একটি মেয়ের আত্মকাহিনি – সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
চাঁদের আলোয় তেপান্তরের মতো একটা মাঠ। মাঠের মাঝখানে তেলমাখা একটা তাগড়া ঘোড়া দাঁড়িয়ে আছে। চেস্টনাট ব্রাউন তার রং। চামরের মতো লেজ দোলাচ্ছে। ওই ঘোড়াটাকে ধরতে হবে। পিচ্ছিল পিঠে চেপে বসতে হবে। ঘোড়াটা দিগবিদিগ জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটবে। চেষ্টা করবে ফেলে দিতে। তোমার কসরতটা হবে, চেপে থাকা। পড়ে গেলে তুমি তোমার সার্কিটের বাইরে চলে গেলে। পৃথিবীটা এখন রেসের মাঠ। সকলেই জকি।
দীপার বাবা পয়সাঅলা লোক। জাহাজের মাল খালাসের কারবার, স্টিভেডার। বেহালার দিকে বৃহৎ বাগানবাড়ি। তিনপুরুষের ব্যবসা। বেশ থকথকে পয়সায় ডুবে আছেন। পয়সাও এক। ধরনের পাঁক। একমাত্র মেয়ে দীপাকে রেখে মা মারা গেছেন। দীপা বড় হয়েছে একটা ভয়ের পরিবেশে। তার বাবা, কাকা, জ্যাঠামশাই সব দৈত্যের মতো দেখতে। কংস, দুর্যোধন, দুঃশাসন। দীপার সেইরকমই মনে হত। হাঁউ হাঁউ করে কথা। গগন ফাটানো হাসি। গপ গপ করে খাওয়া। এক-একজন এক এক কেজি মাংস খেয়ে ফেলতেন। দাঁতে হাড় ভাঙতেন মটমট করে। মজ্জাটা চুষে নিতেন স্যুৎ স্যুৎ শব্দে। মনে হত, তিনটে রাক্ষস পাশাপাশি খেতে বসেছে। চিৎকার করে বলতেন, ভাত দিয়ে যাও। লে আও ঝোল। থলথলে হুঁড়ি। বাড়িতে সকলেই চেক চেক লুঙ্গি পরতেন। কাঁধ কাটা গেঞ্জি। মোটা মোটা হাতে বড় বড় লোম। ঢেলা ঢেলা চোখ। চোখের কোলে পাউচ। রাতের দিকে সব মদ্যপান করতেন। নেশা হলে দীপার কাকাবাবু। নিজেকে খুব অপরাধী ভাবতেন। যে সামনে আসত তাকেই বলতেন, পা থেকে জুতো খুলে। আমাকে প্যাঁদাও। আমি কী করেছি জানিস! প্রশ্নটা করার পরেই একটা অ্যান্টি ক্লাইম্যাক্স হত। সবাই যখন ভাবছে, না জানি কত কী পাপের ফিরিস্তি বেরিয়ে আসবে, কাকা কান্না জড়ানো গলায়। বলে উঠতেন, আমি কি করিনি। কারুর জন্যে কিস্যু করিনি। করবও না কোনওদিন। প্যাঁদাও, শালাকে উত্তম-মধ্যম প্যাঁদাও, জুতিয়ে খাল খিঁচে নাও।
ঠিক সেই মুহূর্তে জ্যাঠামশাই নেশার ঘোরে বলতেন, ইশ, নাদুটা সব সিক্রেট আউট করে দিলে। মুকুজ্যে পরিবারের মানসম্মান আর কিছুই রইল না। আমার ঘোড়াটা নিয়ে আয়। বিশ্বাসঘাতকটার বুকে বুলেট চালাই। মীরজাফর, মীরজাফর।
দীপার বাবা নেশার ঘোরে হয়ে যেতেন চিফ জাস্টিস, ক্যালকাটা হাইকোর্ট। তিনি খুব গম্ভীর গলায় বার বার বলতেন, সাইলেন্স, সাইলেন্স। দিস ইজ কনটেম্পট অফ দি কোর্ট। টার্ন দেম আউট, টার্ন দেম আউট। নাদু উইল বি হ্যাঙ্গড টিল ডেথ।
দীপার ঠাকুরদা বেঁচে ছিলেন। যথেষ্ট বয়েস। প্রায় অথর্ব। একটা ঘরে শুয়ে শুয়েই দিন কাটাতেন। সেবার জন্যে একজন নার্স ছিলেন। বেশ স্বাস্থ্যবতী। মুখটা ছিল মঙ্গোলিয়ান ধাঁচের। মহিলা দীপাকেও খুব ভালোবাসতেন। ঠাকুরদা মাতালদের এই হট্টগোলের সময় কেবলই বলতেন, সন্ধের আর কত দেরি?
রাত আটটা সাড়ে আটটার পর দীপা ভয়ে কুঁকড়ে যেত। চেনা মানুষগুলো সব অচেনা হয়ে যেত। রান্নাঘরে দুজন রাঁধুনি ভালোমন্দ রাঁধছে। রান্নার গন্ধে বাড়ি ভাসছে। কাজের লোকেরা ব্যস্তসমস্ত হয়ে ঘুরছে। নানারকম ভাজাভুজি নিয়ে মদের আসরের দিকে ছুটছে। সেখানে দু-চারজন। বাইরের লোকও থাকত। বাবুদের পেয়ারের বন্ধু, মোসায়েবের দল। পরের পয়সায় মদ খাওয়ার জন্য আসত। তাদের মধ্যে একজন নেশার ঘোরে মেয়েদের মতো ঘুরে ঘুরে নাচত। আর। একজন গম্ভীর গলায় বলত সাধু, সাধু।
বউরা সব ভয়ে সিঁটিয়ে থাকত। এদের পয়সা ছিল। জাহাজের বিদেশি মাল বাড়ি বোঝাই। মানুষকে এরা মানুষ বলেই মনে করত না। দম্ভ ফেটে পড়ত। অভাবী লোকের সঙ্গে। চাকরবাকরের মতো ব্যবহার করত। কথায় কথায় বলত জুতিয়ে লাশ করে দোবো। তিন। ভাইয়ের তিনটে মোটর। বাইরে বেরোবার সাজগোজের কী ঘটা। লোকগুলোকে তখন ভীষণ বোকা বোকা দেখাত। দীপা ছিল নীরব দর্শক। মায়ের কথা তার মনেই পড়ে না। জ্ঞান হওয়ার আগেই তিনি মারা গিয়েছিলেন। দীপার মায়ের জন্যে দীপার বাবার কোনও আক্ষেপ ছিল বলে। মনেই হয় না। ভদ্রলোক একমাত্র নিজেকেই ভালোবাসতেন। দীপার জ্যাঠামশাই ওরই মধ্যে কিছুটা সংবেদনশীল মানুষ ছিলেন। দীপার জ্যাঠাইমা ছিলেন বোকাসোকা। তিনিই দীপাকে মানুষ করেছিলেন। মুকুজ্যে পরিবারের বউরা সব অলস ছিলেন। অতিরিক্ত আলস্য ও প্রচুর প্রোটিনজাত খাদ্যে তাঁরা মেদভারে বিপর্যস্ত ছিলেন। পুরুষরা সেইটাই পছন্দ করতেন। এও এক ধরনের বিকৃত রুচি। দীপা বড়ো হয়ে বুঝেছিল, এটাও এক ধরনের ভালগার টেস্ট। বউগুলোকে করে ফেলেছিল জ্যান্ত পাশবালিশ। দীপার মনে হয়েছিল মেয়েরা বন্দি হতে পছন্দ করে। দাসত্বের প্রতি তাদের ভয়ংকর আসক্তি। খাঁচা থাকবে। পুরুষের ভোগের সামগ্রী হবে। এই ভাবটা তাদের সংস্কারে চলে গেছে। মেয়েরা নিজেরাই মনে করে, তারা দেহ ছাড়া কিছুই নয়, ভিতরে একটা মন নড়াচড়া করে ঠিকই, কিন্তু সেই মনটা বিকলাঙ্গ। অন্ধকারে একটা পাখি। ভিতরটা খুব নোংরা। যা-তা বই পড়ে। অশ্লীল আলোচনা করে। কাজের মেয়েদের সঙ্গে পরের বাড়ির আলোচনা করে। যখনই সুযোগ পায় আজেবাজে সিনেমা দেখতে ছোটে। আর কুৎসিত সাজগোজ করে স্বামীদের সঙ্গে বিয়েবাড়িতে হল্লা করতে ছোটে। সঙ্কীর্ণ মনের মানুষ সব। নিজেদের মধ্যে তুমুল ঝগড়া করে। তখন মুখের আর কোনও আগল থাকে না। বস্তির ভাষা ব্যবহার করে। স্বামীকে বলে ভাতার। বউগুলো সব মাগি। তখন মুখ-চোখের চেহারা পালটে যায়। আঁচল খসে পড়ে। বিশাল বুক থলথল করে নাচতে থাকে। বৃহৎ নিতম্ব দুলতে থাকে। খোঁপা আলগা হয়ে যায়। গা থেকে একটা পাশবিক গন্ধ বেরোতে থাকে। সমস্ত হিংস্র পশুর সমাহার। মাসের মধ্যে তিন-চার বার দীপা এই দৃশ্য দেখায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল। কাকার উপর রাগ করে একদিন তার কাকিমা তিন বছরের মেয়ের গলা টিপে ধরেছিল। সেই মুহূর্তে তার। কাকিমাকে মনে হয়েছিল মানুষ নয়, পিশাচিনী। ঘটনাটা ঘটেছিল দুপুরে। সেই রাতেই দেখা গেল কাকিমা সেজেগুঁজে, দশ ভরি গয়না চাপিয়ে কাকার সঙ্গে গাড়ি চেপে পার্টিতে যাচ্ছে!
এইসব দেখে দীপার ভয় হত, তার ভবিষ্যৎটা কী হবে! ওই জ্যাঠাইমা, কাকিমার মতো মহিলা। কোনও একটা লোকের বউ। ব্যবসাদার, দালাল অথবা ফোড়ে। অনেক টাকা তার। গদগদ চেহারা। ধামার মতো উঁড়ি। গলগল করে ঘামে। মাংস খেয়ে দেশলাই কাঠি দিয়ে দাঁত খোঁচায়। ফুক ফুক করে ঘরের দেয়ালে কুঁচি ফেলে। বগলের চুলে ঘামে জড়িয়ে থাকা পাউডার। রাতের বেলা বিছানায় জড়িয়ে ধরে। লোমঅলা বুকে মুখ চেপে ধরে। এখানে-ওখানে খামচায়। ইচ্ছার বিরুদ্ধে দেহভোগ করে। অবাঞ্ছিত সন্তানের মা হতে হয়। দীপা স্বপ্নে দেখত, হাজার হাজার হাত অক্টোপাসের মতো এগিয়ে আসছে। বিশাল, বিকট একটা মুখ, কমলাভোগের মতো দুটো চোখ, শিমপ্যাঞ্জির মতো মোটা দুটো ঠোঁট, নর্দমার মতো নিঃশ্বাস। ছ্যাঁত করে ঘুম ভেঙে যেত। রাতের কালো আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে হত আত্মহত্যা করি। বাগানের ঝাঁকড়া গাছে কালপ্যাঁচা ডাকছে। উত্তরের পাঁচিলে হুলো বেড়ালের জৈব চিৎকার।
দীপা ঘর থেকে বারান্দায় বেরিয়ে আসত। অসুস্থ ঠাকুরদার ঘরে আলো জ্বলছে কম পাওয়ারের। নার্স দিদি ইউরিন্যাল দিচ্ছে। ছ’ফুট লম্বা একটা মানুষের খাঁচা বিছানায় পড়ে আছে। কোনও আব্রু নেই। লজ্জা নেই। ঠাকুরদার যৌবনের ছবিতে কী অহংকার, কী দাপট! ইউরোপিয়ান। পোশাক। নিষ্ঠুর দুটো চোখ, বাজপাখির মতো। শিকারের শখ ছিল। রাইফেল ছিল। বহুবার। বিলেত গিয়েছিলেন। তিন ছেলে ও তিন মেয়ের জন্মদাতা। সেই মানুষটার কী অবস্থা! ছেলেরা ফিরেও তাকায় না, বউরা মাঝেমধ্যে আসে। সমস্ত দায়িত্ব ওই নার্সের।
দীপা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ফিরে যায় ঘরে। বয়সের তুলনায় তার চিন্তাটা ছিল অনেক পাকা। শরীরে সব লক্ষণই সুস্পষ্ট। রাতে কোনও কোনও দিন নার্সদিদি তার পাশে এসে শুত। আদর। করে জড়িয়ে ধরত। তখন দীপার মনে হত শরীরের কোনও একটা স্তরে কিছু একটা ঘটছে, যার অনুভূতিটা সম্পূর্ণ অন্যরকম। এই অনুভূতির মধ্যেই আছে নেশা, আছে শৃঙ্খল। একসময় দীপা নিজেকে সমর্পণ করে দিত তার হাতে। তখন অতটা বুঝত না, ব্যাপারটা কী হচ্ছে। এখন বোঝে। বুঝে আরও ভয় পেয়ে যায়। মানুষের স্বভাবে কী আছে কেউ বলতে পারে না। একটা। গুহা আছে ভিতরে। বসে আছে প্রবণতা। আকর্ষণ এত প্রবল, অপেক্ষা করার উপায় নেই। দীপা উন্মুখ হয়ে থাকত। কখন সে আসবে। তার একটা পাপবোধ। একটা অসুস্থতা। না জানার ভান; কিন্তু ভীষণ উপভোগ্য। যে রাতে ঠাকুরদা একটুও ঘুমোতেন না, সারাক্ষণ নার্সদিদিকে ওইখানেই ব্যস্ত থাকতে হত, দীপা রেগে যেত। অসুস্থ মানুষের কষ্টটা তার কাছে কিছুই নয়। নিজের সুখটাই বড়। এইটাই পৃথিবীর চরম সত্য। আমি আমি, তুমি তুমি। বাকিটা অভিনয়। লোকলজ্জা। বুদ্ধিমান মানুষ সেই কারণেই কিছু অনুশাসন তৈরি করে রেখেছে। কিছু কর্তব্য। ভাব, ভাবনাহীন কিছু করণীয় কাজ।
ওই বাড়িতে আরও কিছুকাল থাকলে দীপার কী হত এখন আর বলা যায় না। ঘটনাই ভাগ্য। দীপার বাবা ওই সময় এক চিত্রাভিনেত্রীর খপ্পরে পড়লেন। মহিলা তিন-চারটে বাংলা ছবিতে নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। প্রথমটা হিট করেছিল। মহিলার দেহ ছিল। কোনও এক পার্টিতে দীপার বাবার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল সেই মহিলার। দীপার মায়ের মৃত্যুর পর দীপার বাবা একটা অস্বস্তির মধ্যে ছিলেন। সকালে উঠে টুথব্রাশ হারিয়ে গেলে যে অসুবিধে হয় অনেকটা সেইরকম। সুধন্যবাবু আর একটা অ্যাঙ্গুলার টুথব্রাশ পেয়ে গেলেন, তবে দামটা একটু বেশি। ছাপ মারা নায়িকা। শহরের দেয়ালে যার ছবি সাঁটা থাকে।
দু-ধরনের পুরুষ আছে—এক হিসেবি লম্পট, আর এক বেহিসেবি লম্পট। সব পুরুষই লম্পট যেমন সব কিশোরীই লেসবিয়ান। উত্তেজিত হয়ে লাভ নেই, আধুনিক মনস্তাত্বিকদের এইটাই বক্তব্য। মানুষের কাণ্ডকারখানা দেখে তাঁরা অন্য কোনও সিদ্ধান্তে আসতে পারছেন না বলে। মানবজাতির কাছে ক্ষমা চাইছেন। সুধন্য মুখার্জি ছাগলের মাংস ভয়ংকর ভালোবাসতেন, সেই কারণে বুদ্ধিটাও হয়ে গিয়েছিল ছাগলের মতো। মানুষ তো এমনিই নাচের পুতুল, অদৃশ্য দড়ির টানে সারাজীবন হাত-পা ছোঁড়ে, এর সঙ্গে যোগ হল এক খেলোয়াড় মহিলা। ডবল ডিমের। ওমলেটের মতো ডবল নিয়তি। বোকা-লম্পটদের মেয়েরা সহজেই চিনতে পারে। এই একটু গায়ে গা লাগিয়ে বসা, চোখের ভঙ্গি করা, শরীরের ঝলক দেখানো, মাঝেমধ্যে হাসতে হাসতে গায়ে ঢলে পড়া—এইজাতীয় কিছু প্রাচীন টোটকাই যথেষ্ট। লোকটা একেবারে পোষা কুকুর। পটাপট ল্যাজ নাড়বে। সুধন্যর ব্রেনের একটা অংশ অকেজো হয়ে গেল। অদ্ভুত একটা ইউফোবিয়া তৈরি হল। পৃথিবীটা হল নারীদেহ। মানুষ তার শৈশবটা কোনওরকমে পেরোতে পারলেই হয়ে গেল। তারপর স্রেফ নারী সম্ভোগ। প্রেম কাকে বলে, কবিতায় আছে, না সাহিত্যে আছে, ফুলে আছে না ফলে আছে ইত্যাদি গবেষণার প্রয়োজন নেই। লেগে থাকো, জড়িয়ে থাকো, নিমজ্জিত হয়ে যাও। অজগরের মতো গিলে ফেলুক তোমাকে। পৃথিবীকে ঘোরাচ্ছে কোনও শক্তি, কামিনী আর কাঞ্চন। সেই অভিনেত্রীর নাম ছিল রমলা। তাঁর জীবনকাহিনি একটু ঘোলাটে মতো ছিল। মা ছিলেন থিয়েটারের অভিনেত্রী। খুব দাপট ছিল। ইংরেজিটা ভালো জানতেন। সেকালের এক বিখ্যাত নটের বিপরীতে অভিনয় করতেন কলকাতার এক নামকরা মঞ্চে। শেক্সপিয়ারের নাটকেও তিনি অভিনয় করতেন। রমলার পিতা কে ছিলেন? রমলার মায়ের স্বামী ছিলেন কলকাতার নামজাদা এক কলেজের অধ্যাপক। অ্যানিমিক চেহারা। অ্যাকাডেমিক টাইপ। উত্তর কলকাতার এক এঁদো গলিতে সাবেক কালের এক স্যাঁতস্যাঁতে বাড়িতে সেই অধ্যাপক থাকতেন। বিষণ্ণ পরিবেশে। একনাগাড়ে তিন-চার মাস সেই বাড়িতে থাকলে আত্মহত্যার ইচ্ছে হওয়া স্বাভাবিক। অধ্যাপকের মাথায় পরিমিত টাক, চোখে পুরু চশমা। অ্যামিবায়োসিসের রুগি। সপ্তাহের তিনটে দিন মাথাধরায় কাবু। মাইগ্রেন। অধ্যাপক হিসেবে যথেষ্ট সুনাম ছিল। মানুষও ভালো। কেবল একটা জিনিসেরই অভাব ছিল, সেটা হল। জীবনীশক্তি। প্যাঁ করে সানাই বাজল। মালা গেল এগলা থেকে ওগলায়। কিছু লোক রাত বারোটা পর্যন্ত মহা হল্লা করে পোলাও, মালাইকারির ভুষ্টিনাশ করে গেল। রজনীগন্ধা দোলানো ভেলভেটের চাদর-মোড়া বিছানায় এক যুবতীর পাশে তুমি শুলে। সেইটাই সব নয়, আসল খেল তারপরে। তাকত। কবিতাই শোনাও আর নীল আকাশে চাঁদ দেখাও; কিছুই কিছু নয়। তোমাকে হতে হবে একটা স্যাভেজ, ব্রুট। পশু না হলে তুমি নাম কা ওয়াস্তে স্বামী। তোমার স্ট্যাটাস হল সিঁদুরের একটি রেখা।
রমলা সেই বিবর্ণ মানুষটিকে বাবা বলে জানলেও, অধ্যাপক জানতেন রমলা তার সন্তান নয়। রমলার পিতা সেই মঞ্চ দাপানো অভিনেতা। যিনি মাইকেল হয়ে মেঘনাধ বধ আওড়ান, চাণক্য হয়ে দর্শকদের অনুভূতিতে রোমাঞ্চ আনেন। যৌবন সমাগমে রমলাও অনুমান করতে পেরেছিল, এমন একটা দীঘল শরীরের নির্মাতা ওই অধ্যাপক হতে পারে না। রাতের পর রাত বালিশে পিঠ দিয়ে বসে বসে হাঁপান। শ্বাসের শব্দ শুনলে অবাক হতে হয়, পৃথিবীতে বাতাসের এত অভাব! মানুষটা গ্যালপিং রেটে বৃদ্ধ হয়ে শুরু করেছিলেন। করুণ চোখে নিজের স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে থাকতেন। চওড়া পিঠে চকচকে চামড়া। ফেটে পড়া যৌবন। বহির্মুখী মন। সংসারে অলীক মন বসে না। পুরুষের সঙ্গ পছন্দ করে। যেসব পুরুষ অসুস্থ নয়, যাদের লিভার ভালো, শ্বাসকষ্ট নেই, ন্যায়-অন্যায়ের অলীক বোধে পেন্ডুলামের মতো দোল খায় না, তাদের কাছে পরস্ত্রীর মতো সুস্বাদু স্যালাড আর কী থাকতে পারে। প্রবাদে আছে, আমি মাখব ফলার, তুমি এসে খেয়ে যাবে। নেপোয় মারে দই।
অবশ্য রমলার মা বোকা ছিলেন না। অতিশয় খেলোয়াড় এক মহিলা। প্রতিভা তো ছিলই। নিষ্ঠুরতা স্বার্থপরতায় অদ্বিতীয়। কারুকার্য করা ভোজালির মতো। মণি বসানো সাপের ফণার মতো। বিষাক্ত সুন্দর। পৃথিবীতে অমতের চেয়ে হলাহলের আকর্ষণ বেশি। এক ছোবলে মরব না; কিন্তু তিলতিল করে মৃত্যুর দিকে এগোব। সর্বনাশের আকর্ষণ। চরণামৃত খেলে মোক্ষ লাভ হয়। সেটা কি কেউ জানে না; কিন্তু কোকেন অথবা মরফিন সব গোলাপি;নভোচরের মতো আকাশের দিকে উড়ে যাচ্ছি। পেঁয়াজের খোসার মতো পাতলা শাড়ি পরে চন্দনবর্ণা মহিলা ঘুরে ঘুরে নাচছে। সে সুখ পৃথিবীতে নেই সেই সুখে ভাসছি। নর্দমাকে মনে হচ্ছে যমুনা। সেন্ট্রাল নার্ভাস সিসটেমে সেতার বাজছে।
রমলার মা সেই দশকের কলকাতার হিরোইন। দুই অর্থে এক। নায়িকা প্লাস ড্রাগস। প্রবীণ মাজা ভাঙা সাহিত্যিকরা তাঁর পা চাটতেন। আর উপন্যাসে বড়ো বড়ো আদর্শের বুলি কপচাতেন। উপনিষদ পাঞ্চ করে মনে করতেন ক্ল্যাসিক লিখে ফেলেছি। সভায় শাল জড়িয়ে বসতেন, সবাই। মনে করত ব্রামার জেরক্স কপি। দাঁতে পায়োরিয়া, মুখে দুর্গন্ধ, ঘামে টকসিন স্মেল, গেলাস তুলতে গেলে হাত কাঁপে, উদরে কোষ্ঠকাঠিন্যের বাতাস। সমালোচকরা চারপাশে নেংটি ইঁদুরের মতো ঘোরে। স্তাবকরা এই ভাজার মতো প্রেক্ষাগৃহে বসে চটরপটর তালি বাজায়। কলের। গোড়ায় লাগাম চড়িয়ে বসে আছেন মঞ্চাভিনেত্রী। যখন পিছন ফিরে হেঁটে যান পুরুষদের গলা শুকিয়ে যায়। সামনে দাঁড়িয়ে যখন হাত তোলেন, মনে হয় নিয়তি। একজনের কাছেই নিজেকে সমর্পণ করেছিলেন, তিনি সেই নট, রঘুবীর।
রমলা সবই পেয়েছিল, মায়ের প্রতিভাটা পায়নি। মণিহীন ফণী। সুধন্য সেই চন্দ্রমুখীর নেশায় চুর হয়ে গেলেন। একটা বাড়ি ভাড়া করে সেই প্রতিষ্ঠা করলেন। স্থির করলেন বিগবাজেটের একটা ফিলম করবেন। রমলাকে করে তুলবেন বাংলা চলচ্চিত্রের গ্রেটা গার্বো। ভাগাড়ে যখন নতুন। মৃতদেহ পড়ে তখন শকুনরা সব খ্যাখ্যা করে ছুটে আসে। বাঘ যখন শিকার মারে ফেউরা সব দুরে বসে কেয়াবাত কেয়াবাত করে। সেইকালের এক মরফিনসেবী পরিচালক গন্ধে গন্ধে ছুটে এলেন। তিনি আবার কলকাতার এক মিশনারি কলেজে ইংরেজি অধ্যাপক ছিলেন। পাকতেড়ে চেহারার কোকেনসেবী এক লেখক তাঁর কোটর থেকে বেরিয়ে এলেন। এক ম্যাটিনি আইডল। নায়ক রমলার বিপরীতে অভিনয় করতে নিমরাজি হলেন।
মদের ফোয়ারা ছুটল। মুরগি উড়ে গেল প্লেট প্লেট। রাতের পর রাত আলোচনা। কাউচে এলিয়ে আছেন রমলা। দু আঙুলের ফাঁকে লম্বা পাইপে লাগানো সিগারেট। এনামেল করা ঠোঁটে মাঝে। মাঝে টানছেন। ছাই ঝাড়ার দরকার হলে মিউজিক ডিরেক্টর অ্যাশট্রে এগিয়ে দিয়ে ধন্য হচ্ছেন। ফরাসি পারফুম জড়িয়ে আছে শরীরে। দিনে একরকম সুগন্ধ, রাতে আর একরকম। গবেষণার বিষয় গল্পটা কী হবে। প্রমথেশ বড়ুয়া, দেবকী বোস, জ্যোতির্ময় রায় পাঞ্চ। জবরদস্ত একটা ককটেল। ছবির সব ফ্রেমেই রমলা থাকবে।
সুধন্য মুখার্জি ব্যাঙ্ক যাচ্ছেন, বান্ডিল বান্ডিল টাকা তুলছেন, এম্পায়ার স্টোর্স বিলিতি সাপ্লাই করছে, বাথগেট থেকে আসছে পেটি পেটি সোডা ওয়াটার। দীপার জ্যাঠামশাই একদিন সুধন্যকে বললেন, ‘চৌবাচ্চায় ফুটোটা তা হলে তুমিই করলে।’ প্রথমে মৃদু গলায় হচ্ছিল। দাদা তার ভাইকে সতর্ক করছেন। কর্তা এখনও জীবিত, তাঁর জীবৎকালেই লালবাতি জ্বেলে দেবে। জলের মতো টাকা উড়ছে। রমলার রসের ভিয়েন হচ্ছে। একটাই মেয়ে বড় হচ্ছে। বাপ যদি চরিত্রহীন হন মেয়ের ভবিষ্যৎ কী হবে।
আমি সিনেমা করব। প্রডিউসার। টাকাটা আমার চাই।
সিনেমা!
জ্যাঠামশাই আঁতকে উঠলেন। দীপা আড়াল থেকে দেখছে। বাবাকে চিরকালই তার মনে হত অচেনা একটা মানুষ। দুমদাম কথা বলে। যে-কোনও কথা যে-কোনও লোককে অক্লেশে বলতে পারে। বয়সের মর্যাদা দিতে জানে না। মানুষকে অপমান করে আনন্দ পায়।
জ্যাঠামশাই একটু সামলে বলেছিলেন, মাথাটা তাহলে সত্যিই খারাপ হল। সিনেমার তুমি কী বোঝো? কত টাকার ব্যাপার!
দশলাখ নিয়ে নামব। এতকাল জাহাজের পেটে জীবনটাকে নষ্ট করেছি।
জ্যাঠামশাই বললেন, এইবার মেয়েছেলের তলপেটে জীবনটাকে শেষ করবে।
দীপার বাবা সপাটে দাদাকে একটা চড় হাঁকালেন। নেশাটা চড়ছিল। বড় ভাই হকচকিয়ে। গেলেন। সেই রাতটা ভোলার নয়। দীপা ছুটে এসে জ্যাঠামশাইকে জড়িয়ে ধরেছিল। জ্যাঠাইমা দৌড়ে এসে বলেছিলেন, দাদাকে মারলে! দীপার বাবা যে চেয়ারটায় বসেছিল, সেই চেয়ারটা। উলটে ফেলে দিয়ে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গেল। এই চলে যাওয়াটা দীপার মনে একটা স্থায়ী ছাপ। রেখে গেছে। কেউ বাধা দিতে এগিয়ে আসেনি। দীপার মা বেঁচে থাকলে নিশ্চয় স্বামীর হাত। ধরতেন। একটা নিঃসঙ্গ মানুষ চলে গেল। সারা বাড়ি থমথমে। দীপার সঙ্গে কেউ কথা বলছে না, যেন চড়টা সেই মেরেছে। বেশ বুঝতে পেরেছিল সবাই তাকে ঘৃণা করছে। দীপা বুঝে গিয়েছিল। সংসারে সে একা। সেই রাতের আর একটা ঘটনা, রাত দুটোর সময় ঠাকুরদা মারা গেলেন। সন্ধে থেকেই ছটফট করছিলেন, কাকে যেন খুঁজছিলেন। কারও হাত ধরার চেষ্টা। একটা অজানা পথে একেবারে একা যাওয়া। নাস্তিক ভোগী মানুষরা মৃত্যুর সময় খুব ভয় পান। এপার থেকে ওপারে যাওয়ার সময় সঙ্গে কিছু নিয়ে যাওয়া যায় না। কেউ সঙ্গে যেতেই পারে না। তা ছাড়া। একটা কষ্টও আছে, তখন আর শ্বাস নেওয়া যায় না। ভিতরের বন্দি বাতাস বেরিয়ে আসতে চায়। মৃত্যুর এক ভয়ংকর যন্ত্রণা।
যখন মারা গেলেন, তখন যে যার ঘরে খিল এঁটে শুয়ে আছে। এতদিন যা শুনতে হয়নি, সেই চোখা কথা দীপাকে শুনতে হয়েছে। সব কথার সারাংশ হল, এই বাপের মেয়ে আর কত ভালো হবে। দুধ কলা দিয়ে কালসাপ পোষা। জ্যাঠাইমা মুখ ঘুরিয়ে নিলেন, কাকিমা ফড়ফড়িয়ে চলে গেলেন। ভাবটা এই, নান অফ মাই বিজনেস। বড়র সঙ্গে হয়েছে বড়র বউ বুঝবে। বড় হয়ে বড়র সম্মান যদি আদায় করে নিতে না পারে, সে তোমার দোষ! বসে বসে মদ খাওয়ার সময় মনে থাকে না? ঠাকুরদার মৃত্যুর সময় আপনজনদের মধ্যে দীপাবলীই পাশে ছিল। মানুষ। কীভাবে দুঃসহ যন্ত্রণায় মারা যায় একবারে মাথার কাছে দাঁড়িয়ে দেখা হয়ে গেল। প্রাণবায়ু বেরিয়ে যাওয়ার পর নার্স দিদিমণি পাশের টুলে যেমনভাবে বসে পড়লেন, যেন চা খেয়ে চায়ের কাপ নামিয়ে রাখল। কিছুই না পেয়ালা খালি হয়ে গেল। এইটা হয়তো তার অভিজ্ঞতায় একশো একতম মৃত্যু। দীপার দিকে তাকিয়ে বলেছিল, ‘আমার ছুটি হয়ে গেল। যাও ওনাদের ডাকো।’
ওদের সঙ্গে কথা বলতে দীপার একেবারেই ভালো লাগছিল না। বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কাকা, কাকিমা, জ্যাঠামশাই, জ্যাঠাইমা বলে ডাকতে তার ঘেন্না করছিল। কিছুক্ষণ বসে থেকে নার্স ভদ্রমহিলা বলেছিলেন, ‘নাঃ ডেডবডিতে ঠান্ডা লেগে যাচ্ছে। যাই বাবুদের টেনে তুলি।’
ঘরে কম পাওয়ারের নীল একটা আলো জ্বলছিল। ঠাকুরদা চিৎ হয়ে শুয়ে আছেন অনন্ত নিদ্রায়। সাদা চুল, সাদা দাড়ি। ঘরের বাতাসে তখনও ঘুরে বেড়াচ্ছে তাঁর শেষ নিঃশ্বাস। নীল সমুদ্রে মৃত্যু নীল অনন্তে লীন এক মানুষ। দীপার সেই মুহূর্তে মনে হয়েছিল, এমন একজন মানুষের ছেলেরা এমন কেন হল! ঠাকুরদা তো ধার্মিক ছিলেন। ভাগবত পাঠ করতেন, গীতা পাঠ করতেন, মালা জপতেন, সন্ন্যাসী সঙ্গ করতেন, দানধ্যান ছিল। দীপা ঠাকুরদার হাতটা ধরতে চেয়েছিল, ভয়ে। পারেনি। মৃত্যুকে ভয় করে। এমনি দেখা যায় না। কিন্তু মৃতদেহে তার অবস্থান। ভেতরে তুমি। কে? নিথর, নিষ্পন্দ, দেহ খাঁচায় আমি মৃত্যু। আমি জীবনের সঙ্গেই থাকি। সময় হলেই জীবনকে ঠেলে বের করে দিয়ে দেহের দখলদারি নিই। নীল, হিমশীতল মৃত্যু আমি। আমাকে স্পর্শ কোরো না। জীবনের মতো আমিও এক মহাসত্য।
ঘরে ঘরে আলো জ্বলে উঠল। ভোগের বিছানা ছেড়ে সব নেমে এলেন। মেয়েদের পোশাকে তখনও ঘুম কুঁচকে আছে। সহবাসের সুখ। এ কী মহাবিদ্যু! মাঝরাতে কেউ মারা যায়! সেটা কী উচিত কাজ? টেলিফোনের ডায়াল ঘুরতে লাগল কড়কড় শব্দে। শহরের বিভিন্ন প্রান্তের। আত্মীয়স্বজনদের ঘুম নষ্ট হল। বড়কর্তা পরলোক গেছেন। দুটো বেজে দশ মিনিটে ট্রেন প্ল্যাটফর্ম ছেড়েছে। তোমরা সব এসো।
নাকের গর্তে তুলো গোঁজা হল। নাকের কাজ শেষ। চোখের পাতায় বসানো হল চন্দন-তুলসী। একখণ্ড গীতা রাখা হল বুকে। রথে দাঁড়িয়ে আছেন শ্রীকৃষ্ণ। তিনি বলে গেছেন, মানুষ জন্মায় না, মানুষ মরেও না। অবিনাশী আত্মা। সবই অঙ্গুষ্ঠ পরিমাপের এক জ্যোতির্লিঙ্গের খেলা। তাকে না যায় ছেদা করা, না যায় তাকে কচুকাটা করা, না যায় তাকে আগুনে পোড়ানো। অজেয় অমর, শাশ্বত। নিত্য-শুদ্ধ-বুদ্ধ-মুক্ত। চড়চড়ে রোদ উঠল, তবু চড়া পাওয়ারের আলোগুলো নেভানোর। কথা সবাই ভুলে গেল। দীপার মনে আছে, সে ঘুরে ঘুরে আলো নেভাচ্ছে, আর আত্মীয়, বন্ধুবান্ধবরা সব হাসছে সেজেগুঁজে, মালা, ফুলের রিং, বোকে নিয়ে। একেবারে উৎসবের মেজাজ। গাড়ির পর গাড়ি। দরজা বন্ধের ঢিসটাস শব্দ। কেউ কেউ ঢোকার আগে রুমাল ঘষে চোখ লাল করে নিচ্ছেন। মেয়েদের মধ্য কেউকেউ ফোঁস ফোঁস শব্দ করছেন। চোখে একটু জলও হয়তো আসছে। এরই মাঝে দীপার বড় পিসি এলেন। তিনি একটু আন্তরিকভাবেই কাঁদছিলেন। হাপরের মতোই শব্দ হচ্ছিল। বাবা বলছিলেন বারে বারে। শোনাচ্ছিল, ফাবা, ফাবা। বয়স্কা মহিলা। নানাবিধ ব্যাধিতে শরীর বিপর্যস্ত। তাঁকে ধরেছিলেন তাঁর স্বামী। রিটায়ার্ড ফরেস্ট অফিসার। মুখে অজস্র পাহাড়ি ভাঁজ। পাকানো গোঁফ। পেটানো চেহারা। বাঘ আর বউ দুটোকেই সমান ভালোবাসেন। গঙ্গার জল আর বোতলের জল দুটোরই সমান সেবা করেন। তিনি বউকে শান্ত করার চেষ্টা করছিলেন এই বলে, মান্তু অনেকদিন বেঁচেছেন, ফুল টার্ম ফুল টার্ম, আবার কী, আবার কী, রাইপ ওল্ড এজ। কেঁদে আর শরীর খারাপ কোরো না, তোমার আবার মাইগ্রেন আছে। এখুনি বমি শুরু হবে।
শান্ত করার আর প্রয়োজন হল না। তিনি এক ধাক্কায় ছিটকে পাশে সরে গেলেন। মেয়র এসেছেন। মেয়র। সারা বাড়িতে একটা ঢেউ খেলে গেল। লম্বা, কৃশ এক ভদ্রলোক, সাদা ট্রাউজার, কোট, পায়ে অক্সফোর্ড শু। চারপাশে চারজন স্তাবক। মশমশ করে ঢুকলেন। একজনের হাতে একটা পদ্মফুলের রিং। দীপার জ্যাঠামশাই আর কাকা কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। ধিতিং ধিতিং করে নাচছেন। সাধারণ আত্মীয়স্বজনরা ছিটকে সরে যাচ্ছেন। কাকা ইংরেজিতে বলছেন, ক্লিয়ার আউট, ক্লিয়ার আউট। জ্যাঠামশাই বলছেন, ভিড় হাটাও, ভিড় হাটাও।
মেয়র মৃতদেহ স্পর্শ করবেন না। ইনফেকশনের ভয় আছে। সঙ্গের একজনকে ইশারা করলেন। তিনি ফুলের রিংটা মৃতদেহের বুকের উপর রাখলেন। মেয়র একটা নমস্কার করে বললেন, ‘যথেষ্ট বয়েস হয়েছিল।’
সবাই বললেন, ‘তা ঠিক, তা ঠিক।’
‘এর পর আর বাঁচা উচিত নয়।’
‘অবশ্যই নয়, অবশ্যই নয়।’
‘আই লাইক টু ডাই ইয়াং।’
ভদ্রলোক হয়তো ষাটে পৌঁছেছেন। ভাবছেন ইয়াং। আহারাদি ভালোই হয়। রাতের দিকে দু পাত্তর স্কচ চড়ান। পার্টি পেছনে আছে। এত বড় একটা শহরের মালিক। যুবক তো বটেই। তাঁর এই ডাই ইয়াং শুনে সবাই হায় হায় করে উঠলেন, ‘মরবেন কী স্যার। আপনার মতো মানুষের। অমর হওয়া উচিত। জনগণ আপনাকে চায়।’
মেয়র বললেন, ‘সেটা কোনও কথা নয়। চায় বলেই যে বাঁচতে হবে এমন কোনও কথা নয়। আমার কথা, নড়বড়ে শরীরে বাঁচার কোনও মানে হয় না।’
সবাই বললেন, ‘তা ঠিক, তা ঠিক।’
মেয়র কথা বলতে বলতে মার্বেলপাথর বাঁধানো সিঁড়ি দিয়ে নামছেন। চামড়ার জুতো। স্লিপ না। করে। চারজন বডিগার্ড সতর্ক। এদিকে সার্ভিস দিলে ওদিকে আসবে। মানুষটার কাছ থেকে কত কী বাগিয়ে নেওয়ার আছে। এ তো মানুষ নয়, ভক্তবাঞ্ছা কল্পতরু।
দীপা একপাশেদাঁড়িয়ে সব দেখছে। বড়লোকের কী খাতির। বড় পিসিমা রেগে চলে যাচ্ছেন। হাইপ্রেসার। ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেলে কী হত! সেরিব্রাল অ্যাটাক। কে তখন দেখত আমাকে। মেয়র এসেছে তো কী হয়েছে। পিসেমশাই ঠান্ডা করার চেষ্টা করছেন, কাজের বাড়িতে এমন হয়। তোমার এই রাগটা একটু কমাও মান্তু।
এক ঝটকায় স্বামীর হাত সরিয়ে দিয়ে মান্তু বললেন, ওই জন্যই তো এই মড়াদের বাড়িতে আমি আসতে চাই না। নিজের বাপ, তায় আবার মারা গেছে, বলতে নেই তবু বলছি, কতগুলো জানোয়ারের জন্ম দিয়েছিল।
ছোটোর বউ পাশ দিয়ে যেতে গিয়ে শুনে ফেলল। সাপ যেমন থমকে দাঁড়িয়ে ফণা তোলে। সেইরকম ফোঁস করে উঠল, তার মধ্যে তুমিও পড়ো ঠাকুরঝি। তুমি যে কী সে তোমার স্বামী জানে।
আর তুই কী সে আমরা জানি ঢলানী মাগি। তোর গুণের তো ঘাট নেই। শ্বশুরের কোলে উঠে বসে থাকতিস।
আর তুই কী করতিস! ইলেকট্রিক মিস্ত্রিকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকতিস।
বুড়ো কত্তা ওদিকে খাটে কাঠ হচ্ছে, এদিকে দুই বাঘিনীর খামচাখামচি। মেয়েরা ঝগড়ার। সূত্রপাতেই তুই আর মাগিতে যাবেই যাবে। আর সব অপরাধের সেরা হল যৌন অপরাধ। আর। যত লুকিয়ে চুরিয়েই করো প্রকাশিত হবেই। অনেকটা চিকেন পক্সের মতো। ব্যাপারটার মধ্যে অন্য কিছু থাকলেও সেটাকে টেনে ওই একই লাইনে আনা হবে। আর দুজনের এই কাদা। ছোড়াছুড়ি দীপা শুনছিল। ভয় পাচ্ছিল। পৃথিবীটা বিশেষ সুবিধের জায়গা নয়। প্রশ্ন আসছিল মনে, এই কারণেই কী ঠাকুরদা কাকাকে একটু বেশি ভালোবাসতেন। জ্যাঠামশাই কী সেই কারণেই কাকিমার সঙ্গে কথা বলেন না। জ্যাঠাইমা কী সেই কারণেই কাকিমাকে সহ্য করতে পারেন না। দীপার মনে পড়ল, সে যখন আরও ছোটো ছিল, দেখত পিসিমার সঙ্গে একটা ছেলে আসত। ভালো চেহারা, কোঁকড়া চুল। পিসিমা কথায় কথায় তাকে আদরের চড় মেরে বলত, তুই থাম, আর জ্বালাসনি আমাকে। মেয়েমহলে গবেষণা হত পিসিমার কেন ছেলেপুলে হয় না। একটা কথা প্রায়ই শুনত, ঠাকুরজামাই ঢোঁড়া সাপ। ছোবল আছে বিষ নেই। দীপার মনে আছে পিসিমা খুব সাজতেন। গোড়ালিতে ঝামা ঘষতেন। দুধের সরের সঙ্গে কমলালেবুর খোলা বেটে সারা শরীরে লাগাতেন প্রায় বিবস্ত্র হয়ে। রেশমের তৈরি বক্ষবন্ধনী পরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখতেন। সামনে খোলা জানালা। বাগানের কোণে সার্ভেন্টস কোয়ার্টারে মালির ছেলের গোঁফ গজিয়েছে। সে হাঁ করে দেখছে।
সব কথা, উড়ো কথা, হেঁদো কথা। কোথাও না কোথাও একটু সত্য থাকেই। দীপা দেখেছে কাকিমাকে পাশবালিশ করে ঠাকুরদা শুয়ে আছে। খাটের পাশের টেবিলে খল, নুড়ি। চেটে চেটে মকরধ্বজ খেয়েছেন। ডিশে পড়ে আছে একটা খাস্তা কচুরি। বৃদ্ধ আলুর দম দিয়ে খাস্তা কচুরি। খেতে ভালোবাসতেন। কোনও কোনও মানুষ বয়েস বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেহে ফুলতে থাকেন। মনের দিক থেকে হয়ে ওঠেন পৈশাচিক। পয়সাঅলা লোকদের মধ্যে এটা খুব হয়। কারণ তাঁরা অধার্মিক। দেব-দেবীর পূজাঅর্চনার ঘটা করেন ঠিকই, সে সবই বিত্তবাসনায়। আকাঙ্ক্ষা একটাই —ধনদৌলত। নিজের অন্তরে স্নিগ্ধ, পবিত্র দেবভাব জাগিয়ে তোলার উদ্দেশ্যে নয়। দীপার ঠাকুরদা ষাটের পর এইরকমই হয়ে গিয়েছিলেন। সিল্কের লুঙ্গি, কাঁধকাটা গেঞ্জি পরে বেতের একটা চেয়ারে বসে থাকতেন। বসে বসে কেবল ভোগের কথা বলতেন। মেয়েদের শরীর নিয়ে কথা বলতেন। বহুকাল আগে এ-পাড়ার কোথাও একঘর বেশ্যা ছিল, তাদের কথা বলতেন। আর মাঝে মাঝে দীপাকে আদর করার চেষ্টা করতেন। দীপা তখন পালাবার পথ পেত না। মেয়েরা শৈশব থেকেই বুঝতে শেখে কোন আদরটা কেমন।
বেলা দশটা বেজে গেল, তখনও দীপার বাবা কিন্তু এলেন না। কলকাতার এক হোটেলে বসে আসেন অন্য জগতে। দীপা এখন বোঝে, ফেটাল ওম্যান কাকে বলে। বিষকন্যা, নাগিনী। কলেজে সে লুইসের ‘দি মঙ্ক’ বইটি পড়েছিল। পাঠ্য হিসাবে নয়, পড়তে বাধ্য হয়েছিল তার ইংরেজির অধ্যাপকের অনুরোধে। ছোট্টখাট্টো হাসিখুশি মানুষটি। অনেকটা পাকা নারকোল কুলের মতো দেখতে। চকচকে উজ্জ্বল। একমাথা কালো কোঁকড়া চুল। ছেলেমেয়েদের সঙ্গে বন্ধুর মতো মিশতেন। কোনও কৃত্রিম গাম্ভীর্য ছিল না। দীপার সঙ্গে অদ্ভুত একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। দীপা এখন বোঝে, সেই খোলামেলা, বালকস্বভাবের মানুষটিকে সে ভালোবেসেছিল। সবুজ মাঠের মতো, স্বচ্ছ জলে লুটিয়ে থাকা আকাশের মতো, ঝাঁকড়া একটা মহুয়া গাছের মতো। সেই কথাটা মুখ ফুটে বলতে পারেনি দীপা। লজ্জা করছিল। একজন অধ্যাপককে কী সেইভাবে ভালোবাসা যায়! সম্পর্ক যে গুরু-শিষ্যের। সেই অধ্যাপক ছিলেন অবিবাহিত। কলেজ স্ট্রিটের এক বনেদি বাড়ির তিনতলায় একা থাকতেন। দীপা প্রায়ই সেখানে যেত। লাশের খাটে গেরুয়া চাদরপাতা বিছানা। লাগোয়া ছাদে ছিল অ্যাসবেস্টারের ছাউনিতে একটা রান্নাঘর ও বাথরুম পাশাপাশি। রান্নাঘরে অন্য কোনও রান্নার ব্যবস্থাই ছিল না। ছোট্ট একটা টেবিলে চায়ের সরঞ্জাম। হিটার, কেটলি, কাপ-ডিশ, ছাঁকনি এইসব। কৌটোয় বিস্কুট, চানাচুরি, নিমকি। অনেকটা সন্ন্যাসীর আস্তানার মতো। ঘরে সবসময় বাতাবিলেবুর গন্ধ। খোলা ছাদে ব্যায়ামের সাজসরঞ্জাম—ডাম্বেল, বারবেল, মুগুর। অনেক সময় রামকৃষ্ণ মিশনের। সন্ন্যাসীরা আসতেন। তখন বেদ, বেদান্ত, উপনিষদ, গীতার চর্চা হত। স্বামীজি, ঠাকুরের নানা প্রসঙ্গ। দীপা মেঝেতে বিছানো দড়ির কার্পেটে বসে মুগ্ধ হয়ে শুনত। ওইসব আলোচনা তার ভীষণ ভালো লাগত। মনে মনে অন্য জগৎ থেকে ভিন্ন একটা বাতাস ভেসে আসছে। নীচে। কলেজ স্ট্রিটের ডাবপট্টির হইচই। কিছু উপরেই মশগুল আধ্যাত্মিক প্রসঙ্গ। একই বেঁচে থাকার কত প্রবাহ।
বন্ধুর মতো সেই অধ্যাপক রোমান্টিক অ্যাগনি বোঝাতে গিয়ে দীপাকে বইটি দিয়েছিলেন বাড়তি পাঠ্য হিসাবে। এক সাধুর পতনের কাহিনি। জীবকোষ কুরে কুরে খায় কামনার কীট। সুতো যদি কারও লাটাইয়ে থাকে, সে-লাটাই ধরা আছে রিরংসার হাতে। ও তার নড়াচড়া, ওঠাবসা সবই। সেই কামকুঞ্জে। সর্বনাশা আকর্ষণ তার। গভীর রাতে সেই কাহিনি দীপা পড়েছিল বিছানায় আধশোয়া হয়ে। নায়িকার নাম মাটিলভা। নায়কের নাম সন্ন্যাসী অ্যামব্রোসিয়া। ঘটনাস্থল একটি আশ্রম। অ্যামব্রোসিয়ার আশ্রমে মাটিলভা এসেছিল বৈরাগী, সমাজসেবিকা রূপে। ধরা যায়নি। তার আসল রূপ। কত প্রশংসা তার। নিঃস্বার্থ সেবিকাসুন্দরী। দিন যায়, সে তার প্রলোভনের জালে জড়াতে চায় আদর্শবাদী সন্ন্যাসীকে। তুমি ত্যাগী, চরিত্রবান, সংযমী। তোমাকেই আজি জয় করব। মাকড়সার জালে পতঙ্গের মতো। তোমার প্রতিরোধের দুর্গ ভেঙে যাবে। সেদিন ছিল চাঁদের আলোর রাত। আশ্রমের একটি গ্রামীণঘর। কালো পাথরে দুধের মতো লুটিয়ে আছে। চাঁদের আলো। মাটিলভা বলছে, এসো আমার বাহুবন্ধনে। ইন্দ্রিয়ের সেবাই পাশব ধর্ম। নিগ্রহ এক মানসিক ব্যাধি। নদী জানি যাবেই চলে সাগরের পানে। ঝিমঝিম নিশুতি রাত। পুরোনো। ফার্নিচারে ঘুণপোকার শব্দ। দূরপ্রান্তরে শেয়ালের ডাক। গির্জার নিঃসঙ্গ চূড়ায় রাতের আকাশ বাতাসে শীত। পাহাড়ের মাথায় বরফের কিরীট। যুবক সন্ন্যাসীর প্রতিরোধ, তুমি চলে যাও, এ আমার পথ নয়। আমি নিষ্পাপ, নিষ্কলঙ্ক সন্ন্যাসী।
সুন্দরী নায়িকা বলছে, সন্ন্যাসী। আমার হাতে কী দেখেছ?
চাঁদের আলোয় ঝিলিক মারছে চকচকে ছুরি। তুমি যদি প্রত্যাখ্যান করো, এই ছুরি আমি আমার বুকে বসাব। ফড়ফড় করে সে তার নানের পোশাকের বুকের দিকটা ছিঁড়ে ফেলল। বর্তুলাকার বুকের আধখানা ছিটকে বেরিয়ে এল।
লেখক বর্ণনা দিচ্ছেন। চকচকে ছুরির ফলা বাতাবিলেবুর মতো বাঁ-দিকের বুকে ঠেকানো। উঃ সে কী বুক! এই হল নারীর স্তন। চাঁদের আলো সোজা সেই বুকে এসে পড়েছে। সেই ঝকঝকে সাদা বুকের দিকে তাকিয়ে সন্ন্যাসী স্তম্ভিত। ঈশ্বর কী তার চেয়ে অন্য কোনও সৌন্দর্যের সন্ধান দিতে পারেন। শরীর মুচড়ে দিতে পারে অন্য কোনও এমন বস্তু। চোখ ফেরাতে পারছে না। তৃষ্ণা, আগ্রহ, আবেগ। একটা ক্ষীণ কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে, ছিঃ ছিঃ, তুমি সন্ন্যাসী। প্রলোভন, দেহবাসনা, পাপ। তাকিও না। কিন্তু আনন্দ। এ কী আনন্দ! সারা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে আগুন। ধমনীর রক্ত টগবগ করে ফুটছে। চোখে আগুন। বহুতর পাশবিক কামনায় শরীর কাঁপছে। মাত্র আড়াই হাত দূরে। সেই লোভনীয় প্রলোভন চাঁদের আলোয় ধকধক করছে। সন্ন্যাসী হঠাৎ আর্তনাদ করে উঠলেন, ‘দাঁড়াও। আমি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারছিনা। মোহিনী। তুমি দাঁড়াও, আমার সর্বনাশের জন্য তুমি দাঁড়াও।’
সন্ন্যাসী সেই সুন্দরীর ক্রীতদাসে পরিণত হলেন। আমি বলছি, তুমি করো। পাপ করো, ধ্বংস হয়ে যাও, সংসার, ঈশ্বর, সম্পর্ক সব ধুস। ইন্দ্রিয়ই একমাত্র সত্য। অপরাধেই বাঁচার উত্তেজনা। যে-অভিনেত্রীর ফাঁদে দীপার বাবা ধরা পড়েছিলেন সেই মহিলা ওই ম্যাটিলভার মতোই। রূপালি পর্দায় দীপা তাকে দেখেছিল। ভয়ঙ্কর একটা শরীর, অভিনয় যেমনই হোক। দীপা জানে, সত্য একটাই, দেহ, ইন্দ্রিয়, ইন্দ্রিয়ের দাসত্ব। ছেলে, মেয়ে, দাদা, বউদি কিছুই কিছু নয়। আমি খাব, আমি পরব, আমি রমণ করব, আমি অসুস্থ হব, আমি মরে যাব। এর বাইরে যা কিছু সব ভণ্ডামি। ওই যে অধ্যাপক, তিনিই বা কেন বইটা পড়তে দিয়েছিলেন দীপাকে। কোনও প্রয়োজন ছিল কী? তিনি পড়েছেন। পড়ার পর সেই চোখে দীপার দিকে তাকাচ্ছেন। সে এক ভয়ংকর অস্বস্তি! অমন করে কী দেখছেন? প্রশ্নটা মুখের উপর করা যায় না। কিন্তু প্রশ্নটা আসে।
দীপার বাবা এলেন সম্পত্তির ভাগ বুঝে নিতে। না, একান্নবর্তী পরিবার আর নয়। যে যার স্বাধীন। এমনকী, ব্যবসাও ভাগ করতে হবে। আমার আমার, তোমার তোমার।
জ্যাঠামশাই বোঝাতে চেয়েছিলেন, তুমি ধ্বংস হবে। তুমিও বাঁচবে না।
নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা বাড়িয়ে কারও মঙ্গল হবে? তুমি বরং তোমার শেয়ারটা আমাকে বিক্রি করে দাও। এই মাল খালাসের ব্যবসা তোমার ধাতে সইবে না।
দীপার বাবা টোপটা গিললেন। মাথায় তখন সিনেমা নাচছে। পরামর্শদাতা অনেক। দীপার বড় মামা এসে বললেন, মনে কর, তোর বাবা-মা দুজনেই মারা গেছে। তুই আমার সঙ্গে চ। দেখি তোকে মানুষ করা যায় কি না। এই তাসের বাড়ি এইবার ভাঙবে।
কলকাতার বন্দরে বড় জাহাজ আর তেমন ভিড়ছে না। আমদানি, রপ্তানি কমছে। ইংরেজ আমলের সেই বিপুল বোলবোলা আর নেই। ফিরবেও না কোনওদিন। দক্ষিণে নতুন নতুন বন্দর তৈরি হয়েছে। বড় জাহাজ সব ওই দিকেই ভিড়বে। এদিকে শুধু ইনকিলাব হবে।
দীপার জ্যাঠামশাই আর কাকা একটু আদিখ্যেতা করলেন লোক দেখানো। আসলে সবাই খুশি। বাপ আর মেয়ে দুজনেই ছাঁটাই। একটা চরিত্রহীন, আর একটা মা-মরা আদুরি। পরের দায়িত্ব কে ঘাড়ে নেবে। কলাগাছের মতো চড় চড় করে বাড়ছে। বখাটেরা তাকাতে শুরু করেছে। মায়ের মতো শরীর পেয়েছে, এখন বাপের মতো স্বভাবটা পেলেই হয়েছে আর কী! কে সামলাবে।
এইসব কথা প্রকাশ্যেই হল। যাও বাছা, বাপের সিনেমায় এইবার বুক খুলে নাচো। নায়িকা হও। বড়মামার হাত ধরে দীপা চলে এল মামার বাড়ি। দুই মামা। দাদু, দিদিমা। মামারা খুব মজার মানুষ। কারবারি, কিন্তু শিক্ষিত। গিরিডি আর কোডার্মায় মাইকার কারবার। পয়সার অভাব নেই। দুই ভাইয়ে খুব মনের মিল। বারগণ্ডায় বিশাল বাড়ি। ছবির মতো বাগান, লন। দীপা যেন। প্রকৃতিতে মুক্তি পেল। মুক্তি পেল সুস্থ জীবনে। বোতল নেই, গেলাস নেই, সিল্কের লুঙ্গি নেই, স্যান্ডো গেঞ্জি নেই। মাংসল দেহ নেই। খিস্তি, খেউড় নেই। সদা হাসিখুশি শান্ত একটা পরিবার। বড়মামার মেয়ে তুলি ছিল দীপারই সমবয়সি। সবসময় হেসেই আছে, ফুলের মতো ফুটেই। আছে, শুকোতে জানে না। শিশিরের মতো দুটো চোখ। বড়মাইমা সবসময় সেজেগুঁজে থাকেন, একেবারে টিপটপ। বাড়িটার কোথাও এতটুকু ময়লা নেই, দুর্গন্ধ নেই। মাছের কাঁটা পিপড়ে। টেনে নিয়ে যাচ্ছে, ইঁদুরে মাংসের হাড় নিয়ে ধস্তাধস্তি করছে, এ দৃশ্য চোখে পড়ছে না। প্রকাশ্য তারে ফাঁদালোশায়া বাতাসে ফুলে ফুলে উঠছে না। যেমন-তেমন ভাবে ব্যবহৃত বাথরুমে। মেয়েদের ভেঁড়া বুকের মতো বক্ষবন্ধনীর ঝুলে থাকা অসভ্যতা নেই। মামার বাড়িতে এসে দীপা ধরতে পারল তার মনের সংস্কারটা কী। সে বৈষ্ণব। শান্ত, দাস্য, সখ্য, মধুর এই চারটি ভাব তার মনে বাসা বেঁধে আছে। সে চায় মধুরকে। রাক্ষস স্বভাবের মানুষকে সে ঘৃণা করে। পৈশাচিক পরিবেশে তার প্রবল ভয়।
দীপার মেজোমামা ছিলেন আর এক সুন্দর মানুষ। গিরিডির নামকরা ডাক্তার। সাংঘাতিক প্র্যাকটিস। নাওয়া-খাওয়ার সময় নেই। তিসরি আর তার আশপাশের কয়লা ও মাইকা। মাইনসের শ্রমিকরা ভিড় করে থাকে। গলায় স্টেথিস্কোপ ঝুলিয়ে ডাক্তার ছুটে বেড়াচ্ছেন। টাকাপয়সা কে কী দিচ্ছে খেয়ালই নেই! মাঝে মাঝে মনের আনন্দে শিস দিতেন। ফাঁকা মাঠ পেলেই এক রাউন্ড ছুটে নিতেন। বলতেন, বাছুরের আনন্দ, ছাগল ছানার নাচ, বাচ্চা কুকুরের দুষ্টুমি—এই তিনটেকে এক করে নিজের ভিতরে ঠিক ঠিক আনাটাই হল সাধনা। পয়সায় কী হয়। গুচ্ছের খাওয়া হয়। তারপর বাথরুমে নামিয়ে দিয়ে আসা হয়। আনন্দই হল জীবের শ্রেষ্ঠ খাদ্য। থেকে থেকে চিৎকার করে গেয়ে উঠতেন,
আকাশভরা সূর্য-তারা বিশ্বভরা প্রাণ
তাহারি মাঝখানে আমি পেয়েছি মোর স্থান,
বড়োমাইমা আর মেজোমাইমাকে মনে হত দুই বোন। ‘দিদি, দিদি’ বলে সর্বক্ষণ পেছন পেছন ঘুরত মেজো। বড়র অনুমতি ছাড়া কিছু করত না। দুজনের মিল দেখে দীপা ভীষণ আনন্দ পেত। পৃথিবীর ভালো দিকটা দেখতে কী ভালো লাগে।
একটা আস্তাবল ছিল বিরাট। তিনটে তাগড়া ঘোড়া। চেস্টনাট ব্রাউন কালার। বড়মামা সেই ঘোড়ায় চড়ে দূর পাহাড়ের খনি অঞ্চলে চলে যেতেন রোজ সকালে। দুটো গাড়িও ছিল—একটা জিপ, একটা মোটর। দীপা নরক থেকে স্বর্গে এল। তার দাদামশাই কেন ওই বাড়িতে মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন? পয়সা দেখে, পয়সা ছাড়া ওদের আর কী আছে! যে বাড়িতে একটাও বই নেই সে বাড়ি কেমন বাড়ি। মা তার মরে বেঁচেছে।
বড়মামা মেজোমামাকে বললেন, দীপাকে কীভাবে মানুষ করা যায়। ওর তো মনে ভীষণ দুঃখ।
কীসের দুঃখ?
মা নেই, বাবা থেকেও নেই। এটা একটা কম কথা!
আমরা সবাই কী করতে আছি। ওকে আমরা ডাক্তার করব।
ওর মতো কোমল, ভাবুক মেয়ে ডাক্তার হতে পারবে না, ওকে আমরা অধ্যাপিকা করব।
আমার লাইনটা তাহলে লোপাট হয়ে যাবে।
তোর ছেলে হলে, ছেলেকে ডাক্তার করবি।
কবে হবে তার ঠিক নেই।
দীপার মনে আছে, টুকটুকে ফরসা মেজোমামা কাঁচা শাকসবজি, খোসাসুদ্ধ ফলপাকড় কশমশ করে চিবিয়ে খেতে খুব ভালোবাসতেন। তিনি কশমশ করে শশা খেতে খেতে আস্তাবলের দিকে চলে গেলেন। দুঃখ-দুঃখ মুখ। পাঁচ বছর বিয়ে হয়েছে কোনও ছেলেপুলে হয়নি। সেই কারণেই দীপাকে আঁকড়ে ধরতে চান। মাইকা মাইনে তখনও অনেক সায়েসুবো। ব্যবসা সূত্রে এই পরিবারের সঙ্গে তাদের খাতিরও যথেষ্ট। দীপাকে বিলেত পাঠিয়ে স্পেশ্যালিস্ট ডাক্তার করিয়ে আনতে পারলে আর কোনও ভাবনা থাকবে না। এখনও সময় আছে যা করার করে নাও। অ্যায়সা দিন নেহি রয়েগা। হঠাৎ মনে হল, কোন ভবিষ্যতের কথা ভাবছি। দীপা বড় হবে, তবে তো। ততদিনে বাঙালি শেষ হয়ে যাবে। সময় খুব নিষ্ঠুর।
দীপার আলাদা ঘর। পেছনের বারান্দায় দাঁড়ালে সীমানার ওপারে খোলা জমি দুহাত তুলে ছুটে চলে গেছে পরেশনাথ পাহাড়ের দিকে। শাল আর মহুয়ার জঙ্গল। লাল কাঁকর। হঠাৎ কোথাও বিশাল একটা পাথর। পাহাড়তল্লাট ছেড়ে সমতলে বেড়াতে এসে আর ফিরে যেতে পারেনি। দূর থেকে কে যেন ডাকে, দীপা।
মুক্তির ডাক।
দাদুর কাছে বসে রাতের বেলা দীপা বাঙালির গল্প শোনে। একশো বছরের পেছনের ইতিহাস। দাদুর ধবধবে সাদা চুলদাড়ি। বড় বড় উজ্জ্বল চোখ। সাদা পাঞ্জাবি। রূপকথার মানুষ যেন। মধুপুর থেকে গিরিডি আসার ব্রাঞ্চ লাইন পাতা হল ১৮৭১ সালে। সেই কাজের ঠিকাদারি পেয়েছিলেন হুগলি জেলার গোষ্ঠ কুণ্ডু। প্রকৃতির প্রেমে পড়লেন কুণ্ডুমশাই। তেমনই জলের গুণ। নির্মল বাতাস। গোষ্ঠবাবু গিরিডিতে জমিদারি কিনে ফেললেন। মধুপুরেও কিনলেন। এই ছোটনাগপুর অঞ্চলটার একটা মায়া আছে। মানুষকে বড় টানে। সন্ন্যাসিনীর মতো সুন্দরী। অবাঙালিরা এই গোষ্ঠবাবুকে বলত, ‘বাবু তো বাবু গোষ্ঠবাবু।’ ১৮৮২ সালে একদল জার্মান। এলেন। তখন তো জানাজানি হয়ে গেছে, গিরিডির মাটির তলায় সম্পদ আছে—তামা মাইকা উঁচু জাতের কয়লা। জার্মান সায়েবরা খোঁজ খোঁজ করে বারগান্ডায় খুঁজে পেলেন তামা। খোলা হল ‘বারগান্ডা কপার করপোরেশন’।
দাদুর কাছে সেকালের গল্প শুনতে শুনতে তার কল্পনা আরও ঘন হত। কল্পনার চোখে তৈরি হত অতীত চিত্র। দীপা সেই বিদেশিদের দেখতে পেত। শুনতে পেত পাথরে গাঁইতির শব্দ। বিদেশি বাংলোর লণ্ঠনের আলো। আদিবাসী রমণী। মহুয়ার গন্ধ। মাতাল ভালুক। আটবছর ধরে লোকসান দিয়ে নব্বই সালে জার্মান সায়েবরা কারবার গুটিয়ে ফেললেন। লোকসানের কারণ, যোগাযোগের তেমন ভালো ব্যবস্থা নেই। পথঘাটের অভাব। তামা পরিশোধনের জন্যে যে প্ল্যান্ট দরকার তাও বসানো গেল না। এই নব্বই সালেই বাঙালিরা এলেন। কিনে ফেললেন সায়েবদের যত বাংলো। এই বাঙালি সেটলমেন্টের নেতা ছিলেন, গিরিডির আদি বাসিন্দা তিনকড়ি বসু। তাঁরই আকর্ষণে বাঙালিরা ছুটে এলেন। তামার ব্যবসা যিনি কিনলেন তাঁর নাম জে এন দে। জে এন দে-র মেয়ে রেবা একজন নামকরা অভিনেত্রী।
এইসব শুনতে শুনতে দীপার চোখে ঘুম জড়িয়ে আসত। বাংলোটা তার দাদু কিনেছেন, সেটাও এক জার্মান সাহেবের ছিল। অনেকটাই অদলবদল করা হলেও, আদলটা বিলিতি। বড় বড় ঘর, টানা বারান্দা। ঘোরাফেরা করলেই মনে হয় বেশ উদার। কোনও সঙ্কীর্ণতা নেই।
দাদু খুব মিষ্টি করে বলতেন—দিদিভাই, তোমার খুব ঘুম পেয়েছে, চোখের পাতা ভিজে আসছে।
দীপা তার দক্ষিণের কোণের ঘরে এসে শুয়ে পড়ত। পরিষ্কার বিছানা, ধবধবে মশারি। দক্ষিণের জানালা দুটো ভোলা। শুয়ে শুয়ে ভাবত, দাদুর মতো সুন্দর মানুষ যেন হয় না। চোখের পাতা ঘুমে ভিজে এসেছে। সে কেমন? ঘুম কি কোনও তরল পদার্থ! এই দাদুর কাছ থেকেই দীপা পেয়েছিল কবির মন, ভাষা, উপমা। নারকোল গাছের ঝিরিঝিরি পাতার মতো চোখের পাতা। নারকোল গাছের পাতায় যখন চাঁদের আলো পড়ে জ্যোৎস্নার রাতে। তখন মনে হয় যেন ভিজে গেছে। চাঁদের আলো যেন তরল দুধ।
জানালার দিকে পাশ ফিরে আকাশ। আকাশের গায়ে আঁকা মহুয়ার টোপা টোপা পাতা। ফুলের গন্ধ নাকে নিতে নিতে, অদ্ভুত অদ্ভুত সব কল্পনায় ভাসতে ভাসতে দীপা চলে যেত ঘুমের দেশে। ঘুমের কোনও দেশ আছে? অবশ্যই আছে। মানচিত্রে মিলবে না। কিন্তু জল আছে, হল আছে, আছে কানন-পাহাড়। বিছানায় শুয়ে ঘুমে তলিয়ে যেতে যেতে দীপার মনে হত, এই সময় কোনও নরম শরীর যদি তাকে জড়িয়ে ধরত। নরম শরীরের উষ্ণতা। পিঠের কাছে নরম একজোড়া বুকের ভারী শ্বাস-প্রশ্বাসের ওঠাপাড়া। নরম একটা জানুর তার কোমরের কাছে চেপে বসা। তার বুকের কাছে লেগে থাকা নরম একটা হাত। মুক্তো যেমন ঝিনুকের শ্লেষ্মর আবরণে মাখামাখি। হয়ে থাকে, রাতের নির্জন অন্ধকারের কোলে সেইভাবে থাকা ঘাড়ের কাছে খোপার নীচে ঠেকে থাকা একটা নাকের নরম নিঃশ্বাস। এই নেশাটা ধরিয়ে দিয়ে গেছে সেই মহিলা, যে তার ঠাকুরদার সেবা করত কলকাতার বাড়িতে। সাদা ব্লাউজ, সাদা শাড়ি। শরীরে ওষুধের গন্ধ। ঘামের গন্ধ, চুলের গন্ধ। কী একটা মশলা চিবোতো। মুখে সেই মশলার গন্ধ। পুরু দুটো ঠোঁট। জোড়া ভুরু। অন্ধকার কালো চোখ। সেই দেহের আলিঙ্গন, উত্তাপে দীপার শরীর ঘেমে উঠত। সে পাশ ফেরার সময় দীপাকে জড়িয়ে ধরেই পাশ ফিরত। দীপা তার শরীরে উপর দিয়েই। এপাশ থেকে ওপাশ চলে যেত। সে তার পিচ্ছিল ত্বকে হাত বোলাতে বোলাতে বলত, তোর স্কিন সিল্কের মতো। তোকে ছেড়ে আমি থাকব কেমন করে। এই কথা বলে সে পাগলের মতো আদর করত। তখন তাকে মনে হত নারী-পুরুষ। বিছানার চাদর কুঁচকে যেত। বালিশ ছিটকে চলে যেত খাটের বাইরে। সেই আদরের হাতে দেহ-সমর্পণ করতে দীপার খুব ভালো লাগত। মনে হত। সবটাই অন্যরকম। স্বাভাবিক নয়। একটু ভয়ের; কিন্তু খুব মজার, ভীষণ আরামের।
এই একলা ঘরে, সাদা বিছানায় শুয়ে দীপার সেই অভাববোধটা ফিরে আসত। একটা আকাঙ্ক্ষা। এপাশ-ওপাশ করতে করতে একসময় ঘুম। পাশের ঘরেই মেজোমামা। আলো জ্বলছে। কিছুটা ছিটকে গিয়ে লেগেছে গাছের পাতায়। অনেক রাত পর্যন্ত মেজোমামা লেখাপড়া করতেন। দেশ বিদেশের ডাক্তারি ম্যাগাজিন বই। এই অঞ্চলের মানুষের সাধারণ চিকিৎসায় এতটা জ্ঞানের প্রয়োজন হয়তো ছিল না। কিন্তু জ্ঞানের স্পৃহা ছিল অসীম। মানুষের শরীরই তো জটিল এক দর্শন। অদ্ভুত সব ভাবনা আসত। অনেক সময় উদ্ভট।
এমন যদি হত, হঠাৎ কোনও ভাইরাসের আক্রমণে মানুষের বাইরের আবরণটা হয়ে গেল কাচের মতো স্বচ্ছ গ্লাসকেস। ভাইরাসটার নাম যদি হয় ফ্লোরেসেন্ট ভাইরাস। ডাক্তার ধীরে ধীরে কল্পজগতে প্রয়াণ করতেন। দু-হাত দূরে বিছানায় অকাতর ঘুমে তার সুন্দরী, শিক্ষিতা স্ত্রী। ট্রান্সপারেন্ট। ডাক্তার তার অ্যানাটমির জ্ঞান নিয়ে দেখতে পাচ্ছে। কালচে লাল, থলথলে একটা হৃদয় থির থির করছে। একাধিক আবরণে আবৃত। আবরণের পাটে পাটে এক ধরনের তরল পদার্থ। বুকের খাঁচার ভিতর একটু তেরছা করে আটকানো। তলায় পরদা উপরে আবরণ। দিন নেই রাত নেই ধক ধক করে চলেছে। ভাঁজে ভাঁজে জমে থাকা তরল পদার্থ যেন তেলের কাজ করে। পিচ্ছিল, হড়হড়ে করে রেখেছে। ওঠাপড়ার সময় আটকে না যায়। মুষ্টিবদ্ধ হাতের মতো পাঁচ ইঞ্চি লম্বা, সাড়ে তিন ইঞ্চি চওড়া। মেয়েদের হার্টের ওজন আট আউন্স, ছেলেদের দশ আউন্স। চারটে নল আটকানো।
সেই নলের চেহারা মোটেই সুদৃশ্য নয়। কিড়িকিড়ি। রিং রিং। সারা শরীর ভ্রমণ করে রক্ত হার্টে ঢুকছে। স্বচ্ছ মানুষের স্বচ্ছ আবরণের অন্তরালে শরীরের যাবতীয় যন্ত্রপাতি দৃশ্যমান। একটা। ভয়। এসব কী! মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। দিবারাত্র কাজ করে চলেছে। হার্টের দু-পাশে ঝিল্লির আচ্ছাদনে দুটো ফুসফুস। বিচিত্ৰদৰ্শন দুটো বেলুনের মতো। গাছের শিকড়ের মতো শিরা উপশিরা জড়িয়ে আছে। শ্বাস-প্রশ্বাসের নিয়মিত ছন্দে ফুলছে আর চুপসে যাচ্ছে। রক্তকণিকায় মিশছে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন। অক্সিজেন সমৃদ্ধ রক্ত লক্ষ লক্ষ শিরা-উপশিরার পথ ধরে শরীরের বিভিন্ন খণ্ডে ছুটে চলেছে। ডাক্তার তাঁর ঘোরলাগা চোখে দেখতে পাচ্ছেন। গঙ্গা, যমুনা, সরস্বতী, কাবেরী, নর্মদা, গোদাবরী। কলস্বিনী রক্তনালিকা। মূল স্রোতধারা থেকে বেরিয়ে আসছে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ধারা। বাহিকা। নীল ধমনী। মিনিটে ষাট থেকে আশি, এই হল হৃদয়ের স্পন্দন ছন্দ। সেকেন্ডে একবার অথবা একের একটু বেশি। একবার ধক করা মানেই একশো তিরিশ। কিউবিক সেন্টিমিটার রক্ত হৃদয় থেকে বেরিয়ে গেল। তার মানে মিনিটে পাঁচ লিটার রক্ত পাম্প করছে হার্ট। একজন মানুষ যদি একশো বছর বাঁচে, তা হলে এই বিশ্বস্ত ক্ষুদ্র পাম্পটি ছ-লক্ষ টন রক্ত টানবে আর ছাড়বে। চল্লিশ কোটি হবে স্পন্দন সংখ্যা। ডাক্তার নিজেই ঘাবড়ে গেলেন। বুকের বাঁপাশে বসে আছে এই অবিশ্বাস্য শক্তিশালী যন্ত্রটি। সারাদিন ঘুরছি ফিরছি, অথচ একবারও খেয়াল হচ্ছে না। কে চালায়, আমি চলি বা কেন। হৃদয় কী ভয়ংকর শক্তি তোমার। পঁয়ত্রিশ সের ওজন মাটি থেকে একফুট তুলতে আমার মাংসপেশিকে যে-শক্তি খরচ করতে হয় সেই শক্তি তুমি প্রতি মিনিটে প্রয়োগ করছ। আমার হাত আর পায়ের পেশির শক্তির চেয়ে। তোমার শক্তি দ্বিগুণ বেশি। আমি ক্লান্ত হব কিন্তু তুমি অক্লান্ত কর্মবীর। তোমার শক্তির উৎস আজও খুঁজে পায়নি শরীরতত্ববিদ।
মেজোমামা গভীর রাত পর্যন্ত নিজের ঘরে বসে বসে কী করেন দীপা জানে না। মেজোমাইমাও জানেন না। ঘুমোতে ঘুমোতে মাঝে মাঝে চোখ খুলে বলেন, ‘এ কী এখনও আলো জ্বলছে, তুমি শোওনি। কী করছ কী এখনও?’
—তুমি ঘুমোও, আমাকে বুঝতে দাও, হোয়াই আই ব্রিদ। কে আমাকে প্রথম প্রভাতে বলেছিল, বাছা শ্বাস নাও। এই আমি চালিয়ে দিয়ে গেলাম। ইচ্ছে থাক আর না থাক, এ চলবে। শ্বাসই জীবন। আমিই আবার একদিন বন্ধ করে দিয়ে যাব। তখন তোমার ধমনীতে আর এক ফোঁটাও রক্ত থাকবে না। তাজ্জব কী বাত! কোথায় গেল সব রক্ত।
—তুমি বসে বসে ওই সব ছাইপাঁশভাবো, আমি ঘুমোই।
—সেই ভালো। জানলেই তুমি পাগল হয়ে যাবে।
প্রাচীনকালের শরীরতত্ববিদদের কথা মনে পড়ে গেল ডাক্তারের। কবর থেকে মৃতদেহ তুলে এনে ফালাফালা করে দেখছেন কোথায় কী আছে। সাধারণ মানুষের চোখে তাঁরা পিশাচ। মৃতদেহ কেটে তাঁরা শরীরের ছবি তৈরি করছেন, অ্যানাটমি। হাড়ের খাঁচার রহস্য সন্ধান করছে। মাইকেল অ্যাঞ্জেলো স্কেচবুকে নকশা আঁকছেন। অধ্যাপকের গোপন ঘরে কঙ্কাল ঝুলছে। কতিপয় ছাত্র। তারা কঙ্কালতত্ব বোঝার চেষ্টা করছে। মৃত মানুষের ধমনিতে রক্ত নেই দেখে তাঁরা সিদ্ধান্ত করলেন, জীবন্ত মানুষের এই নালিকায় বাতাস থাকে। এর নাম রাখো আর্টারি। পরে যখন জ্ঞান আরও হল, জানা গেল, না, ধমনি হল এক একটি রক্ত নদী, তখন কিন্তু নামটা আর বদলানো হল না। এয়ার ট্র্যাক্ট, আর্টারিই রয়ে গেল। ডাক্তার আর ভাবতে চাইলেন না। শুয়েই পড়ি বলে স্ত্রীর পাশে এসে শুয়ে পড়লেন। পাশ ফিরে শুয়ে আছে রমণীয় একটি নারী দেহ। গৌরবর্ণ তৃক। তার তলায় একপুরু মেদ, মাংসপেশি। শিরা, ধমনী, কঙ্কাল। এর কোথায় আছে প্রেম, প্রীতি, সৌন্দর্যবোধ। এ তো একটা যন্ত্র। তবু কেন তোমাকে এত ভালোবাসি। মানুষ কি তা হলে মানুষের ভিতরে নেই। মানুষের অনুভূতি কি বাইরে আছে!
নিশীথ রাতের আকাশে। নদীর বুকের উপর দিয়ে বহে যাওয়া বাতাসে। স্ত্রীর চওড়া পিঠে হাত রেখে ডাক্তার শুয়েছিলেন। আবার উঠে বসলেন ধড়মড় করে। তাকিয়ে আছেন দেয়াল ঘড়িটার দিকে। ঘড়িতে কি সমস্যার সমাধান আছে। প্রশ্ন আছে। মহা প্রশ্ন। সময় কোথায় আছে। ঘড়ির ভিতরে, না বাইরে? ঘড়ির কাঁটাদুটো আর ডায়ালের অক্ষরগুলো খুলে নিলে কী হয়। নির্বোধ টিক টিক। স্প্রিং, পিনিয়ন, হুইল, ব্যালেন্স। একটা যন্ত্রমাত্র। সময় তো আছে মহাকালের স্রোতে। সময় আছে মানুষের বেঁচে থাকার বোধে। যন্ত্র, কাঁটা, অক্ষর তিনের মিলনে সময়। ভাষাতে কি মনের ভাব প্রকাশ পাবে যদি না বোধ দিয়ে সাজানো যায়। যদি বলি, গেলাস, পাথর কাঠ। পাথরের গেলাসে মেঘের জল, তা হলে কত কী প্রকাশিত হল একই সঙ্গে। শব্দের পিছনে কণ্ঠযন্ত্র যন্ত্রমাত্র, বোধটাই সব। এই বোধ তো যন্ত্রে নেই। দেহযন্ত্রে জীবন আছে, অ্যাকশন, মোশন আছে। চেতনা কোথায় আছে, বোধ আর বোধি কোথায় আছে। জন্ম আর মৃত্যু তো মানবসভ্যতা নয়, যুদ্ধ বিগ্রহ, সাম্রাজ্যের উত্থান-পতন, সাহিত্য-সংস্কৃতি, নৃত্য-গীত সবই তো বোধের প্রকাশ। তা যদি না হত, তা হলে কীটেরও তো সভ্যতা তৈরি হত। নর্তকীর নৃত্য তার শরীরে আছে, না। সবোধে মুদ্রায়। তাই যদি না হবে, তা হলে পিস্টনের ওঠাপড়াকেও তো নাচ বলতে হয়।
একটা হাত ডাক্তারকে সস্নেহে বিছানায় টেনে নিল—’আর নয়, এইবার ঘুমোও। ভোর হয়ে এল। সারাটা দিন তোমার কোনও বিশ্রাম নেই।’
ডাক্তার স্ত্রীর কোলে ঢুকে যেতে যেতে ভাবছেন, এই কথাটা কে বলছে! একটা শরীর, যে শরীরের বর্ণনা আছে অ্যানাটমির পাতায়! না কখনওই না? এর উৎস অন্য কোথাও। গঙ্গা একটা নদী, হিমালয় থেকে সাগরে দিকে ছুটে চলা জলধারা। আর দেবী! সুরেশ্বরী ভগবতীগঙ্গে, সেই গঙ্গা
তো মানুষের বোধে। দীপার এই মেজোমামা দিন দিন এক অসাধারণ মানুষ হয়ে উঠতে। লাগলেন। কী যেন একটা খুঁজে বেড়াচ্ছেন! অর্থ, সম্মান, ভোগ, প্রতিপত্তি নয়। একটা উত্তর খুঁজছেন। রুগি দেখতে দেখতে ভাবেন, আমার কী করার আছে। যন্ত্র যিনি চালু করেছেন তিনিই বেঁধে দিয়েছেন আয়ু। যেদিন বন্ধ হবে সেদিন বন্ধ হবে। ভিতরে কলকবজা কার নির্দেশে চলছে! তোমরা জানো না, তোমাদের ভিতরে কী আছে! পেট একটা ল্যাবরেটারি, দুটো ফুসফুস তোমার হাপর, হার্ট শক্তিশালী এক পাম্প, কিডনি বিশাল এক ছাঁকনি, আর মস্তিষ্ক তোমার ব্রহ্মাণ্ড, ঘাড়ের পেছনে চেতনার ‘কেবল লাইন’। এসব আমরা ডিসেকট করে জেনেছি; কিন্তু জানতে পারিনি প্রথম শ্বাস তুমি কার ইচ্ছায় নিলে। ডাক্তার রুগি দেখেন, ভিজিট নিতে পারেন না। কার ডাক্তারি কে করে!
ডাক্তারের কেবলই মনে পড়ে জেনেসিসের কাহিনি। হয়তো সেইখানেই আছে তাঁর প্রশ্নের উত্তর।
এই জগকারণের পিছনে আছে এক ইচ্ছাশক্তি। লেট দেয়ার বিলাইট, অ্যান্ড দেয়ার ওয়াজ লাইট, অ্যান্ড ইট ওয়াজ গুড। মহা মহা অন্ধকার শূন্যে কে যেন ফিশফিশ করে বললেন, তমসো মা জ্যোতির্গময়। আলো আমার আলো। আলোয় ভুবন ভরে গেল। শতকোটি সূর্যের দীপ্তি। দিনের সূর্য, রাতের নক্ষত্র। জল, স্থল। সমুদ্র, নদী। প্রাণ, প্রাণী, লতাগুল্ম, স্থলচর, নভোচর। সৃষ্টির ষষ্ঠ দিবসে তৈরি করলেন শ্রেষ্ঠ জীব মানুষ। পৃথিবীর ধুলো থেকে পরম যত্নে। নিজের সামনে তাকে শোয়ালেন। তখনও নিষ্প্রাণ। দেন হি হিমসেলফ ব্রিদভ দিব্রদ অফ লাইফ ইনটু ইট। নাকের ছিদ্রপথ দিয়ে ঢুকিয়ে দিলেন প্রাণবায়ু। চোখ মেলে তাকাল প্রথম মানব। সেই এক আজ কোটি কোটি অনন্ত যাত্রাপথ।
দীপাকে বললেন, ‘এই নে পড়। জোরে জোরে। আমাকে শোনা।’
রবীন্দ্রনাথ। ‘মহাস্বপ্ন’। দীপা পড়ছে, তিনি শুনছেন চোখ বুজিয়ে।
পূর্ণ করি মহাকাল পূর্ণ করি অনন্ত গগন,
নিদ্ৰাময় মহাদেব দেখিছেন মহান স্বপন।
বিশাল জগৎ এই প্রকাণ্ড স্বপন সেই,
হৃদয়সমুদ্রে তাঁর উঠিতেছে বিশ্বের মতন।
উঠিতেছে চন্দ্রসূর্য, উঠিতেছে আলোক আঁধার,
উঠিতেছে লক্ষ-লক্ষ নক্ষত্রের জ্যোতি-পরিবার।
উঠিতেছে, ছুটিতেছে গ্রহ উপগ্রহ দলে দলে,
উঠিতেছে, ডুবিতেছে, রাত্রিদিন আকাশের তলে।
একা বসি মহাসিন্ধু চিরদিন গাইতেছে গান,
ছুটিয়া সহস্র নদী পদতলে মিলাইছে প্রাণ।
দীপা দেখত মেজোমামার চোখ বেয়ে জল নামছে। দেহ স্থির। সবটা শোনার পর চোখ চেয়ে বলতেন, ‘বুঝলি, রবীন্দ্রনাথের সত্যদর্শন হয়েছিল। যত পড়বি, তত আনন্দ পাবি।’
মেজোমামা দীপাকে ভীষণ ভালোবাসতেন। কোনও সময় কাছছাড়া করতেন না। বলতেন, ‘তোর মধ্যে আমি একটা অন্য জগৎ তৈরি করে দিয়ে যাব। শুয়ে শুয়ে ভাববি, তোর গায়ে সবুজ ঘাস গজিয়েছে, বিশাল এক গাছের শিকড় তোর মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। নদী বয়ে যাচ্ছে। সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ছে। তুই হয়ে গেছিস আকাশ। সূর্য, চন্দ্র, নক্ষত্র ফুটে আছে সেই আকাশে।’
দীপাকে তিনি ভর্তি করে দিলেন রবীন্দ্রসংগীত শিক্ষার ক্লাসে। গিরিডিতে তখন বড় বড় মানুষের বাস। রবীন্দ্র বাতাস। ব্রাহ্মসমাজ। ব্রাহ্মমন্দির। উপাসনা। ঈশ্বরকে মানুষ তিনভাবে ধরতে চায় —গুণ সাকার, সগুণ নিরাকার, নিগুণ নিরাকার। ব্রাহ্মবাদে তিনি সগুণ নিরাকার। অখিল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের স্রষ্টা তুমি। মেজোমামা দীপাকে নিয়ে ব্রাহ্মসমাজে যেতেন। তিনকড়ি বসু ছিলেন। আদি বাসিন্দা। তিনিই গড়ে তুলেছিলেন এই বাঙালি উপনিবেশ। কলকাতা থেকে যেসব বিশিষ্ট বাঙালি এখানে এসেছিলেন, তাঁদের অধিকাংশই ছিলেন ব্রাহ্মসমাজভুক্ত। নববিধান আর সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ দুটি ভিন্ন উপাসনা মন্দিরের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মেজোমামা দীপাকে নিয়ে নববিধানে যেতেন। পরিবেশটা দীপাকে খুব মুগ্ধ করেছিল। মহুয়ার বাতাস। শাল, সেগুনের প্রহরা। বোগেনভেলিয়ার বর্ণ বিস্ফোরণ, গোলাপের আভিজাত্য। এর মাঝে সুসংযত, শিক্ষিত নারী-পুরুষের মিলন। সবাই স্ব-স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। সারস্বতচর্চাই তাঁদের ধ্যানজ্ঞান। স্বয়ং। রবীন্দ্রনাথ মাঝে মাঝে অবসর কাটাতে চলে আসতেন বারাগাণ্ডায়। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দশকের সেই বোলবোলা দীপার সময়ে স্তিমিত হয়ে এলেও কিছুটা ছিল। মন্দির জীর্ণ। বাইরের দেয়ালে সময়ের শ্যাওলা। উপাসনা কক্ষে ধুলো আর ঝুল। কাঠে আর পালিশের জেল্লা নেই। তবু মিলন। অতীতকে ধরে রাখার চেষ্টা। এইখানেই মাঘ মাসের সন্ধ্যায় একজনের সুরেলা কণ্ঠে দীপা শুনেছিল ব্রহ্মসংগীত। মোহিত হয়ে গিয়েছিল। মেজোমামা কানে কানে বলেছিলেন, গানটির লেখক বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর। সেই সংগীতের পথে দীপা এক অন্যজগতে চলে গিয়েছিল। যে জগৎ ছিল তার মেজোমামার, পরে দীপা ওই গানটি শিখেছিল সুরমাদির কাছ থেকে। ওই গানটিকেই সে করতে চেয়েছিল তার জীবনের টাইটেল মিউজিক।
অসীম রহস্য মাঝে কে তুমি মহিমাময়!
জগৎ শিশুর মতো চরণে ঘুমায়ে রয়।
এই গানের আসরে সময় পেলেই বড়মামাও এসে যোগ দিতেন। সেজন্যই হয়তো চলে এসেছেন তাঁর অভ্রের কারখানা থেকে। সেখানে একটা বিশাল পালভারাইজার আছে। একপাশে একা দাঁড়িয়ে আছে খাণ্ডোলি পাহাড়। একটু দূরেই একটা লেক। নীলজলে ভাসছে আকাশের ছবি। সেখানে সারাদিন যন্ত্রে চূর্ণ-বিচূর্ণ হচ্ছে অভ্রের পাত। কারখানার বাতাসে ভাসছে অভ্রের রেণু। বড়মামার চুলে, জামা চিকচিক করছে অভ্রের কুচি, যেন জড়োয়ার মানুষ। বড় বড় চুল। বড় বড় টানা টানা চোখ। জীবনের নেশাদুটো—অভ্র আর সাহিত্য। ইংরেজিটা ভীষণ ভালো জানেন। প্রবন্ধ লেখেন, রম্যরচনা লেখেন। গান ভালোবাসেন, ভালোবাসেন কবিতা।
বড়মামা এলেই আসর যেন আরও জমে উঠত। গানের সঙ্গে গলা মেলাবার চেষ্টা করতেন। গানের এক-একটা লাইন শুনে, ‘আহা আহা’ করে উঠতেন। ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলতেন, ‘কী রিয়েলাইজেশান দেখেছিস! বসে আছি পৃথিবীতে, তুলে নিয়ে যাচ্ছেন মহাবিশ্বে। রবীন্দ্রনাথ ইজ রবীন্দ্রনাথ।’ মাথা হেঁটে করে বসে থাকতেন। ভাবের ঘোরে দুলতেন। সারা শরীরে লেগে থাকা অভ্রের রেণু চিকচিক করত। মনে হত জীবন্ত দেবতা, এইমাত্র ভক্তির অঞ্জলি নিয়ে এসে। বসেছেন। দুই মামা পাশাপাশি বসে আছেন। এ ওর গায়ে হেলান দিয়ে। এদিকে একের পর এক গান চলেছে। দীপার মাঝে মাঝে মনে হত পৃথিবীটা কি সত্যিই এত সুন্দর! এত মিল, এত ভালোবাসা! দুই মাইমার একসঙ্গে ওঠা-বসা। ঋষির মতো দাদু। ছবির মতো সাজানো বাড়ি! সব কিছু ঝকঝক করছে, যেন এই মাত্র কেনা হল। নিখুঁত বাগান। লন। রোদ ছাতা। তার বাড়িতে সব কিছু আছে, বেশি বেশি আছে, যত্ন নেই। কাজের লোকগুলি শয়তান। একটা এলোমেলো, বীভৎস, দুর্গন্ধী সংসার। লেখাপড়ার বালাই নেই। গান-বাজনার ধার ধারে না কেউ। টাকা, খাওয়া, ঘুম আর ঝগড়া। দীপা একদিন দাদুকে জিগ্যেস করেছিল, অমন একটি বাড়িতে মায়ের বিয়ে দিয়েছিলেন কেন? দাদু স্বীকার করেছিলেন, ‘জীবনের হিসাব ওই একটা ব্যাপারেই ভুল হয়ে গিয়েছিল। পয়সাটাই দেখেছিলুম, কালচারটা দেখিনি।’
মেজোমামা একদিন দীপাকে বললেন, ‘চল দীপা আজ তোকে একটা জায়গায় নিয়ে যাব। সেজেগুঁজে রেডি হয়ে নে। আমি গাড়িটা বের করে আনি।’
প্রথম শীতের মিষ্টি দুপুর। দীপা এসেছিল ছন্নছাড়া চেহারা নিয়ে। সেই চেহারায় লালিত্য এসেছে। চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়েছে। সে এখন হাসতে পারে, অভিমান করতে পারে। তার চারপাশে এখন ভালোবাসার অনেক লোক। মুখভার করে থাকলে তুলি এসে কাতুকুতু দেয়। মাইমারা ছুটে এসে জানতে চায় শরীর খারাপ কি না। দিদা এসে চুলের পরিচয্যা করেন। দাদু বলেন মজার মজার কথা। দীপা তার জীবনের মূল্য ফিরে পেয়েছে। দীপা দীঘল হয়েছে।
গাড়ি এসে গেল। দীপা সামনের আসনে মেজোমামার পাশে গিয়ে বসল। প্রশ্ন করল, কোথায় যাবে। রাস্তার দুপাশে বড় বড় নামকরা মানুষদের বাড়ি। হেরম্বচন্দ্র মৈত্রের ‘কমল-আবাস’। উলটোদিকে প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের ‘মহুয়া’, সেকালের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সুরেশচন্দ্র। সরকারের ‘উপলপথ’। ডাক্তার নীলরতন সরকারের ‘মাঝলা কুঠি’। যোগীন্দ্রনাথ সরকারের ‘গোল কুঠি’। এই ‘গোল কুঠি’-র কাছে এলেই দীপার মনটা কেমন হয়ে যায়। সেই বিখ্যাত লেখক হারাধনের দশটি ছেলে। কোন ছেলেবেলায় দীপা পড়েছিল। গাড়ি জনপদ পেরিয়ে ফাঁকা মাঠে এসে পড়ল। বড়মামা বেশ বলেন, মাঠ যেন দু-হাত তুলে ছুটতে ছুটতে আকাশের কোলে গিয়ে পাথর হয়ে গিয়েছে। সত্যিই তাই, বহুদূরে কোথাও টিলা দেখলে মনে হয়, একটা শিশু আকাশের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে।
জঙ্গল শুরু হল। মাঝখান দিয়ে রাস্তা। দুপুরবেলাতেও ঝিঝির ডাক। দুটো কান ঝমঝম করছে। শাল, সেগুন, মহুয়া, বট, অশ্বখ। ফাঁকে ফাঁকে রোদ নেমেছে। গাড়ি কখনও উপরে উঠছে কখনও নামছে নীচে। ঢালুতে নামার সময় মেজোমামা স্টার্ট বন্ধ করে দিচ্ছেন। বৃষ্টির জলে রাস্তার দু পাশে ক্ষয়ে ক্ষয়ে গিয়েছে। নালা তৈরি হয়েছে। একটু অসাবধান হলেই গাড়ি পাশ ফিরে শুয়ে পড়বে।
মেজোমামা জিগ্যেস করছেন, ‘কি রে দীপা, তোর ভয় করছে?
‘একটুও না। ভীষণ ভালো লাগছে।’
‘দেখছিস তো, ভয়ের মধ্যেও একটা ভালো লাগা থাকে। যেমন ধর কালো। কালোর মধ্যে কিন্তু সব রং আছে।’
রাস্তা শেষ। মেজোমামা গাড়ি রাখলেন। সামনে ঘন জঙ্গল। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে সঁড়িপথ চলে গিয়েছে। বেশ ঠান্ডা। শীতের কনকনে বাতাস। শুরু হল পায়ে হাঁটা। দুপাশে বড় বড় পাথর। পথও পাথরে। উঁচু-নীচু। জায়গায় জায়গায় মারাত্মক রকমের ঢালু। একটু অসাবধান হলেই গড়িয়ে পড়ে যেতে হবে। এত গাছ! দীপার চোখ যেন ঘোর লেগে যাচ্ছে। পৃথিবী কী ভয়ংকর রকমের উর্বর। জমির এত প্রাণ। মেজোমামা হঠাৎ গান ধরলেন,
প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে
মোরে আরো আরো আরো দাও প্রাণ।
তব ভুবনে তব ভবনে
মোরে আরো আরো আরো দাও স্থান।
দীপা অবাক হয়ে গেল, মেজোমামার এত সুন্দর গলা! ‘তুমি গান গাও না কেন?’
‘গান!’ মেজোমামা একটা বড় পাথরের ওপর বসে পড়লেন, ‘গান!’ দু-চোখে জল টলটল।
‘তুমি কাঁদছ কেন?’
‘তোর মা এই গানটাই এখানে গেয়েছিল এইরকম এক শীতের বেলায়। তার মাকে ওরা মেরে ফেলল। তোর মায়ের গান শুনলে তুই পাগল হয়ে যেতিস। মাকে মনে পড়ে?
‘খুব আবছা।’
‘আয়নার সামনে দাঁড়ালে তুই তোর মাকে দেখতে পাবি। অবিকল তোর মতো।’
মেজোমামা একটুক্ষণ থমকে থেকে বললেন, ‘তোর মা তোরই মতো ফিকে হলুদ রং পছন্দ। করত। তোরই মতো ধীর, শান্ত। তোরই মতোনীচু গলায় কথা বলত। লাজুক লাজুক মুখে তাকিয়ে থাকত। কখনও কিছু চাইত না। একেবারে ঠিক আমার মায়ের মতো স্বভাব। বাড়িতে আছে কী নেই বোঝা যায় না।’
চারপাশে গভীর অরণ্য। ঝিল্লির রব। পাতা ঝরে পড়ার খসখস শব্দ। দীপার মেজোমামা টিলার উপর বসে আছেন। পায়ের পাশ দিয়ে লেজ খাড়া করে চলে যাচ্ছে শুকনো গিরগিটি। আশ্চর্য। একটাই, কোথাও কোনও পাখি ডাকছে না। মেজোমামা মুখ তুলে বললেন, ‘দীপা পেছনে থাক। সময়ে পিছিয়ে যা। দশ বছর, বারো বছর, পনেরো বছর। তোর মা বসে আছে এই টিলার উপর। আমি তোর মায়ের পায়ের কাছে। ওইখানটায় বসে আছে দাদা। বাবা আর মা পাশাপাশি। আমার পাশে বউদি। তোর মেজোমাইমা তখনও আসেনি জীবনে। কলেজে পড়ছে। দৃশ্যটা দেখার চেষ্টা কর। এই পাথরে তার স্পর্শ লেগে আছে। সেই সময়ে যে-গাছগুলি ছিল চারা আজ তারা বিশাল সাবালক। একজন ছিল, এখন নেই, কিন্তু তার না থাকাটাকে অনেকে ধরে রেখেছে। সে না থেকেও আছে। বুঝতে পারছিস ব্যাপারটা! নেইটাকেও কাঁধে নিয়ে পৃথিবী এগোচ্ছে।’
দীপা অবাক হয়ে মেজোমামার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। এত সব বোঝার বয়স তার হয়নি, তবু মনে হল এইসব কথার মধ্যেই আসল কথা আছে। মেজোমামা তাকে বাইরের ঘর থেকে ভিতরের ঘরে নিয়ে যেতে চাইছে। সেদিন রাতে স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা থেকে মদালসার কাহিনি শোনাচ্ছিলেন। মদালসা রানি হয়েছেন। রাজাকে বলেছেন আমার সংসার। করতে আপত্তি নেই কিন্তু একটি শর্ত যে সন্তান মানুষ করবার ব্যাপারে তুমি কোনও বাধা দিতে পারবে না। রাজা বললেন, বেশ তাই হোক। তোমার শর্ত মেনে নিলুম। জন্মের পর থেকে। মদালসা শিশুকে দোলনায় দোল দেন আর বলেন, ‘ত্বমসি নিরঞ্জন!’ —তুমি শুদ্ধ, নিরঞ্জন আত্মা।
এতে কী লাভ?
মহা লাভ, আবাল্য শিশুর সংস্কার গড়ে উঠল যে সে নিরঞ্জন।
নিরঞ্জন মানে?
কলঙ্কহীন, নির্মল, শিব। সংসার তোমাকে কাবু করতে পারবে না। রোগ, শোক, দুঃখ, জরা বাইরে দিয়ে চলে যাবে, যেন ফেরিঅলা হেঁকে যাচ্ছে। এই গল্পটা তোকে কেন শোনাচ্ছি, যাতে তোর মনেও এইরকমই একটা সংস্কার তৈরি হয়।
আজ এই নির্জন বনে একটা শিলার উপর বসে মেজোমামা এমন কিছু বলছেন যা অনেক দূরের কথা। মানুষের ভিতরটাকে অন্যরকম করে দেয়। ভিতরে একটা চাপা দুঃখ তো আছেই, একটা অভাববোধ। নিজের বাড়ি আর মামার বাড়িতে একটা তফাত তো থাকবেই। যদিও তুলির সঙ্গে তার কোনও পার্থক্যই মামারা রাখেনি, তবু নিজের মন থেকে সে যে পরের বাড়ির মেয়ে, ওই বোধটা একেবারে যায়নি। নিজের বাবার কথা ভেবে কুঁকড়ে যায়। না দেখতে আসুক, না আসুক, এক পক্ষে ভালো, কিন্তু একটু ভেবে দেখলে মনে হয় দীপাকে ফুটপাথে ফেলে দিয়ে তিনি অন্য একটি মেয়ের সঙ্গে মজা করতে চলে গিয়েছেন। এমন বাবার পরিচয় নিয়ে পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে ভালো লাগে?
‘নাঃ, তোর মনটা খারাপ করে দিলাম, নে চ, আরও কিছু দূর যেতে হবে।’
মেজোমামা উঠে পড়ে হাঁটতে লাগলেন। এবার ধরেছেন অন্য গান। সেই অপূর্ব সুরেলা গলা। গাছের পাতায় উতলা বাতাসের মাখামাখি। মেজোমামা গাইছেন :
আর কত দূরে আছে সে আনন্দধাম।
আমি শ্রান্ত, আমি অন্ধ, আমি পথ নাহি জানি।।
রবি যায় অস্তাচলে আঁধারে ঢাকে ধরণী
করো কৃপা অনাথে হে বিশ্বজনজননী।।
এই গান দীপাব্রাহ্মসমাজে শুনেছে। মেজোমামা তার চেয়ে ভালো গাইছেন। কানে আর একটা নতুন শব্দ আসছে, জল পড়ার শব্দ। অজস্রধারায় কোথাও জল পড়ে চলেছে। ঢালু পথ বেয়ে তারা নামছে। বনের মধ্যেই বড় টেবিলের মতো খোলা একটা জায়গা। অল্প অল্প ঘাস, বড় ছোট পাথর, রোদ, আর সামনেই ত্রিধারায় নামছে জলপ্রপাত। বড় বড় পাথরের উপর দিয়ে। নেমে নেচে আসছে জলধারা। হেসে কলকল, গেয়ে খলখল, তালেতালে দিয়ে তালি। বাঁ দিক। থেকে পাথরের আড়ালে আড়ালে দামাল এক বালিকার মতো ছুটে আসছে একটি ধারা। প্রখর তেজ। জল ছিটকে ছিটকে উঠছে। মূল ধারাটি নামছে সামনে। উপরের একটা চাতাল ধরে। হরিনাম সঙ্কীর্তনের দলের মতো খোল-করতাল বাজিয়ে ছুটে সে কিনারা বেয়ে ঝরে পড়ছে। অবিরল ধারায়। আর একটি ধারা নামছে একেবারে অন্যপথে। অনেকটা নীচে তৈরি হয়েছে। গভীর একটি হ্রদ। সেই হ্রদ উপচে ডান দিকের শিলাপথ ধরে বয়ে গিয়েছে নদী, তার নাম উশ্রী। এই উশ্রীকে নিয়েই কবি সুনির্মল বসু লিখেছেন,
মনে পড়ে অতীতের স্মৃতি অনাবিল
উশ্রী নদীর জল করে ঝিলমিল
আমলকী বনে বনে ছায়া কাঁপে ক্ষণেক্ষণে
শিরশির করে উঠে ‘শিরশিয়া ঝিল’!
কবি সুনির্মলের বাড়ি দীপা দেখেছে। সামনে মনোরঞ্জন গুহঠাকুরতার বাড়ি। লম্বা লম্বা সিঁড়ি। পিছনেই পশুপতি বসুর ছোট্ট একতলা। বড় বড় কাঁঠাল গাছের ছায়ায় আশ্রমের শান্তি। কবির বাস এইখানেই।
মেজোমামা একটা চ্যাটালো পাথরে ধ্যানাসনে বসে দীপাকে ডেকে বললেন, ‘বোস এখানে, প্রকৃতি দেখ। প্রকৃতির সর্বত্র পরমেশ্বরের আনন্দের প্রকাশ। ঝরনার মতো উপছে পড়েছে। জায়গাটা তোর ভালো লাগছে না?
‘ভীষণ ভালো লাগছে মেজোমামা। মনে হচ্ছে এইখানেই থাকি আর কোথাও যাব না।’
‘তাহলে একটা গান শোন।’
মেজোমামা গাইতে লাগলেন,
‘আমি কান পেতে রই ও আমার আপন হৃদয় গহন-দ্বারে বারে বারে
কোন গোপনবাসীর কান্নাহাসির গোপন কথা শুনিবারে বারেবারে।।
ভ্রমর সেথা হয় বিবাগী নিভৃত নীল পদ্ম লাগি রে,
কোন রাতের পাখি গায় একাকী সঙ্গীবিহীন অন্ধকারে বারেবারে।।
দীপা আর থাকতে পারল না। সেও গলা মেলাল। সামনে কলকল ঝরনা। একসময় মনে হল। দীপা প্রকৃতির সঙ্গে এক হয়ে গিয়েছে। আমি আকাশ হয়ে গিয়েছি। নীল নীল বাতাসের অনিবার ছোটাছুটি। পা থেকে মাথা পর্যন্ত পবিত্রতার তরঙ্গ খেলছে। দেহের সমস্ত দুয়ার খুলে গিয়েছে। পাখি উড়ে যাচ্ছে ডানা মেলে। দীপার চোখে জল এসে গিয়েছে। এত সুখ শেষপর্যন্ত থাকবে তো! তার কানের কাছে সবাই ঘণ্টার মতো বাজিয়ে গিয়েছে ঘোষণা, মেয়েটা অপয়া। দুর্ভাগা। অনেকে শরীরের লক্ষণ মিলিয়ে তার জাত ঠিক করেছে, পদ্মিনী। শঙ্খিনী নয়, হস্তিনী নয়, পদ্মিনী। এ মেয়ের সংসার হবে না। তখন দীপার হয়ে বলার কেউ ছিল না।
অঝোর ঝরনার মতো মেজোমামা অঝোরে গেয়ে চলেছেন। একসময় গান থামিয়ে বললেন, ‘চল, এইবার সাধুর ডেরায় যাই।’
বাঁদিকে একটা ভয়ংকর বিপজ্জনক সঁড়িপথ সোজা উপর দিকে উঠে গিয়েছে। বড় বড় পাথর। কোনওটা আলগা হয়ে ঝুলছে। দু-পাশে ঝোপঝাপ। খুব সাবধানে দুজনে উঠছে। অনেকটা ওঠার পর চাতালের মতো একটা জায়গা। সেখানে পাথরের উপর পাথর সাজিয়ে একটা কুঠিয়া। খুব নীচু হয়ে ঢুকতে হয় এইরকম একটা দরজা। চারপাশে পাথর ছড়িয়ে একটা বেদি। উশ্রীতে পাথরের অভাব নেই। একেবারে পাশ দিয়ে লাফাতে লাফাতে ফুটতে ফুটতে নীচের দিকে গড়িয়ে নামছে ঝরনার একটি শাখা। বাঁপাশে বিশাল একটা তেঁতুল গাছ। তার তলাতে বেদি।
মেজমামানীচু হয়ে কুঠিয়ায় ঢুকলেন। পিছনে দীপা। ভিতরটা অন্ধকার অন্ধকার। কম্বল বিছানো। তার উপর বসে আছেন শীর্ণকায় এক সাধু। পরিধানে গেরুয়া। সামনে একটা স্লেট পেনসিল। মেজোমামাকে দেখে সাধু স্লেটে লিখলেন, ওয়েলকাম।
মেজোমামা পাথরের উপর বসলেন, পাশেদীপা। মেজোমামা বললেন, ‘থ্যাঙ্ক ইউ।’ দীপাকে দেখিয়ে বললেন, ‘আমার ভাগনী।’
সাধু হাসলেন। দীপার মনে হল, হাসিটার জাত আলাদা। ছেলেমানুষের অকারণ আনন্দের হাসির মতো। শরীর শীর্ণ হলেও প্রদীপ্ত মুখ, উজ্জ্বল চোখ। তাকিয়ে আছেন অথচ দেখছেন না কিছুই। এইরকম একটা ভাব। সুদূর দৃষ্টি। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে অস্বস্তি হয়।
মেজোমামা বললেন, ‘একটা-দুটো কথা জিগ্যেস করতে পারি?
সাধু ঘাড় দুলিয়ে বোঝাতে চাইলেন, ‘পারো’। মেজোমামা প্রশ্ন করছেন মুখে সাধু উত্তর দিচ্ছেন স্লেটে লিখে ইংরেজিতে। দীপা পাশে বসে শুনছে আর দেখছে।
মেজোমামা প্রথমে জানতে চাইলেন, ‘মানুষ কী চায়?’
উত্তর এল, ‘মানুষ প্রথমে চায় বাঁচতে। তারপর সে ভালো যা কিছু পায়, অর্থাৎ সে নিজে যা কিছু তার পক্ষে ভালো মনে করে, সেইটাই আরও বেশি করে চাইতে শেখে। যেমন টাকা পেলে আরও আরও টাকা পেতে চায়। বিষয়-সম্পত্তি পেলে আরও পেতে চায়। যশ-খ্যাতি পেলে আরও পেতে চায়। আগে সে পায়, তারপর সেই পাওয়ার ফল দেখে সে চাইতে শেখে। সবার আগে সে চায় বাঁচতে। আগে জীবন দিয়ে সে ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্ট খোলে। সেইটাই তার মিনিমাম ব্যালেন্স। সেইটাকে বজায় রেখে তারপর যত কিছু সঞ্চয়ের ভাবনা।’
‘মানুষ দুঃখও কি চায়?’
‘ওটা চাইতে হয় না, আপনিই আসে। টাকার কি একটা পিঠ? দুটো পিঠ নিয়েই টাকা। টাকা চাইলে এপিঠ-ওপিঠ দুপিঠই তোমার কাছে আসবে। সুখের উলটো পিঠেই আছে দুঃখ। এটাকে চাইলেই ওটা এসে যাবে। যেমন ফুল চাইলে ফুলের গন্ধ আসবে। ভ্রমর চাইলে তার গুঞ্জন। আসবে। শিশু চাইলে তার ক্রন্দন আসবে। পাখি চাইলে গান আসবে। সাপ চাইলে তার ছোবল আসবে। টাকার সঙ্গে ট্যাক্স আসবে। ছাতার সঙ্গে ছায়া আসবে। রোদের সঙ্গে গরম আসবে। বন্ধুর সঙ্গে শত্রু আসবে। বরফের সঙ্গে শীতলতা আসবে। বাতাসের সঙ্গে ধুলো আসবে। আগুনের সঙ্গে দাহিকা শক্তি। জলের সঙ্গে আর্দ্রতা। কৃষ্ণের সঙ্গে রাধা। পুরুষের সঙ্গে প্রকৃতি। যুগলে আছেন। দুঃখ, যন্ত্রণা মানুষ চায় না। কিন্তু সহ্য করতে শেখে। এই সহ্যের শক্তিটা মানুষের মধ্যেই আছে। ভোগে মানুষ খরচ করে, সহ্যে মানুষ অর্জন করে। দুটো দরজা। ভোগের দরজা। দিয়ে শক্তি বেরিয়ে যায় আর সহ্যের দরজা দিয়ে শক্তি ঢোকে।’
‘আমার কাছে এটা খুব পরিষ্কার হল, এখন আমাকে বলুন, এরই মাঝে পরমানন্দে কীভাবে বাঁচা যায়?’
‘গ্রহণ করতে শিখুন। দুঃখ এবং সুখ, শান্তি এবং অশান্তি, অসুখ এবং আরোগ্য দুটোকেই। সমানভাবে নিতে শিখুন। জয় এবং পরাজয় দুটোতেই অবিচলিত থাকুন। জীবন যখন যা কুড়িয়ে পাচ্ছে তখন সেইটাকেই পরম প্রাপ্তি বলে মেনে নিতে শিখুন। তাহলেই আনন্দ। গেল গেল, হল না, হল না, ওর হল আমার হল না এই ভাবটাই নিরানন্দের কারণ। বৃষ্টিতে ভিজতে হবে, রোদে পুড়তে হবে, শীতে কুঁকড়ে থাকতে হবে—এইটাই সত্য। এইটা দর্শন করার নামই সত্য দর্শন। এইটাকে অতিক্রম করার সাধনাই হল যোগ। আর এই যোগ অভ্যাস করাই হল সাধনা। কোনও কিছু আশা না করাটাই হল শ্রেষ্ঠ করা। যা পাওয়া যায় সেইটা পাওয়াই হল শ্রেষ্ঠ পাওয়া।’
মেজোমামা জিগ্যেস করলেন, ‘আমরা এত ভয় পাই কেন?’।
সাধু লিখলেন, ‘ভয় পেতে শেখানো হয়েছে বলেই ভয় পাই। সমস্ত ভয়ের পিছনেই আছে মৃত্যু চিন্তা। মৃত্যুকে বন্ধু করতে পারলেই ভয়কে জয় করা যায়। মানুষের উপর বিশ্বাস হারানোটাই আতঙ্কের।’
‘আমি কোন পথে চলব?’
‘পথ বলে কিছু নেই। সবটাই প্রান্তর। চলার চেয়ে স্থির থাকার চেষ্টাই ভালো। পাথর যত গড়ায় ততই তার ক্ষয় হয়। শ্যাওলা ধরে না। জ্ঞানের শ্যাওলা ধরাতে হলে স্থির থাকতে হবে। পথ পড়ে থাকে। মানুষই চলে চলে ক্লান্ত হয়। বিচারের পথই শ্রেষ্ঠ পথ। নিজেকে জানাই শ্রেষ্ঠ জ্ঞান। যে সাধু হবে সে সাধুই হবে। যে ভোগী হবে সে ভোগীই হবে। যে চোর হবে সে চোরই হবে। যার যা পথ সে সেই পথেই যাবে। এ নিয়ে অকারণ ভাবার কোনও প্রয়োজন নেই।’
‘তাহলে মানুষের চেষ্টা বলে কিছুই থাকবে না?’
‘অবশ্যই থাকবে। আমি যা নই সেইটা ভাবার চেষ্টা করাই চেষ্টা। নিজের স্বরূপটাকে ধরার চেষ্টাই চেষ্টা। ধরতে পারলেই শান্তি।’
‘তাহলে মানুষ ভালো হবে কী করে?’
‘যে ভালো হবে সে ভালো হবে, যে খারাপ সে খারাপই হবে। গেরুয়ার তলায় ভোেগী লম্পট থাকতে পারে। স্বভাব পোশাকে নেই মনে আছে। ভদ্রলোকের পোশাকে ইতরও ঘুরতে পারে।’
‘আপনি আমাকে বদলে দিন।’
‘বদলানো যায় না। যে বদলাবার সে নিজেই বদলে যায়। কুঁড়ি নিজে থেকেই ফুল হয়। শুঁয়োপোকা নিজে থেকেই প্রজাপতি হয়। মানুষ যদি রূপান্তর চায় তাকে প্রার্থনা করতে হবে। গুরুর কিছু করার ক্ষমতা নেই। কৃপা ছাড়া কিছু হয় না।’
মেজোমামা সব শেষে বললেন, ‘এই মেয়েটিকে একটু আশীর্বাদ করবেন।’
সাধু ইশারায় দীপাকে কাছে ডাকলেন। দীপা ভয়ে ভয়ে কাছে এগিয়ে গেল। এমন সাধু সে কখনও দেখেনি। কোনও মন রাখা কথা নেই। সব প্রশ্নেরই কাটা কাটা উত্তর। সাধুর শরীর থেকে সুন্দর সাত্বিক একটা সুবাস বেরোচ্ছে। দীপার মাথায় হাত রাখতেই একটা শক্তির তরঙ্গ খেলে। গেল শরীরে। দীপা কেমন যেন হয়ে গেল। মনটা সেই মুহূর্তে হয়ে গেল ভোরের আকাশের মতো। সাদা একটা পাখি চক্কর মারছে ডানা মেলে। কেমন যেন শীত শীত করছে। দুঃখও নয় সুখও নয় ভারমুক্ত একটা অনুভূতি।
সব শেষে সাধু লিখলেন, ‘এই মুহূর্তে তোমার যদি কোনও অনুভূতি হয়ে থাকে আর তা যদি তোমার ভালো লেগে থাকে, সেই অনুভূতিকে তুমি দীর্ঘস্থায়ী করার চেষ্টা করতে পারো। এর জন্য প্রয়োজন পবিত্র জীবন।’
দীপাকে খুব সহজ উপমায় সাধুবুঝিয়ে দিলেন, দেহের আকাশ হল মন। চিন্তা হল মেঘ।
একেবারে মেঘশূন্য নির্মল মনাকাশ সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। দেখতে হবে মেঘের রং যেন সাদা থাকে। ধারণাই হল সূর্য। সেই ধারণার দীপ্তিতেই মেঘ সাদা হয়, সোনালি হয়। শুভ্র। চিন্তাকে ধারণা করো। ইন্দ্রিয়ের জানালা দিয়ে জগতকে দেখোনা। উপরের জানালা, স্কাইলাইট দিয়ে দেখো। উঁচুতে উঠতে পারলে মানুষ অনেকটা দূর দেখতে পায়। দি সেম আই সে টু মাই ডক্টর।
মেজোমামা কুঠিয়া ছেড়ে বেরিয়ে আসার আগে সাধুর সামনে মাথাটা নীচু করে দিয়ে বললেন, ‘টাচ মি।’
সাধু স্লেটে লিখলেন, ‘আজ উলটোটা হোক। আপনি আমাকে স্পর্শ করুন। দেখি কি ভাইব্রেশন আসে।’
মেজোমামা স্পর্শ করলেন। হাত রাখলেন সাধুর ব্রহ্মতালুতে। হাত যেন ম্যাগনেট আটকে রইল বহুক্ষণ। সাধু বসে আছেন চোখ মুদে, স্থির। বেশ কিছুক্ষণ থাকার পর মেজোমামার হাত খুলে গেল। দুজনে দুজনের দিকে তাকিয়ে রইলেন। সাধু হাসলেন। মেজোমামা হাসলেন।
সূর্য অস্ত নেমেছে। অক্লান্ত, অফুরন্ত উশ্রী লাফিয়ে লাফিয়ে চলেছে। ডুরে শাড়ি পরা চপলা বালিকার মতো। আকাশের রঙে দিবাবসানের রহস্য জমছে। দূরের গাছ শাখা-প্রশাখার খুঁটিনাটি হারিয়ে শুধুমাত্র একটি আকারে পরিণত হচ্ছে। বিশাল বিশাল শিলাখণ্ড যেন আরও ভারী হয়ে উঠছে। নিস্তব্ধতা ভেঙে ফেলার ভয়ে পাখিরা আর শব্দ করছেনা। ইঞ্জিন বন্ধ গাড়ি নিঃশব্দে। গড়িয়ে চলেছে ঢালুপথ বেয়ে। মেজোমামা স্টিয়ারিং-এ স্থির। পাশে বসে আছে দীপা।
গাড়ি খাড়াইতে উঠবে। ইঞ্জিনে ইগনিসনের শব্দ। যন্ত্রের শক্তি গর্জন করে উঠল।
দীপা বলল, ‘মেজোমামা, এসো না, আজ রাতটা আমরা এইখানেই থেকে যাই।’
‘আমারও তো ওইরকম ইচ্ছে করে, ওই তেঁতুলতলায় সাধুর কুঠিয়ার কাছে সারারাত বসে থাকব ধুনি জ্বালিয়ে। মাথার উপর পিচ কালো আকাশ। তারায় ভরা। অন্ধকারে ঝরনার কলকল শব্দ। কোনও বন্যপ্রাণী এসে জল খাচ্ছে। চকচক আওয়াজ। বনের ভিতর আগুনের গোলার মতো দুটো চোখ। অন্ধকারের পাঁচিল ঘেরা নিভৃত একখণ্ড বন। কত কী হয়তো দেখা যায় ওই সময়টায়। কত অলৌকিক কাণ্ডকারখানা। ভাবি, কিন্তু সাহসে কুলোয় না। চড়া আলো, পাকা বাড়ি আর সংসারের আদরে থাকতে থাকতে ভীতু হয়ে গেছি রে দীপা। থাকতে বাধ্য না হলে থাকতে পারব না।’
‘সাধু কী করে আছেন। আমরা তো চলে এলুম উনি তো একা।’
‘সেই কারণেই উনি সাধু।’
গাড়ি ছুটছে শহরে দিকে জোর গতিতে। গাছগুলো সব ঘুরতে ঘুরতে ছিটকে পিছনে চলে যাচ্ছে। গভীর রাতে দীপা একা বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগল সাধু এ কী বললেন। যে যা হবে সে তা হয়েই এসেছি। লেখাপড়া শিখে সবাই পণ্ডিত হতে পারে, কিন্তু সে চোর হবে না সাধু হবে, দয়ালু। হবে না নিষ্ঠুর হবে, সেটা ঠিক হয়ে আছে। সে কী হবে, কেমন হবে সেটা তার কপালে আগেই। কেউ লিখে দিয়েছে। চেষ্টা করলে পণ্ডিত হওয়া যায় সাধু হওয়া যায় না। সেটা অন্য ব্যাপার। দীপার কেমন যেন ভয় করতে লাগল। নিজের বাড়ির কথা মনে পড়ে গেল। সবার আগে মনে পড়ে গেল বাবাকে। একদিন টেলিফোনে কথা বলছেন সেই মহিলার সঙ্গে। খেয়াল নেই যে ঘরের আর এক ধারে দীপা টেবিলে বসে লেখাপড়া করছে। সে কী নরম নরম, মিষ্টি মিষ্টি কথা। মানুষটার মুখের চেহারা অন্যরকম হয়ে গিয়েছে। চোখ দুটো আধবোজা। ঢোলা হাতা পাঞ্জাবি, ফাঁদালো পাজামা পরনে। কবজিতে সোনার ব্যান্ড লাগানো নীল ডায়ালের দামি ঘড়ি। আঙুলে হীরের আংটি ঝিলিক মারছে। এমন এমন সব কথা বলছেন যা কোনও মেয়ের শোনা উচিত নয়। নরম কোলে শুয়ে বেড়াল যেমন ঘড়ঘড় করে গলাটা অনেকটা সেইরকম। টেলিফোনেই আদর করছেন। দুপুরেই একবার দেখা করার অনুমতি চাইছেন। পায়ে ধরছেন। বলছেন, তোমার লাথির দাম লাখ টাকা। বলছেন, তোমার গাড়ি বুক করে দেওয়া হয়েছে। কালই হয়তো ডেলিভারি দেবে। তা হলে আজকের দিনটা তুমি আমার সঙ্গেই থাকবে। তুমি আর আমি।
দীপা আড়ষ্ট হয়ে বসেছিল টেবিলে। নিজেকেই অপরাধী মনে হচ্ছিল। এইসব ভয়ংকর কথা তার শোনা উচিত হয়নি। একটা মানুষ যে কিনা তার বাবা, একটা বাজারি মহিলার শরীরের জন্যে পাগল হয়ে গিয়েছে। দশ হাত দূরে মেয়ে বসে আছে, কোনও দৃকপাত নেই। দুপুরে দেখা হলে কী কী করবে তার খোলাখুলি বর্ণনা। সেই সব শুনে দীপার শরীর হিম হয়ে গিয়েছিল। একটা। মেয়েকে একজন পুরুষ এইভাবে ব্যবহার করবে। সে সহ্য করবে। তার বদলে সে একটা গাড়ি পাবে, হিরে পাবে, অনেক টাকা পাবে।
দীপা চিত হয়ে শুয়ে আছে বিছানায়। খাটটা এত বড় যে তিনজন পাশাপাশি শুলেও আরও একজনের জায়গা থাকবে। একেবারে একা সে। ঘরের তিন পাশের জানালা খোলা। তিন দিকেই গাছপালা। মহুয়া, দেবদারু, আমলকী, কাঞ্চন। পাতায় পাতায় বাতাসের কানাকানি। নিশ্চিদ্র। অন্ধকার। দীপা নিজের শরীরে হাত রাখল। এই শরীর! বুক, পেট, বাহুঁ, কণ্ঠদেশ, ঠোঁট। এই শরীর পুরুষরা ছিঁড়ে খেতে চাইবে। বন্ধুত্ব করবে। বলবে প্রেম। চিঠি লিখবে। বেড়াতে নিয়ে। যাবে, রেস্তোরাঁয় খাওয়াবে, উপহার দেবে। লক্ষ্য কিন্তু একটাই। বর্বরতা। হাত দিয়ে নিজের শরীরের বিভিন্ন স্থান স্পর্শ করতে করতে দীপার মনে হল কোথাও একটা ভালো লাগার ব্যাপার আছে। একটা অনুভূতি সারা শরীরে চারিয়ে যাচ্ছে। একটা কাঁপুনি আসছে। একটু কিছু জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে। ভীষণ একটা আবেগ, দুঃখ, নিঃসঙ্গতা, যন্ত্রণা, আনন্দ। দীপা বিছানায় উঠে বসল। একটু আগে শীত শীত করছিল, এখন গরম। আবার মনে পড়ল। সাধুর কথা। মানুষ যা হতে এসেছে, তাই হবে; যেমন সাপ সাপ হবে, বাঘ বাঘ। তা হলে! তাই কি বারে বারে সেই নার্সকে মনে পড়ে। মনে হয় সে কাছে থাকলে খুব ভালো হত। সে ছিল নেশার মতো। দীপার ভিতরটা হু হু করে উঠল। শরীর আগুনের মতো গরম। মনে হচ্ছে, সব পোশাক খুলে ফেলে। আবার সেই কাঁপুনি। পা থেকে মাথা পর্যন্ত। দাঁতে দাঁতে শব্দ হচ্ছে। অসহায়ের মতো বাইরে তাকাল। মেজোমামার জানালা দিয়ে আলোর একটা আভা বাইরের বাগানে গাছের পাতায় মিহি সিল্কের মতো জড়িয়ে আছে। জেগে আছে এখনও।
দীপা খাট থেকে নামল। অন্ধকারেই আন্দাজ করে এগিয়ে গেল দরজার দিকে। ছিটকিনি খুলে। বাইরে এল। বিশাল লবি। অন্ধকারে সোফা-টোফা জমাট বেঁধে আছে। ঘড়ির টিকটিক। মার্বেল পাথরের ভেনাস। সাইড টেবল, কর্নার টেবল, সেন্টার টেবল। জায়গাটা হা হা করছে। অশরীরী কেউ ছিল যেন! এখনও হয়তো আছে। দীপাকে লক্ষ করছে।
দীপার সঙ্কোচ হচ্ছিল, তবু সে মেজোমামার দরজায় টোকা মারল। মেজোমামা কে, বলে দরজা খুলে দীপাকে দেখে অবাক হলেন, ‘কী রে! তুই! ঘুমোসনি এখনও! ভয় পেয়েছিস?’
দীপা ফিশফিশ করে বলল, ‘একবার আসবে আমার ঘরে?’
‘কী হয়েছে বল তো, সাপখোপ কিছু বেরিয়েছে?’
‘ওসব কিছু নয়, তুমি এসো।’
দীপার পিছনে মেজোমামা। দীপা আলো জ্বেলে দরজা ভেজিয়ে দিল। মেজোমামার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, ‘দ্যাখো তো গাটা জ্বর এসেছে কি না।’
মেজোমামা কপালে হাত রাখলেন। গলার কাছে রাখলেন। নাড়ি টিপলেন, ‘মনে হচ্ছে জ্বর এসেছে। দাঁড়া থার্মোমিটার আনি। তোর মেজোমাইমাকে একবার ডাকি।’
‘না, থার্মোমিটার, মেজমাইমা, কোনও কিছুর দরকার নেই।’ ‘তা হলে একটা ওষুধ দিচ্ছি, খা।’
‘সে পরে হবে। তুমি আমার বন্ধুর মতো, তোমাকে আমি একটা কথা বলতে চাই। তুমি আগে বসো।’
মেজোমামা মশারি সরিয়ে খাটের ধারে বসলেন। দীপাও বসল। মেজোমামা ভয়ে ভয়ে জিগ্যেস করলেন,
‘কী হয়েছে বল তো?’
‘আমার ভয় করছে।’
‘তুই আমাদের বিছানায় শুবি চল। তিনজন খুব আরামে শোয়া যাবে।’
‘সে ভয় নয়, অন্য ভয়।’দীপা ইতস্তত করছে বলতে বলতে তাকে হবেই। একজন কারোকে বলা দরকার। মেজোমামাই তার একমাত্র বন্ধু যাকে সব কথা বলা যায়। সাধুর কথায় দীপা ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছে। রাত যখন গভীর হয়, দরজা বন্ধ করে সে যখন বিছানায় মশারির তলায়, তখন সে কেন সকালের দীপা থাকে না। বয়সটা অনেক বেড়ে যায়। শরীরে টান ধরে। বুক, পেট, পিঠ সব ভারী হতে থাকে। কণ্ঠস্বর কেমন পালটে যায়। চরিত্রটা বদলে যেতে চায়। সে কি তার বাবার মতো, ঠাকুরদার মতো হয়ে যাবে। জ্যাঠামশাই, কাকা আর কাকিমাদের মতো!
মেজোমামা বললেন, ‘বল, কী বলবি বল! শীতের রাত হি হি করছে?’
‘তোমাকে এমন একটা কথা বলব, যা একমাত্র তোমাকেই আমি বলতে পারি। তুমি আমার বন্ধু। সেইকথা তুমি আর কারোকে বলবে না।’
মেজোমামা ভয় পেলেন, ‘কেউ কিছু বলেছে তোকে। হতচ্ছেদ্দা করেছে। অভিমান হয়েছে?
‘না, সে সব কিছু নয়। এমন কথা যা বলা যায় না, তবু বলছি। তুমি আমাকে ভালো করে দাও।’
‘সামান্য একটু জ্বর হয়েছে ঠান্ডা লেগে, তার জন্য এতটা উতলা হচ্ছিস কেন?’
‘তুমি তোমার ঘরের আলো নিবিয়ে, দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে এসো। মেজোমাইমা ঘুমোচ্ছে তো?’
‘হ্যাঁ, তোর মামি ঘুমকাতুরে। শুয়েই ঘুমিয়ে পড়ে।’
‘তা হলে যাও, যা বলছি তাই করে এসো।’
মেজোমামার হঠাৎ একটা অস্বস্তিকর অনুভূতি এল মনে। কত রকমের চোখ আছে পৃথিবীতে। মাঝে মাঝে ভাবতে ইচ্ছে করে। ঈশ্বরের চোখ, নিজের চোখ, সমাজের চোখ। নিজের চোখে। আমি নিষ্পাপ। সমাজের চোখে আমি যে-কোনও মুহূর্তে পাপী হয়ে যেতে পারি। কেউ কখনও এইভাবে অমন করেছিল অতএব তুমিও তাই করবে। সেইটাই আমাদের সিদ্ধান্ত। তুমি নিজেকে সাধু বললে কী হবে! পাপেরও একটা শাস্ত্র আছে। যেমন ঘণ্টা বাজলেই মনে করতে হবে পুজো হচ্ছে, সেইরকম সম্পর্ক যাই হোক, বয়সের ব্যবধান যতই থাক, একটা ঘরে অনেক রাতে একজন পুরুষ ও রমণী, হোক না কিশোরী, পাপ শাস্ত্র বলবে, ভয়ংকর একটা কিছু ন্যাক্কারজনক। ঘটনা ঘটছে। নিজের মন দিয়ে মানুষ বাইরের পৃথিবীটাকে দেখে। সাধুর লেখা সেই গল্প মনে পড়ে গেল—
ফাঁকা একটা মাঠ। অমাবস্যার অন্ধকার রাত। মাঝখানে একটা টিবি। অন্ধকারে দেখলে মনে হবে, একটা লোক গুড়ি মেরে বসে আছে। গুঁড়িখানা বন্ধ হয়েছে। মাঝরাতে মাতাল ওই মাঠের পথ ধরে টলতে টলতে ফিরছে। ঢিবিটা দূর থেকে নজরে পড়েছে। নিজের মনেই বলছে, বাঃ, আমার নেশা হওয়ার আগেই, তুমি ভাই লাগিয়ে বসে আছে। তোমার মালের তো বহুত জোর। সে তো আপশোশ করতে করতে চলে গেল। একটু পরেই এলেন এক সাধু। দূর থেকে টিবিটাকে দেখছেন। ভাবছেন, কী ভাগ্যবান, আমি এখনও বসতেই পারলুম না, আর আপনার ধ্যান লেগে গিয়েছে! সব শেষে এক পুলিশ, দেখে ভাবছেন, ব্যাটা চোর, মাল সাফ করে এখানে ঘাপটি মেরে বসে থাকা হয়েছে! একটা টিবি, তিনজন মানুষের তিন ধরনের দেখা।
মেজোমামা বললেন, ‘দরজাটা খোলা থাক, আলোটাও জ্বলুক। আমাকে দেখতে না পেলে তোর মাইমা অন্যরকম ভাববে।’
দীপাবললে, ‘অন্যরকম মানে কী রকম! আমি তো তোমাকে একেবারে অন্যরকম কথাই বলতে চাইছি।’
দীপা বুঝতে পারছে, মেজোমামা ভীষণ ভয় পেয়েছে। ঠিকমতো বসতে পারছে না। পালাবার জন্যে উশখুশ করছে। ঘন ঘন ঢোঁক গিলছে।
শেষে বললেন, কী এমন কথা! আজ অনেক রাত হয়েছে, কাল সকালেও তো বলা যায়।’
‘এসব কথা রাত ছাড়া বলা যায় না। তুমি অমন ছটফট করলে বলতে পারব না। সময় লাগবে। সারাটা রাতই লেগে যেতে পারে। তুমি অমন ভয় পাচ্ছ কেন? ভূত দেখেছ নাকি!’
‘না, তা নয়, তবে তোকে কেমন অস্বাভাবিক লাগছে। চুল এলোমেলো, চোখ ছলছল। জ্বরের ঘোরে ভুল বকছিস না তো!’
‘এখনও বকিনি, তবে এইবার যা বলব তাতে তোমার মনে হবে আমি সত্যিই হয়তো ভুল বকছি।’
দীপা মেজোমামার পাশে বসে পড়ল। দু-হাত দিয়ে মেজমামার সহজ সরল মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে বললে, ‘আমার মুখটা ভালো করে দেখে বলো তো, কার মতো, বাবার মতো, না মায়ের মতো?’
কিছুক্ষণ দেখে বললেন, ‘দুজনের কারও মতোই নয়, একেবারে অন্যরকম।’
‘মেয়েদের চরিত্র কার মতো হয়, বাবার মতো, না মায়ের মতো। তুমি আমার বাবাকে চেন, আমি
কী সেইরকম হব।চরিত্রহীন?’
‘এই বয়সে এই প্রশ্ন কেন?’
‘সাধু আমার মনে ভীষণ ভয় ধরিয়ে দিয়েছেন। যে যা হবার তাই হবে। অন্য কিছু হওয়ার চেষ্টা করলেও হতে পারবে না। আমি কী হব। আমার মায়ের মত, আমার বাবার মতোনা একেবারে অন্যরকম।’
‘তুই একেবারে পাগলের মতো কথা বলছিস। এই বয়সে এইসব কেউ ভাবে না। তোকে আমরা সবচেয়ে ভালো কলেজে লেখাপড়া শেখাব। পারলে বিলেত পাঠাব। গবেষণা করবি, ডিগ্রি নিবি। তারপর নিজের জীবনের ধারা নিজে ঠিক করে নিবি।’
‘সে তো শিক্ষার কথা, চরিত্রের কথাটা বলো।’
‘শিক্ষাই তো চরিত্র। আলাদা করে চরিত্রের কথা ভাবছিস কেন?’
‘আজকের কাগজে একটা খবর পড়েছ, এক শিক্ষিত অধ্যাপক আর একটা মেয়েকে বিয়ে করবে বলে বউকে খুন করেছিল ধরা পড়েছে। যে মেয়েটাকে বিয়ে করবে সে ওই অধ্যাপকের ছাত্রী। লোকটা তো শিক্ষিত, নামকরা অধ্যাপক।’
‘ওরা অপরাধী। তাই খুঁজে খুঁজে ওইসব খবর পড়ে মাথা খারাপ করবি কেন? এমন ঘটনা অনেক ঘটে। মানুষ নিজের দুর্বলতায় হঠাৎ অনেক কাজ করে ফেলে, পরে আপশোশ করে। রাগের মাথায় মারতে গিয়ে মেরে ফেলে জেলে যায়। একে বলে, টেম্পরারি ইনস্যানিটি। সব দেশেই এমন ঘটনা ঘটে। তাতে তোরই বা কী, আমারই বা কী! সাপ গর্তে থাক, বাঘ জঙ্গলে, কুমির। জলে, পাখি গাছে, আমরা আমাদের মতো, ওরা ওদের মতো। কেউ কারও এলাকায় ঢুকবে না। তাহলেই হল।’
‘তুমি কি জানো, আমি একটা খারাপ মেয়ে। আমাকে খারাপ করে দিয়েছে।’
দীপার মেজোমামা একটু থমকে গেলেন। কুমারী মেয়েদের এই একটা বয়স। কৈশোর আর। যৌবনের সন্ধিক্ষণ। যে বাড়িতে মানুষ হচ্ছিল, সেই বাড়ির মানুষগুলোর পয়সা ছিল, আদর্শ ছিল না। সব কটার ঠোঁটের উপর অহঙ্কারের গোঁফ। পুলিশ, সরকারি পদস্থ কর্মচারীদের তোয়াজ করে যতরকম অন্যায় পথ আছে, সেই পথে অর্থ উপার্জন। প্রতিটি মানুষ ইন্দ্রিয়পরায়ণ। মাত্রাতিরিক্তি যৌনতা। দীপাকে কে কীভাবে ব্যবহার করেছে কে জানে! সে সব কথা এই মাঝরাতে শুনে লাভ কী! মানুষ তো প্রতি মুহূর্তে নতুন জীবন শুরু করতে পারে। যদি ইচ্ছে থাকে, যদি মনের জোর থাকে।
মেজোমামা বললেন, ‘দীপা, তুই কী বলতে চাইছিস আমি জানি না, আমি শুনতেও চাই না। আমি যেমন তোর মামা, আবার আমি তোর অন্তরঙ্গ বন্ধু। আমি বিশ্বাস করি, তুই ভীষণ ভালো মেয়ে। তোর পক্ষে খারাপ হওয়া সম্ভব নয়, কারণ, তোর রক্তে আমাদের বংশের রক্ত আছে।’
দীপা একটুক্ষণ ভাবল। তার মনে হল, যে কথাটা সে বলতে চাইছে, সেটা বলা যায় না। যেমন সকলের সামনে উলঙ্গ হওয়া যায় না। দীপা ভয় পেয়েছিল। সেই ভয়টা ক্রমশ কেটে আসছে। একা ঘরে একা-একটা মানুষ, একটা শরীরে একটা মন, ভয় পেতেই পারে। দীপা ভাবলে, আর কিছুদিন দেখাই যাক না। কী হয়! যদি কিছু না-ই হয়, তাহলে যা হবার তাই হবে। অনেকেরই তো অনেক খুঁত থাকে, কারও ছ’টা আঙুল, কারও থ্যাবড়া নাক, গজদন্ত।
দীপা বলল, ‘চলো, আমরা শুয়ে পড়ি। যে কথাটা তোমাকে বলতে চাই, তা বলা যায় না। ওটা আমার ভিতরেই থাক।’
‘দীপা তোর যা বয়েস সেই বয়সে তুই কেমন করে এইসব কথা বলিস! একেবারে পাকা বুড়ির মতো!’
‘মেজোমামা, মেয়েরা তাড়াতাড়ি পেকে যায়।‘
‘একলা শুতে ভয় করলে, তুই তোর মাইমার পাশে গিয়ে শো, আমি তোর ঘরে শুচ্ছি।’
‘আমার ভূতের ভয় নেই। আমার মা মারা গিয়ে আমাকে অনেকটা সাহসী করে দিয়ে গিয়েছে।’
‘আমি তোকে আরও সাহসী করে দিয়ে যাব। তোকে আমি আত্মরক্ষার কায়দা শেখাব। অ্যানাটমি চেনাব। মানুষের শরীরে কয়েকটা স্পট আছে, সেখানে মারতে পারলে যত বড়ো পালোয়ানই হোক কাবু হয়ে যাবে।’
‘তুমি আমাকে মারধোর শেখাবে কেন?
‘একটাই কারণ, এদেশের পুরুষরা মেয়েদের ভোগের সামগ্রী ছাড়া আর কিছু ভাবতে শেখেনি। বাইরে ভদ্রলোক ভিতরে জানোয়ার। অথচ আমাদের দেশে দেবতার চেয়ে দেবীর সংখ্যাই বেশি।’
‘তুমি আমাকে যুযুৎসু শেখাবে?’
‘আমি শেখাব না, আমার এক জাপানি বন্ধু শেখাবে।’
মেজোমামা তাঁর ঘরে চলে গেলেন। দীপা শুয়ে পড়ল।
মেজোমামার ঘুম কম। দীপার চিন্তায় সারারাত প্রায় জেগেই রইলেন। মনে একটা খোঁচা। কী এমন হতে পারে মেয়েটার। অনেক কিছুই হতে পারে। ওর মনটাকে কেউ নষ্ট করে দিয়েছে।
মানুষকে মনেও বিকলাঙ্গ করা যায়!
পৃথিবীতে মানুষই মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু। বাঘ, ভাল্লুক, সাপ নয়। বড়দার লেখা একটা কবিতা মনে পড়ছে,
মনে হয়েছিল মানুষ
দুটো হাত, দুটো পা
কথা বলে মানুষের মতো,
ভুল ভেঙে যেতে দেরি হল না
দেখতে মানুষ হলেও
নির্ভেজাল জানোয়ার।।
Post a Comment