ভূতচরিত – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়
ভূত নেই বলি কী করে?
এতদিন বুক ফুলিয়ে বন্ধুবান্ধবদের আসরে, সভা-সমিতিতে বলে এসেছি, ভূত শুধু মানুষের ভয়ের ছায়া, দুর্বল মানুষের অসুস্থ কল্পনা।
ভূতে বিশ্বাসী কয়েক জন বন্ধু তর্ক করেছে।
পৃথিবীতে তোমার চেয়ে অনেক পণ্ডিত, বিজ্ঞ লোকেরা ভূতের অস্তিত্ব স্বীকার করেছেন। তুমি চিৎকার করে সে অস্তিত্বে ফাটল ধরাতে পারবে না। সবিনয়ে তাদের বলেছি তাই, পণ্ডিতদেরও ভুল হয়, বিজ্ঞজনেরা প্রমাদমুক্ত নন। বিখ্যাত চিকিৎসকের ভুলের জন্য কত রোগী খতম হয়েছে, প্রথম শ্রেণির উকিলদের ভুলে কত নিরীহ লোক ফাঁসির রজ্জু গলায় পরেছে, তার ঠিক আছে। কাজেই তোমাদের ও প্রমাণ আমি মানতে রাজি নই। যতক্ষণ না আমি নিজের চোখে দেখছি।
বন্ধুরা মারমুখী হয়ে উঠেছে।
‘তার মানে তোমার স্থূল দেখাটাই আসল। তুমি নিজের চোখে—’
তাদের বাধা দিয়ে বলেছি—
‘তোমরা কী বলবে জানি! আমেরিকা আমি দেখিনি বলে, আমেরিকা নেই? আমার ঠাকুরদার বাবাকে আমি চাক্ষুষ দেখিনি, কাজেই তাঁরও অস্তিত্ব নেই, এই তো? কিন্তু আমেরিকা ফেরত অনেক লোকের সঙ্গে আমার পরিচয় আছে। তারা আমেরিকা দেখেছে। আর ঠাকুরদাকে আমি দেখেছি, তাই বৈজ্ঞানিক কারণে তাঁর বাবাও নিশ্চয় ছিলেন। কিন্তু তোমরা কেউ ভূত দেখেছ? এমন কাউকে আমার সামনে হাজির করতে পারো, যিনি স্বচক্ষে ভূত দেখেছেন?’
বন্ধুরা আমার মতন নাস্তিক সম্বন্ধে হতাশ হয়ে তর্ক বন্ধ করেছে।
নাস্তিক। কারণ তাদের মতে, ভূত যে মানে না, ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্বন্ধে তার বিশ্বাস না থাকাই স্বাভাবিক।
আমি নিজে কিন্তু কম চেষ্টা করিনি।
যেখানে ভূতের গন্ধ পেয়েছি, সেখানে ছুটেছি। পোড়ো বাড়িতে, জলা জায়গায়, তেপান্তরের মাঠে, গোরস্থানে, শ্মশানে, কিন্তু ভূতের দেখা পাইনি।
এমনই করে স্কুল জীবন কাটল। কলেজ জীবনের কিছুটা।
একদিন ক্লাস ছিল না। কমনরুমে বসে গল্প করছিলাম। নানা ধরনের কথাবার্তা। দেশবিদেশের কথা, চাকরির অবস্থা, সাধারণভাবে মানুষের মধ্যে ধর্মহীনতার প্রসার! শেষকালে শুরু হল ভূতের কাহিনি।
আমার এক সতীর্থ বলল, ‘মানুষ যত সভ্য হচ্ছে, শহরের প্রসার হচ্ছে, ততই ভূত সরে যাচ্ছে।’
আমি হেসে বললাম, ‘ভূত ছিলই না কোনোদিন, কাজেই সরে যাবার প্রশ্ন ওঠে না।’
আমার কথা শেষ হবার আগেই গুরুগম্ভীর কণ্ঠ কানে এল।
‘বলো কী হে, ভূত নেই?’
চমকে ফিরে দেখলাম।
একটু দূরে আর একটা চেয়ারে একজন ছাত্র। বয়সে আমাদের চেয়েও বড়ো। একমুখ গোঁফ আর দাড়ি। চোখে পুরু পাওয়ারের চশমা। জানতাম ছাত্রটির নাম আনন্দমোহন। দর্শনে এম.এ. পড়ে।
‘ভূত দেখবার সাহস আছে?’
দলের সবাই চুপচাপ। কেবল আমি বললাম, ‘হ্যাঁ আছে।’
আনন্দমোহন চেয়ারটা টেনে আমার পাশে বসল। অনলবর্ষী দৃষ্টি দিয়ে কিছুক্ষণ আমাকে দেখল, তারপর বলল, ‘কিছু হলে আমাকে দায়ী করতে পারবে না।’
হেসে বললাম, ‘নিশ্চিন্তে থাকুন, আমি সাবালক। আপনার কোনো দায় থাকবে না।’
‘বেশ, শোনো তাহলে, ক্যানিং লাইনে চেপে চাঁপাটিতে নামবে। ভালো নাম চম্পাহাটি। সেখান থেকে দু-মাইল দূরে খালেশ্বরীর মন্দির। তার পাশেই শ্মশান। অমাবস্যার রাতে সেই শ্মশানে গিয়ে রাত কাটিয়ে ফিরে আসতে হবে, অবশ্য যদি তোমার বরাতে ফিরে আসা থাকে।’
এরকম ভয় দেখানো কথা আগেও অনেক শুনেছি। অন্য শ্মশানে অন্ধকারে রাতও কাটিয়েছি। কিছু দেখতেও পাইনি। আমার কোনো ক্ষতিও হয়নি। তাই বললাম, ‘কিন্তু আমি যে সত্যি খালেশ্বরী মন্দিরের শ্মশানে গিয়েছি, তা আপনার কাছে প্রমাণ করব কী করে?’
আনন্দমোহন মাথা নাড়ল, ‘তার উপায় আছে। খালেশ্বরী মন্দিরের পাঁচিলে অদ্ভুত পরগাছা আছে। মানুষের আঙুলের মতন লম্বা পাতা। পাঁশুটে রং-এর ফুল হয়। এ ধরনের গাছ অন্য কোথাও দেখিনি। তা ছাড়াও আর এক ব্যাপার আছে। সেই পরগাছার পাতায় পাতায় চিতার ধোঁয়ার গন্ধ! মড়া পোড়ানোর চামড়ার আঁশটা গন্ধে অন্নপ্রাশনের ভাত উঠে আসে। সেই গাছের পাঁচটা পাতা তুলে আনতে হবে।’
‘ঠিক আছে, আমি রাজি।’
আনন্দমোহন আমার সঙ্গে চম্পাহাটি পর্যন্ত যাবে। সেখানে তার এক মাসির বাড়ি। রাত হলে আমি চলে যাব শ্মশানে। পরগাছার পাতা নিয়ে ভোরবেলা ফিরে আনন্দমোহনের সঙ্গে দেখা করব।
যদি পার, আনন্দমোহন পেট পুরে ‘কলেজ কেবিনে’ খাওয়াবে। তা ছাড়া করকরে দশ টাকার একটা নোট দেবে।
আনন্দমোহনের মেসো অনেক বারণ করল।
‘বাবা, ওসব গোয়ার্তুমি করতে যেও না। জায়গাটা খুবই খারাপ। তান্ত্রিকরা উপাসনা করেন। অমাবস্যায় নির্ঘাত ওঁদের আবির্ভাব হয়।’
হেসে উত্তর দিলাম, ‘ওদের সঙ্গে মোলাকাত করতেই তো যাচ্ছি।’
আমি যখন নাছোড়বান্দা, তখন আনন্দমোহনের মেসো একটা রুদ্রাক্ষ নিয়ে হাতে বেঁধে দিয়ে বলল, ‘রাম রাম। বিপদে পড়লে রামনাম জপ করবে। আর কী বলব বাবা, এসব সর্বনেশে খেলায় মেতো না। কোনোদিন মুশকিলে পড়ে যাবে।’
রাত আটটায় খাওয়াদাওয়া সেরে শ্মশানের দিকে রওনা হলাম। ঘুটঘুটে অন্ধকার। ভালো করে পথ দেখাই যায় না। ঝোপে ঝোপে জোনাকির ঝাঁক। কয়েক বার বিশ্রি সুরে পেঁচা ডেকে উঠল। ঝিঁঝির আওয়াজ।
এসবে আমি অভ্যস্ত। এর আগে বাজি রেখে বার তিনেক নানা জায়গার শ্মশানে গিয়েছি। মড়ার খাট থেকে গাঁদা ফুলের মালা ছিঁড়ে এনেছি।
প্রায় ঘণ্টা তিনেক পর শ্মশানে পৌঁছোলাম। এতটা সময় লাগার কথা নয়। মনে হয় পথ হারিয়েছিলাম।
শ্মশানের কাছাকাছি আসতেই তীব্র মাংসল গন্ধে বমি আসতে লাগল। বুঝতে পারলাম বোধ হয় মড়া পোড়ানোর গন্ধ। অথচ কাছে গিয়ে কোনো চিতা দেখতে পেলাম না।
একটু ঘোরাঘুরি করেই বুঝতে পারলাম, উগ্র গন্ধটা আসছে খালেশ্বরী মন্দিরের দিক থেকে।
কাছে গিয়ে টর্চ জ্বালালাম। গন্ধের জন্য নাকে রুমাল চাপা দিলাম।
এইসময় এলোমেলো হাওয়া উঠল। পরগাছাগুলো শিরশির করে কেঁপে উঠল। কী আশ্চর্য, ঠিক যেন আঙুল নেড়ে আমাকে কাছে ডাকছে!
ভোরবেলা ফেরার সময় এই পরগাছার পাতা ছিঁড়ে নিয়ে যাব।
আবার শ্মশানের দিকে ফিরলাম।
স্থির জোনাকির মতন অনেকগুলো আলো। বুঝতে অসুবিধা হল না, ওগুলো শিয়ালের চোখ। তাদের রাজত্বে আমার অনাহূত উপস্থিতিতে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে। কাছে যেতেই ছুটে পালাল।
অদ্ভুত একটা শোঁ-শোঁ শব্দ। মড়ার খুলির মধ্যে দিয়ে বাতাস প্রবাহিত হলে এ ধরনের শব্দ হয়।
আর একটু এগিয়েই দাঁড়িয়ে পড়লাম।
উঁচু ঢিবির ওপর বাঁশের খাট। তার ওপর একটা মড়া। মুখ ঢাকা। ধারে-কাছে কোনো লোক দেখতে পেলাম না।
সরে এলাম। এদিকটা অনেকগুলো গাছের জটলা। তার তলায় মিটমিট করে লণ্ঠন জ্বলছে।
যাক সম্ভবত কোনো লোক আছে এখানে। শ্মশানে সারাটা রাত একলা থাকতে হবে না।
কাছে গিয়ে দেখলাম, লণ্ঠন মাঝখানে রেখে দুজন লোক চুপচাপ বসে আছে। পরনে গেঞ্জি আর ধুতি। বিস্ফারিত চোখ। গালের চোয়াল প্রকট।
‘কে আপনারা?’
বার দুয়েক প্রশ্ন করতে উত্তর মিলল।
‘আমরা মড়া পোড়াতে এসেছি।’
‘শুধু দুজন?’
‘আরও দুজন গাঁয়ে গেছে কাঠ কিনতে। অনেকক্ষণ গেছে ফিরছে না কেন কে জানে! নেশা করে কোথাও পড়ে নেই তো?’
আমি তাদের কাছে বসে পড়লাম। যাক, সারাটা রাত অন্তত মুখ বুজে থাকতে হবে না। কথা বলবার লোক পাব।
একজন আমার দিকে চোখ তুলে জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনি এখানে কেন?’
বললাম, ‘বেড়াতে এসেছি।’
উত্তর শুনে দুজনেই খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসে উঠল।
‘শ্মশানে বেড়াতে? ভালো, ভালো। বেড়াবার আর জায়গা পেলেন না?’
মরীয়া হয়ে বলে ফেললাম, ‘ভূত দেখতে এসেছি।’
আবার সেই খ্যাঁক-খ্যাঁক হাসি।
‘খাঁচা এনেছেন?’
‘খাঁচা? খাঁচা কী হবে?’
‘কেন, ভূত দেখতে পেলে ধরে নিয়ে যাবেন।’
বুঝলাম ঠাট্টা করছে। কোনো উত্তর দিলাম না।
কিন্তু কতক্ষণই-বা চুপচাপ থাকা যায়!
এক সময়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কে মারা গেলেন?’
‘আমাদের দাদা।’
আবার চুপচাপ।
কিছুক্ষণ পর একজন আর একজনকে বলল, ‘এ তো মুশকিল হল। কতক্ষণ এভাবে বসে থাকব। এত দেরি তো হবার কথা নয়!’
‘চল, একটু এগিয়ে দেখি।’
লণ্ঠন তুলে নিয়ে ওরা উঠে দাঁড়াল।
‘আপনি বসে বসে শ্মশানের হাওয়া খান মশাই। আমরা গাঁয়ের দিকে একটু এগিয়ে দেখি।’
বসে বসে দেখলাম লণ্ঠনের ম্লান দীপ্তি গাছপালার আড়ালে ঢাকা পড়ে গেল। হাওয়ায় গড়াতে গড়াতে পায়ের কাছে কী-একটা ঠেকল। হাতে করে তুললাম।
নরমুণ্ড! কী আশ্চর্য, হাতে করতেই যেন নড়ে উঠল। জীবন্ত বস্তুর মতো। মাটিতে ফেলে দিতেই আবার গড়িয়ে গড়িয়ে চলে গেল।
বুঝতে পারলাম মনের ভুল। মনের ভুল, না মনের ভয়।
ভয় ঝেড়ে ফেলার জন্য উঠে দাঁড়ালাম।
হাঁটতে হাঁটতে ডোবার ধারে গিয়ে হাজির।
ধারে একটা হিজল গাছ। তাতে হেলান দিয়ে বসলাম।
বোধ হয় তন্দ্রা এসে গিয়ে থাকবে, গায়ে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি পড়তে চমকে জেগে উঠলাম।
টর্চের আলোয় হাতঘড়ি দেখলাম। রাত তিনটে। তার মানে অনেকক্ষণ ঘুমিয়েছি। আর ঘণ্টা খানেক। চারটের সময় এখান থেকে রওনা হলে ছ-টা নাগাদ আনন্দমোহনের মাসির বাড়ি পৌঁছে যাব।
তার আগে পরগাছার পাতাগুলো ছিঁড়ে নিই।
আবার মন্দিরের কাছে এলাম। হাত বাড়িয়ে পাতা ছিঁড়তে গিয়েই বিপদ। কিছুতেই ছিঁড়তে পারলাম না। কী শক্ত পাতা!
শুধু তাই নয়। মনে হল কে যেন আমাকে ধাক্কা দেবার চেষ্টা করছে, বাধা দিচ্ছে। কিছুতেই পাতা ছিঁড়তে দেবে না।
মনে পড়ে গেল, পকেটে ছুরি আছে।
ছুরি বের করে পাঁচটা পাতা কেটে নিলাম। ঠিক মনে হল, মানুষের দেহের ওপর যেন ছুরি চালাচ্ছি।
তারপরই অবাক কাণ্ড। কাটা পাতা থেকে টপটপ করে রক্ত ঝরে পড়তে লাগল!
রক্ত মানে লাল রং-এর রস।
পাতা পাঁচটা রুমালে বেঁধে শ্মশানে ফিরে এলাম।
মিটমিট করে লণ্ঠন জ্বলছে। তাহলে, লোকগুলো বোধ হয় ফিরে এসেছে।
লণ্ঠনের কাছে গিয়েই চমকে উঠলাম।
সারি সারি তিনটে খাটিয়া।
কিন্তু লোকজন কোথায়? এরা এলই-বা কখন।
টর্চের আলো ফেললাম খাটিয়ার ওপর, তারপর মনে হল পিঠের শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা একটা শিহরণ। আমার সমস্ত শরীর টলতে লাগল।
এ কী করে হল!
তিনটে খাটিয়াতে এক মড়া! এক বয়স, একরকম দেখতে!
লণ্ঠন নিয়ে যে দুজন বসেছিল, এখন মনে পড়ল, তাদের দুজনেরও এরকম চেহারা! সেই চেহারা খাটিয়ার ওপর।
এবার বুঝতে পারলাম, বেশ একটু ভয় ভয় করছে।
কোনো যুক্তি দিয়েই মনকে বোঝাতে পারলাম না। এরকম কী করে হতে পারে!
শ্মশানে থাকতে সাহল হল না।
চম্পাহাটির দিকে রওনা হলাম।
পিছন ফিরতেই মনে হল কারা যেন খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসে উঠল। নাকি সুরে বলে উঠল, ‘খাঁচা এনেছেন? ভূত নিয়ে যাবেন কীসে?’
সেবার বাজি জিতেছিলাম বটে, আনন্দমোহনের প্রশংসাও পেয়েছিলাম, কিন্তু মনের মধ্যে একটা সন্দেহ দানা বেঁধে রইল।
ভূত যদি নেই, তাহলে একই চেহারার তিনটে মড়া পাশাপাশি দেখলাম কী করে! বিশেষ করে যে দুজনকে কিছুক্ষণ আগে জীবন্ত দেখেছি, কথা বলেছি, তারাই মড়া হয়ে খাটিয়ায় শুয়ে!
ভৌতিক না হলেও অলৌকিক তো বটেই! অনেক বছর কেটে গেছে। ভূতের কথা ভাববার আর অবসর পাইনি। ডাক্তারি পড়া নিয়ে প্রাণান্ত। পাঁচ বছরের কোর্স, শেষ হল সাত বছরে। পরীক্ষার মুখে ঠিক একটা করে ঝঞ্ঝাট।
তারপর হাসপাতালে এক বছর হাউস সার্জেন হিসেবে।
জীবনের বীভৎস দিকটার সঙ্গে পরিচিত হলাম। সেই সময় সারা শহরে খুনোখুনির রাজত্ব। সময় নেই, অসময় নেই, গাদা গাদা মড়া মর্গে এসে পৌঁছোতে লাগল। বোমায় কারও হাত-পা উড়ে গেছে, ছোরার আঘাতে কারও পেটের নাড়িভুঁড়ি বাইরে এসে পড়েছে। আবার পথদুর্ঘটনার বলিও আছে। লরি কিংবা বাসের তলায় থেঁতলানো দেহ।
এইসব মড়া চিরে রিপোর্ট দিতে হত। এই কাজে আমার সহায় মাধাই ডোম। সেই অর্ধেকের বেশি কাজ করে দিত।
খালেশ্বরীর মন্দিরের সেই পরগাছার গন্ধে একদিন নাকে রুমাল চাপা দিতে হয়েছিল, কিন্তু এখন স্তূপীকৃত মড়ার গাদার মধ্যে ঘোরাফেরা করতে কোনো গন্ধ পাই না।
এক রাতে ঘুমে অচেতন ছিলাম, হঠাৎ দরজায় ধাক্কা।
ডাক্তার সায়েব! ডাক্তার সায়েব!
অল্প ডাকেই ইদানীং ঘুম ভেঙে যেত। তাড়াতাড়ি উঠে দরজা খুলে দেখলাম মাধাই ডোম দাঁড়িয়ে।
কী খবর জানাই ছিল, তবু জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কী ব্যাপার?’
‘একটা মড়া এসেছে হুজুর।’
‘তাড়া কীসের। কাল সকালেই হবে।’
‘না, আপনি একবার আসুন!’
আশ্চর্য লাগল। মাধাই ডোমের এত আগ্রহ দেখিনি এর আগে।
পোশাক বদলে মর্গে চলে এলাম।
মেঝের ওপর স্ট্রেচারে শোয়ানো রয়েছে। মনে হচ্ছে যেন ঘুমোচ্ছে। বছর উনিশ-কুড়ির বেশি নয়। একমাথা ঢেউ-খেলানো চুলের রাশ। কালো চুলের মাঝখানে পদ্মের মতো ঢলঢলে একটা মুখ। মুখে কোনো বিকৃতি নেই, একটু কুঞ্চনও নয়।
‘কে নিয়ে এল?’
‘পুলিশ।’
‘মারা গেল কীসে?’
উত্তরে মাধাই ডোম দেহটা উপুড় করে দিল।
পিঠের দু-জায়গায় গভীর ক্ষতচিহ্ন। মনে হল ধারালো ছোরা দিয়ে দু-বার আঘাত করা হয়েছে।
মাধাই ডোম আজকাল অনেক বিজ্ঞ হয়েছে। গম্ভীর গলায় বলল, ‘পার্টির ব্যাপার হুজুর। আজকাল যা হয়েছে!’
নিজের কাজ শুরু করলাম। ঘণ্টা খানেকের বেশি লাগল না। রিপোর্ট লেখাও শেষ।
মাধাই ডোমকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘বডি নিতে কেউ এসেছে?’
‘না হুজুর, এখনও হয়তো সর্বনাশের খবরই পায়নি।’
‘তা ঠিক। কাল খোঁজ পড়বে।’
পরের দিনও কেউ এল না। পুলিশ মৃতদেহের ফোটো নিয়েছিল। তার ফোটোও ছাপিয়ে দিয়েছিল বড়ো বড়ো খবরের কাগজে।
দিন চারেক পার হয়ে গেল। দেহ নিতে তবুও কেউ এল না।
ওষুধ ইঞ্জেকশন দিয়ে মৃতদেহ ঠিক রাখার চেষ্টা করা হয়েছিল। যাতে গন্ধ না বের হয়, কিন্তু দেহ আটকে রাখবার একটা সীমা আছে।
মাধাই ডোম এসে তাগাদা দিতে লাগল।
‘হুজুর, আর কতদিন আটকে রাখব? হুকুম দিন, গাদায় পুড়িয়ে দিই।’
মাধাই ডোমের উদ্দেশ্যও ছিল।
অনেক হাড়ের ব্যবসায়ী চড়া দামে কঙ্কাল কিনতে চায়। বেওয়ারিশ লাশ তাদের পাচার করে দেওয়া খুব লাভজনক।
যখন ভাবছি কী করব, তখন একজন ছাত্র এসে খবর দিল, ‘স্যার, একটি ছোকরা আপনার সঙ্গে দেখা করতে চায়।’
এরকম অনেকেই আসে। আত্মীয়স্বজনকে হাসপাতালে ভরতি করতে হয়, কিংবা মেডিকেল রিপ্রেজেনটেটিভ। ওষুধ গছাতে উৎসাহী।
দুটো ব্যাপারেই আমার কোনো হাত ছিল না। তবু ছোকরাকে ডেকে পাঠালাম। মাধাই ডোমকে বললাম, ‘পরে দেখা করতে।’
ছোকরা আমার ঘরে ঢুকতেই চমকে উঠলুম।
চেহারায় এমন মিল হয়? মৃতা মেয়েটির সঙ্গে অদ্ভুত সাদৃশ্য। মুখ, চোখ, রং একরকম। মেয়েটিই যেন পুরুষের বেশ পরে এসেছে।
কিছুক্ষণ কথা বলতে পারলাম না। তারপর বললাম, ‘কী চাই?’
‘আমার বোন আভার বডিটা নিতে এসেছি। ছোরা মারার কেস।’
‘এত দেরি হল আপনার?’
‘আমি অনেক দূর থেকে আসছি। খবরের কাগজে ফোটো দেখে চিনতে পেরেছি।’
কথাগুলো বলার সময়ে ছোকরার গলা অশ্রুরুদ্ধ হয়ে এল। মৃদুকণ্ঠে বলল, ‘দেশ থেকে এ হানাহানির কবে যে শেষ হবে!’
আমি বলেই ফেললাম, ‘আপনার সঙ্গে আপনার বোনের চেহারার কিন্তু অদ্ভুত মিল।’
ছোকরা কিছুক্ষণ একদৃষ্টে আমার দিকে দেখল, তারপর বলল, ‘সত্যি কথা বলতে কী, আমরা যমজ। আমি আভার চেয়ে সাত সেকেন্ডের বড়ো।’
বডি ছেড়ে দেবার জন্য যা প্রয়োজন করে দিলাম।
মনে একটু সান্ত্বনা পেলাম, যাক মেয়েটির দেহের সৎগতি হবে।
ব্যাপারটা ঘটল ঠিক পরের দিন।
কোয়ার্টার থেকে বের হয়ে হাসপাতালে ঢুকছি, মাধাই ডোমের সঙ্গে দেখা।
‘হুজুর, আর একজন লাশের খদ্দের এসেছে।’
‘কে? কোন লাশের?’
‘সেই ছোরা মারার কেস হুজুর। অল্পবয়সি মেয়েটার।’
‘বলিসনি, কাল তার ভাই লাশ নিয়ে গেছে?’
‘বলেছি হুজুর। ভদ্রলোক একবার আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান।’
বিরক্তিকর। বললাম, ‘আসতে বল।’
ভদ্রলোক ঢুকল। প্রৌঢ়। মাথায় কাঁচা-পাকা চুল। চোখে বেশি পাওয়ারের চশমা। খুব গম্ভীর চেহারা।
আমি বললাম, ‘আপনি ডোমের কাছে শোনেননি?’
‘হ্যাঁ, শুনেই তো আপনার কাছে এসেছি। সত্যি কথাটা জানতে।’
‘এ আর সত্যি-মিথ্যে কী? ভাই এসে লাশ নিয়ে গেছে। যমজ ভাই।’
সামনে রাখা চেয়ারে ভদ্রলোক বসে পড়ে বলল, ‘যমজ ভাই? মানে, অঞ্জু এসে বডি নিয়ে গেছে।’
‘নাম মনে নেই। খাতায় লেখা আছে, দেখতে পারেন। আপনি কে?’
‘আমি আভার বাবা।’
‘বাবা?’
‘হ্যাঁ। চাকরি থেকে অবসর নিয়ে রেবতীপুরে থাকি। রেবতীপুর অজ পাড়াগাঁ। বর্ধমান থেকে ত্রিশ মাইল। আমার মেয়ে আভা এখানে কী করত আমি জানি না। আমার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না। শুনেছি বাজে লোকের খপ্পরে পড়েছিল। চালের চোরাকারবার করত!’
ভদ্রলোক দীর্ঘশ্বাস ফেলে পকেট থেকে ভাঁজ করা খবরের কাগজ টেনে বের করল।
‘কাল কাজে বর্ধমান এসেছিলাম। কী আশ্চর্য ব্যাপার দেখুন! জিনিস কিনে গাঁয়ে ফিরছি। সেই কাগজের মোড়কে আভার ছবি। অবাধ্য হোক, যাই হোক, মেয়ে তো! সকালেই ছুটে চলে এলাম।’
‘কিন্তু আপনাকে তো বললাম, আপনার ছেলে এসে বডি নিয়ে গেছে।’
‘তা কী করে হয়?’
ভদ্রলোক অদ্ভুত দৃষ্টি দিয়ে আমাকে দেখল।
‘না হবার কী আছে! আপনার মতন তিনিও খবরে কাগজ দেখে চলে এসেছেন।’
‘কিন্তু,’ ভদ্রলোক ধরা গলায় বললেন, ‘অঞ্জু তো পাঁচ বছর আগে মারা গেছে। বাস দুর্ঘটনায়।’
এবার আমি সোজা হয়ে বসলাম, ‘সেকী!’
‘সেইজন্যই তো আশ্চর্য লাগছিল। অঞ্জু আসবে কী করে!’
অনুভব করতে পারলাম, শরীরের রক্ত মুখে এসে জমল। অনেক বছর আগে খালেশ্বরীর মন্দিরের পাশে শ্মশানের সেই অভিজ্ঞতা মনকে আচ্ছন্ন করল।
দুটো ঘটনাই তো আমার নিজের চোখে দেখা।
কী করে অস্বীকার করব! কোন যুক্তিতে!
Post a Comment