যুগোস্লাভিয়ার রূপকথা: দেবদূত ও তিন ভাই

যুগোস্লাভিয়ার রূপকথা: দেবদূত ও তিন ভাই

অনেক অনেকদিন আগে এক দেশে তিন ভাই থাকত। তারা ছিল বড় গরিব। কেবল একটা নাশপাতি গাছ ছাড়া নিজের বলতে তাদের আর কিচ্ছু ছিল না। তাই তারা তিন ভাই মিলে পালা করে সেই নাশপাতি গাছটা পাহারা দিত। যেকোনো দু-ভাই বাড়ির বাইরে কোনো কাজে গেলে অন্যজন বাড়িতে থাকত। খেয়াল রাখত কেউ যেন গাছটার কোনো ক্ষতি করতে না পারে।

একবার হল কী, সেই তিন ভাইয়ের মন পরীক্ষা করতে স্বর্গ থেকে এক দেবদূতকে পাঠানো হল। সেই দেবদূত এক ভিখারির ছদ্মবেশ নিল আর তার পর একদিন সেই নাশপাতি গাছটার কাছে এল। সবচেয়ে বড় যে ভাই, সে তখন গাছটা পাহারা দিচ্ছিল। দেবদূত তাকে দেখে হাতটা বাড়িয়ে দিল আর বলল,
‘ঈশ্বরের দিব্যি, ভাই, আমাকে একটা পাকা নাশপাতি দাও।’
সবচেয়ে বড় ভাই তক্ষুনি তাকে একটা নাশপাতি দিল আর বলল,
‘আমি তোমাকে এটা দিতে পারি, কারণ এটা আমার। কিন্তু অন্য কোনোটা দিতে পারব না, কারণ ওগুলো আমার ভাইদের।’

দেবদূত বড়ভাইকে ধন্যবাদ দিয়ে চলে গেল।

পরের দিন যখন মেজভাই পাহারায় ছিল, সেইসময় সেই একই ছদ্মবেশে দেবদূত আবার এল। আগের দিনে মতোই মেজভাইয়ের কাছে একটা পাকা নাশপাতি চাইল।

মেজভাই বলল, ‘এটা নাও। এটা আমার আর তাই আমি এটা দিতে পারি। অন্যগুলোর একটাও আমি দিতে পারব না, কারণ ওগুলো আমার ভাইদের।’
দেবদূত মেজভাইকে ধন্যবাদ দিয়ে চলে গেল।

তৃতীয় দিন ছোটোভাইয়ের সঙ্গেও দেবদূতের একই অভিজ্ঞতা হল।

পরের দিন খুব সক্কাল সক্কাল দেবদূত এক সাধুর ছদ্মবেশে সেই তিন ভাইয়ের বাড়িতে এল। তারা তিনজনেই তখনও বাড়িতেই ছিল।

দেবদূত বলল, ‘বাছারা, আমার সঙ্গে এসো। একটা নাশপাতি গাছ পাহারা দেওয়ার চেয়ে ভালো কোনো কাজ আমি হয়তো তোমাদের খুঁজে দিতে পারব।’

একথা শুনে তিন ভাই-ই রাজি হল আর তার পর তারা সবাই মিলে একসঙ্গে বেরিয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ হাঁটার পর তারা একটা চওড়া, গভীর নদীর তীরে এসে পৌঁছোল।

বড়ভাইকে ডেকে দেবদূত বলল, ‘বাছা, আমি যদি তোমাকে কোনো বর দিতে চাই তুমি কী চাইবে?’
বড়ভাই উত্তর দিল, ‘এই পুরো জলটা যদি সুরা হয়ে যায় এবং তা আমার হয়, তাহলে আমি খুব খুশি হব।’

দেবদূত তার জাদুদণ্ডটা তুলে ধরে শূন্যে একটা ক্রস চিহ্ন আঁকল।

আরে! পুরো জলটাই তো উৎকৃষ্ট আঙুর-পেষাই কল থেকে তৈরি সুরা হয়ে গেছে! কোথা থেকে বেশ কিছু পিপেও এসে গেল। লোকেরা সেইসব পিপেতে সুরা ভরতে লাগল আর চালান করতে লাগল। এভাবে একটা বিশাল শিল্প গড়ে উঠল—কারখানা, গুদাম, সুরাভর্তি পিপে টেনে নিয়ে যাওয়ার জন্য গাড়ি. . . লোকজন ব্যস্তসমস্ত হয়ে এদিক ওদিক ছুটোছুটি করতে লাগল। বড়ভাইকে তারা সমীহ করে ‘মালিক’ বলে ডাকতে লাগল।

দেবদূত বলল, ‘তোমার বর তুমি পেয়ে গেছ। দেখো, ঈশ্বরের গরিব সন্তানকে তুমি ভোলোনি, আর তাই আজ নিজে বড়লোক হয়েছ। বিদায়।’

তার পর তারা বড়ভাইকে ছেড়ে রেখে এগিয়ে যেতে লাগল। একসময় তারা একটা বিশাল মাঠের ধারে এসে পৌঁছোল। সেখানে তখন এক ঝাঁক পায়রাকে খাবার দেওয়া হয়েছিল।

মেজভাইকে ডেকে দেবদূত বলল, ‘বাছা, আমি যদি তোমাকে কোনো বর দিতে চাই তুমি কী চাইবে?’
মেজভাই উত্তর দিল, ‘যদি এই মাঠের পায়রাগুলো সব ভেড়া হয়ে যায় এবং তা আমার হয়, তাহলে আমি খুব খুশি হব।’

দেবদূত তার জাদুদণ্ডটা তুলে ধরে শূন্যে একটা ক্রস চিহ্ন আঁকল।

আরে! পুরো মাঠটা ভেড়ায় ভরে গেছে যে!

ঘরবাড়ি, খাটাল সব গজিয়ে উঠল। সেখানে অনেক পুরুষ ও মহিলাদেরও দেখা গেল। কেউ কেউ ভেড়ার দুধ দুইতে লাগল, কেউ আবার সেই দুধ থেকে ছানা তৈরি করে তাই দিয়ে আবার চিজ বানাতে লাগল। একটা জায়গায় পুরুষরা বাজারে বিক্রি করতে নিয়ে যাওয়ার জন্য ভেড়ার মাংস কেটেকুটে ঠিক করতে লাগল। আর এক কোণে একটা দল ভেড়ার লোম ছাড়াতে শুরু করল। আর তারা প্রত্যেকেই যেতে আসতে মেজভাইকে ‘মালিক’ বলে ডাকতে লাগল।

দেবদূত বলল, ‘তোমার বর তুমি পেয়ে গেছ। এখানেই থাকো আর ধনসম্পত্তি উপভোগ করো। দেখো, ঈশ্বরের গরিব সন্তানকে তুমি ভোলোনি।’

এর পর সে আর ছোটোভাই একসঙ্গে যেতে লাগল।

দেবদূত বলল, ‘বাছা, এবার তুমিও একটা বর চাও।’

‘আমি কেবল একটাই জিনিস চাই, প্রভু। আমি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি তিনি যেন আমায় একজন সত্যিকারের ধার্মিক স্ত্রী দেন। এটাই আমার একমাত্র ইচ্ছে।’

দেবদূত চেঁচিয়ে উঠল, ‘একজন সত্যিকারের ধার্মিক স্ত্রী! বাছা আমার, তুমি সবচেয়ে কঠিন একটা জিনিস চেয়েছ। কেন জান? সারা দুনিয়ায় মাত্র তিনজন সত্যিকারের ধার্মিক মহিলা আছেন। তাঁদের দুজনের ইতিমধ্যেই বিয়ে হয়ে গেছে আর তৃতীয়জন একজন রাজকুমারী। ঠিক এই মুহূর্তেই তাঁর জন্য দুজন রাজাকে নির্বাচন করা হয়েছে। যাইহোক, তোমার ভাইয়েরা তাদের বর পেয়ে গেছে, তুমিও অবশ্যই তোমারটা পাবে। চলো, এক্ষুনি ওই ধার্মিক রাজকুমারীর বাবার কাছে যাই আর তোমার দাবিটা জানাই।’

তাই তক্ষুনি তারা শ্রান্ত, ক্লান্ত, বিধ্বস্ত অবস্থায় সেই শহরে গিয়ে হাজির হল যেখানে রাজকুমারী থাকত।

রাজা তো সব কথা শুনে অবাক !

‘তাহলে আমার মেয়ের জন্য তিনজন দাবিদার হল! দুজন রাজা আর এখন এই যুবক! সবাই একই দিনে! আমি এদের মধ্যে থেকে কীভাবে বেছে নেব?’

দেবদূত বলল, ‘ঈশ্বরের ওপর নির্ভর করুন। আঙুর গাছের তিনটে ডাল কাটুন আর রাজকুমারীকে বলুন প্রত্যেকটা ডালের ওপর আলাদা আলাদা দাবিদারের নাম লিখতে। তারপর আজ রাতে বাগানে সেই তিনটে ডাল পুঁতে দিন। রাতের মধ্যে যার ডালটায় ফুল ফুটবে এবং সকাল হওয়ার আগে থোকা থোকা পাকা আঙুরে ভরে যাবে তার সঙ্গে রাজকুমারীর বিয়ে দিন।’

রাজা আর অন্য দুজন দাবিদার এতে রাজি হলেন এবং রাজকুমারী আঙুর গাছের তিনটে ডালের গায়ে নাম লিখে পুঁতে দিলেন। সকাল হলে দেখা গেল, দুটো ডাল একেবারে শুকনো খটখটে, কিন্তু তৃতীয়টা, যেটার গায়ে ছোটোভাই-এর নাম লেখা ছিল, সেটা সবুজ পাতা আর থোকা থোকা পাকা আঙুরে ভরে গেছে। রাজা ঈশ্বরের বিচার মেনে নিলেন এবং তক্ষুনি তাঁর মেয়েকে নিয়ে গির্জায় গেলেন। সেখানে সেই আগন্তুক যুবকটির সঙ্গে রাজকন্যার বিয়ে হল। রাজা তাঁদের আশীর্বাদ করে রাজপ্রাসাদে ফিরে গেলেন।

দেবদূত নবদম্পতিকে সঙ্গে করে একটা জঙ্গলে নিয়ে গেল আর সেখানে তাদের রেখে চলে গেল।

এর পর প্রায় এক বছর কেটে গেছে। তিন ভাই কীরকম আছে, কেমনভাবে দিন কাটাচ্ছে তা দেখার জন্য দেবদূতকে আবার পৃথিবীতে পাঠানো হল। এক বুড়ো ভিখারির ছদ্মবেশে দেবদূত প্রথমে বড়ভাইয়ের কাছে গেল। সে তখন তার আঙুর-পেষাই কল নিয়ে কাজে ব্যস্ত। দেবদূত এক পেয়ালা সুরা ভিক্ষা চাইল।

‘যা, যা, দূর হয়ে যা এখান থেকে, বুড়ো ভিখিরি কোথাকার!’ বড়ভাই রেগে চিৎকার করে উঠল। ‘আমি যদি প্রত্যেক ভিখিরিকে এক কাপ করে সুরা দিতে শুরু করি খুব শিগগিরি তাহলে তো আমি নিজেই ভিখিরি হয়ে যাব!’

দেবদূত তার জাদুদণ্ডটা তুলল, শূন্যে একটা ক্রস চিহ্ন আঁকল।
যাঃ! যত সুরার পিপে, কর্মচারী আর আঙুর-পেষাই কল সব যে অদৃশ্য হয়ে গেল! আর তাদের জায়গায় বইতে শুরু করল একটা চওড়া, গভীর নদী।
‘ধনসম্পদ পেয়ে তুমি ঈশ্বরের গরিব সন্তানকে ভুলে গেছ,’ দেবদূত বলে উঠল, ‘যাও, তোমার নাশপাতি গাছের কাছে ফিরে যাও।’

এর পর দেবদূত গেল মেজভাইয়ের কাছে। সে তখন তার গোয়ালের কাজে ব্যস্ত।

দেবদূত বলল, ‘ভায়া, ঈশ্বরের দিব্যি, আমাকে এক টুকরো চিজ দাও!’

‘এক টুকরো চিজ! অকম্মার ঢেঁকি!’ মেজভাই চিৎকার করে উঠল। ‘দূর হয়ে যা শিগগির, না হলে, এক্ষুনি কুকুর লেলিয়ে দেব!’

দেবদূত তার জাদুদণ্ডটা তুলল, শূন্যে একটা ক্রস চিহ্ন আঁকল।
যাঃ! ভেড়া, গোয়াল, ব্যস্তসমস্ত কর্মচারীরা কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল?
কেবল মেজভাই একা একটা মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে, চারপাশে পায়রার ঝাঁক খাবার খাচ্ছে।
‘ধনসম্পদ পেয়ে তুমি ঈশ্বরের গরিব সন্তানকে ভুলে গেছ,’ দেবদূত বলে উঠল, ‘যাও, তোমার নাশপাতি গাছের কাছে ফিরে যাও।’
এর পর দেবদূত বনের মধ্যে সেই জায়গাটায় গেল যেখানে সে ছোটোভাই আর তার স্ত্রীকে রেখে চলে গিয়েছিল। সে দেখল তারা দারিদ্র্যের মধ্যে খুব কষ্ট করে দিন কাটাচ্ছে। তারা একটা ছোট্ট, দীর্ণ কুঁড়েঘরে বাস করছে।

‘ঈশ্বর তোমাদের সঙ্গে আছেন!’ বুড়ো ভিখিরির ছদ্মবেশে থাকা দেবদূত বলল। ‘ভগবানের দিব্যি বলছি, আজকের রাতটা আমাকে থাকতে দাও আর একটু কিছু খেতে দাও।’

‘আমরা নিজেরাই গরিব,’ ছোটোভাই বলল, ‘কিন্তু এসো, আমাদের যেটুকু আছে সেটুকুই আমরা সকলে মিলে উপভোগ করি।’

তারা আগুনের ধারে সবচেয়ে আরামদায়ক একটা জায়গায় বুড়ো ভিখিরির বিশ্রামের ব্যবস্থা করল। ছোটোভাইয়ের স্ত্রী তিনটে পাত্রে খাবারের আয়োজন করল। তারা এতটাই গরিব ছিল যে উনুনে যে রুটিটা সেঁকা হচ্ছিল সেটা কলে পেষাই করে আনা আটা বা ময়দার নয়, সেটা বিভিন্ন গাছের ছাল গুঁড়ো করে বানানো রুটি।

‘হায় রে!’ স্ত্রী নিজের মনেই বিড়বিড় করে বলে উঠল, ‘আমার খুব লজ্জা করছে , অতিথিকে দেওয়ার মতো আমাদের কোনো ভালো রুটি নেই।’

কিন্তু তারপরে যেটা হল, সেটা সে ভাবতেই পারে নি।

একবার ভাবো তো, যখন উনুনটা খুলে রুটি বের করতে গিয়ে সে দেখল যে সেটা গমের রুটি হয়ে গেছে তখন সে কী অবাক-ই না হল!

‘ঈশ্বর মঙ্গলময়!’ সে চেঁচিয়ে বলে উঠল।

সে ঝরনা থেকে এক কলসি জল নিয়ে গেল, কিন্তু যখন পেয়ালাগুলোতে ঢালতে শুরু করল তখন আনন্দের সঙ্গে দেখল জলটা উৎকৃষ্ট সুরা হয়ে গেছে।

দেবদূত বলল, ‘তোমাদের এত দুঃখের মধ্যেও আনন্দে আছ। আর তোমরা ঈশ্বরের গরিব সন্তানকে ভুলে যাওনি আর তাই ঈশ্বর তোমাদের পুরস্কার দেবেন।’

সে তার জাদুদণ্ডটা তুলল, শূন্যে একটা ক্রস চিহ্ন আঁকল।

আরে! সেই ছোট্ট, দীর্ণ কুঁড়েঘরটা এক নিমেষে অদৃশ্য হয়ে গেল আর তার জায়গায় ধনসম্পদ আর সুন্দর সুন্দর জিনিসে ভরতি একটা বিরাট রাজপ্রাসাদ চলে এল। চাকরবাকররা এদিক ওদিক ঘোরাফেরা করছে আর গরিব ছোটভাইকে ‘মালিক’ ও তার স্ত্রীকে ‘মালকিন’ বলে সম্বোধন করছে।

বুড়ো ভিখিরি উঠে দাঁড়াল এবং চলে যেতে যেতে সেই দম্পতিকে এই বলে আশীর্বাদ করে গেল, ‘ঈশ্বর তোমাদের এই ধনসম্পদগুলো দিয়েছেন। এগুলো তোমরা ততদিনই উপভোগ করতে পারবে যতদিন তোমরা আরও অন্যদের সঙ্গে এগুলো ভাগ করে নেবে।’

তারা দেবদূতের ওই কথাগুলো অবশ্যই মনে রেখেছিল, কারণ তারা বাকি জীবনটা সুখে স্বাচ্ছন্দ্যেই কাটিয়েছিল।

অনুবাদ: অনমিত্র রায়

No comments