স্বামীসুখ – শিবরাম চক্রবর্তী

স্বামীসুখ – শিবরাম চক্রবর্তী

নতুন বইটার প্রথম ম্যাটিনি শো—দর্শকের অভাব নেই। সুরমাও অসংখ্য দর্শকের একজন, তবু শ্রোতার অভাব মেয়েদের যেমন পীড়িত করে এমন আর কিছু না। সুরমা উশখুশ করে। পাশের মহিলাটির সঙ্গে খাতির জমিয়ে পরস্পরের কন্ঠ এবং কর্ণের অভাবমোচন করলে হয়তো মন্দ হয় না।

‘আপনি বুঝি ছবির খুব ভক্ত? প্রথম ম্যাটিনিতেই ছবি দেখতে এসেছেন?’ সুরমা শুরু করে। এ ছাড়া আর কী বলেই-বা শুরু করা যায়!

‘হ্যাঁ, প্রথম ম্যাটিনিতেই এলাম।’ মহিলাটি বলেন। এ ছাড়াই-বা তাঁর বলবার আর কী ছিল?

‘আমিও এলাম।’ সুরমা গড়িয়ে চলে—আলাপের ধাপে ধাপে অবলীলাক্রমে। কলার খোসায় প্রথম পদার্পণের পর আর পিছলে চলে যাবার কোনো বাধা হয় না।—‘পরিমলবাবু কেমন করেন, তাই দেখতেই এলাম আরও।’

‘ওঃ! পরিমলবাবু?’ মহিলাটির কথায় ঈষৎ একটু চমকানিই ছিল যেন—‘হ্যাঁ, পরিমলবাবু তো এই বইয়ে আছেন বটে।’

‘কেন আপনি কি তার অভিনয় দেখতেই আসেননি।’ সুরমা অবাক হয়—‘অমন প্রেমের অভিনয় আর কেউ করতে পারেন নাকি?’

‘প্রেমের অভিনয়? হ্যাঁ—অভিনয়ই বটে।’ ঠোঁটের কোণে একটুকরো বঁাকা হাসি ক্ষণিকের জন্যে যেন খেলা করে।

‘এদেশের স্ক্রিনে ওঁর মতো পারফেক্ট লাভার আর কই? বলুন আপনি!’ নিজের প্রশংসায় অপরপক্ষ থেকে তেমন সায় না এলেও সুরমার উৎসাহ দমতে চায় না। এমনকী, আলোকোজ্জ্বল ঘরের সাদা ছায়াপটের ওপরেই পরিমলবাবুর অনাবিল প্রেমের দু-একটি দৃশ্য তার চোখের ওপর যেন ভাসতে থাকে।

‘পারফেক্ট লাভারদের আমি নাম করতে চাইনে।’ মহিলাটি মুচকি হেসে বলেন।

‘আপনি বুঝি কোনো সিনেমাস্টার?’ সংশয়ের খোঁচায় সুরমার চাহনি শানানো।

‘না না!’ মহিলাটি হাসেন। ‘তোমার ধারণা ভুল। সিনেমার ত্রিসীমানায় আমি নেই। তবে কিনা—আদত কথা এই—আদর্শ প্রেমিকদের ঠিকানা তোমার মতো ছেলেমানুষের কাছে ব্যক্ত করাটা কি ঠিক হবে?’

‘ব্যক্ত করার আপনার প্রয়োজন নেই। কারা পারফেক্ট লাভার জানি আমরা। ছবিতে দেখেই টের পাই।’ সুরমা যেন উসকে ওঠে—‘পরিমলবাবু সত্যি একজন প্রথম শ্রেণির প্রেমিক—কি সিনেমার পর্দায়, আর কি তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে।’

‘বটে, এতদূ§র অবধি তুমি জান?’ তাঁর ঠোঁটে বক্র হাসি!

‘কে না জানে? বাংলা দেশের জানে না কে?’ সুরমা সিনেমা-ফ্যশান হিসেবে অতুলনীয়া—ভারি জোর ওর হাওয়া। ‘আপনি দেখছি আমার পরিমলবাবুকে মনে মনে অপছন্দ করেন। কেন করেন জানতে পারি কি?’

‘তোমার পরিমলবাবু? তার মানে, পরিমলবাবু সম্প্রতি যাঁকে—’

‘না না না!’ সুরমা বাধা দিয়ে ওঠে—‘আপনার ধারণাও ভুল। আমি বলছিলাম আমাদের পরিমলবাবু।’

‘ভালো কথাই বলছিলে। তা, তোমাদের পরিমলবাবুকে আমি অপছন্দ করিনে, কিন্তু পছন্দই-বা কেন করতে যাব বলো তো?’

‘ও, বুঝেচি। এক বউ থাকতে আবার বিয়ে করার জন্যে আপনি পরিমলবাবুর ওপর প্রসন্ন নন? তাই না? কিন্তু কী দুঃখে যে উনি দ্বিতীয় বার বিয়ে করতে বাধ্য হয়েচেন তা কি আপনার জানা আছে?’

‘কী দুঃখে? না, জানি না তো!’

‘সেকী? আমরা সবাই জানি যে! খবরের কাগজের মারফতে বাংলা দেশের সক্কলে জানে।’

‘কী, শুনি তো? বিস্তর কাচ্চাবাচ্চা নিয়ে সংসার—খবরের কাগজ পড়ার ফুরসত পাইনে! শুনি তো—কী?’ মহিলার কন্ঠস্বরে এবার কৌতূহলই অকৃত্রিম।

‘ওঁর বউ পাগল। বদ্ধ পাগল। বহুদিন থেকেই।’ চাপা গলায় সুরমা জানায়—‘কিন্তু ওঁর কী ভয়ংকর ভালোবাসা ভেবে দেখুন! তেমন বউকেও এতদিন ধরে অম্লানবদনে সেবা-শুশ্রূষা করে এসেছেন।’

‘বদ্ধপাগল?’ মহিলাটির বড়ো বড়ো চোখ আরও বড়ো হয়ে ওঠে।

‘এক্কেবারে। তা না হলে কখনো অমন স্বামীর গলা টিপে মারতে যায়? তাই তো গেছল। আর তাইতেই তো উনি, পাগল বউকে ঠাণ্ডা রাখার জন্যেই তার চোখের সামনে থেকে সরে এসেছেন। কত বড়ো বেদনা নিয়ে যে সরেছেন তা উনিই জানেন। কেন, খবরের কাগজে সবই তো বেরিয়ে গেছে।’

‘বদ্ধপাগল!’—যন্ত্রচালিতের মতো মহিলাটি পুনরুক্তি করেন, তাঁর চোখ তেমনি বিস্ফারিত। কথাটা যেন কিছুতেই তাঁর মাথায় ঢুকতে চায় না।

‘এক নম্বরের। তা না হলে অমন চমৎকার স্বামী পেয়ে—কীরকম লম্বা-চওড়া সুশ্রী চেহারা, দেখেছেন তো?’

‘তোমার কি বিশ্বাস হয়, ওর বউ ওর গলা টিপতে গেছল?’

‘কেন হবে না? পাগলে কি না পারে! আর গেছল মানে?—খেপে গিয়ে এমন টেপা টিপে ধরেছিল যে আরেকটু হলেই ওঁর বারোটা বেজে যেত!’

‘ওই লম্বা-চওড়া চেহারার কাছে? গেলেও, একটা মেয়ে পারবে কেন, পেরে উঠবে কেন, হলই-বা পাগল? আমার মনে হয় তুমি উলটো শুনেচ। উনিই হয়তো ওঁর বউয়ের গলা টিপে প্রায় সাবাড় করে এনেছিলেন, সেইটাই ঠিক হবে। তাই হওয়াই সম্ভব। ভয়ংকর প্রেমিকরা তর্কে পরাস্ত হলে তাদের হাতের কাছে ওই একটিমাত্র যুক্তি থাকে কিনা! আর বাবা, ওই হাত, ওই সব আঙুল কারও গলায় যদি চেপে বসে’—মনশ্চক্ষে দৃশ্যটি কল্পনা করতেই মহিলাটি শিউরে ওঠেন।

‘বুঝেছি, পরিমলবাবুর ওপরে আপনি হাড়ে চটা। যাকে দেখতে পারিনে তার চলন বঁাকা!’ সুরমা গড়গড় করে বলে—বলতে বলতে রাগে গরগর করে—‘বুঝেচি।’

সিনেমা শুরু হতে আর দেরি নেই। শেষ বারের ওয়ার্নিং বেল পড়ে গেল। মহিলাটি হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন, ‘আমি এই এলাম বলে।’

সুরমা উত্তর না দিয়েই সরে গেল। কোনো উচ্চবাচ্য না করেই ওঁর যাবার পথ পরিষ্কার করে দেয়। মহিলাটির প্রতি তার ভাব চটে গেছে…কাজেই আসন্ন অভাবের জন্যে তেমন কাতরতা তার হয় না।

মহিলাটি কিন্তু আর ফেরেন না। সিনেমার সম্মুখ হল দিয়ে বেরিয়ে যাবার সময় চকিতের জন্যে একটু দাঁড়ান—না, চারিধারে শোভমানা তারকাদের ছবির দিকে তাকিয়ে নয়—প্রমাণ আয়নাটার সামনেই দাঁড়ান একটু। চকিতের জন্যে কাঁধের শাড়িটা সরিয়ে গলার ধারটা আয়নার ভেতরে দেখে নেন। সুন্দর সুডৌল গ্রীবা—অন্তত, কিছুদিন আগে অবধি সুন্দর সুডৌলই ছিল। কিন্তু দেখা যায় সেখানে চেপে-বসা বিকৃত আঙুলের দাগ…আর, সে-দাগ এখনও মেলায়নি বুঝি!

No comments