ক্যানটারভিলে ভূত – অস্কার ওয়াইল্ড
ক্যানটারভিলে ভূত | Oscar Wilde || The Canterville Ghost
অ্যামেরিকান মিনিস্টার মিঃ হিরাম বি. ওটিস ক্যানটারভিলে চেস বাড়িটি কিনে যে নির্বুদ্ধিতার কাজ করেছেন এই কথাটা ঘুরে-পরে সবাই তাঁকে বলেছিল। কারণ বাড়িটি যে ভূতুড়ে সেবিষয়ে কারও কোনো সন্দেহ ছিল না। এমন কি ন্যায়নিষ্ঠ লর্ড ক্যানটারভিলে নিজেও মিঃ ওটিস তাঁর সঙ্গে দরদস্তুর করতে এলে, তাঁরে এ-বিষয়ে সাবধান করে দিয়েছিলেন।
লর্ড ক্যানটারভিলে বললেন–আমরা নিজেরাই ওই বাড়িটা বাসের উপযুক্ত বলে মনে করিনি। একবার আমার বিধবা পিতামহী বোলটনের ডাচেস ডিনারের জন্যে পোশাক পালটাচ্ছিলেন। এমন সময় দুটি কঙ্কাল হাত এসে তাঁর কাঁধের ওপরে পড়ে। এই দেখেই ভয়ে তিনি মূর্দা যান। আরো একটা কথা আপনাকে আমার বলা দরকার, মিঃ ওটিস, আমাদের সংসারের অনেকেই ওই ভূতটাকে দেখেছে; এমন কি স্থানীয় গির্জার রেকটার এবং কেম্ব্রিজের কিংস কলেজের ফেলো রেভা, আগস্টাস ড্যামপিযরও বাদ যাননি। ডাচেসর সেই দুর্ভাগ্যজনক দুর্ঘটনার পর থেকে আমাদের ছোকরা চাকরদের কেউ আর আমাদের সঙ্গে ওই বাড়িতে থাকতে রাজি হয়নি; আর রাত্রিতে বারান্দা আর লাইব্রেরির দিক থেকে যে সমস্ত অদ্ভুত-অদ্ভুত শব্দ আসত সেই সব শব্দ শোনার পরে লেডি ক্যানটারভাইলের রাত্রে ঘুম হত না।
মিনিস্টারটি উত্তর দিলেন–মি লর্ড, আসবাবপত্র আর ভূত দুজনকেই বাড়ির সঙ্গে দাম নিয়ে আমি কিনে নেব আমি যে-দেশ থেকে আসছি সেটা হচ্ছে আধুনিক। সেখানে টাকা দিয়ে সব কিছু কেনা যায়। আজকাল ছোকরারা পুরনো পৃথিবীটাকে লাল রঙে চিত্র-বিচিত্র করে আর সেরা অভিনেত্রী আর নতকীদের তুলে নিয়ে গিয়ে বাহবা লুটছে। আমার ধারণা ইওরোপে ভূত বলে যদি কোনো পদার্থ থেকেই থাকে তাহলে অতি শীঘ্রই আমরা তার জন্যে জনসাধারণকে আনন্দ দেওয়ার উদ্দেশ্যে হয় যাদুঘরের ব্যবস্থা করে দেব আর নয়তো রাস্তায় নিয়ে খেলা দেখাব।
লর্ড ক্যানটারভিলে একটু হেসে বললেন–আমার বিশ্বাস ভুত রয়েছে, যদিও সে আপনাদের অতি উদযোগী সংগঠকদের প্রস্তাব হয়তো নাকচ করে দিয়েছে। তিনশো বছর ধরে ও এখানে বাস করছে—১৫৪৮ সাল থেকেই একরকম বলতে পারেন এবং আমাদের সংসারে কারও মৃত্যুর আগেই সব সময়ে ও দেখা দিয়েছে।
লর্ড ক্যানটারভিলে, কারও মৃত্যুর আগে বাড়ির ডাক্তারও তো আসেন। কিন্তু স্যার, ভূত বলে। কোনো বস্তু নেই। আমার ধারণা ব্রিটিশ অভিজাত সম্প্রদায়কে খুশি করার জন্যে প্রকৃতি তার। কর্তব্যকর্মে অবহেলা করবে না।
মিঃ ওটিসের শেষ মন্তব্যটি অনুধাবন করতে না পেরে লর্ড ক্যানটারভিলে বললেন–অ্যামেরিকাতে আপনারা খুব স্বাভাবিক অবস্থায় দিন কাটান; আর বাড়িতে আপনি যদি ভূতের অস্তিত্ব স্বীকার না করেন তাহলে আমার অবশ্য বলার কিছু নেই। কেবল মনে রাখবেন এ-বিষয়ে আপনাকে আমি আগেই সাবধান করে দিয়েছি।
সপ্তাহ খানেকের ভেতরেই বাড়ি কেনার কাজ শেষ হয়ে গেল; মাসের শেষ নাগাদ। মিনিস্টার আর তাঁর সংসারের সবাই সেই বাড়িতে উঠে এলেন। মিসেস ওটিস এখন মধ্যবয়স্কা রমণী, চোখ দুটি আর চেহারা বড়োই সুন্দর। ইনি ছিলেন প্রাক-বিবাহিত জীবনে ওয়েস্ট তিপ্পান্নতম স্ট্রিটের নিউ ইয়র্কের প্রখ্যাত নর্তকী মিস লুক্রেসিয়া আর টাপান। দেশ। ছাড়ার পরে অনেক আমেরিকান মহিলাদের স্বাস্থ্যভঙ্গ হয়ে যায়–এক কথায় তাঁরা হয়ে। পড়েন চিররুগ্ন; তাঁরা মনে করেন এইটাই বুঝি ইওরোপীয় শালীনতা। কিন্তু মিসেস ওটিস সে ভুল করেননি। তাঁর স্বাস্থ্যটি বড়ো চমৎকার ছিল। জৈব প্রেরণায় তিনি ছিলেন উদ্দাম। সত্যি কথা বলতে কি অনেক দিন থেকেই তিনি ছিলেন ইংরাজ রমণী। আজকাল এক ভাষা ছাড়া আমেরিকার সঙ্গে আমাদের যে অদ্ভুত একটা মিল রয়েছে তিনি ছিলেন তারই একটি উজ্জ্বল। নিদর্শন। জাতীয়তাবাদের উৎসাহে বাপ-মা তাঁদের বড়ো ছেলের নাম দিয়েছিলেন ওয়াশিংটন। এর জন্যে অনুশোচনা তাঁরা কম করেননি। ছেলেটির চুলগুলি বড়ো। চমৎকার–দেখতে মোটামুটি ভালোই। পরপর তিনটি বছর নিউপোর্ট ক্যাসিনোতে জার্মানদের হারিয়ে আমেরিকান কূটনীতিতে সে যথেষ্ট দক্ষতা অর্জন করেছিল। এমন কি লন্ডনেও বেশ ভালো নাচিয়ে হিসাবে সে বেশ নাম করেছিল। মিস ভাউিনিযার বয়স পনেরো-চঞ্চলা, হরিণ শিশুর মতো সুন্দর দুটি বড়ো বড়ো নীল চোখ-স্বাধীন আর বেপরোয়া। শক্তির দিক থেকেও একেবারে রণদুর্মদা। একবার টাটু ঘোড়ার ওপরে চেপে সে বৃদ্ধ লর্ড বিলটনের সঙ্গে দু’দুবার পার্কের চারপাশে দৌড়ে অ্যাকিলিসের প্রতিমূর্তির ঠিক সাত হারিয়ে দিয়েছিল। এই দেখে চেশায়ারের যুবক ডিউক আনন্দে এতই উত্তেজিত হয়ে ওঠে যে। সে সেখানেই তাকে বিয়ের প্রস্তাব করে। ফলে তার অভিভাবকেরা সেই রাত্রিতেই তাকে ইটনে পাঠিয়ে দেন। ডিউক কাঁদতে কাঁদতে চলে যায় ইটলে। ভার্জিনিয়ার পরে দুটি যমজ ছেলে হয়। তারা সব সময় বনবন করে ঘুরত বলে তাদের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘দি স্টারস আর স্ট্রাইপস, বড়ো সুন্দর ছেলে দুটি একমাত্র মিঃ ওটিস ছাড়া সেই পরিবারের ওরাই ছিল একমাত্র রিপাবলিকান।
ক্যানটারভিলে চেস সবচেয়ে কাছের রেল স্টেশন অ্যাসকেট থেকে সাত মাইল দূরে। মিঃ ওটিস একটা খোলা গাড়ির জন্যে টেলিগ্রাফ করেছিলেন। সবাই বেশ সুর্তি করে হইচই করতে-করতে গাড়িতে উঠে বসলেন। জুলাই মাসের একটি সুন্দর সন্ধ্যা-পাইন বনের গন্ধে বাতাস একেবারে মাতোয়ারা। মাঝে-মাঝে বুনো পায়রার ডাক শোনা যাচ্ছিল। বীচ গাছের ভেতর দিয়ে তাঁদের দিকে তাকিয়ে দেখতে লাগল বাচ্চা বাচ্চা কাঠবিড়ালেরা। ক্যানটারভিলে চেস-এর রাস্তায় ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে আকাশ হঠাৎ মেঘাচ্ছন্ন হয়ে গেল। নেমে এল বাতাসে একটা থমথমে ভাব। মাথার ওপর দিয়ে একদল দাঁডকাক নিঃশব্দে উড়ে গেল। বাড়িতে পৌঁছানোর আগেই কয়েকটা বড়ো বড়ে
একটি বৃদ্ধা মহিলা সিঁড়ির ওপরে নেমে এসে তাঁদের অভ্যর্থনা জানালেন। পরিধানে তাঁর কালো সিল্কের একটি পরিচ্ছন্ন পোশাক, মাথায় সাদা টুপি, আর গায়ে সাদা এপ্রোন। ইনি হচ্ছেন গৃহকর্ত্রী মিসেস উমনে। লেডি ক্যানটারভিলের অনুরোধ তাঁকেই মিসেস ওটিস তাঁর পূর্ব পদে বহাল রাখতে রাজি হয়েছিলেন। তাঁর পিছু পিছু তাঁরা সবাই সুন্দর টিউডর যুগের হলঘর পেরিয়ে লাইব্রেরি ঘরে এসে ঢুকলেন। ঘরটা হচ্ছে লম্বা, নীচু কালো ওক গাছের প্যানেল দেওয়া ঘর। এখানেই চা-এর বন্দোবস্ত হয়েছিল। জামা খুলে তাঁরা সবাই বসে চারপাশে তাকিয়ে দেখতে লাগলেন। মিসেস উমনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে করতে লাগলেন তদারকি।
হঠাৎ মিসেস ওটিস লক্ষ করলেন ফায়ার প্রেসের পাশে মেঝের ওপরে হালকা ধরনের একটা লাল দাগ পড়ে রয়েছে। এর অর্থটা কী বুঝতে না পেরে তিনি মিসেস উমনেকে বললেন–ওখানে সম্ভবত কোনো রঙ পড়েছে।
মিসেস উমনে নীচু স্বরে বললেন–হ্যাঁ, মাদাম। ওখানে রক্তের ছিটে পড়েছে।
মিসেস ওটিস চিৎকার করে উঠলেন–কী বিপদ! বসার ঘরে ওরকম রক্তের দাগ আমি মোটেই বরদাস্ত করতে পারি লো এখনই ওটা মুছে ফেলতে হবে।
বৃদ্ধাটা হেসে আগের মতোই রহস্যজনক স্বরে বললেন–ওটা হচ্ছে লেডি এলিনোর দ্য ক্যানটারভিলের রক্ত। ১৫৭৫ সালে ঠিক এই জায়গাতেই স্বামী স্যার সাইমন দ্য ক্যানটারভিলে তাঁকে হত্যা করেছিলেন। স্যার সাইমন তারপরে নটি বছর বেঁচেছিলেন। তার পরেই একদিন রহস্যজনকভাবে হঠাৎ তিনি নিরুদ্দেশ হয়ে যান। তাঁর দেহটিকে আডও খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাঁরই প্রেতাত্মা এখন-ও এই বাড়িতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বিদেশি পর্যটক এবং আরো অনেক এই রক্তচিহ্নটিকে খুবই প্রশংসা করেছেন; আর ওটিকে আজ পর্যন্ত মুছে ফেলা সম্ভব হয়নি।
ওয়াশিংটন ওটিস চিৎকার করে বলল–যত সব আবোল-তাবোলের কথা! পিনকারটার চ্যাম্পিয়ন স্টেন রিমোভার এবং প্যারাগন ডিটারজেন্ট লাগালেই ও-রঙ উঠে যাবে।
সেই ভয়ার্ত গৃহকর্ত্রী কিছু বলার আগেই সে হাঁটু মুড়ে বসে কালো কসমেটিক-এর মতো একটা চিটচিটে বস্তু দিয়ে মেঝেটা ঘষতে শুরু করল। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই সেই দাগ উঠে গেল।
বিজয়গর্বে সে চেঁচিয়ে উঠল–আমি জানতাম এতেই কাজ হবে। কিন্তু এই কথা বলার সঙ্গে-সঙ্গে হঠাৎ একটা বিদ্যুৎ চমকে উঠল, সেই থমথমে ঘরের মধ্যে বিদ্যুতের ঝিলিক খেলে গেল–আর ভীষণ একটা বঙ্ঘাত তাঁদের সকলের আপাদমস্তক কাঁপিয়ে দিয়ে গেল। মিসেস উমনে তো সেই শব্দে ভির্মি গেলেন।
অ্যামেরিকান মিনিস্টার শান্তভাবে বললেন–সত্যিই কি ভয়ঙ্কর আবহাওয়া! এই বলে তিনি লম্বা একটা চুরুট ধরালেন।-আমার ধারণা, এই পুরনো অঞ্চলটির লোকসংখ্যা এতই বেশি গিয়েছে যে প্রত্যেকে ভালো আবহাওয়া পাচ্ছে না। আমি সব সময়েই বলে এসেছি এই সমস্যা সমাধানের একমাত্র উপায় হচ্ছে এদেশ থেকে জনতাকে বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়া।
মিসেস ওটিস বললেন–প্রিয় হিরাম, যে মহিলা মূৰ্ছা যান তাঁকে নিয়ে আমরা কী করব?
ভাঙা জিনিসপত্রের মতো ব্যবহার কর-তাহলে আর উনি মূৰ্ছা যাবেন না।
কিছুষ্কণের মধ্যেই মিসেস উমনের জ্ঞান ফিরে এল। তিনি যে বেশ বিব্রত হয়ে পড়েছিলেন সেবিষয়ে কোনো সন্দেহ ছিল না। তিনি কঠোরভাবে মিঃ ওটিসকে এই বলে সাবধান করে দিলেন যে এই সংসারের ওপরে বিষম একটা বিপদ ঘনিয়ে আসছে।
তিনি বললেন নিজের চোখে আমি অনেক জিনিস দেখেছি, স্যার। সেই সব দেখে যে কোনো ক্রিশ্চানের শরীরেই রোমাঞ্চ জেগে উঠবে। এখানে যে সব ভয়ঙ্কর জিনিস ঘটেছে সেই সব দেখে রাত্রে আমি ঘুমোতে পারি নে।
মিঃ ওটিস এবং তাঁর স্ত্রী অবশ্য সেই সৎ মহিলাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন যে ভূতটুতকে তাঁরা ভয় করেন না। তাঁর নতুন মনিব-পত্নীর ওপরে ঈশ্বরে আশীর্বাদ বর্ষিত হোক এই প্রার্থনা করে আর সেই সঙ্গে মাইনে বাড়ানোর ব্যবস্থা করে বৃদ্ধা গৃহকর্ত্রী টলতে টলতে নিজের ঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন।
সারা রাত্রি ধরেই ভীষণ ঝড় চলল; কিন্তু বিশেষ কোনো ঘটনা ঘটেনি। পরের দিন সকালে কিন্তু মেঝের ওপরে আবার সেই রক্তের দাগটা দেখা গেল। ব্রেকফাস্টের সময় সবাই নীচে নেমে এসে ব্যাপারটা লক্ষ করল। ওয়াশিংটন বলল–আমার মনে হচ্ছে এর জন্যে প্যারাগন ডিটারজেন্টের দোষ নেই। এটা আমি অনেক পরীক্ষা করেছি। এর জন্যে নিশ্চয় ওই ভূতটাই দাষী। আবার সে ঘষে-ঘষে রক্তের দাগটা মুছে ফেলল; কিন্তু পরের দিন সকালে আবার সেই একই ব্যাপার ঘটল। যদিও লাইব্রেরি ঘরে যথারীতি তালা দেওঘা দিল, তৃতীয় দিন সকালেও সেই রক্তের দাগ দেখা দিল। এই দেখে সবাই বেশ কৌতূহলী হয়ে উঠল। মিঃ ওটিস ভাবলেন, ভূত নেই এ-বিষয়ে তাঁর ধারণা কিছুটা বাড়াবাড়ি হয়ে পড়েছিল। মিসেস ওটিস মনে করলেন প্রেতাত্মা নিয়ে যাঁরা গবেষণা করেন তাঁদের দলে তিনি নাম লেকাবেনা অপরাধের সঙ্গে ভডিত রক্তচিহ্নের স্থায়িত্ব নিয়ে মেসার্স মেঘারস আর পড়মোর কোম্পানিকে দীর্ঘ একটি চিঠি লেখার পরিকল্পনা গ্রহণ করল। ওয়াশিংটন। সেই রাত্রিতেই রাত্রিতেই ভূতের অস্তিত্ব সম্বন্ধে সকলের সন্দেহ চিরদিনের জন্যে দূর হল।
সারাটা দিনই যেমন রোদ উঠেছিল তেমনি ছিল গরম, শীতল। সন্ধ্যায় সবাই মোটরে চড়ে বেড়াত গেযেছিল। রাত্রি ন’টার আগে কেউ ফেরেনি সেদিন। ফিরেই সামান্য আহার করেছিল সবাই। সেদিন ভূত নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। সুতরাং ভূতের অস্তিত্ব সম্বন্ধে ধারণা করার প্রাথমিক কোনো শর্তও সেদিন ছিল না। মিঃ ওটিসের কাছে আমি শুনেছিলাম সেদিন তাঁদের আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল বিভিন্ন ধরনের, বিশেষ করে অবস্থাপন্ন আমেরিকানরা যে সব বিষয় নিয়ে সাধারণত আলোচনা করে–যেমন, অভিনেত্রী হিসাবে সারা বার্নদোতের চেয়ে মিস ফ্যানি ড্যাভোনপোর্টের শ্রেষ্ঠতা, এমন কি অবস্থাপন্ন ইংরাডংদের বাড়িতে সবুজ শস্য, বাকযুইট কেক, দুধে সেদ্ধ ভুট্টাচূর্ণের দুষ্প্রাপ্যতা; পৃথিবীর আত্মাকে বাঁচানোর জন্যে বোস্টন বন্দরের প্রয়োজনীয়তা, রেল-ভ্রমণে গাঁটরি পরীক্ষা করার সুবিধা, লন্ডনের বিরক্তিকর উচ্চারণের তুলনায় নিউ ইয়র্কের উচ্চারণের মিষ্টতা ইত্যাদি। অতিপ্রাকৃত ঘটনার সম্বন্ধে। কোনো আলোচনাই সেদিন হয়নি, এমন কি গল্পচ্ছলে স্যার সাইমন দ্য ক্যাটারভাইলের নাম উচ্চারণও কেউ করেননি। রাত্রি এগারোটার সময় সবাই শুয়ে পড়লেন এবং সাড়ে এগারোটার মধ্যেই ঘরের আলো সব নিবে গেল। কিছুক্ষণ পরে ঘরের বাইরে বারান্দায় ওপরে একটা অদ্ভুত শব্দে মিঃ ওটিসের ঘুম ভেঙে গেল। শব্দটা শুনে মনে হল ধাতুত ধাতুতে ঠোকাঠুকির শব্দ। আরো মনে হল শব্দটা ক্রমশ তাঁর ঘরের দিকেই এগিয়ে আসছে। সঙ্গে সঙ্গে তিনি। বিছানা থেকে উঠে দেশলাই জ্বালিয়ে সময়টা দেখে নিলেন। ঘড়িতে তখন কাঁটায় কাঁটায় একটা বেড়েছে। বেশ শান্তভাবেই নিজের নাড়িটা দেখে নিলেন। না; এতটুকু বেচাল হয়নি নাড়ি। সেই অদ্ভুত শব্দটা তখনো হচ্ছিল। তিনি বেশ স্পষ্টই শুনতে পেলেন কেউ যেন পা ঠুকে ঠকে তাঁর দিকে এগিয়ে আসছে। চটি পরে তিনি তাঁর ‘ড্রেসিং কেস’ থেকে লম্বাটে একটা ফাইল। বার করে দরজাটা খুললেন। ম্লান চাঁদের আলোতে তিনি দেখলেন তাঁরই সামলে ভয়ঙ্কর চেহারার এরটি বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার চোখ দুটো জলন্ত কয়লার মতো জ্বলছে। জটার মতো লম্বা ধূসর চুলগুলো ঝাঁপিয়ে পড়েছে তার কাঁধের ওপরে। তার পরিধানে প্রাচীন কালের পোশাক, সেগুলি যেমন নোংরা, তেমনি ফেঁড়া। তার হাতের কব্ধি আর পায়ের গাঁট থেকে বেশ ভারী আর মরচে-পড়া শেকল ঝুলছে।
মিঃ ওটিস বললেন–প্রিয় মহাশয়, ওই শেকলগুলিতে তেল দেওয়ার জন্য বাধ্য হয়েই আমি আপনাকে অনুরোধ জানাচ্ছি। আর সেই জন্যেই তামানি রাইসিং সান লিউব্রিকেটর’-এর একটা ছোটো শিশি আমি এনেছি। একবার লাগালেই কাজ হবে এতে। এর গুণ কত সে সম্বন্ধে। প্রশংসাপত্র-ও এর গায়ে সাঁটা রয়েছে। শোওয়ার ঘরের বাতির কাছে এটা আমি রাখছি। প্রয়োজন হলে এই জাতীয় আরো তেল আমি আপনাকে আনন্দের সঙ্গেই সরবরাহ করব।
এই বলে যুক্তরাষ্ট্রের মন্ত্রী মহোদয় মার্বেল টেবিলের ওপরে শিশিটি রেখে দরজা বন্ধ করে শোওয়ার জন্যে প্রস্থান করলেন।
স্বাভাবিক একটা ঘৃণা আর বিরক্তিতে ক্যানটারভাইলের ভূত এক মুহূর্ত চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। তারপরে সেই পালিশকরা মেঝের ওপরে সজোরে শিশিটাকে আছাড় দিয়ে শুকনো আর্তনাদ করতে করতে আর ভৌতিক সবুজ একটা আলো ছড়াতে ছড়াতে ভূতটি বারান্দা। দিয়ে পালিয়ে গেল। ঠিক যখন সে ওক কাঠের বিরাট সিড়িঁটার ওপরে গিয়ে দাঁড়িয়েছে এমন সময় একটা দরজা হাট হয়ে খুলে গেল; দুটি খুদে সাদা পোশাক-পরা মূর্তির আবির্ভাব হল। আর সেই সঙ্গে একটা লম্বা বলিশ তার মাথার ওপর দিয়ে হুইশ-ইশশব্দে করে উড়ে গেল। নষ্ট করার মতো সময় আর না থাকায় ভূতটি ঝটিতি চতুর্থ ডাইমেনশনের সাহায্যে কাঠের তক্তার ভিতর দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। তারপরে শান্ত ই বাড়িটি।
বাড়িটা বাঁ দিকে ছোটো একটা গোপন কষ্কে ঢুকে চাঁদের রশ্মির পিঠে হেলান দিয়ে বসে সহজভাবে সে নিঃশ্বাস নিতে লাগল। সেইখানে বসেই নিজের অবস্থাটা ভালো করে বোঝার চেষ্টা করল সে। বিগত তিনশো বছরের গৌরবোজ্জ্বল এবং নিবরচ্ছিন্ন জীবনে এইভাবে অপমানিত সে আর কোনোদিন হয়নি। বিধবা ডাচেসের কথা তার মনে পড়ল। লেস আর মুক্তা হাতে নিয়ে যখন তিনি আমার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন সেই সময় ভয় দেখিযে সে তাঁকে জ্ঞান হারাতে বাধ্য করেছিল। একটা খালি ঘরের পর্দা তুলে সে স্রেফ ভেংচি কেটে যে চারটি পরিচারিকাকে উন্মাদ করে তুলেছিল তাদের কথা মনে হল তারা মনে হল স্থানীয় গির্জার রেকটরের কথা। একদিন বেশি রাত্রি করে লাইব্রেরি থেকে তিনি যখন ফিরছিলেন। এমন সময় সে তাঁর বাতিটা নিবিয়ে দিয়েছিল। তারপর থেকে ভদ্রলোক স্যার উইলিয়ম। গাল-এর চিকিৎসাধীন ছিলেন। বলতে গেলে স্নায়ু-বৈকল্যেই তিনি শেষ পর্যন্ত আপ্পাদান। করেন। মনে পড়ে গেল বৃদ্ধা মাদাম দ্য ট্রিমোলিক-এর কথা। ভদ্রমহিলা একদিন প্রত্যুষে উঠে দেখেন আগুনের ধারে একটি আরাম কেদারায় বসে একটি কংকাল তাঁর নিজের ডায়েরি পড়ছে। এর ফলে তিনি দু’সপ্তাহ মানসিক রোগে বিছানায় পড়ে ছিলেন। সেরে উঠে তিনি গির্জার চলে গেলেন। তারপর থেকে কুখ্যাত নাস্তিক মঁসিয়ে দ্য ভলতেযরের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ত্যাগ করেন। সেই ভয়ঙ্কর রাত্রির কথা তার মনে পড়ে গেল যেদিন গলার ভেতরে। মুক্তার মালা ঢুকিযে অসৎচরিত্র লর্ড ক্যানটারভিলেকে দমবন্ধ অবস্থায় তার ড্রেসিং রুমে পড়ে থাকতে দেখা গেল। মৃত্যুর ঠিক আগে সে স্বীকার করেছিল যে তাসের ভেলকি দেখিয়ে চার্লস জেমস ফক্সকে সে পঞ্চাশ হাজার পাউন্ড ঠকিযেছিল; আর ভূতই যে তাকে ওই মালাটা গিলতে বাধ্য করেছিল সেকথাও স্বীকার করতে দ্বিধা করেনি সে। সেই সব বিরাট বিরাট কৃতিত্বের কথা মনে পড়ে গেল তার মনে পড়ল বাটলারের কথা। ডানালার কপাটের ওপরে সবুজ একটা হাতকে ঠুকঠুক করতে দেখে বেচারা নিজেকেই নিজে গুলি করে হত্যা করল। সেই সুন্দরী লেডি স্টাটফিল্ডের কথাও সে ভুলতে পারল না। তাঁর সেই শ্বেতকণ্ঠের ওপরে পাঁচটা আঙুলের দাগ চিপে বসে যে ক্ষতের সৃষ্টি করেছিল সেই ক্ষত ঢাকার জন্যে তিনি সব সময় কালো ভেলভেটের বন্ধনী গলার ওপরে জড়িয়ে রাখতেন। তারপরে একদিন তিনি পুকুরে ডুবে আত্মহত্যা করলেন। সত্যিকার কলাবিদের আত্মম্ভরিতার উৎসাহে সে তার ভীবনের কৃতিত্বপূর্ণ অধ্যায় গুলি নিয়ে আলোচনা করল। এইসব কৃতিত্ব দেখানোর পরে কোথা থেকে হতভাগা একটা আমেরিকান এসে তাকে রাইসিং সান লিউব্রিকেটর দিতে চায়! তার। মাথা লক্ষ করে বালিশ ছুঁড়ে দেয়! অহো ভাগ্যম! অসহ্য, অসহ্য! তাছাড়া, কোনো ভুত যে। নশ্বর মানুষের কাছে এইভাবে অপমানিত হয়েছে এর নজির ভুতদের ইতিহাসে আর। কোথাও নেই। সেই জন্যে, প্রতিহিংসা চরিতার্থতাকে করতেই হবে। আর সেই চিন্তাতেই মারা দিনটাই সে মশগুল হয়ে বসে রইল।
পরের দিন সকালে ওটিসরা ব্রেকফাস্টের টেবিলে বসে ভূতের বিষয়ে কিছু আলোচনা করলেন। তাঁর উপহার এটি গ্রহণ করেনি এটা দেখে যুক্তরাষ্ট্রের মিনিস্টার স্বাভাবিকভাবেই কিছুটা বিরক্ত হলেন। তিনি বললেন-ভূতের শীরীরিক কোনো ক্ষতি করার ইচ্ছা আমার নেই, কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরে ভূতটি এখানে বাস করছে সেই কথা ভেবে এটা বলতে আমি বাধ্য যে তাকে লক্ষ করে বালিশ ছোঁড়াটা ভদ্রতাসূচক হয়নি।
যথার্থ মন্তব্য; কিন্তু দুঃখের সঙ্গে বলছি যে এই কথা শুনে দুটি যমজ ভাই একেবারে হো-হো করে হেসে উঠল
মিঃ ওটিস বলে গেলেন–অন্য পক্ষে ‘রাইসিং সান লিউব্রিকেটর’ নিতে ওর যদি সত্যিই আপত্তি থাকে তাহলে ওর শেকলগুলি আমাদের খুলে নিতে হবে। কারণ ঘরের বাইরে এই ধরনের শব্দ হলে রাত্রিতে ঘুমের ব্যাঘাত হতে বাধ্য
সপ্তাহের বাকি কটা দিন অবশ্য তাঁরা নির্ঝঞ্ঝাটেই কাটিয়েছেন। ভূতটি কোনোরকম অদ্ভুত কাজ করার চেষ্টা করেনি। লাইব্রেরির মেঝেতে সেই রক্তের দাগটাই কেবল প্রতিদিন দেখা যাচ্ছিল–আর সেইটাই সকলকে বেশ উত্তেজিত করে রেখেছিল ব্যাপারটা সত্যিই বড়ো অদ্ভুত মিসেস ওটিস নিজে প্রতিদিন রাত্রিতে ওই ঘরটা চাবি দিয়ে বন্ধ করে দিতেন; সেই সঙ্গে খুব শক্ত করে বন্ধ করা হত জানালাগুলি অবাক হওয়ার একমাত্র কারণ হচ্ছে এই যে রঙটা বহুরূপী। কোনো কোনো দিন সকালে ওটা ফিকে (প্রায় ভারতীয়) লাল, কোনো কোনো দিন সিঁদুরের মতো, কোনো কোনো দিন বা বেগনে। হঠাৎ একদিন প্রার্থনা থেকে ফিরে এসে তাঁরা দেখেন রঙটা হয়েছে উজ্জ্বল পান্নার মতো সবুজ রঙের এই দ্রুত পরিবর্তন স্বাভাবিকভাবেই তাঁরা বেশ আমোদ পেতেন; আর এর আসল চরিত্রটা যে কী তাই নিয়ে বাজি ধরতে তারা দ্বিধা করতেন না। এঁদের মধ্যে একমাত্র ভার্জিনিয়াই ওঁদের। তর্ক-আলোচনা থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখত। এই রক্তের দাগ দেখে বেশ কষ্ট হত তার। যে সকালে রক্তটা পান্নার মতো সবুজ হয়ে দাঁড়াল সেদিনই আর একটু হলে সে প্রায় কেঁদেই ফেলত।
রবিবার রাত্রিতে ভূতটির দ্বিতীয় আবির্ভাব হল। সবাই শুয়ে পড়ার একটু পরেই হঠাৎ হলঘরের মধ্যে কিছু একটা ভেঙে পড়ে যাওয়ার শব্দ হল। সেই ভীষণ শব্দে সবাই বেশ ভয় পেয়ে গেলেন। সবাই দৌড়ে নীচে নেমে এসে দেখলেন একটা জায়গায কতকগুলি পুরনো বর্ম ঝোলানো ছিল, সেগুলি স্থানচ্যুত হয়ে শানবাঁধানো মেঝের ওপরে পড়ে গিয়েছে। আর উঁচু পিঠওয়ালা চেয়ারে বসে রয়েছে ক্যানটারভিলে ভূতা বসে-বসে হাঁটু দুটো সে ঘষছে; আর ভীষণ যন্ত্রণায় বিকৃত করছে তার মুখ। যমজ ভাই দুটি তাদের খেলার বন্দুক সঙ্গে নিয়ে এসেছিল। ভূতের মাথা লক্ষ করে অভ্রান্তভাবে তারা দুটো ছররা ছুড়ল; আর ক্যালিফোরনিয়ান ভদ্রতা অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রের মন্ত্রী রিভলভার উঁচিয়ে ভূতটিকে মাথার। ওপরে হাত দুটো তুলতে নির্দেশ দিলেন। রাগে বিকট একটা চিৎকার করে ভূতটি লাফিয়ে উঠল; তারপরে ধোঁয়ার মতো সেখান থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল। যাওয়ার সময় ওয়াশিংটন। ওটিসের বাতিটা নিবিঘে দিয়ে চারপাশ অন্ধকারে ঢেকে দিয়ে গেল। একেবারে থামল সিড়িঁর উপরে গিয়ে। সেখানে দাঁড়িয়ে সে তার বিখ্যাত দৈত্যসুলভ হাসিটি হাসতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হল। কয়েকবারই সে দেখেছে এই হাসিটি তার বড়োই কাজে লেগেছে। শোনা যায় এই দানবীয় হাসি শুনে একরাত্রিতেই লর্ড বেকারের অমন ঝাঁকড়া-ঝাঁকড়া কালো চুল পেকে সাদা হয়ে গিয়েছে। আর মাস শেষ হওয়ার আগেই লেডি ক্যানটারভাইলের ফরাসি গভর্নেসরা চাকরি ছাড়ার নোটিশ দিতে বাধ্য হয়েছিল। সেই ভেবে সেই দানবীয় হাসিটি সে হাসল পুরনো বাডির খিলালে সেই ভয়ঙ্কর হাসিটি উন্মত্ত কলরবে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল; কিন্তু সেই প্রতিধ্বনি মিলিয়ে যেতে না যেতেই সামনের একটা দরজা খুলে গেল; আর ফিকে নীল একটা ড্রেসিং গাউন পরে বেরিয়ে এলেন মিসেস ওটিস; বললেন–আমার ধারণা আপনার শরীরটা ভালো নেই। সেই জন্যে আমি এক বোতল ডাক্তার দোবেল-এর তৈরি মিকচার নিয়ে এসেছি। যদি বদহজম হয়ে থাকে তাহলে এতে আপনার যথেষ্ট উপকার হবে।
এই শুনে রাগে গরগর করতে-করতে ভূতটি তাঁর দিকে ক্যাঁট-ক্যাঁট করে তাকিয়ে রইল; তারপরে ঠিক করল একটা বড়ো কালো কুকুরের বেশ ধরবে সে। এই কাজে তার দক্ষতা সত্যিই ছিল অগাধ। কিন্তু সেই সময় তার দিকে এগিয়ে আসার পদশব্দ পেযেই সে তার সেই ভয়ঙ্কর পরিকল্পনা কার্যকরী করবে কিনা ভাবতে লাগল। সুতরাং সে ঈষৎ অগ্নিশিখায় রূপান্তরিত হয়েই সন্তুষ্ট হল; তারপরে গভীর একটা কবরখানার অতনাদ করেই সে অদৃশ্য হয়ে গেল। ঠিক সেই সময় যমজ দুটি ভাই কাছে এসে পড়ল।
নিজের ঘরে এসে সে একেবারে ভেঙে পড়ল। একটা তোলপাড় শুরু হয়ে গেল তার মনের মধ্যে। যমজ ভাই দুটির অসভ্যতা, আর মিসেস ওটিসের জঘন্য বস্তুবাদ স্বাভাবিকভাবেই তার কাছে বড়োই বিরক্তিকর মনে হল। কিন্তু যেটা তার কাছে বিষম কষ্টদায়ক হল সেটা হচ্ছে এই যে সে বর্মটাকে পরতে পারল না। সে ভেবেছিল ভূত বর্ম পরে বসে রয়েছে এই দৃশ্য দেখে আধুনিক আমেরিকানেরও তাক লেকে যাওয়ার কথা। এর পেছনে অন্য কোনো সুবোধ্য কারণ না থাকলেও, তাদের ভাতীয় কবি লও ফেলোর সম্ভ্রমের জন্যেই তার চমকে যাওয়া উচিত ছিল। ক্যানটারভিলেরা যখন শহরে যেতেন তখন সারাদিনের মধ্যে একটি ক্লান্ত ঘন্টা সে নিজেও লও ফেলোর কবিতার বই-এর পাতা অনেকবার উলটিযেছে। কেনিলওয়ার্থ টুর্নামেন্টে সে নিজে এই বর্মটি বেশ সাফল্যের সঙ্গেই পরেছে; আর তাই দেখে অনূঢ় রানি। নিজেই তার কত প্রশংসা করেছেন। তবু আজ যখন সে সেই বর্মটি পরতে গেল তখন তার বিষম ভার বইতে না পেরে মেঝের ওপরে সে হুড়মুড় করে পড়ে গেল, পড়ে যাওয়ার ফলে তার ডান হাতের আঙুলের গাঁটগুলি হতবিহষ্কৃত হল; হাঁটুর ওপরে বসে যন্ত্রণায় সে কুকুরের মতো চিৎকার করে উঠল।
এর পরে কয়েকটা দিন সে ভীষণ রকম অসুস্থ হয়ে উঠল। সেই রক্তাক্ত দাগটিকে যথাস্থানে। বসিয়ে দেওয়া ছাড়া নিজের ঘর থেকে সে বাইরে প্রায় বেরোল না বললেই হয়। যাই হোক, খুব সাবধানে থাকার ফলে সে সুস্থ হয়ে উঠল; সুস্থ হয়েই যুক্তরাষ্ট্রের মন্ত্রী আর তাঁর পরিবারবর্গকে শায়েস্তা করার জন্যে সে তৃতীয় পরিকল্পনা গ্রহণ করতে কৃতসংকল্প হল। তার পুনরাবির্ভাবের দিল ঠিক করল শুক্রবার, ১৭ই আগস্ট। সেদিনের বেশির ভাগ সময়টাই সে তার পোশাক রাখার আলমারিটা ঘাঁটল। অনেক ঘেটেঘুটে সে একটা লাল পালক দেওয়া খোলসের তৈরি টুপি বার করল; সেই সঙ্গে বার করল মরচে-পড়া একটা ছোরা। সন্ধের দিকে ভয়ঙ্কর ঝড়ের সঙ্গে শুরু হল বৃষ্টি। এত ডোরে বাতাস বইতে লাগল যে পুরনো বাড়ির জানালা-দরজাগুলো সব খটাখট করে শব্দ করতে লাগল। সত্যি কথা বলতে কি এই রকম একটা আবহাওয়াকেই সে পছন্দ করতে বেশি। তার পরিকল্পনাটা হচ্ছে এইরমক ওয়াশিংটন ওটিসের ঘরে সে নিঃশব্দে প্রবেশ করবে। বিছানার কাছে পায়ের দিকে দাঁড়িয়ে তার দিকে তাকিয়ে সে বিড বিড় করে কথা বলবে; তারপর মৃদু একটা সঙ্গীতের সুরের তালে-তালে নিজের গলার মধ্যে তিনবার জােরটা বসিয়ে দেবে। ওয়াশিংটন ওটিস-ই ‘পিঙ্কারটনের প্যারাগন ডিটারজেন্ট দিয়ে বারবার সেই রক্তের দাগটা মুছে দিচ্ছে। এই জন্যে তারই ওপরে তার রাগটা ছিল বেশি। সেই বেপরোয়া আর মূর্খ যুবকটিকে ভয়ে একেবারে উথানশক্তিরহিত করে দিয়ে সে ঢুকে যাবে সেই ঘরে যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের মন্ত্রী আর তাঁর স্ত্রী ঘুমোচ্ছেন। মিসেস ওটিসের কপালের ওপরে তার চিটচিটে হাতটা রেখে কবরখানার ভয়ঙ্কর গোপন রহস্যের কথা ফিসফিস করে মিঃ ওটিসের কানের কাছে আওড়াবো ভার্জিন্যি মেয়েটার ব্যাপারে সে এখনই কিছুই ঠিক করে উঠতে পারেনি। মেয়েটি বেশ শান্তশিষ্ট। এখনো পর্যন্ত সে তাকে কোনো আপমান। করেনি। ওয়ার্ডোবের ভেতর থেকে কয়েকটা শূন্যগর্ভ আওয়াজও তার পহেক্ক যথেষ্ট হবে। তাতেও যদি তার ঘুম না ভাঙে তাহলে সে কাঁচের জানালাটা বাগিয়ে ধরে একটু আঁচড়াবে। আর ওই যমজ ভাই দুটো, তাদের সে বেশ একটু শিক্ষা দেবেই। প্রথমেই অবশ্য সে তাদের বুকের ওপরে গিয়ে বসবে। তাদের মনে হবে দুঃস্বপ্ন দেখে তাদের দম বন্ধ হয়ে আসছে। তারপরে তাদের বিছানা কাছাকাছি বলেই, সে সবুজ বরফের মতো ঠাণ্ডা কনকনে মৃতদেহের মতো তাদের দুটি বিছানার মাঝখানে দাঁড়াবে; এতেই তারা ভয়ে জমে যাবে। শেষকালে, বিছানার চাদর দুটো তুলে সাদা ব্লিচ করা হাড় আর ঘূর্ণায়মান চোখ বার করে সে ঘরময় হামাগুড়ি দেবে।’ডাম্ব দ্যানিয়েল’ অথবা ‘সুইসাইড স্কেলিটনের’ অভিনেতার মতো দেখতে হবে তাকে। এই চরিত্রে অনেকবারই সে উন্নতধরনের পরিবেশের সৃষ্টি করেছে। মার্টিন দ্য ম্যানিয়্যাক’ অথবা ‘দ্য মাস্কড মিস্ট্রি’-তে যে বিখ্যাত চরিত্রটি সে অভিনয় করেছিল এই অভিনয়টি মোটামুটি তারই কাছাকাছি যাবে।
সাড়ে দশটার সময় সবাই শুতে গেল। সে শব্দ সে শুনতে পেল। যমজ ভাই দুটোর উন্মত্ত চিৎকারে কিছুক্ষণ সে একটু অস্থিরতার মধ্যে রইল। তার মনে হল, স্কুলের ছাত্রদের মতো ছেলে দুটো ঘুমানোর আগে হালকা হাসিঠাট্টায় মেতে উঠেছে। কিন্তু সওযা এগারোটার সব শান্ত হয়ে এল। বারোটা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সে বেরিয়ে পড়ল। কাঁচের জানালার পাশে পেঁচারা পাখার শব্দ করল; পুরানো ইউ গাছের ওপর থেকে চিৎকার করে উঠল দাঁড়কাকের দল;আর হারিয়ে যাওয়া আত্মার মতো আর্তনাদ করতে-করতে বাতাস ছোটাছুটি করতে লাগল। চারপাশে। কিন্তু নির্বিকারভাবে ওটিসের পরিবার ঘুমের বিভোর। তাদের কপালে যে কী লেখা রয়েছে সে কথা তারা ভাবতেও পারল না। ঝড-জলের শব্দ ছাপিয়ে মন্ত্রীমহোদয়ের নাসিকাগর্জন তার কানে এসে ঢুকল। তার সেই নিষ্ঠুর বলিরেখায় ভরা মুখের ওপরে কদর্য একটা হাসি ফুটিয়ে সে বেরিয়ে পড়ল চুপি চুপি। মেঘের ভেতরে চাঁদ লুকিয়ে পড়ল যে বিরাট ‘ওরিযেল’ জানালার পাশে তার আর তার নিহত স্ত্রীর অস্ত্রগুলির নক্সা সোনার রঙে খোদাই করা ছিল সেখান দিয়ে সে পেরিয়ে এল। অমঙ্গল ছায়ার মতো সে এগোতে লাগল। মনে হল অন্ধকারও তাকে দেখে ঘৃণায় মুখ সঙ্কুচিত করছে। একবার মনে হল কার যেন ডাক শুনতে পাচ্ছে সে। মনে হতে সে থেমে গেল। না, ওটা হচ্ছে কুকুরের ডাক। ষোড়শ শতাব্দীতে প্রচলিত অদ্ভুত অদ্ভুত অভিসম্পাতের শব্দ ফিসফিস করে আওড়াতে আওড়াতে সে এগোতে লাগল। মাঝে মাঝে মধ্যরাত্রির বাতাসের বুকে সেই মরচ-পড়া ছোরটা লাগল দোলাতে। অবশেষে যে বারান্দা দিয়ে হতভাগ্য ওয়াশিংটনের ঘরে ঢোকা যায় সেই বারান্দায় হাজির হল সে। মুহূর্তের জন্যে একটু দাঁড়াল। বাতাসে তার সাদা চুলগুলোকে ওলট-পালট করিয়ে দিয়ে সেই কদর্য মৃত লোকটার ভয়ঙ্করতা আরো বাড়িয়ে দিল। তারপরে সওযা বারোটার ঘণ্টা বাজল। সে বুঝতে পারল এবার সময় হয়েছে। মনের আনন্দে একটা চুকচুক শব্দ করে সে কোণের দিকে ঘুরে গেল। কিন্তু মুখটা ঘোরানোর সঙ্গে সঙ্গে একটা করুণ ভয়ার্ত চিৎকার করে সে। থমকে দাঁড়াল, তারপরে সাদা ফ্যাকাশে মুখটা তার লম্বা হাড়ের দুটো হাত দিয়ে ঢেলে দিল। ঠিক তার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটা ভয়ঙ্কর অশরীরী মূর্তি। চুপচাপ খোদাই করা মূর্তির মতো-উন্মাদের স্বপ্নের মতো ভোলা তার মাথাটা ন্যাড়া, বার্নিশ করা। তার মুখটা গোল, মোটা আর সাদা। মনে হল, একটা শাশ্বত ভ্রূকুটির ভেতর দিয়ে ভাল একটা অট্টহাসি। ফেটে-ফেটে পড়ছে। মুখটা যেন একটা আগুনে চুল্লি। অতিকায় দৈত্যের মতো চেহারার ওপরে তারই পরিধেঘের মতো বিশ্রী ভয়াল একটা পোশাক ঝুলছে। তার বুকের ওপরে একটা প্রাচীরপত্র সাঁটা। তার ওপরে প্রাচীন অহষ্করে কী যেন অদ্ভুত একটা লেখা। মনে হল ওর ওপরে লেখা রয়েছে কারও লজ্জার কাহিনি, কোনো উদ্দাম পাপের কাহিনি, কোনো পাপের ইতিহাস, তার ডান হাতে উঁচু করে ধরা রয়েছে চকচকে ইস্পাতের একটা কুকরি।
এর আগে কোনো ভূত না দেখার ফলে সে স্বাভাবিকভাবেই ভীষণ ভয় পেয়ে গেল। তারপরে সেই ভয়ঙ্কর ভৌতিক প্রাণীটির দিকে তাড়াতাড়ি আর একবার তাকিয়ে নিয়েই সে তার ঘরের মধ্যে পালিয়ে গেল পালানোর সময় তার লম্বা চাদরটা ফেলে গেল বারান্দার ওপরে; আর মরচে-পড়া ছোরাটা পড়ে গেল মন্ত্রীমশাযের তোর ভেতরে। পরের দিন কালে। বাটলার সেটা কুড়িযে পায়। একবার নিজের নির্জন ঘরে হাজির হয়েই সে ঘরের বিছানার ওপরে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল; তারপরে কাপড়ের ভেতরে ঢুকিয়ে ফেলল নিজের মুখ। যাই হোক, কিছুক্ষণ পরে সেই সাহসী ক্যানটারভিলে ভূতটি তার স্বাভাবিক অবস্থাটা ফিরিয়ে নিয়ে এল। তারপরে ঠিক করল সকাল হলেই সে নেমে গিয়ে দ্বিতীয় ভূতটির সঙ্গে কথা বলবে। সেই পরিকল্পনা অনুসারে ঠিক ভোর হয়-হয় এই রকম সময় সে সেই জাযগায় ফিরে গেল। ভাবল, একজন ভূতের চেয়ে দুঙন ভূতের শক্তি অনেক বেশি দুজনে মিলে তারা ওই যমড ভাই দুটিকে অনায়াসেই কায়দা করতে পারবে। যথাস্থানে হাজির হয়ে একটা ভয়ঙ্কর দৃশ্য তার চোখে পড়ল। ছায়া-মূর্তিটির নিশ্চয় কিছু একটা হয়েছে, কারণ তার সেই শূন্য। চকোটরে সেই লাল জ্যোতি আর নেই, সেই চকচকে কুকরিটা পড়ে গিয়েছে তার হাত থেকে; আর অসহায় ভাবে দেওয়ালের গায়ে সে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে কোনোরকমে। দৌড়ে গিয়ে হাত দুটো দিয়ে সে তাকে ধরল; সভয়ে দেখল ধরার সঙ্গে সঙ্গে তার মাথাটা ঘাড় থেকে বিচ্যুত হয়ে মেঝের ওপরে গড়িয়ে পড়ল; দেহটার কোমর গেল ভেঙে। সে দেখল। দু-সুতোর তৈরি একটা সাদা বিছানার চাদরকে সে জড়িয়ে ধরেছে। এই অদ্ভুত পরিবর্তনের অর্থটা হৃদয়ঙ্গম করতে না পেরে সে তাড়াতাড়ি সেই বিজ্ঞাপনটাকে মুঠোর মধ্যে ধরে। প্রভাতের আলোয় পড়তে লাগল। বাপরে, বাপ! বিশ্বের এই একটিমাত্র ভুত ছাড়া আর সব ভূতই মেকী! অতএব সাবধান। ঠকবেন না। ক্যানটারভিলে ভুত তো রেগে কাঁই আর সব ভুত মেকী। বিদ্যুতের মতো সব ব্যাপারটা তার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল। তার সঙ্গে ফাজলামি করা হয়েছে, তাকে ধাপ্পা দেওয়া হয়েছে, প্রতারণা করা হয়েছে তার সঙ্গে। বৃদ্ধ ক্যানটারভাইলের চোখে তার স্বাভাবিক দৃষ্টি ফিরে এল। ফোকলা মাডি দুটো চিপে ধরল সে। শীর্ণ হাত দুটো আকাশের দিকে উঁচিয়ে প্রাচীনতম যুগের রীতি অনুসারে চমৎকার বাকবিন্যাসের ভিত্তিতে সে প্রতিজ্ঞা করল–মোরগ যখন আনন্দের সঙ্গে দু’বার ডাকবে তখনই রক্তাক্ত কাজ সংগঠিত হবে; নিঃশব্দ পদসঞ্চারে তখনই বেরিয়ে যাবে। প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্যে।
এই ভয়ঙ্কর শপথ গ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গে লাল টালির ছাদ দেওয়া দূরের কোনো বাড়ি থেকে মোরগ ডেকে উঠল। একটা তিক্ত দীর্ঘ চাপা হাসি হেসে সে অপেক্ষা করতে লাগল। আধঘণ্টা ধরে সে অপেক্ষা করল; কিন্তু কোনো অজ্ঞাত কারণে, মোরগটা আর ডাকল না। অবশেষে সাড়ে সাতটার সময় বাড়ির চাকরানিরা এসে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সে আর সেখানে অপেক্ষা করতে পারল না। ব্যর্থ আশা আর ব্যর্থ উদ্দেশ্যের কথা ভাবতে ভাবতে কোনোরকমে সে। তার ঘের ফিরে এল। সেখানে গিয়ে প্রাচীন বীরত্বের ওপরে লেখা কয়েকটা বই ঘেটে সে দেখল। এই বইগুলি তার খুব প্রিয় ছিল। প্রতিটি ক্ষেত্রেই যখন সে ওই জাতীয় কোনো প্রতিজ্ঞা করেছে তখনই মোরগ নিয়ম করে দু’বার ডেকেছে। সে রেগে গজগজ করতে করতে বলল–দুষ্টু মোরগটা জাহান্নামে যাক। আমার সেদিন থাকলে আমার সেই শক্ত বর্শাটা নিয়ে ব্যাটাকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে এমন চিৎকার করাতাম যে মনে হত ব্যাটা মরণ আর্তনাদ করছে।
পরের দিন ভূতটি বেশ দুর্বল আর ক্লান্ত হয়ে পড়ল। বিগত চারটি সপ্তাহে ভয়ঙ্কর উত্তেজনার ফল ফলতে শুরু করল। একেবারে বিপর্যস্ত হয়ে গেল তার স্নায়ুগুলি। সামান্য একটু শব্দেই সে চমকে উঠতে লাগল। পাঁচটি দিন সে ঘরের মধ্যে বসে বইল; তারপরে ঠিক করল লাইব্রেরি। ঘরের মেঝেতে আর সে সেই রক্তচিহ্নটি বসিয়ে আসবে না। ওটিস-এর পরিবারবর্গ ওটা যদি পছন্দ না করে স্পষ্টতই ও-জিনিসটি না দেখার অধিকার তাদের রয়েছে। মনে হয় ওরা নীচু বাস্তব স্তরের মানুষ। ইন্দ্রিযড ঘটনার যে একটা সাংকেতিক মূল্য রয়েছে তা হৃদয়ঙ্গম করতে ওরা অক্ষম সপ্তাহে একবার আবির্ভাব হওয়া আর মাসের প্রতি প্রথম আর তৃতীয় শুক্রবার। ডানালার পাশে গিয়ে মুখ ভেঙানোই তার প্রধান কাজ। সে বুঝতে পারল না এই কর্তব্যে সে অবহেলা করবে কেমন করে? কথাটা সত্যি যে তার জীবনটা বড়ো নোংরা ছিল; কিন্তু আবার অন্য দিক থেকে কিছু অতি প্রাকৃতের সঙ্গে জড়িত তাদের সম্বন্ধে তার বিবেকটা ছিল বড়ো সজাগ। সেই জন্যে পরের তিনটি শনিবার যথারীতি সে বারান্দায় বেরিয়েছিল, কিন্তু কেউ তাকে দেখতে অথবা তার পায়ের শব্দ শুনতে যা পায় সে বিষয়ে সে খুব সতর্ক ছিল। এই উদ্দেশ্যে সে বুট খুলে ফেলল, ঘুণ-ধরা কাঠের তক্তার উপরে খুব আস্তে আস্তে হাঁটল, বেশ বড়ো কালো একটা ভেলভেটের আলখাল্লায় নিজেকে রাখল ঢেকে, আর শেকলগুলোকে মসৃণ। করার জন্যে, যদিও এটা করতে তার খুবই কষ্ট হয়েছিল, তবুও সে ‘রাইসিং সান লিউব্রিকেটর’ ব্যবহার করল। একাজ করতে প্রথমে সে অপমানবোধ করেছিলকিন্তু এই তেলের উপকারিতা বোঝার মতো জ্ঞান তার হয়েছিল। এতসব করার পরেও বারবার তাকে অপদস্ত হতে হল। প্রায় বারান্দার ওপরে দড়ি বেঁধে রাখত তারা। তার ফলে অন্ধকারে তাকে লাফিয়ে চলতে হত। একবার যমজ ভাই দুটি এমন এক কৌশল করেছিল যার ফলে তাকে ভীষণভাবে পড়ে যেতে হয়েছিল। এই শেষ অপমানটি তার এত বেশি লেগেছিল যে সে ঠিক করল–আব না, এবার তার লুপ্ত গৌরব ফিরিয়ে আনার জন্যে তাকে একবার শেষ চেষ্টা করতে হবে। সে ঠিক করে ফেলুল পরের রাত্রিতে ‘রেকলেস রুপার্ট’ অথবা ‘দ্য হেডলেস। আর্ল’-এর যে বিখ্যাত ভূমিকায় সে অভিনয় করেছিল সেই বেশে ইটন-এ পড়া ওই দুটি উদ্ধত যুবককে একটা চরম শাস্তি সে দেবে।
সত্তর বছরেরও বেশি সে এই ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। সত্যি কথা বলতে কি সুন্দরী লেডি বারবারা মোদিসকে সে যেদিন ভয়ে মুহ্যমান করে দিয়েছিল সেদিনই সে এই ভূমিকায় শেষ অভিনয় করেছিল। সেই ভয়েই সে বর্তমান লর্ড ক্যানটারভিলে-এর পিতামহের সঙ্গে বিয়ে। ভেঙে দিয়ে সুন্দর যুবক জ্যাক ক্যাসলটনের সঙ্গে গ্রেটনা গ্রীন-এ পালিয়ে গিয়েছিল; বলেছিল, সন্ধে আর ভোরে যে বাড়ির বারান্দায় ভুত ঘুরে বেড়ায দ্বন্দ্বযুদ্ধে বেচারা ড্যককে লর্ড ক্যানটারভিলে গুলি করে হত্যা করেছিলেন। তারই ফলে এক বছরের ভেতরেই ভগ্নহৃদয়ে। লেডি বারবারা টানব্রিজ ওয়েলস-এ মারা গিয়েছিল। তবে সাজগোজটা শেষ বড়োই কঠিন। সেই সাজ সাজতে তার পুরো তিনটি ঘন্টা লাগল। অবশেষে সাজগোজ শেষ হলে নিজের চেহারা দেখে সে বেশ খুশিই হল। একটা বেজে পনেরো মিনিটের সময় সে তার কুঠরি থেকে নিঃশব্দে বেরিয়ে যে বারান্দার ওপরে এসে দাঁড়াল। নীল পর্দা ঝোলানো থাকায় যে ঘরে যমজ ভাই দুটি থাকতো তাকে ‘ব্লু বেড চেম্বার’ বলা হত। ভালোভাবে ঢোকার জন্যে সে ধাক্কা দিয়ে কপাটটা খুল দিলা খুলে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একটা ভারী জলের কুঁজো তার ওপরে পড়ে গেল; জল পড়ে তার চামড়া পর্যন্ত গেল ভিজে; ইঞ্চি দুয়েকের জন্যে তার বাঁ কাঁধটা। কোনোরকমে বেঁচে গেল। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই বিছানার ওপর থেকে চাপা গলার হাসি ভেসে এল। সমস্ত ব্যাপারটা তার স্নায়ুগুলিকে এমনভাবে বিকল করে দিল যে সে অত্যন্ত। দ্রুতবেগে তার ঘরে ফিরে এল। পরের দিন প্রচণ্ড ঠান্ডা লেগে সে শুয়ে রইল। তার একমাত্র সান্ত্বনা হল মাথাটাকে সে সঙ্গে করে নিয়ে যায়নি; গেলে কী সাংঘাতিক বিপদ ঘটত তা। ঈশ্বরই জানেন।
সেই অভদ্র আমেরিকানদের ভয় দেখানোর বাসনা অতঃপর সে পরিত্যাগ করল। শব্দহীন শ্লিপার পায়ে দিয়ে বারান্দায় গুঁড়ি দিয়ে ঘুরে বেড়িযেই সে খুশি হল; এই বেড়ানোর সময় ঠাণ্ডা লাগার ভয়ে গলায় সে একটা লাল মাফলার জড়াত: পাশে যমজ ভাইরা তাকে আক্রমণ করে এই ভয়ে হাতে সে রাখত সেকেল একটা বন্দুক। শেষ ধাক্কা খেল সে ১৯শে সেপ্টেম্বর। কোনোরকম অপমানিত হওয়ার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা নেই এই মনে করে নীচের বিরাট ঘরে ঢোকার জন্যে সেদিন সে গিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের মন্ত্রী আর তাঁর স্ত্রীর যে দুটি ফটোগ্রাফ। ছিল–কিছুদিন আগেও ওখানে টাঙানো থাকত ক্যানটারভিলে বংশের ছবি, সেইদিকে তাকিয়ে সে ঠাট্টা করছিল তাঁদের। তার পরনে ছিল কবরখানার ধাঁচের পরিচ্ছন্ন অথচ লম্বা পোশাক, চোয়ালটা বাধা ছিল বেগনে রঙের কাপড়ের টুকরো দিয়ে হাতে ছিল কবর খননকারীর কোদাল। সত্যি কথা বলতে কি জোনাস দ্য গ্রেঙলেস’, অথবা ‘চার্টসে বার্ন-এর করপস স্ন্যাচার’-এর ভূমিকায় যে পোশাক সে পরেছিল এটা সেই রকম। তার এই অভিনয় ক্যানটারভিলেদের মনে রাখার কথা; কারণ এই থেকে প্রতিবেশী লর্ড রুফোর্ড-এর সঙ্গে তাদের সত্যিকারের বিবাদ শুরু হয়। রাত্রি প্রায় দুটো বেড়ে মিনিট পনেরো হয়েছে। যতদূর সে ডানত তখন কারও ঘুরে বেড়ানোর কথা নয়। রক্তের কোনো দাগ পড়েছে কিনা দেখার জন্যে সে যখন লাইব্রেরি ঘরের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছিল ঠিক সেই সময় অন্ধকার থেকে অকস্মাৎ তার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে উন্মত্তের মতো মাথার ওপরে হাত তুলে তার কানের কাছে চিৎকার করে বলল—বু-বু!!
অত্যন্ত ভয় পেয়ে গেল সে এবং সেই অবস্থায় ভয় পাওয়াটাই তার কাছে অত্যন্ত স্বাভাবিক। ভয় পেয়ে সে সিঁড়ির দিকে দৌড়ে গেল, কিন্তু দেখল মিঃ ওটিস তাঁর বিরাট গার্ডেন সিরিঞ্জ’ নিয়ে তার জন্যে অপেক্ষা করছেন। এইভাবে দু’পাশে শত্রুর দ্বারা অবরুদ্ধ হয়ে, আর পালানোর কোনো প্রশস্ত পথ না পাওয়ার ফলে সে বিরাট লোহার স্টোভের ভেতরে অদৃশ্য হয়ে গেল। তার ভাগ্য ভালো যে স্টোভটা লেবানো ছিল। চিমনির ভেতর দিয়ে কালিঝুলি মেখে এক কিম্ভতকিমাকার অবস্থায় শেষ পর্যন্ত নিজের ঘরে গিয়ে পৌঁছল সে।
এরপরে আর কোনোদিন সে রাত্রিতে বেড়াতে বেরতো না। যমজ ভাই দুটি অনেকবার তার। জন্যে অপেক্ষা করে বসে থাকত আর গোটা বারান্দাটায় সুপুরি ছড়িয়ে রাখত। এতে তাদের বাবা, মা আর চাকর-বাকর সবাই বিরক্ত হত। কিন্তু তাদের কাজ তার জন্যে ব্যাহত হয়নি। বেশ সপষ্টই বোঝা যায় ওদের ব্যবহারে সে এতই মর্মাহত হয়েছিল যে সে কিছুতেই বাইরে বেরতে পারেনি। ফলে মিঃ ওটিস তাঁর অপরূপ সাংস্কৃতিক আসর বসানোর আয়োজন করলেন। ছেলেরা সব নানাজাতীয় খেলায় মেতে উঠল, ভার্জিনিয়া তার টার্টু ঘোড়ার চেপে ঘুরতে লাগল রাস্তায় রাস্তায়, আর চেশায়াবের যুবক ডিউক তার ছুটির শেষ সপ্তাহটা কাটাতে এল ক্যানটারভিলে চেস-এ সবাই ভাবল ভুতটি বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছে এবং মিঃ ওটিস লর্ড ক্যানটারভিলেকে এ-বিষয়ে দীর্ঘ একটি পত্র লিখলেন। উত্তরে লর্ড তাঁর স্ত্রীকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানালেন।
সেদিক থেকে ওটিস প্রতারিত হয়েছিলেন। কারণ অকেজো হলেও, ভূত বাড়ি ছাড়েনি। বরং একথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে যখনই সে শুনল চেশায়ারের যুবক ডিউক ওখানে অতিথি হিসাবে আসছে তখনই সে আর একবার গা ঝাড়া দিয়ে উঠল। এরই বাবার কাকা লর্ড ফ্রানসিস স্টিলটল ক্যানটারভাইলের ভূতের সঙ্গে পাশা খেলবে বলে কর্নেল বারবারির সঙ্গে একবার একশো গিনি বাজি ধরেছিলেন। পরের দিন সকালে তাস খেলার ঘরে মেঝের ওপরে তিনি অসহায় অবস্থায় পুষ্কাঘাতে পড়েছিলেন। তারপরে যদিও তিনি অনেক বছর বেঁচেছিলেন তবু আর কোনোদিন তিনি ‘ডবল সিকসেস’ ছাড়া আর কিছু বলতে পারেননি। যদিও এই ঘটনাটা তখনকার দিনে অনেকেই জানত তবু দুটি অভিজাত বংশের সম্ভ জন্যে ঘটনাটাকে চাপা দেওয়ার উদ্দেশ্যে সব রকম ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল। স্টিলটনদের ওপরে তার যে প্রভাব এখনো রয়েছে সেটা প্রমাণ করার জন্যেই সে স্বাভাবিক ভাবেই ব্যাকুল হয়ে উঠল। সেই জন্য সে ঠিক করল ভার্জিনিয়ার প্রেমিকের কাছে সে ‘ভাম্পায়ার মউক’। অথবা ‘রডলেস বেনিডিকটাইন’-এর বেশ ধরে দেখা দেবে। এই অভিনয়টি লেডি স্টারটাপ ১৭৬৪ সালের নববর্ষের রাত্রিতে দেখেছিলেন দেখেই ভয়ে চিৎকার করতে করতে তাঁর ফিট হল;আর তাতেই তিন দিনের দিন তিনি মারা গেলেন। মারা যাওয়ার সময় নিকট আত্মীয় ক্যানটারভিলেদের তাঁর সমস্ত সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করে তিনি তাঁর সব সম্পত্তি তাঁর। লন্ডনের ওষুধ বিক্রেতাকে দিয়ে গেল। কিন্তু শেষকালে যমজ ভাইদের ভয়ে সেই পরিকল্পনা তাকে ছাড়তে হল।
এরই কয়েক দিন পরে একদিন ভার্জিনিয়া আর তার কোঁকড়ানো চুলওয়ালা প্রেমিক দুজনে ব্রকলে মাঠের দিকে ঘোড়ায় চড়ে ঘুরতে গেল। একটা বুনো ঝোঁপ পেরোতে গিয়ে ভার্জিনিযা তার পোশাক এমন বিশ্রীভাবে ছিডল যে বাড়ি ফিরে সে ঠিক করল যাতে কেউ তাকে ওই অবস্থায় দেখতে না পায় সেই জন্যে সে পেছনের সিড়ি দিয়ে ঢুকবে। এই ভেবে সে ট্যাপেস্ট্রি চেম্বারের পাশ দিয়ে ছুটতে শুরু করল। চেম্বারের দরজাটা সামান্য একটু খোলা ছিল। তার মনে হল ভেতরে কেউ রয়েছে। তার মায়ের পরিচারিকা মাঝে-মাঝে ওইখানে বসে তার কাজকর্ম করত। সে ভাবল তাকেই সে তার পোশাকটা সেলাই করে দিতে বলবে। এই ভেবে। ঘরের ভেতরে উঁকি দিল। উঁকি দিয়েই একেবারে অবাক হয়ে গেল। স্বয়ং ক্যানটারভিলে ভূত বসে রয়েছে সেখানে। জানালার ধারে বসে বসে ইয়োলো গাছের শুকনো সোনালি ফুলগুলির দিকে তাকিয়ে রয়েছে। সোনালি ফুলগুলি বাতাসে উড়ছে; ঝডের আবেগে লাল পাতাগুল। উন্মত্ত আবেগে দীর্ঘ পথের ওপরে বেড়াচ্ছে নেচে। একটা হাতের ওপরে মাথাটা রেখে সে বসে রয়েছে। দেখলেই মনে হবে তার সারা সত্তার ওপরে মারাত্মক রকমের একটা অবসাদ নেমে এসেছে। একেবারে নিঃসঙ্গ পরিত্যাক্ত মনে হল তাকে। এ-অবসাদ তার আর নয়। ভূতটিকে ওই অবস্থায় দেখে প্রথমেই তার মনে হয়েছিল ছুটে পালিয়ে গিয়ে নিজেক ঘরে ঢুকে পড়া; কিন্তু তারপরেই কেমন যেন দয়া হল তারা তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার বাসনায় ভার্জিনিয়া উদ্বুদ্ধ হয়ে হালকা পায়ে তার দিকে এগিয়ে গেল। ভূতটি দুঃখ আর হতাশায় এতই মুহ্যমান হয়ে পড়েছিল যে কথা না বলা পর্যন্ত ভার্জিনিয়ার উপস্থিতি সে টেরই পায়নি।
ভার্জিনিয়া বলল–আপনার জন্যে আমি দুঃখিত, কিন্তু আমার ভাইরা কালই ইটন-এ পড়তে চলে যাচ্ছে। এরপর থেকে আপনি যদি ভালোভাবে চলাফেরা করেন তাহলে আপনাকে আর। কেউ বিরক্ত করবে না।
সেই সুন্দরী মেয়েটি যে তার সঙ্গে কথা বলবে এটা ভাবতে না পেরে অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে ভূত বলল–আবোল-তাবোল বলে তো লাভ নেই–ভালোভাবে চলাফেরা করার কথা–সে অসম্বব–যা হয় না তাই, উদ্ভট ব্যাপার। আমাকে শেকলের শব্দ করতে কথা–সে অসম্ভব–যা হয় না তাই, উদ্ভট ব্যাপার। আমাকে শেকলের শব্দ করতে হবে, ঝাঁঝরির ভেতর দিয়ে গোঙাতে হবে–রাত্রিতে বারান্দায় বারান্দায় ঘুরে বেড়াতে হবে। অবশ্য ভালোভাবে। চলাফেরা বলাতে এই যদি তুমি বোঝতে চাও সেটা হল অন্য কথা। আমার অস্তিত্বের কারণ একমাত্র ওইগুলিই।
উঁহু! অস্তিত্ব বজায় রাখার ওটা করণই হতে পারে না। তাছাড়া, আপনি যে খুব দুষ্ট প্রকৃতির ছিলেন তা আপনি নিজেও জানেন। যেদিন আমরা এখানে প্রথম এলাম সেইদিনই মিসেস উমনে আমাদের বলেছেন যে আপনি আপনার স্ত্রীকে খুন করেছিলেন।
ভূত বিরক্ত হয়ে বলল–সেকথা আমিও স্বীকার করি। কিন্তু সেটা আমার ঘরোযা ব্যাপার। সেবিষয়ে আর কারও কিছু বলার এক্তিয়ার নেই।
নীতির কথা শুরু হলে ভার্জিনিয়া মাঝে-মাঝে একটু গম্ভীর হয়ে পড়ে। এই কথা শুনে সে বলল–কাউকে হত্যা করাটা অন্যায়।
বস্তুনিরপেক্ষ নীতির সস্তা বাড়াবাড়িটাকে আমি ঘৃণা করি। আমার স্ত্রী ছিল একেবারে অকর্মা। সে কোনোদিন আমার জামার কলারে মাড় দিল না; আর রান্নার ব্যাপারে সে ছিল একেবারে অপদার্থ তোমাকে বলব কী, একবার হোগলে’ বলে আমি একটা খরগোস শিকার করেছিলাম। কী অদ্ভুত মাংস তার! তুমি জান সেটা কী বিশ্রী রান্না করল সে। একেবারে অখাদ্য। সে সব কথা থাকগে। সে সব চুকেবুকে গেছে। কিন্তু তাদের বোনকে খুন করলেও তার ভাইদের উচিত হয়নি আমাকে অনাহারে মেরে ফেলা।
অনাহারে মেরে ফেলা! হায় মিষ্টার ভূত, অর্থাৎ, স্যার সাইমন, আপনার কি খিদে পেয়েছে? আমার ব্যাগে স্যানডউইচ রয়েছে। খাবেন?
না, ধন্যবাদ। আজকাল আমি আর কিছু খাই নে। তুমি যে বললে এতেই আমি খুশি। তোমাদের ওই বর্বর, অসৎ, ভয়ঙ্কর আর যাচ্ছেতাই রুচির পরিবারবর্গের তুলনায় তুমি অনেক ভালো।
ভার্জিনিয়া মেঝের উপর পা ঠুকে বলল–চুপ। আপনি নিজেই বর্বর, ভয়ঙ্কর আর যাচ্ছেতাই আর অসৎ হওয়ার কথা যদি বলেন তা হলে বলতে হয় আপনিই আমার রঙের বাক্স থেকে রঙ চুরি করে লাইব্রেরি ঘরে ওই রক্তের দাগ এঁকেছিলেন। আমরা তো হেস মরে যাই। প্রথমে আপনি নিলেন সিঁদুরসুদ্ধ সব লাল রঙা ফলে, সূর্যাস্তের ছবি আঁকা আমার বন্ধ হয়ে গেল। তারপরে আপনি চুরি করলেন আমার এমারেন্ড-গ্রীন আর ক্রোম ইয়োলো। শেষকালে পড়ে রইল কেবল ইনডিগো আর চাইনিস হোয়াইট। এখন আমি চাঁদনি রাতের ছবি ছাড়া আর কিছুই আঁকতে পারি নে। এই দৃশ্য কেবল যে মনটাকে ভারাক্রান্ত করে তোলে তাই নয়, আঁকাও বড়ো কষ্টকর। যদিও আমি খুবই বিরক্ত হয়েছিলেম তবু এবিষয়ে আপনাকে আমি কিছু বলিনি। তাছাড়া, সমস্ত ব্যাপারটাই বড়ো হাস্যকর করাণ, রক্তের রঙ এমারেল্ড-গ্রীন হবে একথা কেউ কোনো দিন শুনেছে?
ভূতটি শান্ত আর বিনয়ের সঙ্গেই বলল–তা বটে। কিন্তু আমার করারই বা কী ছিল? আজকাল সত্যিকার রঙ পাওয়া মুস্কিল। তাছাড়া, তোমার ভাই যখন ‘প্যারগান। ডিটারজেনট’-এর সাহায্য নিলে তখন তোমার রঙ চুরি করতেই বা আমার দোষটা কোথায়? আর রঙের কথা যদি বল ওটা হচ্ছে রুচির কথা। ক্যানটারভিলেদের ধমনীতে নীল রক্ত বইছে–ইংলন্ডে সবচেয়ে গাঢ় নীলও বলতে পার; কিন্তু আমি ডালি তোমরা যারা আমেরিকান তাদের ওসব বালাই নেই।
আপনি কিছুই জানেন না। আপনার উচিত আমেরিকা গিয়ে নিজের মানসিক বৃত্তির উন্নতি করা। আমেরিকায় বিনা খরচে যদি যেতে চান তাহলে আমার বাবা আপনাকে খুশি হয়েই সাহায্য করতে পারেন। যদিও ওখানে সব রকম ‘সিপরিটের’ ওপরেই বেশ মোটা সুল্ক রয়েছে তবু কাস্টমস-এর হাত থেকে রেহাই পেতে খুব একটা অসুবিধে হবে না। কারণ, ওই বিভাগের অফিসাররা সবাই ডেমোক্র্যাট। একবার নিউ ইয়র্কে হাজির হলেই আপনি নিশ্চয় উন্নতি করবেন। আমি জানি সেখানে এমন অনেক লোক রয়েছে যারা পিতামহ সংগ্রহ করার জন্যে এক লষ্ক ডলার দিতে রাজি হবে; আর ঘরোয়া ভূত পেলে তো কথাই নেই।
-না। আমেরিকা আমার ভালো লাগবে না।
ভার্জিনিয়া ব্যঙ্গের সুরে বলল–মনে হচ্ছে আপনার কোনো ধ্বংসও নেই, কোনো কৌতূহলও নেই।
ধ্বংসও নেই! কৌতূহলও নেই! তোমাদের আছে নৌবিভাগ আর আচার!
আমি চললাম। বাবাকে দিয়ে বলি যমজ ভাইদের জন্যে যেন তিনি আরো এক সপ্তাহের ছুটির দরখাস্ত করেন।
ভূত চিৎকার করে উঠল-না, না। আমি নিঃসঙ্গ, বড়ো দুঃখ আমার। কী যে করি বুঝতে পারছি নে। আমি ঘুমোতে চাই; কিন্তু ঘুমোতে পারছি নে।
কী কথা যে বলেন! ঘুমোতে হলে স্রেফ বিছানায় শুয়ে বাতিটা নিবিয়ে দিন। মাঝে-মাঝে জেগে থাকাটা বড়ো কষ্টকর মনে হয়, বিশেষ করে গিড়ায। কিন্তু ঘুমোতে কোনো অসুবিধে নেই। এমন কি শিশুরাও ঘুমোতে জানে। তাদের যে বেশি বুদ্ধি রয়েছে সেকথা আপনিও স্বীকার করবেন না।
ভূত খুব দুঃখের সঙ্গে বলল–তিনশো বছর আমি ঘুমোইনি।
কথাটা শুনে ভার্জিনিয়ার সুন্দর চোখ দুটি অবার বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল।
ভূত বলে গেল–তিনশো বছর আমি ঘুমোইনি। আমি বড়ো ক্লান্ত।
ভার্জিনিয়া বলল–হতভাগ্য, হতভাগ্য ভূত! তোমার কি ঘুমানোর কোনো জায়গা নেই?
নীচু স্বপ্নালু স্বরে ভূত বলল–দূরে…দূরে পাইলবন ছাড়িয়ে ছোটো একটা বাগান রয়েছে। সেখানে লম্বা ঘাস ঘন হয়ে উন্মেছে। সাদা হেমলক ফুলের সমারোহ ভেগেছে সেখানে। সারা রাত ধরে নাইটিংগেল পাখি সেখানে গান করে। সেখানে ঘুমন্ত আত্মার মাথার ওপর ইউ গাছগুলি তাদের বিরাট হাতগুলি দেয় ছড়িয়ে।
জলে ভার্জিনিয়ার চোখ দুটি ভিজে গেল; হাত দিয়ে মুখ ঢাকল সো আস্তে আস্তে সে। বলল–মৃত্যুর উদ্যানের কথা বলছ?
হ্যাঁ, মৃত্যু। মৃত্যু সত্যিই বড়ো মধুর। নরম তামাটে মাটির তলায় শুয়ে থাকা; মাথার ওপরে। ঘাসগুলি বীজন করবে কোন পেতে শুনবে স্তব্ধতার বাণী। ভূত-ভবিষ্যৎ বলে কিছু থাকবে না আর। সময়ের জ্ঞান যাবে হারিয়ে; জীবনকে ক্ষমা করা, নিজের মধ্যে শান্তিকে অনুভব করা। কী মধুর! তুমি আমাকে সাহায্য করতে পার? মৃত্যুর দ্বার আমার জন্যে তুমি খুলে দিতে পার। কারণ প্রেম তোমার সঙ্গী। আর মৃত্যুর চেয়ে প্রেমের ক্ষমতা অনেক বেশি।
কেমন যেন তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে গেল ভার্জিনিয়া। মনে হল সে একটা ভয়ঙ্কর স্বপ্ন দেখছে।
তারপরে আবার কথা বলল ভূত। বাতাসের দীর্ঘশ্বাসের মতো শোনাল তার স্বর: লাইব্রেরির জানালার ওপর পুরনো যে একটি ভবিষ্যৎবাণী লেখা রয়েছে তা কি তুমি পড়েছ?
মেয়েটি ওপর দিকে চোখ তুলে বলল–খুব পড়েছি। ভালো ভাবেই পড়েছি। অদ্ভুত কালো কালো অক্ষরে লেখা পড়া খুবই কষ্টকর। মাত্র দুটো লাইন লেখা রয়েছে। সোজা কথায় বললে দাঁড়ায়-কোনো সোনালি মেয়েকে দেখে পাপীর মুখ থেকে যেদিন প্রার্থনার বাণী উচ্চারিত হবে, যেদিন বন্ধ্যা বাদাম গাছে ফুলের সমারোহ জাগবে, যেদিন কোনো শিশু তার চোখের জল ফেলবে সেই দিনই সারা বাড়িটা স্তব্ধ হয়ে যাবে। শান্তি নেমে আসবে ক্যানটারভাইলে। কিন্তু এর অর্থ যে কী তা আমি জানি নে।
সে দুঃখের সঙ্গে বলল–অর্থ হচ্ছে আমার পাপের জন্যে তোমাকে কাঁদতে হবে। কারণ, আমার চোখে কোনো জল নেই, আমার আত্মার জন্যে আমার সঙ্গে তোমাকে প্রার্থনা করতে হবে। কারণ, আমার কোনো বিশ্বাস নেই তারপর আমার সঙ্গে যদি তুমি মিষ্টি আর সদস। ব্যবহার করে থাক তাহলে মৃত্যুর দেবদূত আমাকে দয়া করবেন। অন্ধকারে তুমি ভয়াল ছায়াদের ঘুরে বেড়াতে দেখবে, অমঙ্গলের স্বর তোমার কানে কানে ফিস ফিস করে অনেক কিছু বলবে; কিন্তু তারা তোমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না, কারণ নরকের শক্তি শিশুর পবিত্রতা নষ্ট করতে পারে না।
ভার্জিনিয়া কোনো উত্তর দিল না। তার দিকে তাকিয়ে গভীর নৈরাশ্যে ভূতটি তার নিজের হাত দুটো মোচড়াতে লাগল। হঠাৎ ভার্জিনিয়া বিবর্ণ মুখে উঠে দাঁড়াল। তার চেখের ভেতর থেকে একটা অদ্ভুত আলোর জ্যোতি বেরোতে লাগল। সে শক্ত হয়ে বলল–আমি ভয় পাই লে; তোমার ওপারে দয়া দেখাতে দেবদূতকে আমি বলব।
একটা ক্ষীণ আনন্দের ধ্বনি তুলে সে উঠে দাঁড়াল, তারপরে তার হাতটা ধরে পুরনো যুগের ভঙ্গিমায় চুমু খেল। তার আঙুলগুলি বরফের মতো ঠান্ডা; ঠোঁট দুটো আগুনের মতো গরম। ভার্জিনিয়া কাঁপল না সে তাকে হাত ধরে অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘর দিয়ে নিয়ে গেল। বিবর্ণ দেওয়াল চিত্রের উপরে খুদে খুদে শিকারিদের চিত্র আঁকা রয়েছে। তারা তাদের শিঙা ফুকে তাকে সরে যাওয়ার ইঙ্গিত করল। ‘খুদে ভার্জিনিয়া চলে যাও, চলে যাও।’ কিন্তু ভূত তার হাত শক্ত করে ধরে রইল। সে বন্ধ করে রইল তার চোখ দুটো। ভীষণ ভীষণ জানোয়াররা লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল তার দিকে। সাবধান, ছোটো ভার্জিনিয়া, সাবধান। আর হয়তো আমরা তোমাকে দেখতে পাব না।’ কিন্তু ভূতটি তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেল এবং ভার্জিনিয়া তাদের। কথায় কান দিল না। ঘরের শেষে গিয়ে সে থেমে কী যেন বলল। ভার্জিনিযা তা বুঝতে পারল না। চোখ খুলে সে দেখল ঘরের দেওয়ালটা কুয়াশার মতো মিলিয়ে যাচ্ছে। তার সামনেই বিরাট একটা গর্ত। কনকনে ঠান্ডা বাতাস বইছে। যেন তার পোশাক ধরে টানছে। ভূতটি বলল–তাড়াতাড়ি। তা না হলে বড়ো দেরি হয়ে যাবে।
মিনিট দশেক পরে চা খাওয়ার ঘন্টা পড়ল। ভার্জিনিয়া না আসায় মিসেস ওটিস তাকে ডেকে আনার জন্যে চাকর পাঠালেন। কিছুক্ষণ পরে চাকরটি ঘুরে এসে জানাল তাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ডিনার টেবিলের জন্যে ভার্জিনিয়া প্রতিদিন বাগানে ফুল তুলতে যেত। সেইজন্যে মিসেস ওটিস প্রথমে বিশেষ ভয় পাননি। কিন্তু ছ’টা বাজার পরেও যখন ভাডিনিযা এল না তখনই তিনি বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন। উদ্বিগ্ন হয়েই ছেলেদের পাঠিয়ে দিলেন তার খোঁড়ে; আর মিঃ ওটিস-এর সঙ্গে নিজে প্রতিটি ঘর তন্ন তন্ন করে খুঁজতে লাগলেন। সাড়ে ছ’টা নাগাদ ছেলেরা ফিরে এসে ডানাল তাকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। তাঁরা সকলেই উত্তেজিত হয়ে উঠলেন এবং সেই বিশেষ ক্ষেত্রে কী করা উচিত সে সম্বনে কেউ কিছু ঠিক করতে পারলেন না। ঠিক এই সময় হঠাৎ মিঃ ওটিসের মনে পড়ল যে দিন কয়েক। আগে একদল জিপসিকে তাঁর পার্কে তাঁবু ফেলতে অনুমতি দিয়েছিলেন। সেইজন্যেই বড়ো ছেলে আর দুটি চাকরকে নিয়ে তিনি ‘ব্ল্যাকফেল হলো’র দিকে এগিয়ে গেলেন তিনি। জানতেন জিপসিরা ওখানেই তখন রয়েছে। বাচ্চা ডিউক তো মরিয়া হয়ে বলল সেও সঙ্গে যাবে। কিন্তু মারামারি বাধতে পারে এই ভয়ে মিঃ ওটিস রাজি হলেন না। সেইখানে উপস্থিত হয়ে তিনি দেখলেন জিপসিরা চলে গিয়েছে–আর চলে গিয়েছে হঠাৎ ওয়াশিংটন আর দুটি চাকরকে চারপাশ খুঁড়তে বলে তিনি তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে এসে দেশের সর্বত্র পুলিশকে টেলিগ্রাম করে দিলেন এই বলে যে জিপসিরা একটা বাচ্চা মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে গিয়েছে। তারপরে তিনি ঘোড়া থামাতে বলে স্ত্রী আর তিনটি ছেলেদের ডিনারে বসতে বললেন। তারপরে একটা চাকরকে সঙ্গে নিয়ে তিনি ঘোড়া ছুটিয়ে ছিলেন অ্যাসকট রোড-এর দিকে। মাত্র দু’মাইলও তিনি যাননি এমন সময় তাঁর মনে হল কে যেন ঘোড়ায় চেপে তাঁর। পেছনে-পেছনে আসছে। ঘুরে চেয়ে দেখলেন টাটুতে চেপে ডিউক দৌড়ে আসচ্ছে। হাঁপাতে হাঁপাতে এসে ছেলেটি বলল–আমি অত্যন্ত দুঃখিত, মিঃ ওটিস; কিন্তু ভার্জিনিয়াকে না খুঁজে পাওয়া পর্যন্ত আমি খেতে পারলাম না। আমার ওপরে দমা করে রাগ করবেন না। গত বছর আমাদের বিয়েথে আপনি যদি রাজি হতেন তাহলে এসব ঝামেলা বাধত না। আপনি আমাকে ফিরিয়ে দেবেন না তো? আমি যেতে পারি নে। আমি যাব না।
মন্ত্রী সেই সুন্দর সব-সময় বিপদাপন্ন যুবকটির দিকে চেয়ে না হেসে পারলেন না। ভার্জিনিয়ার ওপরে তার এই আকর্ষণ দেখে মুগ্ধও হলেন একটু। সেই জন্যে ঘোড়া থেকে একটু ঝুঁকে পড়ে বললেন–ঠিক আছে সিসিলা ফিরে যেতে না চাইলে নিশ্চয় তুমি আমার সঙ্গে আসবে। কিন্তু অ্যাসকট-এ গিয়ে তোমার জন্যে একটা টুপি কিনে দেব চল।
এই বলেই দুজনে ঘোড়ায় চড়ে রেল স্টেশনের দিকে ছুটলেন। সেখানে স্টেশন মাস্টারকে ডিজ্ঞাসা করলেন ভার্জিনিয়ার চেহারার কাউকে স্টেশনে দেখা গিয়েছে কি না। কিন্তু সেখানে তার কোনো সংবাদ পাওয়া গেল না। স্টেশন মাস্টার অবশ্য চারপাশে তার পাঠিয়ে দিয়ে জানালেন যে চারপাশে তাকে খুঁজে বার করার জন্যে তীক্ষ্ণ প্রহরী রাখা হবে। এই শুনে ডিউকের জন্যে একটা টুপি কিলে মিঃ ওটিস বেকসলের দিকে ছুটলেন। জায়গাটা ওখান। থেকে মাইল চারেক দূরে একটা গ্রাম। তিনি শুনেছিলেন ডাযগাটার পাশেই বিরাট একটা মাঠ থাকায় জিপসিরা সাধারণত ওইখানে ডেরা পাততে ভালোবাসে। সেখানে গিয়ে তাঁরা গ্রাম্য চৌকিদারকে ডেকে তুললেন; কিন্তু ভার্জিনিয়ার কোনো সংবাদ সে দিতে পারল না। কোথাও কোনো সংবাদ না পেয়ে ভীষণ ক্লান্ত হয়ে তাঁরা বাড়িতে ফিরে এলেন। লন্ঠন নিয়ে গেটের কাছে ওয়াশিংটন আর দুটি যমজ ভাই তাঁদের জন্যে অপেক্ষা করছিল। ভার্জিনিয়ার কোথাও কোনো সংবাদ নেই। আবার অন্বেষণ শুরু হল; কিন্তু সব চেষ্টাই ব্যর্থ হল তাঁদের। সপষ্টই বোঝা গেল অন্তত সেই রাত্রির মতো ভার্জিনিয়াকে তাঁরা হারিয়ে ফেলেছেন। খুব দুঃখের সঙ্গে ঘোড়া দুটিকে সহিমের হাতে তুলে দিয়ে মিঃ ওটিস ছেলেদের নিয়ে পায়ে হেঁটে ঘরের ভেতরে ঢুকলেন। ঘরে এসে সবাই দেখলেন চাকররা সব ভয়ে জড়সড় হয়ে বসে রয়েছে। মিসেস ওটিস একটা সোফার ওপরে শুয়ে রয়েছেন। উদ্বেগে তিনি অস্থির হয়ে উঠেছেন। ওকটি পরিচারিকা তাঁর কপালে ও-ডি-কোলন-কোলন দিচ্ছে। মিঃ ওটিস মুখে কিছু দেওয়ার জন্যে তাঁকে বারবার অনুরোধ করে আর সকলের জন্যে ডিনার তৈরি করতে নির্দেশদিলেন। খুবই দুঃখের সঙ্গেই আহারপর্ব সমাধা হল তাঁদের। খাওয়ার সময় কেউ কোনো কথা বলল না। খাওয়ার শেষ হওয়ার পরে সকলের অনুরোধ উপেক্ষা করেই সবাইকে তিনি ঘুমাতে যাওয়ার হুকুম দিলেন। যে হেতু তাঁদের দিক থেকে করণীয় কিছু নেই সেই হেতু তিনি ঠিক করলেন একজন ডিটেকটিভকে পাঠিয়ে দেওয়ার জন্যে। পরের দিন সকালেই তিনি স্কটল্যানড ইয়ার্ডে টেলিফোন করবেন। ডাইনিং রুম থেকে বেরিয়ে আসার সমঘে গম্বুজের ঘড়িতে বারোটা। বাজার শব্দ হল; আর বারোটার শেষ ঘন্টাটি পড়ার সঙ্গে-সঙ্গে হাঠৎ যেন কিছু একটা ভেঙে পড়ে যাওয়ার শব্দ এল; সেই সঙ্গে শোনা গেল অকস্মাৎ তীব্র একটা আর্তনাদ। ভয়ঙ্কর বজুপাতে কেঁপে উঠল বাডি, অপার্থিব সঙ্গীতের একটা সুর ছড়িয়ে পড়ল বাতাসে, বিকট শব্দে সিড়িঁর মাথার ওপরে একটা কাঠের তক্তা ভেঙে পড়ল; আর তারই ভেতর থেকে বেরিয়ে এল বিবর্ণ মুখে ভার্জিনিয়া। তার হাতে একটা ছোটো বাক্স। মুহূর্তের মধ্যে সবাই তার দিকে ছুটে গেলেন। মিসে ওটিস দু’হাতে জড়িয়ে ধরলেন তাকে, ডিউক তাকে চুম্বনে চুম্বনে অস্থির করে তুলল; আর সকলকে ঘিরে যমজ ভাই দুটি উন্মাদের মতো নাচতে শুরু করল।
সকলের সঙ্গে ভার্জিনিয়া এতক্ষণ রসিকতা করছিল এই মনে করে মিঃ ওটিস রাগ করে বললেন–হা ঈশ্বর! এতইড্রণ তুমি কোথায় ছিলে? আমরা তোমার খোঁজে সারা দেশটা ঘুরে বেডালমা তোমার মা তো ভয়ে আধমরা হয়ে গিয়েছেন। আর কোলোদনি এইরকম বাস্তব ঠাট্টা তুমি করবে না বলে দিচ্ছি।
নাচতে-নাচতে যমজ ভাই দুটি বলল–অবশ্য এক ভূতের ওপরে ছাড়া।
ভার্জিনিয়া শান্তভাবে বলল–বাবা, আমি ভূতটির কাছেই এতক্ষণ ছিলাম। সে মারা গিয়েছে। তোমরা তাকে দেখবে চলা সে সত্যিই বড়ো পাপ করে ছিল। তার জন্যে সে অনুতপ্ত হয়েছে। মারা যাওয়ার আগে সে আমাকে এই সব মণিমুক্তো দিয়ে গিয়েছে।
তার সেই গম্ভীর থমথমে ভাব দেখে সবাই তার দিকে বিস্মিত দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন। ঘুরে দাঁড়িয়ে সে তাঁদের ভাঙা দেওয়ালের ভেতর দিয়ে সরু একটা গোপন বারান্দায় নিয়ে এল। বাতি জ্বালিয়ে ওয়াশিংটন তাঁদের পিছু পিছু চলতে লাগল। অবশেষে তাঁরা একটি ওক কাঠের বিরাট দরজার সামনে উপস্থিত হলেন। সেই দরজার গায়ে মরচে-পড়া পেরেক গাঁথা রয়েছে। ভার্জিনিয়া তার গায়ে হাত দিতেই সেটা হাট হয়ে খুলে গেল। তাঁরা একটা চোরা কুঠরির মধ্যে হাজির হলেন। এর ছাদ নীচু। একটা মাত্র ভারি দেওয়া ছোটো ঘনালা সেই ঘরে রয়েছে দেওয়ালের সঙ্গে গাঁথা রয়েছে বিরাট একটা লোহার বালা। তার সঙ্গে শেকল দিয়ে বাঁধা একটা শীর্ণ কঙ্কাল। মেঝের ওপরে লম্বা হয়ে শুয়ে রয়েছে কঙ্কালটি। তার কাছ থেকে একটু দূরে নাগালের বাইরে একটা পুরনো খাবারের পাত্র আর কলসি বসানো। দেখে মনে হল কঙ্কালটি তার শীর্ণ হাত দিয়ে সেই দুটি পাত্রকে ধরার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করছে। ওই কলসিতে সম্ভবত একদিন জল ছিল। সেই জলের সবুজ দাগ এখনো তার ভেতরে লেগে ছিল। ভার্জিনিয়া সেই কঙ্কালের সামনে হাঁটু মুড়ে বসে হাত দুটি জড়ো করে নিঃশব্দে প্রার্থনা করল। বাকি সবাই সেই করুণ ঘটনাটির দিকে স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলেন। এই ঘটনাটি তখনো পর্যন্ত অনাবিষ্কৃতই ছিল।
ওই কুঠরিটা বাড়ির কোন অংশে তা জানার জন্যে যমজ ভাই দুটি এতক্ষণ জানালা দিয়ে। বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিল। তাদের মধ্যে একজন হঠাৎ চিৎকার করে উঠল–দেখ, দেখ ওই শুকনো বাদাম গাছে ফুল ফুটেছে। এখান থেকে আমি তা স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছি।
দাঁড়িয়ে উঠল ভার্জিনিযা। তার মুখের ওপরে ছড়িয়ে পড়ল একটি স্বর্গীয় দ্যুতি। সে বলল–ঈশ্বর ওঁকে ক্ষমা করেছেন।
ডিউক চেঁচিয়ে বলল–তুমি একজন দেবকুমারী ভার্জিনিয়া।
এই বলে ভার্জিনিয়াকে জড়িয়ে ধরে সে তাকে চুমু খেল।
এই অদ্ভুত ঘটনার চারদিন পরে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার আয়োজন হল। শবযাত্রা শুরু হল ক্যানটারভিলে চেস থেকে রাত্রি প্রায় এগারোটার সময়। আটটি কালো ঘোড়া শবাধারটিকে টেনে নিয়ে গেলা ঘোড়ার মাথায় ছিল উটপাখির পালকের নিশান। সীসের কফিনের ওপরে ঢাকা ছিল লাল কাপড়ের একটা আবরণ; তার ওপরে আঁকা ছিল ক্যানটারভিলে কোর্ট-অফ-আর্মস। শবাধারবাহী গাড়ির আশেপাশে মশাল জ্বালিয়ে চলছিল। চাকর-বাকরদের দল। সমস্ত শোভাযাত্রাটিই বেশ জাঁকজমকপূর্ণ ছিল। প্রধান শোককর্তা। ছিলেন লর্ড ক্যানটারভিলে। ওযেলস থেকে বিশেষ করে এই শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ। করতেই তিনি এসেছিলেন। ভার্জিনিয়ার সঙ্গে তিনি বলেছিলেন প্রথম গাড়িটিতে। তারপরে ছিলেন সস্ত্রীক যুক্তরাষ্ট্রের মন্ত্রী, তারপরে ওয়াশিংটন তিনটি ছেলে তারপরে। সকলের শেষে ছিলেন মিসেস উমনে। তাঁর জীবনের পঞ্চাশটি বছর ভূতটি তাঁকে বিব্রত করেছিল বলেই তিনি যে তার শেষকৃত্যটা দেখবেন এটা ধরে নেওয়া যেতে পারে। গির্জার এক কোণে বৃদ্ধ একটি ইউ গাছের তলায় গভীর গর্ত খোঁড়া হল। রেভা, আগস্টাস ডামপির বেশ গম্ভীর। পরিবেশের মধ্যে প্রার্থনার পদগুলি পড়লেন। অনুষ্ঠান শেষ হলে ক্যানটারভিলে বংশের প্রথা অনুযায়ী চাকররা তাদের মশালগুলি নিবিয়ে দিল। কফিনটাকে মাটির তলায় নামানোর সময় ভার্জিনিয়া এগিয়ে গিয়ে সাদা আর ফিকে রঙের বাদামের ফুল দিয়ে তৈরি করা বড়ো একটা ক্রুশ তার ওপরে রাখলে মেঘ কেটে গিয়ে আকাশে চাঁদ উঠল আর সেই ছোটো গির্জার কবরখানাতে ছড়িয়ে দিল রুপোর আলো। দূর থেকে গান করতে লাগল একটি নাইটিংগেল পাখি।
পরের দিন সকালে লর্ড ক্যানটারভিলে শহরে ফিরে যাওয়ার আগে ভূতটি ভার্জিনিয়াকে যে মুক্তোর বাক্সটি দিয়েছে সে সম্বন্ধে মিঃ ওটিস তাঁর সঙ্গে আলোচনা করতে বসলেন। মুক্তোর। গ্যগুলি ষোড়শ শতাব্দীর; মূল্য আর শিল্পকলার দিক থেকে সেগুলি অনবদ্য। তাই সেগুলি গ্রহণ করতে মিঃ ওটিসের বিবেকে লাগছিল। তিনি বললেন–মি লর্ড, এদেশে দানপত্রের সঙ্গে ডামি আর ছোটোখাটো অলঙ্কার দেওয়ার প্রথা রয়েছে। আর এটা আমার কাছে খুবই পরিষ্কার যে ওই সব অলঙ্কারগুলিই নীতিগতভাবে উত্তরাধিকারসূত্রে আপনারই বংশের প্রাপ্য। সেই জন্যে বিশেষ একটি অজ্ঞাত পরিস্থিতিতে আবিষ্কৃত ওই রত্নগুলি সঙ্গে নিয়ে লন্ডনে যেতে আপনাকে আমি অনুরোধ করছি। আমার মেয়ের কথা যদি বলেন তাহলে বলব ও হচ্ছে বাচ্চা। তাছাড়া, ওই রকম অলঙ্কার নিয়ে, অলস বিলাসিতায় জীবন কাটাতেও সে অভ্যস্ত বা উৎসুক নয। মিসেস ওটিসের আর্টের বিষয়ে যথেষ্ট অভিজ্ঞতা রয়েছে। কারণ বাল্য বযসে কয়েকটি শীত তিনি বেস্টলে কাটিয়েছিলেন। তিনি আমাকে বলেছেন যে ওই । অলঙ্কারগুলি বিক্রি করলে অনেক দাম পাওয়া যাবে। এই সব কারণে লর্ড ক্যানটারভিলে, আপনি বেশ বুঝতে পারছেন ওইগুলি আমার পরিবারে কেন রাখতে আমি রাজি হচ্ছি নে। আর সত্যি কথা বলতে কি এই সব মূল্যবান জমকালো অলঙ্কার ব্রিটিশ অভিজাত সম্প্রদাযের কাছে যতই গৌরবজনক বলে মনে হোক না কেন আমাদের মতো যারা। রিপাবলিকানের সাধারণ আর অমর নীতিতে মানুষ হয়ে উঠেছে তাদের কাছে ওদের কোনো দাম নেই। অবশ্য একথাটা আমি উল্লেখ করতে চাই যে আপনার হতভাগ্য আর বিপতগামী। পূর্বপুরুষের স্মৃতিচিহ্ন হিসাবে ওই বাক্সটি নিজের কাছে রাখতে পারলে ভার্জিনিয়া খুশি হবে বাক্সটা অতি পুরাতন আর সেই সঙ্গে সংস্কারের বাইরে চলে গিয়েছে বলেই আমার ধারণা। আমার অনুরোধ রাখাটা আপনার কাছে কষ্টকর হবে না। আমার কথা যদি বলেন তাহলে একথা বলতে আমি বাধ্য যে আমার কোনো সন্তানের মধ্যযুগীয় কোনো জিনিসের ওপরে যে। আকর্ষণ রয়েছে তা জানতে পেরে আমি সত্যিই বিস্মিত হয়েছি। এর একমাত্র কারণ সম্ভবত এই যে মিসেস ওটিস এথেন্স থেকে ফেরার পথে লন্ডনের একটি শহরতলিতে দিন কতক যখন অবস্থান করছিলেন সেই সময়েই ওর জন্ম হয়েছিল।
এই সম্মানিত মন্ত্রীর কথাগুলি বেশ গম্ভীরভাবেই মুচকি-মুচকি হাসতে-হাসতে লর্ড ক্যানটারভিলে শুনছিলেন। মন্ত্রী মহোদয়ের কথা শেষ হওয়ার পরে তিনি বেশ হৃদ্যতার সঙ্গে তাঁর করমর্দন করে বললেন–প্রিয় স্যার, আপনার সুন্দরী কন্যা আমার হতভাগ্য পূর্বপুরুষ স্যার সাইমনের যথেষ্ট উপকার করেছে। সেদিক থেকে তার এই সাহসের জন্যে আমি এবং আমার বংশের সকলেই তার কাছে কৃতজ্ঞ। ওই অলঙ্কারগুলি ন্যায়ত তারই প্রাপ্য। তাছাড়া, হৃদযহীলের মতো ওই অলঙ্কারগুলি আমি যদি তার কাছ থেকে নিয়ে চলে যাই তাহলে আমায় বিশ্বাস সেই দুষ্ট বৃদ্ধটি এক পক্ষের মধ্যেই তার কবরখানা থেকে উঠে আমার। একেবারে প্রাণান্ত করে ছেড়ে দেবো উত্তরাধিকারের কথা যদি বলেন তাহলে বলতে পারি যে উইল-এ যা লেখা নেই তা কখনো উত্তরাধিকারীর প্রাপ্য নয়। ওই বব্লগুলির অস্তিত্ব আমরা কেউ জানতাম না। সেদিক থেকে বিচার করলে ওই রত্নগুলির ওপরে আমার যদি কোনো অধিকার থাকে, তাহলে আপনার হেড বাবুটিরও সেই একই অধিকার রয়েছে। তাছাড়া, মিঃ ওটিস আপনি হয়তো ভুলে যাচ্ছেন যে সভূত বাড়িটাকেই আপনি কিনেছিলেন; সুতরাং ভূতের যদি কোনো সম্পত্তি থেকে থাকে সে-সম্পত্তিও আপনারই। কারণ স্যার সাইমন রাত্রিতে বারান্দার ওপরে ঘুরে বেড়ালেও, আইনের দিক থেকে তিনি মৃত, এবং দাম দিয়েই আপনি তাঁর সম্পত্তি কেনে নিয়েছিলেন।
লর্ড ক্যানটারভাইলের এবম্বিধ প্রত্যাখ্যানে মিঃ ওটিস খুবই মর্মাহত হলেন, তাঁর মতটা পুনর্বিবেচনা করার জন্যে অনুরোধও আর একবার তাঁকে করলেন, কিন্তু সৎ-বুদ্ধিসম্পন্ন লর্ড তাঁর মতে অবিচল হয়ে রইলেন। ভূতের সম্পত্তি রেখে দেওয়া ছাড়া মিঃ ওটিসের আর কোনো উপায় রইল না।
১৮৯০ সালের বসন্তকালে যখন চেশায়ারের যুবতী ডাচেসের বিবাহ উপলক্ষে তাকে রানির প্রথম ড্রয়িংরুমে নিয়ে যাওয়া হল তখন সবাই তার অলঙ্কারগুলি দেখে একেবারে ধন্য-ধন্য করে উঠল। ভার্জিনিয়া আর যুবক ডিউকের বিয়েতে সবাই আনন্দিত হল; কারণ এমন রাজযোটক মিল নাকি সহজে কারও চোখে পড়ে না। খুশি হলেন না কেবল ডাম্বলটনের মারশনেস। ভদ্রমহিলার সাতটি অবিবাহিতা কন্যা ছিল। তাদের একটিকে ডিউকের ঘাড়ে চাপানোর জন্যে তিন তিন বার বেশ মোটা খরচ করে ডিনার পার্টি দিয়েছিলেন আর সবচেয়ে আশ্চর্যের ঘটনা হচ্ছে সেই পার্টিতে মিঃ ওটিসকেও তিনি নিমন্ত্রণ করেছিলেন। মিঃ ওটিস ডিউককে খুবই পছন্দ করতেন; কিন্তু নীতিগতভাবে তার ওই খেতাবটি তাঁর কাছে ছিল বড়োই অবান্তর। কিন্তু আপত্তি শেষ পর্যন্ত তাঁর ধোপে টেকেনি। আমার মনে হয় বর আর বধূ হাত ধরাধরি করে যখন সেন্ট জর্জ গির্জার বেদির কাছে ঘুরছিল তখন ইংলন্ডের মধ্যে মিঃ ওটিসের মতো গর্বিত মানুষ আর কেউ ছিল না।
বিবাহ বাসর উদযাপন করে ডিউক আর ডাচেস ক্যানটারভিলে চেস-এ যেদিন ফিরে এল তার পরের দিন বিকেলের দিকে তারা হাঁটতে হাঁটতে পাইনবনে ঘেরা নির্জন সমাধির কাছে হাজির হল। স্যার সাইমনের সমাধি ফলকটি খুঁজে বার করতে তাদের কষ্ট হয়েছিল যথেষ্ট। ডাচেস সঙ্গে নিয়ে এসেছিল কয়েকটি সুন্দর গোলাপ। সেইগুলি সে সমাধির ওপরে ছড়িয়ে দিল। কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে তারা ধ্বংসপ্রায় সমাধিগুলির চারপাশে ঘুরে বেড়াতে লাগল। সেইখানে একটি ভাঙা স্তম্ভের ধারে ডাচেস বসে পড়ল, সিগারেট খেতে-খেতে ডিউক তার পায়ের কাছে বসে তার সুন্দর চোখ দুটির দিকে রইল তাকিয়ে। ডিউক হঠাৎ তার সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেলে ডাচেসের হাতটা ধরে বলল–ভার্জিনিয়া, কোনো স্ত্রীর তার স্বামীর কাছ থেকে কিছু লুকিয়ে রাখা উচিত নয়।
প্রিয় সিসিল, আমি তো কিছু লুকিয়ে রাখিনি।
ডিউক হেসে বলল–রেখেছ। ভূতের সঙ্গে ঘরের মধ্যে থাকার সময় তোমার কী কথা হয়েছিল সেকথা তো বলনি।
ভার্জিনিয়া গম্ভীরভাবে বলল–সেকথা আমি কাউকে বলিনি।
আমি তা জানি; কিন্তু আমাকে বলতে পার।
দয়া করে আমাকে তা বলতে বলো না, সিসিল। আমি তা বলতে পারব না। হতভাগ্য স্যার সাইমন! তাঁর কাছে আমি সত্যিই বড়ো ঋণী। হেসো না, সত্যিই বলছি ঋণী। তাঁর কাছ থেকেই আমি বুঝতে পরেছি জীবন কী জিনিস, মৃত্যু বলতে কী বোঝায়; আর প্রেম ওদের চেয়ে কেন মহত্তর।
ডিউক উঠে তার স্ত্রীকে চুমু খেল।
তোমার ওই হৃদয়টা যতক্ষণ আমার থাকবে ততক্ষণ ওই কথাটা তুমি গোপন করেই রেখ।
আমার হৃদয় চিরকাল তোমারই থাকবে, সিসিল।
আমাদের সন্তানদের সেই কথাটা একদিন তুমি বলবে–বলবে না?
লজ্জায় ভার্জিনিয়ার মুখটা লাল হয়ে উঠল।
Post a Comment