গভীর রাতের কান্না – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

গভীর রাতের কান্না – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

আনন্দ আর প্রদীপ সেদিন একটা চায়ের দোকানে বসে গল্প করছিল। হঠাৎ ভূতের কথা ওঠায় আনন্দ বললে, ‘আমি ওসব ভূত প্রেত বিশ্বাস করি না।’

প্রদীপ বললে, ‘আমি বিশ্বাস করি। ভূত প্রেত একেবারে আজগুবি কথা নয়। ভূত সত্যি আছে।’

আনন্দ বললে, ‘তুই ভূত দেখেছিস?

প্রদীপ বললে, ‘আলবাত দেখেছি!’

আনন্দ বললে, ‘তাই নাকি বল তাহলে কোথায় দেখেছিস?’

প্রদীপ বললে, ‘শোন তাহলে।’

এই বলে প্রদীপ দু-কাপ চায়ের অর্ডার দিয়ে, সিগাটের ধরিয়ে বলতে আরম্ভ করল—

‘আমার কাঠের ব্যাবসা, তাই যখন প্রয়োজন হয় আমাকে কাঠের জন্য আসাম, উত্তরবঙ্গ, বিহার যেতে হয়।

হঠাৎ একবার প্রয়োজন হল আসাম যাবার। তখন ব্রিজ তৈরি হয়নি, তাই গঙ্গাসাগর হয়ে কাটিহারের ওপর দিয়ে যেতে হত শিলিগুড়ি বা আসাম।’

তখন স্টেশনে ছিল একটা টিকিট ঘর আর একটা টিনের চালা, যাত্রীদের জন্য। আর আলোর মধ্যে ছিল কেরোসিনের লণ্ঠন।

এর কিছুটা দূরে রেল কোয়ার্টার। একটাতে থাকত স্টেশনমাস্টার আর একটায় কেরানি ও অন্যান্য কর্মচারী।

সারাদিনে মাত্র দু-তিনটে ট্রেন। ট্রেন এলে স্টেশনটা একটু জমজমাট হত। মাঝ পথ ফাঁকা জনমানব শূন্য। বিছানাপত্র বেঁধে খাবার কিছু সঙ্গে নিয়ে যথাসময়ে শিয়ালদহ স্টেশনে গেলাম। ট্রেন ছাড়তে আর দশ মিনিট।

টিকিট কাউন্টার থেকে একটা দ্বিতীয় শ্রেণির টিকিট কাটলাম। দেখতে দেখতে সময় হয়ে এল। ট্রেন এল, উঠলাম।

স্টেশন পার হতেই চারদিক অন্ধকার। সেই অন্ধকারের ভেতর দিয়ে ছুটে চলল আসাম মেল। আমি যে কামরায় উঠেছিলাম তার মধ্যে খুব বেশি যাত্রী ছিল না। সব মিলিয়ে ছেলে-মেয়ে পনেরো থেকে ষোলো জন মাত্র।

সিট প্রায় ফাঁকা দেখে বিছানা পেতে শুয়ে পড়লাম। একখানা ম্যাগাজিন পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়লাম।

ভোরবেলা হকারদের ‘গরম চা গরম সিঙাড়া’ ইত্যাদি বিভিন্ন কণ্ঠের চিৎকারে আর কুলিদের ওঠা-নামার দুমদাম শব্দে ঘুম ভেঙে গেল।

জানলা দিয়ে চেয়ে দেখি সাহেবগঞ্জ স্টেশন। আর কালবিলম্ব না-করে বিছানা বগলে নিয়ে ব্যাগটা ঝুলিয়ে নেমে গেলাম।

স্টেশনের বাথরুমে গিয়ে মুখ-হাত ধুয়ে একটা চায়ের দোকানে চা নিলাম, সঙ্গে লুচি আলুরদম। চায়ের সঙ্গে সেগুলো সদ্ব্যবহার করে সকালের আহার শেষে করলাম।

খাওয়াদাওয়া শেষ করে স্টিমারের ওপারে বেশ খানিকটা বালির ওপর দিয়ে হেঁটে উঠে বসলাম ট্রেনে। তখন রেলপথের অবস্থা ভালো ছিল না বলে অনেক সময় আস্তে আস্তে আবার থেমে থেমে যেত ট্রেন।

কামরায় খুব লোক ছিল না। কাজেই বেশ আরাম করে বসলাম। গাড়ি স্টার্ট দিল কিন্তু খুব আস্তে আস্তে। বালির ওপর দিয়ে জোরে চালানো অসম্ভব। এইভাবেই গাড়িটা এল মতিহারি স্টেশনে। এখানে কিছু যাত্রী উঠল।

এবার ট্রেন জোরে চলতে লাগল। এখানে বয় এসে খাবার অর্ডার নিয়ে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই এল কাটিহার স্টেশন। অনেক লোক এখানে ওঠা-নামা করতে লাগল। আমার মাছ ভাতের অর্ডার ছিল, আমাকে বয় দিয়ে গেল। আমি দেরি না-করে খাওয়ার পাট শেষ করে ফেললুম।

সন্ধ্যার কিছু আগে শিলিগুড়িতে এসে পৌঁছোলাম।

এখানে গাড়ি প্রায় বিশ-পঁচিশ মিনিট দাঁড়িয়েছিল।

ভোরে এসে পৌঁছোলাম আলিপুরদুয়ার স্টেশনে।

স্টেশনমাস্টারের বয়স বেশি নয়, আর লোকটিও অমায়িক দেখলাম। তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘এখানে কোনো হোটেল বা থাকবার জায়গা আছে?’

স্টেশনমাস্টার বললেন, ‘এই জংলা জায়গায় হোটেল কোথায় পাবেন? এখানে বেশি যাত্রীও আসে না।’

তার কথা শুনে আমার চোখ কপালে উঠল। আজ দু-দিন স্নান হয়নি। এ অবস্থায় কোথায় যাই।

আমার অবস্থা দেখে ভদ্রলোক বললেন, ‘আপনি বোধ হয় প্রথম এখানে এসেছেন?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’

স্টেশনমাস্টার বললেন, ‘আসুন আমার সঙ্গে। এখানে আমার একটা মেস আছে সেখানে আপনি দু-একদিন থাকতে পারেন।’

আমি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললাম, ‘ধন্যবাদ। আপনার অনুগ্রহের কথা চিরদিন মনে থাকবে।’

রেলওয়ে কোয়ার্টাসের মধ্যেই মেস। রেলের দশ-বারোজন কর্মচারী এখানে খায়।

আমি মেসের একটা ঘরে বিছানাপত্র রেখে পাতকুয়ায় স্নান করে আহারাদি সমাপ্ত করে একজন রেল কর্মচারীকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘এখানে কাছাকাছি কাঠের কোনো ঠিকাদার আছে কিনা।’

তিনি বললেন, ‘কাছাকাছি বলতে এখান থেকে দু-মাইল দূরে একজন কাঠ চালান দেবার ঠিকাদার আছেন। কেন, আপনি কি কাঠের ব্যাবসা করেন?’

আমি ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাতেই তিনি বললেন, ‘তাহলে ওর কাছেই যান। তা হলেই আপনার কাজ মিটে যাবে। তিনি লোকজন নিয়ে জঙ্গলে একপাশে বাংলো তৈরি করে বাস করেন।’

সব শুনে আমি খুশি হলাম। তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করে কলকাতায় ফিরে যাবার উদ্দেশ্যে আমি দুপুরের ঠিকাদারের বাংলোয় যাবার কথা বললাম।

রেল কর্মচারী বললেন, ‘এখন গেলে ফিরতে হয়তো সন্ধ্যা হয়ে যাবে। তার চেয়ে আপনি সকালে উঠে যাবেন। এখান আবার চিতাবাঘের ভয় আছে।’

আমি বললাম, ‘উপায় নেই আমাকে তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে কলকাতায়, সেজন্যে কাজ মিটিয়ে ফেলতে চাই। আপনি বরং আমাকে পথের সন্ধান বলে দিন।’

তিনি বললেন, ‘স্টেশন থেকে বেরিয়ে যে সোজা রাস্তা পাবেন ওই রাস্তায় একমাইল এগিয়ে গেলে দেখবেন রাস্তাটা দু-ভাগ হয়ে গেছে। যেটা বাঁ-দিকে জঙ্গলের দিকে গেছে আপনি সেদিকে গিয়ে দেখবেন একটা কাঠের বাংলো। ওইটাই ঠিকাদারের বাংলো।’

আমি আর অপেক্ষা না-করে টর্চলাইটটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। ঠিকাদারের বাংলোর উদ্দেশ্যে।

চলেছি তো চলেছি। পথ যেন আর শেষ হয় না। শেষে ঠিকাদারের আস্তানায় এসে হাজির হলাম। ভাগ্যের জোরে তিনি তখন বাংলোতেই ছিলেন। ভদ্রলোক বাঙালি নয়। যত্ন করে আমায় বসালেন। চা খাওয়ালেন। তারপর ব্যাবসার কথাবার্তা পাকা করে বেরিয়ে পড়লাম সেখান থেকে। তিনি বাংলোতে থাকতে বলছিলেন।

আমি বললাম, ‘ধন্যবাদ। থাকবার উপায় নেই। কলকাতায় ফিরতে হবে। ঠিক সময় মতো যদি স্টেশনে পৌঁছোতে পারি তাহলে রাতের ট্রেনেই কলকাতা রওনা হব।’

এই কথা বলে সেখান থেকে বেরিয়ে পড়লাম।

প্রায় একমাইল রাস্তা হাঁটার পর হঠাৎ সারা আকাশ ছেয়ে কালো মেঘ ছেয়ে গেল। দু-পাশে জঙ্গল।

টর্চলাইটের ব্যাটারিও প্রায় শেষ। তাড়াতাড়ি নতুন ব্যাটারি নিতে ভুল হয়ে গেছে। ব্যাটারির অল্প আলোতে এগিয়ে চলেছি। হঠাৎ সামনে একটা কালো কুকুর দেখতে পেলাম। চোখ দুটো দপ দপ করে জ্বলছে। আমি বার বার আঁতকে উঠছিলাম। হঠাৎ উঠল হাওয়া আর সেইসঙ্গে বৃষ্টি। কুকুরটা অন্ধকারে মিশে গেল।

আমিও আশ্রয়ের আশায় ছুট দিলাম।

কিছুদূর এসে মনে হল আমি অন্যদিকে এসেছি। এমন সময় বিদ্যুতের আলোয় খানিকটা দূরে দেখা গেল একখানা ঘর।

আমি ছুটলাম সেইদিকে। ঘরের কাছে গিয়ে দেখলাম দরজা খোলা। আমি কোনোকিছু না-ভেবে ভেতরে ঢুকে গেলাম।

টর্চলাইটটা জ্বেলে দেখলাম, ঘরটা বৈঠকখানা বলেই মনে হয়। তবে ঘরের মধ্যে আসবার কিছু নেই। চারদিক ধুলো বালি জমা হয়ে আছে।

ভেতর দিকে একটা দরজা। সেটাও খোলা, সেই দরজা দিয়ে দেখলাম একটা ছোটো উঠোন।

বুঝতে পারলাম ঘরে কেউ থাকে না। যাইহোক আশ্রয় যখন পেয়েছি তখন বৃষ্টি না-থামা পর্যন্ত অপেক্ষা করা যাক। এই ভেবে দরজার পাশে কাঠের মেঝের উপরেই বসে রইলাম।

বৃষ্টি যেন থামতেই চায় না।

যত রাত হয় বৃষ্টি আরও জোরে হয়। টর্চলাইটের আলোতে হাতঘড়িটা দেখলাম তখন রাত একটা।

চুপ করে বসে আছি নিরুপায় হয়ে, হঠাৎ মাথার ওপর ঝটপটানি শব্দ শুনে চমকে উঠে দেখি একটা বাদুড় আমার মাথার উপর ঘুরপাক খাচ্ছে, ঘুরতে ঘুরতে এক কোণে ঝুলে রইল। চোখ দুটো কী ভয়ংকর! যেন আগুনের মতো জ্বলছে।

ভয়ে কাঠ হয়ে বসে রইলাম। ঘরের ভেতর থেকে নানারকম শব্দ। কখনো মনে হল কেউ ঘুরে বেড়াচ্ছে। আবার পরক্ষণেই শোনা গেল বিচিত্র সব শব্দ।

বাদুড়টা ঝটপট করতে করতে আমার মাথার ওপর দিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল।

আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম।

কিছুক্ষণ কেটে গেল, কোনো শব্দ নেই।

এমন সময়ে ঘরের ভেতর থেকে কান্নার শব্দ ভেসে এল।

কান্নার শব্দে চমকে উঠলাম। বুঝলাম কোনো মেয়েছেলে কাঁদছে। ঘরে তাহলে লোকজন আছে। এই ভেবে সাহস পেলাম। একবার ভাবলাম ভেতরে গিয়ে দেখি ব্যাপারটা কী? আবার ভাবলাম কী দরকার পরের ব্যাপারে মাথা গলাবার।

বৃষ্টি অনেকটা কমে এসেছে। কিন্তু কান্নার শব্দ কমেনি।

একঘেয়ে কান্নার শব্দে অসহ্য হয়ে উঠলাম। ভাবলাম স্টেশনে ফিরে যাওয়া উচিত ছিল।

বিরক্ত হয়ে টর্চটা হাতে নিয়ে ভেতরে গেলাম।

সামনের ঘর থেকে কান্নার শব্দ আসছিল। দরজা খোলা ছিল, সাহস করে ঢুকে গেলাম ঘরের মধ্যে। ঘরে লোকজন দূরে কথা একটা আসবাবপত্রও নেই। শুধুমাত্র একটা পুরোনো শাড়ি পড়ে আছে।

টর্চ নিভিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসব আবার কান্নার শব্দ হল। কেউ কোথাও নেই, অথচ কাঁদছে কে?

আমি ঘরের মাঝখানে গিয়ে চেঁচিয়ে বললাম, ‘কে কাঁদছ উত্তর দাও!’

সঙ্গে সঙ্গে ঠিক আমার মাথার উপর কে যেন হেসে উঠল। সেই হাসি শুনে বুকের রক্ত যেন জল হয়ে গেল!

আমি ভয়ে বাইরে বেরিয়ে আসার জন্য পা ফেলতেই বন্ধ হয়ে গেল দরজাটা।

আমি ভয়ে কাঠ হয়ে গেলাম, আবার দরজা খুলে গেল।

ঘরের কোণে যেখানে শাড়িটা পড়েছিল সেখানে দেখা গেল একটা অস্পষ্ট নারীমূর্তি! মূর্তিটা নাকি সুরে বললে, ‘টর্চ জ্বালিও না। কেন কাঁদছি তাহলে শোনো।’

এই বলে ছায়ামূর্তি বলতে শুরু করল—

‘আমি বাঙালি ঘরের মেয়ে। অল্প বয়সে বিধবা হই।

আমার স্বামীর অনেক টাকা পয়সা ছিল। জমিজমাও ছিল প্রচুর। সেই লোভে স্বামীর এক আত্মীয় আমাকে খুন করে কাঠের বাক্স করে আমায় পুঁতে দেয়। সেই থেকে আমি ভূত হয়ে আছি। ভূত হয়ে আমি অনেক কষ্ট পাচ্ছি, আর সহ্য করতে পারছি না, তুমি দয়া করে আমার নামে গয়ায় যদি পিণ্ড দাও!’

‘আচ্ছা, আপনি যে মুক্তি পেয়েছেন জানব কী করে?’

ভূতটা বলল, ‘তুমি যেখানে পিণ্ড দেবে ফল্গু নদীর ধারে, সেখানে আধ মাইল দূরে দেখবে বালি আছে; তার ওপর দেখবে আমার নাম যেটা তোমায় দিলাম। তাহলে বুঝবে আমার মুক্তি হয়েছে।’

আমি বাধ্য হয়ে বললাম, ‘বেশ তাই হবে।’

‘তাহলে এটা রাখো, কিন্তু বেইমানি কোরো না। তাহলে আমি তোমার ঘাড় মটকাব।’

সঙ্গে সঙ্গে আমার পকেটে কেউ যেন কী দিল। আমি পকেটে হাত দিতেই মেয়েটি বলল, ‘এখানে নয় কাল দেখো। গয়া যাবার খরচ আমার নাম লিখে দিলুম। তুমি ভুল পথে এসেছ। আমি তোমায় পৌঁছে দিচ্ছি।’

আমি একেবারে ঘর থেকে বেরিয়ে রাস্তায়।

স্টেশনের কাছাকাছি একটা জঙ্গল। সেখানে আসতেই ভোর হয়ে এল।

পেছন থেকে মেয়েটি বললে, ‘আমি আর যেতে পারব না সকাল হয়ে গেছে।’

তারপর আমি পিছন ফিরে দেখি, একটা নরকঙ্কাল যাচ্ছে। কী ভয়ঙ্কর দেখতে! আমার সারাদেহ তখন কাঁপছে। ওঃ এরই সঙ্গে আমি কাল সারারাত একটা নোংরা বাড়িতে বন্দি ছিলাম!

স্টেশনে ফিরে এসে দেখলাম এক টুকরো নাম লেখা কাগজ ও একটা সোনার হার।

কলকাতায় ফিরে সেটা বিক্রি করে গয়ায় পিণ্ড দিয়ে এসেছিলাম।

No comments