লোকটা – আশিস সান্যাল

লোকটা – আশিস সান্যাল

লোকটাকে দেখলে সত্যি করুণা হয়। সব সময় কেমন যেন একটা মনমরা ভাব। কারও সঙ্গে কখনও মন খুলে কথা বলে না। কাজের ফাঁকে সময় পেলেই চুপচাপ বসে বসে কি যেন ভাবে। এ নিয়ে কম বিদ্রূপ আর গালিগালাজ সইতে হয় না।

কাজ করে লোকটা একটা দর্জির দোকানে। মেয়েদের ব্লাউস সেলাই করাই তার কাজ। কোনটা আটত্রিশ আর ছত্রিশ, এই হিসেবের মধ্যেই তার সময় বাঁধা। মাঝে মাঝে আবার আটত্রিশ সাইজের ব্লাউস ছত্রিশ আবার ছত্রিশকে আটত্রিশ করবার ঝামেলাও এসে পড়ে। দোকানের মালিক এসব কাজ তাকেই দেয় বেশি। তার কাজ নাকি সবচেয়ে ভালো। কিন্তু এসব ছত্রিশ আটত্রিশের মাঝে হাঁপিয়ে ওঠে সে। মাঝে মাঝে ভাবে, এসব মেয়েগুলো কোথা থেকে আসে? নিজের বউটা কিছুতে তেত্রিশের উপর উঠলো না।

মালিক যতক্ষণ থাকে, ততক্ষণ একটুও চুপ করে বসে থাকবার উপায় নেই। দুপুরে মালিক যখন খেতে যায় বাড়িতে, তখন যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে সে। একটা পুরানো খাতা বের করে আনমনে কি সব পড়ে। আবার মাঝে মাঝে পেন্সিল দিয়ে লেখে কিসব হিজিবিজি। মালিক আসবার আগেই সব গুটিয়ে রেখে দেয়।

শনি আর রবিবার এলেই লোকটার মন কেমন যেন ছটফট করে ওঠে। ও দুদিন কিছুতেই তাকে আটকানো যায় না। চলে যায় ক্যানিংয়ে মাতলা নদীর পাড়ে। সেখানে কে যেন আছে তার। মাতলার মাতাল ঢেউ আর লোনা বাতাসে ওর বুকটা নাকি জুড়িয়ে যায়। যাদু আছে মাতলার ঢেউ আর বাতাসে।

দুদিন কাটিয়ে যখন বাড়ি ফিরে আসে, তখন এক হুলুস্থুল ব্যাপার। গিন্নি ঝাটা নিয়ে সাদর সম্বর্ধনা জানিয়ে খেকিয়ে ওঠে।

এলেন বাবু রাজ্যজয় করে। আসার কি দরকার ছিলো। পিরিতের লোকটার সঙ্গে থাকলেই হতো।

কোনও উত্তর দেয়না লোকটা। চুপচাপ ঘরে গিয়ে ওঠে। তারপর ভাগ্য ভালো থাকলে দু মুঠো খেয়ে চলে যায় কাজে। আর যদি ভাগ্য প্রসন্ন না হয় তো, না খেয়েই চলে যায় সেদিন। কোনও উচ্চবাচ্য করে না। কিন্তু গিন্নির গলা ফাটানো চিৎকার চলতেই থাকে।

কি পোড়াকপাল আমার! নইলে এমন লোকের হাতে পড়তে হয় আমার। সারাটা জীবন খাটতে খাটতেই গেলো। একটু সুখের মুখও দেখতে পারলাম না কোন দিন। ওই মিনসেটা যতদিন থাকবে, ততদিন সুখ নেই কপালে।

ছোট মেয়েটা ঠিক বুঝতে পারে না, মা কেন বাবাকে এত গালাগালি করছে। মাঝে মাঝে না খেয়ে গেলে সেই দুপুরে একটা বাটিতে খাবার নিয়ে যায় দোকানে বাবার জন্য। কিন্তু লোকটা নির্বিকার। এত রোদে ছোট মেয়েটা যে এতদূর কষ্ট করে এলো, তা নিয়ে ভাবনা নেই কোনও। দিব্যি খাবার খেয়ে বাটিটা দিয়ে দেয় মেয়েটার হাতে। কাছে টেনে মেয়েটাকে ও একটু আদর করবে তাও পর্যন্ত করে না।

সেবার পুজোর সময় দোকানে কাজের খুব ভিড়। মালিক বললো।

এবার কিন্তু ছুটি হবে না। বিস্তর কাজ।

কিন্তু আমাকে যে যেতেই হবে। বললো লোকটা।

যেতে হবে বললেই যেতে দেওয়া যায়? বলি দোকান লাটে উঠলে খাবে কি? বৌ আর মেয়ের মুখে কি দেবে?

সে ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

মানে?

মানে আমি সব কাজ সেরে যাবো। রাত জেগে করে যাবো সব কাজ।

বেশ। যে কটা কাজ দিয়েছি, শেষ করে যেতে হবে।

রাতদিন খেটে নোকটা কাজ শেষ করলো। শনিবারের ভোরের ট্রেনেই চলে গেলো ক্যানিং। দুদিন সেখানে কাটিয়ে সোমবার সকালে যখন সে বাড়ি পৌঁছলো, তখন সে এক কুরুক্ষেত্র। গিন্নির চিৎকারে পাড়া প্রতিবেশী সব সচকিত হয়ে উঠলো। প্রতিবারই এরকম শুনে তাদের অভ্যেস। কিন্তু এবারের গণ্ডগোলটা যেন একটু অন্য ধরনের। গিন্নি গলা ফাটিয়ে বলছে।

পুজোর সময় সবাই দু’চার পয়সা বেশি কামায় আর উনি হরিশ্চন্দ্রের বেটা হরিশচন্দ্র। মাগমেয়ের পরনে কাপড় না জুটুক, তাতে কি এসে যায়! পিরিতের লোক আছে তার। কবিতা লিখে পড়াতে যান পিরিতের লোককে, কিন্তু এদিকে যে সংসারে আগুন লাগতে শুরু করেছে।

কেন, কি হয়েছে? খুব অসহায় ভাবে জিজ্ঞেস করলো লোকটি।

ঘরে গেলে বুঝতে পারবে। মালিক সব কটা সেলাই করা ব্লাউস ফেরত দিয়ে গেছে। আর বলে গেছে, ও কটা ঠিক করে দিয়ে আসতে। দোকানে আর যেতে হবে না।

আমার ভুল হয়েছে? অসম্ভব।

হঠাৎ লোকটার মুখে এমন পুরুষোচিত কথা শুনে সবাই হকচকিয়ে গেলো। গিন্নি কিন্তু সুর আরো চড়িয়ে বললো

তাহলে কি মালিক অমনি অমনি ফেরত দিয়ে গেছে?

ভুল যদি হয়ে থাকে, তবে ওরই হয়েছে। আমার হয়নি। আজ কুড়ি বছর হলো একাজ করছি, আমি জানিনা কোনটা কি?

উগ্রমূর্তি ধারণ করলো লোকটা। বউয়ের গলার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গলা চড়াতে লাগলো সে। প্রায় হাতাহাতি ব্যাপার। গিন্নি চিৎকারে না পেরে ঘরে গিয়ে নোকটার ছাড়া জামার পকেট থেকে একটা খাতা বের করে নিয়ে এলো। তারপর বেশ বিকৃত সুরে সকলকে শুনিয়ে খাতায় লেখা কবিতার কয়েকটা পংক্তি পড়তে লাগলো। মুহূর্তে কেমন যেন মিইয়ে গেলোলোকটা। তার সেই উগ্র চেহারা আর থাকলো না। একটা করুণ অসহায় রূপ ফুটে উঠলো সর্বাঙ্গে। গিন্নি বিকৃত সুর করে করে পড়ছে, আর লোকটার মুখ চোখ ক্রমশ ফ্যাকাশে হয়ে উঠছে। কয়েকটা লাইন এরকম বিকৃত করে পড়ে গিন্নি বলে উঠলো—

তাও যদি বের হতো পত্রিকায়। বস্তা বস্তা লিখে কি চিতার আগুনে দেবে?

লোকটার চোখ দুটি ছলছল করে উঠলো। ঠিক সেই সময় মালিক এসে দাঁড়ালো সেখানে। গিন্নির কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে বললো।

এই সব ছাই ভস্ম লিখে কি পেট ভরবে? আর তার জন্য শনি রবি দুদিন কাজ কামাই করে যেতে হবে ক্যানিং? যতসব বাজে কাজে সময় নষ্ট করা।

অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে রইলোলোকটা। কোনও কথার উত্তর দিতে পারলো সে। কেবল চোখ দুটি ছলছল করছিলো। মালিক চুপচাপ তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রেশ রাগত ভাবেই বললো–

হয়েছে ওই ব্লাউসগুলোর রিপেয়ারের কাজ? সব কটা ভুল হয়েছে। যাবার জন্য আর কাজে মন ছিলো না।

অসম্ভব। ভুল আমার হয়নি। হতে পারে না। চিৎকার করে বলে উঠলো লোকটা। মালিক প্রত্যুত্তরে বললো–

তবে কি ভুল হয়েছে আমার?

হ্যাঁ আপনার। চলুন মিলিয়ে দিই।

তখনকার মতো শান্ত হয়ে গেলো সব। আমার খুব অদ্ভুত লাগলো, লোকটার আচরণ দেখে। যখনই কবিতার কথা উঠছে, তখন মিইয়ে যাচ্ছে লোকটা। অসহায় ভাবে তাকিয়ে থাকছে। কিন্তু কাজের ভুলত্রুটির কথা উঠলেই ফোঁস করে উঠছে সে।

দুদিন পরে দুপুরবেলায় দোকানটার সামনে দিয়ে যাচ্ছি, দেখি লোকটা একটা খাতা বের করে কি সব লিখছে। আমি যেতেই লুকিয়ে ফেললো খাতাটা। আমি

সেদিনের প্রসঙ্গ তুলে জিজ্ঞেস করলুম।

আচ্ছা, আপনার কবিতা নিয়ে যখন ওরা বিদ্রূপ করে, তখন উত্তর দেন না আপনি। অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকেন। কিন্তু কাজের ত্রুটির কথা উঠলেই কেন গর্জে ওঠেন। ওদের এরকম বিদ্রূপ সহ্য করেন কেন আপনি?

প্রশ্নটা শুনে কেমন যেন অস্বস্তি বোধ করলো লোকটা। এমন প্রশ্ন কেউ তাকে কোনদিন করবে ভাবতে পারেনি। একটু ভেবে নিয়ে তারপর আস্তে আস্তে বললো–

কাজ হলো এক ধরনের দক্ষতা। আজ কুড়ি বছর ধরে রাউস তৈরি করছি। সুজ্জং মোটামুটি একটা দক্ষতা আমার এসে গেছে। আমি জানি, কতটুকু করতে পারি আমি। কিন্তু সৃষ্টি সম্বন্ধে কি কখনও নিশ্চিত হওয়া যায়? কেউ কি বলতে পারে, তার লেখা কবিতা বা গল্প কেমন হয়েছে। আসলে জানেন, সৃষ্টির কাছে প্রত্যেক স্রষ্টাই অসহায়।

আমি কথাগুলো ভাবতে ভাবতে বেরিয়ে এলাম সেখান থেকে। মনে মনে ভাবলাম, প্রত্যেক শিল্পীর মনেই ওই লোকটার মতো একটা অসহায় ব্যক্তিত্ব লুকিয়ে থাকে।

No comments