ইউলিসিসের কুকুর – বাণী বসু

ইউলিসিসের কুকুর – বাণী বসু

There, full of vermins he lay abandoned on the heaps of dung.

বড়ো বড়ো মানুষদের নামে এখন আমাদের রাস্তা-ঘাট-পার্ক-ময়দান-সদন সরোবর-স্টেডিয়াম। বেশিরভাগই উনিশ থেকে বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়কার আমাদের গৌরব, আমাদের জনক, ঐতিহ্য, পিতৃপুরুষ। এইভাবেই তাই তর্পণ করি। পুরোনো নামের রাস্তা হয়ে যায় মহাত্মা গান্ধি রোড, রবীন্দ্র সরণি, শরৎ বসু রোড, নেতাজি সুভাষ রোড। নতুন প্রমোদ ভবন, মঞ্চ হয়, নাম দিই রবীন্দ্রসদন, নজরুলমঞ্চ, শিশিরমঞ্চ। সাদার্ন অ্যাভেনিউয়ের নামে ব্রিটিশ রাজের কোনো গন্ধ ছিল না, তবু সে রাস্তা এখন আমাদের জাতির অহংকার মেঘনাদ সাহার নামে। এই মেঘনাদ সাহা সরণির মোটামুটি মাঝখানে শরৎ বসু রোড আর কেয়াতলার মাঝামাঝি জায়গায় আমরা থাকি। লেকের দিকে মুখ। মা, দাদা, বউদি, টুটুল আর আমি।

ছিমছাম শান্তির সংসার আমাদের। বাস, ট্যাক্সি, গাড়ি, অটো অনবরত ছুটে চলেছে এপার-ওপার দুটো রাস্তা দিয়েই। তবু আমরা নিরিবিলির স্বাদ পাই। কেননা, থাকি এগারো তলায়। এত ওপর থেকে লেকসমেত পুরো দক্ষিণ শহরতলিটাই মানচিত্রের মতো চোখের তলায় বিছিয়ে থাকে। এত গাছ! এত গাছ! আর এত সবুজ। এ যেন ধুলো-ধোঁয়া-আবর্জনার কলকাতাই নয়, প্রথম পৃথিবীর কোনো সবুজ নগর সভ্যতা। বাস্তবিকই এখান থেকে কলকাতাকে বড়ো সুঠাম দেখায়। গাছ-গাছালির মাঝসাঝ দিয়ে কখনও দেখা দিতে দিতে কখনও দেখা না দিতে দিতে এলিয়ে থাকে লেকের চিকচিকে চিকন বাহুলতা। লেকের ভেতরে দ্বীপ। সুন্দর অঙ্গদের মতো। শুনতে পাই লেকের জল আজকাল দূষিত হয়ে গেছে। তীরভূমির সুন্দর কোথাও বা নষ্ট হয়ে গেছে নোংরামিতে, মস্তানিতে। কিন্তু এত উঁচু থেকে সেসব বোঝা যায় না। সুন্দরটুকু আর সুঠামটুকুই চোখে ভেসে থাকে। চোখ থেকে প্রবেশ করে হৃদয়ে, মগজে। এমন একটা শান্তি ছড়াতে থাকে যে রাগ-ঝাল সব নিমেষেই হাওয়া।

দাদা বাড়ি এসেছে অফিস থেকে, অফিসে হয়ে থাকবে কিছু অপ্রিয় ঘটনা, হয়তো বা চোটপাটই! রাত হয়ে গেছে। সাড়ে নটা। টগবগ করে ফুটতে ফুটতে দাদা বেল দিচ্ছে ধরুন, বাড়ির চাবি তো দাদার পকেটেই ঘোরে। কিন্তু এসব সময়ে দাদা যেন চাবির অস্তিত্বটাই ভুলে যায়। সকাল আটটা থেকে রাত সাড়ে ন-টা পরের চাকরি তো! চুষে ছিবড়ে করে দেয় একেবারে। তাই বেলের ওপর অসহিষ্ণু আঙুল। আপনি দরজাটা খুলে যায়, যেন জাদু। বাবা! বাবা! বাবা! টুটুল তার মিষ্টি কচি গলায় কলকলিয়ে ওঠে। পেছনে বউদির কোমল, অথচ জিজ্ঞাসু চালচিত্র। মুখে বলছে না—কেন এত দেরি! অথচ উদবেগ লেগে আছে চোখে, উদবেগ আর উদবেগ-মুক্তি। ঝপ করে অমনি পারা নেমে যায়। প্রথম দফায়। মাঝখানের টেবিলে ব্রিফবাক্সটা নামিয়ে সোফায় বসে জুতোর ফিতে খুলতে থাকবে দাদা। ভেতরে ভেতরে হাসি হাসি পাচ্ছে, কিন্তু এমন গোঁ যে এটাকে প্রকাশ করবে না। অফিসি-অশান্তির আঁচটা বউদি-টুটুলকেও পেতেই হবে। বউদি পায়। মুখের হাসিটা থিরথির করে কাঁপতে থাকে। হাসা ভালো না না-হাসা ভালো ঠিক করতে পারছে না বেচারি। কিন্তু টুটুলের ভয় পেতে বয়ে গেছে। তার মনের ভেতরের খেলার মাঠে সদাই নির্ভার ছুটোছুটি। তাই সে বাবার গালের নাগাল না পেয়ে হাঁটুর ওপর, প্যান্টের জমিতেই চুমু দেবে। এমন মিষ্টি তার আওয়াজ, আর এমন চনমনে সেই চুমুর পেছনের চোখ আর ঠোঁটের কারসাজি যে দাদা তাকে কোলে টেনে না নিয়েই পারবে না। সন্টিপুটি! সন্টিপুটি! সন্টিপুটি! দুজনে লুটোপুটি খাবে।

আমি আস্তে করে দাদার চোখ টেনে নিয়ে যাব সামনের দেয়ালে। যেন নদীর ঘাট। নীল-বেগনি-সাদা জলে চিকমিক। নীলচে সবুজ, সবজে নীল ছায়ায় নৌকো, অদূর দ্বীপ, সাঁকো, বেড়াচ্ছে মানুষজন। ছাবিবশ বাই তেত্রিশ ইঞ্চির মতো হবে, ক্লোদ মনের আঁকা। এই একই ল্যান্ডস্কেপ এঁকেছিলেন নাকি দুই শিল্পীই মনে আর রেনোয়া। শান্তির দ্বিতীয় স্রোত মনের ওই নীল-সবুজ থেকেই এবার নামবে।

একটু ঠান্ডা খাবে নাকি?—কে বলল? বউদি?

ফ্রিজের দরজা খুলে যাবে। স্বপ্ন-আলোর মধ্যে থেকে ঝলক-ঝলক ঠান্ডা। গ্লাসে করে বরফ সাজিয়ে তার ওপর ঠান্ডা শরবত ঢালা হবে। হাসবে বউদি, বলবে, জলজিরা অন দা রকস। একটু একটু চুমুক দিতে দিতে শরীর শিথিল হয়ে আসবে দাদার। মনের মধ্যে ঠান্ডা বইতে থাকবে। এরপর যা একটা মজা হবে না। দাদা আর টুটুল একসঙ্গে শাওয়ারের তলায় দাঁড়িয়ে পড়বে। টুটুলটা একদম নাঙ্গা। তিড়িং তিড়িং করে উইচিংড়ের মতো লাফাবে। জলের পোকা তো ছেলেটা। এই গরমে ওকে যতবার খুশি শাওয়ারের তলায় দাঁড়াতে দাও কিছু হবে না। গ্রীষ্মের দিনে বাবার সঙ্গে এই রাত চান, তারপরে পাউডারে-পাউডারে সাদা হয়ে চারজনে খেতে বসা একটা মহা উৎসবের মতো ব্যাপার। নিত্য-নিত্য হলেও পুরোনো, একঘেয়ে হয়ে যায় না।

এইবারে আসরে নামবে মা। মায়ের এই অবতরণ এত সহজ যে বোঝাই যাবে মা-ই আপাতত এ দৃশ্যের নায়িকা। ফরসা রংটা মায়ের। চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলে —দ্যাখো দ্যাখো আমি ফরসা। আমি ফরসা! রোগাও না মোটাও না, খাটোও না লম্বাও না। মায়ের চুলগুলো পরিচ্ছন্ন বাঁধা থাকবে। একটি গাছিও নিজের অবস্থান ভুলবে না। বিকেলবেলায় টান টান করে পরা স্নিগ্ধ শাড়ি এখন একটু আলগা। অনুচ্চ গলায় মা ডাকবে—কী রে? তোদের হল? খাবার দিচ্ছি। চানের পরে একেবারে সাফসুতরো মেজাজ, দাদা আদুরে গলায় বলবে, মাম্মি ডিয়ার, মাম্মি ডিয়ার, কী বেঁধেছ আজ আমার জন্যে? নিজের দেড় গালটা দাদা মায়ের প্রৌঢ় শিথিল গালে ঘষবে। বউদি হাসবে। ও তো জানে এই দেড়ো গালের ঘষাতে গাল কেমন ছড়ে যায়। গালের এই ছড়ে-যাওয়াটুকু ওরা শাশুড়ি-বউয়ে ভাগাভাগি করে নিয়েছে, রাগারাগি করে না! মায়েরটা ভোরের আলোর মতো। বউয়েরটা গোধূলির লালের মতো।

রাতের খাবারটা খুব সাদামাটা। টুটুলের ভালো-মন্দের কথা ভেবে বাছাই। কেননা এই সময়টাই একমাত্র টুটুল বড়োদের সঙ্গে খায়। প্রথমে একটা স্যুপ দেবে মা। এটা বউদি স্পেশ্যাল। কোনোদিন লাল টকটকে তাজা টোম্যাটোর, কোনোদিন হালকা চিকেনের জলের মধ্যে নুডলরা জড়ামড়ি করে শুয়ে থাকে। কোনোদিন আবার বর্ণহীন তরলের ওপর কমলা, সবুজ, সাদা সবজির লেসের কারু। ফুলো ফুলো রুটি থাকে, হালকা-সেঁকা পাঁউরুটি থাকে। তা ছাড়া হয়তো একটা মাছের স্টু। সকালে দাদা শুক্তো খেয়ে যায়নি, কি পোস্ত খেয়ে যায়নি। দাদার ভাগ বাটিতে করে বসানো থাকবে। গরম, কিন্তু জিভ ঝলসায় না। রাতের গাঢ় ঘুমে ঢলবার আগে এই কুসুমকুসুম গরম খানা।

খেতে খেতে সামনের দেয়ালে চোখ পড়ে যাবেই। সেখানে লম্বাটে একটা এচিং। শিব-পার্বতীর মুখের মুগ্ধ ডৌল, লম্বা টানা যামিনী রায় চোখ, আর পার্বতীর চিবুকে শিবের, শিবের কাঁধে পার্বতীর অজন্তা-আঙুল।

দেখতে দেখতে দাদা ফট করে হয়তো বলবে, আচ্ছা মা, আমাদের আর্টে পুরুষকেও এমন মেয়েলি করে আঁকে কেন বলো তো?

এই এদের তক্কো শুরু হল। দেশের যাবতীয় জিনিস—তার শিক্ষাদীক্ষা, শিল্পকলা, সংগীত-সাহিত্য, ইতিহাস-ঐতিহ্য—সব দাদা লেন্সের তলায় রেখে রেখে দেখবে। এটা কেন? ওটা কেন? সেটা কেন? যেন কোনো গোয়েন্দা-সংস্থা ওকে মাথায় দিব্যি দিয়ে রিপোর্ট দিতে বলেছে।

আমি কি অতশত জানি!–মা চট করে উত্তর দিতে চাইবে না। আসলে তর্কাতর্কি দিয়ে আবহাওয়াটা নষ্ট করতে চাইছে না। সারাদিনের মধ্যে এই একবারই তো।

তবু?

শুনেছি, সমঝদাররা বলেন আমরা বস্তু বা ব্যক্তি আঁকি না, ভাব আঁকি। এ ছবির মেজাজ খুব রোম্যান্টিক। দেখছিস না শিবের আঙুল আর পার্বতীর আঙুল একই রকম লীলায়িত।

তাই বলে শিবের মতো একটা জবরদস্ত পুরুষমানুষকে গোঁফ দাড়ি দেবে না। কী মিতালি, তুমি কিছু বলো!

বলব?–বউদি একটু একটু হাসবে।

বলতেই তো বলছি!

পুরুষের চোখ দিয়ে বিশ্ব দেখা তো, তাই তাদের যা ভালো লাগে তেমন করেই সব আঁকাজোকা গড়াপেটা হয়।

এই এক ফেমিনিস্ট কচকচি শুরু হয় তোমার।

বলছিলাম না তো সেইজন্যে। …বউদির চোখে অভিমান, একটু দুষ্টুমিও কি!

মা বলবে, মিতালি কিন্তু কথাটা খারাপ বলেনি। ভাববার মত। টুটুল মাছটা খাচ্ছিস না? বেছে দিয়েছি তো!

টুটুল আসলে এখন ঢুলছে। সারা দিন স্কুল, সারা বিকেল খেলা, সারা সন্ধে পড়া-পড়া খেলা আর খেলা-খেলা পড়া। চোখ টেনে টেনে জেগেছিল সুষ্ঠু বাবার জন্যে। বাবা, দিদু, মায়ের সঙ্গে একসঙ্গে বোদের টেবিলে, বড়োদের মতো করে খাবে। কিন্তু ওই গরমে রাত সাড়ে নটার চানটা তার সমস্ত স্নায়ু আলগা করে দিয়েছে। ঘুম এখন আঙুল বুলোচ্ছে তার কচি শরীরে। আয় ঘুম, যায় ঘুম।

সব ভালো, সব সুন্দর এদের। দাদার এই প্রশ্নগুলো, যখন-তখন ওই খারাপ লাগা, সংশয়, আর অসন্তোষ বাদে। কেমন ভয়-ভয় করে আমার। এত বিরক্তি ওর কীসের। বাবার কথা ভেবে?

কোনোদিন হয়তো হন্তদন্ত হয়ে বাড়ি ফিরেই বলবে, পুরো দেড় ঘন্টা জ্যাম একটা মিছিলের জন্যে, ভাবতে পারো! গাড়িগুলো চলছে কোনো লেন-টেনের বালাই-ই নেই। আমার বনেটে আজ প্রায় ভিড়িয়ে দিয়েছিল এক ব্যাটা ট্যাক্সি। হঠাৎ দেখলে মনে হবে গোটা শহরটাই উন্মাদ হয়ে গেছে। সদ্য পালিয়ে এসেছে। কোনো পাগলাগারদের গারদ বেঁকিয়ে।

খামোকা রাগ করে নিজের ক্ষতি করছ। এটা রিয়্যালটি! মেনে নাও।বউদি বলবে।

রিয়্যালিটি নয়। অন্য অনেক সভ্য দেশ আছে পৃথিবীতে। এটাই অসভ্যতম, বর্বরতম দেশ। এগুলো এই দেশেরই রিয়্যালিটি। তোমার আর কী! বাড়িতে বসে হাওয়া খাচ্ছ।

বাঃ, আমি বুঝি টুটুলকে নিয়ে স্কুল আসাযাওয়া করি না! বাজার হাট, দোকান, ব্যাংক, পোস্টাপিস এগুলো কি উড়ে উড়ে হয়?

হুঁ। …দাদা কাগজটা তুলে নেয়।

কান পেতে শুনি দাদা ফোঁসফোঁস করছে। শুনতে পাই মায়ের বুক ঢিপঢিপ করছে। আস্তে ধীরে ওঠে মা। চায়ের কাপটা নামিয়ে রাখে। তারপর পেছন দিকের কমলা পরদাটায় কান ধরে দুদিকে সরিয়ে দেয়। ছেলের রাগে মায়ের রাগ, সেই ঝাল ঝাড়ছে মা পর্দার ওপর। পরক্ষণেই বুঝতে পারি শুধু রাগ নয়। গুঢ় উদ্দেশ্য আছে এর পেছনে। কেননা, পর্দা সরাতেই ঝাঁপিয়ে আসে গ্রীষ্ম-সকালের এখনও তপ্ত না-হওয়া দক্ষিণে হাওয়া, অনেক নীচে বিস্তৃত সবুজের মধ্যে কৃষ্ণচূড়ারা ঝলমলে হাসি হাসতে থাকে। এক ঝাঁক টিয়া খিরিশ গাছটার মাথা থেকে সবুজ বিদ্যুতের মতো দাদার চোখের আড়াআড়ি উড়ে যায়। আজ ওদেরও অফিসের বেলা হয়ে গেল।

কেমন স্তিমিত হয়ে যায় দাদার মেজাজ। চুপচাপ। আমি বুঝি কৃষ্ণচূড়ার সিঁদূরে লাল চারদিকের সবুজে মাখামাখি হয়ে সোজা ঢুকে যাচ্ছে ওর বুকের ভেতরে। টিয়াগুলোর বিদ্যুৎগতি ওর রক্তে ভালোলাগার ঝড় তুলেছে, চেয়ারে মাথা কাত করে বাবু বলে ওঠেন, সত্যি মা, এখান থেকে মনেই হয় না এই বদমাশ, ঠগবাজ, অসভ্য, নোংরা দেশটাতে আছি। ইউরোপে এক দেশ থেকে অন্য দেশে যেতে হাইওয়ের ধারে কাছে রেস্ট হাউসের জানলা দিয়ে তাকালে এইরকমটাই দেখা যায় হয়তো! অন্তত ফটোগুলো তো তাই বলে।

কৃষ্ণচূড়াও?–কেমন চাপা অভিমান মায়ের গলায়।

ওঃ হো হো, মাম্মি ডিয়ার, না কৃষ্ণচূড়া নেই, নেই তোমার ফেভারিট সপ্তপর্ণী। কোনো ফুল-টুল বড়ো বড়ো গাছের মাথায় দেখা যায় বলেও জানি না। ট্রপিক্যাল নয়তো। বেশির ভাগই পাতাঝরা গাছের বন। পাইন আছে, ফার, ওক, বার্চ, মেপল কতরকম। গাছেদের বিউটিও খুব কম নয়।

টুটুল কলকলিয়ে ওঠে, বাবা, ওদের টিয়া আছে? আয়রে আয় টিয়ে, নায়ে ভরা দিয়ে?

মনের দিগন্ত হাতড়ায় দাদা। চুপ করে থাকে। অন্যমনস্ক।

বউদি চায়ের কাপগুলো তুলে নিয়ে যায়। মা ছেলে কাগজের দুটো পাতা মুখের সামনে ধরে বসে থাকে। কী অত পড়ে ওরা? দূর বাবা!

টুটুল তার ট্রাইসাইকেলে চড়ে ঘর থেকে বারান্দা, বারান্দা থেকে ঘর ঘুরে বেড়ায়। স্থূপীকৃত খেলনা-গাড়িগুলোকে ছত্রভঙ্গ করে তার ওপর দিয়ে সাইকেল চালিয়ে নিয়ে যায়। হাততালি দিয়ে হেসে ওঠে, অ্যাক্সিডেন্ট! অ্যাক্সিডেন্ট!

বাঁকা চোখে ছেলের দিকে তাকায় দাদা। ভেতর থেকে বউদির গলা ভেসে আসে, টুটুল, চান করবে এসো। স্কুলের দেরি হয়ে যাবে-এ-এ।

হঠাৎ দাদা চেঁচিয়ে ওঠে, তিনটে রেপ! দুটো তার মধ্যে গণধর্ষণ, বুঝলে মা?

মা চুপ।

এ কী? এতগুলো অ্যাক্সিডেন্ট একেবারে শহরের মাঝ-মধ্যিখানে? ওনারা একে অন্যকে ওভারটেক করছিলেন। গেছে একটি কলেজ-তরুণী, একটা বাচ্চাছেলে আর তার মা, ছেলেকে স্কুলে দিতে যাচ্ছিল—এই তোমার মিতালি আর টুটুলের মতো।

খোকন!

মা, এটা পড়েছ? গ্রামকে গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে, এক রাজনৈতিক দল অন্য দলের সমর্থকদের। পুরো গ্রাম পুড়ে ছাই। এক ঠাকুমা আর তার চার বছরের নাতি বেগুনপোড়া–ছবি দিয়েছে ঠিক তুমি আর তোমার নাতির মতন।

মা থরথর করে কেঁপে ওঠে।

একটু চুপচাপ। তারপর দাদা আশ্চর্য হয়ে বলে ওঠে, বালিগঞ্জের বহুতলের নতলার ফ্ল্যাটে দম্পতি খুন? বাইপাসে জলার ধারে আবার জোড়া লাশ? মুণ্ডু নেই মা!

তুই চুপ করবি।-মায়ের মুখ লাল হয়ে গেছে কষ্টে, ভয়ে, হতাশায়।

চুপ করব! চুপ করব কেন? রাস্তায় যেখান সেখান থেকে বাচ্চা, যুবক, প্রৌঢ়, তুলে নিয়ে যাচ্ছে—হয় প্রতিহিংসা নয় যানসম। আরও শোনো-আবার খ্রিস্টান খুন। নেতারা বলছেন—এ গুন্ডা বদমাশের কাজ। গুন্ডা বদমাশ বেছে বেছে খ্রিস্টানই শিকার করছে—অ্যাকর্ডিং টু দেম। হোটেলের ব্যাপারটা পড়লে? মিনিস্টাররা মিনি মাগনা খেয়ে আর খাইয়ে হোটেলটাকে লাটে তুলে দিয়েছে। বিক্রি করতে চাইলে কর্মচারীরা ধর্মঘট করেছে, বলছে—বিক্রি করতে দেব না, কাজ-কাম করব না, বসে বসে খাব—এটাই মানুষের অধিকার।

বলেছে! এই কথা!

বেসরকারিকরণ করতে দিচ্ছে না, সব কটা দলের ট্রেড ইউনিয়ন তাদের পেছনে। এর আর কী মানে দাঁড়ায়?—কাগজটা হাত থেকে ছুড়ে ফেলে দেয় দাদা, যেন এভাবেই এইসব বিশৃঙ্খলা, খুন, দুর্ঘটনার সুরাহা হবে। মুখে তার আক্রোশ।

অন্য দেশও আছে মা। সভ্য, বাধ্য, অবর্বর। মা কেমন গোঁয়ারের মতো বলে, ওখানে স্কুলে বাচ্চারা বন্দুক ছুড়ে ছুড়ে টিচার আর ক্লাসের বন্ধুদের মেরে ফেলছে। শুনিসনি? ভয়ানক নয়?

দাদা যেন শুনতেও পায়নি। বলে, সরকারি হাসপাতালের ক্যাম্পাসে এখন চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের বেআইনি কলোনি। হাসপাতালের তার থেকে হুক করে তাদের আলো, পাখা, হিটার সবই চলছে। রোগীদের খাবার থেকে চুরি করে ডেইলি খাওয়াটাও হয়ে যাচ্ছে মা। বিশাল অঙ্কের ইলেকট্রিক বিল মেটাতে পারছে না কতৃপক্ষ, ওদিকে সদ্যোজাত বাচ্চাকে কুকুরে তুলে নিয়ে যাচ্ছে, শিশু পাচার হচ্ছে, এক বেডে তিনজন রোগী। ময়লা পরিষ্কার হয় না ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে, সে সময়টা ওয়ার্ডবয়রা অবৈধ প্রেমের রোমাঞ্চ উপভোগ করে। সরকারি হাসপাতালের প্রোফেসর কাম চিকিৎসক স্বয়ংই চিকিৎসা পাননি। খবরট কদিনই…

ওদের মেয়েদের বাবারা পর্যন্ত অ্যাবিউজ করে… মা বলে।

মাইনর-রেপ তো এখানে জলভাত এখন। কেউ অবাক পর্যন্ত হয় না—দাদা বলে।

ওদের বাবা-মা ডিভোর্স হলে বাচ্চাকে রাস্তায় ফেলে দিয়ে যায়—মা।

খেতে দিতে না পেরে এখানে বাবা-মা ছেলে বিক্রি করে দিচ্ছে, নিজের হাতে খুন করছে-দাদা।

ওদের প্রেসিডেন্ট নিজের অফিসে বসে…

একটা ক্রুদ্ধ চিৎকার করে ওঠে দাদা—কী? কী বলতে চাও তবে তুমি! খুঁজে খুঁজে খারাপগুলো বার করছ কেন? মনুষ্যত্বের এই ইতর সর্বাত্মক অপমানের সাফাই গাইছ। মিনিমাম সিকিয়োরিটি নেই, মিনিমাম সততা নেই, মিনিমাম শিক্ষা শৃঙ্খলা নেই। এদের সাফাই! অন্য দেশেও আছে, কিন্তু সেগুলো ব্যতিক্রম। এখানে সেটাই রীতি! তুমি স্বীকার করো, বা না করো।

বউদি ভেজা তোয়ালে হাতে ছুটে আসে।–কী হল! চাঁচাচ্ছ কেন? এ কী মা! তুমি কাঁদছ?

টপ টপ করে জল পড়ছে মায়ের চোখ দিয়ে। ধরা গলায় বলল, এত কথা কেন বলিস? তুই তো জানিস ওরা তোর বাবাকে ফিরিয়ে দেয়নি। গলা বন্ধ হয়ে যায়, আর কথা বলতে পারে না।

দেখো তো কী করলে? বউদি ধমকে ওঠে।

দাদা বলে, সরি মা। এক্সট্রিমলি সরি, কেঁদো না, আমি চানে যাচ্ছি। তোয়ালে কাঁধে পেলে উঠে গেল দাদা।

হ্যাঁ বাবা। বাবার কথা কি আর দাদার মনে আছে? সে তখন কত ছোট্ট! এই টুটুলের থেকে একটু বড়ো হবে হয়তো। মনেও নেই, অভাববোধও নেই আর। মা একাই তো ছেলেকে মানুষ করে তুলল। আর কত অল্প বয়স থেকেই দাদা সংসারের ভার নিতে শিখল। কোথায় গেল বাবা। কত দিন মানুষটাকে দেখি না। শুধু মনের গভীরে বিশ্বাস করি, সে আছে, কোথাও আছে। একদিন না একদিন আসবে। চৌকো কাঠামোর জোয়ান মানুষটা। যেমন বুদ্ধি তেমন জেদ। বিজ্ঞানী ছিল। পরমাণু বিজ্ঞান। মানুষটা ছিল এমনিতে খুব আমুদে, মিশুক। মায়ের সঙ্গে কত মশকরা, দাদার সঙ্গে কত খেলা। যেসব সহকর্মীরা বাড়িতে আসত তাদের সঙ্গেও কাজকর্মের ফাঁকে ফাঁকে ঠাট্টা তামাশা চলত। মুখটা আর ভালো করে মনে পড়ে না। চোখ, মুখ, নাক কেমন আবছা হয়ে গেছে। কিন্তু ব্যক্তিত্বটা মনে আছে। ঝকঝকে, ধারালো, কী আত্মবিশ্বাস। জানবার, জয় করবার কী অদম্য ইচ্ছা! জীবনের সব যুদ্ধ যেন জয় করে ফেলবেই।

বাগবাজার থেকে এখানে আসার পেছনেও তো সেই একই জেদ! একই উদ্যম। তা নয়তো তিন পুরুষের সেই বিরাট বাড়ি, তার উঁচু উঁচু ঘর, লম্বা-চওড়া দালানেও তাকে ধরল না কেন? কেন বাবা এখানে চলে এল, ছোটোভাইকে নিজের অংশটা ছেড়ে দিয়ে! এখানে নাকি বাবার একলার স্টাডি, একলার লাইব্রেরি, যতক্ষণ খুশি নির্বিঘ্নে কাজ করতে পারে। আর ইনস্টিট্যুটের ল্যাবরেটরি। এখান থেকে মাইল খানেকের মধ্যে। আমি জানি, এগুলো বাবার নিজের অর্জন। মুখে চুরুট ঝুলিয়ে বাবা ইনস্টিটুটে বেরিয়ে যাচ্ছে, ছুটির দিনেও কিছু মনে পড়েছে, বেরিয়ে যাচ্ছে—এমন কত দেখেছি। ছোটোখাটো সীমাবদ্ধ কাজ, সীমাবদ্ধ সময় নিয়ে বাবা সন্তুষ্ট থাকতে পারত না। নতুন নতুন জ্ঞান আর নিত্যনতুন উদ্ভাবনের জন্য পৃথিবীর শেষ প্রান্তে যেতেও বাবার আপত্তি ছিল না। তাই, সে ডাক যখন এসে পৌঁছোল, তাকে আর কিছুতেই আটকে রাখা গেল না। মায়ের নিজের বাবা অসুস্থ, মা যেতে পারবে না। দাদা সবে ভালো স্কুলে ভরতির সুযোগ পেয়েছে, তার কথাও ভাবতে হয়। তা ছাড়াও, বাবার কাজের যে ক্ষেত্র সে এক গোপন রণক্ষেত্রবিশেষ। সেখানে দারা-পুত্র-পরিবারের খুব একটা স্থান নেই। তবু বাবা যাবেই।—চার-পাঁচটা বছর দেখতে দেখতে কেটে যাবে—বাবা মাকে বোঝাল। ছেলেকে আদর করল। তারপর চলে গেল। সেই চার-পাঁচ বছর এখন বিশ বছরে দাঁড়িয়েছে। এখন আর তার কোনো খবরই নেই। প্রথম প্রথম ফোন আসত, পিকচার পোস্টকার্ড আসত, আসল ঠিকানা নয় একটা বিশেষ ঠিকানায় চিঠি দিতে হত বাবাকে। বাবার উপায় ছিল না নিজের গোপন ঠিকানা জানাবার। তারপর একদিন সব চিঠি, সব খবর আসা বন্ধ হয়ে গেল। মানুষটা যে কোথায়, কেমন আছে, সেটা আর জানাই গেল না। মা সে সময়ে কাকাকে নিয়ে কনসুলেটে ধরনা দিয়েছে। খরচপত্তর করে পাঠিয়েছে সে মুলুকে। কিন্তু কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। বাবা নাকি সে দেশ ছেড়ে চলে গেছে। কোথায় গেছে? জানে না, কেউ জানে না।

আস্তে আস্তে মা শান্ত হয়ে গেল। সমস্ত কর্তব্য করে যায় নিখুঁতভাবে। কিন্তু মনটার নাগাল আর কেউ পেল না। এত লোক আসে এত লোক যায়, মায়ের মনে কোনো দাগ পড়ে না। ঘনিষ্ঠ আত্মীয়রা বলল, ভুলে যাও তাকে। অনেকে বলল সে নিশ্চয় প্রতিরক্ষার কিছু গোপন ব্যাপারে জড়িয়ে পড়েছে। আর তাকে আসতে দেবে না। একটা বিশাল শক্তিশালী দেশ, নিয়তির মতো। কঠিন দেয়াল এক। সে দেয়ালে মাথা ঠুকেও মা কিছু পেল না। মায়ের এখন একমাত্র দুর্বলতা ছেলে। ছেলেকে নিয়েই বেঁচে আছে মা। আঁকড়ে থাকেনি কোনোদিন। দাদা যেমন ইচ্ছে পড়াশোনা করেছে, চাকরি নিয়েছে, যেমন ইচ্ছে বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে মিশেছে। কিছুতেই বাধা দেওয়া নেই। খালি ওই একটা নিষেধ। বিদেশ যাবে না। ইউরোপ হোক, অস্ট্রেলিয়া হোক, কোথাও না। আর মার্কিন দেশ! নাম শুনলেই মায়ের মুখ ছাইয়ের মতো সাদা হয়ে যায়।

দাদা বিয়েও তো করল নিজের পছন্দে। এসব নিয়ে সাধারণত কত মনকষাকষি হয়ে থাকে। সেসব কিছু হল না। বউদি মানুষটাও কপালগুণে বুঝদার। তবে হাসিখুশি, উচ্ছল, মায়ের ঠিক উলটো।

প্রথম প্রথম বউদিকে খুব অপ্রতিভ হতে দেখেছি। মার কি আমাকে পছন্দ হয়নি?—দাদাকে জিজ্ঞেস করেছে।

দূর, দাদা বলেছে,–মায়ের কথা তো তোমাকে বলেইছি। তুমি তোমার মতো থাকবে। কিন্তু, বললেই কি আর তা পারা যায়। কোনো কারণে খিলখিল করে হেসে উঠেই বউদি

থতমত খেয়ে চুপ করে যেত। যেন কত অপরাধী!

একদিন মা আর বউদি খেতে বসেছে, মা হঠাৎ বলল, মিতা তোমার কি শরীর খারাপ?

না তো!

তবে মন খারাপ?

না মা।

আমাদের মা-ছেলের সংসারে কোনো সুর ছিল না। রং ছিল না মিতা। তুমি সেই রং আর সুর এনেছ। তোমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধব নেই?

আছে তো!

তো তাদের একদিন ডাকো না, খাওয়াও, আড্ডা জমাও, হাসি-গান হইহল্লা।

মা সেদিন নিজে হাতে খাবারদাবার করল। বউদি ঘর গুছোল, ফুলটুল সাজাল। সেদিন দেখলাম, মা কত সহজে সব করছে। আড়ালেও থাকল না, ওদের মাঝমধ্যিখানেও রইল না, কিন্তু দেখলাম—কিছুই ভোলেনি মা, হাসি, গল্প, গান কিছু না।

বন্ধুরা তো উচ্ছসিত! সবাই চলে যেতে বউদি হঠাৎ মায়ের ঘরে এসে তার কোলে মাথা রাখল, দু-হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল, কোথায় এতদিন লুকিয়েছিলে মা!

বউদির চুলে হাত বুলিয়ে মা বলল, আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলেদেখতে আমি পাইনি…

তারপর ধীরে ধীরে এদের বাড়ির স্বভাবে একটা পরিবর্তন এল। মা-ও যেমন একটু খোলামেলা, হাসিখুশি হল, বউদিও রইল না আর অতটা হুল্লোড়ে। চমৎকার একটা ভারসাম্য আপনা থেকেই এসে গেল সংসারে। আর টুটুল আসতে তো সব কিছুই অন্যরকম। টুটুলের সঙ্গে মায়ের যত খেলা, যত গল্প-বলা, যত গান, যতেক আহ্লাদ। বাবা একেবারে হারিয়ে গেল।

জুন মাসের সেই শুক্রবারটা? উঃ! স্পষ্ট মনে পড়ে। দাদা যেমন বেরিয়ে যায়, গিয়েছিল। বউদি যেমন বাজার-হাট-ছেলের স্কুলের জন্যে বেরোয়, বেরিয়েছিল। অতিরিক্তের মধ্যে মা সেদিন দশটা সাড়ে-দশটা বাজতেই বাইরের পোশাক পরে ফিটফাট হয়ে গেল, ব্যাগের মধ্যে কীসব কাগজপত্র ভরল, থলির মধ্যে ছাতা নিয়ে বেরিয়ে গেল। মা যে একেবারে বেরোয় না তা নয়। বাজারেও যায়। দরকার হলে টুটুলকে আনতেও যায়। কিন্তু নিয়মিত নয়। সেদিন মা টিপটপ চুল বেঁধে, হাতে ব্যাগ, যেন অফিস যাচ্ছে।

তখন সন্ধে পেরোব পেরোব করছে, মা ফিরল। মুখ-চোখ ক্লান্ত। হতেই পারে, যা গরম! বউদিও তাই বলল, মা তোমার রোদ লেগে যায়নি তো।

মাথা নাড়ল মা। কাপড় বদলাল না। মুখ হাত ধুতে যেন ভুলে গেছে। নিজের ঘরেই বসেই রইল—ভূতের মতো।

বোমটা ফাটল রাত্তিরবেলায়। দাদা অফিস থেকে এসে সোজা মায়ের ঘরে।

এখনও এমনি করে বসে! মা তোমার টাকাটা কি ছিনতাই টিনতাই হয়ে গেল নাকি?

এফ. ডি. টা তুলতেই তো গিয়েছিলে?—বউদি জিজ্ঞেস করল।

মা নিশ্বাস ফেলে ক্লান্ত গলায় বলল, সারা দুপুরটা বড্ড হয়রান হয়েছি রে। একবার বলে আগাম নোটিশ দিতে হবে, দিয়েছি বলে তার কপি দেখালে বলে আমাদের ফাইলে তো পাচ্ছি না, তারপরে বলে হলুদ ফর্ম লাগবে একটা, এখন নেই। পরে আসুন। আবার বলে, ওটা অটোম্যাটিক্যালি আবার ফিক্সড হয়ে গেছে। শেষকালে একজন হঠাৎ বলে উঠল—এতগুলো টাকা তো পাচ্ছেন মাসিমা, সবটা একা খাবেন? বোনপোদের একটু খাওয়াবেন না? তারপর অনেকে মিলে শুরু করল, মাসিমা কত ভালো, কত ধনী, কত উদার, ঈশ্বরের একেবারে কাছের লোক —এই করে হাজার পাঁচেক টাকা নিয়ে নিল।

পাঁচ হাজার। তুমি দিলে?

মা বলল, টাকাটা তো গেলই। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা ভদ্রলোকের ছেলে সব, অমন একটা জায়গায় কাজ করছে যখন শিক্ষা-টিক্ষাও আছে, পরিষ্কার জামাকাপড় পরা স্বাভাবিক দেখতে। কিন্তু আমাকে যখন ঘিরে ধরেছিল, মনে হচ্ছিল একদল নেকড়ে আমার ঘাড়ের ওপর নিশ্বাস ফেলছে। হিংস্র নখদাঁতগুলো যেন আস্তিনের তলায়, ঠোঁটের পেছনে লুকিয়ে রেখেছিল, ক্রমশই কাছে ঘেঁষে ঘেঁষে আসছিল, মাসিমা-মাসিমা করে। টাকার জন্যে এক্ষুনি যেন আমার গায়ে হাত বুলোতে শুরু করবে। খোকন, ঘেন্নায় আমি যে প্যাকেটটা হাতে উঠেছে দিয়ে এসেছি। আমার কেমন গা ছমছম করছে।

দাদা শান্তভাবে বলল, তোমার আজ করছে। আমার অনেক দিন ধরেই করছে। মা। যে কোনোদিন দেখবে এখানে মাস মাইনেটা নিতে গেলেও ঘুষ দিতে হচ্ছে। হয়তো তুমি ঠিকই বলো। সবাই এমন নয়, কিছু কিছু। কিন্তু এই কিছু কিছু-ই সব কন্ট্রোল করছে।

দাদা যদি প্রচণ্ড রাগারাগি করত, ফেটে পড়ত, সে একরকম হত। কিন্তু আজ দাদা অসহ্য গম্ভীর, যেন একটা অন্ধকার, দুর্ভেদ্য পাহাড়ের মতো। আমার ভেতরটা থরথর করে কেঁপে উঠল। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। এইটাই আসল বোঝ। আমি স্পষ্ট বুঝি।

কয়েকদিনের মধ্যেই শুরু হয়ে গেল প্রচণ্ড ব্যস্ততা। রেজিগনেশন, অ্যাপয়েন্টমেন্ট, পাসপোর্ট, ভিসা, কেনাকাটা। সে এক হুলুটথুলুট কাণ্ড। এরই মধ্যে মায়েতে ছেলেতে চলেছে দড়ি টানাটানি। মা-ও কিছুতে যাবে না। ছেলেও কিছুতেই তাকে ছাড়বে না। মা বলল, আমি নিজের মতো থাকব পোস্টঅফিসের টাকাটার সুদেই আমার চলে যাবে। হঠাৎ কোনো দমকা খরচ হলে তুই তো রইলিই। আমাকে আর টানাটানি করিস না।

দাদা বলল, আমাদের ছেড়ে, টুটুলকে ছেড়ে তুমি থাকতে পারবে?

খুব কষ্ট হবে, কিন্তু পারব।

খুব কষ্ট হবে! তা সেই খুব কষ্টটা করবে কেন শুধু শুধু? এত জেদ কীসের? এত জেদ ভালো নয় মা। আচ্ছা, তুমি না হয় পারলে। টুটুল! টুটুল পারবে?

এতক্ষণে মায়ের চোখ ফেটে জল বেরিয়ে এল। শিশুর মায়া বড়ো মায়া! মা ধরা গলায় বলল, বাড়ন্ত বাচ্চা, ভুলতে দেরি হবে না দেখিস!

ভোলবার আগেই যদি মনের কষ্টে ওর কঠিন কিছু হয়?

শিউরে উঠে মা টুটুলকে বুকে টেনে নিল।

আর এই মুহূর্তে ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া টুটুলটা তার পাকা কথার ঝুড়িটা নামিয়ে দিল। মাকে আঁকড়ে ধরে কেঁদে উঠল, দিদু, ও দিদু তোমাকে ছেড়ে আমি বাঁচব না!

কোথা থেকে যে এসব কথা শেখে এরা! কিন্তু ও তো শুধু পাকা কথাটা নলেই ক্ষান্ত হয়নি, ফুপিরে ফুঁপিয়ে হৃদয়বিদায়ক কান্নাও কাঁদছে। অতএব মায়েরও পাসপোর্ট, ভিসা, টিকিট হয়, ওদের লাগেজের সঙ্গে মায়ের লাগেজও যোগ হয়। তারপর একদিন রাত নটা নাগাদ শক্ত করে টুটুলের হাত মুঠোয় নিয়ে একখানা টাটা সুমোয় উঠে যায় মা। দাঁতে দাঁত চেপে, ঠোঁটে ঠোঁটে চেপে। একবারও পেছন ফিরে তাকায় না। বউদিই বরং দেখি চোখ মুছছে, আবার জল পড়ছে আবার মুছছে। দাদার মুখটা কঠিন, কিন্তু শোকার্ত। ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের প্লেনটা উড়ে যায়।

চিৎকার করে উঠতে চাই। কিন্তু ওরা কি শুনতে পাবে? মূৰ্ছিত হয়ে পড়ি—ওরা দেখতে পায় না। যাক, তবে চলেই যাক। দেয়ালে দেয়ালে ছাতলা জমুক, মেঝেতে পুরু ধুলোর আস্তরণ। পোকামাকড় আরশোলা ছুঁচো ইঁদুরের নিরঙ্কুশ রাজত্ব হোক ওদের সুখের সংসার।

বারান্দা দিয়ে এখনও দেখতে পাই। রবীন্দ্রসরোবরে স্টেডিয়ামের ট্র্যাকে দৌড়োচ্ছে দলের পর দল খেলাপাগল কিশোর। সবুজের ছাপের ওপর খালি গায়ে ফুটবলে শট মারছে, ধবধবে পোশাকে কেতাদুরস্ত ক্রিকেট শানাচ্ছে। কবাড়ি খেলছে। লেকের জলে গ্রীষ্ম-বিকেলের পড়ন্ত আলোয় শুরু হচ্ছে রোয়িং, ওদের মধ্যে টুটুলকে কোনোদিন দেখতে পাব কি? ঘোর এপ্রিলে লাল হয়ে ফোটে কৃষ্ণচূড়া, রঙ্গন। রাংচিতার পাতায় আলো ঝলকায়, শীতভর ফুটতে থাকে মরশুমি ফুল। রাত জমিয়ে জলসা হয়, দূরের বেতারে ভেসে আসে নতুন গায়কের নতুন গান, পুরোনো গায়কের মন কেমন-করা পুরোনো গান, হয়ে যেতে থাকে বইমেলা, শিল্পপ্রদর্শনী। আর সারাবছর ধরে খিরিশ গাছ থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে সবুজ বিদ্যুৎরেখা ঝলসে, আপিসে বেরোয়, আপিস থেকে ফেরে স্বদেশি টিয়ার ঝাঁক। দেখতে পাবে না। শুনতে পাবে না মা, দাদা, বউদি।

ঝুল জমেছে সিলিংয়ের কোণে কোণে। মাকড়সারা অদ্ভুত চতুরালি দেখিয়ে জাল বুনছে, পোকা ধরছে, চুষে ছিবড়ে করে ফেলে দিচ্ছে। শুকনো পোকা আর নধর মাকড়সায় ক্রমে ভরে যায় সারা সংসার। কেউ নেই যে সে ঝুল ঝাড়বে, কেউ নেই যে কীটনাশক ছেটাবে।

তারপরে একদিন গুড়গুড় করে মেঘ ডাকতে থাকে। কালি নীলে ঢেকে যায় আকাশরেখা, প্রলয়ংকর ঝড় ওঠে। দড়াম দড়াম করে আছাড় খেতে থাকে বড়ো বড়ো গাছ। এগারো তলার ওপরেও শুনি সমুদ্রের হুহুংকার। দানব-হাওয়া ধাক্কা দিতে থাকে। দমাদ্দম শিলাবৃষ্টি হয়, আর শিলার ঘায়ে হুড়মুড়হুড়মুড় করে ভেঙে পড়তে থাকে জানলার বারান্দার কাচ। বাস, আর বাধা কী? পরিত্যক্ত বাড়ি। বাইরের ঝড় নির্বিবাদে ঢুকে পড়ে অন্দরে। তাণ্ডব চলতে থাকে। মিছিলের ডাক, লাঠিচার্জ গুলির আওয়াজ উজাড় হয়ে যাচ্ছে নিঃস্ব মানুষ। জলে বিষ, আলো নেই, ভাইরাসের পর ভাইরাস আক্রমণ করতে থাকে লক্ষ লক্ষ মানুষকে, এ. সি ঘরে চিংড়ি মালাইকারি আর রেশমি কাবাব, কুলচা আর কুলপির মিটিং, নতুন নতুন দুর্ঘটনা, নতুন নতুন ক্ষতিপূরণ, নতুন নতুন কর। রাজার তোষাখানার কৃষ্ণগহ্বর মরণটানে টেনে নেয় সব, চিহ্ন রাখে না। শুয়ে থাকি। কাদায়, জলে, রক্তে, ক্লেদে থাবা রেখে শুয়ে থাকি। কত দিন, কত মাস, বছর যায়। মাঝে মাঝে ঝনঝন করে ফোন বেজে ওঠে। ওরা কি ফিরছে? ওরা কি আমার খবর নিচ্ছে? নাঃ, এ রং নাম্বার। তারপরে একদিন দরজার বেল বাজে। কে এসেছ ভুল করে। এ ঠিকানায় কেউ থাকে না।

কেন আমাকে বিরক্ত করো? কী আশ্চর্য! দেখি আস্তে আস্তে শব্দ করে খুলে যাচ্ছে দরজা। আমার রোঁয়া ফুলে উঠেছে, গায়ে কাঁটা, বুঝি নির্ভুল আঙুলে সুইচ টিপছে কেউ। বাতি জ্বলে ওঠে, ঝুল-জমা, ঝাপসা আলো। সেই আলোয় দেখি—বিকৃতদেহ দীনহীন ভিখারি এক। ক্লান্ত, বৃদ্ধ, যেন কত দেশান্তর, কত বিপর্যয়ের সমুদ্র পেরিয়ে এল, প্রত্যাশায় আকুল চোখ-ধুলো ময়লা, আবর্জনা সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে। একটার পর একটা দরজা খোলে, জানলা খোলে। আমি ফিসফিস করে বলি, বড্ড দেরি করে ফেলেছ বাবা, বড্ড। তোমার যদি এতদিনে সময় হল, এদের সময় ফুরিয়ে গেছে। এখানে আর কেউ তোমায় চিনতে পারবে না। ফিরে যাও যে সমুদ্দুর থেকে এসেছিলে সেইখানে। কিংবা এসো, এই ধবংসস্তূপে, এই সর্বনাশে, তুমি আর আমি, আমি আর তুমি ওতপ্রোত হয়ে শুয়ে থাকি।

No comments