কেয়ামত – বাণী বসু

কেয়ামত – বাণী বসু

পিউ এসে জিজ্ঞেস করে গেল—‘কাকিমণি তুমি বিকেলে কখন বাড়ি ফিরছ?’ তখন সবে প্রথম গ্রাস ভাত মুখে তুলেছি। আমার সিসটেমটা একটু অদ্ভুত। আগে খাওয়া, পরে চান। রান্না-টান্না সেরে ছেলেকে স্কুলের ভাত দিয়ে, ছেলের বাবাকে অফিসের ভাত দিয়ে, নিজে খেয়ে নিই, তারপরে রান্নাঘর, যাকে বলে হেঁশেল, তুলে গুছিয়ে আর যেখানে যা বাকি আছে করে, তবে চানে ঢুকি। হপ্তায় দু দিন অর্থাৎ শনি-রবিবার ছাড়া চুল ভিজোই না, যেমন বেণী তেমনি থাকে। ভালো করে মাথা ছাড়া স্নান, তারপর একেবারে তৈরি হয়ে বেরোই। স্বাস্থ্যসম্মত নয় জানি, কিন্তু এ ছাড়া আমার উপায়ও নেই। সকালের খাওয়ার চেয়েও সকালের চানটা আমার কাছে জরুরি বেশি। পিউকে বললুম—‘পাঁচটার মধ্যে। কেন?’

পিউ বলল—‘মা জিগগেস করেছিল। আচ্ছা আমার স্কুলের দেরি হয়ে যাবে, যাই কাকিমণি।’ পিউ একছুট্টে চলে গেল।

পিউ আমার প্রতিবেশীর মেয়ে। দু-চারটে বাড়ি পরে থাকে। পিউয়ের বাবা মস্ত অ্যাডভোকেট। চারতলা বাড়ি। আধুনিক কেতার যৌথ পরিবার। পিউয়ের ঠাকুর্দা-ঠাকুমা, বাবা-মা থাকেন প্রথম দু তলায়। ওপর দিকে তার দুই কাকা-কাকিমা। ভিন্ন হাঁড়ি। কিন্তু একই বাড়িতে বাস। বাবা-মা থাকতেই পিউয়ের বাবা সব ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। ফলে যৌথ পরিবার-জনিত অশান্তি ওদের বাড়িতে খুব কম। বরং পিউ কাকা-কাকিদের কাছ থেকে যথেষ্ট স্নেহ ভালোবাসা পায়। আসলে পিউ বলতে গেলে ওদের বাড়ির একমাত্র মেয়ে। ওর এক কাকা এখনও নিঃসন্তান, অন্য কাকার দুই ছেলে, পিউয়ের নিজের দিদিও বেশ বড়। ওর থেকে চোদ্দ পনের বছরের বড়, তার বিয়ে হয়ে গেছে অনেকদিন। তার মেয়ে তো বলতে গেলে পিউয়ের ভক্ত শিষ্যা গোছের। কাজেই পিউ খুব আহ্লাদি। পিউয়ের ফ্রক ড্রেস ইত্যাদি হয় ডজন হিসেবে। জন্মদিনের উপহারে একটা পুরো শোকেস ভরে গেছে। পুজোর সময় পিউ এত রকমের জামা কাপড় পায় যে ইচ্ছে করলে বোধহয় ঘণ্টায় ঘণ্টায় বেশবদল করতে পারে। মেয়েটাকে দেখতেও বেশ সুন্দর। ফর্সা। গোল বাচ্চা-বাচ্চা মুখ। আধুনিক ফ্যাশনে বয়-কাট করা চুল। বড় বড় চোখ। ফুলো ফুলো ঠোঁট। দেখলেই ভালো লাগে। পিউ অজস্র কথা বলে। নেচে নেচে চলে। চলার মধ্যে ভারী সুন্দর একটা ছন্দ আছে। আধা-খেলোয়াড়ি, আধা-নাচিয়ে ছন্দ। নাচ শেখে বলে নয়, এমনিতেই মেয়েটার এমনি চটপটে ছন্দোময় চলাফেরা। অনেক সময়ে পিউ যখন রাস্তা দিয়ে নাচের স্কুলে, কি যোগের স্কুলে, কি আঁকার স্কুলে যায়, আমি জানলায় চোখ পেতে রাখি। রাস্তাময় খানা-খোঁদল। এখানে একটা ইঁট, ওখানে একটা আধলা। বর্ষার জল ছোট ছোট গর্তে ভরে আছে। পিউ ছোট্ট একটা ফড়িং-এর মতো লাফ দিয়ে একটা গর্ত পার হল, আরেকটা, আরেকটা, কাহারবা কিংবা ঝাঁপতালের ছন্দে। আমার স্বামী তিলক বলে—‘কী ব্যাপার? তুমি এতক্ষণ ধরে জানলায় দাঁড়িয়ে কী দেখছ বলো তো? ভালুক-নাচ বা বাঁদর খেলার ডুগডুগি শুনিনি তো?’

আমি ওর ইয়ার্কি অগ্রাহ্য করে বলি—‘দেখবে এসো না, পিউ কী সুন্দর যাচ্ছে।’

তিলকবাবুর মুখ হাঁ হয়ে যায়। —‘পিউ কি সুন্দর যাচ্ছে? নাঃ মাথাটা একেবারেই খারাপ দেখছি।’

তা কী করব, আমার সৌন্দর্য বড় ভালো লাগে। কথার সৌন্দর্য, চলার সৌন্দর্য। আমাদের বাড়ির কোণের জানলায় দাঁড়ালে ট্রাম-রাস্তা দেখা যায়। আমি ট্রামের ছন্দও দেখি। ট্রাম, বাস, গাড়ি যখন নিজস্ব চালে চলবার সুযোগ পায়, তখন আমি যদি বাড়ি থাকি তো অবকাশ করে নিই দেখব বলে। যা কিছু গতিময়, আনন্দময়, প্রাণময় তা-ই আমার ভালো লাগে। আর সে হিসেবে, একটা চোদ্দ বছরের ফুটফুটে মেয়ে যে নাকি পৃথিবীতে এসে থেকে অনাদর, অভাব, অপ্রাপ্তি কাকে বলে জানেনি, যার জীবনের ছন্দ চলার ছন্দের সঙ্গে হুবহু মিশে গেছে তার টুকটুকে পায়ে প্রজাপতির মতো গোষ্পদ পেরোনো যে আমার দারুণ ভালো লাগবে এ তো জানা কথাই।

পিউ অবশ্য একটু পাকা। অনুমান হয় ওর মা-কাকিমা-ঠাকুমারা ওর সামনেই সব কথা বলেন। তাই পিউ কিছুটা ওর ঠাকুমার মতো, কিছুটা ওর মার মতো, কিছুটা ওর কাকিদের মতো, এমনকি ওর বাবা কাকা ঠাকুর্দাদার মতোও কথা শিখেছে। কিন্তু ও বোকা নয়। আর ওর পাকামিটাও একরকম নতুন স্বাদের ছেলেমানুষি। যেমন, ও আমাদের বাড়িতে ঢুকেই হয়ত বলবে——‘ও কাকিমণিগো। আজকে কি সব্বোনাশ হয়েছে শোনো একবার।’ কিংবা বলবে, ‘যার ভালো তার সব কি ভালো হতে হয় কাকিমণি! আমাদের নতুন টিচার সঙ্ঘমিত্রাদি! যেমনি দেখতে, তেমনি পড়ান, তেমনি গান করেন, তেমনি সুন্দর আচার-ব্যবহার। কি নম্র।’ পিউ যে সব সময়েই এই রকম বড়দের ভঙ্গিতে কথা বলে তা নয়। তবে মাঝে মাঝেই তার কথাবার্তায় এই সব আর্ষ প্রয়োগ ঢুকে পড়ে।

বিকেলে আমি বাড়ি ফেরার একটু পরেই পিউয়ের মা মিসেস সরকার এসে ঢুকলেন। মুখ পান-জর্দায় ভর্তি। সেসব সামলাতে সামলাতে বললেন, ‘আজ শুককুরবার, আজ আর ছাড়ছি না। কাল ছুটি, পরশু ছুটি। তরশুও হয়ত বিদ্যাসাগরের জন্যে ছুটি হয়ে যেতে পারে। মৃত্যুর শতবর্ষ পূর্ণ হল, না?’

আমি হেসে বললুম: ‘ছাড়ছেন না কেন সেটাই বলুন আগে?’

‘আজ সারা রাতের প্রোগ্রাম। সাত-সাতখানা ক্যাসেট এসেছে। পরপর চলবে। পান সিগারেট চা কফি স্ন্যাকস সব আমার। আপনাদের খালি কমপ্যানি দিতে হবে। কর্তা না যান, গিন্নিকে যেতেই হবে।’

ওরে বাবা! সারাদিন ধরে গাধার খাটুনি, খাতা দেখতে হয় পাহাড় প্রমাণ। প্রতিদিন। যে কটা পয়সা রোজগার করি আমার মালিকরা তার প্রতিটি উশুল করে নেন। রাত্রে বিছানায় পড়ি আর ঘুমসাগরে তলিয়ে যাই। কে কী, কেন কবে কোথায় কিছু খেয়াল থাকে না। যদি আমাকে কেউ জিজ্ঞেস করে তুমি কী সবচেয়ে ভালোবাসো? আমি নির্দ্বিধায় বলব ঘুম। কিন্তু অ্যাডভোকেট গিন্নি নতুন ভিসিপি কিনেছেন। টিভি একটা পাল্টে আরেকটা এনেছেন, তার রং নাকি চোখ জুড়িয়ে দ্যায়। প্রতিবেশীরাই যদি না দেখল, বাছা-বাছা প্রতিবেশী অবশ্য, তবে আর এসবের দাম কি? ওঁদের বাড়ি থেকে অষ্টপ্রহরই ভেসে আসে হরেক কিসিমের গান বাজনা, স্টিরিয়োয় উদ্দাম। প্রথম প্রথম খুব ভালো লাগত, আমার ছেলে কিচলু তো সেঁটে থাকত আগে আগে। ‘—মা, আমাদেরও একটা স্টিরিয়ো কেনো না!’

কিচলুর বাবা বলত, ‘হ্যাঁ ভূতের ভয়ে চড়লেম গাছে, ভূত বলে তোরে পেলেম কাছে। দূরে দূরেই অস্থির হয়ে যাচ্ছি। এবার তুই ঘরের মধ্যে গানের বন্যা বইয়ে দে।’

আমি বলি—‘তুই স্কুল পেরিয়ে কলেজে ওঠ, দোব।’

কিচলুর মুখ কাঁচুমাচু হয়ে যায়। তার স্কুল পেরোতে এখনও অনেক দেরি। কিচলু মিউজিক সিসটেমের বদলে দাবা-বোর্ড পায়, খুব শৌখিন। খেলতে খেলতে বাপ-ছেলের হুঁশ থাকে না। জানলা-পথে গাঁক গাঁক করে কিছু নকল কিশোরকুমার ভেসে আসে। ভালো জিনিস ভালো। কিন্তু কম কম। মাত্রা বেশি হয়ে গেলে খুব ভালো জিনিসের বেলাও যেন মনে হয় ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি।

কিন্তু মিসেস সরকার ভিসিপি উদ্বোধন করবেন, না গেলে রাগ করবেন। মিসেস সরকারের আর কি! ধনী বাপের একমাত্র মেয়ে। শরৎচন্দ্রের ভাষায় এক পুঁটলি টাকা নিয়ে শ্বশুরঘরে এসেছেন। এখন তো বোধহয় বাবা-মা গত। সবই ওঁর। জীবনে কোনদিন কুটো ভেঙে দুখানা করতে হয়নি। এখনও ওঁর বাপের বাড়ির বুড়ি আয়ি ওঁকে দুধ নিয়ে সাধাসাধি করে। উনি বারান্দায় বসে বসে রাস্তা দেখেন, একটা খুদে ছেলে ওঁর পা টিপে দেয়। বুড়ি আয়ি দুধ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সেই দুধের রং ওঁর গা থেকে ফেটে পড়ে। ক্রমশই এতো মোটা হয়ে পড়ছেন যে ভয় হয় হার্টের ব্যামো-ট্যামো না ধরে। আমাকে বলেন—‘পিউদের যোগ-স্কুলে ভর্তি হবো? নাকি বলুন তো!’ আমার ইচ্ছে হয় বলি—‘তার আগে একটু নড়ে বসুন দিদি।’ টাকা আছে বলে আমার নড়া-চড়াগুলোও অন্য লোকে করে দেবে এ কেমন কথা! তা হলে জীবনটাও অন্য কেউ বেঁচে দিলে হয়!

উদ্বোধন বেশ জমজমাটিই হল। ওদের বাড়ির সবাই তো আছে, মায় পুঁচকে পা-টেপার ছেলে, খুদে ফরমাসের মেয়ে পর্যন্ত। কুটুম্বরাও আছেন। পিউয়ের দিদি, তার একরত্তি মেয়ে, শাশুড়ি, পাড়ার কেউ কেউ, ওঁদের কাছে-পিঠের আত্মীয়স্বজন। পিউয়ের কাকিমা সকলকে কফি আর ডালমুট পরিবেশন করল। কিন্তু আমার আবার এত লোকজন সহ্য হয় না। অসোয়াস্তি লাগতে থাকে। প্রথম ছবিটি দেখেই তো আমার চক্ষু চড়ক গাছ। পিউ পাশেই বসেছিল, দেখলুম ‘মুগ্ধ নয়ান, পেতে আছি কান’ গোছের অবস্থা। একবার আমার হাতটা টিপে বলল, ‘কাকিমণি কী সুন্দর না?’ দুটোর পরে আমি আস্তে আস্তে উঠে এলুম। মিসেস সরকার একবার গাল কাত করে বললেন, ‘ও কী! চললেন যে?’ মৃদুস্বরে বললুম—‘বড্ড ঘুম পেয়েছে, আর থাকতে পারছি না।’

আমরা মানে আমি, আমার স্বামী তিলক একটু সেকেলে। সব কিছু আমরা কিচলুকে সঙ্গে নিয়ে বসে দেখতে পারি না। সব কিছু কিচলু দেখুক, শুনুক সেটাও চাই না। এ ব্যাপারে আমার স্বামীর, আমার, আমাদের নিকটজনদের সম্পূর্ণ ঐকমত্য আছে। সেহেতু আমাদের দেখা শোনাগুলোও খানিকটা কিচলুর স্ট্যান্ডার্ডের হয়ে গেছে। কিন্তু মিসেস সরকার করেছেন কি? অতগুলি অত বয়সের লোক জড়ো করে কী দেখাচ্ছেন? নিজের না হয় করবার কিছু নেই। তাই বলে…। আমাকে আবার আশ্বাস দিয়েছিলেন, যত রাত হবে ততই নাকি এ-মার্কা ছবি দেখাবেন।

আমি আর যাই না। কিন্তু প্রতি শনিবার পিউদের বাড়ি ভিডিও ক্যাসেট চলতে থাকে। তার বাইরেও দেখি পিউয়ের মা গাড়ি নিয়ে মেয়ে নিয়ে সিনেমা যাচ্ছেন।

‘কোথায় যাচ্ছেন অঞ্জলিদি?’

‘দূর আপনাকে বলবো কেন?’ অঞ্জলিদি ঠোঁট ফোলান। তার পরেই হেসে বলেন, ‘ববি এসেছে, দেখে আসি।’

আমি আশ্চর্য হয়ে বলি, ‘এই যে সেদিন বাড়ি বসে দেখলেন?’

‘হলে বসে বড় পর্দায় দেখার মজা আলাদা, আপনি বুঝবেন না।’

পিউ কানের রিং দুলিয়ে বলে—‘হ্যাঁ কাকিমণি, মা ববি কোথাও এলে দেখবেই, সে যেখানেই হোক, যতদূরেই হোক, যত অখাদ্য হলেই হোক।’

মিসেস সরকার ধরাপড়া মুখে হেসে বললেন—‘এই কিশোর-প্রেমের ছবিগুলো দেখতে আমার দুর্দান্ত লাগে জানেন মিসেস মিত্র। একটাও বাদ দিই না, ববি, জুলি, এক দুজেকে লিয়ে, চাঁদনি, কেয়ামত সে কেয়ামত তক…।’

পিউ বলল—‘ববি মা কতবার দেখেছো যেন? ছত্রিশ বার না? আর কিউ এস কিউ টি পনের বার। প্রত্যেকবার চারটে করে রুমাল ভেজাবে মা, জানো কাকিমণি!’

‘হ্যাঁ, তোকে বলেছে।’ মিসেস সরকার লজ্জা পেয়ে যান। তারপরেই গাড়িখানা হুশ, করে চলে যায়।

মায়ের এই অত্যধিক সিনেমা-প্রীতির জন্য প্রায়ই পিউয়ের নাচের ক্লাস, যোগ-ব্যায়ামের ক্লাস কামাই হয়ে যায়। অথচ মেয়েটার মধ্যে সত্যি ক্ষমতা আছে। যোগনিদ্রা, উত্থিত পদ্মাসন, আকর্ণ ধনুরাসন সব শক্ত শক্ত আসন এত সুন্দর করে যে চেয়ে দেখতে ইচ্ছে করে। আর নাচ তো ওর স্বভাবের অঙ্গ। সরকার বাড়ির প্রধান ব্যক্তি মনে হয় মিসেস সরকার। তাঁকে কেন্দ্র করেই সংসারখানা ঘোরে। তাঁর সিনেমা দেখার ইচ্ছে হলে, একলা-একলা যেতে ভালো লাগে না বলে বেশির ভাগই পিউকে এমনি সঙ্গী হতে হয়। পিউ নিজেও অবশ্য কম যায় না। তার স্কুল, যোগ-স্কুল, নাচ-স্কুল মিলিয়ে অনেক বন্ধু-বান্ধব আছে, তাদের জুটিয়ে নিয়ে ও-ও প্রায়ই দেখি সিনেমা দেখতে কি অন্য কিছু হুজুগে চলেছে। পিউয়ের প্রায় সর্বক্ষণের সঙ্গী হয় গৌতম নয় টুলটুল। প্রথমটি যোগ-স্কুলের, দ্বিতীয়টি পড়ার স্কুলের। এ ছাড়াও অন্যেরা থাকে। কিন্তু এ-দুজন ওর সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য। দুজনেই পিউয়ের থেকে বয়সে বড়, কিন্তু ভীষণ বন্ধু।

একদিন হাসতে হাসতে গল্পচ্ছলে মিসেস সরকারকে বলেছিলুম, ‘আচ্ছা মিসেস সরকার, ছেলেমেয়েদের নিয়ে, এমন কি পুঁচকে বা বড় কাজের লোক নিয়ে সবরকম ফিল্‌ম দেখতে আপনার অসোয়াস্তি হয় না?’

মিসেস সরকার মুখ টিপে হেসে বলেন, ‘কী ভাবেন কি ওদের? অ্যাাঁ? আপনার আমার চেয়ে ওস্তাদ ওরা, বুঝলেন?’

‘পিউকে নিয়ে অত ফিল্‌ম আপনি না দেখলে পারেন, মিসেস সরকার, ওর পড়াশোনার ক্ষতি হয়।’

‘আহা-হা-হা, ও নিজে যেন দেখে না, রাজ্যির বন্ধু-বান্ধব জুটিয়ে রাতদিন দেখছে, আমার সঙ্গে দেখলেই যত দোষ!’ পিউয়ের মা তাঁর লিপস্টিক মাখা ঠোঁট দুখানা অভ্যাসমতো ফোলান।

আমি সুযোগ পেয়ে যাই—‘আচ্ছা অঞ্জলিদি, এই যে ও এত বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে মেশে, এখান-ওখান ইচ্ছেমতো যায়, এতে আপনার কোনও ভয় হয় না? আপনি এগুলো হতে দ্যান? একটু রেসট্রিকশন…।’

আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে উনি বলেন—‘আপনি কোথায় আছেন মিসেস মিত্র, মানে কোন যুগে?’

আমি কিছু বলি না। উনিই বলেন আবার ‘আপনি বোধহয় গত শতাব্দীতে পড়ে আছেন ভাই, কিছু মনে করবেন না। এখন ফ্রি মিক্সিং-এর যুগ। তা ছাড়া ওদের স্বাধীনতা দিতে হবে। স্বাধীনতা না দিয়ে ঘরের কোণে পুতুপুতু করে রেখে, দাবা খেলে আর ট্যাঁকে করে মিউজিয়াম-টিয়াম দেখিয়ে ছেলে মানুষ করবেন ভেবেছেন? পিউয়ের বাবা কি বলেন জানেন? ‘মেয়ে যা চায় দাও, যা চায় দাও। ভগবানের ইচ্ছেয় অভাব তো কিছু নেই।’ আসলে কি জানেন, অঙ্ক ইংরিজির দিদিমণিরা বড্ড কড়া হয়।’ বলে হেসে ফেললেন মিসেস সরকার।

আমার কথার জবাব দেওয়া হল, আমাকে বেশ করে যাকে বলে ‘ঠোকা’ হল, আমি ছেলে মানুষ করতে পারবো না এই মর্মে সতর্কীকরণ করা হল, নিজেদের ঐশ্বর্য এবং আধুনিকতার ফিরিস্তি হল, কাজেই শেষ পর্যন্ত মিসেস সরকার আপাদমস্তক সন্তুষ্ট হয়েই বিদায় নিলেন।

মমতা, আসক্তি এসব ভালো জিনিস নয়। বিশেষত যে আমার ধরা-ছোঁয়ার বাইরে তার ওপর। কিন্তু আমি যে পিউকে, পিউদের ছন্দকে কখন নিজের অজান্তে ভালবেসে ফেলেছি! তিলককে দেখো কী সুন্দর নিজের ঘরের জানলার ধারে বসে একমনে সিগারেট টেনে যাচ্ছে। নিজের ছেলেটি আর বউটি ছাড়া বিশ্বসংসার চেনে না। —‘কে রে? পিউ? কে পিউ? অ! পি-উ! তাই বল! শাড়ি পরে তোকে যে চেনাই যাচ্ছে না।’ এই হল তিলক, সরকারি আপিসের অফ্‌সর।

‘রে রে? পিউ এলি নাকি? বাঃ বাঃ কী সুন্দর শাড়ি পরেছিস! রোজ-রোজ তাই বলে পরিস না। তুই যেমন ছোট্ট আছিস, ছোট্ট থাক!’

‘বারে কাকিমণি আমি বুঝি চিরকালই ছোট্ট থাকব? জানো আমার ষোল বছর বয়স হল!’

‘তাই বুঝি? ষো—লো? বলিস কি? এ যে বুড়ি দিদিমা হয়ে গেলি? ষো—লো?’—এই হল তিলকের বউ, মানে আমি, মানে অঙ্ক ইংরিজির দিদিমণি।

আমি আসক্ত, আমার মমত্ববোধ এসেছে পিউয়ের সম্পর্কে তাই আমার মাথার ভেতরে কে বসে বসে সাইরেন বাজায়। আমি চকিত হয়ে শুনি। ওই পিউ যাচ্ছে, সঙ্গে টুলটুল, সঙ্গে গৌতম।

বাদল শেষের এক অপরাহ্ণবেলায় পিউয়ের মা মিসেস অঞ্জলি সরকার এসে আমার বসার ঘরের চৌকিতে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। গলগল করে ঘাম বেরোচ্ছে। পাউডার ফুটে উঠেছে। চোখে আতঙ্ক।

আমি বললুম, ‘কি হল? কি হয়েছে? একটু শরবৎ করে আনি।’

—‘শরবৎ-টরবৎ থাক, মিসেস মিত্র, সর্বনাশ হয়েছে। আপনিই ভরসা।’

বিপদে শ্রীমধুসূদন শরণ জানি। আমি কিভাবে মিসেস সরকারের বিপদবারণ বিপত্তারণ হতে পারি বুঝলুম না।

‘পিউ ওর ছোট কাকিমাকে কী বলেছে জানেন?’

—‘কী?’

—‘ও নাকি গৌতমকে ভালো ওঃ ভালোবাসে, বিয়ে করবে, উঃ বাবারি।’

—আমি বললুম, ‘ছেলেমানুষ বলছে, বলতে দিন না।’

‘না না। ও বলছে ও ছেলেমানুষ নয়। ওর সঙ্গে গৌতমের এক্ষুনি বিয়ে দিতে হবে।’

‘সে কি? ওর তো এখনো আঠার হয়নি?’

‘আরে ওর দিদির তো পনেরয় বিয়ে দিয়েছিল ওর বাবা। ও বলছে ওসব আইন আছে আইন থাক, ওর সঙ্গে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব গৌতমের বিয়ে দিতে হবে। নমিতা, আমি আঠারয় কেন ষোলতেও বিয়ে দিতে রাজি আছি, সে আমরা নিজে দেখে শুনে পছন্দ হলেই দেবো। তাই বলে গৌতম?’

গৌতম ছেলেটি পিউদের যোগ স্কুলের বন্ধু। ওর চেয়ে বড়। কুড়ি একুশ হবে। কি পড়াশুনো করে জানি না। চাকরি-বাকরির স্তরে এখনও ওঠেনি যদ্দূর জানি। খুব সুদেহী। যোগব্যায়াম যারা করে, তারা জামা না খুললে তো দেখা যায় না তারা এত সুন্দর! আমি একবার গৌতমকে টিভি-তে দেখেছিলুম। অল বেঙ্গল যোগকুমার হয়েছিল। কিছু যোগাসনও করে দেখিয়েছিল। ভিকট্রিস্ট্যান্ডের ওপর যখন দাঁড়িয়েছিল তখন মনে হচ্ছিল কোনও গ্রীক ভাস্কর্য প্রাণ পেয়েছে। সেবারও তিলককে ডেকেছিলুম—‘দেখে যাও, দেখে যাও কী সুন্দর।’ মহা অনিচ্ছায় দাবা-বোর্ড ছেড়ে উঠে এসে তিলক একটু দেখল তারপর বলল, ‘তুমি রেগ পার্ককে দেখেছো?’

‘কে সে?’

‘এক সময়ের মিঃ ইউনিভার্স। কোন বছর মনে করতে পারছি না।’

‘আমি কি করে দেখব?’

‘তার কাছে দাঁড়াতে পারে না।’

এই সব লোকের সঙ্গে কথা চলে? মোট কথা গৌতম একটি কালো অ্যাপলো। পিউ এখন একটা ষোল বছরের প্রাণবন্ত সুন্দর মেয়ে। পিউয়ের দোষ নেই।

মিসেস সরকার বললেন, ‘কিছু বলুন মিসেস মিত্র? কিছু তো বলুন?’ অসতর্ক মুহূর্তে উনি আমাকে নাম ধরে তুমি করে ডেকে ফেলেছিলেন। এখন আবার ফর্ম্যালিটির খোলসে ঢুকে পড়েছেন।

বললুম, ‘গৌতম কী বলছে? তার বাড়ির লোক?’

‘গৌতম কী বলছে তার বাড়ির লোক কী বলতে পারে এসব অবান্তর কথা আমি ভাবছি নাকি? গৌতম তো একটা রাস্তার ছেলে। ওর বাবা কি করে জানি না। ছোটখাটো কিছু বোধহয়। আমাদের কত বড় বংশ বলুন তো। এসব কথা চিন্তা করা যায়?’

‘আমি জানতে চাইছিলুম গৌতমও কি পিউকে বিয়ে করতে এতটাই আগ্রহী? ওর বাড়ির লোকে কিভাবে জিনিসটা নিতে পারেন?’

‘ওই ছোঁড়াই তো যোগের নাম করে ছেলেমানুষ মেয়েটাকে ভুলিয়েছে। ওরই তো দোষ। কি সব কম্পুটার-টার শেখে। এক কড়ার মুরোদ নেই। শিববাবুদের একতলায় ভাড়া থাকে। ও-ই তো যত নষ্টের গোড়া।’

গৌতমকে যতবার দেখেছি আমার ওকে খুব ভদ্র, সরল এবং সহজ মনে হয়েছে। মিসেস সরকার বললেন—‘পিউকে আপনার কাছে পাঠিয়ে দেবো। খুব কাকিমণি কাকিমণি করে। আপনি ওকে একটু বুঝিয়ে বলুন মিসেস মিত্র। প্লী-জ।’

মিসেস সরকার চলে গেলেন।

পিউ, এল। শনিবার দুপুরবেলায়। আমি চুল শ্যাম্পু করে পাখার তলায় শুকোচ্ছিলুম। বেল বাজল। খুলে দেখি পিউ। সবুজ রঙের একটা চুড়িদার পরা পিউ। কিন্তু পিউয়ের মুখে হাসি নেই। চোখ দুটো ভারাক্রান্ত। মুখে একটা বিস্ময়ের ভাব। বললুম—‘পিউ আয়।’

পিউ ঢুকতে ঢুকতে বলল—‘মা তোমাকে সব বলেছে কাকিমণি, না?’

‘হ্যাঁ।’

‘তুমিও কি আমাকে বকবে? মারবে?’

‘কি বলছিস পিউ?’

পিউ তার কামিজটা তুলে পিঠ দেখাল। একটা কালশিটে দাগ মেরুদণ্ড বরাবর। কোমরের ওপরের খানিকটা অংশ ফুলে উঠেছে। আমি শিউরে বললুম, ‘একি?’

পিউ বললে, ‘কাকিমা জুতো দিয়ে পিটিয়েছে, আমি নাকি বংশের মুখে চুন কালি লেপেছি। আর মা একটা স্টীলের জলসুদ্ধ ঘটি ছুঁড়ে মেরেছিল। মুখে কিছু বলেনি।

আমি তাড়াতাড়ি ওকে ঘরে নিয়ে গিয়ে ওষুধ বার করছি, পিউ বলল,—‘কাকিমণি, ওষুধ দিয়ে আমার মনের কালশিটে সারাতে পারবে? আমার মনের ইনফ্ল্যামেশন, ব্যথা কমাতে পারবে?’

পিউ বরাবরই পাকা-পাকা কথা কয়। আজ আমি অবাক হয়ে গেলুম। শুধু কথা নয়, কথার ধরনে। পিউ বলল—‘কাকিমণি, আসলে ওষুধ দিয়ে তুমি তোমার মনের ঘাটা সারাতে চাইছ। আমারটা নিয়ে তোমার মাথাব্যথা নেই।’

বললুম, ‘পিউ, কী বলছিস, ভালো করে বল আমি বুঝতে পারছি না।’

‘কাকিমণি, সবাই আমাকে ভালোবাসছে এই ধারণাটাকে ভালোবাসে। ওষুধ দিলে ভালোবাসার সেই ধারণাটা তোমাদের শান্ত হবে। নিজেকে তোমরা বোঝাবে পিউয়ের পিঠে ব্যথা করছিল, আমি তো ওষুধ দিয়েছি। আমি তো আমার কর্তব্য করেছি। আচ্ছা কাকিমণি, মা কেন গৌতমের সঙ্গে আমার বিয়ে দিতে চাইছে না?’

পিউ আমার মুখের দিকে বড় বড় চোখ মেলে চাইল। চোখে না-বোঝার বিপুল বিস্ময়।

‘কেন বলো তো? আমি ভেবেছিলুম মা-ই আগে অ্যাপ্রুভ করবে, কাকিমারা ঠাকুমা তারপরে। সবশেষে বাবা আর দাদু।’

‘তুই কেন এমন ভেবেছিলি পিউ?’

‘মানুষের হাব-ভাব পছন্দ-অপছন্দ দেখে একটা ধারণা হয় না? এতদিন ধরে আমি আমার বাড়ির লোকদের একটুও বুঝতে পারিনি, এটা কি করে হয় কাকিমণি! ছোটকাকিমা, যে নিজের মেয়ে নেই বলে, অর্ধেক গয়না আমাকে দিয়ে দিয়েছে সেই ছোটকাকিমা, আমার এতটুকু জ্বর হলে যে সারাক্ষণ জলপাটি নিয়ে বসে থাকে সেই ছোটকাকিমা আমায় জুতো মারল!’

আমি কী বলব? কী করে বলব? অথচ বলতেই হবে। নইলে আমার চোখের সামনে এই সুন্দর ফুলটা শুকিয়ে যাবে। বললুম—‘পিউ, মানুষ অনেক সময়ে ভালোবেসেও মারে, শাসন করে, উল্টো আচরণ করে, তার মানে এই নয় যে তোর মা-কাকিমা তোকে ভালোবাসেন না।’

পিউ বলল, ‘জুতোতে অনেক সময়ে কাঁটা উঠে থাকে। ফুটলে শিওর ধনুষ্টঙ্কার। কাকি তো একবারও দেখল না আমার পিঠে কাঁটা ফুটেছে কি না, কাকি শাসন করছে বলে মা তো তেড়ে এল না! মা শাসন করছে বলে কাকিও তো তেড়ে এল না কাকিমণি! ওরা কি তা হলে অন্য কোনও পিউকে ভালোবাসে? যাকে আমি চিনি না?’

আমি বললুম, ‘পিউ তুই গৌতমকে বিয়ে করতে চাইছিস। বেশ তো, তোর বয়সটা হোক, গৌতম পাশ-টাশ করে চাকরি করুক। তারপর বিয়ে করবি। তাড়া করছিস কেন?’

তখন পিউ বড় অদ্ভুত কথা বলল। বলল, ‘কাকিমণি আমার মায়ের, মানে দাদুর অনেক লাখ টাকার সম্পত্তি। সমস্ত আমাদের দু বোনের নামে। এ আমি ছোট্ট থেকে শুনে আসছি। আজকালকার যা দিনকাল তাতে গৌতমের মতো সাধারণ ছেলের দাঁড়ানোর বলতে গেলে কোনও সম্ভাবনা নেই। আমার অনেক টাকা আছে, গৌতমের খাটবার শক্তি আছে, ইচ্ছে আছে। এই টাকাটা দিয়ে যদি একটা কম্পুটার সেন্টার খোলা যায়, তা হলেই গৌতম দাঁড়িয়ে যাবে। আমাদের কোনও অভাব থাকবে না। ব্যাপারটা যত তাড়াতাড়ি হয়, ততই ভাল না?’ মনে মনে বললুম, ‘সর্বনাশ’। মুখে বললুম—‘আইডিয়াটা কার? গৌতমের?’

পিউ বলল, ‘গৌতমের তো বটেই। ও শো করে করে এখন টাকা জমাচ্ছে। তবে ও আমার টাকার কথা জানে না। আমি কিছু বলিনি। একেবারে অবাক করে দোব।’

স্বস্তির নিশ্বাস ফেললুম। পিউ বলল—‘কাকিমণি সব্বাইকেই ডাক্তার, এঞ্জিনিয়ার, প্রোফেসর বিয়ে করতে হবে কেন? গৌতমকে আমি প্রাণের চেয়েও ভালোবাসি। গৌতমও আমাকে প্রাণের চেয়েও ভালোবাসে…’ বলতে বলতে এতক্ষণে পিউ কেঁদে ফেলল। তারপর বলল, ‘কাকিমণি, তুমি মা-দের একটু বোঝাও। গৌতমকে ছাড়া আমি বাঁচব না।’

পিউ পিউয়ের মা দুজনেই আমাকে বলে গেল অপর পক্ষকে বোঝাতে। ওদের বাড়ি আমি পারতপক্ষে যাই না। গেলুম। মিসেস সরকার বললেন, ‘বুঝিয়েছেন? আশার কিছু আছে?’

বললুম, ‘আঠার বছর বয়স পর্যন্ত অপেক্ষা করতে ও বোধহয় রাজি হয়ে যাবে। তবে বিয়ে গৌতমকেই করবে। আর মিসেস সরকার, ছেলেটি তো ভালোই। বয়স খুব অল্প, এখন থেকেই তো বলা যায় না ভবিষ্যতে কে কী দাঁড়াবে। অত সুন্দর স্বাস্থ্য, সুন্দর চেহারা, খাটিয়ে, বুদ্ধিমান, মানুষ হিসেবে ভালো, বাকিটুকু তো ওকে আপনারাই গড়েপিটে নিতে পারেন। পিউয়ের যখন এত পছন্দ!’

‘কী বললেন?’ প্রায় বাঘিনীর মতো গর্জন করে উঠলেন মিসেস সরকার। ‘আপনাকে কেউ গৌতমের হয়ে সালিশি করতে ডাকেনি মিসেস মিত্র। আপনি আর বংশমর্যাদার কী বুঝবেন, আপনাকে কিছু বলাই আমার ভুল হয়েছিল।’

আস্তে আস্তে পিউয়ের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছি। সত্যি কী ভুল! আমি নিম্ন মধ্যবিত্ত বাড়ির মেয়ে। আমি, আমার মা, আমার বোন, বাড়ির সবাই চাকরি করতুম, পড়াশোনা করতুম। আমার মা আমার সঙ্গে স্কুল ফাইনাল, বি. এ., এম. এ. পাশ করেছেন, এখনও তিনি একটা স্কুলের অ্যাসিস্ট্যান্ট হেড-মিসট্রেস। আমার ছোট বোন বেসরকারি ফার্মে স্টেনো টাইপিস্টের কাজ করে, আমি স্কুলে পড়াই, আমার শ্বশুরবাড়িও এমনি। কারুর কস্মিনকালেও কোনও জমিজমা, উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া টাকাকড়ি ছিল না। যে যেমন পেয়েছে লেখাপড়া করেছে, কোনও না কোনও ভদ্র চাকরিতে ঢুকে গেছে। বংশমর্যাদা তখনই হয় যখন অন্যের জমানো টাকা-পয়সা খরচ করবার অধিকার বর্তায়।

আমি আর পিউদের বাড়ি যাইনি। কিন্তু আমি মহা ভুল করেছিলাম। পিউ ঠিকই বলেছিল—আমরা আসলে ভালোবাসি না। ভালবাসি এই অহঙ্কারটা করতে ভালোবাসি। টুলটুল একদিন আতঙ্কিত মুখে এসে বলল, ‘নমিতাদি, পিউকে ওরা ঘরে বন্ধ করে রেখেছে। বেরোতে দেয় না। ও খাচ্ছে না। ওর বাবা বলেছে, তেমন অবস্থা হলে স্যালাইন দেওয়া হবে।’

একদিন গৌতম স্বয়ং এল, কাতরগলায় বলল, ‘নমিতাদি আপনি পিউকে বাঁচান, আমি কথা দিচ্ছি আমি চলে যাবো, অনেক দূরে চলে যাবো। ওর বাবা, কাকারা ওর ওপর অকথ্য অত্যাচার করছেন। চুলের মুঠি ধরে মেঝেয় ফেলে, বুট দিয়ে—উঃ’ গৌতম কেঁদে ফেলল। আমি কোনরকমে চোখের জল চেপে কঠোর গলায় বললুম, ‘গৌতম, তোমার তো কুড়ি একুশ বছর বয়স হয়েছে, কিছু বোঝো। বড়লোকের মেয়ের সঙ্গে প্রেম করার সময়ে এসব মনে ছিল না?’

গৌতম ধরাগলায় মুখ নিচু করে বলল—‘বিশ্বাস করুন নমিতাদি, কিভাবে ইনভলভড হয়ে গেলুম আমি জানি না। অনেকবার নিজেকে সরিয়ে নেবার চেষ্টা করেছি। পারিনি। কিন্তু এই পরিস্থিতি যে হতে পারে, ওঁরা যে পিউকে এমনিভাবে মারবেন, অত্যাচার করবেন তা আমার স্বপ্নেও জানা ছিল না। ওঁরা এত লিবার‍্যাল। মেলামেশা করা, ছবি-টবি দেখা, কোনও ব্যাপারেই তো ওঁদের কনজারভেটিভ বলে মনে হয়নি। তা ছাড়া পিউকে ওঁরা এত ভালোবাসেন!’

ওই একটা কথাতেই এসেই সব ঠেকে যাচ্ছে। ভালোবাসা। ভালোবাসা কী? আমি তিলককে সব বললুম, অনুরোধ করলুম—‘চলো, আমরা দুজনে মিলে যাই। তা হলে হয়ত একটু ওজন দেবে।’

তিলক বলল, ‘খেপেছো? অযাচিত উপদেশ দিতে মহাজনরা বারণ করে গেছেন। জানো না? পরের ব্যাপারে নাক গলানোর অভ্যেসটা তোমার বিপজ্জনক। ওটা বন্ধ করো। ওরা শুধু অপমান করে পথ দেখিয়ে দেবে, পানু সরকারকে আমি খুব ভালো করে চিনি।’

আমার বুকের মধ্যেটা ফাটতে লাগল। আমি মাথা কুটতে লাগলুম। কিন্তু আমার অহঙ্কার, আমার স্বামী, আর মহাজনবাক্য আমায় যেতে দিল না। অনেক রাত্তিরে যেন শুনলুম—পিউ ডাকছে, ‘কাকিমণি, কাকিমণি, দরজা খোলো’, সর্বাঙ্গে কালশিটে পড়া আলুথালু পিউ, মুখটা এমন ফুলেছে যে চেনা যায় না। ছুটে গিয়ে দরজা খুলে দিয়ে বুকের মধ্যে টেনে নিলুম—‘আয়, পিউ, আয় মা, আমি তোর সব ব্যথা সারিয়ে দেবো।’ তারপরেই ঘুম ভেঙে গেল। তিলক আমাকে ঝাঁকাচ্ছে। —‘ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে বাচ্চা মেয়ের মতো—কাঁদছো কেন? আচ্ছা তো!’

তখনও ঘুমের ঘোর যায়নি। কী করে তিলককে বোঝাই। মানুষের বয়স বাড়ে, তার অনুভূতির বয়স সব সময়ে বাড়ে না। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে ঘুমোতে লাগলুম।

ভোররাতে সত্যিকার দরজা ঠেলাঠেলিতে সবাইকার ঘুম ভেঙে গেল। আমার বাড়ি, তার পাশের বাড়ি, তার পাশের বাড়ি, গোটা পাড়া। গোটা পাড়া ভেঙে পড়েছে উনচল্লিশ নম্বরের দরজায়। পিউ জ্বলছে। সে বন্ধ ছিল। দফায় দফায় তার প্রিয়জনেরা থার্ড ডিগ্রি প্রয়োগ করেছে। কিল, চড়, লাথি; চোরের ঠ্যাঙানি, বাড়ির একমাত্র প্রিয়তম মেয়েটির ওপর। যতক্ষণ না তার নরম শরীরে মনে কালশিটের দাগ পড়ে যায়, যতক্ষণ না থেঁতলে যায় তার এতদিনের আদরে গড়া জীবন্ত মনটা, যতক্ষণ না সে মৃত্যু ছাড়া আর কিছুতে পরিত্রাণ দেখতে না পায়। সে কখনও কখনও বাথরুমে যাবার জন্য ছাড়া পেত, কখন কেরোসিন জোগাড় করে রেখেছে, কেউ জানে না, হয়ত তেমন করে জানবার চেষ্টাও করেনি। তার পরে পরিত্রাণ নেই দেখতে পেয়ে বুঝতে পেরে পিউ এখন জ্বলে যাচ্ছে।

দরজা বন্ধ। জানলা দিয়ে ঘরের ভেতরে লকলকে শিখা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু কোনও আওয়াজ নয়। দরজা জানলা ভেঙে যখন ভেতরে পৌঁছনো গেল, যখন দমকলের ঘণ্টা সমস্ত পাড়া চকিত করে ছুটে এল তখন পিউ একটা শুকনো কালো কাঠকয়লার লম্বাটে টুকরো মতো হয়ে গেছে।

পিউয়ের মা কাকিমা অজ্ঞান হয়ে গেছে আতঙ্কে। বাবা কাকারা ছোটাছুটি করছে। ছেলেগুলোকে পাশের বাড়ি নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এমন সময়ে শুনতে পেলুম গৌতমও জ্বলছে। বাঃ কেমন সুন্দর পরিসমাপ্তি। দি এন্ড।

এই নমিতাদি শুনেছিলুম কপাল ঠুকতে ঠুকতে নিজের মাথাটাই ভেঙে ফেলেছিলেন। স্বামী তিলকনাথ মিত্রকে তিনি কাছে ঘেঁসতে দিচ্ছিলেন না। ছেলে এসে—মায়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে তিনি অবশেষে রক্তাক্ত মাথায় অজ্ঞান হয়ে যান।

গল্প নয়। এটা সত্য ঘটনা। এই সমাজ যখন তার একচক্ষু ভোগসর্বস্বতার আগুনে ছোট ছোট নিস্পাপ কিশোর-কিশোরীদের এমনি করে পুড়িয়ে মারে তখন কোনও গল্পকার তাঁর শিল্পকৃতির গজদন্তমিনারে বসে ফর্ম আগে না বিষয় আগে এই চিরন্তন নান্দনিক তর্কে নিজেকে নিযুক্ত রাখতে পারেন না। তাঁকে তখন উপন্যাস, ছোটগল্প, রম্যরচনা, কবিতা সমস্ত লণ্ডভণ্ড করে পাগলের মতো ছুটে বেরিয়ে আসতে হবেই। পিউরা যে জ্বলছে!

No comments