বন্ধ ঘরের রহস্য – আর্থার কোনান ডয়েল
ওকালতি আমার পেশা, কিন্তু অ্যাথলেটিক্স আমার নেশা। দশটা-পাঁচটা চার দেওয়ালের মধ্যে ব্যস্ত থাকার পর শারীরিক কসরত করার সময় পাই কেবল সন্ধেবেলায়। অফিসপাড়ার বদ্ধ পরিবেশ থেকে বেরিয়ে যখন হ্যাম্পস্টেড বা হাইগেটের দিকে একটু উঁচু জায়গায় রাতের দিকে হাঁটতে যাই, তখন মুক্ত হাওয়া সেবনে শরীর মন দুই-ই তাজা হয়ে ওঠে। এইরকমই এক সন্ধেবেলা নিরুদ্দেশ-ভ্রমণে আমার সঙ্গে ফেলিক্স স্ট্যানফোর্ডের প্রথম আলাপ হয়, আর এই আলাপ থেকেই আমার জীবনের সবচেয়ে রহস্যময় অভিজ্ঞতার আস্বাদ পাই।
মাসটা ছিল এপ্রিল বা মে, সাল ১৮৯৪। সেদিন হাঁটতে হাঁটতে চলে গেছি লন্ডনের প্রায় উত্তরসীমানায়। রাস্তার দুদিকে গাছের সারি আর বাংলো বাড়ি। বসন্তকালের মনোরম সন্ধ্যা-আকাশ পরিষ্কার, চাঁদের আলোয় সবকিছুই সুন্দর লাগছিল। আমি তখন বহু মাইল হেঁটে ধীরেসুস্থে চারিদিক দেখতে-দেখতে ফেরা শুরু করেছি। এক মনে হাঁটছি–হঠাৎ একটা বাড়ির দিকে আমার নজর গেল।
বাড়িটা বেশ বড়–রাস্তা থেকে একটু পেছিয়ে–সামনে বেশ কিছুটা ফাঁকা জমি। এমনিতে বাড়িটা আধুনিক ঢঙে বানানো কিন্তু আশপাশের বাড়ির তুলনায় জলুসহীন। রাস্তার ধারের বাড়িগুলো সবই একলাইনে দাঁড়িয়ে–শুধু এই বাড়িটার সামনের জায়গাটুকু খালি থাকায় বাড়িটাকে একটু বেখাপ্পা লাগছিল। নিশ্চয়ই কোনও বড়লোক ব্যবসায়ীর বাগানবাড়ি ছিল এটা–শহর হয়তো তখনও এতদূর এসে পৌঁছয়নি। ধীরে-ধীরে লন্ডন শহরের লাল ইটের বাড়ির অক্টোপাস এই অঞ্চলটুকুকেও গ্রাস করেছে। আরও কিছুদিনে হয়তো সেই অক্টোপাস বাড়িটার সামনের ফাঁকা জমিটুকুও হজম করে নেবে, আর এখানে মাথা তুলবে বছরে আশি পাউন্ড ভাড়ার একডজন ছোট-ছোট বাড়ি। আমি যখন এইসব ভাবছি তখন হঠাৎ-ই একটি ঘটনা আমার মনকে অন্যদিকে ঘোরাল।
ঘোড়ায় টানা চারচাকার একটা নড়বড়ে গাড়ি কাঁচকোচ আওয়াজ করতে করতে দ্রুতবেগে ছুটে আসছিল, আর উলটোদিকে দেখা যাচ্ছিল একটা সাইকেলের মলিন আলো। চাঁদের আলোয় ভেসে যাওয়া এই লম্বা রাস্তায় মাত্র দুটি বাহনই চলমান অবস্থায় ছিল। কিন্তু তবুও যেমন আটলান্টিকে অনেকসময় দুটো জাহাজে ধাক্কা লাগে, ঠিক তেমনই আশ্চর্য নিপুণতায় গাড়িটার সঙ্গে সাইকেলের লাগাল ধাক্কা। দোষটা সাইকেল আরোহীরই। গাড়ির সামনে দিয়েই সে রাস্তা পার হতে গিয়েছিল, হিসেবে ভুল করে ঘোড়র ধাক্কায় ছিটকে পড়ল রাস্তায়। উঠে দাঁড়িয়ে দাঁত খিঁচিয়ে সে তেড়ে গেল গাড়োয়ানের দিকে। তবে গাড়োয়ানও তাকে বেশ দু-চার কথা শুনিয়ে দিল। এই কথাকাটাকাটির ফাঁকে সাইকেল আরোহী ঘোড়ার গাড়ির নম্বরটা টুকে নিতে ভুলে গেল আর সেটা বুঝতে পেরেই গাড়োয়ান জোরে গাড়ি হাঁকিয়ে পিঠটান গেল। সাইকেল আরোহী পড়ে থাকা সাইকেলটা তুলতে গিয়ে হঠাৎ-ই বসে পড়ল আর যন্ত্রণায় অস্ফুটস্বরে আর্তনাদ করে উঠল। আমি ছুটে ওর কাছে গিয়ে জিগ্যেস করলাম, খুব লেগেছে?
মনে হচ্ছে, গোড়ালিটা মচকে গেছে–খুব ব্যথা। আপনার হাতটা একটু বাড়ান–ধরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করি, ও বলল।
সাইকেলের ম্লান আলোয় ওকে দাঁড় করাতে গিয়ে দেখলাম ভদ্রঘরের ছেলে। বয়স বেশি নয়। ছোট কালো গোঁফ আছে। চোখদুটি বড় বাদামি রঙের, ভাঙা চোয়াল আর একটু নার্ভাস দেখতে। স্বাস্থ্য বিশেষ ভালো নয়। হয় পরিশ্রম নয় দুশ্চিন্তার ছাপ পড়েছে ওর ফ্যাকাশে মুখে। আমি ওর হাত ধরে টানতেই উঠে দাঁড়াল, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে একটা পা মাটি থেকে তুলে নিল। ওই পা-টা নাড়াতে গেলেই যন্ত্রণার আওয়াজ করছিল।
পা-টা মাটিতে ফেলতে পারছি না। বলল ও।
তুমি বয়সে অনেক ছোট। তোমাকে আর আপনি বলছি না। কোথায় থাকো।
এই তো, এই বাড়িতেই, বলে মাথা নেড়ে ওই বড়, অন্ধকার বাড়িটার দিকে দেখাল।
রাস্তা পার হয়ে বাড়ির গেটে ঢোকার সময়েই হতভাগা ঘোড়ার গাড়িটা ধাক্কা মারল। আমায় একটু বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দেবেন?
সহজেই তা করা গেল। প্রথমে ওর সাইকেলটা গেটের ভেতরে রাখলাম। তারপর ওকে ধরে কম্পাউন্ডের ড্রাইভ দিয়ে নিয়ে গিয়ে হলঘরের দরজার সামনে পৌঁছলাম। কোথাও একটুও আলো নেই–অন্ধকার। নৈঃশব্দের জন্য মনে হচ্ছিল, এই বাড়িতে কেউ কোনওদিন থাকেনি।
ঠিক আছে অনেক ধন্যবাদ, বলে ও দরজার তলায় চাবি লাগানোর চেষ্টা করল।
আমি বললাম, দাঁড়াও, আমি তোমাকে ঠিকমত ঘরের ভেতর পৌঁছে দিই।
ও মৃদু আপত্তি জানালেও এটা বুঝতে পারল যে, আমাকে ছাড়া ওর চলবে না।
দরজাটা খুলতেই ঘুটঘুঁটে অন্ধকারে ঢাকা হলঘর। ও একদিকে হেলে গিয়ে এগিয়ে গেল। আমার হাত ওর বাহুতে। অন্ধকারে চোখ সইয়ে নিতে নিতে ও বলল, এই যে, ডানদিকের এই দরজাটা।
আমি দরজাটা খুললাম আর তক্ষুনি ও কোনওরকমে একটা দেশলাই জ্বালাল। টেবিলের ওপর একটা বাতি ছিল। দুজনে মিলে সেটা জ্বালালাম।
এখন আমি একদম ঠিক। আপনি যেতে পারেন। শুভরাত্রি, এই বলে ও একটা চেয়ারে বসল এবং প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই অজ্ঞান হয়ে গেল।
আমি একটু দ্বিধায় পড়ে গেলাম। ছেলেটিকে এভাবে ছেড়ে যাই কী করে? ওকে দেখে মনে হচ্ছিল, ও হয়তো মারাই গেছে। একটু পরে ওর ঠোঁটটা কেঁপে উঠল, বুকের একটু ওঠানামা দেখা গেল। কিন্তু ওর আধবোজা চোখদুটি একেবারে সাদা এবং ওর শরীর ফ্যাকাশে লাগছিল। আমার একার পক্ষে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন, তাই ঘণ্টা বাজানোর দড়িটায় একটা টান দিলাম আর বহুদূরে ঘণ্টা বাজার আওয়াজ শুনতে পেলাম। কিন্তু কেউ এল না। আস্তে-আস্তে ঘণ্টার আওয়াজ স্তব্ধ হয়ে গেল, অথচ কোনও মানুষের কথা বা পায়ের শব্দ শুনলাম না। একটু অপেক্ষা করে আবার ঘণ্টা বাজালাম, কিন্তু ফলের কোনও হেরফের হল না। নিশ্চয়ই কাছাকাছি কেউ আছে–এই ছেলেটি নিশ্চয়ই এত বড় বাড়িতে একা থাকে না। বাড়ির লোকদের ওর অবস্থা জানানো দরকার। তারা যদি ঘণ্টার আওয়াজে সাড়া না দেয়, আমাকেই তাদের খুঁজে বের করতে হবে। আমি বাতিটা হাতে নিয়ে তাড়াতাড়ি ঘরের বাইরে গেলাম।
যা দেখলাম, তা বিস্ময়কর। পুরো হলঘরটা খালি। সিঁড়িগুলো কার্পেটহীন ও ধুলোয় ঢাকা। দেখলাম তিনটে দরজা–তিনটে বড়-বড় ঘরে যাওয়ার। তিনটে ঘরেই কার্পেট বা পরদা নেই, ওপরে মাকড়সার জাল ও দেওয়ালে সঁাতাপড়া দাগ। নিস্তব্ধ শূন্য ঘরগুলোতে আমার পায়ের আওয়াজের প্রতিধ্বনি শুনতে পাচ্ছিলাম। তারপর ভেতরের প্যাসেজ দিয়ে রান্নাঘরের দিকে এগোলাম–ওখানে অন্তত কাউকে পাওয়া যাবে। হয়তো আশপাশের কোনও ঘরে কেয়ারটেকারকে দেখতে পাব। কিন্তু কোথাও কেউ নেই সব খালি। হতাশ হয়ে আর-একটি দালান ধরে এগোলাম কিন্তু সেখানে অন্য বিস্ময় অপেক্ষা করছিল।
দালানটা শেষ হয়েছে একটা বড় বাদামি রঙের দরজার সামনে আর দরজার চাবির ফুটোর ওপর প্রায় পাঁচ শিলিং মুদ্রার মাপের একটা লাল মোমের সিল লাগানো। সিলটা নিশ্চয়ই বহুকাল আগের, কারণ সেটি বিবর্ণ হয়ে গেছে, তার ওপরে ধুলোর পলেস্তারা। দরজার দিকে তাকিয়ে ভাবছি ঘরের ভেতর কী থাকতে পারে, এমন সময় শুনলাম কেউ ডাকছে। দৌড়ে গিয়ে দেখি ছেলেটি চেয়ারে বসে আছে। ঘরে আলো না থাকাতে ও বেশ অবাক হয়ে গেছে।
আপনি ঘরের বাতিটা নিয়ে কেন চলে গেছলেন? ও জিগ্যেস করল।
আমি লোকজন খুঁজছিলাম–তোমার সাহায্যের জন্য।
আমি এই বাড়িতে একা থাকি।
তোমার শরীর খারাপ হলে তো মুশকিল হয়ে যাবে।
হঠাৎ কেমন জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম। আসলে আমার মায়ের থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে দুর্বল হার্ট পেয়েছি। ব্যথা পেলে বা আবেগবশত এরকম হয়। মনে হয় মায়ের মতো এতেই আমার মৃত্যু হবে। আপনি কি ডাক্তার?
না, উকিল। আমার নাম ফ্রাঙ্ক অল্ডার।
আমি ফেলিক্স স্টানিফোর্ড। ভালোই হল আপনার সঙ্গে আলাপ হয়ে। আমার বন্ধু মিঃ পার্সিভাল বলছিলেন, আমাদের শিগগিরই একজন উকিল লাগবে।
বেশ তো।
সেটা অবশ্য মিঃ পার্সিভালের ওপর নির্ভর করছে। আচ্ছা, আপনি বাতি হাতে বাড়ির পুরো একতলাটা ঘুরে এলেন?
হ্যাঁ।
পুরোটা? ও বেশ জোর দিয়ে জিগ্যেস করল আর তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আমার দিকে।
তাই তো মনে হল। আশা করেছিলাম কাউকে-না কাউকে পাবই।
সবকটা ঘরে ঢুকেছিলেন কি? তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে আবার প্রশ্ন।
যে কটায় ঢুকতে পেরেছিলাম।
ও! তাহলে তো আপনি দেখেই ফেলেছেন! এই বলে ও কাধটা ঝাঁকাল, ভাবটা এমন যে যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে।
কী দেখে ফেলেছি?
ওই সিল করা দরজাটা।
হ্যাঁ, দেখেছি।
ভেতরে কী আছে, জানতে ইচ্ছে করেনি, আপনার?
ব্যাপারটা একটু অদ্ভুত লেগেছিল।
আচ্ছা, মনে করুন এই বাড়িতে আপনি বছরের-পর বছর কাটিয়ে যাচ্ছেন আর ভাবছেন ওই দরজার ওপারে কী আছে, অথচ ঢুকে দেখছেন না। পারবেন এমন করে থাকতে?
কী, বলতে চাইছ তুমি? তুমি জানো না ওই ঘরে কী আছে?
আপনি যতটা জানেন, আমিও ঠিক ততটাই জানি।
তাহলে দরজা খুলে দেখছ না কেন?
উপায় নেই, বলল ও।
ওর কথাবার্তায় একটা বিব্রত ভাব ছিল। হয়তো কোনও স্পর্শকাতর জায়গায় অজান্তে ঘা দিয়ে ফেলেছি। এমনিতে আমার সাধারণ শোকের মতো অহেতুক কৌতূহল কম, কিন্তু এখানের যা ব্যাপার, তাতে আমার কৌতূহল তীব্র হয়ে উঠেছে। যা হোক, এ-বাড়িতে আর বেশিক্ষণ থাকার কোনও অজুহাত আপাতত নেই, কেন না ছেলেটি প্রায় সুস্থ হয়ে উঠেছে, আমি তাই উঠে পড়লাম।
আপনার কি তাড়া আছে, ও জিগ্যেস করল।
না। আমার এখন এমন কিছু কাজ নেই।
তাহলে খানিকক্ষণ থাকুন না আমার সঙ্গে। আসলে একেবারে একা থাকি, কাজকর্মও কিছু নেই। লন্ডনে হয়তো এমন কোনও লোক পাবেন না যে আমার মতো জীবন কাটায়। কারও সঙ্গে কথাবার্তা বলার সুযোগও তো পাই না।
আমি ছোট ঘরটির চারিদিক দেখলাম। সাজানো-গোছানো বিশেষ নয়–একটা সোফা-কাম-বেড একদিকে রাখা। মাথায় ঘুরছে এই বিশাল শূন্য বাড়িটা আর বিশেষজ্ঞ ওই সিল লাগানো রহস্যময় দরজাটা। প্রায় অপ্রাকৃত একটা পরিবেশ। ইচ্ছে করছিল, আরও একটু খোঁজখবর নিই। হয়তো আর খানিকক্ষণ থাকলেই জানতে পারব আরও কিছু। ওকে বললাম যে, আমার কিছুক্ষণ থাকতে ভালোই লাগবে।
ও বলল, “দেখুন, সাইড টেবিলে ড্রিংকসের ব্যবস্থা আছে। আমি তো হাঁটতে পারছি না, সুতরাং হেল্প ইয়োরসেলফ। আর ট্রেতে চুরুট রাখা আছে। আমিও একটু চুরুট খাব। এবার বলুন–আপনি তো উকিল। মিঃ অলডার?”
হ্যাঁ।
আর আমি কিছুই নই। পৃথিবীর চেয়ে অসহায় জীব আমি। লাখপতির সন্তান। বিশাল সম্পদ আমার আমার অধিকারে আসবে, এই আশায় বড় হয়েছি। আর দেখুন আজ আমি কী– কপর্দকহীন, সম্পূর্ণ বেকার। ভাগ্যের কী পরিহাস–আমি এই বিশাল বাড়ির মালিক, যে-বাড়ি ঠিকমতো রাখার সামর্থ্যও আমার নেই। ছোট এক চিলতে জমি গাধার বদলে ঘোড়া দিয়ে চাষ করানোর মতো হয়তো একটা কুঁড়েঘরই আমার পক্ষে যথেষ্ট।
তাহলে বাড়িটা বিক্রি করে দিচ্ছ না কেন?
সম্ভব নয়।
তা হলে ভাড়ায় দিয়ে দাও।
তারও উপায় নেই।
আমার অবাক ভাব দেখে ও হাসল : দাঁড়ান, আপনাকে পুরো ব্যপারটা বুঝিয়ে বলি–অবশ্য যদি আপনার শুনতে ভালো লাগে।
না-না, তুমি বলো।
আসলে আপনি আজ আমার যে-উপকারটা করলেন, তার সামান্য প্রতিদান হিসাবে অন্তত আপনার কৌতূহলটুকু তো মেটাতে পারি। আপনি হয়তো আমার বাবার নাম শুনে থাকবেন, বিখ্যাত ব্যাংকার স্ট্যানিলস স্ট্যানিফোর্ড।
ব্যাংকার স্ট্যানিফোর্ডের নাম সঙ্গে-সঙ্গে আমার মনে পড়ল।
বছরসাতেক আগে হঠাৎ করে তার দেশ ছেড়ে চলে যাওয়া নিয়ে অনেক কেচ্ছা কেলেংকারি রটেছিল।
বুঝতে পারছি আমার বাবার কথা আপনার মনে পড়েছে। বাবা তার বেশ কিছু বন্ধুর টাকা ফাটকায় লাগিয়েছিলেন। সেই টাকা ডুবে যাওয়ায় বন্ধুদের এড়াতে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান।
খুব নরমস্বভাবের সংবেদনশীল মানুষ ছিলেন বাবা, বন্ধুদের প্রতি দায়বদ্ধতার জন্য তিনি ভীষণ বিচলিত হয়েছিলেন, আইনত তিনি কোনও অপরাধ করেননি। কিন্তু পুরো ব্যাপারটায় তিনি এত মর্মাহত হয়েছিলেন যে, নিজের পরিবারের লোকেদেরও মুখ দেখাতে চাননি। পরে তিনি বিদেশ বিভূঁইয়ে মারা যান–কোথায় মারা যান তা-ও আমরা জানি না।
তোমার বাবা মারা গেছেন!
আমার কাছে বাবার মৃত্যুর কোনও প্রমাণ নেই। কিন্তু ফাটকায় লগ্নী করা সেই টাকা আবার উদ্ধার হয়েছে। বেঁচে থাকলে উনি নিশ্চয়ই সসম্মানে ফিরে আসতেন। কিন্তু মনে হয় গত দু-বছরের মধ্যে কোনও একসময় তার মৃত্যু হয়েছে।
গত দু-বছরের মধ্যে কেন?
কেন-না দু-বছর আগেও তাঁর চিঠি পেয়েছি।
চিঠিতে উনি ওঁর ঠিকানা জানাননি?
চিঠিটা এসেছিল প্যারিস থেকে–কিন্তু কোনও ঠিকানা ছিল না। ওই সময়েই আমার মা মারা যান। তখনই বাবার চিঠিটা এসেছিল–আমাকে কিছু উপদেশ আর কিছু নির্দেশ দিয়েছিলেন। তারপর থেকে আর কোনও খবর নেই।
তার আগে কখনও বাবার খবর পেয়েছিলে?
হ্যাঁ এবং সিল লাগানো দরজার রহস্যের শুরু তখনই। টেবিলটা একটু আমার দিকে ঠেলে দিন।
এখানেই আমার বাবার চিঠিগুলো রাখা আছে। মিঃ পার্সিভাল ছাড়া আপনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি এই চিঠিগুলো দেখছেন।
কিছু মনে কোরো না, মিঃ পার্সিভাল কে?
উনি ছিলেন বাবার একান্ত সচিব এবং প্রথমে মায়ের ও পরে আমার বন্ধু এবং উপদেষ্টা। মিঃ পার্সিভাল না থাকলে আমাদের যে কী অবস্থা হত, তা ভাবতেও পারি না। উনি ছাড়া বাবার চিঠিগুলো আর কেউ দেখেনি। এই দেখুন প্রথম চিঠি সাত বছর আগে লেখা। দেশ ছাড়ার দিন। নিজেই পড়ে নিন। চিঠিটা ফেলিক্সের মাকে লেখা:
তোমাকে আমার ব্যাবসার ব্যাপারে কখনও কিছু বলিনি, কেন না ডঃ উইলিয়ম আমায় বলেছিলেন তোমার হার্ট খুব দুর্বল। কোনওরকম উত্তেজনা তোমার পক্ষে বিশেষ ক্ষতিকারক হবে। কিন্তু এখন পরিস্থিতি এমন যে, তোমাকে বলতে বাধ্য হচ্ছি।
আমার ব্যাবসার অবস্থা খুব খারাপ। এই কারণে আমি কিছুদিনের জন্যে তোমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছি। তবে অবশ্যই যত শীঘ্র সম্ভব চলে আসব। আমাদের এই বিচ্ছেদ অতি অল্প সময়ের জন্য। সুতরাং এ নিয়ে ভেবে তুমি শরীর খারাপ কোরো না।
আমার একটা বিশেষ অনুরোধ আছে। চেষ্টা কোরো কোনওমতেই যেন এই অনুরোধ পালনে কোনও অন্যথা না হয়। লনে যাওয়ার প্যাসেজে আমার যে ডার্করুমটা আছে, যেখানে আমার ফোটোগ্রাফির কাজ করি, সে-ঘরে এমন কিছু জিনিস আছে যেগুলি আমি গোপন রাখতে চাই। তবে সেগুলির সঙ্গে কিন্তু কলঙ্কজনক কিছু জড়িয়ে নেই। তা সত্ত্বেও আমি চাই তুমি বা ফেলিক্স অবশ্যই আমার এই অনুরোধ রাখবে। ফেলিক্সের বয়েস যখন একুশ বছর হবে, তখন ও ওই ঘরে ঢুকতে পারে, তা আগে নয়।
এখন তোমার কাছ থেকে বিদায় নিই। আমার এই অল্পদিনের অনুপস্থিতিতে যে কোনও ব্যাপারে পরামর্শ নিতে গেলে মিঃ পার্সিভলের সঙ্গে যোগাযোগ কোরো। ওঁর ওপর আমার অগাধ আস্থা। তোমাকে আর ফেলিক্সকে এভাবে ছেড়ে যেতে খুব খারাপ লাগছে–কিন্তু বিশ্বাস করো, আমি নিরুপায়।
ইতি–
তোমার স্ট্যানিসলস
৪ঠা জুন, ১৮৮৭
আমার চিঠি পরা শেষ হলে ফেলিক্স খানিকটা কৈফিয়ত দেওয়ার সুরে বলল, আমাদের এই পারিবারিক ব্যাপার আলোচনা করে হয়তো আপনার সময় নষ্ট করলাম। ধরে নিন, আপনি সবকিছু একজন ল’ইয়ার হিসেবে শুনলেন। অনেক বছর ধরে কাউকে এই কথাগুলো বলতে চাইছিলাম।
আমাকে বিশ্বাস করে এত কিছু বললে এতেই আমি খুশি। তা ছাড়া পুরো ব্যাপারটা বেশ কৌতূহল জাগায়।
জানেন, আমার বাবার সত্যের প্রতি আকর্ষণ ছিল এমনই যে, মাঝে-মাঝে সেটা প্রায় মানসিক রোগের পর্যায়ে চলে যেত। কখনও তিনি মিথ্যেকথা বলতেন না। সুতরাং তিনি যখন বলেছিলেন যে, মায়ের সঙ্গে শিগগিরই আবার দেখা করবেন এবং ডার্করুমে কোনও কলঙ্কজনক ব্যাপার নেই, বাবা নিশ্চয়ই সত্যি কথাই বলছিলেন।
তাহলে ওই ঘরে কী থাকতে পারে?
সেটা আমার বা মায়ের কল্পনার বাইরে। আমরা বাবার কথায় আমরা দরজায় সিল লাগিয়ে দিয়েছিলাম। এবং সেই সিল এখনও লাগানো। বাবার অন্তর্ধানের পর মা বছরপাঁচেক বেঁচে ছিলেন। যদিও ডাক্তাররা ভেবেছিলেন যে, মা বেশিদিন বাঁচবেন না। মায়ের হার্টের অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গেছল। বাবার যাওয়ার পর প্রথম কয়েক মাসে মাকে লেখা বাবার দুটো চিঠি এসেছিল। দুটোই প্যারিস থেকে পোস্ট করা, কিন্তু কোনও ঠিকানা নেই। দুটো চিঠিই ছিল ছোট বক্তব্য একই? চিন্তা কোরো না, শিগগির দেখা হবে। এর পরে মায়ের মৃত্যু পর্যন্ত আর কোনও চিঠি আসেনি। তারপরে আমাকে একটা চিঠি লিখেছিলেন তার বক্তব্য এতই ব্যক্তিগত যে, চিঠিটা আপনাকে দেখাতে পারছি না। চিঠিতে মোটামুটি বলেছিলেন, আমি যেন তাকে খারাপ মানুষ না ভাবি। আমায় অনেক উপদেশ দিয়েছিলেন। এ-ও বলেছিলেন যে, মায়ের মৃত্যুর পর ওই ঘরটার দরজা বন্ধ রাখার যৌক্তিকতা অনেক কমে গেছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও আমার একুশ বছর বয়েস না হওয়া অবধি ওই ঘর না খোলাই ভালো। ঘর খুললে অত্যন্ত বেদনাদায়ক পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে। বরং অপেক্ষা করলে সময়ের প্রভাবে ওই পরিস্থিতি সামলে নেওয়া সম্ভব হবে। আর বলেছিলেন, ওই ঘরের দায়িত্ব আমার ওপর থাকল। সুতরাং বুঝতেই পারছেন, চরম দারিদ্র সত্ত্বেও এই বাড়ি আমি কেন বিক্রি করিনি বা ভাড়া দিইনি।
বন্ধক তো রাখতে পারতে!
বাবা বাড়িটা আগেই বন্ধক রেখেছেন।
পুরো পরিস্থিতিটাই অদ্ভুত।
আমি আর আমার মা এতকাল আসবাবপত্র বিক্রি করে চালিয়েছি। চাকরবাকরদের একে-একে বিদায় করা হয়েছে। আপাতত, আমি এই একটা ঘরেই থাকি–আমাকে দেখাশোনা করারও কেউ নেই। তবে আর মাত্র দু-মাস অপেক্ষা করতে হবে।
তার মানে?
আমার একুশ বছর বয়স হতে আর দু-মাস বাকি। তার পরেই প্রথম কাজ ওই ঘরের দরজাটা খোলা, আর দ্বিতীয় কাজ বাড়িটা বিক্রি করে দেওয়া।
আচ্ছা, ফাটকায় লাগানো টাকা যখন উদ্ধার হয়েই গেছল, তখন তোমার বাবা ফিরে এলেন না কেন?
বাবা নিশ্চয়ই ততদিনে গত হয়েছিলেন।
আচ্ছা, তুমি বললে দেশ ছেড়ে যাওয়ার আগে তোমার বাবা আইনত দণ্ডনীয় কোনও অপরাধ করেননি।
হ্যাঁ।
তাহলে তোমার মাকে সঙ্গে নিয়ে যাননি কেন? জানি না।
নিজের ঠিকানা গোপন করার কারণ কী হতে পারে?
তা-ও বলা কঠিন।
মা মারা গেলেন, তাঁর শেষকৃত্যও হয়ে গেল–তবুও তোমার বাবা কেন ফিরে এলেন না?
জানি না। দ্যাখো, একজন পেশাদার উকিল হিসেবে তোমাকে এটুকু বলতে পারি যে, তোমার বাবার দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পেছনে অবশ্যই কোনও গুরুতর কারণ ছিল। যদিও তার বিরুদ্ধে কোনও অপরাধের প্রমাণ ছিল না। তিনি হয়তো জানতেন কোনও প্রমাণ পাওয়া গেলে ব্যাপারটা থানা-আদালত অবধি গড়াতে পারে। সুতরাং তিনি দেশের বাইরে চলে যাওয়াই সমীচীন মনে করেন। এ ছাড়া তো আর কোনও যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা পাচ্ছি না।
ফেলিক্স স্বভাবতই একটু ক্ষুণ্ণ হল। আমায় ঠান্ডা গলায় বলল, আপনি আমার বাবাকে চিনতেন না। যখন আমাদের ছেড়ে যান, তখন আমি খুবই ছোট। কিন্তু বিশ্বাস করুন, বাবাই আমার আদর্শ। বাবার দোষ ছিল একটাই, তিনি একটু স্পর্শকাতর মানুষ ছিলেন। আর নিজের স্বার্থ নিয়ে কখনও ভাবেননি। তার মাধ্যমে কারুর আর্থিক ক্ষতির কথা তিনি ভাবতেই পারতেন না। তাঁর আত্মসম্মানবোধও ছিল অত্যন্ত প্রখর। সুতরাং তার অন্তর্ধানের কারণ খুঁজতে গিয়ে তার এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলো ভুলে গেলে চলবে না।
কিছু মনে কোরো না আমি তো বাইরের লোক, একটা নিরপেক্ষ মত দিলাম, এই মাত্র। যাক্, এবার উঠি, অনেকটা হাঁটতে হবে এখন। সমস্ত ঘটনাটা এমনই যে, এর শেষটুকু জানার কৌতূহল থাকবে।
আপনার কার্ডটা রেখে যান, বলল ফেলিক্স।
কার্ড রেখে শুভ রাত্রি জানিয়ে রওনা দিলাম।
বেশ কিছুকাল আর কোনও খবর পেলাম না।
হঠাৎ একদিন দুপুরে আমার অফিসে বেয়ারা একটা কার্ড দিয়ে গেল–একজন মিঃ জে, এইচ, পার্সিভাল আমার সঙ্গে দেখা করতে চান। একটু পরেই ঘরে ঢুকলেন তিনি–বয়েস বছর পঞ্চাশেক, ছোটখাটো চেহারা। চোখদুটো কিন্তু উজ্জ্বল।
ফেলিক্স স্ট্যানিফোর্ডের কাছে আমার নাম নিশ্চয়ই শুনে থাকবেন, উনি বললেন।
অবশ্যই। আমার মনে আছে, বললাম।
ফেলিক্স আপনাকে ওর বাবার অন্তর্ধান এবং একটা সিল করা ঘরের কথা বলে থাকবে।
হ্যাঁ।
তা হলে আপনি নিশ্চয় জানেন যে, ফেলিক্সের একুশ বছর বয়েস হলে ওই ঘরটা খোলার অনুমতি দিয়েছিলেন ওর বাবা।
জানি।
আজই ফেলিক্সের বয়স একুশ হল।
ঘরটা খুলেছেন? উৎসাহের সঙ্গে জিগ্যেস করলাম।
এখনও খুলিনি, গম্ভীরভাবে বললেন মিঃ পার্সিভাল।
আমার মনে হয় দরজাটা ভোলা সময় একজন সাক্ষী উপস্থিত থাকা দরকার। আপনি সাক্ষী হিসাবে থাকতে রাজি?
সানন্দে।
দিনের বেলা আপনি আর আমি দুজনেই ব্যস্ত। রাত নটায় যদি আমরা ওই বাড়িতে পৌঁছই?
নিশ্চয়ই আসব।
ওই কথাই রইল। আমরা আপনার জন্য অপেক্ষা করব, এই বলে মিঃ পার্সিভাল বিদায় নিলেন।
রাতে পৌঁছলাম ওই বাড়িতে। ফেলিক্সের ছোট ঘরটিতে ওরা দুজনে আমার অপেক্ষায় বসেছিলেন। ফেলিক্সকে স্বাভাবিকভাবেই বেশ নার্ভাস লাগছিল। কিন্তু মিঃ পার্সিভালের বিশেষ উত্তেজিত ভাব দেখে অস্বাভাবিক লাগল, ওঁর মুখ লালচে। হাতগুলো অস্থিরভাবে নড়াচড়া করছে।
ফেলিক্স আমাকে দেখে বিশেষ খুশি হয়ে ধন্যবাদ জানাল। তার পরেই সে বলল পার্সিভালকে, আর দেরি করে কী লাভ? চলুন, যা হওয়ার তাড়াতাড়ি হয়ে যাক।
পার্সিভাল বাতিটা হাতে নিয়ে আগে চললেন। কিন্তু দরজাটার কাছে পৌঁছনোর আগেই প্যাসেজে দাঁড়িয়ে পড়লেন। ওঁর হাত এত কঁপছিল যে, বাতির আলোর ছায়া দেওয়ালে ওঠানামা করছিল।
একটু ভাঙা গলায় পার্সিভাল বললেন, মিঃ স্ট্যানিফোর্ড, আপনি মন শক্ত করুন। সিল ভেঙে দরজা খোলার পর যাতে কোনও মানসিক আঘাত না পান।
কী থাকতে পারে ওই ঘরে, পার্সিভাল? আপনি কি বলছেন আমি ভয় পাব?
না, মিঃ স্ট্যানিফোর্ড। কিন্তু আমাদের তৈরি থাকা দরকার…মন শক্ত করা চাই..আপনার যাতে কিছু পার্সিভাল শুকনো ঠোঁট ভিজিয়ে অতিকষ্টে টুকরো-টুকরো কথাগুলি বলছিলেন। তখনও আমি স্পষ্ট বুঝলাম যে, পার্সিভাল জানেন ওই ঘরে কী আছে এবং যা আছে তা ভয়ানক, বীভৎস।
মিঃ স্ট্যানিফোর্ড, এই নিন চাবি। কিন্তু আমার সতর্কবাণী মনে রাখবেন, বললেন পার্সিভাল।
পার্সিভালের হাত থেকে চাবির গোছাটা ফেলিক্স ছিনিয়ে নিল। তারপর বিবর্ণ সিলটির নীচে একটা ছুরি ঢুকিয়ে এক ঝটকায় সিলটি উঠিয়ে ফেলল। বাতিটা পার্সিভালের হাতে কাঁপছে, তাই আমি বাতিটা আমার হাতে নিয়ে চাবির ফুটোর ওপর আলো ফেললাম। আর ফেলিক্স একটার-পর-একটা চাবি দিয়ে দরজাটা খোলার চেষ্টা করতে লাগল।
হঠাৎ একটা চাবি লেগে গেল আর দরজাটা এক ধাক্কায় খুলে গেল। আর তার পরেই ফেলিক্স ঘরের ভেতরে এক পা গিয়েই একটা আর্তচিৎকার করে জ্ঞান হারিয়ে আমাদের পায়ের কাছে পড়ে গেল।
আমিও যদি পার্সিলের সতর্কবাণী না শুনতাম বা ভয়াবহ কিছু সহ্য করার জন্য তৈরি না থাকতাম, বাতিটা হয়তো আমার হাত থেকে পড়ে যেত। ঘরটায় কোনও জানালা বা আসবাবপত্র নেই। একটা ফটোগ্রাফিক ল্যাবরেটরির মতো সাজানো-একপাশে একটা সিংক ও তাতে একটা কল লাগানো। একটা তাকে কিছু শিশি বোতল রাখা। এবং ঘরের মধ্যে তীব্র, অস্বস্তিকর একটা গন্ধ কিছুটা কেমিক্যালের, কিছুটা জান্তব। আমাদের সামনে একটা টেবিল ও চেয়ার রাখা আছে। আমাদের দিকে পেছন ফিরে একজন ওই চেয়ারে বসে কিছু যেন লিখছে। মানুষটির দেহরেখা ও ভঙ্গী একদম জীবন্ত মানুষের মতো, কিন্তু তার ওপর আলো পড়তেই আতঙ্কে আমার মাথার চুল খাড়া হয়ে গেল। লোকটির ঘাড় আমার কবজির মতো সরু। ঘাড়ের চামড়া কোঁচকানো কালো। তার শরীরের ওপর ধুলোর পুরু প্রলেপ-ঘন, হলদেটে ধুলো। চুল, কাধ, হলদে কুঁচকে যাওয়া হাত–সবেতেই ধুলোর প্রলেপ। মাথাটি ঝুঁকে বুকের ওপর। তার কলমটি একটি বিবর্ণ কাগজের ওপর পড়ে আছে।
হায়! মিঃ স্ট্যানিফোর্ড, আমার মালিক! পার্সিভাল এই বলে কেঁদে উঠলেন এবং তাঁর চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল।
ইনিই মিঃ স্ট্যানিস স্ট্যানিফোর্ড! আমি অবাক বিস্ময়ে বললাম।
এইখানে উনি সাতবছর বসে আছেন–সাত-সাতটি বছর। কেন এমন করলেন উনি? কত অনুরোধ করেছি, পায়ে ধরেছি–তা-ও আমার কথা শোনেননি। দেখুন টেবিলে একটা চাবি পড়ে আছে। ভেতর থেকে দরজায় চাবি লাগিয়ে দিয়েছিলেন। ওই দেখুন, কিছু লিখে রেখেছেন। ওটা দেখতে হবে।
হ্যাঁ, ওই কাগজটা নিয়ে নিন আর, ভগবানের দোহাই, এই ঘর থেকে বেরিয়ে আসুন, আমি বললাম। এই ঘরের হাওয়া বিষাক্ত। আসুন, স্ট্যানিফোর্ড, বেরিয়ে আসুন! আতঙ্ক বিহ্বল ফেলিক্স স্ট্যানিফোর্ডের দু-হাত দুজনে ধরে ওকে কিছুটা টানতে টানতে, কিছুটা বয়ে নিয়ে আমরা ওর ঘরে চলে এলাম।
জ্ঞান ফিরে এলে ফেলিক্স বলল, উনিই আমার বাবা। মৃত অবস্থায় চেয়ারে বসে! পার্সিভাল, আপনি নিশ্চয় সবকিছু জানতেন। তাই আপনি ওই ঘরে ঢোকার আগে আমাকে সতর্ক করেছিলেন।
হ্যাঁ, মিঃ স্ট্যানিফোর্ড, আমি জানতাম। আমি ভালো ভেবেই সবকিছু করেছি। কিন্তু আমার অবস্থাটা একটু বিবেচনা করে দেখুন–সাত বছর ধরে আমি জানি আপনার বাবা ওই ঘরে মরে পড়ে আছেন!
আপনি সবকিছু জেনেও আমাদের কিছু বলেননি!
আমার ওপর রাগ করবেন না, মিঃ স্ট্যানিফোর্ড। আবার বলি, এই ঘটনায় আমার ভূমিকাই সবচেয়ে কঠিন ছিল।
আমার মাথা ঘুরছে। কিছুই বুঝতে পারছি না! এই বলে ফেলিক্স টলতে টলতে গিয়ে বোতল থেকে খানিকটা ব্র্যান্ডি খেল ও আমার মাকে ও আমাকে লেখা বাবার চিঠিগুলো কি তা হলে জাল?
না। চিঠিগুলো আপনার বাবাই লিখেছিলেন এবং আপনাদের ঠিকানাও ওঁরই হাতে লেখা। আমাকে ওগুলো দিয়েছিলেন ডাকবাক্সে ফেলার জন্য। আপনার বাবা আমার মালিক ছিলেন। এবং কর্মচারী হিসেবে তাঁর আদেশ আমি অক্ষরে-অক্ষরে পালন করেছি।
ততক্ষণে ব্র্যান্ডির প্রভাবে ফেলিক্স একটু সুস্থ হয়েছে। ও বলল, এবার বলুন। হয়তো এখন সহ্য করতে পারব।
মিঃ স্ট্যানিফোর্ড, আপনি তো জানেন একটা সময়ে আপনার বাবা বিশেষ বিপদে পড়েন। উনি ভেবেছিলেন, অনেকের কষ্টার্জিত সঞ্চয় ওঁর গাফিলতির ফলে ডুবতে বসেছে। তখন উনি আত্মহত্যা করার সিদ্ধান্ত নেন। মিঃ স্ট্যানিফোর্ড, আপনি ভাবতেও পারবেন না আপনার বাবার এই সিদ্ধান্ত বদলানোর জন্য আমি কী না করেছি–অনুরোধ, উপরোধ, জবরদস্তি। কিন্তু তিনি মনস্থির করে ফেলেছিলেন। আমাকে শুধু বলেছিলেন যে, ওঁর মৃত্যুটা সহজ না বেদনাদায়ক হবে, সেটা নির্ভর করছে আমার ওপর। আমি বুঝতে পেরেছিলাম ওঁর কথার নড়চড় হবে না। শেষপর্যন্ত আমাকে মেনেই নিতে হয় ওঁর অনুরোধ, আর ওঁর কথামতো সবকিছু করতে রাজি হলাম।।
ওঁর চিন্তার কারণ ছিল একটাই। লন্ডনের ডাক্তার ওঁকে বলে দিয়েছিলেন। ওঁর স্ত্রীর হৃদযন্ত্র খুবই দুর্বল এবং সামান্য মানসিক আঘাতেই তা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। স্বামী হিসাবে উনি এমন কিছু করতে চাননি যাতে স্ত্রীর মৃত্যু হয়। এদিকে নিজের জীবনও তার কাছে দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল। কী করে স্ত্রীর কোনওরকম ক্ষতি না করে নিজের জীবন শেষ করা যায়, এই ছিল তার লক্ষ্য।
আপনি এখন নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন উনি কী রাস্তা নিয়েছিলেন। আপনার মা যে চিঠি পান, সেটা আপনার বাবারই লেখা। চিঠিতে যা লেখা ছিল, তা সবই সত্য। উনি লিখেছিলেন যে, আপনার মায়ের সঙ্গে শিগগিরই ওঁর দেখা হবে। তার মানে উনি কয়েক মাসের মধ্যেই আপনার মায়ের মৃত্যুর সম্ভাবনার ইঙ্গিত করছিলেন। আপনার মায়ের আসন্ন মৃত্যু সম্বন্ধে উনি এত নিশ্চিত ছিলেন যে, আপনার মাকে দুটো মাত্র চিঠি লিখে যানকিছুদিনের ব্যবধান রেখে পাঠানোর জন্য। কিন্তু আপনার মা পাঁচ বছর বেঁচে ছিলেন আর তাকে পাঠানোর জন্য আর কোনও চিঠি ছিল না।
আপনার বাবা আর-একটা চিঠি লিখে গেছলেন, যেটা আপনার মায়ের মৃত্যুর পর আপনাকে পাঠাতে বলেছিলেন। এই তিনটে চিঠিই আমি প্যারিসে গিয়ে ডাকবাক্সে ফেলি, যাতে সকলেই নিঃসন্দেহ হয় যে, আপনার বাবা বিদেশে আছেন। উনি আমাকে বলে গেছলেন কাউকে কিছু না জানাতে, তাই আমি চুপ করে থেকেছি। আমি তার বিশ্বস্ত কর্মচারী ছিলাম। উনি ভেবেছিলেন, সাত বছর পরে ওঁর মৃত্যুর খবর পেলে ওঁর বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন শোকটা অনেক সহজেই সামলে নেবে। উনি সর্বদা আর সবাইয়ের সুযোগ সুবিধে ভেবে কাজ করতেন।
আমরা চুপচাপ এতক্ষণ পার্সিভালের কথা শুনছিলাম। নৈঃশব্দ ভেঙে প্রথম কথা বলল ফেলিক্স, আপনার কোনও দোষ নেই, পার্সিভাল। আপনি আমার মাকে মানসিক আঘাত থেকে রক্ষা করেছেন, এবং তাই উনি আর কটা বছর বেঁচে ছিলেন। ওই কাগজটা কী?
আপনার বাবার মৃত্যুর সময়ে এইটাই লিখছিলেন। পড়ে শোনাব?
পড়ুন।
বিষটা খেয়েছি এবং বুঝতে পারছি তা আমার শিরায়-শিরায় ছড়িয়ে পড়ছে। অনুভূতিটা অদ্ভুত। কিন্তু কোনও যন্ত্রণা নেই। আমার ইচ্ছা অনুযায়ী যদি সবকিছু করা হয়, তা হলে এই লেখা যখন কেউ পড়বে, ততদিনে আমার মৃত্যুর পর কয়েক বছর কেটে যাবে। আমার কাছে যারা লগ্নীর জন্য টাকা দিয়েছিল, তারা এতদিনে নিশ্চয়ই আমার প্রতি তাদের বিরুপতা ভুলে গিয়ে থাকবে। আর, ফেলিক্স, তুমিও এই পারিবারিক কলঙ্কের জন্য আমায় ক্ষমা কোরো। ঈশ্বর আমার এই ক্লান্ত আত্মাকে বিশ্রাম দিন।
আমরা তিনজনেই একসঙ্গে বলে উঠলাম তাই হোক।
Post a Comment