পাঁচ মুণ্ডীর আসর – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়
স্টেশনের নাম লোচনপুর। সেখান থেকে আরও দু-ক্রোশ। যানবাহন বলতে কিছু নেই। গরমে আর শীতে গোরুর গাড়ি চলে, কিন্তু বর্ষায় তা সম্ভব নয়। মাঝপথে দু-দুটো খাল। অন্য সময়ে বালির স্তূপ, বর্ষাকালে পার হওয়া দায়! খেয়া-নৌকা ছাড়া।
উপায় নেই। কোর্টের কাজ। এই চার মাইল পথ পায়ে হেঁটে গিয়ে পূবাই গাঁয়ের সর্বেশ্বর জানাকে ধরতে হবে। ধরা মানে, কোর্টের ভাষায়, সমন ধরিয়ে দেওয়া। এই কাজ না করতে পারলে চাকরি থাকবে না।
হয়তো গিয়ে দেখব, আগে থাকতে খবর পেয়ে সর্বেশ্বর ডুব মেরেছে। কোথাও পাওয়া যাবে না তাকে। তা যদি হয়, তাহলে তার বাড়ির দরজায় নোটিস সেঁটে দিয়ে আসতে হবে। মোট কথা যেতে আমাকে হবেই।
যাত্রা শুরু করলাম। কাঁচা মাটির পথ কিছুটা গিয়েই শেষ হয়ে গেল। তারপর আল। হাত খানেক চওড়া। সার্কাসের খেলায় সরু তারের ওপর দিয়ে যেভাবে লোকটা হাঁটে, সেইরকম কায়দায় সাবধানে এগিয়ে চলেছি। একটু এদিক-ওদিক হলেই একেবারে কাদাগোলা জলে নাকানি-চোবানি খেতে হবে।
একমাত্র ভরসার কথা, এখনও যথেষ্ট আলো রয়েছে। চারদিক পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। হাতের লাঠিটা ঠুকতে ঠুকতে চলতে লাগলাম।
যা শুনেছিলাম, তা ভুল। খাল দুটো নয়, একটা। খেয়া-নৌকার ব্যবস্থা নেই। সরু খালের ওপর বাঁশের একটা সেতু রয়েছে। দু-হাতে বাঁশ আঁকড়ে খাল পার হলাম।
তারপর আল নয়, সরু পথ। পায়ে চলা দু-পাশে ঘোড়া নিম আর আশশ্যাওড়ার গাছ। জায়গাটা বেশ অন্ধকার।
মাইল খানেক পথ পার হয়ে পূবাই গাঁয়ে হাজির হলাম।
ছোট্ট গ্রাম। একটা দোকান আর গোটা দশেক চালাঘর এই গ্রামের সীমানা।
বরাত ভালোই বলতে হবে। সর্বেশ্বরকে একেবারে বাড়ির দাওয়াতেই পেয়ে গেলাম। বসে বসে গাবের আটা দিয়ে জাল মাজছিল।
তার কাছে খোঁজ করতেই বাজখাঁই আওয়াজে বলল, ‘আমি সর্বেশ্বর জানা। পিতা ঈশ্বর পতিতপাবন জানা। মশাইয়ের প্রয়োজন?’
প্রয়োজনটা দেখেই সর্বেশ্বর চমকে উঠল। এমন জানলে হয়তো জাঁক করে পরিচয়ই দিত না।
কাজ শেষ করে কোঁচার খুঁটে গাল, কপাল মুছে নিয়ে বললাম, ‘একটু জল খাওয়াতে পারেন?’
সর্বেশ্বর একদৃষ্টে কিছুক্ষণ আমার দিকে চেয়ে রইল। সে দৃষ্টিতে যেন আগুন ঝরছে।
তারপর বলল, ‘লোচনপুর থেকে আসবার সময় একটা খাল পার হয়ে এসেছেন না?’
ঘাড় নেড়ে বললাম, ‘হ্যাঁ।’
‘অনেক জল পাবেন সেই খালে। পেট ভরে চুমুক দিতে পারেন।’
অবস্থা দেখে আমি আর দাঁড়ালাম না। দাঁড়াতে সাহস হল না। কিছু বলা যায় না, দলবল ডেকে যদি লাঠির ঘায়ে এখানে খতম করে দেয়, তাহলেও কিছু করতে পারব না। তারপর মাটি খুঁড়ে লাশটা যদি পুঁতে ফেলে, তাহলেও কাক চিলে জানতে পারবে না।
কোর্টের পেয়াদার ভাগ্যে মারধোর হামেশাই হয়। লোকজন খেপে উঠে আধমরা করে দেয়। একবার ভাবে না, আমরা নিমিত্র মাত্র। শুধু নির্দেশ জারি করেই খালাস।
বুঝতে পারলাম, এ গাঁয়ে ঠাঁই হবে না। ভেবেছিলাম রাতটা কোথাও বিশ্রাম করে ভোর ভোর রওনা হব, কিন্তু তা হবার নয়।
একেবারে গাঁয়ের মুখে যে দোকানটা দেখেছিলাম, সেখানে এসে দাঁড়ালাম।
‘খাওয়ার জিনিস কিছু পাওয়া যাবে?’
দোকানী নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসল।
‘কী চাই বলুন-না কর্ত্তা?’
চেয়ে দেখলাম, দুটো ধামা পাশাপাশি সাজানো। গোটা কয়েক জার আছে, তবে সব কটাই খালি।
দোকানীই আবার বলল, ‘মুড়ি আছে, পাটালি আছে।’
‘আর কিছু? দুধ কিংবা কলা?’
‘আজ্ঞে না, ওসব এখানে পাবেন না।’
নিরুপায়। মুড়ি আর পাটালি নিয়েই কাঠের বেঞ্চের ওপর বসে পড়লাম। দু-এক গাল মুখে দিয়েই বুঝতে পারলাম, মুড়িগুলো অন্তত এক সপ্তাহের বাসি আর পাটালি যে এত তেতো হয় কী করে, অনেক ভেবেও কূলকিনারা পেলাম না।
খাওয়া শেষ করে, জল খেয়ে পয়সা দেবার মুখে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘এখানে রাতটা কাটাবার জায়গা হবে? এ দোকানঘরের একপাশে হাত-পা মুড়ে পড়ে থাকব।’
কোনো উত্তর নেই দেখে মুখটা তুলেই শঙ্কিত হলাম।
দোকানী একদৃষ্টে আমার বুকের ওপর আটকানো পেতলের চাকতির দিকে দেখছে। যেটার ওপর কোর্টের নাম খোদাই করা।
তাড়াতাড়ি পয়সা ক-টা দোকানী হাত থেকে কেড়ে নিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘না মশাই, থাকার জায়গা-টায়গা হবে না। ছেলেপুলে পরিবার নিয়ে থাকি, এখানে আপনি শোবেন কোথায়?’
‘সন্ধ্যা হয়ে এল, তাহলে এখন যাই কোথায়?’
‘এইবেলা স্টেশনের দিকে রওনা হয়ে পড়ুন। কতটা আর পথ। কলকাতা যাবার শেষ গাড়ি দশটা বত্রিশে। সেটা অনায়াসেই পেয়ে যাবেন।’
আমাকে আর কিছু বলবার অবসর না-দিয়ে দোকানী ঝাঁপ বন্ধ করতে শুরু করল। যাতে দোকানের সামনে থেকে অন্তত সরে যেতে বাধ্য হই।
বুঝতে পারলাম, এ গাঁয়ে আশ্রয়ের কোনো আশা নেই। বুকের চাকতিটাই আমার কাল। কোর্টের পেয়াদাকে এরা সমনের শামিল বলে মনে করে।
ঠিক করলাম, স্টেশনেই চলে যাব। সত্যিই তো কতটা আর পথ। যেতে দু-ঘণ্টা কিংবা তিন ঘণ্টা লাগলেও হাতে অনেক সময় থাকবে।
লাঠিটা বাগিয়ে নিয়ে হাঁটতে আরম্ভ করলাম। চাকতিটা খুলে নিয়ে পকেটের মধ্যে রেখে দিলাম।
চারদিকে সন্ধ্যার অন্ধকার নেমেছে। গাছপালার জন্য আরও ঝুপসি ঠেকছে। যাবার সময় যে পথ মসৃণ, সরল মনে হয়েছিল, আধো অন্ধকারে সে পথেই বার বার হোঁচট খেতে লাগলাম।
একটু পরে অন্ধকার ঘন হল। আকাশে ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ। চাঁদের দেখা নেই। তারাও নেই। ঝোপের ফাঁক থেকে শিয়াল ডেকে উঠল। হুক্কা হুয়া। হুয়া, হুয়া হুয়া।
শক্ত হাতে লাঠিটা ধরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। শিয়ালকে ভয় নেই। শিয়াল জ্যান্ত মানুষের কাছে ঘেঁষে না। কিন্তু জঙ্গলে আর কোনো জন্তু নেই তো? হিংস্র কোনো জানোয়ার?
প্রায় ঘণ্টা খানেক চলার পর খেয়াল হল এতক্ষণে খালের পারে পৌঁছানো উচিত ছিল। বাঁশের সেতুর কাছ বরাবর। দুটো হাত আড়াআড়িভাবে চোখের ওপর রেখে চারদিক নিরীক্ষণ করে দেখলাম। এখনও অন্ধকার সূচিভেদ্য হয়ে ওঠেনি। অনেকক্ষণ চেয়ে থাকলে আবছা দেখা যায়। চারদিকে গাছের জটলা। অল্প অল্প বাতাস শুরু হয়েছে। সেই বাতাসে গাছের পাতাগুলো শিরশির করে কাঁপছে।
আর কোনো সন্দেহ নেই নিশ্চয় পথ হারিয়েছি; সম্ভবত জঙ্গলের মধ্যে একাধিক পায়ে-চলা পথ আছে। একটা পথের বদলে আর একটা পথ ধরে হাঁটতে আরম্ভ করেছি।
এখন উপায়।
লাঠিটা ঠুকে চিৎকার করলাম, ‘কে আছ, আমি পথ হারিয়ে ফেলেছি। আমাকে সাহায্য করো!’
একবার, দু-বার, তিনবার। চিৎকারে কোনো ফল হল না। শুধু গাছের ডালে বিশ্রামরত কাকের দল কা-কা শব্দ করে ঝটপট করতে করতে উড়ে গেল।
কিন্তু এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে সমস্যার সমাধান হবে না। যেকোনো রকমেই হোক, এ জঙ্গল থেকে বেরিয়ে পড়তেই হবে। নইলে রাত বাড়বে, জায়গাটা মোটেই নিরাপদ নয়।
সোজা রাস্তা ধরে এগোতে লাগলাম। গাছপালার যেন আর শেষ নেই। যত এগোই, জঙ্গল যেন তত দুর্ভেদ্য বলে মনে হয়।
পায়ের পাশ দিয়ে সরসর করে সরীসৃপগতিতে যেসব প্রাণী চলাফেরা করছে, তাদের কথা ভেবে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল।
বেশ কিছুক্ষণ চলার পর মনে হল জঙ্গল যেন একটু ফিকে হয়ে এল। চারদিকে বিস্তীর্ণ জলাভূমি। অন্ধকারে জোড়া জোড়া জ্বলন্ত চোখ ঘোরাফেরা করছে। বুঝলাম সে চোখের মালিক শিয়ালের দল।
জঙ্গল পার হয়ে এসে মনে একটু সাহস হল। ভালো করে চেয়ে চেয়ে দেখলাম কোথাও যদি আলোর বিন্দু চোখে পড়ে। গ্রামের নিশানা।
হঠাৎ পিছন থেকে বিকট শব্দ এল।
‘বলো হরি, হরিবোল!’
সে শব্দে বুকের রক্ত যেন হিম হয়ে গেল। তবু এই ভেবে মনে আশ্বাস পেলাম, নির্জন প্রান্তরে আমি একলা নই। আরও লোক আছে। এদের জিজ্ঞাসা করলেই পথের নির্দেশ পাওয়া যাবে।
হরিধ্বনি আরও কাছে আসতেই আমি পথ ছেড়ে সরে দাঁড়ালাম। সেটাই নিয়ম। অনন্তপথের যাত্রীকে পথ দেওয়া উচিত।
লাঠিতে ভর দিয়ে একপাশে দাঁড়িয়ে রইলাম।
অন্ধকারে জ্বলন্ত একটা মশাল এগিয়ে আসছে। একটু পরেই শববাহীরা সামনে এল। শুধু চারজন খাটিয়া বয়ে নিয়ে চলেছে। সামনের ডানদিকের লোকটার হাতে মশাল। আর কোনো লোক নেই।
‘শুনুন!’ কাতর কণ্ঠে অনুরোধ করলাম।
বাহকরা থামল না, শুধু চলার গতি একটু মৃদু করল আর চারজনেই আমার দিকে দৃষ্টি ফেরাল।
সঙ্গে সঙ্গে আমার মেরুদণ্ড বেয়ে একটা হিমেল স্রোত বয়ে গেল। আমি ভীরু এমন অপবাদ কেউ দিতে পারবে না, কিন্তু আমার মনে হল শ্লথ মুষ্টি থেকে লাঠিটা খসে মাটিতে পড়ে যাবে, সমস্ত শরীর অজানা একটা আতঙ্কে শিউরে উঠল।
চারজন লোকেরই ঠিক একরকম চেহারা! এক ধরনের অবিন্যস্ত চুল, রক্তিম চোখ, এমনকী মুখের বসন্তের দাগ পর্যন্ত!
আমার প্রশ্নের কোনো উত্তর না-দিয়েই বাহকরা পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেল।
শুধু যদি দুজনের চেহারার মধ্যে এ ধরনের সাদৃশ্য থাকত, তাহলে ভাবতাম তারা হয়তো যমজ ভাই, কিন্তু এরকম চারজনের অভিন্ন চেহারা হল কী করে!
মনের মধ্যে অলৌকিক যে প্রসঙ্গ উঁকি দিচ্ছিল, নিজেকে ধমক দিয়ে তার পথ বন্ধ করার চেষ্টা করলাম। আমার চোখের ভুল। মনের মধ্যে ভয়টা বাসা বেঁধেই ছিল, মশালের আলোয় ক্ষণেকের দেখায় নিশ্চয় বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে।
নিজেকে সাহস দেবার জন্য চিৎকার করে গান গাইতে শুরু করলাম। বেসুরো, বেতালা। কিন্তু পরমুহূর্তেই ‘বলো হরিবোল’-এর বিকট ধ্বনিতে চমকে থেমে গেলাম।
মনে হল শব্দটা যেন আমার পাশ থেকে উঠছে। অথচ শববাহকের দল ততক্ষণে অনেক এগিয়ে গেছে। তাদের চিৎকার এত কাছে শ্রুতিগোচর হবার কথা নয়।
মনের মধ্যে একটু অস্বস্তি শুরু হল। কিন্তু এভাবে চুপচাপ পথের পাশে দাঁড়িয়ে থাকলে বিপদ বাড়বে। তাই জোরে জোরে পা ফেলে এগিয়ে চললাম।
লক্ষ করিনি, আকাশ কখন কালো মেঘে ছেয়ে গেছে। ছুরির ফলার মতন বিদ্যুতের শানিত স্ফুরণ। দমকা হাওয়া উঠল। হাওয়ার এমন বেগ যে এগোনো দুষ্কর হয়ে পড়ল।
আবার সেই চিৎকার। এবারে যেন একেবারে কানের পাশে। ‘বলো হরি, হরিবোল!’
চিন্তা করে লাভ নেই। চিন্তা করে এ ব্যাপারে জট ছাড়ানো যাবে না। রহস্য যাই হোক, যেভাবেই হোক, আমাকে প্রাণে বাঁচতে হবে। কোনোরকমে একটা লোকালয়ে গিয়ে পৌঁছোতে হবে।
বড়ো বড়ো বৃষ্টির ফলা। সারা গায়ে হুল ফোটাতে শুরু করল। ছুটতে আরম্ভ করলাম, লাঠিটা বগলে চেপে।
জানি না, বোধ হয় আধ মাইলেরও বেশি একটানা দৌড়েছি। হিসাব রাখিনি। হঠাৎ আর একবার বিদ্যুৎ চমকাতেই দেখলাম, পথের পাশে একটা চালাঘর।
মনে মনে ভগবানকে ধন্যবাদ জানালাম। বিপদতারণ তুমি আছ, দুর্বলের ত্রাণকর্তা। ছুটে গিয়ে চালাঘরে আশ্রয় নিলাম। মনে মনে ভাবলাম, অন্তত প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে শরীরটা বাঁচবে। এমনও হতে পারে চালাঘরে কোনো লোকের সাক্ষাৎ মিলবে। রাতের নির্ভর।
অন্ধকারটা চোখে একটু সহ্য হতে বুঝলাম চালাঘর নয়, শুধু চালা। তিনদিক আচ্ছাদিত, একদিক খোলা। বোধ হয় রোদের তাপ কিংবা বৃষ্টির প্রকোপ থেকে পথচারীকে বাঁচাবার জন্যই এটি তৈরি হয়েছিল।
আস্তে আস্তে এগোতে গিয়েই থেমে গেলাম।
কড়কড় কড়াৎ। প্রচণ্ড শব্দে বজ্রপাত হল। তার আগে বিদ্যুতের অলোয় চারদিক উদ্ভাসিত হয়ে গেল।
সেই আলোতেই দেখলাম। এবার আরও স্পষ্ট, আরও নিকটে।
শবটি সামনে রেখে চারজন পাশে দাঁড়িয়ে আছে। সারি দিয়ে। হুবহু এক চেহারা! এমনকী অসংস্কৃত দাড়ি গোঁফের মাত্রা পর্যন্ত!
চোখাচোখি হতেই চারজন একসঙ্গে হো হো করে হেসে উঠল। শিকারকে যেন কুক্ষিগত করার উল্লাসে। লাঠিটা বজ্রমুষ্টিতে ধরে পাষাণমূর্তির মতন দাঁড়িয়ে রইলাম। নিঃসন্দেহ হলাম, এ হাসি স্বাভাবিক নয়। রক্তমাংসের কোনো লোক এভাবে হাসতে পারে না। অশরীরী আত্মার বীভৎস হাসি!
আমাকে আবার আতঙ্কিত করে একজন খনখনে গলায় বলল, ‘আপনি একটু মৃতদেহের কাছে থাকুন, আমরা কাঠের ব্যবস্থা করে আসি।’
কোনোরকমে নিঃশ্বাস রোধ করে বললাম, ‘আপনারা সবাই যাবেন?’
আবার সেই রক্তজল-করা হাসি।
‘আমরা যেখানে যাই, একসঙ্গেই যাই!’
যাবার আগে লোকগুলো মশালটা জ্বালিয়ে দিয়ে গেল।
বৃষ্টি থেমে গেছে। মাঝে মাঝে শুধু মেঘের গর্জন আর বিদ্যুতের চমক।
আড়চোখে চেয়ে দেখলাম। সাদা কাপড়ে শবের আগাগোড়া ঢাকা। মশালের আলোয় সবকিছু পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।
আচমকা দমকা হাওয়ায় শবের আবরণ সরে গেল। আমি একবার সেদিকে দেখেই চিৎকার করে উঠলাম।
একেবারে এক মুখ! গোঁফ, দাড়ি, চুল, গড়ন কোথাও কোনো প্রভেদ নেই। এমনকী বসন্তের দাগ পর্যন্ত!
দু-হাতে চোখ দুটো রগড়ে নিলাম। এও কি সম্ভব! শব আর চারজন বাহকের আকৃতিতে কোনো তফাত নেই!
বুকের মধ্যে স্পন্দন দ্রুততর হল। লাঠিটা আঁকড়ে ধরার শক্তিও যেন ক্রমে লোপ পেয়ে যাচ্ছে। তারপর যা ঘটল, তা অবর্ণনীয়।
শব চোখ খুলল। রক্তিম দুটি চোখ। প্রথমে দুটো ঠোঁট কেঁপে কেঁপে উঠল, তারপর খনখনে গলার স্বর ভেসে উঠল। একটু উঠে বসার মতো করে বলল, ‘ঠিকই ভেবেছ! আমরা পাঁচজন একই লোক। কোনো তফাত নেই। বসন্ত রোগে মারা গিয়েছিলাম বলে প্রতিবেশীরা কেউ ভয়ে পোড়াতে এল না। দেহের সৎগতি হবে না? তাই নিজের দেহ থেকে চারজন বাহক সৃষ্টি করলাম। তারাই বয়ে নিয়ে এল শ্মশানে। কেমন বুদ্ধি বার করলাম বলো তো? হো, হো, হো!’
তারপর আমার কিছু মনে নেই।
যখন জ্ঞান হল দেখলাম পথের একপাশে কর্দমাক্ত দেহে পড়ে আছি। পরনের পোশাক ছিন্নভিন্ন। জেলেরা আমার মুখে-চোখে জল দিচ্ছে। বাতাস করছে।
একটু সুস্থ বোধ করে উঠে বসলাম। চারদিকে চেয়ে চেয়ে দেখলাম। চালাঘর আছে, কিন্তু শূন্য। রাতের বিভীষিকা কোথাও নেই।
আস্তে আস্তে বললাম, ‘লোচনপুর স্টেশন এখান থেকে কত দূর?’
‘লোচনপুর? এখান থেকে পাক্কা দশ মাইল। একেবারে উলটো দিকে।’
‘এ জায়গার নাম কী?’
‘এটাকে বলে পাঁচমুণ্ডীর আসর।’
‘পাঁচমুণ্ডীর আসর?’ চমকে উঠলাম।
‘হ্যাঁ গো কত্তা। একরকমের পাঁচজন তেনাদের দেখা যায়। পথ ভুলিয়ে লোককে এখানে নিয়ে আসে। তারপর সাবাড় করে দেয়। তুমি বামুন বলে বোধ হয় বেঁচে গেছ।’
ছেঁড়া পরিচ্ছদের ফাঁক দিয়ে পৈতেটা দেখা যাচ্ছিল।
এ কাহিনি অনেককে বলেছি, কেউ বিশ্বাস করেছে, কেউ করেনি। কিন্তু যারা বিশ্বাস করেনি তারা রাতের বেলা পূবাই গাঁ থেকে পশ্চিমমুখো রাস্তা ধরে পাঁচমুণ্ডীর আসরের দিকে কেউ আসতে রাজি হয়নি। আমাকে যদি কেউ এক থলি আকবরী মোহর দেয়, তবু আমি ওপথে আর জীবনে যাব না।
Post a Comment