রিক্সায় কোনো রিস্ক নেই! – শিবরাম চক্রবর্তী
পাড়ায় গদাইয়ের গাড়ি চেপে একবার ভারি বিপাকে পড়েছিলাম, এবার ভোঁদাইয়ের মোটরে চড়ে এতদিন পরে আগেকার সেই গদাঘাতের দুঃখও ভুলতে হল!
বাস্তবিক, আমার বিবেচনায় রিক্সাই ভালো সবচেয়ে। এমনকী পা-গাড়িও তেমন নিরাপদ নয়। চালিয়ে গেলে কি হয় জানিনে, চালাইনি কখনো, কিন্তু আর কেউ যদি সাইকেল চালিয়ে আসছে দেখি তক্ষুণি আমি সাত হাত দূরে পালিয়ে যাই। রাস্তার ধার ঘেঁষে গেলে মোটর-চাপা পড়বার ভয় নেই, কিন্তু সাইকেলের বেলায় যে ধারেই তুমি যাও না, তোমার ঘাড়ে এসে চাপবেই। ফুটপাথে উঠেও নিস্তার নেই।
তাই বলছিলাম, রিক্সাই আমাদের ভালো। কোনো রিস্ক নেই একেবারেই। না সওয়ারির, না পথচারির।
কী কাজে শহরতলিতে যেতে হয়েছিল। ট্রামে বাসে ওঠা বেজায় দায়, পাদানিতেও পা দেওয়া যায় না। হাঁটতে হাঁটতে যদি কিছুটা এগিয়ে কোনো ট্রাম বাস একটু খালি পাওয়া যায় সেই ভরসায় এগোচ্ছি। আশায় আশায় যদ্দুর এগিয়ে আসা যায়।
হঠাৎ দেখি, ভোঁদা তার মোটর নিয়ে ভোঁ ভোঁ করে আসছে। আমাকে দেখে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে— ‘এসো আমার গাড়িতে। পৌঁছে দিচ্ছে তোমায়’। বলল সে।
‘ঠেলতে হবে না তো ফের?’ উঠতে গিয়েও থমকে দাঁড়ালাম।
‘কী বললে?’
‘গাড়ি চড়ার ভারি ঠেলা ভাই!’ গদাইজনিত আমার পূর্ব অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করলাম। সেগাড়ি একবার থামলে আর চলবার নামটি করে না। থেমে গেলেই নেমে গিয়ে ঠেলতে হয় আবার। গদাই আর আমি দুজনে মিলে সেই গাড়ি চালিয়ে—গদাই সামনের স্টিয়ারিং হুইলে আর আমি গাড়ির পেছন থেকে—সাত দিন আমায় কাত হয়ে থাকতে হয়েছিল বিছানায়। কাতর কন্ঠে জানালাম। ‘তোমার গাড়িও সেইরকম— নেমে নেমে—মাঝে মাঝে ঠেলতে হবে না তো?’
‘কী যে বলো তুমি! একি গদাইয়ের লঝঝর গাড়ি পেয়েছ? আনকোরা নতুন মডেলের গাড়ি— দেখচ না?’
কিন্তু গাড়ি ঠেলার চেয়েও যে ভারী ঠ্যালা আছে আরও— সেই অভিজ্ঞতা হল আমার সেদিন! কেমন করে যেন আঁচ পাচ্ছিলাম সেই অবশ্যম্ভাবী অভিজ্ঞতার, আমার অবচেতন বিজ্ঞতার মধ্যেই হয়তো বা। তার আভাসেই বলতে গেলাম কি না কে জানে— ‘কিন্তু তার দরকার কি এমন? আর একটুখানি গেলেই তো শহরতলির স্টেশনটা। সেখান থেকে ট্রেনে চেপে শেয়ালদা, শেয়ালদার টার্মিনাসে ট্রাম ধরে কলেজ স্ট্রিট মার্কেট— আমার ভাগ্নে ভাগ্নির বইয়ের দোকান হয়ে সেখান থেকে চোরবাগান আর কতটুকু?’ বলতে গেলাম আমি।
‘তা হলেও বেশ দেরি হবে তোমার—’ বাধা দিয়ে বলল ভোঁদা— ‘এধারের ট্রেন সব আধঘণ্টা পর পর আসে। ভিড়ও হয় নেহাত কম না। ধরতে পারলেও, চড়তে পারবে কি না সেই সমস্যা, আর তা পারলেও, বাড়ি পৌঁছোতে অন্তত তিরিশ মিনিট লেট তোমার হবেই— আমি তোমাকে তিন মিনিটে পৌঁছে দিতাম।’
সেই তিরিশ মিনিটের লেট বাঁচাতে তিরিশ বছর আগেই বৈতরণীর তীরে পৌঁছোচ্ছিলাম গিয়ে!
‘গাড়িটার স্পিড একটু কমাও ভাই!’ যেতে যেতেই আমি বলি— ‘বড্ডো জোরে চালাচ্ছো মনে হচ্ছে।’
‘মোটেই না। ভালো গাড়ি এমনি স্পিডেই চলে। এই রকমই স্পিড নেয়।’ স্টিয়ারিং হুইলে এক হাত রেখে, আর এক্সিলেটারে তার পা রেখে, আর এক হাতে নিজের গোঁফে চাড়া দিতে দিতে নির্ভাবনায় সেজানায়।
আমি কিন্তু দুর্ভাবনায় মরি। একটা পথ-দুর্ঘটনা না বাধিয়ে বসে আচমকা।
‘ভারি ভয় করছে কিন্তু আমার। যদি একটা কিছু…’
এক ইঞ্চির চেয়ে কিঞ্চিৎ বেশি ব্যবধানে একটা সাইকেলের পাশ কাটিয়ে সেযায়— ‘জানো, গাড়িকে সব সময় টিপটপ কন্ডিশনে রাখতে হয় তা হলেই আর টপ করে কোনো দুর্ঘটনা ঘটে না। গাড়ির মেকানিজম যদি গাড়ির মালিকের জানা থাকে আর সর্বদাই যদি সেনিজের গাড়ির খবর রাখে আর নিজেই চালায়…’
‘তা বটে…।’ উল্কার মতো একটা লরির পাশ দিয়ে যাবার কালে সভয়ে আমি চোখ বুজি, আমার কথা আর নিশ্বাস দুই-ই বন্ধ হয়ে আসে।
‘এই লরিগুলোই তো অ্যাক্সিডেন্ট বাধায়। বুঝেছ? কী করে চালাতে হয় জানে না একদম…’ ভোঁদা ভারি ব্যাজার হয়ে ওঠে লরিটার ওপর।
‘হ্যাঁ, কী বলছিলাম। এর কলকব্জা সব আমার নখদর্পণে। এর কোণার বোল্টুটাও আমার অজানা নয়। আমার গাড়ি আমি নিজেই সারি। কোনো কারখানায় সারাতে পাঠাই না। গাড়ির সব পার্টস নষ্ট করে দেয় তারাই…।’
পর পর দুটো পেট্রোল ট্যাঙ্কের রগ ঘেঁষে চলে যায় গাড়িটা। না, ভোঁদার আমন্ত্রণ না নিলেই বুঝি ভালো করতাম আজ।
‘গাড়ির আসল জিনিস হচ্ছে তার ব্রেক। ব্রেক যদি তোমার ঠিক থাকে, দুনিয়ার কিছুকে তোমার তোয়াক্কা নেই। বুঝলে?’
‘ব্রেক তোমার ঠিক আছে তো?’ কম্পিত কন্ঠে জানতে চাই। আর ওর স্পিডো-মিটারে পঁয়ষট্টি মাইলের স্পিড উঠেছে দেখতে পাই।
পঁয়ষট্টি! পঁয়ষট্টি পঁয়ষট্টি!! আমার মনে অনুরণিত হতে থাকে।
‘ব্রেক আমার পারফেক্ট বলেই এত জোরে আমি চালাতে পারি।’ ওর কন্ঠে ধ্বনিত হয়ে ওঠে।
‘তোমার ব্রেক ভালো জেনে তবু একটু আশ্বাস পেলাম এখন।’ আমি বললাম।
‘ভালো বলে ভালো। আমি নিজে হপ্তায় দুবার করে অ্যাডজাস্ট করি ব্রেকটা। ব্রেকের কোনো গলদ আমি বরদাস্ত করতে পারি না। ব্রেকই তো গাড়ির প্রাণ হে।’
‘আর সোয়ারিদেরও বই কী!’ আমি সায় দিই ওর কথায়— ‘তা হলেও একটু আস্তে চালালে কি ভালো হত না? ক্ষতি কী ছিল?’
‘তাহলে তো গোরুর গাড়ি কী রিক্সাতেই যেতে পারতে! …এই দ্যাখো সত্তরে তুলেছি স্পিড। চেয়ে দ্যাখো।’ সেদেখায়— ‘ওই ব্রেকের ভরসাতেই।’
আমি সভয়ে চোখ তুলে তাকাই। দেখি সত্তর— শত্তুর মুখে ছাই দিয়ে— সত্যিই!
‘তোমার ব্রেক ঠিক আছে তো? জানো তো ঠিক?’ আমি জিজ্ঞেস করি আবার— ‘গাড়ি বার করার আগে পরীক্ষা করেছিলে আজ?’
‘ঘাবড়াচ্ছো কেন হে? আমার ব্রেকের সম্পর্কে তোমার কোনো সন্দেহ আছে না কি? দাঁড়াও তাহলে, এক্ষুণি তোমার সন্দেহ মোচন করি। চক্ষু-কর্ণের বিবাদভঞ্জন হয়ে যাক… এই দারুণ স্পিডের মাথাতেই আমি ব্রেক কষব ঠিক এখান থেকে এক-শো গজ দূরে— দরজার পাল্লাটা ধরে শক্ত হয়ে বসো… রেডি…!’
আর ঠিক এক-শো গজ দূরেই সেই কান্ডটা ঘটল! বরাত জোর যে তিনজনেই আমরা রক্ষা পেলাম। একআধটু আঁচড়ের ওপর দিয়েই বাঁচান হল সেযাত্রায়।
তিনজন? মানে, আমি ভোঁদা আর পেছনের খালি ট্যাক্সির ড্রাইভারটা।
দুখানা গাড়ির ধ্বংসাবশেষের ভেতর থেকে যখন কোনোরকমে খাড়া হয়ে উঠেছি তখন ওদের দুজনের মধ্যে দারুণ তর্ক বেধেছে। ভোঁদা সেই ট্যাক্সি-ড্রাইভারকে বোঝাতে চেষ্টা করছে যে তার গাড়ির ব্রেকটাও যদি ওর নিজের ব্রেকের মতই টিপটপ অবস্থায় থাকত তাহলে অমন টপ করে এই দুর্ঘটনা ঘটতে পারত না। লোকটা কিন্তু মানতে চাইছে না কিছুতেই। দারুণ ঝগড়া বেধে গেছে দুজনের।
মোড়ের পুলিশ সার্জেন্ট এদিকেই এগিয়ে আসছে দেখতে পেলাম। আর এমনি সময়েই… এই দুর্বিপাকে…
ঠুন ঠুন ঠুন ঠুন! কানের মধ্যে যেন মধুবর্ষণ হল অকস্মাৎ।
পাশ দিয়ে যাচ্ছিল, থামিয়ে চেপে বসেছি তৎক্ষণাৎ। ওদের দুজনকে সেই সতর্ক অবস্থায় ফেলে রেখেই…
না, রিক্সায় কোনো রিস্ক নেই।
আর, পাহারাওয়ালার পাল্লায় পড়ার মতন রিস্ক আর হয় না! অতএব অকুস্থল থেকে যঃ পলায়তি…!
Post a Comment