আমরা কোথায় চলেছি? – হুমায়ূন আহমেদ

আমরা কোথায় চলেছি? – হুমায়ূন আহমেদ

ভদ্রলোক একজন সিএ। নিজের ফার্ম আছে। ভাল রোজগার করেন। ছেলেমেয়েরা সব বড় হয়ে গেছে। তার সর্ব কনিষ্ঠা কন্যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে এম. এ. পড়ছে। অতি সজ্জন মানুষ। বিনয়ী, ভদ্র এবং খানিকটা লাজুক ধরনের। তিনি তার মেয়েকে নিয়ে বাসায় ফিরছিলেন। ড্রাইভার গাড়ি চালাচ্ছে, তারা দুজন পেছনের সীটে বসেছেন। গল্পগুজব করছেন। গাড়ি বড় রাস্তা ছেড়ে বাইলেনে ঢুকল। ট্রাফিক জ্যাম। ড্রাইভারকে আস্তে আস্তে এগুতে হচ্ছে–হঠাৎ দুর্ঘটনা–একটা ছেলে চেঁচিয়ে উঠল। তার পায়ের পাতার উপর দিয়ে গাড়ি চলে গেছে। ছেলেটি চেঁচাচ্ছে–মেরে। ফেলেছে। আমাকে মেরে ফেলেছে।

ভদ্রলোক ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বললেন। ড্রাইভার বলল, স্যার, এই ছেলে বদমায়েশী করছে। গাড়ি ওর পায়ের উপর দিয়ে যায় নাই।

তুমি থাম।

ড্রাইভার গাড়ি থামাল। দেখতে দেখতে লোক জমে গেল। ছেলেটি দেখা গেল একা নয়। সঙ্গে অনেক বন্ধু বান্ধব আছে। তারা হুংকার দিচ্ছে–ভাঙ, গাড়ির কাচ ভাঙ। হারামজাদাকে টাই ধরে নামা।

তিনি বিব্রত। সঙ্গে তরুণী মেয়ে। ছেলেরা যেসব ভাষা ব্যবহার করছে তা নিজের। কন্যাকে পাশে নিয়ে শোনা যায় না। তিনি বললেন, তোমার পায়ের উপর দিয়ে গাড়ি চলে গিয়ে থাকলে খুব অন্যায় হয়েছে। তুমি উঠে বস। আমি ডাক্তারের কাছে নিয়ে। যাই।

চুপ থাক শালা। টেকা বের কর, ক্ষতিপূরণ দে। পাঁচ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ।

ভদ্রলোক হতভম্ব হয়ে পড়লেন। তার কন্যা কাঁদতে শুরু করল। এতগুলি মানুষ। চারদিকে। কেউ কিছু দেখছে না। সবাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। তিনি কি করবেন। ভেবে পেলেন না। সঙ্গে পাঁচ হাজার টাকাও নেই। তিনি বিড়বিড় করে বললেন, এত টাকা সঙ্গে নেই।

না থাকলে গাড়ি রেখে যা। টাকা দিয়ে গাড়ি ছাড়িয়ে নিবি।

একজন অসহিষ্ণু গলায় বলল, দেরি করছ কেন? একটা ইট এনে গাড়ির কাচ ভাঙা শুরু কর।

ভদ্রলোক মানিব্যাগে যা টাকা ছিল সব দিলেন। হাতের ঘড়ি খুলে দিলেন। মেয়েটি সমানে কাঁদছে। তিনি মেয়ের পিঠে হাত রেখে বললেন–

এই দিন তো দিন নয় আরো দিন আছে
এই দিনেরে নিবে তোমরা সেই দিনেরো কাছে।

গল্পটা আমি মেয়েটির কাছ থেকে শুনি। আমাকে এই গল্প শোনানোর তার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে–আমাকে জানানো যে তার বাবা চরম দুঃসময়ে আমার ব্যবহৃত দুটি কবিতার চরণ আবৃত্তি করেছেন।

সমস্যা হচ্ছে, কবিতার চরণ কি সমস্যার সমাধান? আমরা কোথায় চলেছি? মানুষের যাত্রা সব সময় অন্ধকার থেকে আলোর দিকে। আমরা কি অন্ধকারে যাত্রা শুরু করতে যাচ্ছি? তরুণ ছেলেরা এ কী খেলায় মেতেছে? সমাজে প্রতারক থাকে। কিন্তু তরুণ ছেলেদের এই ভূমিকায় আমরা তো আগে কখনো দেখিনি। এদের চোখে থাকবে স্বপ্ন। এদের মনে থাকবে আশা ও আনন্দ। আজ এদের হৃদয়ে অন্ধকার জমাট বাধতে শুরু করেছে।

কাঠগড়ায় কাদের আগে দাঁড় করাব? ঐ সব ছেলেদের বাবা-মাদের? নাকি শিক্ষকদের? নাকি দেশের কবি-সাহিত্যিকদের?

এই পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ জন্মায় হৃদয়ে জ্বলন্ত প্রদীপ নিয়ে। সেই প্রদীপ যেন সারা জীবন জ্বলতে পারে সে জন্যে বাবা-মারা প্রদীপে তেল ঢেলে দেন। বন্ধু বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনরাও এই কাজটি করেন। পরবর্তী সময়ে শিক্ষকরা এই দায়িত্ব পালন করেন। দেশের কবি-সাহিত্যিকরাও এই কাজটি পরোক্ষভাবে করেন। তাহলে কি ধরে নেব, প্রদীপে তেল ঢালার কাজটি আমরা করতে পারছি না? প্রদীপ যখন পূর্ণ। জ্যোতিতে জ্বলার কথা, তখন তা নিভে যাচ্ছে।

দিনে দুপুরে সবার চোখের সামনে মেয়েদের গলার চেইন ধরে টান দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা দেখছি, কিন্তু এগিয়ে আসছি না। একটি প্রতিবাদের বাক্য উচ্চারিত হচ্ছে না। কেন? আমরা কি মানসিকভাবে এইসব অপরাধ জীবনের অংশ হিসেবে স্বীকার করে নিচ্ছি?

হাইওয়েতে এক্সিডেন্ট হয়। আহত মানুষটিকে দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে। হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারলে তার জীবন রক্ষা হবে। কিন্তু কোন গাড়ি থামে না। এক্সিডেন্ট করে একজন মরতে বসেছে, মরুক। আমাকে দ্রুত পৌঁছতে হবে। এ দেশের একজন অভিনেতার স্ত্রীর এমন দূর্ভাগ্যজনক মৃত্যু হয়েছে বলে খবরের কাগজে পড়লাম। রক্তে ভেসে যাওয়া এই মহিলা তার জীবনের চরম সংকটের মুখেও পাশে। দাঁড়ানো ছেলেমেয়েদের সান্ত্বনা দিয়ে বলেছেন–তোমরা কেঁদো না, সব ঠিক হয়ে যাবে।

কিছুই ঠিক হয়নি। একটি গাড়িও থামেনি। মহিলাকে দীর্ঘ পথ নেয়া হয় রিকশায় করে। তিনি মারা যান। যে কটি গাড়ি সেই সময় তাকে ফেলে রেখে চলে গেছে, তার সব আরোহীদের কি হত্যা-অপরাধে বিচার হওয়া উচিত নয়?

শ্রেষ্ঠ প্রাণী মানুষের আজ এ কী পরাজয়? আর্নেস্ট হেমিংওয়ের সেই মহান বাণী।–Man can be destroyed but not defeated-এর উল্টোই কেন দেখছি? কেন। আমরা বারবার পরাজিত হবার পথ বেছে নিচ্ছি?

একটা গল্প দিয়ে শুরু করেছিলাম, আরেকটি গল্প দিয়ে শেষ করি। স্থান। সেকেণ্ড ক্যাপিটেল। সময় সন্ধ্যা। রিকশা করে একটি একটি মেয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ পাশে একটা বেবিটেক্সি এসে থামল। তিন তরুণ বের হয়ে এল। একজনের হাতে ভয়াল ছোরা। তাদের দাবি–গলার চেইন, হাতের চুড়ি খুলে দিতে হবে। মেয়েটি চেইন খুলে দিল, হাতের চুড়ি খুলছে। খোলা যাচ্ছে না। তিন তরুণই অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে। এই সময় প্রায় সত্তর বছরের একজন বৃদ্ধ এগিয়ে এলেন–চিৎকার করে বললেন, তোমরা। এইসব কি করছে? খবরদার বললাম। খবরদার।

ছুরি হাতে তরুণটি ক্রুদ্ধ গলায় চেঁচিয়ে উঠল–জানে শ্যাষ কইরা দিমু।

বৃদ্ধ বললেন, দাও, জানে শেষ করে দাও। কিন্তু আমার চোখের সামনে আমি অন্যায় হতে দেব না।

দুর্বল অশক্ত শরীরের এই বৃদ্ধ শক্ত গ্রানাইট পাথরের এক দেয়াল হয়ে মেয়েটির সামনে দাঁড়ালেন। ছেলেগুলির সাধ্য কি সেই দেয়াল ভেদ করে! বৃদ্ধ হুংকার দিলেন, এই মেয়ের চেইন ফেরত দাও। এর কাছে মাফ চাও–ততক্ষণে লোক জমে গেছে। একটি পুলিশের গাড়ি এগিয়ে আসছে। যে বেবীটেক্সি করে এরা এসেছিল সেই বেবীটেক্সিওয়ালা তার গাড়ি স্টার্ট দিয়েছে। আর দেরি করা যাবে না। পালিয়ে যেতে হবে।

তারা মেয়েটির চেইন ফেলে দিয়ে লাফিয়ে ট্যাক্সিতে উঠল।

ঐ বৃদ্ধকে আমি দেখিনি। আমি তার গল্প শুনেছি। আজকে এই লেখার মাধ্যমে আমি দূর থেকে তার পদস্পর্শ করছি। পবিত্র মানুষের স্পর্শে অন্তর পবিত্র হয়। আমরা সবাই অশুচি হয়ে আছি–কিছু পবিত্র মানুষের বড়ই প্রয়োজন আমাদের।

No comments