রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৫টি কবিতা | Rabindranath Tagore Poems

Rabindranath Tagore Poems

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৬১ সালের ৭ই মে কলকাতার এক ধনাঢ্য পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিঁনি ছিলেন অগ্রণী বাঙ্গালী কবি, ঔপন্যাসিক, সঙ্গীতস্রষ্টা, নাট্যকার, চিত্রকর, ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক, কন্ঠশিল্পী ও দার্শনিক। তাঁকে বাংলা ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ্য সাহিত্যিক মনে করা হয়। ১৯১৩ সালে গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের জন্য তাঁকে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয়। ইউরোপের বাহিরের প্রথম নোবেল পুরস্কার বিজয়ী হিসাবে তিনি বিশ্বে ব্যপক খ্যাতি লাভ করেন। দীর্ঘ রোগভোগের পর ১৯৪১ সালের ৭ই অগাস্ট জোড়াসাঁকোর বাসভবনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তবে মৃত্যুর সাত দিন আগে পর্যন্ত তিঁনি সৃষ্টিশীল ছিলেন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কবিতা || Rabindranath Tagore Poems

১. সোনার তরী

গগনে গরজে মেঘ, ঘন বরষা।
কূলে একা বসে আছি, নাহি ভরসা।
রাশি রাশি ভারা ভারা
ধান কাটা হল সারা,
ভরা নদী ক্ষুরধারা
খরপরশা।
কাটিতে কাটিতে ধান এল বরষা।

একখানি ছোটো খেত, আমি একেলা,
চারি দিকে বাঁকা জল করিছে খেলা।
পরপারে দেখি আঁকা
তরুছায়ামসীমাখা
গ্রামখানি মেঘে ঢাকা
প্রভাতবেলা–
এ পারেতে ছোটো খেত, আমি একেলা।

গান গেয়ে তরী বেয়ে কে আসে পারে,
দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে।
ভরা-পালে চলে যায়,
কোনো দিকে নাহি চায়,
ঢেউগুলি নিরুপায়
ভাঙে দু-ধারে–
দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে।

ওগো, তুমি কোথা যাও কোন্‌ বিদেশে,
বারেক ভিড়াও তরী কূলেতে এসে।
যেয়ো যেথা যেতে চাও,
যারে খুশি তারে দাও,
শুধু তুমি নিয়ে যাও
ক্ষণিক হেসে
আমার সোনার ধান কূলেতে এসে।

যত চাও তত লও তরণী-‘পরে।
আর আছে?– আর নাই, দিয়েছি ভরে।
এতকাল নদীকূলে
যাহা লয়ে ছিনু ভুলে
সকলি দিলাম তুলে
থরে বিথরে–
এখন আমারে লহ করুণা করে।

ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই– ছোটো সে তরী
আমারি সোনার ধানে গিয়েছে ভরি।
শ্রাবণগগন ঘিরে
ঘন মেঘ ঘুরে ফিরে,
শূন্য নদীর তীরে
রহিনু পড়ি–
যাহা ছিল নিয়ে গেল সোনার তরী।

২. নৌকাযাত্রা

মধু মাঝির এ নৌকোখান।
বাধা আছে রাজগঞ্জের ঘাটে,
কারে। কোনো কাজে লাগছে না তো
বোঝাই-করা আছে কেবল পাটে ।
আমায় যদি দেয় তারা নৌকাটি
আমি তবে একশোটা দাড় আটি,
“পাল তুলে দিই চাঁরটে পাঁচট! ছ-টা,
মিথ্যে ঘুরে বেড়াই না কো হাটে ।
আমি কেবল যাই একটিবার
সাত সমুদ্র তেরে! নদীর পার

তখন তুমি কেদে না মা, যেন
বসে বসে একলা ঘরের কোণে, »
আমি তো মা, যাচ্ছি না কো চলে
রামের মতো! চোদ্দবছর বনে ।
আমি যাব রাজপুত্র হয়ে
নৌকো-ভরা সোনামানিক বয়ে
আশুকে আর শ্যামকে নেব সাথে,
আমর! শুধু যাব মা, তিন জনে ।
আমি কেবল যাব একটিবার
সাত সমুদ্র তেরে! নদীর পার।

ভোরের বেল। দেব নৌকো! ছেড়ে
দেখতে দেখতে কোথায় যাব ভেসে ।
ছুপুর বেল। তুমি পুকুর ঘাটে,
আমরা তখন নতুন রাজার দেশে ।
পেরিয়ে যাব তিরপুণির ঘাট,
পেরিয়ে যাব তেপাস্তরের মাঠ,
ফিরে আসতে সন্ধ্যে হয়ে যাবে,
গল্প বলব তোমার কোলে এসে।
আমি কেবল যাব একটিবার
সাত সমুত্র তেরো নদীর পার।

৩. ছুটির দিনে

এ দেখো মা, আকাশ ছেয়ে
মিলিয়ে এল আলো;
আজকে আমার ছুটোছুটি

লাগল না আর ভালো ।
ঘণ্টা বেজে.গেল কখন্‌

_ অনেক হোলো বেলা,

তোমায় মনে পড়ে গেল

ফেলে এলেম খেলা ।.

আজকে আমার ছুটি, আমার
শনিবারের ছুটি
কাজ যা.আছে সব রেখে আয়
মা, তোর পায়ে লুটি ॥
দ্বারের কাছে এই খানে বোস্‌
এই হেথা চৌকাঠ ;
বল্‌ সামারে কোথায় আছে
তেপান্তরের মাঠ

এ দেখো মা, বর্ষ এল

ঘনঘটায় ঘিরে
বিজুলি ধায় একে বেঁকে

আকাশ চিরে চিরে ।
দেবতা যখন ডেকে ওঠে

থর্থরিয়ে কেপে
ভয় করতেই ভালবাসি

তোমায় বুকে চেপে।
ঝুপঝুপিয়ে বুষ্টি যখন

বাশের বনে পড়ে
কথ। শুনতে ভালবাসি

বসে কোণের ঘরে ।

এ দেখো মা, জান্ল। দিয়ে
আসে জলের ছাট,

বল্‌ গে! আমায় কোথায়’ আছে

তেপাস্তরের মাঠ।

কোন্‌ সাগরের তীরে মা গে৷

কোন্‌ পাহাড়ের পারে,
কোন্‌ রাজাদের দেশে মা গে

কোন্‌ নদীটির ধারে ।
কোনোখানে আল বাধা তার

নাই ডাইনে বায়ে
পথ দিয়ে তার সন্ধ্যে বেলায়

পৌঁছে না কেউ গায়ে?
সারাদিন কি ধুধু করে

শুকৃনো ঘাসের জমি ।
একট। গাছে থাকে শুধু

ব্যাঙ্গমা-বেঙ্গমি ?

সেখান দিয়ে কাঠকুড়,নি

যায়না নিয়ে কাঠ?
বল্‌ গে! আমায় কোথায় আছে
তেপাস্তরের মাঠ ।

এমনিতরেো। মেঘ করেছে

সারা আকাশ ব্যেপে,
রাজপুত্তর যাচ্ছে মাঠে

একুল। ঘোড়ায় চেপে ।
গজমোতির মালাটি তার

বুকের পরে নাচে,
রাজকন্তা কোথায় আছে

খোজ পেলে কার কাছে ।
মেঘে যখন ঝিলিক মারে

আকাশের এই কোণে,
ছয়োরানী-মায়ের কথা |

পড়ে না তার মনে ?
ছুখিনী মা গোয়াল ঘরে

দিচ্ছে এখন ঝট,
রাজপুত্তর চলে-যে কোন্‌

তেপাস্তরের মাঠ ।

এ দেখ, মা গায়ের পথে
রোদ নাইকো মোটে ;
রাখাল-ছেলে সকাল ক’রে
ফিরেছে আজ গোঠে।

আজকে দেখো রাত হয়েছে

দিন না যেতে যেতে,
কৃষাণেরা বসে আছে

দাওয়ায় মাছর পেতে ।
আজকে আমি নুকিয়েছি মা,

পুথি-পত্তর যত,__
পড়ার কথা আজ বোলো না।

যখন বাবার মতো
বড়ে। হব, তখন আমি

পড়ব প্রথম পাঠ,_-
আজ বলো মা, কোথায় আছে

তেপান্তরের মাঠ।

৪. বীরপুরুষ

মনে করো যেন বিদেশ ঘুরে

মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেকদুরে।
তুমি যাচ্ছ পালকিতে মা চড়ে
দরজা দুটো একটুকু ফাক করে,
আমি যাচ্ছি রাঙা ঘোড়ার পরে

টগবগিয়ে তোমার পাশে পাশে ।
রাস্তা থেকে ঘোড়ার খুরে খুরে

রাঙা ধুলোয় মেঘ উড়িয়ে আসে

সন্ধ্যে হোলো, তূর্ষ নামে পাটে,
এলেম যেন জোড়াদীঘির মাঠে।
ধুধু করে যে-দিক পাঁনে চাই,
কোনোখানে জন-মানব নাই,
তুমি যেন আপন মনে তাই
ভয় পেয়েছ, ভাবছ, এলেম কোথা,
আমি বলছি–ভয় কোরো না মা গো
এ দেখা যায় মর! নদীর সৌতা।

চোর-কাটাতে মাঠ রয়েছে ঢেকে,
মাঝখানেতে পথ গিয়েছে বেঁকে ।
গোরুবাছুর নাইকো! কোনোখানে,
সন্ধ্যে হোতেই গেছে গায়ের পানে,
আমরা কোথায় যাচ্ছি কে তা জানে,
অন্ধকারে দেখা যায় না ভালো ।
তুমি যেন বললে আমায় ডেকে,
“দীঘির ধারে এ যে কিসের আলো ”

এমন সময় “হারে রে রে রে রে,”

এ যে কারা আসতেছে ডাক ছেড়ে ।–
তুমি ভয়ে পালকিতে এক কোণে
ঠাকুর দেবতা স্মরণ করছ মনে,
বেয়ারাগুলো পাশের কাটা-বনে

পালকি ছেড়ে কাঁপছে থরোথরো,
আমি যেন তোমায় বলছি ডেকে

“আমি আছি ভয় কেন মা করো ।”

হাতে-লাঠি মাথায় ঝাঁকড়া চুল,
কানে তাদের গৌজ। জবার ফুল ।
আমি বলি, পাড়া, খবরদার ;
এক পা কাছে আসিস যদি আর

এই চেয়ে দেখ আমার ও লোয়ার ..!
টুকরো করে দেব তোদের সুরে ্

শুনে তারা লম্ফ দিয়ে উঠে সি |
ডেঁচিয়ে উঠল “হারে রে রে রে ট

তুমি বললে, “যাসনে বুক ওরে,”
আমি বলি, “দেখো না চুপ পট ।
ছুটিয়ে ঘোড়া গেলাম তাদের মাঝে,
ঢাল তলোয়ার ঝনঝনিয়ে বাজে,
কী ভয়ানক লড়াই হোলো মা যে,
শুনে তোমার গায়ে দেবে কাট।।
কত লোক যে পালিয়ে গেল ভয়ে
কত লোকের মাথা পড়ল কাটা ।

এত লোকের সঙ্গে লড়াই ক’রে
ভাবছ খোকা গেলই বুঝি ম’রে।
আমি তখন রক্ত মেখে ঘেমে
বলছি এসে, “লড়াই গেছে থেমে”,
তুমি শুনে পালকি থেকে নেমে
চুমো খেয়ে নিচ্ছ আমায় কোলে;
বলছ,“ভাগ্যে খোক। সঙ্গে ছিল
কী দদদশাই হোত তা না হোলে।”

রোজ কত কী ঘটে যাহা তাহা–
এমন কেন সত্যি হয় না, আহা ।
ঠিক যেন এক গল্প হোত তবে,
শুনত যার। অবাক হোত সবে,
দাদা বলত “কেমন ক’রে হবে,
খোকার গায়ে এত কি জোর আছে ।”
পাড়ার লোকে সবাই বলত শুনে,
“ভাগ্যে খোকা! ছিল মায়ের কাছে ॥

৫. নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে

নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে
রয়েছ নয়নে নয়নে,
হৃদয় তোমারে পায় না জানিতে
হৃদয়ে রয়েছ গোপনে।

বাসনা বসে মন অবিরত,
ধায় দশ দিশে পাগলের মতো।
স্থির আঁখি তুমি ক্ষরণে শতত
জাগিছ শয়নে স্বপনে।

সবাই ছেড়েছে নাই যার কেহ
তুমি আছ তার আছে তব কেহ
নিরাশ্রয় জন পথ যার যেও
সেও আছে তব ভবনে।

তুমি ছাড়া কেহ সাথি নাই আর
সমুখে অনন্ত জীবন বিস্তার,
কাল পারাপার করিতেছ পার
কেহ নাহি জানে কেমনে।

জানি শুধু তুমি আছ তাই আছি
তুমি প্রাণময় তাই আমি বাঁচি,
যতো পাই তোমায় আরো ততো যাচি
যতো জানি ততো জানি নে।

জানি আমি তোমায় পাবো নিরন্তন
লোক লোকান্তরে যুগ যুগান্তর
তুমি আর আমি, মাঝে কেহ নাই
কোনো বাঁধা নাই ভুবনে।

নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে
রয়েছ নয়নে নয়নে।

৬. শেষ চিঠি

মনে হচ্ছে শূন্য বাড়িটা অপ্রসন্ন,
অপরাধ হয়েছে আমার
তাই আছে মুখ ফিরিয়ে।
ঘরে ঘরে বেড়াই ঘুরে,
আমার জায়গা নেই–
হাঁপিয়ে বেরিয়ে চলে আসি।
এ বাড়ি ভাড়া দিয়ে চলে যাব দেরাদুনে।
অমলির ঘরে ঢুকতে পারি নি বহুদিন
মোচড় যেন দিত বুকে।
ভাড়াটে আসবে, ঘর দিতেই হবে সাফ ক’রে,
তাই খুললেম ঘরের তালা।
একজোড়া আগ্রার জুতো,
চুল বাঁধবার চিরুনি, তেল, এসেন্সের শিশি
শেলফে তার পড়বার বই,
ছোটো হার্মোনিয়ম।
একটা অ্যালবাম,
ছবি কেটে কেটে জুড়েছে তার পাতায়।
আলনায় তোয়ালে, জামা, খদ্দরের শাড়ি।
ছোটো কাঁচের আলমারিতে নানা রকমের পুতুল,
শিশি, খালি পাউডারের কৌটো।
চুপ করে বসে রইলেম চৌকিতে।
টেবিলের সামনে।
লাল চামড়ার বাক্স,
ইস্কুলে নিয়ে যেত সঙ্গে।
তার থেকে খাতাটি নিলেম তুলে,
আঁক কষবার খাতা।
ভিতর থেকে পড়ল একটি আখোলা চিঠি,
আমারি ঠিকানা লেখা
অমলির কাঁচা হাতের অক্ষরে।
শুনেছি ডুবে মরবার সময়
অতীত কালের সব ছবি
এক মুহূর্তে দেখা দেয় নিবিড় হয়ে–
চিঠিখানি হাতে নিয়ে তেমনি পড়ল মনে
অনেক কথা এক নিমেষে।
অমলার মা যখন গেলেন মারা
তখন ওর বয়স ছিল সাত বছর।
কেমন একটা ভয় লাগল মনে,
ও বুঝি বাঁচবে না বেশি দিন।
কেননা বড়ো করুণ ছিল ওর মুখ,
যেন অকালবিচ্ছেদের ছায়া
ভাবীকাল থেকে উল্টে এসে পড়েছিল
ওর বড়ো বড়ো কালো চোখের উপরে।
সাহস হ’ত না ওকে সঙ্গছাড়া করি।
কাজ করছি আপিসে বসে,
হঠাৎ হ’ত মনে
যদি কোনো আপদ ঘটে থাকে।
বাঁকিপুর থেকে মাসি এল ছুটিতে–
বললে, “মেয়েটার পড়াশুনো হল মাটি।
মুর্খু মেয়ের বোঝা বইবে কে
আজকালকার দিনে।’
লজ্জা পেলেম কথা শুনে তার,
বললেম “কালই দেব ভর্তি করে বেথুনে’।
ইস্কুলে তো গেল,
কিন্তু ছুটির দিন বেড়ে যায় পড়ার দিনের চেয়ে।
কতদিন স্কুলের বাস্‌ অমনি যেত ফিরে।
সে চক্রান্তে বাপেরও ছিল যোগ।
ফিরে বছর মাসি এল ছুটিতে;
বললে, “এমন করে চলবে না।
নিজে ওকে যাব নিয়ে,
বোর্ডিঙে দেব বেনারসের স্কুলে,
ওকে বাঁচানো চাই বাপের স্নেহ থেকে।’
মাসির সঙ্গে গেল চলে।
অশ্রুহীন অভিমান
নিয়ে গেল বুক ভরে
যেতে দিলেম বলে।
বেরিয়ে পড়লেম বদ্রিনাথের তীর্থযাত্রায়
নিজের কাছ থেকে পালাবার ঝোঁকে।
চার মাস খবর নেই।
মনে হল গ্রন্থি হয়েছে আলগা
গুরুর কৃপায়।
মেয়েকে মনে মনে সঁপে দিলেম দেবতার হাতে,
বুকের থেকে নেমে গেল বোঝা।
চার মাস পরে এলেম ফিরে।
ছুটেছিলেম অমলিকে দেখতে কাশীতে–
পথের মধ্যে পেলেম চিঠি–
কী আর বলব,
দেবতাই তাকে নিয়েছে।
যাক সে-সব কথা।
অমলার ঘরে বসে সেই আখোলা চিঠি খুলে দেখি,
তাতে লেখা–
“তোমাকে দেখতে বড্‌ডো ইচ্ছে করছে’।
আর কিছুই নেই।

৭. বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর

দিনের আলো নিবে এল,
সুয্যি ডোবে-ডোবে।
আকাশ ঘিরে মেঘ জুটেছে
চাঁদের লোভে লোভে।
মেঘের উপর মেঘ করেছে,
রঙের উপর রঙ,
মন্দিরেতে কাঁসর ঘন্টা।
বাজল ঠঙ্ ঠঙ্।
ও পারেতে বৃষ্টি এল,
ঝাপসা গাছপালা।
এ পারেতে মেঘের মাথায়
একশো মানিক জ্বালা।
বাদলা হাওয়ায় মনে পড়ে
ছেলেবেলার গান-
“বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর,
নদেয় এল বান।”

আকাশ জুড়ে মেঘের খেলা,
কোথায় বা সীমানা!
দেশে দেশে খেলে বেড়ায়,
কেউ করে না মানা।
কত নতুন ফুলের বনে
বৃষ্টি দিয়ে যায়,
পলে পলে নতুন খেলা
কোথায় ভেবে পায়।
মেঘের খেলা দেখে কত
খেলা পড়ে মনে,
কত দিনের নুকোচুরি
কত ঘরের কোণে।
তারি সঙ্গে মনে পড়ে
ছেলেবেলার গান —
“বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর,
নদেয় এল বান।’
মনে পড়ে ঘরটি আলো
মায়ের হাসিমুখ,
মনে পড়ে মেঘের ডাকে
গুরুগুরু বুক।
বিছানাটির একটি পাশে
ঘুমিয়ে আছে খোকা,
মায়ের ‘পরে দৌরাত্মি সে
না যায় লেখাজোখা।
ঘরেতে দুরন্ত ছেলে
করে দাপাদাপি,
বাইরেতে মেঘ ডেকে ওঠে —
সৃষ্টি ওঠে কাঁপি।
মনে পড়ে মায়ের মুখে
শুনেছিলেম গান —
“বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর,
নদেয় এল বান।”

মনে পড়ে সুয়োরানী
দুয়োরানীর কথা,
মনে পড়ে অভিমানী
কঙ্কাবতীর ব্যথা।
মনে পড়ে ঘরের কোণে
মিটিমিটি আলো,
একটা দিকের দেয়ালেতে
ছায়া কালো কালো।
বাইরে কেবল জলের শব্দ
ঝুপ্‌ ঝুপ্‌ ঝুপ্‌ —
দস্যি ছেলে গল্প শোনে
একেবারে চুপ।
তারি সঙ্গে মনে পড়ে
মেঘলা দিনের গান —
“বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর,
নদেয় এল বান।”

কবে বৃষ্টি পড়েছিল,
বান এল সে কোথা।
শিবঠাকুরের বিয়ে হল,
কবেকার সে কথা।
সেদিনও কি এম্‌নিতরো
মেঘের ঘটাখানা।
থেকে থেকে বিজুলি কি

দিতেছিল হানা।
তিন কন্যে বিয়ে ক’রে
কী হল তার শেষে।
না জানি কোন্‌ নদীর ধারে,
না জানি কোন্‌ দেশে,
কোন্‌ ছেলেরে ঘুম পাড়াতে
কে গাহিল গান-
“বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর,
নদেয় এল বান।’

৮. ১৪০০ সাল

আজি হতে শতবর্ষ পরে
কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি
কৌতূহলভরে–
আজি হতে শতবর্ষ পরে।
আজি নববসন্তের প্রভাতের আনন্দের
লেশমাত্র ভাগ–
আজিকার কোনো ফুল, বিহঙ্গের কোনো গান,
আজিকার কোনো রক্তরাগ
অনুরাগে সিক্ত করি পারিব না পাঠাইতে
তোমাদের করে
আজি হতে শতবর্ষ পরে।

তবু তুমি একবার খুলিয়া দক্ষিণদ্বার
বসি বাতায়নে
সুদূর দিগন্তে চাহি কল্পনায় অবগাহি
ভেবে দেখো মনে–
একদিন শতবর্ষ আগে
চঞ্চল পুলকরাশি কোন্‌ স্বর্গ হতে ভাসি
নিখিলের মর্মে আসি লাগে–
নবীন ফাল্গুনদিন সকল বন্ধনহীন
উন্মত্ত অধীর–
উড়ায়ে চঞ্চল পাখা পুষ্পরেণুগন্ধমাখা
দক্ষিণসমীর–
সহসা আসিয়া ত্বরা রাঙায়ে দিয়েছে ধরা
যৌবনের রাগে
তোমাদের শতবর্ষ আগে।
সেদিন উতলা প্রাণে, হৃদয় মগন গানে,
কবি এক জাগে–
কত কথা পুষ্পপ্রায় বিকশি তুলিতে চায়
কত অনুরাগে
একদিন শতবর্ষ আগে।
আজি হতে শতবর্ষ পরে
এখন করিছে গান সে কোন্‌ নূতন কবি
তোমাদের ঘরে?
আজিকার বসন্তের আনন্দ-অভিবাদন
পাঠায়ে দিলাম তাঁর করে।
আমার বসন্তগান তোমার বসন্তদিনে
ধ্বনিত হউক ক্ষণতরে
হৃদয়স্পন্দনে তব ভ্রমরগুঞ্জনে নব
পল্লবমর্মরে
আজি হতে শতবর্ষ পরে।

৯. মাকে আমার পড়ে না মনে

মাকে আমার পড়ে না মনে।

শুধু কখন খেলতে গিয়ে
হঠাৎ অকারণে

একটা কী সুর গুনগুনিয়ে

কানে আমার বাজে,

মায়ের কথা মিলায় যেন

আমার খেলার মাঝে।
মা বুঝি গান গাইত, আমার

দোলনা ঠেলে ঠেলে;
মা গিয়েছে, যেতে যেতে

গানটি গেছে ফেলে।
মাকে আমার পড়ে না মনে।

শুধু যখন আশ্বিনেতে
ভোরে শিউলিবনে

শিশির-ভেজা হাওয়া বেয়ে
ফুলের গন্ধ আসে,

তখন কেন মায়ের কথা

আমার মনে ভাসে?
কবে বুঝি আনত মা সেই

ফুলের সাজি বয়ে,
পুজোর গন্ধ আসে যে তাই

মায়ের গন্ধ হয়ে।
মাকে আমার পড়ে না মনে।

শুধু যখন বসি গিয়ে
শোবার ঘরের কোণে;

জানলা থেকে তাকাই দূরে

নীল আকাশের দিকে
মনে হয়, মা আমার পানে

চাইছে অনিমিখে।
কোলের ‘পরে ধরে কবে

দেখত আমায় চেয়ে,
সেই চাউনি রেখে গেছে

সারা আকাশ ছেয়ে।

১০. দরিদ্রা

দরিদ্রা বলিয়া তােরে বেশি ভালবাসি
হে ধরিত্রী, স্নেহ তাের বেশি ভাল লাগে,
বেদনা-কাতর মুখে সকরুণ হাসি
দেখে’ মাের মর্ম্ম মাঝে বড় ব্যথা জাগে!
আপনার বক্ষ হতে রস রক্ত নিয়ে
প্রাণটুকু দিয়েছিস্ সন্তানের দেহে,
অহর্নিশি মুখে তার আছিস্ তাকিয়ে
অমৃত নারিস্‌ দিতে প্রাণপণ স্নেহে!
কত যুগ হতে তুই বর্ণ গন্ধ গীতে
সৃজন করিতেছিস্‌ আনন্দ আবাস,
আজো শেষ নাহি হল দিবসে নিশীথে,
স্বর্গ নাই, রচেছিস্‌ স্বর্গের আভাস!
তাই তাের মুখখানি বিষাদ-কোমল,
সকল সৌন্দর্য্যে তাের ভরা অশ্রুজল!

১১. ওরে মাঝি

ওরে মাঝি, ওরে আমার
মানবজন্মতরীর মাঝি,
শুনতে কি পাস দূরের থেকে
পারের বাঁশি উঠছে বাজি।
তরী কি তোর দিনের শেষে
ঠেকবে এবার ঘাটে এসে।
সেথায় সন্ধ্যা-অন্ধকারে
দেয় কি দেখা প্রদীপরাজি।

যেন আমার লাগছে মনে,
মন্দমধুর এই পবনে
সিন্ধুপারের হাসিটি কার
আঁধার বেয়ে আসছে আজি।
আসার বেলায় কুসুমগুলি
কিছু এনেছিলেম তুলি,
যেগুলি তার নবীন আছে
এইবেলা নে সাজিয়ে সাজি।

১২.অকর্মার বিভ্রাট

লাঙল কাঁদিয়া বলে ছাড়ি দিয়ে গলা,
তুই কোথা হতে এলি ওরে ভাই ফলা?
যেদিন আমার সাথে তোরে দিল জুড়ি
সেই দিন হতে মোর মাথা-খোঁড়াখুঁড়ি।
ফলা কহে, ভালো ভাই, আমি যাই খ’সে,
দেখি তুমি কী আরামে থাক ঘরে ব’সে।
ফলাখানা টুটে গেল, হল্‌খানা তাই
খুশি হয়ে পড়ে থাকে, কোনো কর্ম নাই।
চাষা বলে, এ আপদ আর কেন রাখা,
এরে আজ চলা করে ধরাইব আখা।
হল্‌ বলে, ওরে ফলা, আয় ভাই ধেয়ে–
খাটুনি যে ভালো ছিল জ্বলুনির চেয়ে।

১৩. অন্তর মম বিকশিত করো

অন্তর মম বিকশিত করো
অন্তরতর হে।
নির্মল করো, উজ্জ্বল করো,
সুন্দর কর হে।
জাগ্রত করো, উদ্যত করো,
নির্ভয় করো হে।
মঙ্গল করো, নরলস নিঃসংশয় করো হে।
অন্তর মম বিকশিত করো,
অন্তরতর হে।

যুক্ত করো হে সবার সঙ্গে,
মুক্ত করো হে বন্ধ,
সঞ্চার করো সকল মর্মে
শান্ত তোমার ছন্দ।
চরণপদ্মে মম চিত নিঃস্পন্দিত করো হে,
নন্দিত করো, নন্দিত করো,
নন্দিত করো হে।
অন্তর মম বিকশিত করো
অন্তরতর হে।

১৪. আফ্রিকা

উদ্‌ভ্রান্ত সেই আদিম যুগে
স্রষ্টা যখন নিজের প্রতি অসন্তোষে
নতুন সৃষ্টিকে বারবার করছিলেন বিধ্বস্ত,
তাঁর সেই অধৈর্যে ঘন-ঘন মাথা নাড়ার দিনে
রুদ্র সমুদ্রের বাহু
প্রাচী ধরিত্রীর বুকের থেকে
ছিনিয়ে নিয়ে গেল তোমাকে, আফ্রিকা-
বাঁধলে তোমাকে বনস্পতির নিবিড় পাহারায়
কৃপণ আলোর অন্তঃপুরে।
সেখানে নিভৃত অবকাশে তুমি
সংগ্রহ করছিলে দুর্গমের রহস্য,
চিনছিলে জলস্থল-আকাশের দুর্বোধ সংকেত,
প্রকৃতির দৃষ্টি-অতীত জাদু
মন্ত্র জাগাচ্ছিল তোমার চেতনাতীত মনে।
বিদ্রূপ করছিলে ভীষণকে
বিরূপের ছদ্মবেশে,
শঙ্কাকে চাচ্ছিলে হার মানাতে
আপনাকে উগ্র করে বিভীষিকার প্রচণ্ড মহিমায়
তাণ্ডবের দুন্দুভিনিনাদে।।

হায় ছায়াবৃতা,
কালো ঘোমটার নীচে
অপরিচিত ছিল তোমার মানবরূপ
উপেক্ষার আবিল দৃষ্টিতে।
এল ওরা লোহার হাতকড়ি নিয়ে,
নখ যাদের তীক্ষ্ণ তোমার নেকড়ের চেয়ে,
এল মানুষ-ধরার দল
গর্বে যারা অন্ধ তোমার সূর্যহারা অরণ্যের চেয়ে।
সভ্যের বর্বর লোভ
নগ্ন করল আপন নির্লজ্জ অমানুষতা।
তোমার ভাষাহীন ক্রন্দনে বাষ্পাকুল অরণ্যপথে
পঙ্কিল হল ধূলি তোমার রক্তে অশ্রুতে মিশে,
দস্যু-পায়ের কাঁটা-মারা জুতোর তলায়
বীভৎস কাদার পিণ্ড
চিরচিহ্ন দিয়ে গেল তোমার অপমানিত ইতিহাসে।।

সমুদ্রপারে সেই মুহূর্তেই তাদের পাড়ায় পাড়ায়
মন্দিরে বাজছিল পূজার ঘণ্টা
সকালে সন্ধ্যায়, দয়াময় দেবতার নামে;
শিশুরা খেলছিল মায়ের কোলে;
কবির সংগীতে বেজে উঠছিল
সুন্দরের আরাধনা।।

আজ যখন পশ্চিম দিগন্তে
প্রদোষকাল ঝঞ্ঝাবাতাসে রুদ্ধশ্বাস,
যখন গুপ্ত গহ্বর থেকে পশুরা বেরিয়ে এল-
অশুভ ধ্বনিতে ঘোষণা করল দিনের অন্তিমকাল,
এসো যুগান্তরের কবি,
আসন্ন সন্ধ্যার শেষ রশ্মিপাতে
দাঁড়াও ওই মানহারা মানবীর দ্বারে;
বলো ‘ক্ষমা কর’-
হিংস্র প্রলাপের মধ্যে
সেই হোক তোমার সভ্যতার শেষ পুণ্যবাণী।।

১৫. কৃষ্ণকলি

কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি।
কালো তারে বলে গাঁয়ের লোক।
মেঘলাদিনে দেখেছিলেম মাঠে
কালো মেয়ের কালো হরিণ চোখ।
ঘোমটা মাথায় ছিল না তার মোটে,
মুক্তবেণী পিঠের ‘পরে লোটে।
কালো? তা সে যতই কালো হোক,
দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।

ঘন মেঘে আঁধার হল দেখে
ডাকতেছিল শ্যামল দুটি গাই,
শ্যামা মেয়ে ব্যস্ত ব্যাকুল পদে
কুটির হতে এস্ত এল তাই।
আকাশ-পানে হানি যুগল ভুরু
শুনলে বারেক মেঘের গুরুগুরু।
কালো? তা সে যতই কালো হোক,
দেখেছি তার কালো হরিণ চোখ।

পুবে বাতাস এল হঠাৎ ধেয়ে,
ধানের ক্ষেতে খেলিয়ে গেল ঢেউ।
আলের ধারে দাঁড়িয়ে ছিলেম একা,
মাঠের মাঝে আর ছিল না কেউ।
আমার পানে দেখলে কিনা চেয়ে,
আমিই জানি আর জানে সে মেয়ে,
কালো? তা সে যতই কালো হোক,
দেখেছি তার কালো হরিণ চোখ।

এমনি করে কালো কাজল মেঘ
জ্যৈষ্ঠ মাসে আসে ঈশান কোণে।
এমনি ক’রে কালো কোমল ছায়া
আষাঢ় মাসে নামে তমাল-বনে।
এমনি ক’রে শ্রাবণ-রজনীতে
হঠাৎ খুশি ঘনিয়ে আসে চিতে।
কালো? তা সে যতই কালো হোক,
দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।

কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি,
আর যা বলে বলুক অন্য লোক।
দেখেছিলেম ময়নাপাড়ার মাঠে
কালো মেয়ের কালো হরিণ-চোখ।
মাথার ‘পরে দেয়নি তুলে বাস,
লজ্জা পাবার পায়নি অবকাশ।

কালো তা সে যতই কালো হোক,
দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।

No comments