ফসিল – সুবোধ ঘোষ

ফসিল – সুবোধ ঘোষ

নেটিভ স্টেট অঞ্জনগড় আয়তন কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে আটষট্টি বর্গমাইল। তবুও নেটিভ স্টেট, বাঘের বাচ্চা বাঘই। মহারাজ আছেন ফৌজ, ফৌজদার, সেরেস্তা, নাজারৎ সব আছে। এককুড়ির উপর মহারাজের উপাধি তিনি ত্রিভুবনপতি তিনি নরপাল, ধর্মপাল এবং অরাতিদমনা চারপুরুষ আগে এ-রাজ্যে বিশুদ্ধ শাস্ত্রীয় প্রথায় অপরাধীকে শূলে চড়ানো হতো এখন সেটা আর সম্ভব নয়। তার বদলে অপরাধীকে শুধু উলঙ্গ করে নিয়ে মৌমাছি লেলিয়ে দেওয়া হয়।

সাবেক কালের কেল্লাটা যদিও লুপ্তশ্রী, তার পাথরের গাঁথুনিটা আজও অটুটা কেল্লার ফটকে বুনো হাতীর জীর্ণ কঙ্কালের মতো দুটো মরচে-পড়া কামান তার নলের ভেতরে পায়রার দল স্বচ্ছন্দে ডিম পাড়ে তার ছায়ায় বসে ক্লান্ত কুকুরেরা ঝিমোয়া দপ্তরে দপ্তরে শুধু পাগড়ি আর তরবারির ঘটা, দেয়ালে দেয়ালে খুঁটের মতো তামা আর লোহার ঢাল।

সচিব আছে, সেরেস্তাদারও আছে। ক্ষত্রিয় তিলক আর মোগল তকমার অদ্ভুত মিলন দেখা যায় দপ্তরে। যেন দুই যুগের দুই জাতের আমলাদের যৌথ-প্রতিভার সাহায্যে মহারাজা প্রজারঞ্জন করেন। সেই অপূর্ব অদ্ভুত শাসনের তাপে উত্যক্ত হয়ে রাজ্যের অর্ধেক প্রজা সরে পড়েছে দূর মরিসাসের চিনির কারখানায় কুলির কাজ নিয়ে।

সাড়ে-আটষট্টি বর্গমাইল অঞ্জনগড়—শুধু ঘোড়ানিম আর ফণীমনসায় ছাওয়া রুক্ষ কাঁকুরে মাটির ভাঙা আর নেড়া-নেড়া পাহাড়া কুর্মি আর ভীলেরা দু’ক্রোশ দূরের পাহাড়ের গায়ে লুকানো জলকুণ্ড থেকে মোষের চামড়ার থলিতে জল ভরে আনে—জমিতে সেচ দেয়—ভুট্টা যব আর জনার ফলায়।

প্রত্যেক বছর স্টেটের তসীল বিভাগ আর ভীল কুর্মি প্রজাদের মধ্যে একটা সংঘর্ষ বাধো চাষীরা রাজভাণ্ডারের জন্য ফসল ছাড়তে চায় না। কিন্তু অর্ধেক ফসল দিতেই হবে। মহারাজার সুগঠিত পোলো টীম আছে। হয়-শ্রেষ্ঠ শতাধিক ওয়েলারের হ্রেষারবে রাজ-আস্তাবল সতত মুখরিতা সিডনির নেটিভ এই দেবতুল্য জীবগুলির ওপর মহারাজার অপার ভক্তি তাদের তো আর খোল ভূষি খাওয়ানো চলে না। ভুট্টা, যব, জনার চাই-ই।

তসীলদার অগত্যা সেপাই ডাকে। রাজপুত বীরের বল্লম আর লাঠির মারে ক্ষাত্রবীর্যের স্ফুলিঙ্গ বৃষ্টি হয়। এক ঘণ্টার মধ্যে সব প্রতিবাদ স্তব্ধ, সব বিদ্রোহ প্রশমিত হয়ে যায়।

পরাজিত ভীলদের অপরিমেয় জংলী সহিষ্ণুতাও ভেঙে পড়ে। তারা দলে দলে রাজ্য ছেড়ে গিয়ে ভর্তি হয় সোজা কোনো ধাঙর-রিক্রুটারের ক্যাম্পে মেয়ে মরদ শিশু নিয়ে কেউ যায়। নয়াদিল্লি, কেউ কলকাতা, কেউ শিলং ভীলেরা ভুলেও আর ফিরে আসে না।

শুধু নড়তে চায় না কুর্মি প্রজারা। এ-রাজ্যে তাদের সাতপুরুষের বাস। ঘোড়ানিমের ছায়ায় ছায়ায় ছোট বড় এমন ঠাণ্ডা মাটির ডাঙা, কালমেঘ আর অনন্তমূলের চারার এক একটা ঝোপ সালসার মতো সুগন্ধ মাটিতে তাদের যেন নাড়ীর টানে বেঁধে রেখেছে এই মাটি। বেহারার মতো চাষ করে, বিদ্রোহ করে আর মারও খায়—ঋতুচক্রের মতো। এই ত্রিদশার আবর্তনে তাদের দিনসন্ধ্যার সমস্ত মুহূর্তগুলি ঘুরপাক খায়। এদিক ওদিক হবার উপায় নেই।

তবে অঞ্জনগড় থেকে দয়াধর্ম একেবারে নির্বাসিত নয়। প্রতি রবিবারে কেল্লার সামনে সুপ্রশস্ত চবুতরায় হাজারের ওপর দুঃস্থ জমায়েত হয়। দরবার থেকে বিতরণ করা হয় চিড়ে আর গুড়া সংক্রান্তির দিনে মহারাজা গায়ে আলপনা আঁকা হাতীর পিঠে চড়ে আর জুলুস নিয়ে পথে বার হন—প্রজাদের আশীর্বাদ করতে তাঁর জন্মদিনে কেল্লার আঙিনায় রামলীলা গান হয়—প্রজারা নিমন্ত্রণ পায়। তবে অতিরিক্ত ক্ষত্রিয়ত্বের প্রকোপে যা হয়—সব ব্যাপারেই লাঠিা যেখানে জনতা আর জয়ধ্বনি, সেখানে লাঠি চলবেই আর দু’চারটে অভাগার মাথা ফাটবেই। চিড়ে আশীর্বাদ বা রামলীলা—সবই লাঠির সহযোগে পরিবেশন করা হয় প্রজারা সেই ভাবেই উপভোগ করতে অভ্যস্ত।

লাঠিতন্ত্রের দাপটে স্টেটের শাসন আদায় উসুল আর তসীল চলছিল বটে, কিন্তু যেটুকু হচ্ছিল, তাতে গদির গৌরব অটুট রাখা যায় না। নরেন্দ্রমণ্ডলের চাঁদা আর পোলো টীমের খরচ! রাজবাড়ির বাপেরকেলে সিন্দুকের রূপপা আর সোনার গাদিতে হাত দিতে হয়। আর, সিন্দুকও খালি হতে থাকে।

অঞ্জনগড়ের এই উদ্বিগ্ন অদৃষ্টের সন্ধিক্ষণে দরবারের ল-এজেন্টের পদে নিযুক্ত হয়ে এলো একজন ইংরেজী আইননবিশ উপদেষ্টা। আমাদের মুখার্জীই এলো ল-এজেন্ট হয়ে। মুখার্জীর চওড়া বুক—যেমন পোলো ম্যাচে তেমনি স্টেটের কাজে অচিরে মহারাজার বড় সহায় হয়ে দাঁড়ালো। ক্রমে মুখার্জীই হয়ে গেল ডি ফ্যাক্টো সচিবোত্তম, আর সচিবোত্তম রইলেন শুধু সই করতে।

আমাদের মুখার্জী আদর্শবাদী। ছেলেবেলার ইতিহাস-পড়া ডিমোক্রেসীর স্বপ্নটা আজো তার চিন্তার পাকে পাকে জড়িয়ে আছে। বয়সে অপ্রবীণ হলেও সে অত্যন্ত শান্তবুদ্ধি। সে বিশ্বাস করে —যে সৎসাহসী সে কখনো পরাজিত হয় না, যে কল্যাণকৃৎ তার কখনো দুর্গতি হতে পারে না।

মুখার্জী তার প্রতিভার প্রতিটি পরমাণু উজাড় করে দিলো স্টেটের উন্নতির সাধনায়। অঞ্জনগড়ের আবালবৃদ্ধ চিনে ফেলল তাদের এজেন্ট সাহেবকে, একদিকে যেমন কট্টর অন্য দিকে তেমনি হমদরদা প্রজারা ভয় পায় ভক্তিও করো মুখার্জীর নির্দেশে বন্ধ হলো লাঠিবাজি। সমস্ত দপ্তর চুলচেরা অডিট করে তোলপাড় করা হলো। স্টেটের জরিপ হলো নতুন করে সেন্সাস নেওয়া হলো। এমন কি মরচে পড়া কামান দুটোকে পালিস দিয়ে চকচকে করে ফেলা হলো।

ল-এজেন্ট মুখার্জীই একদিন আবিষ্কার করল অঞ্জনগড়ের অন্তর্ভোম সম্পদ। কলকাতা থেকে জিওলজিস্ট আনিয়ে সার্ভে ও সন্ধান করিয়ে একদিন বুঝতে পারে মুখার্জী—এই অঞ্জনগড়ে রত্ন, এর গ্রানিটে গড়া পাঁজরের ভাঁজে ভাঁজে অভ্র আর অ্যাসবেস্টসের ঝুপ কলকাতার মার্চেন্টদের ডাকিয়ে ঐ কাঁকুরে মাটির ডাঙাগুলিই লাখ লাখ টাকায় ইজারা করিয়ে দিলো। অঞ্জনগড়ের শ্রী গেল ফিরে। আজ কেল্লার এক পাশে গড়ে উঠেছে সুবিরাট গোয়ালিয়রী স্টাইলের প্যালেস। মার্বেল, মোজায়িক, কংক্রীট আর ভিনিসিয়ান শার্সীর বিচিত্র পরিসজ্জা! সরকারী গ্যারেজে দামী দামী জার্মান সিডান আর টুরার। আস্তাবলে নতুন আমদানী আইরিশ পনির অবিরাম লাথালাথি প্রকাণ্ড একটা বিদ্যুতের পাওয়ার হাউস—দিবারাত্র ধক ধক শব্দে অঞ্জনগড়ের নতুন চেতনা আর পরমায়ু ঘোষণা করে।

সত্যই নতুন প্রাণের জোয়ার এসেছে অঞ্জনগড়ো মার্চেন্টরা একজোট হয়ে প্রতিষ্ঠা করেছে— মাইনিং সিন্ডিকেটা খনি অঞ্চলে ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে খোয়া-বাঁধানো বড় বড় সড়ক, কুলির ধাওড়া, পাম্প-বসান ইঁদারা, ক্লাব, বাংলো, কেয়ারী-করা ফুলের বাগিচা আর জিমখানা কুর্মি কুলিরা দলে দলে ধাওড়া জাঁকিয়ে বসেছে। নগদ মজুরী পায়, মুরগী বলি দেয়, হাঁড়িয়া খায় আর নিত্য সন্ধ্যায় মাদল ঢোলক পিটিয়ে খনি অঞ্চল সরগরম করে রাখে।

মহারাজ এইবার প্লান আঁটছেন—দুটো নতুন পোললা গ্রাউন্ড তৈরি করতে হবে আরো বাইশ বিঘা জমি যোগ করে প্যালেসের বাগানটাকে বাড়াতে হবে। নহবতের জন্য একজন মাইনে-করা ইটালিয়ান ব্যান্ডমাস্টার হলেই ভালো।

অঞ্জনগড়ের মানচিত্রটা টেবিলের ওপর ছড়িয়ে মুখার্জী বিভোর হয়ে ভাবে, তার ইরিগেশন স্কীমটার কথা। উত্তর থেকে দক্ষিণ সমান্তরাল দশটা ক্যানেল। মাঝে মাঝে খিলান-করা কড়া গাঁথুনির শুস-বসানো বড় বড় ড্যাম। অঞ্জনা নদীর সমস্ত জলের ঢলটা কায়দা করে অঞ্জনগড়ের পাথুরে বুকের ভেতর চালিয়ে দিতে হবে—রক্তবাহী শিরার মতো। প্রত্যেক কুর্মি প্রজাকে মাথা পিছু এক বিঘা জমি দিতে হবে বিনা সেলামীতে, আর পাঁচ বছরের মতো বিনা খাজনায়। আউশ আর আমন তা ছাড়া একটা রবি। বছরে এই তিন কিস্তি ফসল তুলতেই হবে উত্তরের প্লটের সমস্তটাই নার্সারী, আলু আর তামাক দক্ষিণেরটা আখ, যব আর গম। তারপর—

তারপর ধীরে একটা ব্যাঙ্ক, ক্রমে একটা ট্যানারী আর কাগজের মিল রাজকোষের সে অকিঞ্চনতা আর নেই। এই তো শুভ মাহেন্দ্রক্ষণ! শিল্পীর তুলির আঁচড়ের মতো এক একটি এস্টিমেটে সে অঞ্জনগড়ের রূপ ফিরিয়ে দেবে। সে দেখিয়ে দেবে রাজ্যশাসন লাঠিবাজি নয়, এও একটা আর্ট

একটা স্কুল, এইটাতে মহারাজার স্পষ্ট জবাব, কভি নেহি। মুখার্জী উঠলো দেখা যাক, বুঝিয়ে বাঝিয়ে মহারাজার আপত্তি টলাতে পারে কি না।

মহারাজা তাঁর গালপাট্টা দাড়ির গোছাটাকে একটা নির্মম মোচড় দিয়ে মুখার্জীর সামনে এগিয়ে দিলেন দুটো কাগজ—এই দেখ।

প্রথম পত্র প্রবল প্রতাপ দরবার আর দরবারের ঈশ্বর মহারাজ। আপনি প্রজার বাপা আপনি দেন বলেই আমরা খাই। অতএব এ বছর ভুট্টা জনার যা ফলবে, তার উপর যেন তসীলদারের

জুলুম না হয়। আমরা নগদ টাকায় খাজনা দেবা আইন–সঙ্গতভাবে সরকারকে যা দেয়, তা আমরা দেব ও রসিদ নেব। ইতি দরবারের অনুগত ভৃত্য কুর্মি সমাজের তরফে দুলাল মাহাতো, বকলম খাস।

দ্বিতীয় পত্র—মহারাজার পেয়াদা এসে আমাদের খনির ভেতর ঢুকে চারজন কুর্মি কুলিকে ধরে নিয়ে গেছে আর তাদের স্ত্রীদের লাঠি দিয়ে মেরেছে। আমরা একে অধিকার-বিরুদ্ধ মনে করি এবং দাবী করি, মহারাজার পক্ষ থেকে শীঘ্রই এ-ব্যাপারের সুমীমাংসা হবে ইতি সিন্ডিকেটের চেয়ারম্যান, গিবসন।

মহারাজা বললেন—দেখছো তো মুখার্জী, শালাদের হিম্মৎ।

–হ্যাঁ দেখছি।

টেবিলে ঘুষি মেরে বিকট চীৎকার করে অরাতিদমন প্রায় ফেটে পড়লেন—মুড়ো, শালাদের মুড়ো কেটে এনে ছড়িয়ে দাও আমার সামনে আমি বসে বসে দেখি দু’দিন দু’রাত ধরে দেখি।

মুখার্জী মহারাজাকে শান্ত করে–আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। আমি একবার ভেতরে ভেতরে অনুসন্ধান করি, আসল ব্যাপার কি।

বৃদ্ধ দুলাল মাহাতো বহুদিন পরে মরিসাস থেকে অঞ্জনগড়ে ফিরেছে। বাকি জীবনটা উপভোগ করার জন্য সঙ্গে নগদ সাতটি টাকা এবং বুকভরা হাঁপানি নিয়ে ফিরেছে। তার আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে কুর্মিদের জীবনেও যেন একটা চঞ্চলতা—একটা নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে।

কুর্মিরা দুলালের কাছে শিখেছে–নগদ মজুরী কি জিনিসা ফয়জাবাদ স্টেশনে কোনো বাবুসাহেবের একটা দশসেরী বোঝা ট্রেনের কামরায় তুলে দাও! বাস–নগদ একটি আনা, হাতে হাতে!

দুলাল বলেছে—ভাইসব, এই বুড়োর মাথায় য’টা সাদা চুল দেখছ, ঠিক ততবার সে বিশ্বাস করে ঠকেছে। এবার আর কাউকে বিশ্বাস নয়া সব নগদ নগদ এক হাতে নেবে তবে অন্য হাতে সেলাম করবো।

সিন্ডিকেটের সাহেবদের সঙ্গে দুলাল সমানে কথা চালায় কুলিদের মজুরীর রেট, হপ্তা, পেমেন্ট, ছুটি, ভাতা আর ওষুধের ব্যবস্থা—এ সব সে-ই কুর্মিদের মুখপাত্র হয়ে আলোচনা করেছে পাক প্রতিশ্রুতি আদায় করে নিয়েছে। সিন্ডিকেটও দুলালকে উঠতে বসতে তোয়াজ করে —চলে এস দুলাল। বল তো রাতারাতি বিশ ডজন ধাওড়া করে দি। তোমার সব কুর্মিদের ভর্তি করে নেব।

দুলাল জবাব দেয়—আচ্ছা, সে হবে তবে আপাতত কুলি পিছু কিছু কয়লা আর কেরোসিন তেল মুফতি দেবার অর্ডার হোক।

—আচ্ছা তাই হবে। সিন্ডিকেটের সাহেবরা তাকে কথা দেয়।

দুলালের আমন্ত্রণ পেয়ে একদিন রাজ্যের কুর্মি একত্রিত হলো ঘোড়ানিমের জঙ্গলে পাকাচুলে ভরা মাথা থেকে পাগড়িটা খুলে হাতে নিয়ে দুলাল দাঁড়ালো—আজ আমাদের মণ্ডলের প্রতিষ্ঠা হলো। এখন ভাব কি করা উচিত চিনে দেখ, কে আমাদের দুশমন আর কেই বা দোস্ত। আর ভয় করলে চলবে না।।

পেট আর ইজ্জত, এর ওপর যে ছুরি চালাতে আসবে তাকে আর কোনো মতেই ক্ষমা নয়।

ভাঙা শঙ্খের মতো দুলালের স্থবির কণ্ঠনালীটা অতিরিক্ত উৎসাহে কেঁপে কেঁপে আওয়াজ ছাড়ে—ভাই সব, আজ থেকে এ মাহাতোর প্রাণ মণ্ডলের জন্য, আর মণ্ডলের প্রাণ…।

কুর্মি জনতা একসঙ্গে হাজার লাঠি তুলে প্রত্যুত্তর দিল—মাহাতোর জন্য।

ঢাক ঢোল পিটিয়ে একটা নিশান পর্যন্ত উড়িয়ে দিলো তারা। তারপর যে যার ঘরে ফিরে গেল।

ঘটনাটা যতই গোপনে ঘটুক না কেন, মুখার্জীর কিছু জানতে বাকি রইল না। এটুকু সে বুঝল —এই মেঘেই বজ্ৰ থাকে। সময় থাকতে চটপট একটা ব্যবস্থা দরকার। কিন্তু মহারাজা যেন ঘুণাক্ষরেও জানতে না পান। ফিউডল দেমাকে অন্ধ আর ইজ্জত কমপ্লেক্সে জর্জর এই সব নরপালদের তা হলে সামলানো দুষ্কর হবে। বৃথা একটা রক্তপাতও হয় তো হয়ে যাবে তার চেয়ে নিজেই একহাত ভদ্রভাবে লড়ে নেওয়া যাক।

পেয়াদারা এসে মহারাজাকে জানালো—কুর্মিরা রাজবাড়ির বাগানে আর পোলোলনে বেগার খাটতে এলো না। তারা বলছে—বিনা মজুরীতে খাটলে পাপ হবে রাজ্যের অমঙ্গল হবে।

ডাক পড়ল মুখার্জীর দুলাল মাহাতোকেও তলব করা হলো। জোড়হাতে দুলাল মাহাতো প্রণিপাত করে দাঁড়ালো মেষশিশুর মতো ভীরু দুলাল যেন ঠক ঠক করে কাঁপছে।

—তুমিই এসব শয়তানী করছ? মহারাজা বললেন।

—হুজুরের জুতোর ধুলো আমি।

—চুপ থাক।

—জী সরকার।

—চুপ! মহারাজ জীমূতধ্বনি করলেন। দুলাল কাঠের পুতুলের মতো স্থির হয়ে গেল।

মহারাজা বলেন—বিলাতি বেনিয়াদের সঙ্গে তোমার সম্পর্ক ছাড়তে হবে। আমার বিনা হুকুমে কোনো কুর্মি খনিতে কুলি খাটতে পারবে না।

–জী সরকার। আপনার হুকুম আমার জাতকে জানিয়ে দেবো।

–যাও।

দুলাল দণ্ডবৎ করে চলে গেল। এবার আদেশ হলো মুখার্জীর ওপর সিন্ডিকেটকে এখুনি নোটিস দাও, যেন আমার বিনা সুপারিশে আমার কোনো কুর্মি প্রজাকে কুলির কাজে ভর্তি না করে।

অবিলম্বে যথাস্থান থেকে উত্তর এলো একে একে। দুলাল মাহাতার স্বাক্ষরিত পত্র। যেহেতু আমরা নগদ মজুরী পাই, না পেলে আমাদের পেট চলবে না, সেইহেতু আমরা খনির সাহেবদের কথা মানতে বাধ্যা আশা করি দরবার এতে বাধা দেবেন না। আগামী মাসে আমাদের নতুন মন্দির প্রতিষ্ঠা হবে রাজতহবিল থেকে এক হাজার টাকা মঞ্জুর করতে সরকারের হুকুম হয়। …আগামী শীতের সময়ে বিনা টিকিটে জঙ্গলের ঝুরি আর লকড়ি ব্যবহার করবার অনুমতি হয়।

নোটিশের প্রত্যুত্তরে সিন্ডিকেটেরও একটা জবাব এলো—মহারাজের সঙ্গে কোনো নতুন শর্তে চুক্তিবদ্ধ হতে আমরা রাজি আছি। তবে আজ নয়। বর্তমান চুক্তির মেয়াদ যখন ফুরোবে— নিরানব্বই বছর পরে।

–কী রকম বুঝছ মুখার্জী? অগত্যা দেখছি ফৌজদারকেই ডাকতে হয়। জিজ্ঞাসা করি, খাল কাটার স্বপ্নটা ছেড়ে দিয়ে এখন আমার ইজ্জতের কথাটা একবার ভাববে কি না?

মহারাজা আস্তে আস্তে বললেন বটে, কিন্তু মুখ-চোখের চেহারা থেকে বোঝা গেল, একটা আক্রোশ শত ফণা বিস্তার করে তাঁর মনের ভেতর ফুঁসে ফুঁসে ছটফট করছে।

মুখার্জী সবিনয়ে নিবেদন করে—মন খারাপ করবেন না সরকার আমাকে সময় দিন, সব গুছিয়ে আনছি আমি।

মুখার্জী বুঝেছে দুলালের এই দুঃসাহসের প্রেরণা যোগাচ্ছে কারা। সিন্ডিকেটের দুষ্ট উৎসাহেই কুর্মিসমাজের এই নাচানাচি। এই শুভযোগ ছিন্ন না করে দিলে রাজ্যের সমূহ অশান্তি অমঙ্গলও। কিন্তু কি করা যায়!

দুলাল মাহাতোর কুঁড়ের কাছে মুখার্জী এসে দাঁড়ালো। দুলাল ব্যস্তভাবে বের হয়ে এসে একটা চৌকি এনে মুখার্জিকে বসতে দিলো। মাথার পাগড়িটা খুলে মুখার্জীর পায়ের কাছে রেখে দুলাল বসলো মাটির ওপর। মুখার্জী এক এক করে তাকে বুঝিয়ে বলল যেন একটা অভিমানের সুরে মুখার্জীর গলার স্বর ভেঙে পড়ে—একি করছো মাহাতো! দরবারের ছেলে তোমরা, কখনো ছেলে দোষ করে কখনো করে বাপা তাই বলে পরকে ডেকে কেউ ঘরের ইজ্জত নষ্ট করে না। সিন্ডিকেট আজ তোমাদের ভালো খাওয়াচ্ছে, কিন্তু কাল যখন তার কাজ ফুরোবে তখন তোমাদের দিকে ফিরেও তাকাবে না এই দরবারই তখন দুমুঠো চিড়ে দিয়ে তোমাদের বাঁচাবো

মুখার্জীর পায়ে হাত রেখে দুলাল বলে—কসম, এজেন্ট বাবা, তোমার কথা রাখবা বাপের তুল্য মহারাজা, তাঁর জন্য আমরা জান দিতে তৈরি। তবে ঐ দরখাস্তটি একটু জলদি মঞ্জুর হয়।

দ্বিতীয় প্রশ্ন বা উত্তরের অপেক্ষা না করে মুখার্জী দুলালের কুঁড়ে থেকে বেরিয়ে পড়ে নাঃ, রোগে তো ধরেই ছিল অনেক দিন এবার দেখা দিয়েছে বিকারের লক্ষণ।

স্নান আহার আর পোশাক বদলাবার কথা মুখার্জীকে ভুলতে হলো আজ। একটানা ড্রাইভ করে থামলো এসে সিন্ডিকেটের অফিসে

–দেখুন মিস্টার গিবসন, রাজা-প্রজা সম্পর্কের ভেতর দয়া করে হস্তক্ষেপ করবেন না আপনারা আপনাদের কারবারের জন্য যে কোনো সুবিধা দরবারের কাছে আবেদন করলেই তো পেয়ে যাবেন।

গিবসন বললেন—মিস্টার মুখার্জী, আমরা মানিমেকার নই, আমাদের একটা মিশনও আছে। নির্যাতিত মানুষের পক্ষ নিয়ে আমরা চিরকাল লড়ে এসেছি। দরকার থাকে আরো লড়বো।

—সব কুর্মি প্রজাদের লোভ দেখিয়ে আপনারা কুলি করে ফেলছেন। স্টেটের এগ্রিকালচার তাহলে কি করে বাঁচে বলুন তো!

ঝোঁকের মাথায় মুখার্জী তার ক্ষোভের আসল কারণটি ব্যক্ত করে ফেললো।

—এগ্রিকালচার না বাঁচুক, ওয়েলথ তো বাঁচছে। এটা অস্বীকার করতে পারেন? গিবসন বিদ্রুপের স্বরে উত্তর দেয়।

—তর্ক ছেড়ে কো-অপারেশনের কথা ভাবুন, মিস্টার গিবসন। কুলি ভর্তির সময় দরবার থেকে একটু অনুমোদন করিয়ে নেবেন, এই মাত্র। মহারাজাও খুশি হবেন এবং তাতে আপনাদেরও অন্যদিকে নিশ্চয় ভালো হবে।

—সরি মিস্টার মুখার্জী! গিবসন বাঁকা হাসি হেসে চুরুট ধরালেন।

নিদারুণ বিরক্তিতে লাল হয়ে উঠলো মুখার্জীর কর্ণমূল। সজোরে চেয়ারটা ঠেলে দিয়ে উঠে দাঁড়াল মুখার্জী আর সেই মুহূর্তে অফিস ছেড়ে চলে যায়।

ম্যাককেনা এসে জিজ্ঞেস করলেন—কি ব্যাপার গিবসন?

–মুখার্জী, দ্যাট মংকি অব অ্যান অ্যাডমিনিস্ট্রেটর, ওকে মুখের ওপর শুনিয়ে দিয়েছি। কোনো টার্মই গ্রাহ্য করিনি।

—ঠিক করেছ। শুনেছ তো ওর ঐ ইরিগেশন স্কিমটার কথা? সময় থাকতে ওই স্কিম ভণ্ডুল করে দিতে হবে, নইলে সাংঘাতিক লেবারের অভাবে পড়তে হবে। কারবার এখন বাড়তির মুখে, খুব সাবধান

—কোনো চিন্তা নেই। পোষা বিড়াল মাহাতো রয়েছে আমাদের হাতে। ওকে দিয়েই স্টেটের সব ডিজাইন ভণ্ডুল করবো।

পরস্পর হাস্য বিনিময় করে ম্যাককেনা বলেন—মাহাতো এসে বসে আছে যে ওকে নিয়ে এস, আর সেই কাজটা এবার সেরেই ফেলা সিন্ডিকেটের অফিসের পিছনের দরজার কাছে বসে ছিল মাহাতো। অফিসের একটা নিভৃত কামরায় মাহাতোকে নিয়ে গিয়ে গিবসন বলে—এই যে দরখাস্ত তৈরি। সব কথা লেখা আছে এতে সই করে ফেল আজই দিল্লীর ডাকে পাঠিয়ে দেবো।

সই করে মাহাতো। মাহাতোর পিঠ থাবড়ে ম্যাককেনা তাকে বিদায় দিলো—ডরো মৎ মাহাতো, আমরা আছি। যদি ভিটে-মাটি উৎখাত করে তবে আমাদের ধাওড়া খোলা থাকবে তোমাদের জন্য সব সময়, ডরো মৎ।

নিজের দপ্তরে বসে মুখার্জী শুধু আকাশপাতাল ভাবে কলম ধরতে আর মন চায় না। মহারাজাকে আশ্বাস দেবার মতো সব কথা ফুরিয়ে গেছে তারা পরের রথের সারথ্য আর বোধহয় চলবে না তার দ্বারা। এইবার রথীর হাতেই তুলে দিতে হবে লাগামা কিন্তু মানুষগুলির মাথায় ঘিলু নিশ্চয় শুকিয়ে গেছে সবা সবাই নিজের মূঢ়তায়—একটা আত্মবিনাশের উৎকট কল্পনাতাণ্ডবে মজে আছে যেনা কিংবা সে-ই ভুল করেছে কোথাও।

মহারাজার আহ্বান খাস কামরায়।

সচিবোত্তম ও ফৌজদার শুষ্কমুখে বসে আছেন। মহারাজা কৌচের চারিদিক পায়চারি করছেন ছটফট করে। মুখার্জী ঢুকতেই একেবারে অগ্নদগার করলেন।–নাও, এবার গদিতে থুথু ফেলে আমি চললাম। তুমিই বসো তার ওপর আর স্টেট চালিও।

হতভম্ব মুখার্জী সচিবোত্তমের দিকে তাকায়। মুখার্জীর হাতে সচিবোত্তম তখুনি তুলে দিলেন। একটি চিঠি। পলিটিক্যাল এজেন্টের নোট।–স্টেটের ইন্টার্নাল ব্যাপার সম্বন্ধে বহু অভিযোগ এসেছে। দিনদিন আরো নতুন ও গুরুতর অভিযোগ সব আসছে। আমার হস্তক্ষেপের পূর্বে, আশা করি, দরবার শীঘ্রই সুব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হবে।

ফৌজদার একটু ভ্রূকুটি করে বলেন—এই সবের জন্য আপনার কনসিলিয়েশন পলিসিই দায়ী, এজেন্ট সাহেব।

ফৌজদারের অভিযোগের সূত্র ধরে মহারাজা চীৎকার করে উঠলেন—নিশ্চয়, খুব সত্যি কথা আমি সব জানি মুখার্জী আমি অন্ধ নই।

—সব জানি? এ কি বলছেন সরকার?

—থাম, সব জানি। নইলে আমার রাজ্যের ধুলোমাটি বেচে যে বেনিয়ারা পেট চালায়, তাদের এত সাহস হয় কোথা থেকে? কে তাদের ভেতরে ভেতরে সাহস দেয়?

মহারাজা যেন দম বন্ধ করে কৌচের উপর এলিয়ে পড়লেন। একটা পেয়াদা ব্যস্তভাবে ব্যজন করে তাঁকে সুস্থ করতে থাকে। সচিবোত্তম ফৌজদার আর মুখার্জী ভিন্ন ভিন্ন দিকে মুখ ফিরিয়ে বোবা হয়ে বসে রইলা

গলা ঝেড়ে নিয়ে মহারাজা আবার কথা পাড়লেন। ফৌজদার সাহেব, এবার আপনিই আমার ইজ্জত বাঁচান।

সচিবোত্তম বলেন—তাই হোক, কুর্মিদের আপনি শায়েস্তা করুন, ফৌজদার সাহেব, আর আমি সিন্ডিকেটকে একটা সিভিল সুটে ফাঁসাচ্ছি। চেষ্টা করলে কন্ট্রাক্টের মধ্যে এমন বহু ফাঁক পাওয়া যাবে।

মহারাজা মুখার্জীর দিকে চকিতে তাকিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। কিন্তু মুখার্জী এরই মধ্যে দেখে ফেলেছে, মহারাজার চোখ দুটো ভেজা-ভেজা।

সিংহের চোখে জল! এর পেছনে কতখানি অন্তর্দাহ লুকিয়ে আছে, তা স্বভাবত শশক হলেও মুখার্জী আন্দাজ করে নিতে পারে। সত্যিই তো, এ দিকটা তার এতদিন চোখ পড়ে নি। তার ভুল হয়েছে। মহারাজার সামনে এগিয়ে দিয়ে সে শান্তভাবে তার শেষ কথাটা জানালো আমার ভুল হয়েছে সরকার। এবার আমায় ছুটি দিন। তবে আমায় যদি কখনো ডাকেন, আমি আসবই।

মহারাজা মুহূর্তের মধ্যে একেবারে নরম হয়ে গেলেন–না, না মুখার্জী, কি যে বলো! তুমি আবার যাবে কোথায়? অনেকে অনেক কিছু বলছে বটে, কিন্তু আমি তা বিশ্বাস করি না। তবে পলিসি বদলাতেই হবে একটু কড়া হতে হবে। ব্যাঙের লাথি আর সহ্য হয় না মুখার্জী।

শীতের মরা মেঘের মতো একটা রিক্ততা, একটা ক্লান্তি যেন মুখার্জীর হাত-পায়ের গাঁটগুলোকে শিথিল করে দিয়েছে। দপ্তরে যাওয়া ছেড়ে দিয়েছে সে শুধু বিকেল হলে ব্রিচেস চড়িয়ে বয়ের কাঁধে দু’ডজন ম্যালেট চাপিয়ে পোলো লনে উপস্থিত হয়। সমস্তটা সময় পুরো গ্যালপে ক্ষ্যাপা ঝড়ের মতো খেলে যায়। ডাইনে বাঁয়ে বেপরোয়া আন্ডার-নেক হিট চালায়। কড় কড় করে এক একটা ম্যালেট ভেঙে উড়ে যায় ফালি হয়ে মুখের ফেনা আর গায়ের ঘামের। স্রোতে ভিজে ঢোল হয়ে যায় কালো ওয়েলারের পায়ের ফ্ল্যানেল। তবু স্কোরের নেশায় পাগল হয়ে মুখার্জী চার্জ করে বিপক্ষদল ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে অতি মন্থর ট্রটে ঘুরে ঘুরে আত্মরক্ষা করে। চক্কর শেষ হবার পরেও বিশ্রাম করার নাম করে না মুখার্জী ক্যান্টারে ঘোড়া ছুটিয়ে সারা পোলো লনটাকে বিদ্যুদ্বেগে পাক দিয়ে বেড়াতে থাকে। রেকাবে ভর দিয়ে মাঝে মাঝে চোখ বুজে দাঁড়িয়ে থাকে—বুক ভ’রে যেন স্পীড পান করো।

খেলা শেষে মহারাজ অনুযোগ করেন—বড় রাফ খেলা খেলছো মুখার্জী!

সেদিনও সন্ধ্যের আগে নিয়মিত সূর্যাস্ত হলো অঞ্জনগড়ের পাহাড়ের আড়ালে। মহারাজা সাজগোজ করে খেলার মাঠে যাবার উদ্যোগ করছেন পেয়াদা একটা খবর নিয়ে এলো—চৌদ্দ নম্বরের পীট ধসেছে, এখনো ধসছে। নব্বই জন পুরুষ আর মেয়ে কুর্মি কুলি চাপা পড়েছে।

—অতি সুসংবাদ! মহারাজা গালপাট্টায় হাত বুলিয়ে উৎকট আনন্দের বিস্ফোরণে চেঁচিয়ে উঠলেন সচিবোত্তম কোথায়? কোই হ্যায়? শীগগির ডাক, সিন্ডিকেটের দেমাক এইবার গুঁড়ো করবো।

–হুকুম করুন সরকার একজন চাপরাসী এসে কাছে দাঁড়ায়।

চেঁচিয়ে ওঠেন মহারাজা।–সচিবোত্তম, তার মানে আমাদের বুড়ো দেওয়ান সাহেব, তাঁকে শীগগির একবার ডাকা সিন্ডিকেটের দেমাক এইবার গুড়ো করবো।

সচিবোত্তম এলেন, কিন্তু মরা কাতলা মাছের মতো দৃষ্টি তাঁর চোখে বললেন—দুঃসংবাদ!

—কিসের দুঃসংবাদ?

—বিনা টিকিটে কুর্মিরা লকড়ি কাটছিল। ফরেস্ট রেঞ্জার বাধা দেয়। তাতে রেঞ্জার আর গার্ডদের কুর্মিরা মেরে তাড়িয়ে দিয়েছে।

-তারপর?—মহারাজার চোয়াল দুটি কড় কড় করে বেজে উঠলো।

—তারপর ফৌজদার গিয়ে গুলি চালিয়েছে। ছররা ব্যবহার করলেই ভালো ছিল তা না করে চালিয়েছে মুঙ্গেরী গাদা আর দেড় ছটাকী বুলেটা মরেছে বাইশ জন আর ঘায়েল পঞ্চাশের ওপর। ঘোড়ানিমের জঙ্গলে সব লাশ এখনো ছড়িয়ে পড়ে আছে।

মহারাজা বিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে রইলেন খানিকক্ষণ। তাঁর চোখের সামনে পলিটিক্যাল এজেন্টের নোটটা যেন চকচকে সূচীমুখ বর্শার ফলার মতো ভেসে বেড়াতে থাকে।

—খবরটা কি রাষ্ট্র হয়ে গেছে?

—অন্তত সিন্ডিকেট তো জেনে ফেলেছে। সচিবোত্তম উত্তর দিলেন।

মুখার্জীকে ডাকলেন মহারাজা। এই তো ব্যাপার মুখার্জী। এইবার তোমার বাঙালী ইলম দেখাও একটা রাস্তা বাতলাও।

একটু ভেবে নিয়ে মুখার্জী বলে—আর দেরী করবেন না। সব ছেড়ে দিয়ে মাহাতোকে আগে আটক করে ফেলুন।

জন পঞ্চাশ পেয়াদা সড়কি লাঠি লণ্ঠন নিয়ে অন্ধকারে দৌড় দিয়ে দুলালের ঘরের দিকে ছুটে চলে যায়।

মুখার্জী বলে—আমার শরীর ভালো নয় সরকার, কেমন গা বমি-বমি করছে। আমি যাই।

চৌদ্দ নম্বরের পীট ধসেছে। মার্চেন্টরা খুবই ঘাবড়ে গিয়েছে। তৃতীয় সীমের ছাদটা ভালো করে টিম্বার ছিল না, তাতেই এই দুর্ঘটনা। ঊর্ধ্বোৎক্ষিপ্ত পাথরের কুচি আর ধুলোর সঙ্গে রসাতল থেকে যেন একটা আর্তনাদ থেমে থেমে বেরিয়ে আসছে বুম বুম বুম। কোয়ার্টার্সের পিলারগুলো চাপের চোটে তুবড়ির মতো ধুলো হয়ে ফেটে পড়ছে। এরই মধ্যে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে পীটের মুখটা ঘিরে দেওয়া হয়েছে।

অন্যান্য ধাওড়া থেকে দলে দলে কুলিরা দৌড়ে আসছিল। মাঝপথেই দারোয়ানরা তাদের ফিরিয়ে দিয়েছে কাজে যাও সব, কিছু হয়নি। কেউ ঘায়েল হয় নি, মরে নি কেউ।

মার্চেন্টরা দল পাকিয়ে অন্ধকারে একটু দূরে দাঁড়িয়ে চাপা গলায় আলোচনা করছেন। গিবসন বলেন—মাটি দিয়ে ভরাট করবার উপায় নেই, এখনো দু’দিন ধরে ধসবে হাজিরা বইটা পুড়িয়ে আজই নতুন একটা তৈরি করে রাখো। অন্তত একশো নাম কমিয়ে দাও।

ম্যাককেনা বলেন—তাতে আর কি লাভ হবে? মহারাজার কানে পৌঁছে গেছে সব। তা ছাড়া, দ্যাট মাহাতো, তাকে বোঝাবে কি দিয়ে? কালকের সকালেই শহরের কাগজগুলো খবর পেয়ে। যাবে আর পাতা ভরে স্ক্যান্ডাল ছড়াবে দিনের পর দিন। তারপর আসবেন একটি এনকোয়ারী কমিটি, একটা গান্ধিয়াইট বদমাশও বোধহয় তার মধ্যে থাকবে। বোেঝ ব্যাপার!

সে রাতে ক্লাবঘরে আর আলো জ্বললো না। একসঙ্গে একশো ইলেকট্রিক ঝাড়ের আলো জ্বলে উঠলো প্যালেসের একটি প্রকোষ্ঠে। আবার ডাক পড়ল মুখার্জীর।

অভূতপূর্ব দৃশ্য! মহারাজা, সচিবোত্তম আর ফৌজদার—গিবসন, ম্যাককেনা, মূর আর প্যাটার্সন! সুদীর্ঘ মেহগনি টেবিলে গেলাস আর ডিকেন্টারের ঠাসাঠাসি।

সস্মিতবদনে মহারাজা মুখার্জীকে অভ্যর্থনা করেন। মাহাতো ধরা পড়েছে মুখার্জী ভাগ্যিস সময় থাকতে বুদ্ধিটা দিয়েছিলো।

গিবসন সায় দিয়ে বলে—নিশ্চয়, অনেক ক্লামজি ঝঞ্চাট থেকে বাঁচা গেল।

আমাদের উভয়ের ভাগ্য ভালো বলতে হবে।

এ বৈঠকের সিদ্ধান্ত ও আশু কর্তব্য কি নির্ধারিত হয়ে গেছে, ফৌজদার সেটা মুখার্জীর কানে কানে সংক্ষেপে শুনিয়ে দিলো। মুখার্জী চমকে ওঠে, ফ্যাকাসে হয়ে যায় মুখা তারপর শুধু হাতের চেটোয় মুখ গুঁজে বসে থাকে।

গিবসন মুখার্জীর পিঠ ঠুকে বলে—এসব কাজে একটু শক্ত হতে হয় মুখার্জী, নার্ভাস হবেন না।

রাতদুপুরে অন্ধকারের মধ্যে আবার চৌদ্দ নম্বর পীটের কাছে মোটর গাড়ি আর মানুষের একটা ভিড়া ফৌজদারের গাড়ির ভেতর থেকে দারোয়ানেরা কম্বল মোড়া দুলাল মাহাতোর লাশটা টেনে নামালো। ঘোড়ানিমের জঙ্গল থেকে ট্রাক বোঝাই লাশ এলো আরো ক্ষুধার্ত খনির গহ্বরের মুখে লাশগুলি তুলে নিয়ে দারোয়ানেরা ভুজ্যি চড়িয়ে দিলো একে একে।

শ্যাম্পেনের পাতলা নেশা আর চুরুটের ধোঁয়ায় ছল ছল করছিল মুখার্জীর চোখ দুটো গাড়ির বাম্পারের ওপর এলিয়ে বসে চৌদ্দ নম্বর পীটের দিকে তাকিয়ে সে ভাবছিল অন্য কথা। অনেক দিন পরের একটা কথা। লক্ষ বছর পরে, এই পৃথিবীর কোনো একটা জাদুঘরে, জ্ঞানবৃদ্ধ প্রত্নতাত্বিকের দল উগ্র কৌতূহলে স্থির দৃষ্টি মেলে দেখছে কতগুলি ফসিল। অর্ধপশুগঠন, অপরিণত মস্তিষ্ক ও আত্মহত্যাপ্রবণ তাদের সাব-হিউম্যান শ্রেণীর পিতৃপুরুষের শিলীভূত অস্থিকঙ্কাল, আর ছেনি হাতুড়ি গাঁইতা কতকগুলি লোহার ত্রুড কিম্ভুত হাতিয়ার। অনুমান করছে তারা, প্রাচীন পৃথিবীর একদল হতভাগ্য মানুষ বোধহয় একদিন আকস্মিক কোনো ভূ-বিপর্যয়ে কোয়ার্টস আর গ্রানিটের গহ্বরে সমাধিস্থ হয়ে গিয়েছিল। তারা দেখে, শুধু কতগুলি সাদা সাদা ফসিল, তাতে আজকের এই এত লাল রক্তের কোনো দাগ নেই!

No comments