ঘণ্টাধ্বনি – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
সাঁঝবেলাতে গোয়ালঘরে ধুনো দিতে গিয়ে কালিদাসী শুনতে পেল, রামমন্দিরে খুব তেজালো কাঁসি বাজছে। কাঁইনানা, কাঁইনানা।
গুন্টু দুপুর থেকে বাড়ি নেই। আলায় বালায় সারাদিন ঘোরে। মাথাগরম ছেলে। যখন তখন হাফ-পেন্টুল খুলে পুকুরে ঝাঁপায়। চৌপর দিন জলে দাপাদাপি করে। কবে জলের ঠাকুর টেনে নেয় ছেলেটাকে! তবে ভরসা এই, গুন্টুর প্রাণে ভক্তি আছে। সন্ধে হলেই রামমন্দিরে গিয়ে বুড়ো বাজনদার আফিংখোর গোবিন্দর হাত থেকে কাঁসি কেড়ে নিয়ে নেচে-নেচে বাজায়। ওই বাজাচ্ছে।
এখন। কাঁইনানা, কাঁইনানা।
কেলে গরুটার নাম শান্তি। ভারী নেই-আঁকড়া। কালিদাসীকে পেয়ে গলা এগিয়ে দিল। ভাবখানা—একটু চুলকে দাও। তা দেয় কালীদাসী। খানিকক্ষণ তুলতুলে কম্বলের মতো গলায়। আঙুলের কাতুকুতু দিতে থাকে। অন্য গরু শিপ্রা ফোঁসফোঁস করতে থাকে। শিং নাড়া দেয়; কালিদাসী বলে–রোসো মা তোমাকেও দিচ্ছি। এ মুখপুড়ীর আর কিছুতেই আরাম ফুরোয় না।
মন্দিরে আরতি হচ্ছে। চক্কোত্তিমশাইয়ের এই সময়ে প্রায়দিনই ভাব হত। ভাব হলে হাত-পা টানা দিয়ে চিত হয়ে পড়ে মুখে গাঁজলা তুলে নানা কথা বলত। সে সব কথা স্বয়ং ভগবানের। একবার কালীদাসীকে বলেছিল—ও কালী, ভুরের পায়েস খাব, এনে দিবি?
তা ভুরে গুড় দিয়েছিল কালীদাসী। একটু আধটু নয়, আধ মণেরও বেশি হবে। তাই দিয়ে সেবার বিরাট পায়েস ভোগ লাগানো হল মন্দিরে।
চক্কোত্তিমশাই এখন বয়সে পঙ্গু হয়ে টিনের চারচালায় দাওয়ায় চৌকি পেতে বসে থাকে দিন। রাত। তামাক খায়। সেজ ছেলে মনোরঞ্জন এখন মন্দিরের সেবাইত। কালিদাসীর এখন আর যাওয়ার সময় হয় না। প্রায়ই ভাবে একদিন গিয়ে বসে আরতি দেখবে।
ধোঁয়ায় ধোঁয়াঙ্কার গোয়ালঘরে কালীদাসীর ভালো করে ঠাহর হয় না কিছু। টেমি হাতে এগিয়ে গিয়ে খড়ের গাদা গোছ করতে হাত বাড়িয়েই মধ্যের আঙুলে কাঁকড়াবিছের হুল খেয়ে উঃহুঃকরে ওঠে।
ত্রিশ বছর আগে যখন প্রথম কাঁকড়াবিছের হুল খেয়েছিল কালিদাসী তখন যন্ত্রণার চোটে সে কী দাপাদাপি! হাসপাতাল পর্যন্ত যেতে হয়েছিল! পুরো চব্বিশ ঘণ্টা সে বিষ-ব্যথা থানা গেড়ে ছিল ডান পায়ের বুড়ো আঙুলে।
তারপর মাসটাক যেতে-না-যেতে ফের একদিন হুল দিল। আবার দাপাদাপি। আবার হাসপাতাল। কিন্তু কাঁকড়াবিছেরা কালিদাসীকে সেই থেকে কেমন যে পেয়ে বসল। কাছে পেলেই হুল দেয়। এই ত্রিশ বছর ধরে মাসকে দু-তিনবার দিচ্ছে। অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে এখন, তেমন লাগে না।
কালিদাসী টেমি রেখে খানিক কাঁচা গোবর বাঁ-হাতের মাঝের আঙুলটায় বসাল ঠিক যেমন গোলাপগাছের ডগায় লোকে গোবরের ঢিবলি দেয়।
কালিদাসীর শরীরটা কাঁকড়াবিছের বিষে ভরে গেছে। এখন বিষে বিষক্ষয় হয়ে যায়।
আশ্চর্য এই বাচ্চা দেওয়ার সময়ে মেনি বিড়ালটা গোয়ালঘরে এসে ওই খড়ের গাদায় বাসা বাঁধে। ফুলি কুকুরটা তো ফি-বছর খড়ের মাচার নীচে গর্ত করে চার-পাঁচটা ছানা বিয়োয়। গরু দুটো সম্বচ্ছর এই ঘরে রাত কাটায়। এগুলোকে কোনওদিন হুল দেয়নি পোড়ারমুখোরা। মানুষের ওপর যত ওদের রাগ। আর মানুষের মধ্যে আবার সবচেয়ে ঘেন্নার হল ওদের কালিদাসী হতভাগী।
আঙুলে-গোবরে করে টেমি হাতে কালিদাসী গোয়ালঘর থেকে বেরিয়ে এসে কাঠের কপাটটা টেনে দিতে-দিতে আপনমনে বকবক করছিল—ঝাটাখেকো, কেলেঘেন্না, খালভরাগুলো কোথাকার! কালিদাসীর কাছে বড় জো পেয়েছিস।
নীচের তলার নতুন ভাড়াটে হেম ঘোষ, নতুন বিয়ে করেই মা-বাপ-ভাই ছেড়ে আলাদা বাসা করে উঠে এসেছে। তার বউ রেবা নাকি বড়ঘরের মেয়ে, কাজকর্ম করতে পারবে না। শ্বশুরবাড়িতে শুয়ে বসে থাকত বলে শাশুড়ির সঙ্গে ঝগড়া বেধে পড়ল। হেম ঘোষ বউয়ের পক্ষে। বাড়ি ছেড়ে উঠে এল। চাকরি তার তেমন কিছু নয়। দাশনগরে এক তালা তৈরির কারখানায় চাবির খাঁজ কাটে। ত্রিশ টাকার ঘর ভাড়াও দু-মাস বাকি ফেলেছে। তবু বউয়ের সুবিধের জন্য সবসময়ে কাজ করার বাচ্চা ঝি বহাল করেছে, তার ওপর ঠিকে কাজের লোক তো আছেই।
দাওয়ায় বসে লুঙ্গি পরে হেম বিড়ি খাচ্ছিল। কালিদাসীর বকবকানি শুনে বলল–কী হল দিদিমা? কাঁকড়াবিছে কামড়াল বুঝি?
কালিদাসী বলল—তা কামড়াবে না কেন বাবা? কালিদাসী যে ভালোমানুষের মেয়ে হয়ে
শতেক পাপ করেছে।
হেম ঘোষ বিড়িটা ফেলে একটু তটস্থ হয়ে বলে—এ তো বড় মুশকিলের কথা হল দিদিমা! এ বাড়িতে বড় দেখছি কাঁকড়াবিছের উৎপাত! রেবাকে যদি কামড়ায় তো রক্ষে নেই।
কালিদাসী মনে-মনে বলে—বউকে তাজমহলে নিয়ে গিয়ে রাখো গে যাও। দেখালে বটে তোমরা বাপ! আজকালকার রত্তি মেয়েরা কী করে যে গোটাগুটি পুরুষ মানুষগুলোকে হজম করে বসে থাকে!
ওপরের বারান্দায় উঠে আসতে-আসতে কালিদাসী ফের মন্দিরের শব্দ শোনে। গুন্টু কাঁসি বাজাচ্ছে। কাঁইনানা, কাঁইনানা।
টেমি ফুঁ দিয়ে নিবিয়ে দেয় কালিদাসী। বুড়ো বয়সের ভুল। মন্দার মা বারান্দায় বসে উনুন সাজাচ্ছে, এক্ষুনি দেশলাই চাইবে। টেমিটা না নেবালে, দেশলাইয়ের কাঠি বাঁচত। ছাদে গিয়ে উনুন ধরাতে মন্দার মা না হোক চার-পাঁচটা কাঠি নষ্ট করবে।
এসবই কালিদাসীর জ্বালা। সংসারে আছে এক উড়নচণ্ডী ছেলে, আর মেয়ের ঘরের নাতি ওই গুন্টু। তবু সংসারের হাজার চিন্তায় কালিদাসীর ডুবজল।
.
দুই
কানাই মাস্টারের আজ সারাদিন বড় হতভম্ব লাগছে।
এমনিতে কানাই বড় নিরীহ লোক। তিন বছর হল তার দশ বছর বয়সি ছেলেটা এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে শয্যাশায়ী প্রায়। শরীরের সবক’টা হাড়ের জোড়ে বিষযন্ত্রণা। হাঁটু, কনুই, কবজি সব ফুলে আছে। শরীরটা শুকিয়ে যাচ্ছে। হাসপাতালের ডাক্তাররা ঠারেঠোরো বলেছে, ভালো হওয়ার রোগ নয়।
কানাই মাস্টারের একটাই ছেলে, আর মেয়ে দুটো। তার নিজের বয়স বেশি নয়, চল্লিশ টল্লিশ হবে। কিন্তু এ বয়সেই বড় বুড়োটে মেরে গেছে কানাই। ছেলের চিন্তা উদয়াস্ত ভিতরটা কুরে খায়। তার ওপর ক’টা টিউশনি করে রসকষ আরও মরে যাচ্ছে ক্রমে।
আজ হল কী, ইস্কুলের আট ক্লাসে থার্ড পিরিয়ডে ক্লাস নিচ্ছে। মদন নামে ধেড়ে ছেলে আছে একটা। তার গলায় আবার কালো তাগায় বাঁধা রুপোর তক্তি। রাঙামুলো চেহারা। কোনওকালে পড়াশুনোর ধার মাড়ায় না। পড়া জিগ্যেস করলে শুভদৃষ্টির সময় নববধূ যেমন চোখ নামায় তেমনি নতচোখে চেয়ে থাকে মেঝের দিকে। তার বাপ বড় কারবারি, তাই মাসকাবারে ইস্কুলের বেতন কখনও বাকি পড়ে না। সেই কারণে কেউ বড় একটা ঘাঁটায়ও না মদনকে। আছ মদন, থাকো মদন, গোছের ভাব করে সবাই তাকে এড়িয়ে যায়। প্রতি ক্লাসে তিন-চার বছর করে থাকলে মদনের বাবদ ইস্কুলের একটা স্থায়ী আয় তো বহাল রইল। এমনিতে ইস্কুলের ছেলেদের মধ্যে শতকরা ষাট সত্তরজনই ডিফলটার। কারও সাত-আট মাসের বেতন বাকি পড়ে আছে। ধমক চমক করলে গারজিয়ানরা এসে হেডস্যারের হাতে পায়ে ধরে। সেই সব গারজিয়ানরাও ‘দিন আনি, দিন খাই’ গোছের। কেউ বিড়ি বাঁধে, কারও তেলেভাজার দোকান, একজন গামছা ফিরি করে ময়দানে। এইরকম সব। তাদের মধ্যে মদনের বাবা হচ্ছে নৈবেদ্যর কলা।
মদনা ক্লাস এইটে পড়লেও তো আর ছেলেমানুষ নয়। বয়সের ডাক দিয়েছে। শরীর জাম্বুবানের মতো বড়সড়ো।
বয়সের দোষই হবে। রোজই ইস্কুলের সামনের রাস্তা দিয়ে বীণাপাণি ইস্কুলের মেয়েরা যায়। ইস্কুলের বড় ক্লাসের ধেড়ে ছেলেরা এই সময়টুকুতে রাস্তার মোড়ে, সামনের বারান্দায়, পাশের মাঠে জমে থাকে। কেউ দেখিয়ে-দেখিয়ে সিগারেট টানে, কেউ সাইকেলে করে বোঁ চক্কর মারে। যার যা আছে সব দেখায় মেয়েদের। হাসি-টাসি তো আছেই। ছেলেদের এইসব বোকামি দেখে মেয়েদের কেউ-কেউ হাসিতে ঢলাঢলি করে যায়, কেউ গম্ভীর মুখে দৌড়-হেঁটে পালায়, দু একজন ‘জুতো মারব, লাথি মারব’ গোছের কথা বলে শাসিয়েও গেছে। নিত্যিকার ঘটনা, কারও গায়ে লাগে না। আজ হল কী, থার্ড পিরিয়ডে যখন কানাই ক্লাস নিচ্ছে তখন টুকটুক করে একটা ফুটফুটে বছরদশেকের মেয়ে সোজা সরল পায়ে ক্লাসের দরজায় এসে দাঁড়িয়ে পাখির কণ্ঠে বলল, মাস্টারমশাই!
কানাই অবাক। মেয়েটার পরনে ইস্কুলের সাদা ইউনিফর্ম, হাঁটু পর্যন্ত বাহারি মোজা। মুখচোখ ভারী তিরতিরে সুন্দর।
কানাই মাস্টার মুগ্ধ হয়ে বলল, এসো মা। কী হয়েছে বলো তো?
মেয়েটা ক্লাসে ঢুকে একটা ভাঁজকরা কাগজ কানাইয়ের সামনের টেবিলে রেখে বলল, মাস্টারমশাই একটা দুষ্টু ছেলে আমি ইস্কুলে যাওয়ার সময় আমার হাতে এটা দিয়ে বলল, এটা বাড়ি নিয়ে গিয়ে লুকিয়ে পোড়। কীসব বাজে কথা লেখা আছে দেখুন। ওই ছেলেটা। বলে মেয়েটি মদনকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়–
কানাই চিঠিটা খুলে দেখে তাতে লেখা—প্রীয়তম রোজী আমি তোমাকে ভালোবাসে আমার মোনের কথা তুমি কী বুঝতে পারো না? কিস জানিবে। তোমার প্রীয় মদন।
চিঠির ওপর শ্রীকালী লিখতেও ভুল হয়নি।
কানাই দুটো কারণে চটে গিয়েছিল। এক তো মেয়েদের চিঠি দেওয়া সাঙ্ঘাতিক বেয়াদবি। তার ওপর এইটুকু একটা চিঠিতে এতগুলো বানান ভুল!
—তুমি এসো মা, আমি দেখছি। এই বলে কানাই মাস্টার রোজিকে বিদায় করে মদনকে ডাকল। যখন ডাকল তখনই একটা বেসামাল রাগ পেটের ভিতর থেকে উঠে আসছিল তার। সেই রাগে হাত থরথর করে কাঁপে, মাথাটা ঘোলা লাগে, দাঁতে-দাঁতে বাতাস পেষাই হয়।
মদন কাছে আসতেই বিনা প্রশ্নে প্রথমে চুলের মুঠি ধরে মাথাটা নামিয়ে ঠক করে টেবিলে ঠুকে দিল কানাই। সেই সঙ্গে পিঠে যত জোরে সম্ভব এক কিল। বোঝা গেল মদনের চেহারাটা বড়সড়ো হলেও গাটা নরম। কিলটা নরম চর্বির থাকে এমন পড়ল যেন জলে কিল মারবার মতো মনে হল।
মদন এমনিতে ঠান্ডা ছেলে, সাত চড়ে রা কাড়ে না। আজও কাড়ল না। তাইতেই কানাইয়ের মাথাটা আরও বিগড়ে গেল। হারামজাদা, গিদ্ধড়, পাজি, বদমাশ, নরাধম ঠিক নামতার মতো মুখে বলে যাচ্ছে কানাই আর মারছে। সে কী মার! মারের চোটে একবার গিয়ে দেয়ালে পড়ল, একবার ব্ল্যাকবোর্ডে ফাস্ট বেঞ্চের ডেস্কের কোণায় লেগে কপালটা ফেটে রক্ত ঝরতে লাগল। সমস্ত ক্লাস পাথরের মতো নিশ্চল। শুধু সামনের ফাঁকা জায়গাটায় বেধড়ক ঠ্যাঙানি চলেছে তো চলেইছে। ডাস্টারটা দিয়েও কানাই মাস্টার মদনের চোয়াল, মাথা কান ফাটিয়ে দিয়েছিল আজ।
এরকম মার বড় একটা দেখা যায়নি স্মরণকালে। আর কানাই মাস্টার নিজের ছেলের অসুখ হওয়ার পর থেকেই মারধর করা ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু আজকের খ্যাপা মার দেখে আশপাশের ক্লাস ফেলে মাস্টারমশাইরা ছুটে এসে দরজার কাছে ভিড় করে ফেললেন। কিন্তু কেউ কিছু বলতে বা করতে ভরসা পাচ্ছিলেন না। শেষপর্যন্ত হেডস্যার এসে মাঝখানে পড়ে সেই আসুরিক ব্যাপার থামালেন। মদন তখন রক্তমাখা মুখে, ফাটা ঠোঁটে, ফোলা গাল, ছেড়া চুল আর তোবড়ানো জামাকাপড়ে পাগলের মতো চেঁচাচ্ছে—স্যার, আমাকে মেরে ফেলুন স্যার! আমাকে মেরে ফেলুন স্যার! জুতো মারুন স্যার, আমি আজই সুইসাইড করব স্যার।
মদন এত কথা কখনও বলে না। মার খেয়ে আজ তার মাথা বিগড়ে গিয়েছিল। মার খাওয়ার পরও তার চেঁচানি আর থামে না। কেবল কাঁদে আর আরও মারতে বলে, সুইসাইড করবে বলে চেঁচায়। নিজের ক্লাস থেকে ছুটে বেরিয়ে সে সারা ইস্কুলময় দৌড়োদৌড়ি করে চেঁচিয়ে কাঁদতে লাগল।
কানাই মাস্টারের কুপিত বায়ু যখন ঠান্ডা হল তখন সে মদনের আচরণ দেখে ভয়ে হতভম্ব হয়ে গেল। ছেলেটার হল কী?
টিচার্স রুমে কানাই মাস্টারকে সবাই ধরে এনে পাখার তলায় বসিয়েছে। ইস্কুলের সামনে পাবলিকের ভিড় জমে গেছে। এই অবস্থায় মদন দৌড়ে গিয়ে মাস্টারমশাইদের পায়ের ওপর গড়িয়ে পড়ে বলছে, লাথি মারুন স্যার, জুতো মারুন স্যার। আবার উঠে গিয়ে আর একজনের পায়ে পড়ে ওরকম বলে।
হেডমাস্টারমশাই এসে কানাই মাস্টারের কানে-কানে বললেন,—ছেলেটার ব্রেনটা বোধহয় ড্যামেজ হয়েছে। আপনি আর স্পটে থাকবেন না, বাড়ি চলে যান।
শুনে কানাইয়ের শরীর হিম হয়ে এল। আর বুকের কী ধড়ফড়ানি! শশী বেয়ারা রিকশা ডেকে দিল। কানাই স্কুল থেকে বাড়ি ফিরেই শ্যা নিয়ে রইল। সারাদিন ভাবছে—এ আমার আজ কী হয়েছিল? এ আমি করলাম কী?
বিকেলের দিকে একবার উঠে এসে নিজের ছেলের বিছানায় বসল কানাই। কৃশ করুণ মুখ তুলে ছেলেটা চাইল বাবার দিকে। একটু হাসল। সে হাসি কান্নার ওপরকার সরের মতো। বড় সহ্যশক্তি ছেলেটার। কত সহ্য করছে! কানাই ভাবে, ওর ব্যথাগুলো কেন আমার হয় না?
ভাবতে-ভাবতে বিছের হুলের মতো মদনের কথা মনে পড়ে। বড় যন্ত্রণা হয় বুকের মধ্যে। এত পাপ কি ভগবান সইবেন? মদনের যদি ভালোমন্দ কিছু হয় তো তার কর্মফল কানাইতেও অর্সাবে। যদি সেই পাপ ছেলেটার ওপর এসে পড়ে?
বাইরে কে ডাকছে। কানাইয়ের বউ দিনরাত কেঁদেকেটে মাথা খুঁড়ে আজকাল বড় রোগা হয়ে গেছে। চেনা যায় না! সে এসে বলল, ইস্কুলের ছেলেরা এসেছে। বুক কেঁপে গেল। তবু নিজেকে শক্ত করে উঠে এল কানাই।
বড় ক্লাসের কয়েকটা ছেলে গম্ভীরমুখে বাইরে দাঁড়িয়ে। একজন মাতব্বর গোছের ছেলে বলল, স্যার মদনকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
—হাসপাতাল! বলে কানাই হাঁ।
অন্য একটা ফচকে ছেলে বলল, আপনি ঘাবড়াবেন না স্যার। কয়েকটা স্টিচ পড়েছে মাত্র। আর কিছু নয়।
ছেলেরা চলে গেলেও হতভম্ব ভাবটা যায়নি কানাই মাস্টারের। ঘর থেকে কয়েকদিন না বেরোনোই ভালো। ছেলেগুলো নিশ্চয়ই খেপে আছে। কে কোথা থেকে আধলা ছুড়বে হয়তো। না হলে ধরে ঠ্যাঙালেই বা কী করার আছে! সবচেয়ে চিত্তির হয় যদি মদনের বাবা পুলিশের কাছে। যায়। যায়নি কি আর! গেছে। পুলিশও বোধহয় এতক্ষণে রওনা হওয়ার জন্য কোমরের কষি বাঁধতে লেগেছে। রক্তপাতে ফৌজদারি হয় সবাই জানে।
ছেলের মা এসে বলল, বাজারে যাও। তেল মশলা কিছু নেই।
শ্বাস ছেড়ে কানাই ওঠে। সন্ধের মুখে রামমন্দিরে আরতির ঘণ্টা বাজছে। সঙ্গে ঠনঠন কাঁসির আওয়াজ রোজ ভালো লাগে না। আজ লাগল। ঘণ্টা ডাকছে।
কানাই বেরিয়ে পড়ে। চোখে জল আসছে। বুকটা কেমন করে। কোনওকালে মন্দিরে যায় না কানাই মাস্টার। আজ ভাবল একবার যাবে। বুড়ো চক্কোত্তিমশাইয়ের সঙ্গে একবার দেখা করে আসবে। সবাই বলে লোকটা খুব বড় মানুষ। এককালে তাঁর ভর হত। জিগ্যেস করবে—আমার পাপ কি ছেলেতে অর্সাবে ঠাকুর?
.
তিন
রেবার গানের মাস্টারমশাই এসেছে। লোকটা ছোকরা, তার ওপর গান শেখায়। এসব লোক বড় বিপজ্জনক হয়।
তাই প্রথম-প্রথম গানের মাস্টার এলেই হেম গিয়ে ঘরে মোড়া পেতে বসে সব লক্ষ করত। গানের আড়ালে আবডালে দুজনের কোন হেলন-দোলন নজরে পড়ে কি না।
একদিন রেবা ধমক দিল মাস্টারমশাই চলে যাওয়ার পর। বলল, সুরের কিছু বোঝে না, তবু সামনে গিয়ে অমন হাঁ করে বসে থাকো কেন বলো তো? তুমি সামনে থাকলে আমার গাইতে বড় লজ্জা করে। আর কখনও ওরকম করবে না বলে দিচ্ছি।
কপাল এমনই যে হেমের বউ রেবা বেশ সুন্দরীই। সাদাটে রং, লম্বাটে গড়ন, মুখখানা মন্দ নয়, তার ওপর চোখ দুখানা ভারী মিঠে। এমন করে তাকায় যেন সবসময় বড় অবাক হয়ে আছে। এইরকম বউ যার থাকে তার বড় জ্বালা।
হেমের আজকাল বারবার ডাইসে হাত পড়ে যায়। লোহার হেঁকাও বিয়ের পর থেকে বড় বেশি খাচ্ছে হেম। কারখানায় কাজের সময়ে অন্যমনস্ক থাকলে আরও কত বিপদ হতে পারে। রেবার মতো সুন্দরী বউ জুটবে এমন ভরসা তার ছিল না কখনও, তবু কোন পুরুষ না বিয়ের আগে সুন্দরী বউয়ের কথা ভাবে। হেমও ভাবত। কিন্তু এ জ্বালা জানলে বিয়েতে বসবার আগে আর একবার ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখত সে।
বিয়ের পর একদিন হাওড়ার খুরুট রোডের কাছে সিনেমা দেখতে গেছে। টিকিট কাটবার পর শো শুরু হতে দেরি আছে দেখে হেম রেবাকে নিয়ে লেমোনেড খেতে গেল। রেবা লেমোনেড দিয়ে দুটো মাথা ধরার বড়ি খেল। রেবার বড়ি খাওয়ার দৃশ্যটা হাঁ করে দেখছিল হেম। দেখতে গিয়ে এত মজে গিয়েছিল যে সে নিজেও রেবার মতো ঘাড় উঁচু করে হাঁ করে বড়ি গেলার মতো ভাব করে ফেলেছিল নিজের অজান্তে। তারপর যখন রেবা লেমোনেডের ঝাঁঝে মুখচোখ কোঁচকালো তখন তাই দেখে হেমেরও কোঁচকালো। আর এইসব হওয়ার সময়ে দোকানের চাওড়া আয়নায় হেম হঠাৎ দেখতে পায় তিন-চারটে বখা ছেলে রাস্তার ওপাশে দাঁড়িয়ে রেবার দিকে চেয়ে নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি বলাবলি করছে।
ভ্রূ কুঁচকে খানিক চেয়ে থাকে সে। মাথা বিগড়ে গেল। সে গুন্ডা নয়, কিন্তু তখন মনে হয়েছিল, হলে ভালো হত। তার বউয়ের দিকে না হয় লোকে তাকাবে—এ কেমন কথা?
হলে ঢুকবার পর গন্ডগোলটা পাকাল। সেই তিনটে ছোঁড়া একেবারে পিছনের সিটে। হেম ছবি দেখবে কী, বারবার ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে দেখছে। নিউজরিল শেষ হয়ে ইন্টারভ্যালের আলো জ্বলবার সময়ে দেখল এক ছোকরা রেবার সিটের পিছনে হাত রেখেছে। আর যাবে কোথায়!
–কীরকম ভদ্রলোক হে তুমি? ভদ্রমহিলার একেবারে ঘাড়ের ওপর হাত রেখেছ? এই বলে খেঁকিয়ে উঠেছিল সে।
ছেলেগুলো আচমকা ধমক খেয়ে প্রথমটায় ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেল। তারপরই তেড়ে খুঁড়ে উঠে তারাও তড়পাতে থাকে—কে মেয়েছেলের ঘাড়ে হাত রেখেছে? আপনি তুমি-তুমি করে বলছেন কেন? অত উঁচিবাই থাকলে মেয়েছেলে সিন্দুকে ভরে রেখে আসবেন। লেডিজ সিটে গিয়ে বসবেন এবার থেকে।
হেম হাতফাত চালিয়ে দিত ঠিক। রেবাই তাকে সামলায়। পরে বাড়ি ফেরার সময় বলেছিল —ওরা কিছু তো করেনি, তুমি রেগে গেলে কেন?
রাগ যে কেন হয় হেমের, তা কারও বোঝার নয়। এই জীবনটা এইরকম জ্বলে পুড়ে যাবে।
ছোকরা গানের মাস্টার ঘরে সন্ধের আলো জ্বালাবার মুখটাতেই এসে হাজির। রেবা প্রায় দুপুর-দুপুর বেলা থেকে খুব সেজে বসে আছে। কোলে ভোলা গানের খাতা নিয়ে বিছানায় আসন। পিঁড়ি হয়ে বসে তখন থেকে ‘তৃষ্ণাতুরের কেউ জল চায় কেউ বা সিরাজি মাগে’ লাইনটায় সুর লাগাচ্ছে। হেমকে দেখেও দেখছে না।
হেম ঘোষের গলায় এক সময়ে সুর ছিল। না ঠিক গানের গলা নয়! তবে সিনেমা বা রেডিওর গান গুনগুন করতে-করতে প্রায় সুরটা এনে ফেলত।
আচ্ছা, এমন হতে পারে না কি যে, হেম খুব গোপনে কোনও বড় ওস্তাদের কাছে গিয়ে গান শিখে খুব বড় গাইয়ে হয়ে গেল একদিন। রেবা টেরও পেল না এত কাণ্ড। তারপর কোনওদিন হয়তো রেবার মাস্টার গান শেখাতে এসে সুর তুলতে গলদঘর্ম হচ্ছে, এমন সময়ে সাদামাটা চাবির কারিগর হেম ঘোষ হঠাৎ সবাইকে চমকে দিয়ে ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে নিখুঁত সুরে গানটা গেয়ে দিল! রেবা তখন যা অবাক হয়ে তাকাবে না। সেই দিনই মাস্টারকে অহঙ্কারের সঙ্গে বলে দেবে আর আপনাকে দরকার হবে না প্রভাসদা। তারপর হেমের সঙ্গে যখন একা হবে রেবা তখন দু-হাতে গলা জড়িয়ে ধরে হেমের কালো মোটা ঠোঁটে চুমু খেয়ে বলবে—তোমার ভিতর কত জাদু আছে বলো তো! তখন হেম খুব হাসবে। খুব হাসবে। একেবারে হেঃ হেঃ করে পেট ভরে হেসে নেমে একচোট।
দাওয়ার বসে খানিকক্ষণ এইসব ভাবল সে। ঘর থেকে গান আসছে, গোয়াল থেকে মশা আর শুকনো গোবরের গন্ধ। কাঁকড়াবিছের চিন্তাটাও বড্ড পেয়ে বসেছে হেমকে। চক্কোত্তিমশাই। অনেক ওষুধ জানেন। দিনেকালে কত শক্ত রোগ ভালো করেছেন বলে শোনা যায়। একবার চক্কোত্তিমশাইয়ের কাছে গিয়ে কাঁকড়াবিছে কামড়ালে কী ওষুধ দিলে আরাম হয় তা ফাঁকমতো জেনে আসবে হেম। রেবার যা সুখের শরীর, একবার বিষবিচ্ছুর কামড় খেলে ফুলের মতো শরীরটা নীলবর্ণ হয়ে নেতিয়ে পড়বে না? ভাবতেই গা শিউরে ওঠে।
‘…কেউ বা সিরাজি মাগে—এ এ’ গানের মাস্টারের ভরাট গলার সঙ্গে ডুয়েটে রেবার কোকিলস্বর জড়ামড়ি করছে। সইতে পারে না হেম ঘোষ। বিড়িটা নিবে গিয়েছিল, আর ধরাতে ইচ্ছে হল না। ফেলে দিয়ে উঠে দাঁড়াল। বেরোবে।
হেমের পরনে লুঙ্গি আর গেঞ্জি। গেঞ্জির ওপর জামাটা চড়িয়ে নিলে হত। কিন্তু এসময়টায় ঘরে ঢুকতে সাহস হয় না। রেবা রেগে যাবে ঘরে ঢুকলে।
উঠোনে পাঁচিল দিয়ে ঘেরা, পাঁচিলের গায়ে বেরোনোর দরজা। ঠিক দরজার চৌকাঠে মুখোমুখি কালিদাসীর ছেলে অভয়পদর সঙ্গে দেখা। অভয়পদর হাতে এক ঠোঙা ঝালমুড়ি। ঝালের চোটে শিস টানছিল। হেম ঘোষকে দেখে ঠোঙাটা এগিয়ে ধরল। হেম হাত পাতলে ঠোঙা উপুড় করে দেয় অভয়। তলানি মুড়িতে যত কুঁড়ো মিশে আছে। তাই মুখে ফেলে হেম ঘোষ বলে—খবর কী?
—আর খবর! অভয়পদ বলে—আজও মোহনবাগানের একটা পয়েন্ট গেল।
হেম ঘোষ খেলার মাঠের খবর রাখে না। তবু অভয়পদকে তোয়াজ করবার জন্য বলল, এঃ হেঃ! একটা পয়েন্ট চলে গেল?
অভয়পদর বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। হাওড়ার বিখ্যাত মাতব্বর জ্ঞান সরকারের শাগরেদ। জ্ঞানদা ওর মাথাটা খেয়ে রেখেছে। ঘুমে জাগরণে সবসময়ে ওর মুখে জ্ঞানদা আর মোহনবাগানের কথা। কবে জ্ঞানদা ডেকে অভয়পদর সঙ্গে গোপন পরামর্শ করেছে, কবে যেন। বলেছে—অভয়, আমার বাড়িতে একটা বাচ্চা চাকর ঠিক করে দিস তো, কবে হয়তো জ্ঞানদার গাড়িতে উঠে বড়বাজারের লোহাপট্টিতে গেছে, এসবই অভয়পদর বলবার মতো কথা। আজকাল অভয়পদকে দেখলেই লোকে সটকাবার তাল করে। কাঁহাতক জ্ঞানদার বৃত্তান্ত শোনা যায়!
হেম ঘোষের সেই ভয়। তবে কিনা অভয়পদর আর কোনও দোষ নেই। বরং জ্ঞানদার শাগরেদি করে সে চিরকুমার রয়ে গেছে, মেয়েমানুষকে খুব ভক্তিশ্রদ্ধা করে, লোকের বেবিফুড জোগাড় করে দেয়, ইলেকট্রিক বিল জমা দিয়ে আসে পাঁচজনের। মড়া পোড়াতে যায়। বাড়ি ভাড়ার টাকা তুলে, দুধ আর খুঁটে বেচে মা কালিদাসী সংসারটাকে কষ্টেসৃষ্টে টেনে নেয়। নিষ্কর্মা অভয়পদ তাই বড় সুখে আছে।
অভয়পদ বলল—আজ একটা মিটিং আছে জ্ঞানদার বাড়িতে, বুঝলে? চা-টা খেয়েই বেরোব।
—খুব ভালো। বলে হেম বেরিয়ে আসছিল।
মানুষ যে কেন খামোকা মিটিং করে মরে আজও হেম বোঝে না। যত সব ফালতু কারবার। দশটা মাথা এক হয়ে যত সব গুজুর-গুজুর, ফুসুর-ফুসুর।
সিঁড়ির মুখ থেকে অভয়পদ ফিরে এসে বলল—ও হেম, শোনো।
হেম ভয়ে সিঁটিয়ে যায়। মিটিং-এর কথা না ফেঁদে বসে। ওসব কথায় বড্ড মাথা বিগড়ে যায় তার।
অভয়পদ গলার স্বর নামিয়ে বলে তোমার বউ কি সিগারেট-টিগারেট টানে নাকি! রাতে ওপরের বারান্দা থেকে যেন দেখলুম উঠোনে রেবা সিগারেটে টান মারতে-মারতে পায়চারি করছে।
কী কেলেঙ্কারী! হেমের ভিতরটা যেন লজ্জায় গর্তের মতো হয়ে যায়। কাল তখন অনেক রাতে তারা স্বামী-স্ত্রী জ্যোছনা দেখতে উঠোনের দিকে দাওয়ায় এসে বসেছিল একটু। এমনিতে হেম ঘোষ সিগারেট খায় না, রেবার চাপাচাপিতে ইদানীং খেতে হচ্ছে। কাল রাতেও খাচ্ছিল। সদ্য ধরানো সিগারেটটায় দু-টান দিতে না দিতেই রেবা হাত থেকে কেড়ে নিয়ে বলল—আমি খাব।
হেম অবাক। দেখে, রেবা দিব্যি ফসফস টান মারছে। কাশিটাশি নেই, চোখে জলও এল না ধোঁয়ায়। বলল—আগে খেতেটেতে নাকি?
–কত! বাবার প্যাকেট থেকে চুরি করে অনেক খেয়েছি। বেশ লাগে।
বলে রেবা সিগারেট টানতে টানতে উঠোনে ঘুরে বেড়াতে লাগল। সেসময়ে বাড়ির কারও জেগে থাকবার কথা নয়। তারাও কিছু টের পায়নি। রামচন্দ্র হে! অভয়পদ দেখে ফেলেছে তবে!
হেম ঘোষ হেসে আমতা-আমতা করে বলে—ওই শখ করে দুটো টান দিয়েছিল আর কী! তারপর কেশে-টেশে ফেলে দেয়।
অভয়পদ আদর্শবাদী লোক। মুখটা কেমনধারা করে বলল—দেশটা যে একেবারে সাহেব হয়ে গেল হে হেম! ভারতবর্ষের কত সম্পদ ছিল!
কথাটা ভালো বুঝল না হেম। অভয়পদও বুঝিয়ে বলল না। চলে গেল।
রেবাকে সিগারেট খেতে অভয় দেখেছে, লজ্জা শুধু সে জন্যই নয়। হেম ঘোষ আর-একটা কথা ভেবে থমকে দাঁড়িয়ে জিভ কাটল। কী কেলেঙ্কারী! কাল জ্যোছনায় তাদের দুজনেরই বড় রস উস্কেছিল। নিরিবিলি, নিশুতি জ্যোছনায় পরীর মতো বউটাকে দেখে খুব দু-চারটে দেহতত্বের কথা হেসে-হেসে বলে ফেলেছিল হেম। রেবাও দু-চারটে ভালো টিপ্পনি ঝেড়েছিল। দোষের কথা নয়। স্বামী-স্ত্রী একা হলে এরকম কত কথা হয়! কিন্তু সেসবই যে শুনে ফেলেছে অভয়পদ! কী লজ্জা! কী লজ্জা!
এই জিভ কাটা অবস্থায় হেম ঘোষ যখন দাঁড়িয়ে ঠিক তখনই এক জোড়া মাঝবয়সি স্বামী-স্ত্রী ভুইফোঁড়ের মতো তার সামনে কোত্থেকে হাজির হয়ে আচমকা বলল—আচ্ছা মশাই, গুন্টু কি বাড়িতে আছে?
আর-এক দফা লজ্জা পেয়ে হেম বলেনা, সে মন্দিরে কাঁসি বাজাতে গেছে।
.
চার
গুন্টু যখন কাঁসি বাজায় তখন সে নিজেই শব্দ হয়ে যায়। ব্যাপারটা কীরকম হয়, কাঁসি বাজাতে বাজাতে শব্দটা আস্তে-আস্তে বড় হতে থাকে। কাঁইনানা-কাঁইনানা হয়ে বাজতে-বাজতে কানে তালা ধরে আসে, শরীর ঝিমঝিম করে। তারপর শব্দটা যেন তার চারধারে লাফাতে থাকে। লাফিয়ে-লাফিয়ে বহুদূর চলে যায়। আবার ফিরে আসে। তারপরই সে পরিষ্কার টের পায় শব্দটা আকাশ বাতাস সব হাঁ করে গিলে ফেলল। প্রকাণ্ড হয়ে গেল। দুনিয়াভর হয়ে গেল। আকাশভর হয়ে গেল। তারপর আর গুন্টু নিজেকে টের পায় না। বড় মজা হয় তখন। গুন্টু শব্দ হয়ে যায়।
মাস দুই আগে গুন্টু চৌধুরীদের প্রকাণ্ড বাগানে পেয়ারা চুরি করতে ঢুকেছিল দুপুরবেলা। কোথাও কিছু না, হঠাৎ একটা শিরীষগাছে এক হনুমানকে দেখতে পেল সে, বুকে বাচ্চা নিয়ে বসে আছে।
যে-কোনও কিছুকে লক্ষ করে ঢিল ছোড়া গুন্টুর স্বভাব। বে-খেয়ালে কত সময় কত মারাত্মক জায়গায় ঢিল ছুড়েছে সে। চলন্ত গাড়ির হেডলাইট ফাটিয়েছে একবার, রাস্তার আলো ভেঙেছে। কতবার, জ্ঞান সরকারের বাইরের ঘরের দেয়ালঘড়িটা রাস্তা থেকে ঢিল ছুড়ে ভেঙেছিল।
সেই স্বভাববশে হনুমানটার দিকেও খামোকা একটা মুঠোভর ঢিল কুড়িয়ে ছুড়ে মেরেছিল। হনুমানটার তেমন লাগেনি তাতে। কিন্তু হঠাৎ খেপে গিয়ে সেটা হড়হড় করে গাছ থেকে নেমে এসে তাড়া করল গুন্টুকে। গুন্টু দৌড়-দৌড়। জংলা বাগানটার মাঝ বরাবর পুরোনো পুকুর, তাতে সবুজ শ্যাওলা থিকথিক করছে, বড়-বড় মাছ। অন্যদিকে পথ না পেয়ে গুন্টু সেই পুকুরে ঝাঁপ খায়।
গুন্টু সাঁতরায় ভালোই। কিন্তু ত্যাঁদড় হনুমানটার জ্বালায় কিছুতেই আর জল ছেড়ে উঠতে পারে না। যেদিক দিয়ে উঠতে যায় সেদিকেই সেটা গিয়ে হুপহুপ করে হাঁক ছাড়ে। সেই হাঁক ডাকে আরও কয়েকটা হনুমান কোত্থেকে এসে জুটল। অথৈ জলের মধ্যে গুন্টুকে সারাক্ষণ হাত পা নেড়ে ভেসে থাকতে হয়েছিল। ফলে পচা আঁশটে গন্ধ, শ্যাওলার লতা বারবার পায়ে হাতে জড়াচ্ছে, বড়-বড় জাহাজের মতো মাছ মাঝে-মাঝে গায়ে ধাক্কা দিয়ে ঘষটে যাচ্ছে। কয়েকবার লেজের ঝাপটা খেলো। এক হাত তফাত দিয়ে সাঁতরে চলে গেল একটা জলঢোঁড়া। পায়ের বুড়ো আঙুল বাড়িয়ে ডুব দিয়ে বহুবার থই খুঁজে পেল না গুন্টু। তার কচি বুকে দম বেশি ছিল না তো। তাই এক সময়ে হঠাৎ চোখের সামনে সূর্য নিবুনিবু হয়ে গেল, বুকে বাতাসের টান, হাতে পায়ে খিল। সে তখন বিড়বিড় করে বলেছিল—আমি যে রোজ সন্ধেয় তোমার মন্দিরে আরতির সময়ে কাঁসি বাজাই!
তারপরই হঠাৎ যেন এক পাতালপুরীর হাত এসে গুন্টুকে টেনে নিল জলের তলায়।
সেইখানে রামচন্দ্রের সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা। মরলে তো সবাই তাঁর দেখা পায়। গুন্টু গিয়ে দেখে আরেব্বাস! সেখানে পেল্লায় চৌকি পেতে বুড়ো চক্কোত্তিমশাই বসে তামাক খাচ্ছেন। তাকে দেখে বলে উঠলেন—গুন্টু রাজার গালে হাত! গুন্টু রাজার গালে হাত! গুন্টু রাজার গালে হাত।
তা গালে হাত দেওয়ারই দাখিল। যা অবাক হয়েছিল। তবু গুন্টু চক্কোত্তিমশাইকে অচিন জায়গায় পেয়ে ভারী খুশি। প্রণাম করে ফের ভালো করে তামাক সেজে দিল। চক্কোত্তিমশাই বললেন—তা শব্দ হওয়া ভালো। দুনিয়াটা হলই তো শব্দ থেকে। যেখানে সেখানে ভালো করে যদি শুনিস তো দেখবি, দুনিয়ায় সব শব্দ। তুইও শব্দ, আমিও শব্দ। মনে করিয়ে দিস, তোকে ভালো দিন দেখে একটা শব্দ দেব’খন। সে এমন শব্দ যে কাঁসির শব্দ তার কাছে কোথায় লাগে। এখন যা।
ডোবার আধঘণ্টা পর গুন্টু ফের ভেসে উঠেছিল। পেটে জল, মুখে গাঁজলা, চোখের মণি। ওলটানো, জ্ঞান নেই, মৃত্যুক্ষীণ নাড়ি চলছে না। তাই দেখে হনুমানগুলো এমন হাল্লাচিল্লা ফেলে দিয়েছিল যে চৌধুরীবাগানের বুড়ো মালি এসে পড়েছিল দুপুরের ঘুম ভেঙে। সেই তোলে গুন্টুকে। পেটের জল বার করে সেঁক তাপ দেয়। ডাক্তার-বদ্যি করতে হয়নি, হাসপাতালেও যেতে হয়নি। কেউ তেমন টেরও পায়নি ঘটনা।
বেঁচে গিয়ে তেমন অবাক হয়নি গুন্টু। কেমন করে যেন মনে হয়—মরলেই হল আর কী! চক্কোমত্তিমশাই সব জায়গায় পাহারা দিচ্ছে না! যেখানেই যাও গিয়ে দেখবে ঠিক বুড়ো মানুষ। আপদবিপদের দোর আগলে চৌকি পেতে বসে তামাক খাচ্ছে নিশ্চিন্তে।
রাম মন্দিরে আরতির সময় এখনও বেজায় ভিড় হয়। নতুন ঠাকুরমশাই আরতিও করেন ভালো, তবে কিনা চক্কোত্তিমশাইয়ের আরতি যারা দেখেছে তাদের চোখে অন্য কিছু আর লাগে না। তবু অভ্যাসবশে মানুষ এসে দাঁড়ায় খানিক।
এখান থেকে চারচালাটা বেশি দূর নয়। নাটমন্দিরের পর একটা মাঠ তারপর একটা কাঁচা রাস্তা, সেটা পেরিয়েই বাগানের বাঁশের বেড়ার গায়ে কাঠের ফটক। কয়েকটা ফুল গাছের ঝোপ, জোনাকি পোকার আলো, একটু অন্ধকার। খোলা দাওয়ায় একটা চৌকি পাতা, সাদা বিছানা, মেঝেয় চটি জোড়া নিখুঁতভাবে রাখা, একপাশে গড়গড়া। বিছানায় চাক্কোত্তিমশাই দুটো বালিশে ঠেলান দিয়ে বসে থাকেন। গুড়ুক-গুড়ুক তামাক খাওয়ার শব্দ হয়।
আউন্তি যাউন্তি মানুষজন দু-দণ্ড দাঁড়ায় এসে সামনে। বলে—চক্কোত্তিমশাই, মন্দিরের পুজোয় আর যে যান না!
বুড়ো মানুষটা একগাল হেসে বলেন রামকৃষ্ণদেব বলতেন, মেয়েরা ততদিন এই পুতুল খেলে যতদিন বে না হয়। বিয়ে করে আসল ঘরসংসার পেলে আর পুতুল খেলে কে রে?
লোকে একটুআধটু বোঝেনা যে তা নয়।
গুন্টু বোঝে। আরতির পর গুন্টুর অনেকক্ষণ সাড় থাকে না। মগজে তখন কেবল ঘণ্টার শব্দ, কেবল কাঁসির আওয়াজ।
একদিন বলে ফেলেছিল গুন্টু-আরতির পর আমি এক অন্যরকম ঘণ্টার শব্দ শুনি। সে আওয়াজ মন্দিরের নয়, অন্য জায়গা থেকে আসে।
চক্কোত্তিমশাই সাবধান করে দিয়ে বলেছিলেন—খুব মনপ্রাণ দিয়ে শুনবি। কাউকে বলিস না।
গুন্টুর মায়ের কথা মনে নেই। সে মায়ের পেট থেকে পড়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তার মা মারা যায়। সেই থেকে সে দিদিমার কাছে। তার বাবা আবার বিয়ে করেছে। মাঝে-মাঝে ঝাড়গ্রাম থেকে বাবা তাকে দেখতে আসে। ভারী নিরীহ, ভীতু মানুষ, দ্বিতীয় পক্ষের দাপটে অস্থির। দ্বিতীয় পক্ষ আসতেও দেয় না বড় একটা। কিন্তু বাবা এসে গুন্টুকে দেখে ভারী খুশি হয়। এক গাল হাসে, বড় চোখে হাঁ করে এমনভাবে দেখে যেমন লোভী লোক খাবারের দোকানের দিকে চায়।
বাবা একদিন জিগ্যেস করেছিল বলো তো বাবা, তোমার কে কে আছে?
গুন্টু ভেবেচিন্তে বলেছিল—দিদিমা, মামা আর চক্কোত্তিমশাই।
বাবা অবাক হয় বলে—চক্কোত্তি আবার কে?
—সে আছে।
বাবা শ্বাস ফেলে বলল—আর আমি?
গুন্টু তখন লজ্জা পেয়ে বলে—হ্যাঁ বাবা, তুমিও। আর সৎমা।
—ছিঃ বাবা, সৎমা বলতে নেই। লোকে খারাপ ভাববে। শুধু মা। আরও বলি বাবা, তোমার কিন্তু আর দুটি বোন আছে। তারা তোমাকে ভারী দেখতে চায়। তোমার মাও বলে, এবার গুন্টুকে নিয়ে এসো।
গুন্টুর যে যেতে অনিচ্ছে তা নয়। কিন্তু দিদিমা ছাড়তে চায় না। কথা উঠলে বলে, আঁতুড় থেকে মানুষ করছি, ওর নাড়ি আমি ছাড়া আর তো কেউ চিনবে না। অন্যের হাতে নষ্ট হয়ে যাবে। কিন্তু মুশকিল হল, গুন্টু শুনেছে, তার সৎমায়ের দুটি মাত্র মেয়ে, আর নাকি ছেলেপুলে হবে না। কিন্তু সৎমায়ের খুব ছেলের শখ। তাই এখন প্রায়ই গুন্টুর বাবাকে বলে, সতীনপোকে নিয়ে এসো, তাকে নিজের ছেলে করে নেব।
তাই বাবা আজকাল খুব ঘন-ঘন আসে। গুন্টুও জানে, একদিন তাকে হয়তো ঝাড়গ্রামে চলে যেতে হবে। সৎমাকে সে দেখেনি। তবে ‘মা’ বলে কাউকে ডাকতে খুব ইচ্ছে করে তার। আবার এ জায়গা ছেড়ে, দিদিমা মামা আর চক্কোত্তিমশাইকে ছেড়ে চলে যেতে ইচ্ছেও করে না। গুন্টুর আজকাল তাই মনটা দু-ভাগ হয়ে গেছে।
মামা প্রায়ই গুন্টুকে বলে—তোকে যা একটা লিডার তৈরি করব না গুন্টু, দেখে নিস। একটু বড় হ, তখন জ্ঞানদার কাছে নিয়ে গিয়ে এখন ট্রেনিং দেওয়াব। জ্ঞানদার হাতে কত লিডার তৈরি হয়েছে।
গুন্টুর লিডার হতে খুব ইচ্ছে।
আরতির শেষে আজ বড় একা-একা লাগছিল গুন্টুর। কাঁসি বাজানোর সময় আজ তিনধা নাচন নেচেছে। এখন তাম্রপাত্র নিয়ে নাটমণ্ডপের ধারে বসে হাজারটা হাতের পাতায় তামার। কুশি দিয়ে চরণামৃত দিচ্ছে। কত হাত! হাতগুলোতে ভয় লোভ হিংসে মাখানো। এক আধটা হাত ভারী ঠান্ডা। দেখে-দেখে আজকাল বুঝতে পারে সে।
একটা সাদা কাঁপা-কাঁপা হাত থেকে খানিক চরণামৃত চলকে পড়ে গেল। মুখের দিকে তাকানোর সময় নেই গুন্টুর। কিন্তু সে ঠিক টের পায় এ হাতটা হল কানাই মাস্টারের। কানাই স্যারের প্রাণে আজ বড় কষ্ট।
একটা ছ্যাকা খাওয়া, কড়াপড়া বিদঘুটে হাত দেখে পরিষ্কার বুঝতে পারল গুন্টু, এ হল হেম ঘোষ। হেম ঘোষের হাতটা কাকে যেন খুন করতে চায়।
একবার চক্কোত্তিমশাই একটা কচি বেলগাছ দেখিয়ে গুন্টুকে জিগ্যেস করেছিলেন—বল তো কত পাতা আছে গাছটার।
ভেবেচিন্তে গুন্টু বলে—হাজার দুই হবে।
-দেখ তো গুণে।
সে বড় কষ্ট গেছে। এক মানুষ সমান উঁচু গাছটার নীচে টুল পেতে তার ওপর দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ ধরে পাতা গুণতে হল। দাঁড়াল চার হাজারের ওপর। তবু একটা আন্দাজ হল।
সেই থেকে চক্কোত্তিমশাই এরকম হরেক জিনিস আন্দাজ করতে শেখান গুন্টুকে। করতে করতে গুন্টুর আন্দাজ ভারী চমৎকার হয়েছে। খুব ঝুপসি গাছ হলেও তা দেখে টকাস করে বলে দিতে পারে তাতে পাতা কত। জানে, গুনে দেখলে ঠিক মিলে যাবে।
চক্কেত্তিমশাই শিখিয়েছেন, রোজ রাতে শোওয়ার আগে বিছানায় বসে সারা দিনের কথা ভাববি। সকাল থেকে কী করলি, কী খেলি, সব হুবহু মনে করা চাই। এ না করে ঘুমোবি না।
তাই করত রোজ গুন্টু। ছ’মাস পর তার বেশ তড়তড়ে মন হল। টক করে সব মনে পড়ে যেতে থাকে। তখন চক্কোত্তিমশাই শেখালেন, এবার রোজকার কথা, আর তার সঙ্গে আগের দিন, আগের-আগের দিন এইভাবে মনে করবি। করতে-করতে দেখবি একদিন তোর আর-জন্মের কথা মনে পড়ে যাবে।
—তাতে কী হয় চক্কোত্তিমশাই?
—তাহলে আর মানুষ মরে না। দেহ ছাড়ে, কিন্তু মরে না।
গুন্টুর দিকে আর-একটা হাত এগিয়ে আসে। হাতে শাঁখা, তাতে সিঁদুরের দাগ। গুন্টু যেন এ হাত চেনে। কুশি তুলেও গুন্টু থেমে থাকে। এ হাত কি চরণামৃত চায়? না এ হাত একটা ছেলে চায়। এ হাতের বড় আকুলিবিকুলি।
হাতটা ওই অত হাতের ভিড়ের ভিতর থেকে একটু ওপরে উঠে এসে গুন্টুর থুতনি ধরে মুখখানা ওপরে তুলল। আর তখন নাটমন্দিরের জোর আলোয় একজোড়া জল টলটলে চোখ দেখতে পায় গুন্টু। ঘোমটার নীচে ফরসা মুখ। ঠোঁটে একটা কান্নায় ভেজা হাসি। পিছনেই বাবা দাঁড়িয়ে। ভারী তটস্থভাবে বাবা মহিলাটির কাঁধে হাত দিয়ে বলল—এখন না। ও এখন ব্যস্ত। বাড়িতে যাক ভালো করে দেখো।
চোখ বুজে মহিলাটি বলে—এ যে দেবতার মতো ছেলে। আমার সতীন বড় ভাগ্যবতী ছিল।
গুন্টু ভারী লজ্জা পায়। তাড়াতাড়ি হাতে হাতে চরণামৃত ঢেলে দিতে থাকে সে। মাথা নীচু। কারও মুখের দিকে তাকানোর সময় নেই।
.
পাঁচ
রেবা ঝুঁকে গানের খাতা দেখছিল। গানের মাস্টার প্রভাস খানিকক্ষণ তবলায় আড় চৌতাল তুলবার চেষ্টা করে এইমাত্র একটা সিগারেট ধরাল। নতমুখী রেবার দিকে চেয়ে রইল খানিক। বেশ দেখতে মেয়েটা। মাঝে-মাঝে এমন করে তাকায় যে ভিতরটা কেঁপে ওঠে।
প্রভাস অনেকদিন ধরেই বুঝবার চেষ্টা করছে, রেবার হাবভাবে কোনও ইঙ্গিত আছে কি না। মাঝে-মাঝে যেন মনে হয়, আছে। আবার কখনও মনে হয়, না, নেই।
আছে কি নেই সেটা বুঝবার জন্যও একটা কিছু করা দরকার। ধসা কানা হয়ে বসে থেকে কোনওদিনই তা বোঝা যাবে না।
ভাবতে-ভাবতে প্রভাস একবার বাঁয়ার একটা টুম শব্দ তুলল। রেবা তাকাল না। বাঁ-হাতখানা হারমোনিয়ামের ওপর দিয়ে এসে ঝুলছে। কী চমৎকার আঙুল! এই মেয়ের বর কিনা হেম ঘোষ! কাকের মুখে কমলালেবু।
প্রভাস আন্দাজ করে, হেম ঘোষের বউ হয়ে রেবা নিশ্চয়ই খুব সুখী নয়। তাহলে রেবা প্রভাসকে একেবারে হ্যাটা করবে না।
ভেবেচিন্তে প্রভাস আজ সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলল। একটা কিছু হোক। হয়ে যাক।
গানের সময়ে আজকাল ঘরের লোকজন তাড়িয়ে দরজা দিয়ে জানলার পরদা টেনেটুনে দিয়ে বসে রেবা। সেটাও কি একটা ইঙ্গিত নয়? কোন বোকা এসব ইঙ্গিত ধরতে না পারে?
খুব সাহস হল প্রভাসের। আত্মবিশ্বাস জেগে উঠল।
একটু ঝুঁকে প্রভাস হঠাৎ রেবার ঝুলন্ত হাতখানা খপাত করে চেপে ধরে ডেকে উঠল—রেবা!
জানলার পরদার ওপাশে অভয়পদ একটা অনেকক্ষণ ধরে চেপে রাখা শ্বাস ছেড়ে বেশ জোরে বলে উঠল—আগেই বলেছি কিনা মা, যে মেয়ে সিগারেট খায়, তার চরিত্র ভালো হতে পারে না! এসে দেখে যাও এখন স্বচক্ষে।
ঘরের ভিতরে প্রভাস তখন ছিটকে নেমে পড়েছে চৌকি থেকে। টর্চ জ্বেলে তাড়াহুড়ো করে চটি খুঁজছে। মনের ভুল। ঘাবড়ে গিয়ে ভুলে গেছে যে, চটি দরজার বাইরে ছেড়ে আসে রোজ।
রেবা সাদা মুখে প্রভাসের দিকে চেয়ে বলল কী করলেন বলুন তো প্রভাসদা! এখন এ বাড়িতে কি আর থাকা যাবে! কত কষ্টে বাপের বাড়ির কাছে এই বাসা খুঁজে বের করেছি। এখন যদি ছাড়তে হয় তবে ও ঠিক আবার ওদের সংসারে নিয়ে গিয়ে তুলবে।
প্রভাস দরজার কপাট হাতড়ে ছিটকিনি খুঁজছে তাড়াতাড়ি।
রেবা পিছনে এসে দাঁড়িয়ে বলতে লাগল—এ বাসায় কত সস্তায় ছিলাম জানেন! এ অঞ্চলে পঁচিশ টাকায় ঘর আর পাওয়া যাবে? বাড়িউলি মানুষটা কত ভালো ছিল। ছিঃ ছিঃ, এ আপনি কী করলেন বলুন তো!
প্রভাস ছিটকিনি খুলে চটি খোঁজার জন্য আর ঝামেলা করল না। দুই লাফে উঠোন পেরিয়ে খালি পায়ে রাস্তায় নেমেই একটা রিকশায় উঠে পড়ল। বলল—জোরে চালাও ভাই।
রেবা দরজার কাছ বরাবর গিয়ে সজল চোখে তাকিয়ে থাকল একটু। তারপর কেঁদে ফেলল। ইস, অভয়দা দেখে ফেলেছে। এখন ঠিক বাড়ি-ছাড়া করবে তাদের।
উঠোনের ওপাশের অন্ধকার থেকে কালিদাসীর গলা আসছিল—তোরই বা উঁকি মারতে
যাওয়ার কী দরকার! ওসব লোক ওরকমই হয় বাবু। তুই নিজের কাজে যা!
—যাচ্ছি।
—গুন্টুকে ডেকে দিস তো। দুপুর থেকে ছেলের টিকি নেই। রেবার খুব বলতে ইচ্ছে করছিল—মাসিমা, আমাদের বাসা ছাড়তে বলবেন না। আমি গানের মাস্টারকে ছাড়িয়ে দেব।
কিন্তু তা আর বলা হল না। সিঁড়িতে শব্দ করে কালিদাসী উঠে গেল।
গুম হয়ে বসে রইল রেবা। এ বাড়িতে যে কত সুবিধে! খুব সস্তায় কালিদাসীর কাছ থেকে খুঁটে কেনে রেবা। আড়াই টাকা সের দরে খাঁটি গরুর দুধ কেনে।
প্রভাসের জন্য সব গেল।
.
ছয়
নাটমন্দিরের নীচে নেমে এসে কানাই মাস্টার হাজার জোড়া জুতোর মধ্যে নিজের জুতোজোড়া খুঁজে পাচ্ছিল না। জায়গাটা একটু অন্ধকার মতোও বটে।
হেম ঘোষ নেমে এসে বলল, কী খুঁজছেন মাস্টারমশাই, জুতো? বলে ফস করে দেশলাইয়ের কাঠি জ্বেলে ধরল।
কানাই জুতো খুঁজে পেয়ে হেম ঘোষকে বলল, যাবেন নাকি বাজারের দিকে?
একা চলাফেরা করতে আজ কানাইয়ের ঠিক সাহস হচ্ছে না। মারাটা বড় খারাপ হয়েছে মদনকে। একবার যাবে চক্কোত্তিমশাইয়ের কাছে, ফাঁকমতো।
হেম ঘোষ উদাস গলায় বলে—সকালেই বাজার করেছি। তা আমার আর কাজ কী, চলুন বরং বাজার থেকে ঘুরেই আসি একটু। বাজার জায়গাটা ভালো।
হেমের মনে একটা পোকা কামড়াচ্ছে তখন থেকে। একা ঘরে রেবা আর গানের মাস্টার। চোখে-চোখে কথা হচ্ছে না তো! কিংবা হারমোনিয়ামের রিডে একজনের আঙুলে অন্যজনের আঙুল ছোঁয়া লাগে যদি! এর চেয়ে নিজেদের সংসারে বেশ ছিল। দশ জোড়া পাহারা দেওয়ার চোখ ছিল সেখানে। কাঁকড়াবিছের কথাও ভাবে হেম ঘোষ। ওষুধটা চক্কোত্তিমশাইয়ের কাছ থেকে জেনে নিতে হবে।
মনের কথা মনে রেখে দুজনে অন্য সব কথা বলতে-বলতে বাজারপানে যেতে থাকে।
.
সাত
কালিদাসী ডাক শুনে বারান্দায় এসে দেখে উঠোনে জামাই দাঁড়িয়ে। সঙ্গে বউ আর দুটো মেয়ে।
কালিদাসী শ্বাস ছাড়ে। জামাই আসবে জানাই ছিল। গুন্টুকে বুঝি এবার নিয়ে যায়।
—এসো। বলে নীরস গলায় ডাকে কালিদাসী।
ওরা উঠে আসে।
জামাই প্রণাম করতে করতেই বলে—গুন্টুকে নিয়ে যেতে এলাম মা। অনেকদিন হয়ে গেল। আপনারও কষ্ট বুড়ো বয়সে।
কালিদাসী মন্দার মাকে মিষ্টি আনতে পাঠায়। তারপর গম্ভীরমুখে এসে সামনে বসে। বলে— যার ধন সে তো নেবেই। ঠেকাবো কোন আইনে। এই বুঝি মেয়ে দুটি? বেশ মিষ্টি হয়েছে দেখতে। আর এ আমার নতুন মেয়েটিও বেশ।
এসবই মুখের ভদ্রতা। বুকটা ভিতরে ভিতরে জ্বলে যায়। কাঁকড়াবিছে কোন ফাঁকে পাঁজর কেটে বুকের ভিতর সেঁধিয়েছে। এ হুলের বড় জ্বালা।
খানিকক্ষণ বসে গল্পগাছা করে ওরা চলে গেল। কাল সকালে গুন্টুকে নিতে আসবে। কালিদাসী একটা চাদর গায়ে নীচে নেমে এসে ডাকল—রেবা। ও রেবা!
রেবা শুয়ে ছিল বিছানায়। ডাক শুনে হুড়মুড় করে উঠে পড়ল। এই বুঝি বাড়ি ছাড়বার কথা বলতে এসেছে!
কিন্তু না। কালিদাসী বলল—আমাকে একবার চক্কোত্তিমশাইয়ের কাছে যেতে হবে। মন্দার মা বাড়ি গেল, তা তুমি যদি একটু সঙ্গে চলো মা। আমার তো চোখে ভালো ঠাহর হয় না। রাতবিরেতে।
–যাচ্ছি মাসিমা। বলে রেবা তক্ষুনি চটি পায়ে বেরিয়ে এল। রাস্তায় এসে অবশ্য জিভ কাটল রেবা। চটিজোড়া তার নয়, প্রভাসের। অন্ধকারে তাড়াহুড়োয় বুঝতে পারেনি। এখন আর কিছু করার নেই।
রেবা বলল, মাসিমা, আমার কী দোষ বলুন। লোকটা যে ওরকম তা কি জানতাম!
কালিদাসীর বুকভরা তখন গুন্টুর চিন্তা। বলল, সে জানি বাছা। আজকালকার লোক বড় ভালো নয়। সাবধানে থাকবে।
রেবা কালিদাসীকে ধরে খুব যত্নে কাঁচা ড্রেনটা পার করাল। মনে-মনে বলল, চক্কোত্তিমশাই, দ্যাখো বুড়ি যেন আমাদের না তাড়ায়।
.
আট
গুন্টুকে নিয়ে রেলগাড়ি হাওড়া ছেড়েছে অনেকক্ষণ। জানলার ধারে বসে সে এখন বাইরে গ্রাম আর খেত দেখছে। গা ঘেঁষে ছোট বোন দুটি বসে। মা একটু তফাত থেকে মাঝে-মাঝে মুগ্ধচোখে তার মুখের দিকে চাইছে। আর বার-বার জিগ্যেস করছে, খিদে পেয়েছে বাবা তোমার? কিছু দিই? সন্দেশ আছে, রসগোল্লা, লুচি। কত এনেছি দ্যাখো! বাবা একবার কানে-কানে জিগ্যেস করেছিল—মাকে তোর পছন্দ হয়েছে তো গুন্টু?
গুন্টু ঘাড় নাড়ল। বেশ মা। বোন দুটিও বড় ভালো। এরকম মা বোন তার ছিল না তো এতদিন! দিদিমা বড় কেঁদেছে ডুয়ে পড়ে। মামা স্টেশন পর্যন্ত শুকনো মুখে এসে গাড়িতে তুলে দিয়ে গেছে। চক্কোত্তিমশাইয়ের সঙ্গে দেখা করে আসেনি। মনটা বড় খারাপ লাগে। আবার ভাবে, নতুন একটা জায়গায় যাচ্ছে, সেখানে না জানি কত ফুর্তি হবে! কত খেলা!
.
নয়
দিন ফুরোয়। সাঁঝের আঁধার ঘনিয়ে আসে। মন্দিরে ঘণ্টা বাজছে। কানাই মাস্টার টিউশনিতে বেরোল। হেম আজ গেল রেবাকে নিয়ে সিনেমায়। অভয়পদ পরোটা খেয়ে পুজো কমিটির মিটিং এ যাওয়ার সময় বলে গেল—মা, যাই। কালিদাসী শুনতে পেল না, সে তখন গোয়ালঘরে গরু দুটোর সঙ্গে রাজ্যের কথা ফেঁদে বসেছে।
দিনটা গেল, যেমন যায়।
Post a Comment