নন্দিতা – বাণী বসু

 

নন্দিতা – বাণী বসু

শুনছ? শুনছ? ওঠো না গো একবার!! মাঝরাত্তিরে নন্দিতার ঠেলাঠেলিতে ঘুমটা একেবারে কাচের বাসনের মতো খানখান হয়ে গেল।

হলটা কী? ধড়ফড় করে উঠে বসল শুভেন্দু। বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে। জানালাগুলো বেশিরভাগই বন্ধ। তা সত্ত্বেও ধারাবর্ষণের তুমুল শব্দ কাচ কাঠ সমস্ত অনায়াসে ভেদ করে ফেলছে।

ভোঁতা, ভারী শব্দ একটা! ভরা শ্রাবণের মধ্যরাত। জ্বালাময় মাঝ-বর্ষার দিনাবসান। ধরিত্রীরও। তার বুকে অবিরাম জীবনধারণের লড়াইয়ে ক্ষতবিক্ষত মানুষগুলিরও। অন্ততপক্ষে শুভেন্দুশেখরের তো বটেই। গতকাল সকালে ট্রেনেই ফিরেছে তিনদিনের ঝটিকা ট্যুর সেরে, তারপর গেছে অফিস। সেখানে ট্যুর-ক্লান্ত বলে কোনো বিশেষ বিবেচনা স্বভাবতই মেলেনি। সন্ধেয় বাড়ি ফেরার লগ্ন থেকেই ঘুমটা আসছিল নেশার মতো। একটা চমৎকার আমেজ, তাকে আরও চমৎকারভাবে জমিয়ে দিল বেশি-করে গাওয়া ঘি-ঢালা নাতিগাঢ় মুগের ডালের খিচুড়ি আর পাটিসাপটার মতো কি জানি কীসের পুর ভরা দুর্দান্ত ওমলেট। বর্ষারাতের সেই জমজমাট ঘুম এইভাবে কেউ ভাঙায়? ঠেলে ঠেলে! অল্প ঠেলায় হল না দেখে ধাঁই ধাঁই করে রাম ধাক্কা মেয়ে?

শুনতে পাচ্ছ না? নন্দিতা কাঁদো-কাঁদো গলায় বলল।

কী শুনতে পাবো? ঘুমে ভারী, বিরক্ত গলায় শুভেন্দু বলল।

কুকুরটা কী ভীষণ কাঁদছে! অন্ধকারে মনে হল নন্দিতাও কাঁদছে। গলার স্বরটা যেন আধা-বিকৃত।

অবিরাম বর্ষণের ভারী আওয়াজ ভেদ করে এই সময়ে কোনো চতুষ্পদ প্রাণীর ডাক শুনতে পাওয়া গেল। করুণ সাইরেনের মতো ধাপে ধাপে সুরে চড়ল ডাকটা, তারপর আবার খাদে নেমে এল। কেউ কেউ কেউ কেউ কেউ, অতঃপর ভিন্ন রাগিণীতে শুরু হল আলাপ।

ঘুমোতে না পারো, একটা কাম্পোজ খেয়ে শুয়ে পড়ো, শুভেন্দু আবার ঝুপ করে শুয়ে পড়ল।

ঘুমোতে না পারার কথা হচ্ছে না-নন্দিতা আর্তগলায় বলে উঠল, কুকুরটা যে ভয়ানক কাঁদছে। ওকে এই দারুণ বৃষ্টির মধ্যে ছাদে বেঁধে রেখে দিয়েছে। তা ছাড়া … নন্দিতার কথা শেষ হল না, শুভেন্দু প্রায় খেকিয়ে উঠল তো আমি কী করব? কথাগুলো কেটে কেটে প্রত্যেকটাতে বেশ খানিকটা রাগ ভরে ভরে সে বলল। কদিন ধরে এ এক মহা উৎপাত শুরু হয়েছে। তাদের দোতলা বাড়ির পরেই একটা ছোটো জমি ঘেরা পড়ে আছে। তারপর এক পুলিশ ইনসপেক্টরের বাড়ি। ভদ্রলোকের খুব জন্তু-জানোয়ারের শখ। খরগোশ, গিনিপিগ থেকে আরম্ভ করে ছাগল, গোরু, এমনকি বাঁদর পর্যন্ত পোষা হয়ে গেছে। তা পুষুন, কেউ আপত্তি করছে না। কিন্তু পোষা প্রাণীগুলোর কোনও যত্নই ওঁরা করেন না। খরগোশ, গিনিপিগগুলোকে গুন্ডাহুলো এসে এসে খতম করে গেল। ছাগলিটা যে কদিন দুধ দিল, দিল। তারপর ভদ্রলোক স্বহস্তে তাকে কেটে খেয়ে ফেললেন। গোরুটা বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে দিবারাত্র হাম্বা হাম্বা করত, গলার দড়ি কখনও খোলা হত না, তার কী গতি হল তাদের কারুরই জানা নেই। আর বাদরটার লক্ষ্য ছিল এ পাড়ার যতেক গৃহস্থবাড়ি। নিজের মালিকের কাছ থেকে যথেষ্ট খেতে পেত না কিনা কে জানে, কিন্তু পাড়ায় হেন বাড়ি নেই যেখান থেকে সে দাঁত মুখ খিচিয়ে ভোজ্য সংগ্রহ না করেছে। ক্লাইম্যাক্স হল শুভেন্দুর শার্ট পাঞ্জাবির বোতাম ভক্ষণ। কেউ কিছু বলতে সাহস পায় না। পুলিশের দারোগা, ওরে বাবা, বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা। তবে ইদানীং ভদ্রলোক যা শুরু করেছেন সত্যিই সহ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে। একটার পর একটা দারুণ সুন্দর দামি কুকুর আনছেন আর অযত্ন অবহেলা দিয়ে কয়েক মাসের মধ্যেই মেয়ে ফেলছেন। শুভেন্দু আর অতশত জানবে কোত্থেকে, নন্দিতাই জানায়। জানালায় দাঁড়িয়ে প্রাণপণে ইশারা করে শুভেন্দুকে ডাকে, দেখো দেখো দেখে যাও। দারোগার বাড়ির উঠোনে একটা ছোটো ডোল, তাতে গিন্নি এঁটো কাঁটা সব এনে ফেলে দিলেন, তারপরেই ডাক দিলেন, আঃ আঃ টমি, আঃ আঃ! আপাদমস্তক টানটান চব্বিশ-পঁচিশ ইঞ্চি উঁচু একটা গ্ৰেহাউন্ড অপরূপ ভঙ্গিতে এগিয়ে এল। ভদ্রমহিলা তাকে এঁটোকাঁটাগুলো খাওয়াবার জন্যে ক্রমাগত তাড়না করছেন, আর অভিজাত বংশীয় গ্ৰেহাউন্ডটা ক্রমাগত তার লম্বা সরু চকচকে মুখটা ফিরিয়ে নিচ্ছে। গ্রে-হাউন্ডটা বোধহয় মরে গেল তবু পাত-কুড়োনো মুখে দিল না এবং কুকুরটা মরে গেল তবু তার মালিকরা তাকে তার যোগ্য খাদ্য দিলেন না। একটা চমৎকার স্প্যানিয়েল মরে গেল আপাদমস্তক ঘা হয়ে। চুলকোতে চুলকোতে কুকুরটা যেন খেপে যেত একেক সময়ে। সারা শরীর থেকে খাবলা খাবলা লোম উঠে, দগদগে ঘা নিয়ে প্রচণ্ড লাফিয়ে উঠে সামনের থাবায় মুখ দিয়ে শুয়ে পড়ল, উঠল না আর। কোথা থেকে ভদ্রলোক এত সুন্দর সুন্দর পেডিগ্রি-ডগ জোগাড় করেন কে জানে। পুলিশের লোক, কোথা থেকে আর! মিনি-মাগনা পায় বলেই বোধহয় আরও এত অছো। কী জিনিস পেয়েছে জানেই না। লেটেস্ট হচ্ছে একটা ডালমেশিয়ান। অপরূপ কুকুর। নন্দিতা জানলার কাছ থেকে নড়েই না, দ্যাখো দ্যাখো, কী সুন্দর ঘুরে বেড়াচ্ছে! সাদার ওপর কালো কালো গোল গোল ছিট, আবার ভালো চামড়ার কলার, এবার বোধহয় দারোগার মক্কল কলার সুষ্ঠুই উপহার দিয়েছে। কুকুরটা খুব সম্ভব পূর্ণবয়স্ক। পোয মানতে চাইছে না। পোয মানাবার উপায় হিসেবে দারোগাবাবু থার্ড-ডিগ্রি প্রয়োগ করেছেন। টমি—কাম হিয়ার। ভদ্রলোকের সব কুকুরই টমি! টমি আসছে না, লম্বা হিলহিলে চাবুকের বাতাস কাটার শব্দ সুইশশশ। নন্দিতা কানে আঙুল চেপে বসে পড়ে। টমি সিট ডাউন। এবারও টমি আসছে না, আবারও চাবুক নামছে। এবার নন্দিতা জ্ঞানশূন্য হয়ে জানলার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে, অ মেলোমশাই, মেসোমশাই। তার তীক্ষ্ণ সরু গলাও ভদ্রলোকের মোটা কানে পৌঁছতে দেরি হচ্ছে! অবশেষে অবাক হয়ে দারোগা মেলোমশাই মুখ তুলে তাকিয়েছেন। কস্মিনকালেও নন্দিতা তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে মাসি বোনঝি সম্পর্ক পাতায়নি। অতএব অবাক।

মারবেন না, প্লিজ, অমন করে মারবেন না! আকুলিবিকুলি করতে থাকে নন্দিতা। চোখের কোলে টলটলে জল। অতশত হয়তো দেখতে পাচ্ছেন না মেসো, কিন্তু কেমন হতবুদ্ধি হয়েই হাতের বেতটা ফেলে দিয়ে উঠে যাচ্ছেন। উঠোন ছেড়ে ভেতরে। ঘরের আশ্রয়ে।

সেই অবাধ্য ডালমেশিয়ানেরই এখন এই দুর্গতি হয়েছে। দোতলার ছাদে উপঝুরন্ত বৃষ্টির তলায় আশ্রয়হীন। কোথাও ছুটে পালিয়ে যাবে তার উপায় নেই। বাঁধা। নন্দিতা অনেক কষ্টে চোখের জল চাপতে চাপতে বলল, তুমি তো কদিন ছিলে না, জানো না। রোদে জলে ওকে একভাবে বেঁধে রেখে দ্যায়। নিজেরা নিশ্চিন্তে খাচ্ছে, দাচ্ছে, ঘুমোচ্ছে। আমরা ঘুমোতে পারছি না! খাবার মুখে রুচছে না! ওদের দেখো হেলদোল নেই! কেউ কেউ কেউ আবার বৃষ্টি ছাপিয়ে কুকুরের ডাক ভেসে এল! নন্দিতা বলল, ওর নিশ্চয় অসুখ করেছে, খুব কষ্ট হচ্ছে, যাও না একবার প্লিজ।

শুভেন্দু অবাক হয়ে বলল, তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে? ওদের পাড়ায় সবাই ভয় পায়, এড়িয়ে চলে, আমি মাঝখান থেকে কুকুর ডাকছে বলে এই রাত্তিরে গিয়ে কমপ্লেন করব?

ওহ, বুঝতে পারছ না, কুকুর ডাকছে বলে নয়! নন্দিতার গলা যেন রুদ্ধ হয়ে যাবে কুকুরটা কষ্ট পাচ্ছে বলে। বৃষ্টিতে! রোগে! … সে আর কিছু বলতে পারে না, ঝরঝর করে কাঁদতে থাকে।

শুভেন্দু বলে, একটা কুকুর কষ্ট পাচ্ছে বলে, এই দুর্যোগের রাত্তিরে তুমি আমাকে বাড়ি-ছাড়া করবে? জানো কত জন্তু-জানোয়ার, কত মানুষ নিরাশ্রয় ঠিক এখন, এই মুহূর্তে। বৃষ্টিতে উড়ে গেছে কার খোড়ো চাল, জল জমে ভেসে গেছে গেরস্থালি…।

শুভেন্দুর কথা শেষ হল না, হঠাৎ নন্দিতা দড়াম করে এক লাফ দিল বিছানা থেকে মাটিতে। ছুটতে ছুটতে গিয়ে দরজার খিল নামাল। তারপর বাইরে বেরিয়ে গেল।

অগত্যা শুভেন্দুকে উঠতেই হয়। খোঁজো কোথায় টর্চ, কোথায় বর্ষাতি, কোথায় ছাতা! নীচে নেমে সে অবাক হয়ে দেখল সদর দরজা খোলা। হু হু করে বৃষ্টির ছাট ঢুকছে। নন্দিতা এই রাত্তির দেড়টায় জলের মধ্যে একাই বেরিয়ে গেছে।

কোনোক্রমে বর্ষাতি টর্চ আর ছাতা সামলাতে সামলাতে প্রতিবেশীর বাড়ির দরজায় সে যখন পৌছোল ততক্ষণে সে-বাড়ির দরজাও খুলে গেছে। চৌকাঠের এপারে সোঁপাটে ভিজে নন্দিতা, ওপারে টর্চ হাতে লুঙ্গি-পরিহিত ভঁড়িয়াল দারোগা, দোহাই আপনারা কিছু করুন, কিছু করুন মেলোমশায়, কুকুরটা যন্ত্রণায় কতরাচ্ছে, ভয়ানক কষ্ট হচ্ছে ওর, কিছু করুন!

দারোগা বললেন, আপনি তো আচ্ছা জাহাঁবাজ মহিলা দেখছি। আমার স্ত্রী বলেন বটে জানলা থেকে যখন তখন স্পাইং করেন, আমার কুকুর আমি মারি কাটি আপনার কী? ইয়ার্কি পেয়েছেন? শেষ কথাটা উনি শুভেন্দুর দিকে চেয়ে বললেন।

শুভেন্দুর ভেতরটা রাগে জ্বলে যাচ্ছে নন্দিতার ওপরও, দারোগার ওপরও। সে যথাসাধ্য মোলায়েম করে বলল, আসলে কী জানেন, আমার স্ত্রী কুকুর ভীষণ ভালবাসে, একটু দেখুনই না! এত করে বলছে যখন!

কড়া চোখে তার দিকে তাকিয়ে দারোগা হাঁক দিলেন, হারু, হারু, ঢ্যাপলা! ছাতা নিয়ে একবার ওপরে যা দিকিনি, দ্যাখ তো টমিটা কেন এত চেঁচাচ্ছে!

দুটো ছায়ামূর্তি ছাতা নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠছে দেখা গেল। দারোগা বললেন, দেখুন মশাই, এক পাড়াতে থাকি, বিপদে আপদে নিশ্চয় একে অপরের সহায়। কিন্তু পরের ব্যাপারে খামোখা এভাবে নাক গলালে মেয়েছেলে বলে মান রাখতে পারব না। আসুন আপনারা। আসুন এবার …। গলাটা শেষের দিকে আরও কড়া।

এই সময় একটি ছায়ামূর্তি টর্চের আলোর বৃত্তের মধ্যে দৃশ্যমান হয়ে পরম সন্তোষের সঙ্গে বলল, বাবা, টমি আর চ্যাঁচাচ্ছে না, কেমন দাপাচ্ছিল, কাটা পাঁঠার মতো, এখন চুপ করে শুয়ে পড়েছে।

নন্দিতা ফিসফিস করে বলল, মরে গেছে। সে স্থলিত পায়ে পিছন ফিরে বাড়ির দিকে চলতে লাগল। বৃষ্টিতে ভিজে শাড়ি পায়ের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। দড়াম করে আছাড় খেল একটা। শুভেন্দু তাকে তুলে ধরে, কোনোমতে বাড়ি নিয়ে আসে, সেই রাতে গরম জল করে ব্রান্ডি দিয়ে খাওয়ায়, পরদিন সকাল না হতেই টেটভ্যাকের খোঁজে ছোটে। হাঁটুর কাছে বেশ খানিকটা কেটে গেছে। দুটো স্টিচ। সে এক কাণ্ড!

নন্দিতা ডাকসাইটে কুকুর-প্রেমিক বলেই যে এমনটা ঘটল তা কিন্তু নয়। নন্দিতা কুকুর দেখতে ভালোবাসে, পুষতে মোটেই নয়। সে কোনো জন্তু-জানোয়ার পাখি-টাখি পোষবার আদৌ পক্ষপাতী নয়। ওসব আবদার তার নেই। বলতে গেলে কোনও আবদারই তার নেই। আপন খেয়ালে বইপত্তর, ক্যাসেট-ফিলম নিয়ে থাকে, ভালো ভালো রান্না করে, করে দু পক্ষের বন্ধুবান্ধব আত্মীয়স্বজনকে খাওয়ায়। খুব মিশুকে। যেখানে যায় হেসে গল্প করে, মজা করে একগাদা বন্ধু বানিয়ে ফেলবে। এরকম একটা স্টিমার পার্টির জমায়েতে হাসি-খুশি উচ্ছল স্বভাবের প্রাণবন্ত মেয়েটিকে মাস্তুল ধরে পাক খেতে খেতে একটার পর একটা কবিতা আবৃত্তি করতে দেখেই একেবারে ঘাড়মোড় ভেঙে প্রেমে পড়ে গিয়েছিল শুভেন্দু। আর বিয়ের পর তো নন্দিতা একটা অভিজ্ঞতা। এত স্বতঃস্ফূর্ত তার আবেগ! ভালোবাসা ও আকাঙক্ষার প্রকাশ এমন জমকালো! এমন হৃদয়ের দু কূল ভাসিয়ে নেওয়া প্লাবনের মতো উত্তাল! যে শুভেন্দু মনে মনে গোপনে জানে এমনটা বোধ হয় আর হয় না। এবং সে অতি ভাগ্যবান! বিশেষত সে বাপ-মা মরা, মামার বাড়িতে এবং পরে হস্টেলে মানুষ। স্নেহ-ভালোবাসা-আদরের জন্য কতটা কাঙাল সে ছিল, বিয়ের পর নন্দিতার প্রবল স্রোতে ভেসে যেতে যেতে ভালো করেই বুঝতে পারে। ওই এক দোষ, একে কী বলবে শুভেন্দু বুঝতে পারে না। খামখেয়ালি না সেন্টিমেন্টাল! না ওই পরের ব্যাপারে নাক-গলানোর আদিখ্যেতা! কী বলবে একে সে সত্যিই জানে না।

রোজই অফিস থেকে ফেরবার সময়ে এক বুক আনন্দ নিয়ে ফেরে শুভেন্দু। সে জানে যতই কলিগের সঙ্গে মনোমালিন্য হোক, ডিরেক্টর যতই বাঁকা চোখে তাকাক, গুচ্ছের নীরস অর্থহীন কাজের জন্যে তাকে যতই ছোটাছুটি করাক এরা, বাড়িতে তার জন্যে অসাধারণ কিছু অপেক্ষা করে আছে। দরজা খুললেই চমকে উঠবে হলুদ শাড়ি, শ্যাওলা সবুজ চুলের সেই মেয়ে কাজলবিহীন কাজলা চোখে এমন চাওয়া চাইবে, দাঁত ঝিকিয়ে এমন হাসি হাসবে যে সহস্র রকম দুর্ব্যবহার, হাজারখানা সমস্যার উদ্যত মুখ সব বাঁশির নাচনে সাপের ফণার মতো নুয়ে পড়বে। তারপর বেতের হালকা চেয়ারে মুখোমুখি বসে চা খাওয়া, ঝুপঝুপ সন্ধে নামছে, আলো জ্বলছে। সারাদিনের জমা কথা ফুটছে টুকটাক, দু একটা গানের কলি, একটা ধূপ জ্বেলে দেওয়া। ঘাড় ফিরিয়ে একটু ভঙ্গি—শুনতে এইটুকু কিন্তু এরই মধ্যে যে কী অসামান্য রস ভরা থাকে তা শুভেন্দু ছাড়া কেউ কি জানবে?

কিন্তু কোনো একদিন ওইরকম প্রত্যাশার সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে যদি হাসির চমক দেখে? সারা শরীরে শোকের ছাপ, যেমন-তেমন মলিন শাড়ি, বিকীর্ণমূর্ধজা, মেঘে-ভরা আকাশের মতো বর্ষণোন্মুখ চোখ।

কী হয়েছে নন্দিতা?

কিছু না। এসো।

চা খাওয়া হয়, চায়ের সুগন্ধের সঙ্গে ফিলটার-সিগারেটের গন্ধ মিশতে থাকে। সন্ধে উত্তীর্ণ হয়ে যায়। যন্ত্রচালিত দুটো হাত ধূপ জ্বেলে দেয়। হাতের মধ্যে যেন কোনো আগ্রহ নেই। রাত্তির হয়, খাবার বাড়া হয়। কথাবার্তা, হাসিঠাট্টা, চোখের আঙুলের-ঠোঁটের আদর ছাড়া খাবার বিস্বাদ মনে হয়, কিন্তু বারবার জিজ্ঞেস করে করেও উত্তর পাওয়া যায় না।

কী আবার হবে? কিছু না।

রাত্রে বোঝে নন্দিতা জেগে আছে। কিন্তু কোনো গভীর শোকে সে অনমনীয়, তাকে এখন ছোঁয়া যাবে না।

পরদিন খবর জানল রাস্তায় বেরিয়ে। দু-তিন বাড়ি পরে থাকে অভিলাষদা, তার স্কুল-পড়য়া ন-দশ বছরের ছেলেটি মারা গেছে। একেবারে হঠাৎ। স্কুলেই অসুস্থ হয়ে পড়ে, বাবাকে তার অফিসে খবর দেওয়া হয়েছিল, বাবা আসতে আসতেই সব শেষ। কেন, কী বৃত্তান্ত ভালো বোঝাই যাচ্ছে না।

কদিন পরে শুভেন্দু বলে, চলো নন্দিতা, উট্রাম ঘাট থেকে ঘুরে আসি। উট্রাম ঘাটে যেতে, জেটির ওপর দাঁড়িয়ে আঁচল ওড়াতে, গোল রেস্তোরাঁয় খেতে নন্দিতা ভীষণ ভালোবাসে।

কিন্তু নন্দিতা শূন্য চোখে চেয়ে বলে, কী লাভ?

কীসের কী লাভ?

এভাবে কোথাও বেড়াতে গিয়ে? বা কিছু সে যাই হোক না কেন, করে? কী লাভ? টুবলুর মতো একটা কচি ছেলে যদি এভাবে বিনা বাক্যব্যয়ে … তো কী লাভ? তুমিই বলো?

রাত্তিরে নন্দিতা গভীর শোকে গুমরে গুমরে কাঁদতে থাকে, যেন তার নিজেরই সন্তান গেছে।

আস্তে আস্তে মেঘ কাটতে থাকে, নন্দিতা স্বাভাবিক হয়, যদিও বৎসহারা জননীর এক গভীর, গভীরতর অসুখ সে যেন তার জীবনযাপনের ভেতরে চিরকালই বহন করে যাবে বলে মনে হয়। সবচেয়ে ভয় এবং আশ্চর্যের কথা এরও বেশ কয়েক মাস পরে শুভেন্দুর মাসতুতো বোনের বিয়েতে নেমন্তন্নে গিয়ে, খাওয়াদাওয়া হবার আগেই সে শুভেন্দুর হাত ধরে এসে, চলো এক্ষুনি চলে যাব।

কেন? কী হল? সুন্দর সিল্কের শাড়ি-পরা অলংকৃত বউয়ের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে শুভেন্দু।

শুনতে পাচ্ছ না সানাই বাজছে?

বিয়েবাড়িতে তো সানাই বাজবেই।

আমি সইতে পারি না যে! টুবলু যেদিন চলে গেল, সেদিন সারাদিন সারারাত দূর থেকে সানাইয়ের সুর ভেসে এসেছিল। আমার … আমি সইতে পারি না।

টুবলুর মৃত্যু খুবই মর্মান্তিক। একশোবার। কিন্তু টুবলুদের সঙ্গে নন্দিতার কোনো যাওয়া-আসাই ছিল না। টুবলুর সঙ্গে সে জীবনে দুবার কথা বলেছে কি না সন্দেহ।

অনেক চেষ্টাচরিত্র করে, নন্দিতাকে আগে থেকে কিছু না বলে বাড়ি পালটে ফেলার ব্যবস্থা করে শুভেন্দু। একটু শহরতলির দিকে। মস্তানি-ফস্তানি আছে নাকি একটু আধটু। কিন্তু চার ফ্ল্যাটের নতুন দোতলা বাড়ি। গেটে নন্দিতার পছন্দের মাধবীলতা থোকা থোকা দুলছে। নির্মল আকাশ দেখা যায়। রেললাইনের ধারে সাঁঝের বাজার বসে। সেখানে হরেক রকম টাটকা মাছ, সবজি পাওয়া যায়। একেবারে হাতের কাছে।

নন্দিতা প্রথমে গুইগাঁই করেছিল। তার আবার পুরোনো বাড়ি, উঁচু উঁচু সিলিং, রাশি রাশি জানলা-দরজা, এসব ভাল লাগে। সে ছাদে উঠে গনগনে রোদে কাপড় শুকোতে দেবে, আবার কালবৈশাখী এলে ঝড়ের হাওয়ায় উথালপাথাল হতে হতে কাপড় তুলে আনবে। দুমদাম দরজা জানলার আওয়াজ, ঘুলঘুলিতে চড়ুইপাখির বাসা, পাঁচিলের ফাটলে অশ্বত্থাগাছ এ সবই তার ভারি পছন্দের জিনিস। কিন্তু শুভেন্দুর এক গোঁ। সে এ বাড়ি ছাড়বেই। বউয়ের খামখেয়ালের জন্যে নতুন বাড়িতে থাকতে পাবে না নাকি সে তাই বলে? আচ্ছা বউ তো তার! তখন নন্দিতা অগত্যা হেসে ফেলে। দৌড়োদৌড়ি করে সব গুছিয়ে তুলতে থাকে। কী ফেলে যাবে, কী নেবে, কী নতুন কিনবে তার হিসেবনিকেশ করতে করতে একটা শালিখনি কি চড়ইনির মতোই মহা ব্যস্তসমস্ত হয়ে ওঠে। দেখতে দেখতে শুভেন্দুর বুকের ভেতরটা আনন্দে শিরশির করতে থাকে। নন্দিতা, আ-নন্দিতা অ-নন্দিতা সে গলা ছেড়ে ডেকে ওঠে।

আগেকার পছন্দটাকে আঁকড়ে ধরে নতুনের সব কিছু বরবাদ করে দেবে এমন মেয়েই নয় নন্দিতা। নতুন বাড়িটা তার ভারী ভালো লেগে যায়। ফিকে লাইল্যাক রঙের দেওয়ালে যামিনী রায়ের গণেশজননী টাঙাতে টাঙাতে সে দুদ্দাড় কয়ে ছোটে প্লেনের আওয়াজ শুনে, জানলার গ্রিল ধরে চেয়ে চেয়ে দ্যাখে, বলে, ভালোই হল বলো। আজকাল এয়ারপোর্ট ঢুকতে যা খরচ, এত কাছ থেকে বেশ নিখরচায় প্লেন দেখা যাবে। কী আওয়াজ! যেন আমাদের বাড়িতেই নেমে পড়বে মনে হয়! শুভেন্দু পায়ের ওপর পা তুলে মৃদু মৃদু হাসে। বিজয়ীর মতো।

তুমি আর বড়ো বড়ো কথা বলো না! আসতেই তো চাইছিলে না!

তা অবশ্য সত্যি গো! নন্দিতা কাঁচুমাচু মুখে অকপটে স্বীকার করে, আগের বাড়িটা আমার ভীষণ মায়াবী বাড়ি ছিল! পুরোনো বলে আমি কেমন খারাপ বাসতে পারি না। অন্যে পছন্দ করছে না দেখলে আমার যেন আরও মায়া বসে। যায়! এ বাড়িটা একটু নীচুও। কিন্তু দেয়ালগুলো? সাটিনের মতো! আর জানলা দিয়ে মাধবীলতার ভিউটা দারুণ। অতএব সে খুব চটপট নতুন বাড়ি মনের মতো করে গুছিয়ে ফেলে। লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে, হেসে কুটোপাটি হয়ে, বরের গাল চটকে, কান কামড়ে। খুব তাড়াতাড়ি বাকি তিন প্রতিবেশীর সঙ্গে আলাপ-টালাপও সেরে ফেলে। সন্ধেবেলায় উৎসাহের চোখে দু চার সিঁড়ি টপকে টপকে উঠতে উঠতে শুভেন্দু আহ্লাদে আটখানা হয়ে শোনে তার বাড়ির জানালা দিয়ে নির্ভুল ভাবে গান ভেসে আসছে, পিয়া বিন রয়না নহী জায়। সে বেল বাজিয়ে দরজা খুলতে না খুলতেই বলে ওঠে, পিয়া বিন রয়না যাবার কোনো সম্ভাবনা আপাতত নেই। পিয়া হাজির।

কিন্তু সবচেয়ে বিপজ্জনক নন্দিতামিটা তার বউ এখানেই করে ফেলল। এগুলোকে আজকাল শুভেন্দু নন্দিতামি বলে, আর কোনো নাম বা সংজ্ঞা খুঁজে না পেয়ে। সন্ধের শোয়ে এসপ্লানেড পাড়ায় ছবি দেখতে গিয়েছিল। একেবারে খেয়ে বাড়ি ফিরছে। দুজনেরই খুব মেজাজ খুশ। সারা রাস্তা বাসে বসে বসে ফিলমটার পিণ্ডি চটকেছে দুজনে আর হেসে খুন হয়েছে। তাদের বাড়ি যেতে হলে একটা পাক-খাওয়া গলি পড়ে। গলিটা এড়িয়ে যাওয়া যায়, তবে তাতে ভীষণ ঘুর হয়ে যায়। গলিপথে কিছুটা এগোবার পর একটা চাপা বচসার আওয়াজ শুনতে পেল ওরা, তারপরেই সামনে যেখানে মোড়, গলিটা দু-ভাগ হয়ে ডাইনে বাঁয়ে চলে গেছে সেইখানে টিমটিমে আলোয় একটা জটলা, কয়েকটা তীক্ষ্ণ গালাগাল তারপর একটা ছোরা ঝলসাতে দেখল ওরা। শুভেন্দু কিছু বুঝে ওঠার আগেই জ্যা-মুক্ত তির কিংবা বলা উচিত বুলেটের মতো বেগে নন্দিতা তার পাশ থেকে ছুটে বেরিয়ে গেল। শুভেন্দু দেখতে পেল উদ্যত ছোরা হাতে এক বিশাল চেহারার ঝাঁকড়াচুলো মস্তান, তার পেছনে আরও কিছু দলা-পাকানো লোক, অপরদিকে মাথা নীচু করে এক হাত ওপরে তুলে আঘাত এড়াবার ভঙ্গিতে এক ছোকরা। উভয়ের মাঝখানে লাল শাড়ি পরা নন্দিতা একটা ছোট্ট হাইফেনের মতো, কিংবা ছোট্ট একটা ফুলকির মতো। না, না খবরদার না সে চিৎকার করে বলছে, খবরদার মারতে পারবেন না। নিমেষের মধ্যে ছোকরা ডানদিকের গলি দিয়ে দৌড়োতে দৌড়োতে বেরিয়ে গেল, মস্তানের চোখে আগুন, ছোরা নেমে আসছে।

ব্যস, শুভেন্দু আর কিছু দেখেনি, জানে না। তার সামনে নিকষ আঁধার। যখন আবার দেখল, দেখতে পেল গলির মোড় শূন্য, সে বসে পড়েছে, নন্দিতা বলছে, কী হল তোমার? ওঠো! শিগগির বাড়ি চলো। শুভেন্দু অবাক হয়ে দেখল তার বউ অক্ষত আছে।

কোনোক্রমে বাড়ি ফিরে, দরজায় ভেতর থেকে একটা তালা লাগাল শুভেন্দু। ভারী একটা কৌচ এনে দরজায় ঠেস দিয়ে রাখল। নন্দিতা বলল, কী করছ?

শুভেন্দু গম্ভীরভাবে বলল, এতে কিসুই হবে না। দু-চারখানা লাথিতেই ভেঙে পড়বে। তবু ডুবন্ত মানুষ তো কুটোগাছটাও আঁকড়ে ধরে।

তার মানে? কে লাথি মারবে?

কেন? ওই যাদের নোংরা কাজিয়ার মধ্যে তুমি তোমার নির্বোধ নাকটি গলিয়েছিলে? খুব ভাগ্য ভালো যে তোমাকেই খুন করেনি বা…

নন্দিতা বলল, তাই বলে, আমার চোখের সামনে মানুষ মানুষকে খুন করবে আর আমি কিছু বলব না তা তো হয় না, হতে পারে না!

আর যদি আক্রোশে তোমাকেই খুন করত?

খুন হয়ে যেতাম, কেউ না বাঁচালে।

আর যদি রেপ করত?

রেপই হয়ে যেতাম। নিজেকে রক্ষা করতে না পারলে বা কেউ না রক্ষা করলে! তবে এসব ভাবিনি তখন, দেখেছিলাম দুটো মানুষ, একজনের হাতের ছুরি অন্যজনের ওপরে নেমে আসছে, মাঝখানে দু-আড়াই ফুটের মতো ফাঁকা জায়গা, ওইটুকু ছাড়া আর কিছু দেখিনি, কিছু ভাবিওনি।

কী ভয়ানক! কী ভয়ংকর ভয়ানক! এ মেয়েটা ভাবে না পর্যন্ত! শুভেন্দু ভাবল, এবং ভাবতেই থাকল, ভাবতেই থাকল। অফিস যাবার সময়ে বেরোতে বেরোতে ভাবে, বাড়ি ফেরবার সময়ে ফিরতে ফিরতে ভাবে। গলিতে কদাচ নয়। তথাপি ভয়। আর কিছু না হোক বাড়ি গিয়ে কী দেখবে এই ভেবে ভয়। যার জন্য এত ভয় ভাবনা সেই নন্দিতা কিন্তু একদম স্বাভাবিক। দোকান-বাজার যাচ্ছে, দরজা হাট করে খোলা রেখে বাসনওয়ালির সঙ্গে গল্প জুড়ে দিয়েছে, হাসি গান গল্প। দিব্যি আছে।

কদিন পরে শ্যামবাজারের মোড় থেকে বাসে উঠছে, হঠাৎ কাঁধের ওপর একটা ভারী হাত পড়ল। একেবারে চমকে উঠেছে শুভেন্দু।

কী রে শুভ?

মুখ ফিরিয়ে চেয়ে শুভেন্দু খুশিতে ফেটে পড়ল, আরে রমেন না?

চিনতে পেরেছিস তাহলে?

ভিড়ের মধ্যে থেকে সন্তর্পণে তাকে বার করে আনতে আনতে রমেন বলল।

তোকে কখন থেকে ডাকছি গাড়ির মধ্যে থেকে শুনতেই পাচ্ছিস না। অনেকক্ষণ থেকে তোকে ফলো করতে করতে আসছি। চল ওইদিকে গাড়িটা পার্ক করেছি। শুভেন্দু একমুখ হেসে বলল, কবে ফিরলি?

বছর খানেক। যতীন্দ্রমোহন অ্যাভেনিউয়ের মুখে চেম্বার করেছি। আয় না, দেখে যাবি। আমি অবশ্য এখন চেম্বার বন্ধ করে বেরোচ্ছি।

শুভেন্দু বলল, ঠিকানাটা দে, অন্য একদিন যাব। আজ না। বউ বাড়িতে একা রয়েছে। জায়গাটা ভালো না।

বিয়ে করেছিস? কবে? রমেন উৎসাহিত হয়ে উঠল।

বছর তিনেক হল।

তো চল, তোর বউ দেখে আসি। নেমতন্নটা তো একেবারেই মিস করে গেছি দেখছি।

যাবি? খুব ভালো হয় তাহলে।

রমেন তার ক্রিম রঙের মারুতি ভ্যানের দরজা সরিয়ে দিল। তারপর বলল, আমি পিঠে হাত রাখতে ওরকম ঘাবড়ে ফ্যাকাশে হয়ে গেলি কেন রে?

ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিলুম বুঝি?

হ্যাঁ, একেবারে চমকে উঠলি।

আর বলিস না, এই বউটা আমার মাথা খারাপ করে ছাড়বে।

কী ব্যাপার?

গাড়িতে যেতে যেতে শুভেন্দু তখন ব্যাপারটা বলল! শুনে রমেন হাসতে লাগল।

অন্যদিন শুভেন্দুর ফিরতে ফিরতে সন্ধে হয়ে যায়। আজ রমেনের গাড়িতে অনেক তাড়াতাড়ি হয়ে গেল। দরজা খুলে দিল বাসনমাজার মেয়েটি। কে রে? নন্দিতার গলা শোনা গেল। মেয়েটি চেঁচিয়ে বললে, দাদাবাবু।

ওমা, তুমি এত সকালে! বলতে বলতে শোঁ-ও-ও করে নন্দিতা এসে হাজির হল। পরনে চুড়িদার-কুর্তা। ওড়নাটা কষে কোমরের সঙ্গে বাঁধা আঁটসাঁট করে একটা বিনুনি বেঁধেছে। পায়ে রোলার স্কেট। এ বাড়িতে কোথাও চৌকাঠ নেই। রোলার স্কেট পায়ে চড়িয়ে নন্দিতা ঘর থেকে ঘরান্তরে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

একবার শোঁ করে পেছনে গড়িয়ে আরেকবার দ্বিগুণ শোঁ করে সামনে গড়িয়ে এসে নন্দিতা রাজকীয় সালাম জানাল রোলার স্কেটের ওপর থেকে আইয়ে জনাব। পরক্ষণেই পিছনে অপরিচিত মুখ দেখে ভড়কে গিয়ে পড়তে পড়তে টাল সামলে নিতে নিতে তার পশ্চাদপসরণ। একেবারে রান্নাঘরের মধ্যে ককী কাণ্ড! একটু পরে খালি পায়ে ওড়না দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে ঘরে ঢুকে সে বলল। মুখে লাজুক-লাজুক হাসি।

রমেন বলল, কেন, বেশ তো ছিলেন, বাহনের ওপর থেকে নেমে এলেন কেন?

নন্দিতা মুখ ঢেকে হেসে উঠল।

শুভেন্দু বলল, এই হল আমাদের রমেন। রমেন দা গ্রেট।

বাস? ওইটুকুতেই ইনট্রোডাকশন হয়ে গেল? রমেন বলল।

এর চেয়ে বেশি বলতে হবে না, বুঝলেন? নন্দিতার হাসি-হাসি মুখ, আপনি প্রায়ই আমাদের দুজনের মাঝখানে বসে থাকেন, তা জানেন?

সুদূর লন্ডনে বাস করে আপনাদের মাঝখানে … আমি কি ভূত-টুত নাকি?

আরে, ও বলতে চাইছে তোকে নিয়ে আমাদের মধ্যে গল্পসল্প হয়। এই আর কি!

তাই নাকি, বাঃ। রমেন খুব খুশি হল।

কিছুক্ষণের মধ্যেই নন্দিতা দশভুজা হয়ে উঠল। প্রথমেই একদফা চা-বিস্কুট দিয়ে গেল। চা টা শেষ হতে না হতেই কীসের বড়া গরম গরম ভেজে এনেছে, তার সঙ্গে আবার চা। তার পরে ছানার পুডিং হাজির করল, সেটা শেষ হলে বলল, মুখটা মিষ্টিয়ে গেল না কি? কুচো নিমকি খাবেন?

রমেন বলল, তাই বলি শুভটা রোগাপ্যাংলা ছিল বরাবর, এমন গায়েগতরে হয়ে উঠল কী করে? এই-ই তার সিক্রেট?

নন্দিতা বলল, ওসব বললে শুনছি না, আপনি আজ খেয়ে যাচ্ছেন।

রমেনের সমস্ত আপত্তি হাওয়ায় উড়িয়ে দিল নন্দিতা। তারপর সে এই সদর দরজা খুলে ছুটে যাচ্ছে সম্ভবত বাজারে, এই আবার প্রতিবেশীর ফ্ল্যাটে, রান্নাঘরে যাচ্ছে একবার, পরক্ষণেই সে এসে বসছে, গল্পে যোগ দিচ্ছে। এমনি করে রাত নটা নাগাদ সে গা ফা ধুয়ে একটা জমকালো পোশাকি শাড়ি পরে, কপালে টিপ, পুরো চুল খোলা খেতে ডাকল ওদের। হাত বাড়িয়ে বিরিয়ানি দিচ্ছে ওদের প্লেটে, তখনই শুভেন্দু এবং রমেনও লক্ষ্য করল জিনিসটা। ডান হাতের তলার দিকে আড়াআড়ি একটা চওড়া লালচে দাগ।

ওটা কী? কী হয়েছে? শুভেন্দু শিউরে উঠে জিজ্ঞেস করল।

হাত উলটে নন্দিতা দাগটা দেখল, একটু অবাক হয়ে বলল, তাই জ্বালা-জ্বালা করছিল। ও কিছু না।

কিছুতেই সে আর কিছু বলল না।

দারুণ খেলাম রমেন হাত ধুতে ধুতে বলল।

আবার যাতে আসেন তাই চেষ্টাচরিত্র করে ভালো খাওয়ালাম। নন্দিতার জবাব, বিরিয়ানি রাঁধলাম, জামদানি পরলাম আপনার অনারে, আর এই নিন।

সে মুঠোভরতি কাঁটালিচাপা ফুল রমেনের দুহাতে উপুড় করে দিল। ফুলগুলো নিয়ে যাবার জন্যে একটা পলিথিনের প্যাকেটও এনে দিল রাবার ব্যান্ড সুন্ধু।

রমেন বলল, রোলার স্কেট না পরেই তো আপনি হানড্রেড মাইল স্পিডে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন দেখলুম। ওটার দরকার হয়েছিল কেন?

নন্দিতা চারদিকে কেমন বিহবল চোখে চেয়ে মৃদু হাসল, বলল, কেন জানেন? শোনেন নি, সেই :

জলের কলে টিপ, টিপ
টিপ টিপ
আমরা বলেছিলাম যাব
সমুদ্রে।
নদী বলেছিল যাবে
সমুদ্রে।
আমরা বলেছিলাম যাবো
সমুদ্রে।
আমরা যাব।

বলতে বলতে মুখটা উলসে উঠল তার।

নীচে গিয়ে গাড়িতে উঠতে উঠতে রমেন বলল, দারুণ কাটল রে সন্ধেটা। চলি। আবার দেখা হবে। তারপর স্টিয়ারিঙে হাত রেখে হেসে বলল, তোর বউটা একটা পাগলি!

কী বলতে চাইল রমেন? শুভেন্দু ওপরে উঠতে উঠতে ভাবতে লাগল। তারপর থেকে প্রতিদিনই কাজের ফাঁকে ফাঁকে মাথার মধ্যে কথাটা তাকে আঘাত করে যায়, পাগলি, তোর বউ একটা পাগলি। কেন এ কথা বলল রমেন? পাগলি কথাটা লোকে আদর করে বলে আপনজনকে। দূর পাগলি! আবার বিরক্ত হলে বলে, কী পাগলামি করছ? কিন্তু তোর বউটা একটা পাগলি। কী প্রকৃত মানে এই কথার? শুভেন্দু তার বউ নিয়ে গর্বিত। তিন ঘন্টার মধ্যে লাফঝাঁপ করে বানিয়ে দিল বিরিয়ানি, ফিশ তন্দুর, ফ্রায়েড চিকেন। নিজেই বাজার গেল, এ বাড়ি ও বাড়ি থেকে কী মালমশলা সংগ্রহ করল কে জানে, বানিয়ে তো দিল। অরেঞ্জ চকোলেট রঙের ওই শাড়িটা পরে কপালে লম্বা টিপ, আধ-কোঁকড়া চুল খুলে যখন খাবার টেবিলে পরিবেশন করছিল? সম্রাজ্ঞীর মতো। ম্যাজিশিয়ানের মতো যখন হাতের মুঠো থেকে কাঁটালিচাঁপাগুলো বার করল? কিংবা সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা ঠিক কথা বলার মতো করে বলে উঠে একটা চমৎকার ছোটো গল্পের মতো শেষ করল শুভেন্দুর বাড়িতে রমেনের প্রথম আসার দিনটা!

অথচ প্রতিক্রিয়ায় তোর বউটা একটা পাগলি! এ কথা কেন বললি রমেন? ভেবে বললি? হঠাৎ বিদ্যচ্চমকের মতো শুভেন্দুর মনে পড়ে যায় নন্দিতার ডান হাতের সেই চওড়া কালশিটের দাগ, কদিন আগে যা লাল ছিল, মনে পড়ে যায় বৃষ্টির রাতে ছুটে যাওয়া, কুকুরটা কী ভয়ানক কাঁদছে গো! মনে পড়ে যায় মস্তানের উদ্যত ছুরির তলায় লাল শাড়ি পরা স্ফুলিঙ্গের মতো নন্দিতাকে, সানাই ভাল লাগে না যায়, সানাই শুনলে যে বিষাদের অতলান্তে তুলিয়া যায় সেই নন্দিতাকে। শুভেন্দু আর দেরি করে না।

অফিসে আজ খুবই দেরি হয়ে গেছে। তবু সে শ্যামবাজারের মোড় থেকে চট করে বাস ধরে না। চলে যায় যতীন্দ্রমোহন অ্যাভেনিউ। ডক্টর রমেন বাগচির চেম্বারে।

নিজের নাম পাঠিয়ে দিয়ে ওয়েটিং রুমে বসে শুভেন্দু। চারদিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে। এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক একটি লাল-চোখ তরুণকে নিয়ে বসে আছেন। ছেলেটি যেন ঘুমঘোরে রয়েছে। ঘোর ভাঙলেই সে ভয়ংকর কিছু একটা করে ফেলবে। আরও দুজন সঙ্গী রয়েছেন ভদ্রলোকের। বাইরে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। মাঝে মাঝে এসে চুপি চুপি কথা বলে যাচ্ছেন। শুভেন্দুর পাশেই বসে আরেক জন, শুভেন্দুর থেকে বড়ো হলেও যুবকই। তাঁর সঙ্গে একটি খুব সুন্দরী বউ। এতো সুন্দর, কিন্তু যেন বিষাদপ্রতিমা। দেখলে মনে হয় নৈরাশ্যের সিন্ধু থেকে উঠে এল বুঝি। শুভেন্দুর বাঁ পাশে একটি অল্পবয়সি ছেলে। চোখে চশমা। ধারালো মুখ। সে শুভেন্দুর সঙ্গে যেচে আলাপ করল। কিছু মনে করবেন না দাদা, আপনি কার জন্য এসেছেন?

শুভেন্দু কী বলবে ভেবে পেল না। সে কি সত্যি-সত্যিই নন্দিতার জন্যে এসেছে? নন্দিতা কী …

এসেছি এক নিকট আত্মীয়ার ব্যাপারে, ধরি মাছ না ছুঁই পানি করে বলল শুভেন্দু।

আপনি?

আমার নিজের জন্যে। ছেলেটি খুব সুন্দর হেসে বলল, অনেকের ধারণা সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে খালি মনোরোগীরাই আসে। ধারণাটা ঠিক নয়। অনেক রকম ডিজঅর্ডার আছে জানেন তো? আমার কথাই ধরুন না কেন। দুবার ডাবলু বি সি এস দিয়েছি। র‍্যাঙ্ক ভাল আসেনি তাই আবার দিচ্ছি। এবার বুঝলেন … হয়। এসপার নয় ওসপার। তো যা-ই পড়তে যাই মনের মধ্যে ঝমঝম করে কবিতা বাজে, এখান থেকে এক লাইন ওখান থেকে এক লাইন, ধরুন দাওয়ায় বসে জটলা করে পূর্বপুরুষেরা কি তোমায় আমি রেখে এলেম ঈশ্বরের হাতে কি অবর্তমান তোমার হাসি ঝাউয়ের ফাঁকেআমায় গভীর রাত্রে ডাকে—ও নিরুপম, ও নিরুপম ও নিরুপম বলতে বলতে ছেলেটি উত্তেজিত হয়ে উঠল। সটান উঠে দাঁড়িয়ে ভাবগম্ভীর গলায় আবৃত্তি করতে শুরু করে দিল যেন এটা মঞ্চ—

মন্দ ভালো নেইকো কিছুই, আকাশ মাথায়
বাউল-বাউলি দাঁড়িয়ে থাকায়,
নিম ঘোড়ানিম আকাশ ছুঁড়ে কৃষ্ণ-কিরিচ ফাঁসিয়ে রাখায়,
থই থই থই সমুদ্র জল তাথৈ তাথায়,
ওপর নীচে ডাইনে বামে আমার থেকেই আমার ভাগায় … আমার
ভাগায় … আমার ভাগায়।

শুভেন্দু আশেপাশে তাকাল। সবাই ভয়ের চোখে ছেলেটির দিকে তাকাচ্ছে। সুন্দরী মেয়েটির চোখ ভরতি জল। লালচোখ ছেলেটি লম্বা সিটের ওপর শুয়ে পড়ছে। রমেনের অ্যাসিস্ট্যান্ট মেয়েটি এসে ডাকল, কৌস্তুভ সেনগুপ্ত। কবি ছেলেটি তাড়াতাড়ি চেম্বারে ঢুকে গেল। শুভেন্দুর হঠাৎ ভয় করতে লাগল। ভীষণ ভয়। এসব যেন তার চেনা। এ লাল চোখ সে দেখেছে খবর্দার মারতে পারবেন। বলে যখন ঝলসে উঠেছিল। ওই বিষাদপ্রতিমা নয়ন-ভরা জল, দিনে রাতে দেখতে দেখতে এক সময় সে মরিয়া হয়ে গিয়েছিল। আর এই রকম মিঠে হাসি, চোখ দুটো হঠাৎ উধাও হয়ে যাওয়া, এই রকম … ঠিক এই রকম … ঠিক! ভয়ে অধীর হয়ে উঠল সে। উঃ। কখন তাকে ডাকবে রমেন?

অ্যাসিস্ট্যান্ট মেয়েটি একটা ছোট্ট নোট পেপারে লেখা একটা চিঠি এনে দিল।

শুভ, একটু বোস ভাই। পেশেন্টদের ছেড়ে দিয়েই তোর সঙ্গে বেরোব।

রমেন, রমেন তুই জানিস না, শুভ তোর সঙ্গে মজা মারতে, ইয়ার্কি দিতে আসেনি। তার বাড়িতে ভীষণ বিপদ। খুব বিপন্ন একজনের জন্যেই আজ সে তোর কাছে ছুটে এসেছে।

ঠিক এক ঘন্টা বারো মিনিটের মাথায় শেষ রোগীটি বেরিয়ে গেলে, শুভেন্দুর ডাক পড়ল।

কী ব্যাপার বল? চা খাবি তো? না কফি, মায়া একটু কফি বানাও ভাই। অ্যাসিস্ট্যান্ট মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রমেন বলল।

আরে দূর তোর কফি শুভেন্দু বলল, আমি ভীষণ সমস্যায় পড়ে এসেছি।

তোর আবার কী সমস্যা? ফার্স্ট ক্লাস আছিস! রমেন পাত্তাই দিল না।

শুভেন্দু বলল, তোকে পষ্টাপষ্টি জিজ্ঞেস করছি রমেন, নন্দিতা আমার বউ কি অস্বাভাবিক, মানে অ্যাবনর্মাল?

রমেন ঝুঁকে বসে আশ্চর্য হয়ে বলল, সে কী? একথা কেন বলছিস?

শুভেন্দু বলল, সেদিন ওর ডান হাতে একটা লাল দাগ দেখেছিলি, মনে আছে? সেটা কি জানিস? স্কেলের বাড়ি। আমাদের নীচের ফ্ল্যাটের ভদ্রমহিলা মেরেছেন।

বলিস কী রে? এফ, আই, আর, কর, এফ, আই, আর, কর। ডেঞ্জারাস মহিলা তো!

আরে, আগে সবটা তো শোন!

বল, আয়্যাম অল ইয়ার্স।

নীচের ফ্ল্যাটের ভদ্রমহিলার একটি হাবাগোবা ছেলে আছে। বছর বছর ক্লাসে। ফেল করে। তা করবে না তো কী?

পেনসিল-পেন-খাতা-বই এ সবেরও শ্রাদ্ধ করে ছেলেটা!

করবেই! তার কি সেন্স আছে!

সেটাই। তো ভদ্রমহিলা ছেলেটাকে এরকম কিছু ঘটলেই আচ্ছা করে পেটান। তুই যেদিন গেলি সেদিন সকালে নাকি নন্দিতার ভাষায় অমানুষিক পেটাচ্ছিলেন। ছেলেটার চিৎকার শুনতে পেয়ে ও ছুটে যায়, দুজনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে প্রহারে বাধা দেবার চেষ্টা করে, স্কেলের বাড়িটা ছেলের ওপরই নামছিল, নন্দিতার হাতের ওপর পড়ে।

তাই বল! স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে রমেন বলল।

শুভেন্দু বলল, ভদ্রলোক-ভদ্রমহিলা আমার কাছে গম্ভীর মুখে নালিশ করে গেলেন, আমার স্ত্রী ওঁদের পারিবারিক ব্যাপারে নাক গলাচ্ছে বলে। যখন নালিশ জানাচ্ছিলেন, তখন নন্দিতা বাজার গেছিল। ফিরে এসেছে, ওঁরা দেখতে পাননি। নন্দিতা চোখ গরম করে বলল, আপনারা যদি টুটুকে পেটানো বন্ধ না করেন আমি পুলিশে খবর দেব, হাতে হাতকড়া পরিয়ে ছাড়ব, জেনে রাখবেন। সে কী চেহারা রে, যেন বাঘিনি!

রমেন হাসতে হাসতে বলল, তো কী। ভালোই করেছে তো! সন্তানের দ্বারা বাবা-মাকে ডিভোর্স করার আইনটা পাস হয়ে গেলে ভালোই হয়।

শুভেন্দু বলল, আরও শোন, সে পূর্বাপর আজ অবধি যা ঘটে গেছে সবগুলো বলে গেল, তারপর অভিযোগের স্বরে বলল, তুইও তো প্রথম আলাপেই আমার বউটাকে পাগলি বললি। বলিসনি!

বলেছিলুম বুঝি! রমেন হাসতে লাগল। তারপর হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বলল, তা তোর কী বলার আছে বল!

বলবার আর কী আছে? আমি তোর কাছ থেকে প্রফেশন্যাল ওপিনিয়ন চাইছি। অ্যাডভাইসও।

রমেন হাতের আঙুলগুলো মন্দিরের মত চুড়ো করতে করতে বলল, দ্যাখ শুভ, আমাদের শাস্ত্রে বলে সেন্ট পার্সেন্ট নর্মাল লোক খুব কম। আসল হল ব্যালান্স। মানে ভারসাম্য। এই ভারসাম্যটা যদি এদিক ওদিক হেলে একটু কম বেশি হয়ে যায় তো … মানে বুঝেছিস? এক চুলের তফাত!

আতঙ্কিত চোখে তার দিকে চেয়ে শুভেন্দু বলল, তা হলে?

ধুর—ঘাবড়াচ্ছিস কেন? হালকা গলায় হেসে উঠল রমেন, ঘাবড়াবার আছেটা কী? মেডিক্যাল সায়েন্স যে এত উন্নতি করল, প্রযুক্তি বিজ্ঞান যে আজ কোন চুড়োয় উঠে গেছে, এসব কি ঘাবড়াবার জন্যে? ম্যান ইজ অলমোস্ট গড নাউ। সামান্য … খুব সামান্য একটু মেডিকেট করলেই নন্দিতা ঠিক হয়ে যাবে। আমি তোকে বেস্ট ওষুধ দিচ্ছি আমার স্যাম্পল থেকে। সে খসখস করে একটা প্রেসক্রিপশন লিখল, তারপর ড্রয়ার খুলে বেছে বেছে কয়েক পাতা ওষুধ বার করে দিল। দু রকম ওষুধ। খাওয়াবার নিয়মটা বলে দিল। তারপর বলল, তিন বছর বিয়ে হয়েছে বললি, না? এবার একটা বাচ্চা বানিয়ে ফ্যাল। দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে।

অবাক চোখে চেয়ে নন্দিতা বলল, ওষুধ? ওষুধ খাব কেন?

আরে খাওই না! আমি তো তোমার স্বামী, না শত্রু? বিষ ফিষ দেব?

না, তা নয়। তবে কনট্রাসেপটিভ পিল ফিল আমি আর খাচ্ছি না।

সে তো নয়ই। এবার মেটার্নিটি হোম, কাঁথা, ভ্যাকসিনেশন, ওঁয়া ওঁয়া শুরু হয়ে যাবে, আমার দুঃখের দিন এল বলে।

নন্দিতা হেসে ফেলে—বাব বাঃ, কী হিংসুটে!

এবার লক্ষ্মী মেয়ের মতো ওষুধটা খেয়ে নাও দিকি!

কীসের ওষুধ বলবে তো?

নার্ভের, বাবা নার্ভের, নার্ভ শান্ত রাখবে। মন ঠান্ডা থাকবে, হবু জননীর আদর্শ মানসিক অবস্থার সূচনা হবে।

সত্যি? কই দাও! অনাবিল বিশ্বাসে নন্দিতা হাত বাড়ায়। সকালে, বিকেলে, রাত্রে। সকালে, বিকেলে, রাত্রে। সকালে, বিকেলে, রাত্রে।

তৃতীয় দিন অফিস থেকে সে ফোন করল রমেনকে।

কেমন আছে রে, নন্দিতা?

পার্ফেক্ট। থ্যাংকিউ থ্যাংকিউ ভেরি মাচ।

নিজেকেই থ্যাংকসটা দে। তোর ডায়গনোসিস, আমার প্রেসক্রিপশন, রমেন বলে, ঠিক আছে, চালিয়ে যা এখন কিছু দিন।

সন্ধেবেলায় অফিস থেকে ফিরলে দরজা খুলে দেয় পরিষ্কার ফিটফাট নন্দিতা।

দুজনে চা আর ডালমুট নিয়ে গল্প করে।

জানো, আজকে নন্দিনীকে খুব দিয়েছি।

তাই?

সোজা বললুম, আপনি ভদ্রভাবে কথা বলতে জানেন না, আগে শিখুন, তার পরে বলবেন।

ওমা!

একেবারে চুপসে গেল, জানো? প্রোমোশনের চিঠি আমার হাতে। কী বলবে আর!

ঠিকই।

এবার বোসকেও ধরব। যত রদ্দি মার্কা টুর সব আমাকেই করতে হবে। বললেই বলবে ঠেসে টি. এ বিল দেবেন কোম্পানিকে। ভালোই তো। যেন আমি ফলস টি. এ বিলের এক্সপার্ট। আমার ফ্যামিলি লাইফ বলে প্রাইভেট লাইফ বলে কিছু থাকতে নেই। সব অপমানের শোধ এবার তুলব।

দাঁড়াও, প্রেশারের তিনটে হুইশল হয়ে গেল নন্দিতা চলে যায়। অনেকক্ষণ আসে না আর।

সান্ধ্য চান সারতে সারতে শুভেন্দুর হঠাৎ মনে হয় নন্দিতা তো কই নন্দিনীকে খুব দেওয়ার প্রসঙ্গে উত্তেজিত হয়ে উঠল না। বলল না তো, আহা, ওরকম রূঢ়ভাবে বললে কেন? জিজ্ঞেসও তো করল না কীসের প্রোমোশন। কেন প্রমোশন!

কাজের মেয়েটি চলে গেলেই গোটা ফ্ল্যাটটাতে তারা একা। সেই সময়ে নন্দিতা কোনো কোনোদিন এসে তার কোলের ওপর ঝুপ করে বসে পড়ে, গলা ধরে দোল খায়। বলে, জানো, তোমার ঘামে একটা কাটা ফলের মতো গন্ধ বেরোয়। প্লিজ, আরেকটু পরে চান কোরো। কাঁধের ওপর মুখ রাখে নন্দিতা। দেখো, ভিড় বাসে মেয়েদের সিটের সামনে দাঁড়ালেও, কখনও কোনো মেয়ে তোমার দিকে নাক কুঁচকে তাকাবে না। মেয়েদের আসলে নাকটাই খুব, বোধ হয় সবচেয়ে জোরালো। বুঝলে? তারপর শুভেন্দুর নাকে নিজের নাকটা ঠেকিয়ে বলে, তাই বলে যেন তুমি আবার বাসে মেয়েদের কাছে এটা পরীক্ষা করতে যেয়ো না। খবরদার। চোখ পাকিয়ে তর্জনী তোলে নন্দিতা।

তা সেসব তো কই কিছুই হয় না! শুভেন্দু পত্র-পত্রিকা নিয়ে স্পোর্টস চ্যানেল খুলে বসে থাকে। সাহেবরা অক্লান্ত গলফ খেলে যায়। গলফ খেলে যায়। সামনে দিয়ে নানা কাজে যাতায়াত করে নন্দিতা। কখনও কুশনের ওয়াড় পালটাচ্ছে, কখনও টেবিল মুছছে। টি.ভি.-র গায়ে চুম্বক লাগানো ছোট্ট মূর্তিটা ওপরের দিকে ছিল, নীচে সরিয়ে দিল। হেঁকে বলল একবার, গান শুনবে? চালাব কিছু? কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে নটার সময়ে টেবিলে ধোঁয়া ওঠা গরম খাবার। তারপর একটু টিভি দেখা। নিবিড় ঘুম। রাতে কোনো দিন হয়তো বলো হরি, হরিবোল যায়। বাড়ি কেঁপে ওঠে হরিধবনির চোটে। শুভেন্দু জেগে যায়। এই বুঝি নন্দিতা ঝপাং করে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল। নাঃ। নন্দিতা নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। কোনোদিন মাঝরাত্তিরে রেললাইনের ধারে দু-দলের বোমাবাজির শব্দে রাত যেন ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। নন্দিতা কাছে এসে কাতর গলায় বলে না, ইসসস দেশটা দিন দিন কী হয়ে যাচ্ছে, কতগুলো টাটকা তাজা ছেলে এভাবে হারিয়ে যাচ্ছে। নন্দিতার স্নায়ু। খুব শক্ত হয়ে গেছে। সে নিবিড় ঘুম ঘুমোচ্ছে।

এমনকি, অফিস যাওয়ার সময়ে খেতে বসে অনেক সময়ে শুভেন্দু টুটুর তীক্ষ্ণ চিৎকার শুনতে পায়। ডাক্তার বলে দিয়েছে, ওর মস্তিষ্ক অপরিণত, ও পারবে না। তবু ওর মা ওকে ঠ্যাঙাচ্ছে। শুভেন্দু উত্তর্ণ হয়ে থাকে। টুটুর জন্যে ততটা নয় যতটা নন্দিতার জন্যে। তার ভাব লক্ষ করে নন্দিতা নিঃশব্দে পাতে আর একটু ভাত তুলে দেয়, বলে, খেয়ে নাও। শুনে কী করবে? করতে তো পারবে না কিছু। ওদের ছেলে ওরা বুঝবে।

কাছেই কারও বাড়ি বিয়ে, সকাল থেকে সানাই বাজছে, ভয়ে ভয়ে অফিস যায়, অফিস থেকে ফেরে শুভেন্দু। চোখের সামনে সেই সুন্দরী মেয়েটির ছবি ভাসছে। বিষাদপ্রতিমা, নয়ন ভরা জল। ভয়ে ভয়ে দরজায় বেল দেয়। সর্বনাশ, কেদারা ধরেছে এবার! কেদারা! কেদারা সইতে পারে না নন্দিতা! ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে, বলে, টুবলু, আমার টুবলু চলে গেল, উঃ, ওকে তোমরা নিয়ে যেয়ো না, নিয়ে যেয়ো না! ফিরিয়ে দাও। দরজা খুলে যায়। নন্দিতা শুভেন্দুর মুখের দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলে, কী হল তোমার? শরীর খারাপ করছে? ভেতরে এসো। যা গুমোট চলছে।

শরবত এনে দেয়। ভিজে গামছা দিয়ে কপাল, ঘাড়, হাত-পা সব মুছিয়ে দেয়। ফ্যানটা পুরোদমে চালিয়ে দিয়ে সামনে বসে থাকে। কী গো? ঠিক আছ তো? না

বলব!

ওদিকে মন প্রাণ নিংড়িয়ে কেদারের সুর ওঠে নামে। নন্দিতা যেন বধির হয়ে গেছে।

রমেন ফোন ধরেছে, হালো, হালো। শুভ? বউ ঠিক আছে তো?

একদম ঠিক ভাই, একদম।

তো এইবার একটা … বুঝলি তো? শুধুই দুজন করিব কূজন আর নয় …

হ্যাঁ হ্যাঁ, সে ঠিক আছে, বুঝেছি, বুঝেছি।

চাঁদনি রাত। শ্রাবণের চাঁদ। যদি দেখা গেল না তো গেলই না। কিন্তু যদি দেখা গেল তো সে তার রুপোলি মদ দিয়ে তোমাকে মাতাল করে দেবে একেবারে। তখনই বোঝা যাবে এ চাঁদ নীল আর্মস্ট্রং-এর নয়, এ চাঁদ সুকান্ত ভট্টাচার্যেরও নয়। এ সেই আদি অকৃত্রিম কবি মহা-কবিদের রাকা শশী। চাঁদনি। হেনার উগ্র সুবাস সঙ্গে নিয়ে সেই চাঁদনি ঘরের মধ্যে ঢুকছে। একটা ফিকে রঙের ফ্রিল দেওয়া দেওয়া রাত-জামা, যেন ওই চাঁদেরই ফেনা। নন্দিতা ঘুমোচ্ছে। মাতোয়ালা শুভেন্দু মৃদু মথিত মন্দ্র স্বরে ডাকছে, নন্দিতা, নন্দিতা, কই এসো।

নন্দিতা কি জাগবে না? এমন ডাকেও জাগবে না? আবার ডাকে শুভেন্দু, আবার, আবার।

নন্দিতা জাগছে। খুলে গেছে তার চোখের পাপড়ি।

নন্দিতা আসছে। কিন্তু ও কী?

আসছে আহত জন্তুর মতো। গুঁড়ি মেয়ে। নিজেকে টেনে টেনে।

শিঙালের রাত-চেরা আকাঙক্ষার ডাকে হরিণীর ঠ্যাঙের তুরুকে নয়। নিযে গেল বুঝি পৃথিবীর কোটরের সৃজনী আগুন। বাঁধের মধ্যে ঘুমিয়ে গেছে দুর্দান্ত নদী। না চাইতেই দু কূল ভরে আর দেবে না। তার পুরুষের বুকের তলায় নন্দিতা যান্ত্রিক, উদাস, অসাড় হয়ে থাকে। অবিকল এই পৃথিবীর মতো।

(সমাপ্ত)

No comments