শীলার জন্ম – হুমায়ূন আহমেদ

শীলার জন্ম – হুমায়ূন আহমেদ

আমার দ্বিতীয় মেয়ে শীলার জন্ম আমেরিকায়। জন্ম এবং মৃত্যুর সব গল্পই নাটকীয়, তবে শীলার জন্ম মুহূর্তে যে নাটক হয়, তাতে আমার ভূমিকা আছে বলে গল্পটি বলতে ইচ্ছা করছে।

তারিখ টা হচ্ছে ১৫ই জানুয়ারি।

প্রচণ্ড শীত পড়েছে। রফে বরফে সমস্ত ফার্গো শহর ঢাকা পড়ে গেছে। শেষরাত থেকে নতুন করে তুষারপাত শুরু হল। আবহাওয়া দপ্তর জানাল

‘নিতান্ত প্রয়োজন না হলে রাস্তায় গাড়ি নিয়ে বের হবে না। আমার ঘরের হিটিং ঠিকমতো কাজ করছিল না। ঘর অস্বাভাবিক ঠাণ্ডা। দুতিনটি কম্বল গায়ে দিয়ে শুয়ে আছি। এ-রকম দুর্যোগের দিনে ইউনিভার্সিটিতে কী করে যাব তাই ভাবছি। দেশে যেমন প্রচণ্ড বৃষ্টি-বাদলার দিনে ‘রেইনি ডে’-র ছুটি হয়ে যেত, এখানে স্নো ডে বলে তেমন কিছু নেই। চার ফুট বরফে শহর ঢাকা পড়ে গেছে, অথচ তারপরও ইউনিভার্সিটির কাজকর্ম ঠিকমতো চলছে।

সকালবেলার ঘুমের মতো আরামের ব্যাপার এই জগতে খুব বেশি নেই। সেই আরাম ভোগ করছি, ঠিক তখন গুলতেকিন আমাকে ডেকে তুলে ফ্যাকাশে মুখে বলল, আমার যেন কেমন লাগছে।

আমি বললাম, ঠিক হয়ে যাবে।

বলেই আমার ঘুমিয়ে পড়ার চেষ্টা করলাম। সে ভয় পাওয়া গলায় বলল, তুমি বুঝতে পারছ না, এটা মনে হচ্ছে ঐ ব্যাপার।

ঐ ব্যাপার মানে?

মনে হচ্ছে…

মেয়েরা ধাঁধা খুব পছন্দ করে। আমি লক্ষ করেছি, যে-কথা সরাসরি বললেও কোনো ক্ষতি নেই সেই কথাও তারা ধাঁধার মতো বলতে চেষ্টা করে। তার ব্যথা উঠেছে। তাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে এটা বুঝতে আমার দশ মিনিটের মতো লাগল। যখন বুঝলাম তখন স্পাইনাল কর্ড দিয়ে হিমশীতল একটা স্রোত বয়ে গেল। কী সর্বনাশ।

আমি শুকনো গলায় বললাম, ব্যথা কি খুব বেশি?

না, বেশি না। কম। তবে ব্যথাটা ঢেউয়ের মতো আসে, চলে যায়, আবার আসে। এখন ব্যথা নেই।

তাহলে তুমি রান্নাঘরে চলে যাবে, কী বানাও। চা খেতে খেতে চিন্তা করি নি অব অ্যাকশন।

চিন্তা করার কী আছে? তুমি আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবে–ব্যস।

কথা না-বাড়িয়ে চা বানাও। আবার ব্যথা শুরু হলে মুশকিল হবে।

সে রান্নাঘরে চলে গেল। আমি প্ল্যান অব অ্যাকশন ভাবতে বসলাম। গুলতেকিন পুরো ব্যাপারটা যত সহজ ভাবছে, এটা মোটেই তত সহজ না। প্রধান সমস্যা এই প্রচণ্ড দুর্যোগে তাকে হাসপাতালে নিয়ে পৌঁছানো। এ ছাড়াও ছোটখাট সমস্যা আছে, যেমন নোভাকে কোথায় রেখে যাব? কে তার দেখাশোনা করবে? হাসপাতালে গুলতেকিনকে কতদিন থাকতে হবে? এই দিনগুলিতে নোভাকে সামলাব কিভাবে?

নাও, চা খাও। চা খেয়ে দয়া করে কাপড় পর।

নোভাকে কী করব?

কিছু করতে হবে না। আমি ফরিদকে টেলিফোন করে দিয়েছি, সে এসে পড়বে।

ডাক্তারকেও তো খবর দেয়া দরকার।

খবর দিয়েছি।

কাজ তো দেখি অনেক এগিয়ে রেখেছ।

হ্যাঁ, রেখেছি। প্লিজ, চা-টা তাড়াতাড়ি শেষ কর।

চা শেষ করবার আগেই ফরিদ এসে পড়ল। সে কানাডা থেকে এম-এস করে আমাদের ইউনিভার্সিটিতে পি-এইচ-ডি করতে এসেছে। এই ছেলেটি পাকিস্তানী। পাকিস্তানী কারো সঙ্গে নীতিগতভাবেই আমি কোনো যোগাযোগ রাখি না। একমাত্র ব্যতিক্রম ফরিদ। পৃথিবীতে এক ধরনের মানুষ জন্মায় যাদের জীবনের লক্ষ্য হচ্ছে পরের উপকার করা। পরের উপকার করবার সময়টাতেই তারা খানিকটা হাসিখুশি থাকে, অন্য সময় বিমর্ষ হয়ে থাকে। আমি আমার চল্লিশ বছরের জীবনে ফরিদের মতো ভালো ছেলে দ্বিতীয়টি দেখিনি, ভবিষ্যতে দেখব সেই আশাও করি না।

নোভাকে ফরিদের কাছে রেখে আমি হাসপাতালের দিকে রওনা হলাম। বরফ ঢাকা রাস্তায় আমার ভজ পোলারা গাড়ি চলছে। পেছনের সিটে গুলতেকিন কাত হয়ে শুয়ে আছে, মাঝে মাঝে অস্ফুটস্বরে কাতরাচ্ছে। আমি বললাম, ব্যথা কি খুব বেড়েছে?

তুমি গাড়ি চালাও। কথা বলবে না। তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিয়ে যাও। আমার মনে হচ্ছে বেশি দেরি নেই।

কী সর্বনাশ। আগে বলবে তো।

আমি একসিলেটরে পা পুরোপুরি দাবিয়ে দিলাম। গাড়ি চলল উল্কার গতিতে। আমার ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল বলেই অ্যাকসিডেন্ট না করে সেইন্ট লিউক হাসপাতালে পৌঁছতে পারলাম।

নার্স এসে দেখেশুনে বলল, এক্ষুণি ডেলিভারি হবে, চল ও-টিতে যাই।

গুলতেকিনের চিকিৎসকের নাম ড. মেলয়। ডেলিভারি তিনিই করবেন। আমেরিকান ডাক্তারদের সবার কাছেই ওয়াকি টকি জাতীয় একটি যন্ত্র থাকে। তিনি যেখানেই থাকেন তাঁর সঙ্গে মুহূর্তের মধ্যে যোগাযোগ করা যায়। হাসপাতাল থেকে তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হল। তিনি বললেন, এক মিনিটের মধ্যে রওনা হচ্ছি।

আমি পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হয়ে যখন সিগারেট ধরিয়েছি তখন হাসপাতালের মেট্রন বলল, তুমি চল আমার সঙ্গে।

কোথায়?

অপারেশন থিয়েটারে।

কনে?

তুমি তোমার স্ত্রীর পাশে থাকবে। তাকে সাহস দেবে।

ও খুবই সাহসী মেয়ে। ওকে সাহস দেবার কোনো দরকার নেই।

বাজে কথা বলবে না। তুমি এসো আমার সঙ্গে। ডেলিভারির সময় আমরা কাউকে ঢুকতে দেই না। শুধু স্বামীকে থাকতে বলি। এর প্রয়োজন আছে।

আমি তেমন কোনো প্রয়োজন দেখতে পাচ্ছি না।

যা ঘটতে যাচ্ছে তার অর্ধেক দায়ভাগ তোমার। তুমি এরকম করছ কেন?

আমি মেট্রনের সঙ্গে রওনা হলাম। ও-টিতে ঢোকার প্রস্তুতি হিসেবে আমকে মাস্ক পরিয়ে দিল। অ্যাপ্রন গায়ে চড়িয়ে দিল। এক ধরনের বিশাল মোজায় পা ঢেকে দেয়া হলো। আমি ও-টিতে ঢুকলাম। অপারেশন থিয়েটারটি তেমন আলোকিত নয়। আমার কাছে অন্ধকার লাগল। একটা ছোট এবং যন্ত্রপাতিতে ঠাসা। ফিনাইলের যে কটু গন্ধ হাসপাতালে পাওয়া যায় তেমন গন্ধও পেলাম না, তবে নেশা ধরানোর মতো মিষ্টি সৌরভ ঘরময় ছড়ানো।

গুলতেকিনকে বিশেষ ধরনের একটা টেবিলে শুইয়ে রাখা হয়েছে। তার দুপাশে দুজন নার্স। ডা. মেলয় এসে পড়েছেন, তিনি ছুরি-কাঁচি গুছিয়ে রাখছেন। তাদের প্রত্যেকের মুখে মাস্ক থাকার জন্য তাদের দেখাচ্ছিল ব্লু ক্লাক্স ক্লান-এর সদস্যদের মত। তাদের ঠিক মানুষ বলে মনে হচ্ছিল না। মনে হচ্ছিল তারা যেন একদল রোবট। আমি গুলতেকিনের হাত ধরে দাঁড়ালাম।

ডেলিভারি পেইনের কথাই শুধু শুনেছি, এই ব্যথা যে কত তীব্র, কত তীক্ষ্ণ এবং কত ভয়াবহ সেই সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা ছিল না। এই প্রথম ধারণা হ’ল। ঘামে আমার সমস্ত শরীর ভিজে গেল। থর থর করে কাঁপতে লাগলাম। গলা কাটা কোরবানীর পশুর মতো গুলতেকিন ছটফট করছে। এক সময় আমি ডাক্তারকে বললাম, আপনি দয়া করে পেইন কিলার দিয়ে ব্যথা কমিয়ে দিন। ডাক্তার নির্বিকার ভঙ্গিতে বললেন, পেইন কিলার দেয়া যাবে না। পেইন কিলার দেয়া মাত্র কন্টাকশনের সমস্যা হবে। আর মাত্র কিছুক্ষণ।

সেই কিছুক্ষণ আমার কাছে অনন্তকাল বলে মনে হল। মনে হলো আমি লক্ষ লক্ষ বছর ধরে আমার স্ত্রীর হাত ধরে প্রতীক্ষা করছি।

একসময় প্রতীক্ষার অবসান হ’লজন্ম হলো আমার দ্বিতীয় কন্যা শীলার। হাত পা ছুঁড়ে সে কাঁদছে, সরবে এই পৃথিবীতে তার অধিকার ঘোষণা করছে। যেন সে বলছে, এই পৃথিবী আমার, এই গ্রহ-নক্ষত্র-চন্দ্র-সূর্য আমার, এই অনন্ত নক্ষত্রবীথি আমার।

গুলতেকিন ক্লান্ত গলায় বলল, তুমি চুপ করে আছো কেন, আজান দাও। বাচ্চার কানে আল্লাহর নাম শোনাতে হয়।

আমি আমার ফুসফুসের সমস্ত শক্তি দিয়ে চিৎকার করে বললাম, আল্লাহু আকবর…

নার্সের হাতে একটা ট্রে ছিল। ভয় পেয়ে সে ট্রে ফেলে দিল। ডাক্তার আমার দিকে তাকিয়ে তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, What is happening?

তাদের কোনো কথাই আমার কানে ঢুকছে না। আমি অবাক হয়ে দেখছি আমার শিশু কন্যাকে। সে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। পৃথিবীর রূপরসগন্ধ হয়তো-বা ইতিমধ্যেই তাকে অভিভূত করে ফেলেছে। আমি প্রার্থনা করলাম, যেন পৃথিবী তার মঙ্গলময় হাত প্রসারিত করে আমার কন্যার দিকে। দুঃখ-বেদনার সঙ্গে সঙ্গে যেন প্রগাঢ় আনন্দ বারবার আন্দোলিত করে আমার মা-মণিকে।

No comments