাসিটা রুমালে চাপা দিয়ে নির্লিপ্তভাবে নর্মান বলল—“অনেকক্ষণ ছুটোছুটি করছেন তাহলে—-”

“তা ঘণ্টা চার হল বইকি! কখনও এদিকে, কখনও ঠিক তার উলটো দিকে। অন্ততঃ বারো চোদ্দ মাইল যে দুরমুশ করেছি এই দুখানি শ্রীচরণ দিয়ে, তাতে কোন ভুল নেই। পাগল হয়ে গেছি মশাই, পাগল হয়ে গেছি রাত হল–জামাকাপড় বিছানাপত্তর পয়সাকড়ি সব রইল কোন্ তেপান্তর মাঠের অচিন পুরীতে তার ঠিক নেই-পকেটে তহবিল দুই পেনী—নোটের বাণ্ডিল সেই হোটেলের ঘরে সুটকেসে পড়ে আছে, জামার পকেটে যা ছিল তাই নিয়েই বেরিয়েছিলাম ত! তা থেকে সাবান কিনেছি, রেস্তোরাঁয় তৃপ্তি করে খেয়েছি—এখন সম্বল এই দুই পেনী—”

হঠাৎ একত্সময়ে বিলাপ থামিয়ে ছোকরা সোজাসুজি তাকাল নর্মানের দিকে, প্রায় রুক্ষস্বরে জিজ্ঞাসা করল-“আমার সব কথাই আপনার কাছে খুব অসম্ভব মনে হচ্ছে, না?”

জোরে জোরে মাথা নাড়ল নর্মান—“মোটেই না। অসম্ভব কেন হবে? যে-কোন লোকেরই এমনটা হতে পারে যে-কোন দিন। আমার নিজেরই হয়েছিল, সে মশাই এখানে না, বিদেশের এক শহরে। তা, আমার একটা সুবিধে ছিল, হোটেলের নীচেই একটা খাল বইছে এটা লক্ষ্য করেছিলাম এবং মনে রেখেছিলাম। খালটা খুঁজে বার করা কঠিন হয় নি, কারণ সে-শহরে একটাই খাল—ধার দিয়ে একবার উজানে, একবার ভাটিতে হাঁটতে হাঁটতে—”

“বিদেশে পথ ভুললে এত বিপদ হয় না মশাই” কথার মাঝখানে ঝাঁপিয়ে পড়ল ছোকরা—“সোজা চলে যান ব্রিটিশ কনসালের আফিসে–তারা একটা ব্যবস্থা করে দেবেই। কিন্তু এখানে? একমাত্র সাহায্য পেতে পারেন স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডে–তা সে ত অনেকদিন ধরে অনেকখানি কাঠ-খড়-পোড়ানোর ব্যাপার! এদিকে রাত গভীর হয়ে আসে, এ রাত তো আমায় স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে কাটাতে দেবে না”

“তা বটে” নির্লিপ্ত কণ্ঠের মন্তব্য নর্মানের দিক থেকে।

ছোকরা নিজেই নিজের মুশকিল আসানের ইঙ্গিত দেয়—“একমাত্র উপায় যা হতে পারে আমার তা হল এমন কোন সহৃদয় সজ্জনকে খুঁজে বার করা যিনি আমার বিবরণটা সত্যি সত্যি বিশ্বাস করবেন—-”

“অনেকেই করবেন”–তৃতীয় দফায় নির্লিপ্ত উত্তর নর্মানের–“আমিই ত করেছি”।

“ওঃ, করেছেন?” এক লাফে যেন আকাশ হাতে পেলো ছোকরা-তারপরই, এই বিশ্বাস করার অনুগ্রহেই যেন সে বিগলিত হয়ে গেল কৃতজ্ঞতায়-“বিশ্বাস করেছেন? আমি ভাবি নি যে প্রথম যে-ভদ্রলোকটির কাছে আমার দুর্ভাগ্যের ইতিহাস বলব, তিনিই আন্তরিকভাবে তা বিশ্বাস করবেন”

“বিশ্বাসটা আরও দৃঢ় হতে পারত মশাই”-চতুর্থ দফায় সেই নির্লিপ্ত কণ্ঠের জবাব—“সেই সাবানখানা যদি আমায় দেখাতে পারতেন একবারটি—-যা কিনতে বেরিয়ে আপনার এই দুর্বিপাক-”।

বিদ্যুৎস্পৃষ্টর মত লাফিয়ে উঠল ছোকরা বেঞ্চি থেকে, আর হাত ঢুকিয়ে দিল পকেটে। তার পরেই সে এক বিস্ময়, নৈরাশ্য এবং হতভম্ব ভাব-একের পরে এক, চমকের পরে চমক সিনেমা-পর্দায় ছবির পরে ছবির মত ফুটছে আর মিলিয়ে যাচ্ছে তার মুখে।

এ-পকেট থেকে সে-পকেট, বাইরের পকেট থেকে ভেতরের পকেট, কোটের পকেট থেকে প্যান্টের পকেট—একে একে সব হাতড়ে শূন্য হাত দিয়ে কপালে এক প্রচণ্ড কিল মেরে ছোকরা বলল—“হারিয়েছি—”

নর্মান বলল-“একই অপরাহ্নে হোটেল হারানো এবং সাবান হারানো–দুটোর কথা শুনে কেউ যদি ভাবে যে হারানোগুলো আপনার ইচ্ছাকৃত-”

কথা শেষ হওয়ার আগেই ছোকরা তীরবেগে ছুটে বেরিয়ে গেল, নর্মানের সম্মুখ থেকে, পার্কের ভিতর থেকে কোথায় যাবে আর? হয়ত টেমস (নদী)-এর বাঁধে, নয়ত নাইটসব্রিজের ভিড়ে। পকেটমারদের খেল ঐ দুই জায়গাতেই জমে ভাল। ছোকরা গল্পটা বানিয়েছিল ভাল, অভিনয়ও করেছে চমৎকার! শুধু একটু দূরদৃষ্টি থাকত যদি! একখানা সাবান যদি আগেভাগে কিনে পকেটে রাখত! সতর্কতাই ত ওদের ব্যবসার মূলধন!

নর্মানও উঠল–রাত হয়ে যাচ্ছে–

এটা কি? বেঞ্চের তলায়?—বুকের ভিতর ধুক করে উঠল নর্মানের। মাথা নুইয়ে কুড়িয়ে নিতে এক সেকেণ্ড। দ্বিতীয় সেকেণ্ডেই সে দৌড় শুরু করেছে। যেদিকে ছুটেছিল সেই ছোকরা সেই দিকে। নর্মান যা কুড়িয়ে পেয়েছে, তা একখানা সাবান, সদ্য কেনা দোকান থেকে, কাগজের প্যাকেট অটুট এখনো।।

“ওহে! ও ছোরা! ও মশাই!” –

ছোকরা নাইটব্রিজের ফুটপাথের কিনারায় দাঁড়িয়ে। এক্ষুণি বোধহয় রাস্তা পেরিয়ে যাবে।

“ও মশাই! শুনুন, ও মশাই!” ভূত দেখার মত চমকে উঠল ছোকরা নর্মানকে দৌড়ে আসতে দেখে। নর্মান বলল-“সাবানটা নিন। আপনি যখন হাত ছুড়তে ছুড়তে এসে বেঞ্চিতে বসেছিলেন, সেই সময়ই পড়ে গিয়েছিল বোধ হয়। আর এই নিন আমার কার্ড, আর এই নিন একটা পাউণ্ড। এই হপ্তার ভিতর যে কোনদিন পাউণ্ডটা পাঠিয়ে দিলেই হবে। ঠিকানা ঐ কার্ডে—”

ছোকরা ঢোঁক গিলল, দুই-একটা ধন্যবাদের কথাই বুঝি বলতে গেল, কিন্তু গলা দিয়ে স্বর ফুটল না, হঠাৎ ফুটপাথ থেকে নেমে সে রাস্তা পেরিয়ে চলে গেল।

পরম পরিতৃপ্তিতে ভরে গিয়েছে নর্মানের অন্তর। একটা অবিচার হতে যাচ্ছিল। একটা ঘোরতর অন্যায় সে করতে যাচ্ছিল। তার এই সদাসন্দিগ্ধ মনই যত কু-ধারণার গোড়া। ঈশ্বর রক্ষা করেছেন নর্মানকে।

রাত হল অনেক, নিজের ডেরায় এবার ফিরবে সে। সেই বেঞ্চিটার পাশ দিয়েই যেতে হবে, ঐ পথই সোজা পথ।

বেঞ্চির কাছে কে-একজন ঘুরঘুর করছে না? কখনো কাত হয়ে, কখনো মাথা নিচু হয়ে, কখনো বেঞ্চির পিছনে, কখনো বেঞ্চির তলায় কী যেন খুঁজছে। নর্মান যখন একেবারে কাছে এসে পড়েছে, লোকটি মাথা তুলল তখন। নর্মান চিনল, এ সেই বুড়ো, যে ছিল নর্মানের প্রথমে ঐ বেঞ্চিতে বসেছিল।

“কিছু হারিয়েছেন নাকি?”—জিজ্ঞাসা করল নর্মান।

“একখানা সাবান মশাই! এই সাঁঝের বেলাই কিনেছিলাম-”।

No comments