অফিস – তারাপদ রায়
আমার অফিসে ঢুকবার তিনদিনের মধ্যে বন্ধু এসে বড়বাবুকে অনুরোধ করেছিলেন টেবিল সরায়ে পিকক ড্যান্স নাচবার জায়গার বন্দোবস্ত করার জন্যে। তবুও আমার চাকরি যায়নি।
অবশ্য এ চাকরি যদি যাওয়ার হত তবে অনেক আগেই যেতে পারত, যেদিন যোগদান করেছিলাম কাজে সেইদিনই যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা যায়নি।
এর আগে মফস্বলে কাজ করতাম এক শিক্ষায়তনে। সেখান থেকে কিছুতেই ছেড়ে দিচ্ছিল না। আমার এ অফিস যত তাগাদা দেয় আমাকে তাড়াতাড়ি কাজে যোগদান করার জন্যে, আমার পুরনো শিক্ষায়তন ততই আটকিয়ে দেয়। অবশেষে দুই প্রান্তে যথেষ্ট দৌড়াদৌড়ি করে একটা দিন কোনওরকমে স্থির করা গেল।
এ অফিসে বলে গেলাম, ‘আমি তা হলে অমুক তারিখে আসছি, তবে আসতে একটু দেরি হবে। আর সেখানে আমার প্রভিডেন্ট ফান্ডে কিছু টাকা জমে রয়েছে যদি আসার দিন না নিয়ে আসি পরে নিয়ে আসতে খুবই অসুবিধা হবে।‘
আমার এ অফিস একটু আমতা আমতা করেই রাজি হয়ে গেলেন, ‘ঠিক আছে, ওই প্রথমদিন একটু লেটেই আসবেন।‘
প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা হাতে পেতে পেতে বেলা সাড়ে বারোটা হয়ে গেল। আমার সেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কলকাতা থেকে মাইল ত্রিশেক দূরে ছিল। ট্রেনে আসতে শেয়ালদা পৌঁছাতে প্রায় দু’ ঘণ্টার ধাক্কা, তাও অনেক পরে পরে ট্রেন। আমার এর পরের ট্রেন ছিল সোয়া দু’টার সময়। সেটা সোয়া চারটেয় এসে শেয়ালদায় পৌঁছানোর কথা, কিন্তু পৌঁছাল আরও আধঘণ্টা লেটে। তার মানে পৌনে পাঁচটায়। তারপর ট্রেন থেকে নেমে আর ভাববার অবসর নেই। মফস্বল থেকে পাত্তাড়ি গুটিয়ে চলে আসছি, সঙ্গে হ্যারিকেন, কুঁজো, শতরঞ্জি মোড়া বিছানা, কালো ট্রাঙ্ক, স্বল্পকালীন আবাসের জন্যে যা যা কিনেছিলাম কিছুই ফেলে আসিনি।
ভেবেছিলাম এই সমস্ত জিনিস কালীঘাটে আমার বাসায় রেখে এসে তারপর অফিসে যাব। কিন্তু এখন আর হাতে সময় কোথায়, পাঁচটা বাজতে চলল। যথাকালে একটি ট্যাক্সি সংগ্রহ করে তাতে মালপত্র উঠিয়ে নিলুম, তারপর সোজা এসে নামলুম আমার অফিসের সামনে।
এখন সমস্যা হল এই মালপত্র কোথায় রেখে যাই, কার জিম্মায়? কিছুই ঠিক করতে না পেরে একটা ঝাঁকামুটে রাস্তা থেকে সংগ্রহ করে ফেললুম। তার মাথায় আমার জিনিসপত্র চাপিয়ে দিয়ে অফিসের মধ্যে ঢুকে পড়লুম।
তখন পাঁচটা বেজে দু’এক মিনিট হয়ে গেছে। সবাই বেরচ্ছে অফিস থেকে আর আমি বাক্স-বিছানা-ছাতা-লণ্ঠন নিয়ে অফিসে প্রবেশ করছি। নিশ্চয়ই খুব বিচিত্র দৃশ্য, সবাই খুব অবাক হয়ে দেখতে লাগল।
সোজা প্রধান কর্তার যাঁর কাছ থেকে অনুমতি নিয়েছিলুম তাঁর ঘরে ঢুকে গেলুম। হাফডোরের বাইরে ঝাঁকামুটে অপেক্ষা করতে লাগল। প্রধান কর্তা আমাকে দেখে বললেন, ‘তা হলে আপনি এসে গেছেন, কেমন লাগল আজকের কাজ?’ তিনি বোধহয় ধরে নিয়েছিলেন আমি আগে কোনও সময়ে দুপুর নাগাদ জয়েন করেছি, এখন ছুটির সময় তাঁর সঙ্গে দেখা করে যাচ্ছি।
সুতরাং তাঁকে ব্যাপারটা বোঝানোর চেষ্টা করতে হল, ‘আমি স্যার কিছুতেই আগে আসতে পারলাম না, এই মিনিট পাঁচেক লেট হয়ে গেল, এই এইমাত্রই এলাম।‘
শুনে ভদ্রলোক তাজ্জব, ‘একে আপনি পাঁচ মিনিট লেট বলছেন। পাঁচ মিনিট লেট হয় দশটা পাঁচে, পাঁচটা পাঁচে নয়। আমি আজ পঁয়ত্রিশ বছর কাজ করছি, এ রকম কোথাও কখনও শুনিনি।‘ ভদ্রলোক একটু থেমে নিলেন, তারপর প্রশ্ন করলেন, ‘আজকেই তো আপনার জয়েন করার লাস্ট ডেট ছিল?’ আমি বললাম, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ।‘
‘তা হলে যথেষ্ট হয়েছে, আপনি জয়েন করতে পারেননি, আর তাই আপনার চাকরি খতম, মানে চাকরি এখানে হল না।‘ ভদ্রলোক নিশ্চিন্তে টেবিল গোছাতে লাগলেন বোধহয় অফিস ছাড়বার প্রস্তুতি হিসেবে। আমি কী বলব ভেবে হাত কচলাচ্ছি, হঠাৎ ঝাঁকামুটেটি আর অপেক্ষা করতে রাজি নয় বলে হাফভোর ক্রশ করে ঘরের মধ্যে ঢোকে।
বাক্স-বিছানা ইত্যাদি দেখে আঁতকে উঠলেন প্রধান কর্তা, ‘এগুলো কার, এগুলো কী?’ তিনি আমাকেই উত্তরদাতা জেনে প্রশ্ন করলেন।
‘আজ্ঞে, আমার বাক্স-বিছানা।‘ আমার বিনীত উত্তরে তিনি লাফিয়ে উঠলেন, ‘মানে এই অফিসে থাকবেন মনস্থ করে এসেছেন নাকি?’
সব বুঝিয়ে তাঁর উত্তেজনা প্রশমন করে সেদিন রাত্রিতে চাকরি রক্ষা করে যখন বাড়ি ফিরলাম তখন রাত ন’টা। কিন্তু আমার বাক্স-বিছানা নিয়ে বেরতে পারলাম না। ঢোকবার সময় কিছু বলেনি কিন্তু বেরনোর সময় দারোয়ান কেয়ারটেকারের বিনানুমতিতে ওগুলো নিয়ে বেরতে দিল না। কেয়ারটেকারের অনুমতি আজও মেলেনি। অফিসের সদর দরজার একপাশে আমার বাক্স-বিছানা সাড়ে চার বছর পড়ে ছিল।
Post a Comment