কলাবতী রাজকন্যা – দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার

কলাবতী রাজকন্যা – দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার

এক-যে, রাজা। রাজার সাত রাণী।–বড়রাণী, মেজরাণী, সেজরাণী, ন-রাণী, কনেরাণী, দুয়োরাণী, আর ছোট রাণী।

রাজার মস্ত-বড় রাজ্য; প্রকাণ্ড রাজবাড়ী। হাতীশালে হাতী ঘোড়াশালে ঘোড়া, ভাণ্ডারে মাণিক, কুঠরীভরা মোহর, রাজার সব ছিল। এ ছাড়া,- মন্ত্রী, অমাত্য, সিপাই, লস্করে,- রাজপুরী গমগম্‌ করিত।

কিন্তু, রাজার মনে সুখ ছিল না। সাত রাণী, এক রাণীরও সন্তান হইল না। রাজা, রাজ্যের সকলে, মনের দুঃখে দিন কাটেন।

একদিন রাণীরা নদীর ঘাটে স্নান করিতে গিয়াছেন,- এমন সময়, এক সন্ন্যাসী যে, বড়রাণীর হাতে একটি গাছের শিকড় দিয়া বলিলেন,- “এইটি বাটিয়া সাত রাণীতে খাইও, সোনার চাঁদ ছেলে হইবে।”

রাণীরা, মনের আনন্দে তাড়াতাড়ি স্নান করিয়া আসিয়া, কাপড়-চোপড় ছাড়িয়া, গা-মাথা শুকাইয়া, সকলে পাকশালে গেলেন। আজ বড়রাণী ভাত রাঁধীবেন, মেজরাণী তরকারী কাটিবেন, সেজরাণী ব্যঞ্জন রাঁধিবেন, ন-রাণী জল তুলিবেন, কনেরাণী যোগান দিবেন, দুয়োরাণী বাট্‌না বাটিবেন, আর ছোটরাণী মাছ কুটিবেন। পাঁচরাণী পাকশালে রহিলেন; ন-রাণী কূয়োর পাড়ে গেলেন, ছোটরাণী পাঁশগাদার পাশে মাছে কুটিতে বসিলেন।

সন্ন্যাসীর শিকড়টি বড়রাণীর কাছে। বড়রাণী দুয়োরাণীকে ডাকিয়া বলিলেন,- “বোন, তুই বাটনা বাটবি, শিকড়টি আগে বাটিয়া দে না, সকলে একটু একটু খাই।”

দুয়োরাণী শিকড় বাটিতে বাটিতে কতটুকু নিজে খাইয়া ফেলিলেন। তাহার পর, রুপার থালে সোনার বাটি দিয়া ঢাকিয়া, বড়রাণীর কাছে দিলেন। বড়রাণী ঢাকনা খুলিতেই আর কতকটা খইয়া মেজরাণীর হাতে দিলেন। মেজরাণী খানিকটা খাইয়া, সেজরাণীকে দিলেন। সেজরাণী কিছু খাইয়া, কনেরাণীকে দিলেন। কনেরাণী বাকীটুকু খাইয়া ফেলিলেন। ন-রাণী আসিয়া দেখেন, বাটিতে একটু তলানী পড়িয়া আছে। তিনি তাহাই খাইলেন। ছোটরাণীর জন্য আর কিছুই রহিল না।

মাছ কোটা হইলে, ছোটরাণী উঠিলেন। পথে ন-রাণীর সঙ্গে দেখা হইল। ন-রাণী বলিলেন,- ‘ও অভাগি! তুই তো শিকড়বাটা খাইলি না?- যা, যা, শীগ্‌গীর যা।” ছোটরাণী আকুলি-ব্যাকুলি করিয়া ছুটিয়া আসিলেন; আসিয়া দেখিলেন, শিকড়বাটা একটুকুও নাই। দেখিয়া ছোটরাণী, আছাড় খাইয়া মাটিতে পড়িলেন।

তখন পাঁচ রাণীর এ-র দোষ ও দেয়; ও-র দোষ এ দেয়। এই রকম করিয়া সকলে মিলিয়া গোলমাল করিতে লাগিলেন।

ছোটরাণীর হাতের মাছ আঙ্গিনায় গড়াগড়ি গেল, চোখের জলে আঙ্গিনা ভাসিল।

একটু পরে ন-রাণী আসিলেন। তিনি বলিলেন,- “ওমা! ওর জন্য কি তোরা কিছুই রাখিস্‌ নাই? কেমন লো তোরা! চল্‌ বোন ছোটরাণী, শিল-নোড়াতে যদি একাধটুকু লাগিয়া থাক, তাই তোকে, ধুইয়া খাওয়াই। ঈশ্বর করেন তো, উহাতেই তোর সোনার চাঁদ ছেলে হইবে।”

ছোটরাণী কাঁদিয়া-কাটিয়া শিল-ধোয়া জলটুকুই খাইলেন। তা’র পর, ন-রাণীতে ছোটরাণীতে ভাগাভাগি করিয়া জল আনিতে গেলেন। আর রাণীরা নানাকথা বলাবলি করিতে লাগিলেন।

দশমাস দশ দিন যায়, পাঁচ রাণীর পাঁচ ছেলে হইল। এক-এক ছেলে যেন সোনার চাঁদ! ন-রাণী আর ছোটরাণীর কি হইল? বড়রাণীদের কথাই সত্য; ন-রাণীর পেটে এক পেঁচা আর ছোটরাণীর পেটে এক বানর হইল। বড় রাণীদের ঘরের সামনে ঢোল-ডগর বাজিয়া উঠিল। ন-রাণী আর ছোটরাণীর ঘরে কান্নাকাটি পড়িয়া গেল।

রাজা আর রাজ্যের সকলে আসিয়া, পাঁচ রাণীকে জয়ডঙ্কা দিয়া ঘরে তুলিলেন। ন-রাণী, ছোটরাণীকে কেহ জিজ্ঞাসাও করিল না। কিছুদিন পর, ন-রাণী চিড়িয়াখানার বাঁদী আর ছোটরাণী ঘুঁটেকুড়ানী দাসী হইয়া দুঃখে কষ্টে দিন কাটাইতে লাগিলেন।

ক্রমে ক্রমে রাজার ছেলেরা বড় হইয়া উঠিল; পেঁচা আর বানরও বড় হইল। পাঁচ রাজপুত্রের নাম হইল- হীরারাজপুত্র, মাণিকরাজপুত্র, মোতিরাজপুত্র, শঙ্খরাজপুত্র আর কাঞ্চনরাজপুত্র।

                          পেঁচার নাম হইল ভূতুম্‌
                                   আর
                          বানরের নাম হইল বুদ্ধ।

পাঁচ রাজপুত্র পাঁচটি পক্ষিরাজ ঘোড়ায় চড়িয়া বেড়ায়। তাহাদের সঙ্গে-সঙ্গে কত সিপাই লস্কর পাহারা থাকে। ভূতুম্‌ আর বুদ্ধ দুইজনে তাহাদের মায়েদের কুঁড়েঘরের পাশে একটা ছোট বকুলগাছের ডালে বসিয়া খেলা করে।

পাঁচ রাজপুত্রেরা বেড়াইতে বাহির হইয়া আজ ইহাকে মারে, কাল উহাকে মারে আজ ইহার গর্দান নেয়, কাল ইহার গর্দান নেয়; রাজ্যের লোক তিত-বিরক্ত হইয়া উঠিল।

ভুতুম আর বুদ্ধ, দুইজনে খেলাধূলা করিয়া, যা’র-যা’র মায়ের সঙ্গে যায়। বুদ্ধ মায়ের ঘুঁটে কুড়াইয়া দেয়, ভূতুম চিড়িয়াখানার পাখীর ছানাগুলিকে আহার খাওয়াইয়া দেয়। আর, দুই-একদিন পর-পর দুইজনে রাজবাড়ীর দক্ষিণ দিকে বনের মধ্যে বেড়াইতে যায়।

ভূতুমের মা চিড়িয়াখানার বাঁদী, বুদ্ধুর মা ঘুঁটে-কুড়ানী দাসী। কোনদিন খাইতে পায়, কোনদিন পায় না। বুদ্ধু দুই মায়ের জন্য বন জঙ্গল হইতে কত রকমের ফল আনে। ভূতুম্‌ ঠোঁটে করিয়া দুই মায়ের পান খাইবার সুপারী আনে। এই রকম করিয়া ভূতুম, ভূতুমের মা, বুদ্ধু, বুদ্ধুর মা’র দিন যায়।

একদিন পাঁচ রাজপুত্র পক্ষিরাজ ঘোড়া ছুটাইয়া চিড়িয়াখানা দেখিতে আসিলেন। আসিতে, পথে দেখিলেন, একটি পেঁচা আর একটি বানর বকুল গাছে বসিয়া আছে। দেখিয়াই তাঁহারা সিপাই লস্করকে হুকুম দিলেন- “ঐ পেঁচা আর বানরটিকে ধর, আমরা উহাদিগে পুষিব।” অমনি সিপাই লস্করেরা বকুল গাছে জাল ফেলিল। ভূতুম আর বুদ্ধ জাল ছিঁড়িতে পারিল না। তাহারা ধরা পড়িয়া, খাঁচায় বদ্ধ হইয়া রাজপুত্রদের সঙ্গে রাজপুরীতে আসিল। চিড়িয়াখানা পরিষ্কার করিয়া ভূতুমের মা আসিয়া দেখেন, ভূতুম্‌ নাই! ঘুঁটে ছড়াইয়া বুদ্ধুর মা আসিয়া দেখেন, বুদ্ধু নাই! ভূতুমের মা হাতের ঝাঁটা মাটিতে ফেলিয়া বসিয়া পড়িলেন; বুদ্ধুর মা গোবরের ঝাঁটা ছুড়িয়া ফেলিয়া দিয়া আছাড় খাইয়া পড়িলেন।

রাজপুরীতে আসিয়া ভূতুম্‌ আর বুদ্ধু অবাক্!‌- মস্ত-মস্ত দালান; হাতী, ঘোড়া, সিপাই, লস্কর কত কি!

দেখিয়া তাহারা ভাবিল,- “বা! তবে আমরা বকুল গাছে থাকি কেন? মায়েরাই বা কুঁড়েয় থাকে কেন? ভাবিয়া তাহারা বলিল,- “ও ভাই রাজপুত্র, আমাদিগে আনিয়াছ তো, মাদিগেও আন।”

রাজপুত্রেরা বলিলেন,- বাঃ! ইহারা তো মানুযের মতো কথা কয়! তখন বলিলেন- “বেশ বেশ, তোদের মায়েরা কোথায় বল; আনিয়া চিড়িয়াখানায় রাখিব।”

ভূতুম বলিল, “চিড়িয়াখানার বাঁদী আমার মা।”
বুদ্ধু বলিল,- “ঘুঁটে-কুড়ানী দাসী আমার মা!”
শুনিয়া রাজপুত্রেরা হাসিয়া উঠিলেন-

      “মানুষের পেটে আবার পেঁচা হয়!”
      “মানুযের পেটে আবার বানর হয়!”

ছোটরাণী আর ন-রাণীর কথা, রাজপুত্রের কি-না জানিতেন না, একজন সিপাই ছিল, সে বলিল,-“হইবে না কেন? আমাদের দুই রাণী ছিলেন; তাঁহাদের পেটে পেঁচা আর বানর হইয়াছিল। রাজা সেইজন্য তাঁহাদিগে খেদাইয়া দেন। ইহারাই সেই পেঁচা আর বানর পুত্র।”

শুনিয়া রাজপুত্রেরা “ছি, ছি!” করিয়া উঠিলেন। তখনই খাঁচার উপর লাথি মারিয়া, রাজপুত্রেরা সিপাই-লস্করকে বলিলেন-“এই দুইটাকে খেদাইয়া দাও।” বলিয়া রাজ্যের ছেলেরা পক্ষিরাজে চড়িয়া বেড়াইতে চলিয়া গেলেন।

ভূতুম্‌ আর বুদ্ধু জানিল, তাহারাও রাজার ছেলে! ভূতুমের মা বাঁদী নয়, বুদ্ধুর মা দাসী নয়। বুদ্ধু বলিল,- “দাদা, চল আমরা বাবার কাছে যাইব।”

      ভূতুম্‌ বলিল,- “চল।”

সোনার খাটে গা, রূপার খাটে পা রাখিয়া রাজপুরীর মধ্যে, পাঁচ রাণীতে বসিয়া সিঁথিপাটি করিতেছিলেন। এক দাসী আসিয়া খবর দিল, নদীর ঘাটে যে, শুকপঙ্খী নৌকা আসিয়াছে, তাহার রূপার বৈঠা, হীরার হা’ল। নায়ের মধ্যে মেঘ-বরণ চুল কুঁচ-বরণ কন্যা বসিয়া সোনার শুকের সঙ্গে কথা কহিতেছে।

অমনি নদীর ঘাটে পাহারা বসিল; রাণীরা উঠেন-কি-পড়েন, কে আগে কে পাছে; শুকপঙ্খী নায়ে কুঁচ-বরণ কন্যা দেখিতে চলিলেন। তখন শুকপঙ্খী নায়ে পাল উড়িয়াছে; শুকপঙ্খী তরতর করিয়া ছুটিয়াছে।

           রাণীরা বলিলেন-
 “কুঁচ-বরণ কন্যা মেঘ-বরণ চুল।
  নিয়া যাও কন্যা মোতির ফুল।”

নৌকা হইতে কুঁচ-বরণ কন্যা বলিলেন,-
“মোতির ফুল মোতির ফুল সে বড় দূর,
তোমার পুত্র পাঠাইও কলাবতীর পুর।
হাটের সওদা ঢোল-ডগরে, গাছের পাতে ফল।
তিন বুড়ির রাজ্য ছেড়ে রাঙ্গা নদীর জল।”

বলিতে, বলিতে, শুকপঙ্খী নৌকা অনেক দূর চলিয়া গেল।
রাণীরা সকলে বলিলেন-
“কোন দেশের রাজকন্যা কোন্‌ দেশে ঘর?
সোনার চাঁদ ছেলে আমার তো-মার বর।”

তখন শুকপঙ্খী আরও অনেক দূর চলিয়া গিয়াছে; কুঁচ-বরণ কন্যা উত্তর করিলেন,-

      “কলাবতী রাজকন্যা মেঘ-বরণ কেশ,
      তোমার পুত্র পাঠাইও কলাবতীর দেশ।
      আনতে পারে মোতির ফুল ঢো-ল-ডাগর,
      সেই পুত্রের বাঁদী হয়ে আসব তোমার ঘর।”

শুকপঙ্খী আর দেখা গেল না। রাণীরা অমনি ছেলেদের কাছে খবর পাঠাইলেন। ছেলেরা পক্ষিরাজ ছুটাইয়া বাড়িতে আসিল। রাজা সকল কথা শুনিয়া ময়ূরপঙ্খী সাজাইতে হুকুম দিলেন। হুকুম দিয়া, রাজা, রাজসভায় দরবার করিতে গেলেন।

মস্ত দরবার করিয়া রাজা রাজসভায় বসিয়াছেন। ভূতুম্‌ আর বুদ্ধু গিয়া সেইখানে উপস্থিত হইল। দুয়ারী জিজ্ঞাসা করিল,- “তোমরা কে?”

      বুদ্ধু বলিল,- “বানররাজপুত্র।”
      ভূতুম্‌ বলিল,- “পেঁচারাজপুত্র।”

দুয়ারী দুয়ার ছাড়িয়া দিল।

তখন বুদ্ধু এক লাফে গিয়া রাজার কোলে বসিল। ভূতুম উড়িয়া গিয়া রাজার কাঁধে বসিল। রাজা চমকিয়া উঠিলেন; রাজসভায় সকলে হাঁ! হাঁ!!’ করিয়া উঠিল।

      বুদ্ধু ডাকিল,- “বাবা!”
      ভূতুম্‌ ডাকিল,- “বাবা!”

রাজসভার সকলে চুপ। রাজার চোখ দিয়া টস্‌-টস্‌ করিয়া জল গড়াইয়া গেল। রাজা ভূতুমের গালে চুমা খাইলেন, বুদ্ধুকে দুই হাত দিয়া বুকে তুলিয়া লইলেন। তখনি রাজসভা ভাঙ্গিয়া দিয়া বুদ্ধু আর ভূতুমকে লইয়া রাজা উঠিলেন।

এদিকে তো সাজ সাজ পড়িয়া গিয়াছে। পাঁচ নিশান উড়াইয়া পাঁচখানা ময়ূরপঙ্খী আসিয়া, ঘাটে লাগিল। রাজপুত্রেরা তাহাতে উঠিলেন। রাণীরা হুলুধ্বনি দিয় পাঁচ রাজপুত্রকে কলাবতী রাজকন্যার দেশে পাঠাইলেন।

সেই সময়ে ভূতুম্‌ আর বুদ্ধুকে লইয়া, রাজা যে, নদীর ঘাটে আসিলেন।

বুদ্ধু বলিল,- “বাবা, ও কি যায়?”
রাজা বলিলেন,- “ময়ূরপঙ্খী।”

বুদ্ধু বলিল,- “বাবা, আমরা ময়ূরপঙ্খীতে যাইব; আমাদিকে ময়ূরপঙ্খী দাও।”

      ভূতুম্‌ বলিল.- “বাবা, ময়ূরপঙ্খী দাও।”
      রাণীরা সকলে কিল্‌ কিল্‌ করিয়া উঠিলেন-
         “কে লো, কে লো, বাঁদীর ছানা নাকি লো?”
         “কে লো, কে লো, ঘুঁটে-কুড়ানীর ছা নাকি লো?”
              “ও মা, ও মা, ছি! ছি!”

রাণীরা ভূতুমের গালে ঠোনা মারিয়া দিলেন, বুদ্ধুর গালে চড় মারিয়া ফেলিয়া দিলেন। রাজা আর কথা কহিতে পারিলেন না; চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিলেন। রাণীরা রাগে গর্‌-গর্‌ করিতে-করিতে রাজাকে লইয়া রাজপুরীতে চলিয়া গেলেন।

      বুদ্ধু বলিল,- “দাদা?”
      ভূতুম্‌ বলিল,-“ভাই?”

বুদ্ধু।– “চল আমরা ছুতোরবাড়ী যাই, ময়ূরপঙ্খী গড়াইব; রাজপুত্রেরা যেখানে গেল, সেইখানে যাইব।”
ভূতুম্‌ বলিল,-“চল।”

দিন নাই, রাত্রি নাই, কাঁদিয়া কাটিয়া ভূতুমের মা, বুদ্ধুর মায়ের দিন যায়। তাঁহারাও শুনিলেন, রাজপুত্রেরা ময়ূরপঙ্খী করিয়া কলাবতী রাজকন্যার দেশে চলিয়াছেন। শুনিয়া, দুইজনে, দুইজনের গলা ধরিয়া আরও কাঁদিতে লাগিলেন।

কাঁদিয়া-কাটিয়া দুই বোনে শেষে নদীর ধারে আসিলেন। তাহার পরে, দুইজনে দুইখানা সুপারীর ডোঙ্গায়, দুইকড়া কড়ি, ধান দূর্বা আর আগা-গলুইয়ে পাছা-গলুইয়ে সিন্দুরের ফোঁটা দিয়ে ভাসাইয়া দিলেন।

বুদ্ধুর মা বলিলেন,-
“বুদ্ধু আমার বাপ!
কি করেছি পাপ?
কোন পাপে ছেড়ে গেলি, দিয়ে মনস্তাপ?
শুকপঙ্খী নায়ের পাছে ময়ূরপঙ্খী যায়,
আমার বাছা থাক্‌লে যেতিস্‌ মায়ের এই নায়।
পৃথিবীর যেখানে যে আছ ভগবান,-
আমার বাছার তরে দিলাম এই দূর্বা ধান।”

ভূতুমের মা বলিলেন-
“ভূতুম আমার বাপ!
কি করেছি পাপ?
কোন্‌ পাপে ছেড়ে গেলি, দিয়ে মনস্তাপ?
শুকপঙ্খী নায়ের পাছে ময়ূরপঙ্খী যায়,
আমার বাছা থাকলে যেতিস মায়ের এই নায়।
পৃথিবীর যেখানে যে আছ ভগবান্‌,-
আমার বাছার তরে দিলাম এই দূর্বা ধান।”

সুপারির ডোঙ্গা ভাসাইয়া দিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে ভূতুমের মা, বুদ্ধুর মা কুঁড়েতে ফিরিলেন।

ছুতোরের বাড়ী যাইতে-যাইতে পথে ভূতুম্‌ আর বুদ্ধু দেখিল, দুইখানি সুপারীর ডোঙ্গা ভাসিয়া যাইতেছে।
বুদ্ধু বলিল, “দাদা, এই তো আমাদের না’; এই নায়ে উঠ।”
ভূতুম্‌ বলিল,- “উঠ।”

তখন, বুদ্ধু আর ভূতুম্‌ দুইজনে দুই নায়ে উঠিয়া বসিল। দুই ভাইয়ের দুই ময়ূরপঙ্খী যে পাশাপাশি ভাসিয়া চলিল।
লোকজনে দেখিয়া বলে,- “ও মা! এ আবার কি?’
বুদ্ধু বলে, ভূতুম্‌ বলে,- “আমরা বুদ্ধু আর ভূতুম্‌।”
বুদ্ধু ভূতুম্‌ যায়।

১০

আর, রাজপুত্রেরা? রাজপুত্রদের ময়ূরপঙ্খী যাইতে যাইতে তিন বুড়ীর রাজ্যে গিয়া পৌঁছিল। অমনি তিন বুড়ীর তিন বুড়া পাইক আসিয়া নৌকা আটকাইল। নৌকা আটকাইয়া তাহারা মাঝি-মাল্লা সিপাই-লস্কর সব শুদ্ধ পাঁচ রাজপুত্রকে থলে’র মধ্যে পুরিয়া তিন বুড়ীর কাছে নিয়া গেল।

তাহাদিগে দিয়া তিন বুড়ী তিন সন্ধ্যা জল খাইয়া, নাক ডাকাইয়া ঘুমাইয়া পড়িল!
অনেক রাত্রে, তিন বুড়ীর পেটের মধ্য হইতে রাজপুত্রেরা বলাবলি করিতে লাগিল,- “ভাই, জন্মের মতো বুড়ীদের পেটে রহিলাম। আর মা’দিগে দেখিব না, আর বাবাকে দেখিব না।”

এমন সময় কাহারা আসিয়া আস্তে আস্তে ডাকিল,- “দাদা! দাদা!”
রাজপুত্রেরা চুপি-চুপি উত্তর করিল,-“কে ভাই, কে ভাই? আমরা যে বুড়ীর পেটে!”
বাহির হইতে উত্তর হইল, “আমার লেজ ধর”; “আমার পুচ্ছ ধর।”
রাজপুত্রেরা লেজ ধরিয়া, পুচ্ছ ধরিয়া, বুড়ীদের নাকের ছিদ্র দিয়া বাহির হইয়া আসিল। আসিয়া দেখে; বুদ্ধু আর ভূতুম্‌!
বুদ্ধু বলিল,- “চুপ, চুপ! শীগ্‌গীর তরোয়াল দিয়ে বুড়ীদের গলা কাটিয়া ফেল।”
রাজপুত্রেরা তাহাই করিলেন। রাজপুত্র, মাল্লা-মাঝি সকলে বাহির হইয়া আসিল। আসিয়া, সকলে তাড়াতাড়ি গিয়া ময়ূরপঙ্খীতে পাল তুলিয়া দিল। বুদ্ধু আর ভূতুম্‌কে কেহ জিজ্ঞাসাও করিল না।

১২

ময়ূরপঙ্খী সারারাত ছুটিয়া ছুটিয়া ভোরে রাঙ্গা নদীর জলে গিয়া পড়িল। রাঙ্গা নদীর চারিদিকে কূল নাই, কিনারা নাই, কেবল রাঙ্গা জল। মাঝিরা দিক হারাইল; পাঁচ ময়ূরপঙ্খী ঘুরিতে ঘুরিতে সমুদ্রে গিয়া পড়িল। রাজপুত্র মাল্ল-মাঝি সকলে হাহাকার করিয়া উঠিল।

সাত দিল সাত রাত্রি ধরিয়া ময়ূরপঙ্খীগুলি সমুদ্রের মধ্যে আছাড়িপিছাড়ি করিল। শেষে, নৌকা আর থাকে না; সব যায়-যায়! রাজপুত্রেরা বলিলেন-“হায় ভাই, বুদ্ধু ভাই থাকিতে আজি এখন রক্ষা করিত!” “হায় ভাই, ভূতুম্‌ ভাই থাকিতে এখন রক্ষা করিত!”

      “কি ভাই, কি ভাই!
      কি চাই, কি চাই?”

বলিয়া বুদ্ধু আর ভূতুম্‌ তাহাদের সুপারীর ডোঙ্গা ময়ূরপঙ্খীর গলুইয়ের সঙ্গে বাঁধিয়া থুইয়া, রাজপুত্রদের কাছে আসিল। আর, মাঝিদিগে বলিল, “উত্তর দিকে পাল তুলিয়া দে।”

দেখিতে-দেখিতে ময়ূরপঙ্খী সমুদ্র ছাড়াইয়া এক নদীতে আসিয়া পড়িল। নদীর জল যেন টল্‌টল্‌ ছল্‌ছল্‌ করিতেছে। দুই পাড়ে আম-কাঁঠালের হাজার গাছ। রাজপুত্রেরা সকলে পেট ভরিয়া আম, কাঁঠাল খাইয়া, সুস্থির হইলেন। তখন রাজপুত্রেরা বলিলেন, “ময়ূরপঙ্খীতে বানর আর পেঁচা কেন রে? এ দুইটাকে জলে ফেলিয়া দে।” মাঝিরা বুদ্ধু আর ভূতুম্‌কে জলে ফেলিয়া দিল; তাহাদের সুপারীর ডোঙ্গা খুলিয়া ছুঁড়িয়া ফেলিল। নদীর জলে ময়ূরপঙ্খী আবার চলিতে লাগিল।

চলিতে চলিতে এক জায়গায় আসিয়া পাঁচটি ময়ূরপঙ্খীই রাজপুত্র, মাল্লা, মাঝি সব লইয়া, ভুস করিয়া ডুবিয়া গেল। আর তাহাদের কোনও চিহ্ন-ই রহিল না।
কতক্ষণ পর, বুদ্ধু আর ভূতুমের ডোঙ্গা যে, সেইখানে আসিল। বুদ্ধু বলিল,-“দাদা!”
ভূতুম্‌ বলিল,- “কি?”
বুদ্ধু!- “আমার মন যেন কেমন-কেমন করে, এইখানে কি হইয়াছে। এস তো, ডুব দিয়া, দেখি।”
ভূতুম্‌ বলিল, “হ’ক গে! ওরা মরিয়া গেলেই বাঁচি। আমি ডুব্‌টুব দিতে পারিব না।”
বুদ্ধু বলিল,- “ছি, ছি, অমন কথা বলিও না। তা, তুমি থাক; এই আমার কোমরে সূতা বাঁধিলাম, যতদিন সূতাতে টান না দিব, ততদিন যেন তুলিও না”
ভূতুম্‌ বলিল,- “আচ্ছা, তা’ পারি।”
তখন বুদ্ধু নদীর জলে ডুব দিল; ভূতুম্‌ সূতা ধরিয়া বসিয়া রহিল।

১২

যাইতে যাইতে বুদ্ধু পাতাল-পুরীতে গিয়া দেখিল, এক মস্ত সুড়ঙ্গ। বুদ্ধু সুড়ঙ্গ দিয়া, নামিল।

সুড়ঙ্গ পার হইয়া বুদ্ধু দেখিল, এক যে- রাজপুরী!-যেন ইন্দ্রপুরীর মত!!

কিন্তু সে রাজ্যে মানুষ নাই, জন নাই, কেবল এক একশ বচ্ছুরে’ বুড়ী বসিয়া একটি ছোট কাঁথা সেলাই করিতেছে। বুড়ী বুদ্ধুকে দেখিয়াই হাতের কাঁথা বুদ্ধুর গায়ে ছুঁড়িয়া মারিল। অমনি হাজার হাজার সিপাই আসিয়া বুদ্ধুকে বাঁধিয়া-ছাঁদিয়া রাজপুরীর মধ্যে লইয়া গেল।

নিয়া গিয়া, সিপাইরা, এক অন্ধকুঠরীর মধ্যে, বুদ্ধুকে বন্ধ করিয়া রাখিয়া দিল। অমনি কুঠরীর মধ্যে- “বুদ্ধু ভাই, বুদ্ধু ভাই, আয় ভাই, আয় ভাই।” বলিয়া অনেক লোক বুদ্ধুকে ঘিরিয়া ধরিল। বুদ্ধু দেখিল, রাজপুত্র আর মাল্লা-মাঝিরা!

বুদ্ধু বলিল,- “বটে! তা, আচ্ছা!”
পরদিন বুদ্ধু দাঁত মুখ সিট্‌কাইয়া মারিয়া রহিল! এক দাসী রাজপুত্রদিগে নিত্য কি-না খাবার দিয়া যাইত! সে আসিয়া দেখে, কুঠরীর মধ্যে একটা বানর মরিয়া পড়িয়া আছে। সে যাইবার সময় মরা বানরটাকে ফেলিয়া দিয়া গেল। আর কি?- তখন বুদ্ধু আস্তে আস্তে চোখ মিটি-মিটি উঠে। না তো, এদিক ওদিক চাহিয়া বুদ্ধু, উঠিল। উঠয়াই বুদ্ধু দেখিল প্রকাণ্ড রাজপুরীর তে-তলায় মেঘ-বরণ চুল কুঁচ-বরণ কন্যা সোনার শুকের সঙ্গে কথা কহিতেছে।

বুদ্ধু গাছের ডালে-ডালে, দালানের ছাদে-ছাদে গিয়া কুঁচ-বরণ কন্যার পিছনে দাঁড়াইল। তখন কুঁচ-বরণ কন্যা বলিতেছিলেন,-

      “সোনার পাখী, ও রে শুক, মিছাই গেল
      রূপার বৈঠা হীরার হা’ল-কেউ না এল”!

রাজকন্যার খোঁপায় মোতির ফুল ছিল, বুদ্ধু আস্তে- মোতির ফুলটি উঠাইয়া লইল।

          তখন শুক বলিল,
      “কুঁচ-বরণ কন্যা মেঘ-বরণ চুল,
      কি হইল কন্যা, মোতির ফুল?”

রাজকন্যা খোঁপায় হাত দিয়া দেখিলেন, ফুল নাই। শুক বলিল,-
কলাবতী রাজকন্যা, চি’ন্ত না’ক আর,
মাথা তুলে’ চেয়ে দেখ, বর তোমার!”

কলাবতী, চমকিয়া পিছন ফিরিয়া দেখেন,- বানর! কলাবতীর মাথা হেঁট হইল। হাতের কাঁকণ ছুঁড়িয়া ফেলিয়া, মেঘ-বরণ চুলের বেণী এলাইয়া দিয়া, কলাবতী রাজকন্যা মাটিতে লুটাইয়া পড়িলেন।

কিন্তু, রাজকন্যা কি করিবেন? যখন পণ করিয়াছিলেন, যে, তিন বুড়ীর রাজ্য পার হইয়া, রাঙ্গা-নদীর জল পাড়ি দিয়া, কাঁথা-বুড়ীর, আর, অন্ধকুঠরীর হাত এড়াইয়া তাঁহার পুরীতে আসিয়া যে মোতির ফুল নিতে পারিবে, সে-ই তাঁহার স্বামী হইবে। তখন রাজকন্যা আর কি করেন?-উঠিয়া বানরের গলায় মালা দিলেন। তখন বুন্ধু হাসিয়া বলিল, “রাজকন্যা, এখন তুমি কা’র?”

রাজকন্যা বলিলেন,- “আগে ছিলাম বাপের-মায়ের, তা’র পরে ছিলাম আমার; এখন তোমার।”
বুদ্ধু বলিল,- “তবে আমার দাদাদিগে ছাড়িয়া দাও, আর তুমি আমার সঙ্গে আমার বাড়ীতে চল। মা’দের বড় কষ্ট, তুমি গেলে তাঁহাদের কষ্ট থাকিবে না।”

রাজকন্যা বলিলেন,- “এখন তুমি যাহা বলিবে, তাহাই করিব। তা চল;- কিন্তু তুমি আমাকে এমনি নিতে পারিবে না,-আমি এই কৌটার মধ্যে থাকি, তুমি কৌটায় করিয়া আমাকে লইয়া চল।”
বুদ্ধু বলিল,- “আচ্ছা।”
রাজকন্যা কৌটার ভিতর উঠিলেন।

অমনি শুকপাখী তাড়াতাড়ি গিয়া ঢোল-ডগরে ঘা দিল। দেখিতে দেখিতে রাজপুরীর মধ্যে এক প্রকাণ্ড হাট-বাজার বসিয়া গেল। রাজকন্যার কৌটা দোকানীর কৌটার সঙ্গে মিশিয়া গেল। বুদ্ধু দেখিল, এ তো বেশ্‌। সে ঢোল-ডগর লইয়া বাজাইতে আরম্ভ করিয়া দিল। ঢোল-ডগরের ডাহিনে ঘা দিলে হাট-বাজার বসে, বাঁয়ে ঘা দিলে হাট-বাজার ভাঙ্গিয়া যায়। বুদ্ধু চোখ বুজিয়া বসিয়া বসিয়া বাজাইতে লাগিল। দোকানীরা দোকান উঠাইতে-নামাইতে উঠাইতে নামাইতে একেবারে হয়রাণ হইয়া গেল, আর পারে না। তখন সকলে বলিল,- “রাখুন, রাখুন, রাজকন্যার কৌটা নেন; আমরা আর হাট করিতে চাহি না।”

বুদ্ধু ঢোল-ডগরের বাঁয়ে ঘা মারিল, হাট ভাঙিয়া গেল। কেবল রাজকন্যার কৌটাটি পড়িয়া রহিল। বুদ্ধু এবার আর কিন্তু ঢোলটি ছাড়িল না। ঢোলটি কাঁধে করিয়া কৌটার কাছে গিয়া ডাকিল,-

      “রাজকন্যা রাজকন্যা, ঘুমে আছ কি?
      বরে’ নিতে ঢোল-ডগর নিয়ে এসেছি।”

রাজকন্যা কৌটা হইতে বাহির হইয়া বলিলেন- “আমার বড় ক্ষুধা পাইয়াছে, গাছের-পাতার ফল আনিয়া দাও, খাইব।”

      বুদ্ধু বলিল,- “আচ্ছা।”

রাজকন্যা কৌটায় উঠিলেন। বুদ্ধু ঢোল কাঁধে কৌটা হাতে গাছের পাতার-ফল আনিতে চলিল। সেখানে গিয়া বুদ্ধু দেখিল, গাছের পাতায়-পাতায় কত রকম ফল ধরিয়া রহিয়াছে। দেখিয়া বুদ্ধুরও লোভ হইল! কিন্তু, ও বাবা। এক যে অজগর- গাছের গোড়ায় সোঁ সোঁ করিয়া ফোঁসাইতেছা!

বুদ্ধু তখন আস্তে আস্তে গাছের চারিদিকে ঘুরিয়া আসিয়া, এক দৌড় দিল। তাহার কোমরের সূতায় জড়াইয়া, অজগর, কাটিয়া দুইখান হইয়া গেল। তখন বুদ্ধু গাছে উঠিল, পাতার ফল পাড়িয়া, রাজকন্যাকে ডাকিল।

রাজকন্যা বলিলেন,- “আর না, সব হইয়াছে। …. এখন চল, তোমার বাড়ী যাইব!” বুদ্ধু বলিল,- “না সব হয় নাই; রাজপুত্রদাদাদিগে আর বুড়ীর কাঁথাটি লইতে হইবে।” রাজকন্যা বলিলেন, “লও।”

তখন পাঁচ রাজপুত্র মাল্লা, মাঝি, ময়ূরপঙ্খী, স-ব লইয়া, ঢোল-ডগর কাঁধে, কৌটা হাতে, মোতির ফুল কানে, বুড়ীর কাঁথা গায়ে বুদ্ধু গাছের-পাতার-ফল খাইতে-খাইতে কোমরের সূতায় টান দিল।

ভূতুম্‌ বুঝিল এইবার বুদ্ধু আসিতেছে। সে সূতা টানিয়া তুলিল। পাঁচ রাজপুত্র, সিপাই-লস্কর, মাল্লা-মাঝি, ময়ূরপঙ্খী, সব লইয়া বুদ্ধু ভাসিয়া উঠিল।

ভাসিয়া উঠিয়া মাল্লা-মাঝিরা, ‘সার্‌ সার্‌’ করিয়া পাল তুলিয়া দিল। বুদ্ধু গিয়া ময়ূরপঙ্খীর ছাদে বসিল, পেঁচা গিয়া ময়ূরপঙ্খীর মাস্তুলে বসিল। এবার সকলকে লইয়া ময়ূরপঙ্খী দেশে চলিল।

ছাদের উপর বুদ্ধু চোখ মিটি-মিটি করে আর মাঝে- মাঝে কৌটা খুলিয়া কাহার সঙ্গে যেন কথা হয়, হা’লের মাঝি, যে রাজপুত্রদিগে এই খবর দিল।

খবর পাইয়া তাহারা চুপ। ….রাত্রে সকলে ঘুমাইয়াছে, ভূতুম্‌ আর বুদ্ধু ও ঘুমাইতেছে; সেই সময়, রাজপুত্রেরা চুপি-চুপি আসিয়া কৌটাটি সরাইয়া লইয়া, ঢোল-ডগর শিয়রে, বুড়ীর কাঁথা-গায়ে বুদ্ধুকে ধাক্কা দিয়া জলে ফেলিয়া দিলেন। ভূতুম্‌, মাস্তুলে ছিল, তার বুকে তীর মারিলেন। বুদ্ধু, ভূতুম্‌, জলে পড়িয়া ভাসিয়া গেল। তখন কৌটা খুলিতেই, মেঘ-বরণ চুল কুঁচ-বরণ রাজকন্যা বাহির হইলেন। রাজপুত্রেরা বলিলেন,- “রাজকন্যা, এখন তুমি কা’র?” রাজকন্যা বলিলেন,- “ঢোল-ডগর যা’র।” শুনিয়া রাজপুত্রেরা বলিলেন,- “ও! তা’ বুঝিয়াছি!- রাজকন্যাকে আটক কর।” কি করিবেন? রাজকন্যা ময়ূরপঙ্খীর এক কুঠরীর মধ্যে আটক হইয়া রহিলেন।

১৩

রহিলেন-ময়ূরপঙ্খী আসিয়া ঘাটে লাগিল, আর রাজ্যময় সাজ সাজ পড়িয়া গেল। রাজা আসিলেন, রাণীরা আসিলেন, রাজ্যের সকলে নদীর ধারে আসিল।– মেঘ-বরণ চুল কুঁচ-বরণ কন্যা লইয়া রাজপুত্রেরা আসিয়াছেন। রাণীরা ধান-দূর্বা দিয়া, পঞ্চদীপ সাজাইয়া, শাঁখ শঙ্খ বাজাইয়া কলাবতী রাজকন্যাকে বরণ করিয়া ঘরে তুলিলেন।

রাজকন্যা বলিলেন,- “ঢোল-ডগর যা’র।”
“ঢোল-ডগর হীরারাজপুত্রের?”
“না।”
“ঢোল-ডগর মাণিকরাজপুত্রের?”
“না”
“ঢোল-ডগর মোতিরাজপুত্রের?”
“না”
“ঢোল-ডগর শঙ্খরাজপুত্রের?”
“না”
“ঢোল-ডগর কাঞ্চনরাজপুত্রের?”
“না।”

রাণীরা বলিলেন,- “তবে তোমাকে কাটিয়া ফেলিব।” রাজকন্যা বলিলেন, – “আমার একমাস ব্রত, একমাস পরে যাহা ইচ্ছা করিও।”

      তাহাই ঠিক হইল।

১৪

ভূতুমের মা, বুদ্ধুর মা, এতদিন কাঁদিয়া-কাঁদিয়া মর-মর। শেষে দুইজনে নদীর জলে ডুবিয়া মরিতে গেলেন। এমন সময় একদিক হইতে বুদ্ধু ডাকিল,- “মা!” আর একদিক হইতে ভূতুম্‌ ডাকিল,- “মা” দীন-দুঃখিনী দুই মায়ে ফিরিয়া চাহিয়া দেখেন,-

      বুকের ধন হারামণি বুদ্ধু আসিয়াছে!
      বুকের ধন হারামণি ভূতুম্‌ আসিয়াছে!

বুদ্ধুর মা, ভূতুমের মা, পাগলের মত হইয়া ছুটিয়া গিয়া দুইজনে দুইজনকে বুকে নিলেন। বুদ্ধু ভূতুমের চোখের জলে, তাঁহাদের চোখের জলে, পৃথিবী ভাসিয়া গেল।

      বুদ্ধু ভূতুম্‌ কুঁড়েয় গেল।

পরদিন, সেই যে ঢোল-ডগর ছিল? চিড়িয়াখানার বাঁদী, ঘুঁটে-কুড়ানী দাসীর কুঁড়ের কাছে, মস্ত হাট-বাজার বসিয়া গিয়াছে। দেখিয়া লোক অবাক হইয়া গেল।

তাহার পরদিন, চিড়িয়াখানার বাঁদী, ঘুঁটে-কুড়ানী দাসীর কুঁড়ের চারিদিকে গাছের পাতায় পাতায় ফল ধরিয়াছে! দেখিয়া লোকেরা আশ্চর্যান্বিত হইয়া গেল।

তাহার পরদিন, চিড়িয়াখানার বাঁদি, ঘুঁটে-কুড়ানী দাসীর কুঁড়ে ঘিরিয়া লক্ষ সিপাই পাহারা দিতেছে! দেখিয়া লোক সকল চমকিয়া গেল।

সেই খবর যে, রাজার কাছে গেল।

যাইতেই, সেইদিন কলাবতী রাজকন্যা বলিলেন,- “মহারাজ আমার ব্রতের দিন শেষ হইয়াছে; আমাকে মারিবেন, কি, কাটিবেন, কাটুন।” শুনিয়া রাজার চোখ ফুটিল।– রাজা সব বুঝিতে পারিলেন। বুঝিয়া রাজা বলিলেন, “মা, আমি সব বুঝিয়াছি। কে আমার আছ, ন-রাণীকে আর ছোটরাণীকে ডোল-ডগর বাজাইয়া ঘরে আন।”

অমনি রাজপুরীর যত ঢাক ঢোল বাজিয়া উঠিল। কলাবতী রাজকন্যা, নূতন-জলে স্নান, নূতন কাপড়ে পরণ, ব্রতের ধান-দূর্বা মাথায় গুঁজিয়া, দুই রাণীকে বরণ করিয়া আনিতে আপনি গেলেন।

শুনিয়া, পাঁচরাণী ঘরে গিয়া খিল দিলেন। পাঁচ রাজপুত্র ঘরে গিয়া কবাট দিলেন। লক্ষ সিপাই লইয়া, ঢোল-ডগর বাজাইয়া ন-রাণী ছোটরাণীকে নিয়া কলাবতী রাজকন্যা রাজপুরীতে ফিরিয়া আসিলেন। বুদ্ধু ভূতুম্‌ আসিয়া রাজাকে প্রণাম করিল।

পরদিন মহা ধুম-ধামে মেঘ-বরণ চুল কুঁচ-বরণ কলাবতী রাজকন্যার সঙ্গে বুদ্ধুর বিবাহ হইল। আর-একদেশের রাজকন্যা হীরাবতীর সঙ্গে ভূতুমের বিবাহ হইল।

পাঁচ রাণীরা আর খিল খুলিলেন না! পাঁচ রাজপুত্রেরা আর কবাট খুলিলেন না! রাজা পাঁচ রাণীর আর পাঁচ রাজপুত্রের ঘরের উপরে পাঁটা দিয়া, মাটি দিয়া, বুজাইয়া দিলেন।

ক’দিন যায়। একদিন রাত্রে, বুদ্ধুর ঘরে বুদ্ধু, ভূতুমের ঘরে ভূতুমের ঘরে ভূতুম্‌, কলাবতী রাজকন্যা হীরাবতী রাজকন্যা ঘুমে। খু-ব রাত্রে হীরাবতী কলাবতী উঠিয়া দেখেন,-একি! হীরাবতীর ঘরে তো সোয়ামী নাই! কলাবতীর ঘরেও তো সোয়ামী নাই!- কি হইল, কি হইল? দেখেন,- বিছানার উপরে এক বানরের ছাল, বিছানার উপরে এক পেঁচার পাখ!!

“অ্যাঁ-দ্যা‍খ্‌‍!- তবে তো এঁরা সত্যিকার বানর না, সত্যিকার পেঁচা না।” –দুই বোনে ভাবেন- নানান্‌ খানান্‌ ভাবিয়া শেষে উঁকি দিয়া দেখেন-দুই রাজপুত্র ঘোড়ায় চাপিয়া রাজপুরী পাহারা দেয়। রাজপুত্রেরা যে দেবতার পুত্রের মত সুন্দর!

তখন, দুই বোনে যুক্তি করিয়া তাড়াতাড়ি পেঁচার পাখ বানরের ছাল প্রদীপের আগুনে পোড়াইয়া ফেলিলেন। পোড়াতেই,- গন্ধ!

গন্ধ পাইয়া দুই রাজপুত্র ঘোড়া ফেলিয়া ছুটিয়া আসিলেন। ছুটিয়া আসিয়া দেবকুমার দুই রাজপুত্র বলেন,- “সর্বনাশ, সর্বনাশ! এ কি করিলে! – সন্ন্যাসীর মন্ত্র ছিল, ছদ্মবেশে থাকিতাম, দেবপুরে যাইতাম আসিতাম, রাজপুরে পাহারা দিতাম,- আর তো সে সব করিতে পারিব না!- এখন, আর তো আমরা বানর পেঁচা হইয়া থকিতে পারিব না!-কথা যে, প্রকাশ হইল!”

দুই রাজকন্যা ছিলেন থতমত, হাসিয়া বলিলেন, -“তা’র আর কি? তবে তো ভালোই, তবে তো বেশ হইল। ও মা তবে না-কি পেঁচা?-তবে না কি বানর?- আমরা কোথায় যাই!-”

দুই রাজকন্যার ঘরে, আর কি?- সুখের নিশি, সুখের হাট। তা’র পরদিন ভোরে উঠিয়া সকলে দেখে, দেবতার মত মূর্তি দুই সোনার চাঁদ রাজপুত্র রাজার দুই পাশে বসিয়া আছে! দেখিয়া সকল লোকে চমৎকার মানিল। কলাবতী রাজকন্যা বলিলেন,- “উনি বানরের ছাল গায়ে দিয়া থাকিতেন; কা’ল রাত্রে আমি তাহা পোড়াইয়া ফেলিয়াছি।”

আর-একদেশের রাজকন্যা হীরাবতী বলিলেন,- “উনি পেঁচার পাখ গায়ে দিয়া থাকিতেন, কা’ল আমি তাহা পোড়াইয়া ফেলিয়াছি।”

শুনিয়া সকলে ধন্য ধন্য করিল।
তা’রপর?- তা’রপর-

বুদ্ধুর নাম হইয়াছে-বধুকুমার,
ভূতুমের নাম হইয়াছে-রূপকুমার।
রাজ্যে আনন্দের জয়-জয়কার পড়িয়া গেল।

তাহার পর, ন-রাণী, ছোটরাণী, বুধকুমার, রূপকুমার আর কলাবতী রাজকন্যা, হীরাবতী রাজকন্যা, লইয়া, রাজা সুখে দিন কাটাইতে লাগিলেন।

ঘুমন্ত পুরী

এক দেশের এক রাজপুত্র। রাজপুত্রের রূপে রাজপুরী আলো। রাজপুত্রের গুণের কথা লোকের মুখে ধরে না।
একদিন রাজপুত্রের মনে হইল, দেশভ্রমণে যাইবেন। রাজ্যের লোকের মুখ ভার হইল, রাণী আহার-নিদ্রা ছাড়িলেন, কেবল রাজা বলিলেন,-“আচ্ছা, যাক্।”
তখন দেশের লোক দলে-দলে সাজিল,
রাজা চর-অনুচর দিলেন,
রাণী মণি-মাণিক্যের ডালা লইয়া আসিলেন।
রাজপুত্র লোকজন, মণি-মাণিক্য চর-অনুচর কিছুই সঙ্গে নিলেন না। নূতন পোশাক পরিয়া, নূতন তলোয়ার ঝুলাইয়া রাজপুত্র দেশভ্রমণে বাহির হইলেন।

যাইতে যাইতে যাইতে, কত দেশ, কত পর্বত, কত নদী, কত রাজার রাজ্য ছাড়াইয়া, রাজপুত্র এক বনের মধ্যে দিয়া উপস্থিত হইলেন “দেখিলেন, বনে পাখ-পাখালীর শব্দ নাই, বাঘ-ভালুকের সাড়া নাই!-রাজপুত্র চলিতে লাগিলেন।

চলিতে চলিতে, অনেক দূর গিয়া রাজপুত্র দেখিলেন, বনের মধ্যে এক যে রাজপুরী- রাজপুরীর সীমা। অমন রাজপুরী রাজপুত্র আর কখনও দেখেন নাই। দেখিয়া রাজপুত্র অবাক হইয়া রহিলেন।

রাজপুরীর ফটকের চূড়া আকাশে ঠেকিয়াছে। ফটকের দুয়ার বন জুড়িয়া আছে। কিন্তু ফটকের চূড়ায় বাদ্য বাজে না, ফটকের দুয়ারে দুয়ারী নাই।
রাজপুত্র আস্তে আস্তে রাজপুরীর মধ্যে গেলেন।
রাজপুরীর মধ্যে গিয়া দেখিলেন, পুরী যে পরিস্কার, যেন দুধে ধোয়া,-ধব্ ধব্ করিতেছে। কিন্তু এমন পুরীর মধ্যে জন-মানুষ নাই, কোন কিছুই সাড়া-শব্দ পাওয়া যায় না, পুরী নিভাজ, নিঝুম,-পাতাটি পড়ে না, কুটাটুকু নড়ে না।

রাজপুত্র আশ্চর্য হইয়া গেলেন।
রাজপুত্র এদিক দেখিলেন, ওদিক দেখিলেন পুরীর চারিদিকে দেখিতে লাগিলেন। এক জায়গায় গিয়া রাজপুত্র থমকিয়া গেলেন! দেখিলেন, মস্ত আঙ্গিনা, আঙ্গিনা জুড়িয়া হাতী, ঘোড়া, সেপাই, লস্কর, দুয়ারী, পাহারা, সৈন্য-সামন্ত সব সারি সারি দাঁড়াইয়া রহিয়াছে।

রাজপুত্র হাঁক দিলেন।
কেহ কথা কহিল না,
কেহ তাঁহার দিকে ফিরিয়া দেখিল না।
অবাক হইয়া রাজপুত্র কাছে গিয়া দেখিলেন, কাতারে কাতারে সিপাই, লস্কর, কাতারে কাতারে হাতী ঘোড়া সব পাথরের মূর্তি হইয়া রহিয়াছে। কাহারও চক্ষে পলক পড়ে না কাহারও গায়ে চুল নড়ে না। রাজপুত্র আশ্চর্য হইয়া দাঁড়াইয়া রহিলেন।

তখন রাজপুত্র পুরীর মধ্যে গেলেন।
এক কুঠরিতে গিয়া দেখিলেন, কুঠরির মধ্যে কত রকমের ঢাল তলোয়ার, তীর, ধনুক সব হাজারে হাজারে টানানো রহিয়াছে। পাহারারা পাথরের মূর্তি, সিপাইরা পাথরের মূর্তি। রাজপুত্র আপনার তলোয়ার খুলিয়া আস্তে আস্তে চলিয়া আসিলেন।

আর এক কুঠরিতে গিয়া দেখিলেন, মস্ত রাজদরবার, রাজদরবারে সোনার প্রদীপে ঘিয়ের বাতি জ্বল্ জ্বল্ করিতেছে, চারিদিকে মণি-মাণিক্য ঝক্‌ঝক্ করিতেছে। কিন্তু রাজসিংহাসনে রাজা, পাথরের মূর্তি, মন্ত্রীর আসনে মন্ত্রী পাথরের মূর্তি, পাত্র-মিত্র, ভাট বন্দী, সিপাই লস্কর যে যেখানে, সে সেখানে পাথরের মূর্তি। কাহারও চক্ষে পলক নাই, কাহারও মুখে কথা নাই।
রাজপুত্র দেখিলেন, রাজার মাথায় রাজছত্র হেলিয়া আছে, দাসীর হাতে চামর ঢুলিয়া আছে,-সাড়া নাই, শব্দ নাই, সব ঘুমে নিঝুম। রাজপুত্র মাথা নোয়াইয়া চলিয়া আসিলেন।

আর এক কুঠরীতে গিয়া দেখিলেন, যেন কত শত প্রদীপ একসঙ্গে জ্বলিতেছে -কত রকমের ধন-রত্ন, কত হীরা, কত মাণিক, কত মোতি, -কুঠরিতে আর ধরে না। রাজপুত্র কিছু ছুঁইলেন না; দেখিয়া আর এক কুঠরিতে চলিয়া গেলেন।

সে কুঠরিতে যাইতে-না-যাইতে হাজার হাজার ফুলের গন্ধে রাজপুত্র বিভোগ হইয়া উঠিলেন। কোথা হইতে এমন ফুলের গন্ধ আসে? রাজপুত্র কুঠরির মধ্যে গিয়া দেখিলেন, জল নাই টল নাই, কুঠরির মাঝখানে লাখে লাখে পদ্মফুল ফুটিয়া রহিয়াছে! পদ্মফুলের গন্ধে ঘর ম’-ম’ করিতেছে। রাজপুত্র ধীরে ধীরে ফুলবনের কাছে গেলেন।

ফুলবনের কাছে গিয়া রাজপুত্র দেখিলেন, ফুলের বনে সোনার খাট, সোনার খাটে হীরার ডাঁট, হীরার ডাঁটে ফুলের মালা দোলান রহিয়াছে; সেই মালার নিচে, হীরার নালে সোনার পদ্ম, সোনার পদ্মে এক পরমা সুন্দরী রাজকন্যা বিভোরে ঘুমাইতেছেন। ঘুমন্ত রাজকন্যার হাত দেখা যায় না, পা দেখা যায় না, কেবল চাঁদের কিরণ মুখখানি সোনার পদ্মের সোনার পাঁপ্‌ড়ির মধ্যে টুল্-টুল্ করিতেছে। রাজপুত্র ঝালর হীরার ডাঁটে ভর দিয়া, অবাক হইয়া দেখিতে লাগিলেন।

দেখিতে দেখিতে, দেখিতে, দেখিতে, কত বচ্ছর চলিয়া গেল। রাজকন্যার আর ঘুম ভাঙ্গে না, রাজপুত্রের চক্ষে আর পলক পড়ে না। রাজকন্যা অঘোরে ঘুমাইতেছেন রাজপুত্র বিভোর হইয়া দেখিতেছেন।
চাঁদের কিরণ মুখখানি সোনার পদ্মের সোনার পাপ্‌ড়ির মধ্যে টুল্‌টুল্ …রাজকন্যার আর ঘুম ভাঙ্গে না, রাজপুত্রের চক্ষে আর পলক পড়ে না।…

                                 *                                       *                                    *

হঠাৎ একদিন রাজপুত্র দেখিলেন, রাজকন্যার শিয়রে এক সোনার কাঠি! রাজপুত্র আস্তে আস্তে সোনার কাঠি তুলিয়া লইলেন।
সোনার কাঠি তুলিয়া লইতেই দেখিলেন, আর এক দিকে এক রূপার কাঠি। রাজপুত্র আশ্চর্য হইয়া রূপার কাঠিও তুলিয়া লইলেন্ দুই কাঠি হাতে লইয়া রাজপুত্র নাড়িয়া চাড়িয়া দেখিতে লাগিলেন।

দেখিতে দেখিতে, সোনার কাঠিটি কখন টুক করিয়া ঘুমন্ত রাজকন্যার মাথায় ছুঁইয়া গেল! অমনি পদ্মের বন ‘শিউরে’ উঠিল, সোনার খাট নড়িয়া উঠিল; সোনার পাঁপ্‌ড়ি ঝরিয়া পড়িল, রাজকন্যার হাত হইল; পা হইল; গায়ের আলস ভাঙ্গিয়া, চোখের পাতা কচ্‌লাইয়া ঘুমন্ত রাজকন্যা চমকিয়া উঠিয়া বসিলেন।

আর অমনি রাজপুরীর চারিদিকে পাখি ডাকিয়া উঠিল, দুয়ারে দুয়ারী আসিয়া হাঁক ছাড়িল, উঠাতে হাতী ঘোড়া ডাক ছাড়িল, সিপাই তরোয়াল ঝন্ ঝন্ করিয়া উঠিল; রাজদরবারে রাজা জাগিলেন, মন্ত্রী জাগিলেন, পাত্র জাগিলেন, পাত্র জাগিলেন- হাজার বচ্ছরের ঘুম হইতে, সে যেখানে ছিলেন, জাগিয়া উঠিলেন- লোক লস্কর, সিপাই পাহারা, সৈন্য সামন্ত তীর তরোয়াল লইয়া খাড়া হইল।
-সকলে অবাক হইয়া গেলেন-রাজপুরীতে কে আসিল।
রাজপুত্র। অবাক হইয়া গেলেন,
রাজকন্যা অবাক হইয়া চাহিয়া রহিলেন।

রাজা, মন্ত্রী জন-পরিজন সকলে আসিয়া দেখিলেন -রাজপুত্র রাজকন্যা মাথা নামাইলেন।
রাজপুরীর চারদিকে ঢাক-ঢোল, শানাই-নাকাড়া বাজিয়া উঠিল!
রাজা বলিলেন,-“তুমি কোন দেশের ভাগ্যবান রাজার রাজপুত্র, আমাদিগে মরণ-ঘুমের হাত হইতে রক্ষা করিয়াছে!”
জন-পরিজনেরা বলিল,-“আহা। আপনি কোন্ দেবতা-রাজার দেব রাজপুত্র- এক দৈত্য রূপার কাঠি ছোঁয়াইয়া আমাদের গম্‌গমা সোনার রাজ্যে ঘুম পাড়াইয়া রাখিয়াছিল, -আপনি আসিয়া আমাদিগে জাগাইয়া রক্ষা করিলেন।
রাজপুত্র মাথা নোয়াইয়া চুপ করিয়া রহিলেন।
রাজা বলিলেন,-“আমার কি আছে, কি দিব? এই রাজকন্যা তোমার হাতে দিলাম, এই রাজত্ব তোমাকে দিলাম।”
চারিদিকে ফুল-বৃষ্টি, চারিদিকে চন্দন-বৃষ্টি; ফুল ফোটে, খৈ ছোটে, -রাজপুরীর হাজার ঢালে ‘ডুম-ডুম’ কাটি পড়িল।
তখন, শতে শতে বাঁদী দাসী বাট্না বাটে, হাজারে হাজের দাই দাসী কুট্না কোটে;

                   দুয়ারে দুয়ারে মঙ্গল ঘড়া
                   পাঁচ পল্লব ফুলের তোড়া;
                 আল্পনা বিলিপনা, এয়োর ঝাঁক,
              পাঠ-পিঁড়ি আসনে ঘিরে', বেজে ওঠে শাঁখ।

সে কি শোভা!-রাজপুরীর চার-চত্বর দল‌্‌দল্ ঝল্‌মল্। আঙ্গিনায় আঙ্গিনায় হুলুধ্বনি, রাজভাণ্ডারে ছড়াছড়ি; জনজনতার হুড়াহুড়ি, -এতদিনের ঘুমন্ত রাজপুরী দাপে কাঁপে, আনন্দে তোল্‌-পাড়্।
তাহার পর, ফুটফুটে’ চাঁদের আলোয় আগুন-পুরুতে সম্মুখে, গুয়াপান, রাজ-রাজত্ব যৌতুক দিয়া, রাজা পঞ্চরত্ন মুকুট পরাইয়া রাজপুত্রের সঙ্গে রাজকন্যার বিবাহ দিলেন। চারিদিকে জয়ধ্বনি উঠিল।

এক বছর, দু’বছর, বছরের পর বছর কত বছর গেল, -দেশভ্রমণে গিয়েছেন, রাজপুত্র আজও ফিরেন না। কাঁদিয়া কাঁদিয়া, মাথা খুঁড়িয়া রাণী বিছানা নিয়াছেন। ভাবিয়া ভাবিয়া চোখের জল ফেলিতে ফেলিতে রাজা অন্ধ হইয়াছেন। রাজ্য অন্ধকার, রাজ্যে হাহাকার।
একদিন ভোর হইতে-না-হইতে রাজদুয়ারে ঢাক-ঢোল বাজিয়া উঠিল, হাতী ঘোড়া সিপাই সান্ত্রীর হাঁকে দুয়ার কাঁপিয়া উঠিল।

রাণী বলিলেন,-“কি, কি?”
রাজা বলিলেন,-“কে, কে?”

রাজ্যের প্রজারা ছুটিয়া আসিল। রাজপুত্র- রাজকন্যা বিবাহ করিয়া লইয়া ফিরিয়া আসিয়াছেন!!
কাঁপিতে কাঁপিতে রাজা আসিয়া রাজপুত্রকে বুকে লইলেন। পড়িতে-পড়িতে রাণী আসিয়া রাজকন্যাকে বরণ করিয়া নিলেন।
প্রজারা আনন্দধ্বনি করিয়া উঠিল।

রাজপুত্র রাজার চোখে সোনার কাঠি ছোঁয়াইলেন, রাজার চোখ ভাল হইল। ছেলেকে পাইয়া, ছেলের বউ দেখিয়া রাণীর অসুখ সারিয়া গেল।
তখন, রাজপুত্র লইয়া ঘুমন্ত পুরীর রাজকন্যা লইয়া, রাজা-রাণী সুখে রাজত্ব করিতে লাগিলেন।

কাঁকনমালা, কাঞ্চনমালা

এক রাজপুত্র আর এক রাখাল, দুইজনে বন্ধু। রাজপুত্র প্রতিজ্ঞা করিলেন, যখন তিনি রাজা হইবেন, রাখাল বন্ধুকে তাঁহার মন্ত্রী করিবেন।
রাখাল বলিল,-আচ্ছা।”
দুইজনে মনের সুখে থাকেন। রাখাল মাঠে গরু চরাইয়া আসে, দুই বন্ধুতে গলাগলি হইয়া গাছতলে বসেন। রাখাল বাঁশি বাজায়, রাজপুত্র শোনেন। এইরূপে দিন যায়।

রাজপুত্র রাজা হইলেন। রাজা রাজপুত্রের কাঞ্চনমালা রাণী, ভাণ্ডার ভরা মানিক, -কোথাকার রাখাল, সে আবার বন্ধু! রাজপুত্রের রাখালের কথা মনেই রহিল না।
একদিন রাখাল আসিয়া রাজদুয়ারে ধর্ণা দিল-“বন্ধু রাণী কেমন, দেখাইল না।” দুয়ারী তাঁহাকে “দূর, দূর” করিয়া খেদাইয়া দিল। মনের কষ্টে রাখাল কোথায় গেল, কেহই জানিল না।

পরদিন ঘুম হইতে উঠিয়া রাজা চোখ মেলিতে পারেন না। কি হইল, কি হইল?
-রাণী দেখেন, সকলে দেখে, রাজার মুখ-ময় সূঁচ,-মাথার চুল পর্যন্ত সুচ হইয়া গিয়াছে,-এ কি হইল!-রাজপুরীতে কান্নাকাটি পড়িল।
রাজ খাইতে পারেন না, শুইতে পারেন না, কথা কহিতে পারেন না। রাজা মনে মনে বুঝিলেন, রাখাল-বন্ধুর কাছে প্রতিজ্ঞা করিয়া প্রতিজ্ঞা ভাঙ্গিয়াছি, সেই পাপে এ দশা হইল। কিন্তু মনের কথা কাহাকেও বলিতে পারেন না।
সূঁচরাজার রাজসংসার অচল হইল,-সূঁচরাজা মনের দুঃখে মাথা নামাইয়া বসিয়া থাকেন; রাণী কাঞ্চনমালা দুঃখে-কষ্টে কোন রকমে রাজত্ব চালাইতে লাগিলেন।

একদিন রাণী নদীর ঘাটে স্নান করিতে গিয়াছেন, কাহার এক পরমাসুন্দরী মেয়ে আসিয়া বলিল,-“রাণী যদি দাসী কিনেন, তো, আমি দাসী হইব।” রাণী বলিলেন-“সূঁচরাজার সূঁচ খুলিয়া দিতে পার তো আমি দাসী কিনি।”
দাসী স্বীকার করিল।
তখণ রাণী হাতের কাঁকন দিয়া দাসী কিনিলেন।
দাসী বলিল,-“রাণী মা, তুমি বড় কাহিল হইয়াছ; কতদিন না-জানি ভাল করিয়া খাও না, নাও না। গায়ের গহনা ঢিলা হইয়াছে, মাথার চুল জটা দিয়াছে। তুমি গহনা খুলিয়া রাখ, বেশ করিয়া ক্ষার-খৈল দিয়া স্নান করাইয়া দেই।”
রাণী বলিলেন,”না মা, কি আর স্নান করিব,-থাক।”
দাসী তাহা শুনিল না;-“মা, এখন ডুব দাও।”
রাণী গলা-জলে নামিয়া ডুব দিলেন। দাসী চক্ষের পলকে রাণীর কাপড় পরিয়া, রাণীর গহনা গায়ে দিয়া ঘাটের উপর উঠিয়া ডাকিল-

                                       "দাসী লো দাসী পান্ কৌ।
                                         ঘাটের উপর রাঙ্গা বৌ!
                                        রাজার রাণী কাঁকনমালা;-
                                        ডুব দিবি আর কত বেলা?"

রাণী ডুব দিয়া দেখিলেন, দাসী রাণী হইয়াছে, তিনি বাঁদী হইয়াছেন। রাণী কপালে চড় মারিয়া, ভিজা চুলে কাঁপিতে কাঁপিতে কাঁকনমালার সঙ্গে চলিলেন।

রাজপুরীতে গিয়া কাঁকনমালা পুরী মাথায় করিল। মন্ত্রীকে বলে,-“আমি নাইয়া আসিতেছি, হাতি ঘোড়া সাজাও নাই কেন?” পাত্রকে বলে,-“আমি নাইয়া আসিব, দোল-চৌদোলা পাঠাও নাই কেন?” মন্ত্রীর, পাত্রের গর্দান গেল।
সকলে চমকিল, এ আবার কি!-ভয়ে কেহ কিছু বলিতে পারিল না। কাঁকনমালা রাণী হইয়া বসিল, কাঞ্চনমালা দাসী হইয়া রহিলেন! রাজা কিছুই জানিতে পারিলেন না।

কাঞ্চনমালা আঁস্তাকুড়ে বসিয়া মাছ কোটেন আর কাঁদেন,-
“হাতের কাঁকন দিয়া কিনলাম দাসী,
সেই হইল রাণী, আমি হইলাম বাঁদী।
কি বা পাপে সোনার রাজার রাজ্য গেল ছার
কি বা পাপে ভাঙ্গিল কপাল কাঞ্চনমালার?”

রাণী কাঁদেন আর চোখের জলে ভাসেন।
রাজার কষ্টের সীমা নাই। গায়ে মাছি ভিনভিন্ সূঁচের জ্বালায় গা-মুখ চিন্‌চিন্, কে বাতাস করে, কে বা ওষুধ দেয়!

একদিন ক্ষার-কাপড় ধুইতে কাঞ্চনমালা নদীর ঘাটে গিয়াছেন। দেখিলেন, একজন মানুষ একরাশ সুতা লইয়া গাছতলায় বসিয়া বসিয়া বলিতেছে,-
“পাই এক হাজার সূঁচ,
তবে খাই তরমুজ!
সূঁচ পেতাম পাঁচ হাজার,
তবে যেতাম হাট-বাজার!
যদি পাই লাখ-
তবে দেই রাজ্যপাট!!”
রাণী, শুনিয়া আস্তে আস্তে গিয়া বলিলেন, “কে বাছা সূঁচ চাও, আমি দিতে পারি! তা সূঁচ কি তুমি তুলিতে পারিবে?”
শুনিয়া, মানুষটা চুপ-চাপ সুতার পুঁটলি তুলিয়া রাণীর সঙ্গে চলিল।

পথে যাইতে যাইতে কাঞ্চনমালা, মানুষটির কাছে আপনার দুঃখের কথা সব বলিলেন। শুনিয়া, মানুষ বলিল,-“আচ্ছা!”
রাজপুরীতে গিয়া মানুষ রাণীকে বলিল,-“রাণীমা, রাণীমা, আজ পিট-কুডুলির ব্রত, রাজ্যে পিটা বিলাইতে হয়। আমি লালসুতা নীলসুতা রাঙাইয়া দি, আপনি গে’ আঙ্গিনায় আল্পনা দিয়া পিঁড়ি সাজাইয়া দেন; ও দাসী মানুষ যোগাড়-যাগাড় দিক?”
রাণী আহলাদে আটখানা হইয়া বলিলেন,-“তা’ কেন, হইল- হইল দাসী, দাসীও আজ পিঠা করুক।” তখন রাণী আর দাসী দুইজনেই পিঠা করিতে গেলেন।
ও মা! রাণী যে, পিঠা করিলেন,-আস্কে পিটা, চাস্কে পিটা আর ঘাস্কে পিটা! দাসী, -চন্দ্রপুরী, মোহনবাঁশি, ক্ষীরমুরলী, চন্দনপাতা এই সব পিঠা করিয়াছেন।
মানুষ বুঝিল যে, কে রাণী কে দাসী।
পিঠে-সিটে করিয়া, দুইজনে আলপনা দিতে গেলেন। রাণী, একমন চাঁল বাটিয়া সাত কলস জলে শুলিয়া এ-ই এক গোছা শনের নুড়ি ডুবাইয়া, সারা আঙ্গিনা লেপিতে বসিলেন। এখানে এক খাবল দেন, ওখানে এক খাবল দেন।
দাসী আঙ্গিনার এক কোণে একটু ঝাড়-ঝুড় দিয়া পরিস্কার করিয়া একটু চালের গুঁড়ায় খানিকটা জল মিশাইয়া, এতটুকু নেকড়া ভিজাইয়া, আস্তে আস্তে পদ্ম-লতা আঁকিলেন, পদ্ম-লতার পাশে সোনার সাত কলস আঁকিলেন; কলসের উপর চুড়া, দুই দিকে ধানের ছড়া আঁকিয়া, ময়ূর, পুতুল, মা লক্ষ্মীর সোনা পায়ের দাগ, এই সব আঁকিয়া দিলেন।
তখন মানুষ কাঁকনমালাকে ডাকিয়া বলিল,-“ও বাঁদি! এই মুখে রাণী হইয়াছিস?
হাতে কাঁকনের নাগন্ দাসী!
সেই হইল রাণী, রাণী হইলেন দাসী!
ভাল চাহিস তো, স্বরূপ কথা-কে।”
কাঁকনমালার গায়ে আগুনে হল্কা পড়িল। কাঁকনমালা গর্জিয়া উঠিয়া বলিল,-“কে রে পোড়ারমুখো দূর হ’বি তো হ’।”
জল্লাদকে ডাকিয়া বলিল,-“দাসীর আর ঐ নির্বংশে’র গর্দান নাও; ওদের রক্ত দিয়া আমি স্নান করিব, তবে আমার নাম কাঁকনমালা।”
জল্লাদ গিয়া দাসী আর মানুষকে ধরিল। তখন মানুষটা পুঁটলী খুরিয়া বলিল,-
“সুতন সুতন নট্‌খটি!
রাজার রাজ্যে ঘট্‌মটি
সুতন সুতন নেবোর পো,
জল্লাদকে বেঁধে থো।”
এক গোছা সূতা গিয়া জল্লাদকে আষ্টে-পৃষ্ঠে বাঁধিয়া থুইল।
মানুষটা আবার বলিল,-“সুতন্ তুমি কার?-
সুতা বলিল,-“পুঁটলী যার তার।”
মানুষ বলিল,-“যদি সুতন্ আমার খাও।
কাঁকনমালার নাকে যাও।”
সুতোর দুই গুটি গিয়া কাঁকনমালার নাকে ঢিবি হইয়া বসিল। কাঁকনমালা ব্যস্তে, মস্তে ঘরে উঠিয়া বলিতে লাগিল,-“দুঁয়ার দাঁও, দুঁয়ার দাঁও, এঁটা পাঁগন, দাসী পাঁগন নিয়া আঁসিয়াছে।”
পাগল তখন মন্ত্র পড়িতেছে-
“সুতন্ সুতন্ সরুলি, কোন্ দেশে ঘর?
সূঁচ রাজার সূঁচে গিয়ে আপনি পর।”
দেখিতে-না-দেখিতে হিল্ হিল্ করিয়া লাখ সুতা রাজার গায়ের লাখ সূঁচে পারিয়া গেল।
তখন সূঁচেরা বলিল,-
“সুতার পরাণ সীলি সীলি, কোন ফুড়ন দি।”

মানুষ বলিল,-
“নাগন্ দাসী কাঁকনমালার চোখ-মুখটি।”

রাজার গায়ের লাখ সূঁচ উঠিয়া গেল, লাখ সূঁচে কাঁকনমালার চোখ-মুখ সিলাই করিয়া রহিল। কাঁকনমালার যে ছট্ফটি!
রাজা চক্ষু চাহিয়া দেখেন,-রাখাল বন্ধু!
রাজায় রাখালে কোলাকুলি করিলেন। রাজার চোখের জলে রাখাল ভাসিল, রাখালের চোখের জলে রাজ্য ভাসিলেন।

রাজা বলিলেন,-“বন্ধু আমার দোষ দিও না, শত জন্ম তপস্যা করিয়াও তোমার মত বন্ধু পাইব না। আজ হইতে তুমি আমার মন্ত্রী। তোমাকে ছাড়িয়া আমি কত কষ্ট পাইলাম;-আর ছাড়িব না।”
রাখাল বলিল,-“আচ্ছা! তা তোমার সেই বাঁশিটি যে হারাইয়া ফেলিয়াছি; একটি বাঁশি দিতে হইবে!’
রাজা রাখাল-বন্ধুকে সোনার বাঁশি তৈয়ারী করাইয়া দিলেন। তাহার পর সূঁচের জ্বালায় দিন-রাত ছট্ফট্ করিয়া কাঁকনমালা মরিয়া গেল!
কাঞ্চনমালা দুঃখ ঘুচিল।
তখন রাখাল সারাদিন মন্ত্রীর কাজ করেন, রাত্রে চাঁদের আলোতে আকাশ ভরিয়া গেলে, রাজাকে লইয়া গিয়া নদীর সেই গাছের তলায় বসিয়া বাঁশি বাজান। রাজা গলাগলি করিয়া মন্ত্রী-বন্ধুর বাঁশি শোনেন। রাজা, রাখাল আর কাঞ্চনমালার সুখে দিন যাইতে লাগিল।

সাত ভাই চম্পা

এক রাজার সাত রাণী। দেমাকে, বড়রাণীদের মাটিতে পা পড়ে না। ছোটরাণী খুব শান্ত। এজন্য রাজা ছোটরাণীকে সকলের চাইতে বেশি ভালবাসিতেন।
কিন্তু, অনেক দিন পর্যন্ত রাজার ছেলেমেয়ে হয় না। এত বড় রাজ্য, কে ভোগ করিবে? রাজা মনের দুঃখে থাকেন।

এইরূপে দিন যায়। কতদিন পরে, -ছোটরাণীর ছেলে হইবে। রাজার মনে আনন্দ ধরে না; পাইক-পিয়াদা ডাকিয়া, রাজা রাজ্য ঘোষণা করিয়া দিলেন,-রাজা রাজভণ্ডার খুলিয়া দিয়াছেন, মিঠা-মণ্ডা মণি-মাণিক যে যত পার নিয়া যায়।
বড়রাণীরা হিংসায় জ্বলিয়া মরিতে লাগিল।
রাজা আপনার কোমরে, ছোটরাণীর কোমরে, এক সোনার শিকল বাঁধিয়া দিয়া বলিলেন-“যখন ছেলে হইবে, এই শিকলে নাড়া দিও, আমি আসিয়া, ছেলে দেখিব!” বলিয়া রাজা, রাজ-দরবারে গেলেন।
ছোটরাণীর ছেলে হইবে, আঁতুড়ঘরে কে যাইবে? বড়রাণীরা বলিলেন,-“আহা, ছোটরাণীর ছেলে হইবে, তা অন্য লোক দিব কেন? আমরাই যাইব।”
বড়রাণীরা আঁতুড়ঘরে গিয়াই শিকলে নাড়া দিলেন। অমনি রাজসভা ভাঙ্গিয়া, ঢাক-ঢোলের বাদ্য দিয়া, মণি-মাণিক হাতে ঠাকুর-পুরুত সাথে, রাজা আসিয়া দেখিলেন,-কিছুই না!
রাজা ফিরিয়া গেলেন।
রাজা সভায় বসিতে-না-বসিতে আবার শিকলে নাড়া পড়িল।

রাজা আবার ছুটিয়া গেলেন। দিয়া দেখিলেন, এবারও কিছুই না। মনের কষ্টে রাজা রাগ করিয়া বলিলেন,-“ছেলে না হইতে আবার শিকল নাড়া দিলে, আমি সব রাণীকে কাটিয়া ফেলিব।” বলিয়া রাজা চলিয়া গেলেন।
একে একে ছোটরাণীর সাতটি ছেলেও একটি মেয়ে হইল। আহা, ছেলে-মেয়েগুলো যে…চাঁদের পুতুল…ফুলের কলি। আঁকুপাঁকু করিয়া হাত নাড়ে, পা নাড়ে,-আঁতুড়ঘরে আলো হইয়া গেল।
ছোটরাণী আস্তে আস্তে বলিলেন,-“দিদি, কি ছেলে হইল একবার দেখাইলি না!”
বড়রাণীরা ছোটরাণীর মুখের কাছে রঙ্গ-ভঙ্গী করিয়া হাত নাড়িয়া, নখ নাড়িয়া বলিয়া উঠিল,-“ছেলে না, হাতী হইয়াছে,-ওঁর আবার ছেলে হইবে!-কটা ইঁদুর আর কটা কাঁকড়া হইয়াছে।”
শুনিয়া ছোটরাণী অজ্ঞান পড়িয়া রহিলেন।
নিষ্ঠুর বড়রাণীরা আর শিকলে নাড়া দিল না। চুপি-চুপি হাঁড়ি-সরা আনিয়া ছেলেমেয়েগুলোকে তাহাতে পুরিয়া, পাঁশ-হাদার পুঁতিয়া ফেলিয়া আসিল। তাহার পর শিকল ধরিয়া টান দিল।

রাজা আবার ঢাক-ঢোলের বাদ্য দিয়া, মণি-মাণিক হাতে ঠাকুর-পুরুত নিয়া আসিলেন; বড়রাণীরা হাত মুছিয়া, মুখ মুছিয়া তাড়াতাড়ি করিয়া কতকগুলো ব্যাঙের ছানা, ইঁদুরের ছানা আনিয়া দেখাইল।
দেখিয়া রাজা আগুন হইয়া ছোটরাণীকে রাজপুরীর বাহির করিয়া দিলেন।
বড়রাণীদের মুখে আর হাসি ধরে না,-পায়ের মলের বাজনা থামে না। সুখের কাঁটা দূর হইল; রাজপুরীতে আগুন দিয়া ঝগড়া-কোন্দল সৃষ্টি করিয়া ছয় রাণীকে মনে সুখে ঘরকান্না করিতে লাগিলেন।
পোড়াকপালী ছোটরাণীর দুঃখে গাছ-পাথর ফাটে, নদীনালা শুকায়-ছোটরাণী দাসী হইয়া পথে পথে ঘুরিতে লাগিলেন।

এম্‌নি করিয়া দিন যায়। রাজার মনে সুখ নাই, রাজার রাজ্যে সুখ নাই,-রাজপুরী খাঁ-খাঁ করে, রাজার বাগানে ফুল ফোটে না,-রাজার পূজা হয় না।
একদিন মালী আসিয়া বলিল-“মহারাজ, নিত্য পূজার ফুল পাই না, আজ যে, পাঁশগাদার উপরে, সাত চাঁপা এক পারুল গাছে, টুলটুল সাত চাঁপা আর এক পারুল ফুটিয়াছে।
রাজা বলিলেন,-“তবে সেই আন, পূজা করিব।”
মালী ফুল আনিতে গেল।
মালীকে দেখিয়া পারুলগাছে পারুলফুল চাঁপাফুলদিগে ডাকিয়া বলিল,-
“সাত ভাই চম্পা জাগ রে!”
অমনি সাত চাঁপা নড়িয়া উঠিয়া সাড়া দিল,-
“কেন বোন, পারুল ডাক রে।”
পারুল বলিল,-
“রাজার মালী এসেছে,
পূজার ফুল দিবে কি না দিবে?”
সাত চাঁপা তুর্‌তুর্ করিয়া উঠিয়া গিয়া ঘাড় নাড়িয়া বলিতে লাগিল,-
“না দিব, না দিব ফুল উঠিব শতেক দূর,
আগে আসুক রাজা, তবে দিব ফুল!”
দেখিয়া শুনিয়া মালী অবাক হইয়া গেল। ফুরের সাজি ফেলিয়া, দৌড়িয়া গিয়া রাজার কাছে খবর দিল।
আশ্চর্য হইয়া, রাজা ও রাজসভার সকলে সেইখানে আসিলেন।

রাজা আসিয়া ফুল তুলিতে গেলেন, অমনি পারুল ফুল চাঁপা-ফুলদিগকে ডাকিয়া বলিল,-
“সাত ভাই চম্পা জাগ রে!”
চাঁপারা উত্তর দিল,-
“কেন বোন্ পারুল ডাক রে?”
পারুল বলিল,-
“রাজা আপনি এসেছেন,
ফুল দিবে কি না দিবে?
চাঁপারা বলিল,-
“না দিব, না দিব ফুল, উঠিব শতেক দূর,
আগে আসুক রাজার বড় রাণী
তবে দিব ফুল।”
বলিয়া, চাঁপাফুলেরা আরও উঁচুতে উঠিল।

রাজা বড়রাণীকে ডাকাইলেন। বড়রাণী মল বাজাইতে বাজাইতে আসিয়া ফুল তুলিয়া গেল। চাঁপাফুলেরা বলিল,-
“না দিব, না দিব ফুল, উঠিব শতেক দূর,
আগে আসুক রাজার মেজরাণী, তবে দিব ফুল।”
তাহার পর মেজরাণী আসিলেন, সেজরাণী আসিলেন, নরাণী আসিলেন, কনেরাণী আসিলেন, কেহই ফুল পাইলেন না। ফুলেরা গিয়া আকাশে তারার মত ফুটিয়া রহিল।

রাজা গালে হাত দিয়া মাটিতে বসিয়া পড়িলেন।
শেষে দুয়োরাণী আসিলেন; তখন ফুলেরা বলিল,-
“না দিব, না দিব ফুল, উঠিব শতেক দূরে,
যদি আসে রাজার ঘুঁটে-কুড়ানী দাসী,
তবে দিব ফুল।”

তখন খোঁজ-খোঁজ পড়িয়া গেল। রাজা চৌদোলা পাঠাইয়া দিলেন, পাইক বেহারারা চৌদোলা লইয়া মাঠে গিয়া ঘুটে-কুড়ানী দাসী ছোটরাণীকে লইয়া আসিল।
ছোটরাণীর হাতে পায়ে গোবর, পরনে ছেড়া কাপড়, তাই লইয়া তিনি ফুল তুলিতে গেলেন। অমনি সুরসুর করিয়া চাঁপারা আকাশ হইতে নামিয়া আসিল, পারুল ফুলটি গিয়া তাদের সঙ্গে মিশিল; ফুলের মধ্য হইতে সুন্দর সুন্দর চাঁদের মত সাত রাজপুত্র ও এক রাজকন্যা “মা মা” বলিয়া ডাকিয়া, ঝুপ্ ঝুপ্ করিয়া ঘুঁটে-কুড়ানী দাসী ছোটরাণীর কোলে-কাঁখে ঝাঁপাইয়া পড়িল।

সকলে অবাক্! রাজার চোখ দিয়া ঝর‌্ঝর্ করিয়া জল গড়াইয়া গেল। বড়রাণীরা ভয়ে কাঁপিতে লাগিল।
রাজা তখনি বড়রাণীদিগে হেঁটে কাঁটা উপরে কাঁটা দিয়া পুঁতিয়া ফেলিতে আজ্ঞা দিয়া, সাত-রাজপুত্র, পারুল, মেয়ে আর ছোটরাণীকে লইয়া রাজপুরীতে গেলেন।
রাজপুরীতে জয়ডঙ্কা বাজিয়া উঠিল।

শীত বসন্ত

এক রাজার দুই রাণী, সুয়োরাণী আর দুয়োরাণী। সুয়োরাণী যে, নুনটুকু ঊন হইতেই নখের আগায় আঁচড় কাটিয়া, ঘর-কান্নায় ভাগ বাঁটিয়া সতীনকে একপাশ করিয়া দেয়। দুঃখে দুয়োরাণীর দিন কাটে।

সুয়োরাণীর ছেলে-পিলে হয় না। দুয়োরাণীর দুই ছেলে, -শীত আর বসন্ত। আহা, ছেলে নিয়া দুয়োরাণীর যে যন্ত্রণা! -রাজার রাজপুত্র, সৎমায়ের গঞ্জনা খাইতে-খাইতে দিন যায়!

একদিন নদীর ঘাটে স্নান করিতে গিয়া সুয়োরাণী দুয়োরাণীকে ডাকিয়া বলিল-“আয় তো, তোর মাথায় ক্ষার খৈল দিয়া দি।” ক্ষার খৈল দিতে-দিতে সুয়োরাণী চুপ করিয়া দুয়োরাণীর মাথায় এক ওষুধের বড়ি টিপিয়া দিল। দুঃখিনী দুয়োরাণী টিয়া হইয়া “টি, টি” করিতে-করিতে উড়িয়া গেল।
বাড়ি আসিয়া সুয়োরাণী বলিল,-“দুয়োরাণী তো জলে ডুবিয়া মরিয়াছে।
রাজা তাহাই বিশ্বাস করিলেন।
রাজপুরীর লক্ষ্মী গেল, রাজপুরী আঁধার হইল; মা-হারা শীত-বসন্তের দুঃখের সীমা রহিল না।
টিয়া হইয়া দুঃখিনী দুয়োরাণী উড়তে উড়তে আর এক রাজার রাজ্যে গিয়া পড়িলেন। রাজা দেখিলেন, সোনার টিয়া। রাজার এক টুকটুকে মেয়ে, সেই মেয়ে বলিল,-“বাবা, আমি সোনার টিয়া নিব।”
টিয়া, দুয়োরাণী রাজকন্যার কাছে সোনার পিঞ্জরে রহিলেন।

দিন যায়, বছর যায়, সুয়োরাণীর তিন ছেলে হইল। ও মা! এক-এক ছেলে যে, বাঁশের পাতা-পাট-কাটি, ফুঁ দিলে উড়ে, ছুঁইতে গেলে মরে। সুয়োরাণী কাঁদিয়া কাটিয়া রাজ্য ভাসাইল।

পাট-কাটি তিন ছেলে নিয়া সুয়োরাণী গুম্‌রে গুম্‌রে আগুনে পুড়িয়া ঘর করে। মন ভরা জ্বালা, পেট ভরা হিংসা,-আপনার ছেলেদের থালে পাঁচ পরমান্ন অষ্টরন্ধন, ঘিয়ে চপ্ চপ্ পঞ্চব্যঞ্জন সাজাইয়া দেন; শীত-বসন্তের পাতে আলুন আতেল কড়কড়া ভাত সড়সড়া চাল শাকের উপর ছাইয়ের তাল ফেলিয়া দিয়া চলিয়া যান।

সতীন তো ‘উরী পুরী দক্ষিণ-দু’রী,’-সতীনের ছেলে দুইটা যে, নাদুস্-নুদুস্-আর তাঁহার তিন ছেলে পাট কাটি! হিংসায় রাণীর মুখে অন্ন রুচে না, নিশিতে নিদ্রা হয় না।

রাণী তে-পথের ধূলা এলাইয়া, তিন কোণের কুটা জ্বালাইয়া, বাসি উননের ছাই দিয়া, ভাঙ্গা-কুলায় করিয়া সতীনের ছেলের নামে ভাসাইয়া দিল।
কিছুতেই কিছু হইল না।
রণমূর্তি সৎ-মা গালি-মন্দ দিয়া খেদাইয়া দিল
শেষে একদিন শীত-বসন্ত পাঠশালায় গিয়াছে; কিছুই জানে না, শোনে না, বাড়িতে আসিতেই রণমূর্তি সৎমা তাহাদিগে গালিমন্দ দিয়া খেদাইয়া দিল!
তাহার পর রাণী, বাঁশ-পাতা ছেলে তিনটাকে আছাড় মারিয়া থুইয়া, উথাল পাতাল করিয়া এ জিনিস ভাঙ্গে ও জিনিস চুরে; আপন মাথার চুল ছিঁড়ে, গায়ের আভরণ ছুঁড়িয়া মারে।
দাসী, বাঁদী গিয়া রাজাকে খবর দিল!
‘সুয়োরাণীর ডরে
থর্ থর্ করে-

রাজা আসিয়া বলিলেন,-“এ কি।”
রাণী বলিল,-“কি! সতীনের ছেলে, সেই আমাকে গা’লমন্দ দিল। শীত-বসন্তের রক্ত নহিলে আমি নাইব না!”
অমনি রাজা জল্লাদকে ডাকিয়া আজ্ঞা দিলেন,-“শীত-বসন্তকে কাটিয়া রাণীকে রক্ত আনিয়া দাও।”
শীত-বসন্তের চোখের জল কে দেখে! জল্লাদ শীত-বসন্তকে বাঁধিয়া নিয়া গেল।

এক বনের মধ্যে আনিয়া জল্লাদ, শীত-বসন্তের রাজ-পোশাক খুলিয়া, বাকল পরাইয়া দিল।
শীত বলিলেন,-“ভাই, কপালে এই ছিল!”
বসন্ত বলিলেন,-“দাদা, আমরা কোথায় যাব?”
কাঁদিতে কাঁদিতে শীত বলিলেন,-“ভাই চল, এতদিন পরে আমরা মা’র কাছে যাব।”

খড়গ নামাইয়া রাখিয়া দুই রাজপুত্রের বাঁধন খুলিয়া দিয়া, ছলছল চোখে জল্লাদ বলিল,-“রাজপুত্র! রাজার আজ্ঞা, কি করিব- কোলে-কাঁখে করিয়া মানুষ করিয়াছি, সেই সোনার অঙ্গে আজ কি না খড়গ ছোঁয়াইতে হইবে! -আমি তা’ পারিব না রাজপুত্র।-আমার কপালে যা’ থাকে থাকুক, এ বাকল চাদর পরিয়া বনের পথে চলিয়া যাও, কেহ আর রাজপুত্র বলিয়া চিনিতে পারিবে না।”
বলিয়া, শীত-বসন্তকে পথ দেখাইয়া দিয়া, শিয়াল-কুকুর কাটিয়া জল্লাদ রক্ত নিয়া রাণীকে দিল।
রাণী সেই রক্ত দিয়া স্নান করিলেন; খিল-খিল করিয়া হাসিয়া আপনার তিন ছেলে কোলে, পাঁচ পাত সাজাইয়া খাইতে বসিলেন।

শীত-বসন্ত দুই ভাই চলেন, বন আর ফুরায় না। শেষে, দুই ভাইয়ে এক গাছের তলায় বসিলেন।
বসন্ত বলিলেন,-“দাদা, বড় তৃষ্ণা পাইয়াছে, জল কোথায় পাই?”
শীত বলিলে,-“ভাই, এত পথ আসিলাম জল তো কোথাও দেখিলাম না! আচ্ছা, তুমি বস আমি জল দেখিয়া আসি।”
বসন্ত বসিয়া রহিল, শীত জল আনিতে গেলেন।

যাইতে যাইতে, অনেক দূরে গিয়া, শীত বনের মধ্যে এক সরোবর দেখিতে পাইলেন। জলের তৃষ্ণায় বসন্ত না-জানি কেমন করিতেছে, -কিন্তু কিসে করিয়া জল নিবেন? তখন গায়ের যে চাদর, সেই চাদর খুলিয়া শীত সরোবরে নামিলেন।
সেই দেশের যে রাজা, তিনি মারা গিয়াছেন। রাজার ছেলে নাই, পুত্র নাই, রাজসিংহাসন খালি পড়িয়া আছে। রাজ্যের লোকজনের শ্বেত রাজহাতীর পিঠে পাটসিংহাসন উঠাইয়া দিয়া হাতী ছাড়িয়া দিল। হাতী যাহার কপালে রাজটিকা দেখিবে, তাহাকেই রাজসিংহাসনে উঠায়াই দিয়া আসিবে, সে-ই রাজ্যের রাজা হইবে।

রাজসিংহাসন পিঠে শ্বেত রাজহাতী পৃথিবী ঘুরিয়া কাহারও কপালে রাজটিকা দেখিল না। শেষে ছুটিতে যে বনে শীত-বসন্ত, সেই বনে, আসিয়া দেখে, এক রাজপুত্র গায়ের চাদর ভিজাইয়া সরোবরে জল নিতেছে। -রাজপুত্রের কপালে রাজটিকা। দেখিয়া, শ্বেত রাজহাতী অমনি গুঁড়ে বাড়াইয়া শীতকে ধরিয়া সিংহাসনে তুলিয়া নিল।”
“ভাই বসন্ত, ভাই বসন্ত,” করিয়া শীত কত কাঁদিলেন। হাতী কি তাহা মানে? বন-জঙ্গল ভাঙ্গিয়া, পাট-হাতী শীতকে পিঠে করিয়া ছুটিয়া গেল।

জল আনিতে গেল, দাদা আর ফিরলি না। বসন্ত উঠিয়া সকল বন খুঁজিয়া, “দাদা, দাদা” বলিয়া ডাকিয়া খুন হইল। দাদাকে যে হাতীতে নিয়াছে বসন্ত তো তাহা জানে না; বসন্ত কাঁদিয়া কাঁদিয়া সারা হইল। শেষে, দিন গেল, বিকাল গেল, সন্ধ্যা গেল, রাত্রি হইল; তৃষ্ণায় ক্ষুধায় অস্থির হইয়া দাদাকে হারাইয়া কাঁদিয়া কাঁদিয়া বসন্ত এক গাছের তলায় ধুলা-মাটিতে শুইয়া ঘুমাইয়া পড়িল।

দুঃখিনী মায়ের বুকের মাণিক ছাই-পাঁশে গড়াগড়ি গেল!
খুব ভোরে এক মুনি, জপ-তপ করিবেন, জল আনিতে সরোবরে যাইতে, দেখেন, কোন এক পরম সুন্দর রাজপুত্র গাছের তলায় ধুলা-মাটিতে পড়িয়া আছে। দেখিয়া মুনি বসন্তকে বুকে করিয়া তুলিয়া নিয়া গেলেন।

শ্বেত রাজহাতীর পিঠে শীত তো সেই নাই-রাজার রাজ্যে গেলেন! যাইতেই রাজ্যের যত লোক আসিয়া মাটিতে মাথা ছোঁলাইয়া মন্ত্রী, অমাত্য, সিপাই-সান্ত্রীরা সকলে আসিয়া মাথা নোয়াইল, সকলে রাজসিংহাসনে তুলিয়া নিয়া শীতকে রাজা করিল।
প্রাণের ভাই বসন্ত, সেই বসন্ত বা কোথায়, শীত বা কোথায়! দুঃখিনী মায়ের দুই মাণিক বোঁটা ছিঁড়িয়া দুই খানে পড়িল।
রাজা হইয়া শীত, ধন-রত্ন মণি-মাণিক্য, হাতী-ঘোড়া, সিপাই-লস্কর লইয়া রাজত্ব করিতে লাগিলেন। আজ এ-রাজাকে হারাইয়া দিয়া তাহার রাজ্য নেন, কাল ও-রাজাকে হারাইয়া দিয়া তাহার রাজ্য আনেন, আজ মৃগয়া করেন, কাল দিগি¦জয়ে যান, এই রকমে দিন যায়!

মুনির কাছে আসিয়া বসন্ত গাছের ফল খায়, সরোবরের জল নায়, দায়, থাকে। মুনি চারিপাশে আগুন করিয়া বসিয়া থাকেন, কতদিন কাঠ-কুটা ফুড়াইয়া যায়, -বসন্তের পরনে বাকল, হাতে নড়ি, বনে বনে ঘুরিয়া কাঠ-কুটা কুড়াইয়া মুনির জন্য বহিয়া আনে।
তাহার পর বসন্ত বনের ফুল তুলিয়া মুনির কুটির সাজায় আর সারাদিন ভরিয়া ফুলের মধু খায়।
তাহার পর, সন্ধ্যা হইতে-না হইতে, বনের পাখি সব একখানে হয়, কত মন্ত্রের এইসব শোনে। এইভাবে দিন যায়।
রাজসিংহাসনে শীত আপন রাজ্য লইয়া, বনের বসন্ত আপন বন লইয়া;-দিনে দিনে পলে পলে কাহারও কথা কাহারও মনে থাকিল না।

তিন রাত যাইতে-না-যাইতে সুয়োরাণীর পাপে রাজার সিংহাসন কাঁপিয়া উঠিল; দিন যাইতে-না-যাইতে রাজার রাজ্য গেল। রাজপাট গেল। সকল হারাইয়া, খোয়াইয়া, রাজা আর সুয়োরাণীর মুখ দেখিলেন না; রাজা বনবাসে গেলেন।

সুয়োরাণীর যে, সাজা! ছেলে তিনটা সঙ্গে, এক নেকড়া পরনে এক নেকড়া গায়ে, এ দুয়ারে যায়-“দূর, দূর!” ও দূয়ারে যায়-“ছেই, ছেই!!” তিন ছেলে নিয়া সুয়োরাণী চক্ষের জলে ভাসিয়া পথে পথে ঘুরিতে লাগিলেন।

ঘুরিতে ঘুরিতে সুয়োরাণী সমুদ্রের কিনারা গেলেন। -আর সাত সমুদ্রের ঢেউ আসিয়া চক্ষেরে পলকে সুয়োরাণীর তিন ছেলেকে ভাসাইয়া নিয়া গেল। সুয়োরাণী কাঁদিয়া আকাশ ফাটাইল; বুকে চাপড়, কপালে চাপড় দিয়া, শোকে দুঃখে পাগল হইয়া মাথায় পাষাণ মারিয়া, সুয়োরাণী সকল জ্বালা এড়াইল। সুয়োরাণীর জন্য পিঁপ্‌ড়াটিও কাঁদিল না, কুটাটুকুও নড়িল না; -সাত সমুদ্রের জল সাত দিনের পথে সরিয়া গেল। কোথায় বা সুয়োরাণী, কোথায় বা তিন ছেলে-কোথাও কিছু রহিল না।

সেই যে সোনার টিয়া-সেই যে রাজার মেয়ে? সেই রাজকন্যার যে স্বয়ম্বর। কত ধন, কত দৌলত, কত কি লইয়া কত দেশের রাজপুত্র আসিয়াছেন। সভা করিয়া সকলে বসিয়া আছেন, এখনো রাজকন্যার বা’র নাই।
রূপবতী রাজকন্যা আপন ঘরে সিঁথিপাটি কাটিয়া, আল্‌তা কাজল পরিয়া, সোনার টিয়াকে ডাকিয়া জিঞ্জাসা করিলেন,-
“সোনার টিয়া, বল্ তো আমার আর কি চাই?”
টিয়া বলিল,-
“সাজতো ভাল কন্যা, যদি সোনার নূপুর পাই।”
রাজকন্যা কৌটা খুলিয়া সোনার নূপুর বাহির করিয়া পায়ে দিলেন। সোনার নূপুর রাজকন্যার পায়ে রুনুঝনু করিয়া বাজিয়া উঠিল!
রাজকন্যা বলিলেন,-
“সোনার টিয়া, বল্ তো আমার আর কি চাই।”
টিয়া বলিল,-
“সাজতো ভাল কন্যা, যদি; ময়ূরপেখম পাই!”
রাজকন্যা পেটরা আনিয়া ময়ূরপেখম শাড়ি খুলিয়া পরিলেন। শাড়ির রঙে ঘর উজল শাড়ির শোভায় রাজকন্যার মত উত্তল। মুখখানা ভার করিয়া টিয়া বলিল,-
“রাজকন্যা, রাজকন্যা, কিসের গরব কর;-
শতেক নহর হীরার হার গলায় না পর।”
রাজকন্যা শতেক নহর হীরার হার গলায় দিলেন। শতেক নহরের শতেক হীরা ঝক্-ঝক্ করিয়া উঠিল।
টিয়া বলিল,-
“শতেক নহর ছাই!
নাকে ফুল কানে দুল
সিঁথির মাণিক চাই!”
রাজকন্যা নাকে মোতির ফুলের নোলক পরিলেন; সিঁথিতে মণি-মাণিক্যের সিঁথি পরিলেন।
তখন রাজকন্যার টিয়া বলিল,-
“রাজকন্যা রূপবতী নাম থুয়েছে মায়।
গজমোতি হত শোভা ষোল-কলায়।
না আনিল গজমোতি, কেমন এল বর?
রাজকন্যা রূপবতী ছাইয়ের স্বয়ম্বর!”

শুনিয়া, রূপবতী রাজকন্যা গায়ের আভরণ, পায়ের নূপুর, ময়ূরপেখম, কানের দুল ছুঁড়িয়া, ছিঁড়িয়া, মাটিতে লুটাইয়া পড়িলেন। কিসের স্বয়ম্বর, কিসের কি!
‘সোনার টিয়া, বল্ তো আমার আর কি চাই’
রাজপুত্রদের সভায় খবর গেল, রাজকন্যা রূপবতী স্বয়ম্বর করিবেন না; রাজকন্যার পণ, যে রাজপুত্র গজমোতি আনিয়া দিতে পারিবেন, রাজকন্যা তাঁহার হইবেন -না পারিলে রাজকন্যার নফর থাকিতে হইবে।
সকল রাজপুত্র গজমোতির সন্ধানে বাহির হইলেন।
কত রাজ্যের কত হাতী আসিল, কত হাতীর মাথা কাটা গেল- যে-সে হাতীতে কি গজমোতি থাকে? গজমোতি পাওয়া গেল না।
রাজপুত্রেরা শুনিলেন.
সমুদ্রের কিনারে হাতী,
তাহার মাথায় গজমোতি।
সকল রাজপুত্রে মিলিয়া সমুদ্রের ধারে গেলেন।
সমুদ্রের ধারে যাইতে-না-যাইতেই একপাল হাতী আসিয়া অনেক রাজপুত্রকে মারিয়া ফেলিল, অনেক রাজপুত্রের হাত গেল, পা গেল।
গজমোতি কি মানুষে আনিতে পারে? রাজপুত্রেরা পলাইয়া আসিলেন।
আসিয়া রাজপুত্রেরা কি করেন-রূপবতী রাজকন্যা নফল হইয়া রহিলেন।
কথা শীতরাজার কাণে গেল। শীত বলিলেন,-“কি! রাজকন্যার এত তেজ, রাজপুত্রদিগকে নফর করিয়া রাখে। রাজকন্যার রাজ্য আটক কর।”
রাজকন্যা শীতরাজার হাতে আটক হইয়া রহিলেন।

আজ যায় কাল যায়, বসন্ত মুনির বনে থাকেন। পৃথিবীর খবর বসন্তের কাছে যায় না, বসন্তের খবর পৃথিবী পায় না।
মুনির পাতার কুঁড়ে; পাতার কুঁড়েতে একশুক আর এক সারা থাকে।
একদিন শুক কয়,-
“সারি, সারি! বড় শীত!”
সারী বলে,-
“গায়ের বসন টেনে দিস্।

শুক বলে,-
“বসন গেল ছিঁড়ে, শীত গেল দুরে,
কোনখানে, সারি, নদীর কূল?”
সারি উত্তর করিল,-
“দুধ-মুকুট ধবল পাহাড় ক্ষীর-সাগরের পাড়ে,
গজমোতরি রাঙা আলো ঝর্‌ঝরিয়ে পড়ে।
আলো তলে পদ্ম-রাতে খেলে দুধের জল,
হাজার হাজার ফুটে আছে সোনা-র কমল।”

শুক কহিল,-
“সেই সোনার কমল, সেই গজমোতি
কে আনবে তুলে’ কে পারে রূপবতী!

শুনিয়া বসন্ত বলিলেন,-
শুক সারী মেসো মাসী
কি বল্‌ছিস্ বল্,
আমি আনবো গজমোতি
সোনার কমল।”

শুক সারী বলিল,-“আহা বাছা, পারিবি?”
বসন্ত বলিলেন,-“পারিব না তো কি!”
শুক বলিল,- “তবে, মুনির কাছে গিয়া ত্রিশূলটা চা!”
মুকুট আছে, তাই নিয়া যা।”

বসন্ত মুনির কাছে গেল। গিয়া বলিল,-“বাবা, আমি গজমোতির আর সোনার কমল আনিব, ত্রিশূলটা দাও।”
মুনির ত্রিশূল দিলেন।

মুনির পায়ে প্রণাম করিয়া, ত্রিশূল হাতে বসন্ত শিমুল গাছের কাছে গেলেন। গিয়া দেখিল, শিমুল গাছে কাপড়-চোপড়, শিমুল গাছে রাজমুকুট। বসন্ত বলিলেন,-“হে বৃক্ষ, যদি সত্যকারের বৃক্ষ হও, তোমার কাপড়-চোপড় আর তোমার রাজমুকুট আমাকে দাও।”

বৃক্ষ বসন্তকে কাপড়-চোপড় আর রাজমুকুট দিল। বসন্ত বাকল ছাড়িয়া কাপড়-চোপড় পরিলেন; রাজমুকুট মাথায় দিয়া, বসন্ত ক্ষীর-সাগরের উদ্দেশে চলিতে লাগিলেন।

যাইতে যাইতে বসন্ত কত পর্বত কত বন, কত দেশ-বিদেশ ছাড়াইয়া বার বছর তের দিনে ‘দুধ-মুকুটে’ ধবল পাহাড়ের কাছে গিয়া পৌঁছিলেন। ধবল পাহাড়ের মাথায দুধের সব থক্ থক্ ধবল পাহাড়ের গায়ে দুধের ঝর্ ঝর্ ; বসন্ত সেই পাহাড়ে উঠিলেন।

উঠিয়া দেখিলেন, ধবল পাহাড়ের নিচে ক্ষীরের সাগর-
ক্ষীর-সাগরে ক্ষীরের ঢেউ ঢল্ ঢল্ করে-
লক্ষ হাজার পদ্ম ফুল ফুটে আছে থরে।
ঢেউ থই থই সোনার কমল, তারি মাঝে কি?-
দুধের বরণ হাতীর মাথে-গজমোতি।

বসন্ত দেখিলেন, চারিদিকে পদ্মফুলের মধ্যে দুধবরণ হাতী দুধের জল ছিটাইয়া খেলা করিতেছে- সেই হাতীর মাথায় গজমোতি। -সোনার মতন মণির মতন, হীরার মতন গজমোতির জ্বল্‌জ্বলে আলো ঝর্ ঝর্ করিয়া পড়িতেছে। গজমোতির আলোতে ক্ষীর-সাগরে হাজার চাঁদের মেলা, পদ্মের বনে পাতে পাতে সোনার কিরণ খেলা। দেখিয়া, বসন্ত অবাক হইয়া দাঁড়াইয়া রহিলেন।
তখন, বসন্ত কাপড়-চোপড় কষিয়া, হাতের ত্রিশূল আঁটিয়া ধবল পাহাড়ের উপর হইতে ঝাঁপ দিয়া গজমোতির উপরে পড়িলেন।
অমনি ক্ষীর-সাগর শুকাইয়া গেল, পদ্মের বন শুকাইয়া গেল; দুধ-বরণ হাতী এক সোনার পদ্ম হইয়া জিজ্ঞাসা করিল,-
“কোন্ দেশের রাজপুত্র কোন্ দেশে ঘর?”

বসন্ত বলিলেন,-“বনে বনে বাস, আমি মুনির কোঙর।”
পদ্ম বলিল,-“মাথে রাখ গজমোতি, সোনার কমল বুকে,
রাজকন্যা রূপবতী ঘর করুক সুখে!”

বসন্ত সোনার পদ্ম তুলিয়া বুকে রাখিলেন, গজমোতি, গজমোতি তুলিয়া মাথায় রাখিলেন। রাখিয়া,ক্ষীর-সাগরের বালুর উপর দিয়া বসন্ত দেশে চলিলেন।
অমনি ক্ষীর-সাগরের বালুর তলে কাহারা বলিয়া উঠিল,-“ভাই, ভাই! আমাদিগে নিয়া যায়।”
বসন্ত ত্রিশূল দিয়া বালু খুঁড়িয়া দেখিলেন, তিনটি সোনার মাছ! সোনার মাছ তিনটি লইয়া বসন্ত চলিতে লাগিলেন।
বসন্ত যেখান দিয়া যান, গজমোতির আলোতে দেশ উজ্জ্বল হইয়া ওঠে। লোকেরা বলে,-“দেখ, দেখ, দেবতা যায়।”
বসন্ত চলিতে লাগিলেন।

১০

শীত রাজা মৃগয়ায় বাহির হইয়াছেন। সকল রাজ্যের বন খুঁড়িয়া, একটা হরিণ যে, তাহাও পাওয়া গেল না। শীত সৈন্য-সামন্তের হাতেঘোড়া দিয়া এক গাছতলায় আসিয়া বসিলেন।

গাছতলায় বসিতেই শীতের গায়ে কাঁটা দিল। শীত দেখিলেন, এই তো সেই গাছ! এই গাছের তলায় জল্লাদের কাছ হইতে বনবাসী দুই ভাই আসিয়া বসিয়াছিলেন, ভাই বসন্ত জল চাহিয়াছিল, শীত জল আনিতে গিয়াছিলেন। সব কথা শীতের মনে হইল,-রাজমুকুট ফেলিয়া দিয়া, খাপ তরোয়াল ছুঁড়িয়া দিয়া, শীত, “ভাই বসন্ত!” “ভাই বসন্ত!” করিয়া ধুলার লুটাইয়া কাঁদিতে লাগিলেন।

সৈন্য-সামন্তেরা দেখিয়া অবাক! তাহারা দোল চৌদোল আনিয়া রাজাকে তুলিয়া রাজ্যে লইয়া গেল।

১১

গজমোতির আলোতে দেশ উজ্জ্বল করিতে করিতে বসন্ত রূপবতী রাজকন্যার দেশে আসিলেন।
রাজ্যের লোক ছুটিয়া আসিল,-“দেখ, দেখ, কে আসিয়াছেন!’
বসন্ত বলিলেন,-“আমি বসন্ত, ‘গজমোতি’ আনিয়াছি।”
রাজ্যের লোক কাঁদিয়া বলিল,-“এক দেশের শীত রাজা রাজকন্যাকে আটক করিয়া রাখিয়াছেন।
শুনিয়া, বসন্ত শীত রাজার রাজ্যের গিয়া, তিনি সোনার মাছ রাজাকে পাঠাইয়া দিয়া বলিলেন-“রূপবতী রাজকন্যার রাজ্যে দুয়ার খুলিয়া দিতে আজ্ঞা হউক!”

সকলে বলিলেন-“দেবতা, গজমোতি আনিয়াছেন। তা, রাজা আমাদের ভাইয়ের শোকে পাগল; সাত দিন সাত রাত্রি না গেলে তো দুয়ার খুলিবে না।” ত্রিশূল হাতে, গজমোতি মাথায় বসন্ত, দুয়ার আলো করিয়া সাত দিন সাত রাত্রি বসিয়া রহিলেন।
আট দিনের দিন রাজা একটু ভাল হইয়াছেন, দাসী গিয়া সোনার মাছ কুটিতে বসিল। অমনি মাছেরা বলিল,-
আশে শাই, চোখে ছাই,
কেটো না কেটো না মাসি, রাজা মোদের ভাই!”
দাসী ভয়ে বটী-মটি ফেলিয়া, রাজা কাছে গিয়া খবর দিল।
রাজা বলিলেন,-“কৈ কৈ! সোনার মাছ কৈ?
সোনার মাছ যে এনেছে সে মানুষ কৈ?”
রাজা সোনার মাছ নিয়া পড়িতে পড়িতে ছুটিয়া বসন্তের কাছে গেলেন। দেখিয়া বসন্ত বলিলেন,-“দাদা!
শীত বলিলেন,-“ভাই!”
হাত হইতে সোনার মাছ পড়িয়া গেল; শীত, বসন্তের গলা ধরিয়া কাঁদিতে লাগিলেন। দুই ভাইয়ের চোখের জল দর দর করিয়া বহিয়া গেল।

শীত বলিলেন,-“ভাই সুয়ো-মার জন্যে দুই ভাইয়ের এতকাল ছাড়াছাড়ি।”-তিনটি সোনার মাছ তিন রাজপুত্র হইয়া, শীত বসন্তের পায়ে প্রণাম করিয়া বলিল,-“দাদা, আমরাই অভাগী সুয়োরাণীর তিন ছেলে; আমাদের মুখ চাহিয়া মায়ের অপরাধ ভুলিয়া যান।”
শীত বসন্ত, তিন ভাইকে বুকে লইয়া বলিলেন,-“সে কি ভাই, তোমরা এমন হইয়া ছিলে! সুয়ো-মা কেমন, বাবা কেমন?”
তিন ভাই বলিল,-“সে কথা আর কি বলিব, -বাবা বনবাসে, মা মরিয়া গিয়াছেন; আমরা তিন ভাই ক্ষীর-সমুদ্রের তলে সোনার মাছ হইয়া ছিলাম।”
শুনিয়া শীত-বসন্তের বুক ফাটিল; চোখের জলে ভাসিতে ভাসিতে গলাগলি পাঁচ ভাই রাজপুরী গেলেন।

১২

রাজকন্যার সোনার টিয়া পিঞ্জরে ঘোরে, ঘোরে আর কেবলি কয়-
“দুখিনীর ধন
সাত সমুদ্র ছেঁচে’ এনেছে মাণিক রতন!”

রাজকন্যা বলিলেন,-“কি হয়েছে, কি হয়েছে আমার সোনার টিয়া!”
টিয়া বলিল-“যাদু আমার এল, কন্যা গজমোতি নিয়া!”
সত্য সত্যই; দাসী আসিয়া খবর দিল, শীত রাজার ভাই রাজপুত্র যে, গজমোতি আনিয়াছেন।
শুনিয়া রাজকন্যা রূপবতী হাসিয়া টিয়ার ঠোঁটে চুমু খাইলেন। রাজকন্যা বলিলেন,-“দাসী লো দাসী, কপিলা গাইয়ের দুধ আন্, কাঁচা হলুদ বাটিয়া আন্; আমার সোনার টিয়াকে নাওয়াইয়া দিব!”
দাসীকে দুধ-হলুদ আনিয়া দিল। রাজকন্যা সোনা রূপার পিঁড়ী, পাট কাপড়ের গামছা নিয়া টিয়াকে স্নান করাইতে বসিলেন।

হলুদ দিয়া নাওয়াইতে-নাওয়াইতে রাজকন্যার আঙ্গুলে লাগিয়া টিয়ার মাথার ওষুধ বড়ি খসিয়া পড়িল।-অমনি চারিদিকে আলো হইল, টিয়ার অঙ্গ ছাড়িয়া দুয়োরাণী দুয়োরাণী হইলেন।

মানুষ হইয়া দুয়োরাণী রাজকন্যাকে বুকে সাপটিয়া বলিলেন,-“রূপবতী মা আমার! তোরি জন্যে আমার জীবন পাইলাম।” থতমত খাইয়া রাজকন্যা রাণীর কোলে মাথা গুঁজিলেন।
রাজকন্যা বলিলেন,-“মা, আমার বড় ভয় করে, তুমি পরী, না দেবতা, এতদিন টিয়া হইয়া আমার কাছে ছিলে?”
রাণী বলিলেন,-“রাজকন্যা, শীত আমার ছেলে, গজমোতি যে আনিয়াছে, সেই বসন্ত আমার ছেলে।”
শুনিয়া রাজকন্যা মাথা নামাইল।

১৩

পরদিন রূপবতী রাজকন্যা শীত রাজাকে বলিয়া পাঠাইলেন,-“দুয়ার খুলিয়া দিন, গজমোতি যিনি আনিয়াছেন তাঁহাকে গিয়া বরণ করিব।
রাজা দুয়ার খুলিয়া দিলেন।
বাদ্য-ভান্ড করিয়া রূপবতী রাজকন্যার পঞ্চ চৌদোলা শীত রাজার রাজ্যে পৌঁছিল। শীত রাজার রাজদুয়ারে ডঙ্কা বাজিল, রাজপুরীতে নিশান উড়িল,-রূপবতী রাজকন্যা বসন্তকে বরণ করিলেন।

শীত বলিলেন,-“ভাই আমি তোমাকে পাইয়াছি, রাজ্য নিয়া কি করিব? রাজ্য তোমাকে দিলাম।” রাজপোশাক পরিয়া সোনার থালে গজমোতি রাখিয়া, বসন্ত, শীত, সকলে রাজসভায় বসিলেন। রাজকন্যার চৌদোলা আসিল। চৌদোলায় রঙ্ বেরঙের আঁকন, ময়ূরপাখার ঢাকন। ঢাকন খুলিতেই সকলে দেখে, ভিতরে, এক যে স্বর্গের দেবী, রাজকন্যা রূপবতীকে কোলে করিয়া বসিয়া আছেন!
রম্‌রমা সভা চুপ করিয়া গেল!
স্বর্গের দেবীর চোখে জল ছল্-ছল্, রাজকন্যাকে চুমু খাইয়া চোকের জলে ভাসিয়া স্বর্গের দেবী ডাকিলেন,-“আমার শীত বসন্ত কৈ রে!”
রাজসিংহাসন ফেলিয়া শীত উঠিয়া দেখিলেন, -মা! বসন্ত উঠিয়া দেখিলেন, -মা! সুয়োরাণীর ছেলেরা দেখিলেন, -এই তাঁহাদের দুয়ো-মা! সকলে পড়িতে পড়িতে জুটিয়া আসিলেন।
তখন রাজপুরীর সকলে একদিকে চোখের জল মোছে, আর একদিকে পুরী জুড়িয়া বাদ্য বাজে।

শীত বসন্ত বলিলেন,-“আহা, এ সময় বাবা আসিতেন, সুয়ো-মা থাকিতেন!” সুয়ো-মা মরিয়া গিয়াছে, সুয়ো-মা আর আসিল না; সকল কথা শুনিয়া বনবাস ছাড়িয়া রাজা আসিয়া শীত বসন্তকে বুকে লইলেন।

তখন রাজার রাজ্য ফিরিয়া আসিল, সকল রাজ্য এক হইল, পুরী আলো করিয়া রাজকন্যার গলায় গজমোতি ঝল্‌মল্ করিয়া জ্বলিতে লাগিল। দুঃখিনী দুয়োরাণীর দুঃখ ঘুচিল। রাজা, দুয়োরাণী, শীত, বসন্ত, সুয়োরাণী তিন ছেলে, রূপবতী রাজকন্যা-সকলে সুখে দিন কাটাইতে লাগিলেন।

No comments