চীন দেশের লোককথা: তিন সদানন্দ ভিক্ষুক

চীন দেশের লোককথা: তিন সদানন্দ ভিক্ষুক

অনেক অনেক কাল আগের কথা। একবার তিনজন চৈনিক ভিক্ষুক পায়ে হেঁটে সারাদেশ ঘুরতে বেরিয়েছিলেন। তাঁদের পরনে ছিলো গেরুয়া বসন আর কাঁধে ছিলো ঝোলা। পথ চলতে চলতে তাঁরা দেশের যেখানে পৌঁছাতেন সেখানকার বাজারে গিয়ে দাঁড়াতেন । তারপর তিনজন জোরে জোরে হাসতেন, “হা হা হা, হো হো হো।”।

ভিক্ষুকদের কান্ড দেখে বাজারে দাঁড়িয়ে থাকা প্রতিটি লোক হাসতে শুরু করত আর নিজেদের মধ্যে বলাবলি করত, “হাসি জিনিসটা বড়োই ছোঁয়াচে। দেখো,দেখো, ওদের দেখাদেখি আমরাও কেমন হাসছি।”

কথাটা শুনে প্রথম ভিক্ষুক বললেন, “তোমাদের মন খারাপ হলেই তোমরা প্রাণ খুলে হাসবে। দেখবে, সব কষ্ট পালিয়ে যাবে।”

বাজারে দাঁড়িয়ে থাকা একজন লোক হাত জোর করে ভিক্ষুক তিনজনকে প্রশ্ন করল, “কে আপনারা? দয়া করে আপনাদের পরিচয়টা দেবেন?”
দ্বিতীয় ভিক্ষুক হেসে উত্তর দিলেন, “তোমরা আমাদের জোকার ভাবতে পারো।” কথাটা বলেই তাঁরা আবার হেসে উঠলেন , “হা হা হা, হো হো হো।”

ভিক্ষুক তিনজন এইভাবেই তাঁদের উপদেশ সকলের মধ্যে ছড়িয়ে দিতেন । সবার মধ্যে আনন্দ বিলিয়ে বেড়াতেন।

এইভাবে বেশ কয়েক বছর কেটে গেল। তিনজন ভিক্ষুকেরই বয়স বাড়তে লাগল। একদিন তৃতীয় ভিক্ষুক মারা গেলেন। সংবাদ শুনে গ্রামের সকলে এক সাথে এক জায়গায় জড়ো হল। একজন বলল, “এবার বাকি দুই ভিক্ষুকদের মুখের হাসি থেমে যাবে।”
অপরজন বলল, “আহারে, অভাগা ভিক্ষুকরা। আমার ওঁদের জন্য বড়োই কষ্ট হচ্ছে। চল, একবার ওদের সাথে দেখা করে আসি।”
কথাটা শুনে সকলে দল বেঁধে তাঁদের সাথে দেখা করতে গেল। সেখানে পৌঁছানোর পর, গ্রামবাসীরা যা দেখল, তাতে তো তাদের চক্ষু ছানাবড়া।
মৃত ভিক্ষুকের গায়ে একটা সাদা চাদর মুড়িয়ে তাঁকে মাটিতে শুইয়ে রাখা হয়েছে। আর তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে অপর দুজন ভিক্ষুক উচ্চ স্বরে হেসে চলেছেন, ” হা হা হা, হো হো হো।”

তাদের কান্ড দেখে অবাক হয়ে একজন গ্রামবাসী বাকীদের বলল,”কী অদ্ভুত, দেখো, ওঁরা এখনও হাসছেন । “
সকলে থতমত খেয়ে নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে লাগল।

প্রয়াত বন্ধুর দিকে ইঙ্গিত করে প্রথম ভিক্ষুক দ্বিতীয় ভিক্ষুককে বললেন, “আমার মনে হয় আমাদের বন্ধুও নিশ্চয়ই হাসছে। হা হা হা, হো হো হো।”
এ কথা শুনে দ্বিতীয় ভিক্ষুক বললেন, “বুড়ো আমাদের ভেল্কি দেখাচ্ছে। হা হা হা, হো হো হো।”

কথাগুলো শুনেই গ্রামবাসীরা চমকে গেল।
একজন গ্রামবাসী ভিক্ষুক দুজনকে জিজ্ঞেস করল,
“ভেল্কি দেখাচ্ছেন মানে? ভিক্ষুক তো মারা গেছেন । মরা মানুষ ভেল্কি দেখায় কীভাবে?”
প্রথম ভিক্ষুক উত্তরে বললেন, “হ্যাঁ গো। ও বলেছিলো আমাদের তিনজনের মধ্যে ও সবার শেষে যাবে কিন্তু দেখো ওই আগে চলে গেলো। আমি নিশ্চিত ওর ঝুলিতে এখন আরও কৌশল লুকানো আছে। হো হো হো।”
দ্বিতীয় ভিক্ষুক বললেন, “অবশ্যই। ও আরও ভেল্কি দেখালেও আমি একটুও অবাক হব না। হা হা হা।”

দুজনের কথা শুনে গ্রামবাসীরা ভাবল, ভিক্ষুকরা নিশ্চয়ই পাগল হয়ে গেছে।
একজন গ্রামবাসী রেগে গিয়ে বলল, “চুপ করো। উনি মারা গেছেন। তোমরা ওর প্রতি এতটুকু শ্রদ্ধা দেখাতে পারছেন না?”
কথাটা যেন শুনতেই পাননি এমন ভাব দেখিয়ে প্রথম ভিক্ষুক বললেন, “এসো, আমরা সকলে মিলে প্রাণ খুলে হাসি।”
একজন গ্রামবাসী বলল, “মৃতদের সৎকারের সময় হয়ে গেছে। আমরা সকলে মৃত ভিক্ষুককে স্নান করিয়ে ওঁর পোশাক পরিবর্তন করি। তারপর ওঁকে শ্মশানে নিয়ে যাবো।”
দুজন ভিক্ষুক তাদের বাধা দিয়ে বললেন, “না, না। তোমরা ওকে কোথাও নিয়ে যেও না। আমরা আমাদের বন্ধুকে কথা দিয়েছিলাম, ও যেমনভাবে আছে, আমরা তেমনভাবেই ওর অন্তিম সৎকার করব।”
একথা শুনে সকলে চুপ করে রইল। তারপর তৃতীয় ভিক্ষুককে চিতার উপর শোয়ানো হল। যখনই তারা মৃত ভিক্ষুকের চিতায় আগুন দিল তখনই পটপট, ফটফট করে নানানরকম শব্দ হতে লাগল। সকলে ভয় পেয়ে এদিন ওদিক ছুটতে লাগল।

প্রথম ভিক্ষুক হেসে বললেন, “তোমরা কোথাও যেও না। এগুলি আতসবাজির শব্দ। আমাদের বন্ধু ওর জামার তলায় পটকা লুকিয়ে রেখেছি। আগুন দেওয়ায় ওগুলো জ্বলে উঠেছে। “
গ্রামবাসীরা চিৎকার করে বলে উঠল, “আহা! ভিক্ষুক দারুণ ভেল্কি দেখালেন ।”
এরপর থেকে মৃত ভিক্ষুকের শেষ উপদেশ সকলের মুখে মুখে প্রচারিত হতে লাগল ।

উপদেশটি ছিল – জীবনের শেষ দিন অবধি আনন্দ করে বাঁচো।

অনুবাদ: সুকন্যা দত্ত

No comments